আইয়ুব-আল আমিন
প্রকাশিত ২২ আগস্ট ২০২৩ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
দর্শক-কথা
ঢাকাই চলচ্চিত্রের নির্মাতা-দর্শক রাতে চোখ বেঁধে পান্তা খায়
আইয়ুব-আল আমিন
শিল্প সৃষ্টিতে শিল্পীকে সৎ থাকতে হয়। এটা নিছক কোনো বাক্য নয়। ভণ্ডামি, চুরি, দায়সারা, মায়া-মমতাহীন কর্ম কোনো শিল্পের মধ্যে পড়ে না। মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ যখন সূচকের সর্বনিম্ন দাগ থেকেও অনেক নীচে নেমে যায়, তখন তাদের দ্বারা শিল্প কেনো, নৈমিত্তিক কর্মকাণ্ডও স্বাভাবিক আশা করা নেহাতই মূর্খতা। কোনো সমাজের প্রতিটি মানুষ যখন ওই পর্যায়ে উপনীত হয় তখন সেখানকার শিল্পমান কী হবে সেটা সহজেই অনুমেয়। এটাই স্বাভাবিক ।ডুমুরের ফুল ফোটে—এ কথা সবাই শুনেছে, কিন্তু কেউ কখনো দেখেনি। কেউ দেখে থাকলেও তার ভুল হয়েছে। হয় সেটা ডুমুরের ফুল ছিলো না, না হয় সে ডুমুরই চেনে না।
তবে ওই সব ভণ্ডামির দিনও শেষ। এখন শুরু হয়েছে নতুন ভণ্ডামি; সততার ভণ্ডামি। কোনো শিল্প বা শিল্পধারা কারো ভালো লাগতেই পারে। সেই ধারার অনুপ্রেরণায় কাজ করা দোষেরও কিছু নয়। কিন্তু কোনো শিল্পের হুবহু নকল করে তাকে নিজের মৌলিক শিল্পরূপে জারি করা ভণ্ডামির চূড়ান্ত; অথচ এখন এটাই স্বাভাবিক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুর পরিবর্তন হয়, পরিবর্তন হয় শিল্পেরও। কোনো অঞ্চলের শিল্প ওই অঞ্চলের সার্বিক অবস্থার প্রকাশক। আবার একটি অঞ্চলের সামাজিক অবস্থা অবলোকন করে, সেই অঞ্চলের শিল্পের মানও নিরূপণ করা যায়।
বলা হয়, আমাদের দেশের শত শত মেধাবী তরুণ আছে, যাদের দিয়ে শিল্পের পরিবর্তন সম্ভব। যে ছেলেটি সেই ছোটোবেলা থেকেই ‘নীতি-নৈতিকতা’হীন এক সমাজব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে, সে কীভাবে একটি পরিষ্কার শিল্প তৈরি করবে? হ্যাঁ, অনেকেই বলতে পারেন, বিশৃঙ্খল ও চরম অনৈতিকতার মধ্যেই কেউ একজন আসবেন সবকিছুর পরিবর্তন করতে। কিন্তু তা হয়তো আর সম্ভব নয় এই সমাজে। কারণ পরিবর্তনকারী ওই রকম কাউকে এখন আর সমাজ টিকতে দিতে চায় না, নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায় আবির্ভাবের আগেই। তাই হতাশা ছাড়া সামনে আর কিছু নেই আশা জাগানোর। ভণ্ড আর দুর্নীতিবাজদের ক্রমবিস্তার রোধ করার শক্তি সমাজ হারিয়ে ফেলেছে। উত্তরণের সব পথ আজ প্রায় রুদ্ধ। দিন যতো যাচ্ছে সবকিছুই যেনো তলিয়ে যাচ্ছে ততোই।
বলার অপেক্ষা রাখে না, চলচ্চিত্র সারা পৃথিবীতে এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পমাধ্যম। এর পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রকাশ পায় শিল্পের সব শাখার সমন্বয়ে। স্বভাবতই চলচ্চিত্রশিল্প আজ দুনিয়ার সব শিল্পমাধ্যমকে শাসন করছে। বিভিন্ন ঘটন-অঘটন, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমাদের চলচ্চিত্র আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, একদম গোড়ার দিকেও এর অবস্থা মোটেও এমন ছিলো না। ৭০ দশকের বলিউডি চলচ্চিত্র আর আমাদের চলচ্চিত্রের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য ছিলো না। অথচ আাজ?
সুন্দর গল্প, ভালো অভিনেতা-অভিনেত্রী, সুন্দর সিনেমাটোগ্রাফি, সুন্দর সম্পাদনা ও উন্নত প্রযুক্তি ছাড়া আজ চলচ্চিত্রের কথা কল্পনা করা যায় না। এই সময়ে আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পে এগুলোর কোনোটি সম্পূর্ণরূপে তো নয়ই, সামান্য পরিমাণ আছে বলেও মনে হয় না। তবে এটাই শেষ কথা নয়। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য বিষয় হলো, এই সব বিষয়কে সমন্বয়কারীর প্রজ্ঞা ও মেধা। এই বিষয়টি থেকে আমাদের অবস্থান অনেক দূরে। সুন্দর একটি গল্প সুন্দরভাবে ধারণ, উন্নত প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার করে সুন্দর সম্পাদনের পর সেটাকে দর্শকের সামনে নিয়ে আসবে—এই আশা করার মতো আজ আর তেমন কেউ নেই। আর যে দু-একজন আছেন, তারা আবার এই গণমাধ্যমটিকে গণবিচ্ছিন্ন করে ফেস্টিভাল ও পুরস্কার কেন্দ্রিক করে ফেলেছেন।
দেশের ১০ ভাগ (কোনো কোনো ক্ষেত্রে এরও কম) মানুষ যে চলচ্চিত্র দেখলোই না, অথচ বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হলো, পুরস্কার পেলো—সেই ধোয়া পানি খেয়ে আমাদের কী লাভ? চলচ্চিত্র কার জন্য বানাচ্ছি তাহলে? উদ্দেশ্যটাইবা কী? তাহলে পুরস্কারকে সামনে রেখে কি আমরা চলচ্চিত্র বানাই? বিষয়টি অনেকটা কেবল চাকরির আশায় পড়াশোনা করার মতো। শেষে পড়াশোনাও হয় না, হয়তো ‘ভালো’ চাকরিও হয় না—এই রকম আর কি। দেশের মানুষের মনন ও চাহিদার প্রতি যদি নির্মাতাদের ভাবনা থাকতো, তাহলে হয়তো হলিউড-বলিউডের প্রতি এতখানি মুখাপেক্ষী হতে হতো না। এখন এটা করতে তারা জাস্ট বাধ্য।
১০ বছর আগেও যেখানে প্রেক্ষাগৃহগুলো গমগম করতো, আজ সেখানে ঘুঘু চরে। একসময় বিশাল একটি শ্রেণি ধুয়া তুললো ‘অশ্লীলতা’র। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সেটা পরিবর্তন করে ‘শ্লীল’ চলচ্চিত্র আনা হলো। এতে হলো কী—বিশাল এক শ্রেণি সেই ‘শ্লীল’ চলচ্চিত্র দেখা বন্ধ করে দিলো। এমনকি সেই সময় যারা অশ্লীলতার ধুয়া তুলেছিলো, তারাও সেই চলচ্চিত্র দেখা বন্ধ করলো। দেখবে কী? দেখার মতো তো আর কিছুই থাকলো না; ছিলো যা তা ওই ‘অশ্লীলতা’টুকুই।তখন তারা আর ক্যাটরিনা-মল্লিকাদের দ্বারস্থ না হয়ে পারলো না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সেটাকে কেউ আর সেভাবে ‘অশ্লীল’ বললো না! তাহলে হলো কী? আদতে বিষয়ের কোনো পরিবর্তনই হলো না। মধ্যখানে মারা পড়লো আমাদের শিল্পটি। হ্যাঁ, অনেকেই বলে ওদের ‘অশ্লীলতা’র মধ্যেও একটি আর্ট, মানে শিল্প আছে। আর আমাদের ময়ূরী-মুনমুনদের মধ্যে তো তা নেই। আসলে আমাদের লজ্জা নেই। আমরা খাই পান্তাভাত, আর স্বপ্ন দেখি পোলাও-মাংসের এবং সারাদিন চিন্তাভাবনা, গল্প সবকিছু করি ওই পোলাও-মাংসেরই; পান্তা আমরা ভাবনাতেই আনি না। আনলে লজ্জা পাই। তাই রাতে চোখ বেঁধে পান্তাই খাই।
ফেস্টিভাল আর পুরস্কার কেন্দ্রিক চলচ্চিত্র বাদ দিয়ে মূলধারার চলচ্চিত্রের কথা যদি বলি, তাহলে উন্নত প্রযুক্তি, আধুনিক পাত্র-পাত্রী এবং তরুণ মেধাবী পরিচালকরা যা করছে তা মূলত কী? সূর্য দীঘল বাড়ি কিংবা জীবন থেকে নেয়ার মতো গত ২০ বছরে কী কোনো চলচ্চিত্র হয়েছে? সাদা-কালোর ওই যুগে চলচ্চিত্রের কী উন্নত প্রযুক্তি ছিলো!
এখনকার এই চলচ্চিত্রগুলোতে উন্নত প্রযুক্তির লেবেল, তথাকথিত আধুনিক পাত্র-পাত্রী ছাড়া আর কী আছে উল্লেখ করার মতো? ময়ূরী-মুনমুনদের সময়ের চলচ্চিত্র থেকে‘অশ্লীলতা’টুকু বাদ দিলে যা থাকে, এখনো তা-ই হচ্ছে। এখনকার বলিউডের মূলধারার যে চলচ্চিত্র, তার মানও কিন্তু আমাদের ওই-এই চলচ্চিত্রের সমপর্যায়ের। ওই একই রকম গল্প নিয়েই তারা চলচ্চিত্র করছে; ফারাক শুধু চাকচিক্য আর সাজানো-গোছানোতে।
উন্নত প্রযুক্তি, টাকা-পয়সা, অভিনেতা-অভিনেত্রী ইত্যাদি ইত্যাদি গৌণ বিষয়। আসল প্রয়োজন একজন সৎ ও প্রজ্ঞাবান নির্মাতার। কিন্তু সেই আশা করার মতো আমাদের সমাজে অবশিষ্ট কিছু আর নেই। আফসোস!! অনেকের কাছে মনে হবে আমার এই কথা নেহাত মূর্খতা, তাদের জন্যও আফসোস!!!
লেখক : আইয়ুব-আল-আমিন বর্তমানে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় চিত্রশিল্পী হিসেবে কর্মরত। এর বাইরে তিনি নিয়মিত প্রচ্ছদের কাজ করেন।
ayub.fa@gmail.com
বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ম্যাজিক লণ্ঠনের তৃতীয় সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন