Magic Lanthon

               

মাসুদ পারভেজ

প্রকাশিত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

কাহিনির খোঁজে

মাসুদ পারভেজ

‘সময়ের প্রয়োজনে’ অনেক নতুন কিছুর সঙ্গে মানুষ পরিচিত হয়, খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে এবং একসময় অভ্যস্ত হয়ে যায়। এই সব বিষয় নিয়ে তখন কিংবা আরো পরে একটি কাহিনি তৈরি হয়। হতে পারে সেটা মুখে মুখে প্রচলিত কিংবা অন্যভাবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব কাহিনি একটা মিথেরও জন্ম দেয়। প্রত্যেকটা কাহিনির একটা নিজস্ব পটভূমি থাকে কিংবা থাকে একটা আবহ ।যেমন বলা যায়, মানুষ একসময় সভ্যতার আলো পায়নি, তারা বনজঙ্গলে বাস করত, কাঁচা মাংস আর ফলমূল খেয়ে জীবন কাটাতো; তারা পাথরের গায়ে আঁকিবুঁকি করতো। আর এই সব আঁকিবুঁকি থেকে পরবর্তীকালে বিভিন্ন রকম ইতিহাস আর সভ্যতার খোঁজ পাওয়া যায়। সেই সব আঁকিবুঁকিতে থাকে বাইসন শিকারের দৃশ্য, ছয় পায়ের বাইসন, কিংবা আরো পরে আগুনে শিকার ঝলসানোর কারবার। সভ্যতার ইতিহাসের বাইরে এসব তো এক একটা কাহিনি, যে কাহিনি ঘুম না আসা কোনো এক চন্দ্ররাতে দাদা-নাতিকে কিংবা নানা-নাতিকে শোনায়। তখন দাদা কিংবা নানার এই গল্প করার দৃশ্য থেকে আমরা যে কাহিনির খোঁজ পাই, তা-ই আমাদের পরিবার কাঠামোর কাহিনি। আর সেটা আমাদের যৌথ পরিবারকে নির্দেশ করে।

খোঁজ করলে তখন দেখা যায়, বাংলার যৌথ পরিবারে বাস করার কাহিনি খুব বেশি অতীত নয়। ধীরে ধীরে নগরায়ণ আর শহরায়ণের প্রভাবে জীবন জীবিকার তাগিদে যৌথ পরিবার ভাঙতে থাকে। বিচ্ছিন্ন হতে থাকে সামাজিক আর পারিবারিক বন্ধন। ফলে সেই সব চন্দ্ররাতের কাহিনি শোনার যে প্রেক্ষাপট তা আর বর্তমানের পরিবারগুলোতে দেখা যায় না। ফলে ওই রাতগুলো নিজেই একটা কাহিনি হয়ে যায়। এভাবে খোঁজ করলে দেখা যায়, প্রত্যেকটা বিষয় কিংবা ঘটনার একটা কাহিনি থাকে, যেমন থাকে চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে। পূর্ণদৈর্ঘ্যের একটা চলচ্চিত্রের মধ্যে যে কাহিনি থাকে, সেই কাহিনি ধরেই চলচ্চিত্রে দৃশ্যের পর দৃশ্য আসে।

২.

চলচ্চিত্র শুরুর আগে যে নাম পরিচিতি দেখানো হয়, তাতে বিভিন্ন নামের সঙ্গে পর্দায় ভেসে ওঠে কাহিনি, সংলাপ, চিত্রনাট্য রচয়িতার নাম। তার মানে, প্রতিটি চলচ্চিত্রেই কাহিনি থাকে, সেটা যতো বিমূর্তই হোক না কেনো। তাই বলা যায়, চলচ্চিত্রে কাহিনি একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। যেকোনো ঘটনার যেমন একটা বয়ান থাকে, চলচ্চিত্রের কাহিনিরও তেমন বয়ান থাকে। সেই বয়ান কখনো চলে বর্ণনাত্মক ঢঙে, কখনো ফ্ল্যাশব্যাকে, আবার কখনো ঘটনার ভিতর ঘটনার পরম্পরা তৈরির মধ্য দিয়ে। সবই করা হয় কাহিনির প্রয়োজনে। চলচ্চিত্রে কাহিনির প্রয়োজন আসে কীভাবে সেটা একটা প্রশ্ন। ১৮৯৫ সালে লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় যে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, সেখানে আছে একটি ট্রেন আসার দৃশ্য। এরপর যতোদিন গেছে চলচ্চিত্রের অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। এই পাল্টানোর ইতিহাসে আছে মানব সভ্যতার বিবর্তন আর প্রযুক্তির বিকাশ।

মানব সভ্যতার বিবর্তনে বড়ো ঘটনা—দুইটি বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে পরিচয়। এই যুদ্ধ পৃথিবীতে যে ক্ষত তৈরি করে এবং এর ফলে মানব মনে যে প্রভাব পড়ে তা সাহিত্য ও শিল্পের অন্যান্য শাখার মতো চলচ্চিত্রতেও উঠে আসে। সে হিসেবে চলচ্চিত্রের প্রকারান্তরে বেশকিছু ধারার চলচ্চিত্রও দেখা যায়। আর এই ধারার ব্যাপারটা কিন্তু চলচ্চিত্রের কাহিনিকে প্রভাবিত করে। যেমন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে ইতালিতে নিওরিয়ালিজম ধারার যেসব চলচ্চিত্র তৈরি হয়, তার কাহিনিকে সেই বাস্তবতার আদলেই সাজানো হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে লা স্ত্রাদা চলচ্চিত্রটির কথা বলা যায়। অর্থাৎ ঘটনা কিংবা সময় চলচ্চিত্রের কাহিনিতে একটা প্রভাব রাখে।

আমাদের দেশীয় চলচ্চিত্রের কাহিনির ক্ষেত্রে তেমনটি হওয়ার একটা বড়ো সুযোগ ছিলো। যেখানে দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ,স্বাধীনতা পরবর্তী অবক্ষয়, মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবন, গ্রামীণ জীবনের পট পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয় জনজীবনকে প্রভাবিত করেছে। সুযোগ ছিলো এই অর্থে যে, এসব রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও তেমন উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের কাহিনির খোঁজ পাওয়া যায়নি।

৩.

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কাহিনির খোঁজ করতে হলে পিছনের কিছু বিষয়ের দিকে মাথা ফেরানো দরকার। যেখানে বায়োস্কোপ আর পটচিত্রের নাগাল মেলে। হাটবাজার, মেলা কিংবা পাড়ায় পাড়ায় বায়োস্কোপ দেখানোর সময় বায়োস্কোপওয়ালা সুরে সুরে একটা কাহিনি বলতে থাকেন। তার বর্ণিত এই কাহিনিতে বায়োস্কোপের ভিতরের দৃশ্যগুলোর পরিচয় উঠে আসে। যখন বায়োস্কোপওয়ালা বলেন—কী চমৎকার দেখা গেলো ... অর্থাৎ বায়োস্কোপওয়ালা যে কাহিনি বলছেন, সেটা ওই সব দৃশ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দর্শক নিজ মনে একটা কাহিনি বানিয়ে ফেলে। আবার এই সব দর্শক বায়োস্কোপ দেখা শেষ করে যখন অন্যকে এই সব দৃশ্য সম্পর্কে বয়ান করে, তখন একটা কাহিনি তৈরি করে।

পটচিত্রের ছবিতে একটা ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায়। এই ধারাবাহিকতা না থাকলে কাহিনির পর্যায়ক্রম নষ্ট হতো, অর্থাৎ কাহিনি তৈরি হতো না। কারণ পটচিত্রে ঘটনার ঘনঘটার ক্ষেত্রে চিত্র দিয়ে যেভাবে দৃশ্য নির্দেশ করা হয়, সেখানে কাহিনি নির্মাণ হয়।

কাহিনির বিষয়ে আরেকটু খোঁজ করে দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দিরে দৃষ্টি দেওয়া যাক। দেখা যাবে, মন্দিরের দেয়ালে পোড়ামাটির যে ফলক, সেগুলো রামায়ণ, মহাভারতসহ বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত। আর এই ফলকগুলো কালানুক্রমিকভাবে তিনতলা মন্দিরটিতে বসানো আছে। অর্থাৎ মন্দিরে পোড়ামাটির যে ফলকচিত্র, সেগুলোর ধারাবাহিক বয়ানে একটা কাহিনি উঠে আসবে। এই কাহিনি ইতিহাস আর মিথকে আবদ্ধ করেছে।

এই সব বিষয় ধরে বলা যায়, প্রতিটি অঞ্চলের মানুষের একটা নিজস্ব কাহিনি থাকে। আর এটা তৈরি হয় ওই অঞ্চলের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে। তাই যখন কোনো নির্দিষ্ট ভাষিক অঞ্চলের চলচ্চিত্র দেখা হয়, তখন ওই বিষয়গুলো সেই অঞ্চলের ক্ষেত্রে প্রকট হয়ে ধরা দেয়। আর এসব দেখে বলা যায় কিংবা নির্ধারণ করা যায় সেই অঞ্চলের চলচ্চিত্রের বৈশিষ্ট্য। তখন বলা হয়ে থাকে—এটা ইরানি চলচ্চিত্র, এটা জাপানি, এটা রাশিয়ান, এটা আফ্রিকান, এটা লাতিন, এটা কোরিয়ান চলচ্চিত্র ইত্যাদি।

৪.

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বলতে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরবর্তী সময় থেকে ধরা হয়। সেই হিসাবে বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র আবদুল জব্বার খানের মুখ মুখোশ (১৯৫৬)। মুখ মুখোশ-এর কাহিনি থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বাংলা চলচ্চিত্রের কাহিনির যে বিকাশ, সেটা গবেষণার বিষয় হয়ে উঠতে পারে। মুখ মুখোশ-এর কাহিনি-এক জোতদার বাবার দুই সন্তানের ঘটনাক্রমে পুলিশ আর ডাকাত হওয়া এবং শেষাংশে বাবার কাছে দুই ভাইয়ের ফিরে আসার মধ্য দিয়ে শেষ হয়। মজার ব্যাপার হলো, এই শুরুর চোর-ডাকাত-পুলিশ নিয়ে বাংলাদেশে অসংখ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। অবশ্য সেটা হতেই পারে। কারণ ডাকাতির ঘটনা এই অঞ্চলে অনেক আগে থেকেই প্রচলিত।

শুধু ধনসম্পত্তি নয়, ছোটো বাচ্চা ডাকাতির ঘটনাও রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে— ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’য় ছয় মাসের শিশুকন্যা মহুয়া সুন্দরীকে হুমরা ডাকাতের ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা বর্ণনা হয়েছে। যদি চলচ্চিত্রের কাহিনি এই রকম ডাকাতির ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নেওয়া হয়, তো সেটা নেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু কাহিনির মধ্যে তো বৈচিত্র্য থাকতে হবে। সেটা কিন্তু হয়নি। যে কারণে এমন অনেক চলচ্চিত্রে দেখা গেছে, গ্রামের মেলায়, রেল স্টেশনে কিংবা অন্য কোনোভাবে সন্তান বাবা-মার কাছ থেকে হারিয়ে গেছে। তারপর সেই সন্তানের সঙ্গে বাবা-মার কোনো পরিচয় থাকেনি। চলচ্চিত্রের শেষে দেখা যায়, তারা হারিয়ে যাওয়ার আগে পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠানে একটা গান গেয়েছিলো, আর সেই গানের মোটিফ ধরে আবার তাদের মিলন হয়। মাঝখানে হতে পারে সেই হারিয়ে যাওয়া সন্তানের কেউ চোর-ডাকাত-গুণ্ডা হয়েছে কিংবা খলনায়কের ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসী হয়েছে। আর তাদের বাবা হয়তো কোনো সৎ পুলিশ কর্মকর্তা, না হয় কোনো বিচারক।

মুখ মুখোশ-এর হারিয়ে যাওয়া ভাইয়ের একজন ডাকাত, আরেকজন পুলিশ। বুঝতে কষ্ট হয় না, পুলিশ আর ডাকাতের সাক্ষাৎ হবেই হবে। তো হুমরা ডাকাত যে শিশুকন্যা মহুয়াকে নিয়ে গেলো, এমন অসংখ্য ঘটনা চলচ্চিত্রে দেখা যায়। যেখানে খলনায়ক শিশুকে চুরি করে তার মতো সন্ত্রাসী হিসেবে বড়ো করে তোলে। একসময় জানা যায়, সেই হারিয়ে যাওয়া সন্তানের আসল পরিচয়। আর ঠিক তখনই চলচ্চিত্র শেষ সময়ে হাজির। সময় গড়িয়ে যায় কিন্তু চলচ্চিত্রের কাহিনিতে কোনো পরিবর্তন আসে না।

৫.

ষাটের দশকে একের পর এক বাংলা চলচ্চিত্র ব্যর্থ হতে থাকে। নির্মাতারা ঝুঁকে পড়েন উর্দু ছবি নির্মাণের দিকে। ১৯৬২ সালে ১৬ টি নির্মাণাধীন ছবির মধ্যে ১৩টিই ছিল উর্দু ছবি। জহির রায়হানের উর্দু ছবি সঙ্গম-এর সাফল্য এ প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এর পরই বিশাল এক পালাবদলের ঘটনা ঘটে তৎকালীন ঢাকাই চলচ্চিত্রে। সালাউদ্দিন পরিচালিত রূপবান (১৯৬৫) ঢাকার চলচ্চিত্রকে নতুন পথের দিশা দেয়।‘রূপবান ছবির কাহিনীর অবাস্তবতা ও নির্মাণনৈপুণ্যের দুর্বলতা বা চিত্রায়ণের কৌশলগত ত্রুটি ঢাকা পড়ে যায় ছবিটির ব্যাপক জনপ্রিয়তার জন্য। এই জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ ছিল ছবির গল্প ও গান। রূপবান ঢাকার চলচ্চিত্রকে নিশ্চিত ভরাডুবির হাত থেকে রক্ষা করে’।

রূপবান যে গল্প আর গান নিয়ে ভরাডুবির হাত থেকে বাংলা চলচ্চিত্রকে টেনে তুললো তার রেশ ছিলো সুদূরপ্রসারী। যার ধারাবাহিকতায় ১৯৮৯ সালে তোজাম্মেল হক বকুলের বেদের মেয়ে জোসনা এবং আরো পরে ২০০৯ সালে গিয়াসউদ্দিন সেলিমের মনপুরা আসে। ফোক ধাঁচের আর গ্রামীণ কাহিনি নিয়ে নির্মিত এই সব চলচ্চিত্র নির্মাণের একটা হিড়িক পড়ে। বাংলাদেশের এফ ডি সি’র চলচ্চিত্রে এটি লক্ষণীয় ব্যাপার। যখন কোনো চলচ্চিত্র ব্যবসা করে অর্থাৎ দর্শকপ্রিয়তা পায়, তখন সেই ধাঁচের চলচ্চিত্র-নির্মাণের হিড়িক পড়ে যায়। সাপ নিয়ে যে গল্প কিংবা কাহিনি গড়ে উঠেছে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তা প্রথম আসে জহির রায়হানের বেহুলার (১৯৬৬) মধ্য দিয়ে। বেদের মেয়ে জোসনার দর্শকপ্রিয়তা কিংবা বেহুলার নির্মাণ এই অঞ্চলে সাপ বিষয়ক যে পুরাণ প্রচলিত আছে তারই একটি দিক। ‘মনসামঙ্গল’ কাব্য যা বহন করে চলছে।

এই বিষয়ে আবারও বলা যায়, কাহিনি নির্মাণের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক ইতিহাস একটা বড়ো বিষয়। আর সেক্ষেত্রে নদীবিধৌত এই অঞ্চলে চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্য নিয়ে, কিংবা সাপ নিয়ে চলচ্চিত্রের কাহিনি নির্মাণ হতেই পারে। কিন্তু কাহিনিতে বিচিত্রতার অভাবটা দারুণভাবে ধরা দেয়। ফলে বেদের মেয়ে জোসনার পর ওই ধাঁচের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরির চেষ্টা করলেও তেমন সাফল্য কিংবা সাড়া কোনোটাই মেলেনি। নাগ নাগিনীর প্রেম, কাল নাগিনীর প্রেম, রাঙা বাইদানী, নয়া বাইদানী ইত্যাদি চলচ্চিত্র নির্মাণ হলেও সেসব দর্শক মনে তেমন আমল পায়নি। এখানে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে ওঠে—বেদের মেয়ে জোসনার দর্শককে নিম্নবর্গীয় দর্শক হিসেবে যে বিভাজন করা হয়, সেক্ষেত্রে এই নিম্নবর্গের চৈতন্য কিন্তু অনেক প্রখরতার পরিচয় দেয়। কারণ তারা বেদের মেয়ে জোসনার পর সাপ বিষয়ক কিংবা ফোক ধাঁচের তেমন কোনো চলচ্চিত্রকে আর সাদরে গ্রহণ করেনি। অর্থাৎ নিম্নবর্গীয় দর্শকচৈতন্য প্রথমটিকেই গ্রহণ করেছে এবং এর অনুকরণে বা আদলে যা নির্মাণ হয়েছে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে।

কিন্তু কাহিনি-নির্মাতারা এই বিষয়টা বোঝেন না কিংবা তারা দর্শককে বোকা ভাবেন, ফলে একই কাহিনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখানোর ফন্দি করেন। প্রসঙ্গক্রমে হালের আলোচিত নায়ক, প্রযোজক, পরিচালক অনন্ত জলিল অভিনীত হৃদয় ভাঙ্গা ঢেউ-এর (২০১১) কথা বলা যেতে পারে। এতে একই সঙ্গে আলমগীর কবিরের সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭), হলিউডের কাস্ট অ্যাওয়ে (২০০০) ও হিন্দি কাহোনা পেয়ার হ্যায়-এর (২০০০) ভাব নেওয়া হয়েছে। হৃদয় ভাঙ্গা ঢেউ-এ নায়ক অনন্ত জলিল কারাগার থেকে পালিয়ে একটি দ্বীপে আশ্রয় নেয় আর নায়িকা বর্ষা খলনায়কের হাত থেকে ইজ্জত বাঁচাতে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে অনন্তের কাছে ভেসে আসে। তারপর নায়ক-নায়িকার প্রেম।

সীমানা পেরিয়ের কাহিনি গড়ে উঠেছে ১৯৭০ সালের জলোচ্ছ্বাসের কাহিনিকে ঘিরে। এখানে নায়ক বুলবুল আহমেদ আর নায়িকা জয়শ্রী কবির জলোচ্ছ্বাসে ভেসে এক জনমানবহীন দ্বীপে ঠাঁই পায়। তারপর একসময় তাদের প্রেম হয়। কাস্ট অ্যাওয়েতে ফেডএক্স বিমান দুর্ঘটনায় জনমানবহীন দ্বীপে আটকা পড়ে নায়ক টম হ্যাংকস। হৃত্বিক রোশন আর আমিশা প্যাটেল কাহোনা পেয়ার হ্যায়­-এ একটা দ্বীপে আটকা পড়ে এবং পরে তাদের প্রেম হয়। এই তিনটি চলচ্চিত্রেই গল্পের কাঠামো এক, তবে নায়ক-নায়িকার দ্বীপে আটকে পড়ার পিছনে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপট আছে। এবং এই তিনটি চলচ্চিত্রই হৃদয় ভাঙ্গা ঢেউয়ের আগে নির্মিত। এখন কথা হলো, ২০১১ সালে নির্মিত হৃদয় ভাঙ্গা ঢেউ­-এ পরিচালক গাজী মাজহারুল আনোয়ার ও নায়ক-প্রযোজক অনন্ত আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করেছেন সেটা ভালো কথা, কিন্তু কাহিনির ক্ষেত্রে তো ‘নতুন বোতলে পুরনো মদ’-ই ভরলেন।

চলচ্চিত্রের কাহিনিতে যদি নতুনত্ব না আসে তাহলে প্রযুক্তির ব্যবহার কি কোনো কাজ দেবে? আর ওই তিনটি চলচ্চিত্র যাদের দেখা আছে, তারা তো হৃদয় ভাঙ্গা ঢেউয়ে নতুন কিছু পাবে না। এ কারণেই কাহিনির নতুনত্ব না থাকা একটা ভয়াবহ সঙ্কট। যে সঙ্কট অভিনয়শিল্পীরাও উপলব্ধি করেন। মৌসুমী তার চলচ্চিত্র কমিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে বলেছিলেন চরিত্র আর গল্পের বৈচিত্র্যহীনতার কথা। তার ভাষায়, ‘এখন আর নায়িকা হয়ে গাছের নিচে প্রেম করা চরিত্রে অভিনয় করতে মন চায় না।’ এফ ডি সি’র চলচ্চিত্র মানেই নায়ক-নায়িকার প্রেম-ভালোবাসা-গান আর মারপিটের বাইরে কোনো গল্প নেই। যে কারণে নায়িকার বয়স একটু বেড়ে গেলেও তাকে কলেজ-পড়ুয়া শিক্ষার্থীর চরিত্রে অভিনয় করতে হয়, কলেজে নায়কের প্রেমে পড়তে হয়। এইতো ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া মন বসে না পড়ার টেবিলেতে শাবনুরকে হাইস্কুল-পড়ুয়া শিক্ষার্থীর চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়। হয়তো পরিচালকরা মনে করেন, দর্শক কিছুই বোঝে না। প্রশ্ন উঠতে পারে, থ্রি ইডিয়টস-এ আমির খান যদি কলেজ-পড়ুয়া শিক্ষার্থী হয় তাহলে শাবনুর কেনো নয়? পাঠক, এর উত্তর আপনাদের হাতেই ছেড়ে দিলাম।

৬.

আমার চলচ্চিত্রের ক্যারিয়ারের শুরুতে সৌভাগ্য হয়েছিল জহির রায়হানের সাথে কাজ করার। আমি দীর্ঘদিন তার সাথে কাহিনী লেখার কাজ করেছিলাম। তখন বুঝেছি একটি ছবি সফল করার ক্ষেত্রে ভালো ও মানসম্মত গল্প কতটা জরুরি। জহির রায়হান একটি ছবির গল্পের পেছনে প্রায় এক দেড় বছর ধরে শ্রম দিতেন। অথচ এখনকার ছবিগুলোর গল্প তৈরি হয় চার থেকে পাঁচ দিনে। কোনো দর্শক আজ  হলে গিয়ে একটি ছবি দেখছে আর কাল হলে গিয়ে আরেকটি ছবি দেখছে। এই দর্শকের কাছে মনে হবে, দুটি একই ছবি। শুধু নাম পরিবর্তন হয়েছে। আসলে তা-ই হয়েছে।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কাহিনি নিয়ে এই অভিযোগ অস্বীকার করবার উপায় নেই। এটা আগেও হয়েছে এখনো হচ্ছে। আগে স্যাটেলাইট চ্যানেল, ডিভিডি, ইন্টারনেটের প্রভাব প্রকট না হওয়ায় দর্শক হিন্দি কিংবা অন্য কোনো চলচ্চিত্র থেকে কাহিনি নেওয়ার ব্যাপারটি টের পেতো না। কিন্তু এখন সেটা দর্শক সহজেই জানতে পারে। কিছু কিছু চলচ্চিত্রের কপিরাইট কিনে তা নির্মাণ করা হয়। যেমন : কেয়ামত থেকে কেয়ামত (১৯৯৩) হিন্দি চলচ্চিত্রের কপিরাইট। কিন্তু হিন্দি অনেক চলচ্চিত্রের কাহিনি সরাসরি নকল করা হয়েছে-আমির খান আর মাধুরী অভিনীত দিল সরাসরি নকল করে বাংলাদেশে শাকিল খান-পপি অভিনয় করেন আমার ঘর আমার বেহেশত­-এ; শাহরুখ খান-ঋষি কাপুর-দিব্যা ভারতী অভিনীত দিওয়ানা নকল করে নির্মাণ হয় বিয়ের ফুল, এতে অভিনয় করেন রিয়াজ-শাকিল-শাবনুর।

আরো পরে ফেরদৌস অভিনীত হঠাৎ বৃষ্টি হিন্দি সিরফ তুম-এর নকল। তার পর রিয়াজ-পূর্ণিমা অভিনীত মনের মাঝে তুমি (২০০২) কারিনা কাপুর আর তুষার কাপুর অভিনীত জিনা সিরফ মেরে লিয়ের (২০০২) নকল। সালমান খান-ঐশ্বরিয়া অভিনীত হাম দিল দে চুকে সনম-এর কাহিনি নকল করে রিয়াজ-শাবনুরকে নিয়ে নির্মাণ করা হয় এই মন চায় যে । এছাড়াও সমসাময়িক আরো অনেক চলচ্চিত্র আছে, যা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ড্রাস্টিতে ব্যবসাসফল হয়, এর বেশিরভাগই হিন্দি চলচ্চিত্রের নকল কাহিনিতে নির্মিত। প্রায় এক যুগ আগের এসব চলচ্চিত্রের ব্যবসায়িক সফলতা কিংবা দর্শক টানার কারণ হিসেবে বলা যায়, তখন পর্যন্ত গ্রামগঞ্জে স্যাটেলাইট চ্যানেল কিংবা ডিভিডির ব্যাপকতা বর্তমানের মতো ছিলো না। ফলে বেশিরভাগ দর্শক বুঝতেই পারেনি, যে কাহিনি তারা দেখছে তা হিন্দি চলচ্চিত্র থেকে চুরি করা।

আর এই সময়ে যখন কোনো কাহিনি চুরি করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হচ্ছে, তখন দর্শক সহজেই বুঝতে পারে, এটা কোনো হিন্দি, তামিল কিংবা অন্য কোনো চলচ্চিত্র থেকে নকল করা কাহিনি। এই সহজ ব্যাপারটি বাংলাদেশের নির্মাতারা বুঝতে চান না। তার পরও তারা চুরি করা কাহিনি নিয়েই চলচ্চিত্র বানাচ্ছেন, আবার সেটাকে ব্যবসাসফল করার আশাও করছেন। এখন অনেকে সামান্য এদিক-ওদিক করে নাম পর্যন্ত নকল করছেন। তামিল রুদ্র দ্য ফায়ার-এর আদলে বাংলা চলচ্চিত্রের নাম রাখা হচ্ছে-হিরো দ্য সুপার স্টার, খোঁজ-দ্য সার্চ, দেশা দ্য লিডার ইত্যাদি।

এখন আরেকটি বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে, তা হলো বিদেশে শুটিং করার প্রবণতা। সেই ধারাতে মাহি আর আরেফিন শুভ অভিনীত অগ্নির কথা ধরা যাক। অগ্নির কাহিনি হলো—নায়িকা ছোটো থাকার সময় তার মা-বাবাকে খলনায়ক হত্যা করে। আর সেই হত্যার প্রতিশোধ নিতে নায়িকা বড়ো হয়ে থাইল্যান্ড যায় খলনায়ককে হত্যা করতে। পিতা-মাতা হত্যার প্রতিশোধের এই কাহিনি নিয়ে তো অসংখ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। তাহলে অগ্নি কেনো? আর মাহির যে অ্যাকশন তা নায়িকা দিতি লেডি ইন্সপেক্টর-এ (১৯৯৪) অনেক আগেই দেখিয়েছেন। তো ‘বিদেশে চিত্রায়িত’-এমন টাইটেল ব্যবহারে কী লাভ, যদি কাহিনি হয় ‘নতুন বোতলে পুরনো মদ’! একই কথা বলা যায় হালের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক শাকিব খান অভিনীতি চলচ্চিত্র নিয়েও। সালমানের পর মান্নার মৃত্যু, রিয়াজ-ফেরদৌসের মন্দা ছাড়াও নানাবিধ কারণে বি এফ ডি সি’র চলচ্চিত্র শাকিব-বৃত্তে বন্দি হয়ে পড়ে। মান্নার সামাজিক অ্যাকশন, রিয়াজ-ফেরদৌসের রোমান্টিক অ্যাকশন-সব চলচ্চিত্রেরই নায়ক এখন শাকিব খান। ফলে কাহিনিও ঘুরপাক খায়।

৭.

৯০-এর দশকে বাংলাদেশে শাবনাজ-নাঈম, তারপর সালমান শাহ-শাবনুর, মৌসুমী-ওমর সানি, শাকিল খান-পপি, রিয়াজ-শাবনুর-পপিকে নিয়ে যেসব চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়, তার মধ্যে ধনী-গরিবের প্রেম-ভালোবাসার কাহিনি প্রাধান্য পায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে থাকে পারিবারিক দ্বন্দ্ব। এর বাইরে মান্না, রুবেল, আমিন খান—এদের নিয়ে নির্মাণ করা হয় অ্যাকশন চলচ্চিত্র। যদিও এই অ্যাকশন চলচ্চিত্রের কাহিনিও কোনো না কোনো চলচ্চিত্রের নকল। বাংলাদেশে অ্যাকশনধর্মী কাহিনি নিয়ে প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে শহীদুল ইসলাম খোকনের লড়াকুর (১৯৮৬) নাম আসে। রংবাজ (১৯৭৩) কিংবা নসীব (১৯৮৪) অ্যাকশন ঘরানার চলচ্চিত্র হলেও পুরোপুরি মার্শাল আর্টের অ্যাকশন নিয়ে হাজির হয় লড়াকু। এর পর কাজী হায়াৎ সামাজিক-রাজনৈতিক অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্র নিয়ে হাজির হন।

কাজী হায়াৎ পরিচালিত দাঙ্গা, ত্রাস, দেশপ্রেমিক, সিপাহী, চাঁদাবাজ দর্শকপ্রিয়তা পায়। এক অর্থে বলা যায়, কাজী হায়াৎ তার চলচ্চিত্রের কাহিনিতে একটা নিজস্বতা দেখানোর চেষ্টা করেন। প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা না বলে পারছি না—বাংলাদেশে এখন যারা বিকল্পধারা কিংবা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর চলচ্চিত্রের বিদেশি পুরস্কার প্রাপ্তিতে অতি উৎসাহ প্রকাশ করে, সেক্ষেত্রে বলে রাখা দরকার—কাজী হায়াতের দাঙ্গা ১৯৯১ সালে উত্তর কোরিয়ার পিয়ংইয়ং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আফ্রো-এশিয় সরিডরি বিভাগে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার লাভ করে। কিন্তু এটা দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যায়, কারণ এটা চাষাভুসোর চলচ্চিত্র বলে কথা। আর গণমাধ্যম তো ‘ভদ্রপল্লী’র দখলে!

৮.

একটু পিছনে যাওয়া যাক, যখন বাংলা চলচ্চিত্রে রাজ্জাক, রহমান, বুলবুল, ফারুক, আলমগীর, কবরী, শবনম, শাবানা, ববিতা—এরা নায়ক-নায়িকা ছিলেন। তখনো চলচ্চিত্রের কাহিনি ধনী-গরিবের দ্বন্দ্ব, মধ্যবিত্তের সঙ্কটের মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে। সময়ের হিসাবে দর্শক সেটাকে  গ্রহণও করেছে। কিন্তু এখন দর্শক আর তা গ্রহণ করছে না। এটা সহজ কথা। সে মোতাবেক হালের মনপুরার ব্যবসা সফলতার কথা ধরলে বলা যায়, দর্শক পছন্দ করেছে তাই ব্যবসাসফল হয়েছে। কিন্তু আহামরি কোনো কাহিনি নিয়ে তো মনপুরা নির্মাণ করা হয়নি। বরং বলা যায়, ফারুক-কবরী অভিনীত সুজন সখীর মতো গ্রামীণ পটভূমি আর গান নিয়ে মনপুরা এগিয়েছে। সে মোতাবেক, দর্শক আসলে মৌলিক কাহিনি, মৌলিক গান চায়।

এবার আসা যাক, বিকল্পধারা নামে বি এফ ডি সি’র বাইরে নির্মিত চলচ্চিত্রের কাহিনি প্রসঙ্গে। এসব চলচ্চিত্রের ব্যাপারে খুব সহজেই বলা যায়, নির্মাতারা দর্শক ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ একটি বড়ো বিষয়, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র-নির্মাণে আজও তেমন কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়নি, যেখানে কাহিনিতে ঐতিহাসিক বস্তুনিষ্ঠতা আছে। নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক যেসব চলচ্চিত্র—আগামী, খেলাঘর, আমার বন্ধু রাশেদ নির্মাণ করেছেন তা-ও এই ধারার বাইরে যেতে পারেনি। এক্ষেত্রে জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়ার কাহিনিকে দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা যেতে পারে। ‘আমার সোনার বাংলা ... ৭০ সালে উনি তার জীবন থেকে নেয়া ছবিতে পিকচারাইজ করেন। ৬৯-এর গণ আন্দোলন, অসহযোগ, পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নিষ্পেষণ ...’ এসব কিছুর সমন্বয়ে তো জীবন থেকে নেয়ার কাহিনি বিস্তৃত হয়। তাহলে এখন কেনো সেরকম হয় না? মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র-নির্মাণ এখন একটা চেতনার কারসাজিতে রূপ নিয়েছে। যেহেতু সরকারি অনুদানের একটা ব্যাপার আছে। সেহেতু বিশেষ সরকারের সময়ে চলচ্চিত্র হোক আর না হোক, কাহিনি যথাযথ উঠে আসুক আর না আসুক, তার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকে জড়িয়ে দিলেই হলো! সেই সুযোগই নেন নির্মাতারা।

কথা হচ্ছিলো বিকল্পধারার চলচ্চিত্রের কাহিনি নিয়ে। প্রথমেই হাল আমলের বিদেশি পুরস্কার পাওয়া জনপ্রিয় নির্মাতা ফারুকীর চলচ্চিত্রের কাহিনি প্রসঙ্গে আসা যাক। মেড ইন বাংলাদেশ-এ জাহিদ হাসান যে বিদ্রোহী যুবকের চরিত্রে অভিনয় করেন, তা মান্নাকে দিয়ে অনেক আগেই কাজী হায়াৎ করিয়েছেন। তবে ফারাকটা হলো, মান্না গালির সঙ্গে মারামারিও করে, আর জাহিদ গালি দিয়ে মাঝে মধ্যে দু-একটা চড় মেরেছে। এ থেকে বলা যায়, ভদ্রলোকেরা মারামারি করে না, তাই তাদের চলচ্চিত্রে মারামারি দেখানো হয় না! মেড ইন বাংলাদেশ-এ স্বামী বিদেশে থাকা পাশের বাড়ির ভাবীর সঙ্গে ছাদে কথোপকথন, ব্যাচেলর-এ লিটনের ফ্ল্যাট, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার-এ কনডম কেনা, পিঁপড়াবিদ্যায় ম্যানিকিন নিয়ে শুয়ে থাকা—এসব হলো দর্শককে সুড়সুড়ি দেওয়া। কিন্তু এই যৌন সুড়সুড়ি দেওয়াতে তো দোষ নেই; দোষ হবে, যদি মুনমুন, ময়ূরী, পলি চলচ্চিত্রে ড্যান্স দেয়! কারণ ফারুকী ধরে ফেলেছেন, তার চলচ্চিত্র একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির নির্দিষ্ট বয়সের দর্শক দেখে। তাই কাহিনিতে যৌন সুড়সুড়ি আনা ফারুকীর বড়ো নিয়ামক। আর এটাই ফারুকীর চলচ্চিত্রকে বৃত্তাবদ্ধ করে ফেলেছে। মান্না আর কাজী হায়াৎ জুটির চলচ্চিত্রে যেমন রাজনৈতিক একটা স্ট্যান্টবাজি থাকে, রুবেলের থাকে অ্যাকশন, তেমনি ফারুকী আর আনিসুল হক জুটির থাকে সুড়সুড়ি। তাহলে এই সুড়সুড়ি আর কাটপিসের মধ্যে ফারাকটা কোথায়? দুইয়ের উদ্দেশ্যই তো একই, দর্শক ধরা। দর্শকের ক্যাটাগরিতে দুইটা-ই সফল। কিন্তু এই সুড়সুড়ির মধ্যে একটা অন্যরকম ব্যাপার আছে।

প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, হাল আমলে হিন্দি চলচ্চিত্রের নায়িকা সানি লিওনের কথা। সানি লিওন পর্নো চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এটা হিন্দি চলচ্চিত্র দেখা দর্শক জানে। কিন্তু তারা হিন্দি চলচ্চিত্রে স্বল্পবসনা সানি লিওনকে দেখার সময় কিংবা তার ‘আইটেম সঙ’ দেখার সময় যে সুড়সুড়ির রহস্য অনুভব করে তাতে মনে করে, না-জানি বাকি কাপড় আরো সংক্ষিপ্ত হলে কিংবা বিলীন হলে কী হবে! দর্শক কিন্তু সানি লিওনের পর্নো চলচ্চিত্র দেখে এই রহস্য খোলাসা করতে পারে। কিন্তু প্রেক্ষাপট পুরোটাই ভিন্ন। ফলে এই যৌন সুড়সুড়ির যে রহস্যময় অনুভূতি চলচ্চিত্রের কাহিনির ফাঁকফোকরে দর্শক পায়, তা পর্নোগ্রাফির চেয়েও আকর্ষণীয়। এই আকর্ষণীয় ব্যাপারটাই লক্ষ করা যায় ফারুকীর চলচ্চিত্রে, দর্শক ধরার কৌশল হিসেবে। কিন্তু এটা শ্রেণিবৃত্তে বন্দি দর্শকের কাছে কোনো রকম আপত্তি বা অশ্লীলতা হয়ে ধরা দেয় না।

কাজী মোরশেদ ঘানি নির্মাণ করেন ২০০৮ সালে। এর বিষয় ছিলো কলু পেশাজীবীর গরু চুরিতে সঙ্কট, আর তাতে নিজের কাঁধে জোয়াল নিয়ে নায়কের ঘানি টানা। একই রকম না হলেও সম্ভবত ১৯৯৫ সালে তোজাম্মেল হক বকুল গাড়িয়াল ভাই নির্মাণ করেন। গাড়িয়াল ভাই-এ মহাজন গরু নেওয়ায় নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন নিজ ঘাড়ে জোয়াল নিয়ে গরুরগাড়ি টানেন। ঘানি বাহবা পায় কিন্তু গাড়িয়াল ভাই অগোচরে থেকে যায়। কারণ গাড়িয়াল ভাই চাষাভুসোর জন্যে বানানো চলচ্চিত্র। আর ঘানি বিকল্পধারার তকমা নিয়ে জন্ম নেওয়া। ডিজিটাল এই বাংলাদেশে এটা ভাবতে অবাক লাগতে পারে, এখনো কি এমন অবস্থা আছে—গরুর অভাবে নিজ কাঁধে জোয়াল নিয়ে হালচাষ করতে হয়! পাঠক, গ্রামগঞ্জে এমন দৃশ্য হরহামেশা দেখা মিলবে। ২২ ডিসেম্বর ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার প্রথম পাতায় হালের গরুর অভাবে মানুষের কাঁধে জোয়াল দিয়ে লাঙল টানার ছবি আছে। তো এই ছবি দেখে বিকল্পধারার চলচ্চিত্রের দর্শকদের যদি ভাবান্তর না হয়, তাহলে দুই-তিন ঘণ্টার চলচ্চিত্রে মানুষের কাঁধে জোয়াল দিয়ে ঘানি ঘুরিয়েও কোনো লাভ হবে না। কিন্তু যারা গাড়িয়াল ভাই দেখে তারা ইলিয়াস কাঞ্চনের ঘাড়ে জোয়াল নিয়ে গরুরগাড়ি টানার দৃশ্যে ঠিকই আবেগাপ্লুত হয়।

৯.

আসলে আমাদের চলচ্চিত্র কিংবা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র হওয়ার জন্য যে ধরনের কাহিনি প্রয়োজন, তার বড়ো অভাব। এটা বি এফ ডি সি কিংবা বিকল্পধারা উভয় ক্ষেত্রেই সত্য। আমরা এখনো নায়ক-নায়িকা নির্ভর কাহিনির মধ্যেই আবদ্ধ। যদিও এর ব্যতিক্রম আছে; এ সংখ্যা মাটির ময়নার মতো হাতেগোনা। কাহিনির নিজস্বতা যখন হারায় তখন কাটপিস, নকল গান ইত্যাদি দিয়ে দর্শক ধরার কৌশল করা হয়। ‘দেশীয় চলচ্চিত্রে যখন নকল প্রবণতা শুরু হয়েছে তখন থেকে এ শিল্পে ধস নেমে এসেছে। এর জন্য দায়ী ওই সব প্রযোজক যারা পরিচালকদের বাধ্য করেছেন বিদেশি সিনেমার নকল করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে।’ তাহলে কি প্রযোজকের কাছেই চলচ্চিত্র জিম্মি? প্রযোজকের চাওয়া পাওয়াই কি সবকিছু, এটা প্রতিকারের কি কোনো উপায় নাই?

 

লেখক : মাসুদ পারভেজ, শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়ান। গল্পকার রানার নামে ছোটো কাগজের সম্পাদক। তার প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের নাম ‘ঘটন অঘটনের গল্প’ ‘বিচ্ছেদের মৌসুম’।

parvajm@gmail.com

 

তথ্যসূত্র

১. চৌধুরী, ফিরোজ জামান; ‘ঢাকাই চলচ্চিত্রের টিকে থাকার লড়াই’; প্রথম আলো, ২৩ মে ২০০৯

২. খান, আরিফ; ‘মিডিয়ার সেদিন এদিন’; সাপ্তাহিক ২০০০, ৪ নভেম্বর ২০১১

৩. হোসেন, আমজাদ; ‘তবুও আলোর হাতছানি’; সমকাল-এর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষ্যে বিশেষ ক্রোড়পত্র ‘প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আয়োজন ২’, ২২ জুন ২০১১

৪. আতিক, নূরুল আলম ; ‘জহির রায়হানের খোঁজ পাওয়া গেছে’; ম্যাজিক লণ্ঠন; সম্পাদনা : কাজী মামুন হায়দার; বর্ষ ২, সংখ্যা ২, জুলাই ২০১২, পৃ. ১৫৯, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী

৫. হোসেন, শেখ শাফায়েত; ‘পাঁচ দশকেও শিল্প হয়ে ওঠেনি চলচ্চিত্র’; কালের কণ্ঠ, ২৫ ডিসেম্বর ২০১১


বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জানুয়ারির ম্যাজিক লণ্ঠনের অষ্টম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।



এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন