Magic Lanthon

               

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত; ভাব-ভাষান্তর : তাকিয়া সুলতানা ও জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত ২২ আগস্ট ২০২৩ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

রহস্য ছাড়াই চলচ্চিত্র

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত; ভাব-ভাষান্তর : তাকিয়া সুলতানা ও জাহাঙ্গীর আলম


বেশ আগের কথা, যতোদূর মনে পড়ছে গত শতাব্দীর ৬০ দশকের মাঝামাঝি হবে। ট্রামে চড়ে কলেজে যাচ্ছিলাম। পিছনের আসনে বসা এক যাত্রী হঠাৎ-ই আমার নজর কাড়লো। হাতে খোলা বই, মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন আর নিজ মনে হাসছেন। একসময় আচমকা তা অট্টহাসিতে পরিণত হলো। আমি আড়চোখে তাকাচ্ছিলাম তার দিকে। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম, তিনি নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন; হঠাৎ-ই আমার চোখে চোখ পড়লো তার; একটু এগিয়ে এসে হাতের বইটি আমাকে উপহার দিতে চাইলেন। এরপর ইতস্তত আমার হাতে ‘প্রমিলার প্রথম ফুলশয্যা’ (The First Wedding Night of Pramila) বইটি ধরিয়ে নেমে গেলেন তিনি।

আমিও পরবর্তী স্টপেজে নেমে, চলে গেলাম পাশের একটি পার্কে। খুব আগ্রহ নিয়ে সংবাদপত্র পড়ার চেয়ে দ্রুততম সময়ে সেই পাতলা পেপারব্যাক বইটি শেষ করে ফেললাম। বইটির কাহিনি গোপন প্রণয়, অসুস্থ যমজ বোনকে বিশ্রামে পাঠিয়ে আরেক বোন দুলাভাইয়ের সঙ্গে রাত কাটায়। এর ভাষাও ছিলো অমার্জিত। লেখক ও প্রকাশকের নাম এখন ঠিক মনে পড়ছে না। কিন্তু সেই সহযাত্রীর আবেগী হাসি, অট্টহাসি এবং বইয়ের সস্তা ও কুরুচিপূর্ণ বিষয়বস্তু এখনো ভুলিনি। এ ধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে অবশ্য এখনো বই প্রকাশ হয় এবং তা দেশের লাখো মানুষের বিনোদনের খোরাকও জোগায়।

মূলত এগুলো সেই ধরনের সাহিত্য, যা উগ্র যৌনতাকে পুঁজি করে পাঠককে ধরে রাখে। একধরনের সঙ্গীতও রয়েছে যা দর্শকের গায়ে কাঁটা দেয়। অবশ্য একদিক থেকে দেখলে এ ধরনের  চলচ্চিত্রও আছে, যা মানুষের যৌনক্ষুধা বা ভোগবাসনাকে চরিতার্থ করার ক্ষমতা রাখে।

৬০ দশকের মাঝামাঝি আমাদের মতো ভবিষ্যৎ চলচ্চিত্রনির্মাতাদের অনেকে ভালো চলচ্চিত্রের প্রেমে পড়ে। এজন্য অবশ্য সাধুবাদ জানাতে হয় তৎকালীন কলকাতার চলচ্চিত্র সংসদগুলো ও কিছু চলচ্চিত্রকে; এই সব চলচ্চিত্র আমাদের দেশেই নির্মাণ হয়েছিলো। আমার ভালো চলচ্চিত্র-নির্মাণের প্রেরণা ছিলো এ প্রত্যাশা থেকে যে, এটা হবে একান্ত আমার সৃষ্টি ... চলচ্চিত্র, যা দর্শকদের ভাবাবে। তখন আমাদের অনেকেই বিশ্বাস করতো, শিল্পের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম চলচ্চিত্র। এখনো তা অনেকে বিশ্বাস করে। যখন আমি বিগত কয়েক বছরে নিজের নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো দেখি, তখন আমার মেরুদণ্ডের ভিতরে শীতল স্রোত বয়ে যায়। মনে হয়, আমি কি সত্যিই চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসায় বিশ্বস্ত থাকতে পেরেছি, নাকি আমার অধঃপতন হয়েছে?

সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেন চলচ্চিত্রের একটি নির্দিষ্ট ধাপ পূর্ণ করেছেন। পরবর্তী প্রজন্মের আমরা এখনো ভালো কিছু অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি; যদিও আমাদের ভবিষ্যৎ অনেকটাই প্রতিকূল হতে পারে। চলচ্চিত্রের দর্শক কমছে, দ্রুত গতিতে কমছে স্পন্সর, পরিবেশকরা উদাসীন এবং প্রেক্ষাগৃহ মালিকরা নতুন ধারার চলচ্চিত্রের দিকে ঝুঁকছেন। চারপাশে সমালোচনা শুনি-‘এসব চলচ্চিত্র দিয়ে কী হবে?’, ‘এই চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্দেশ্য কী?’, ‘শুধু সেই চলচ্চিত্রগুলোই থাকুক যা মানুষকে বিনোদন দেয় এবং সুড়সুড়ি দিয়ে অফুরন্ত বিনোদনের খোরাক জোগায়।’, ‘সিরিয়াস চলচ্চিত্র গোল্লায় যাক।’, ‘এসব চলচ্চিত্র শুধু বিদেশে চলচ্চিত্র উৎসবের জন্য; এগুলো কখনো দেশের মানুষের জন্য নয়।’ এ ধরনের মন্তব্য প্রতিনিয়ত আমাদের হজম করতে হয়।

এমনকি সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেনও এ রকম সমালোচনা থেকে রেহাই পাননি। বস্তুত তাদের চলচ্চিত্র ছয়-সাত সপ্তাহের বেশি প্রেক্ষাগৃহে চলেনি। কিন্তু এটাও সত্য, বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের অবস্থা এর চেয়ে বেশি ভালো নয়। তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টা আরো খারাপ, কারণ তারা বেশি অর্থ বিনিয়োগ করে। সবকিছু ভেঙে পড়ার ভয় তাদের ছায়ার মতো তাড়া করে। আমি এখনো এমন কোনো নির্মাতার দেখা পাইনি, যিনি বিপুল সংখ্যক দর্শক প্রত্যাশা করেন না।

এসব সত্ত্বেও কিছু নির্মাতা আছেন যারা সততা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে নিজের চিন্তাভাবনা তুলে ধরতে চান। সত্যজিৎ-পরবর্তী চলচ্চিত্রে তাদের এ প্রচেষ্টাকে অগ্রগতি হিসেবে ধরা হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসব চলচ্চিত্র ও নির্মাতাদের নিয়ে সঠিক পর্যালোচনা হয়েছে খুবই কম। ভারতে সমসাময়িক চলচ্চিত্র নিয়ে যা লেখা হয়েছে, সেগুলো বিচার করলে মনে হয় পৃথিবীতে সবচেয়ে সহজ কাজ চলচ্চিত্র সমালোচক হওয়া! এসব আলোচনায় যেভাবে ভারসাম্যহীন ও অশোভন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়, তা সৃষ্টিশীল চলচ্চিত্রের ব্যাপারে দর্শকের আগ্রহ সৃষ্টির পরিবর্তে তাদের উদাসীন করে।

একটি সময় ছিলো যখন শীর্ষস্থানীয় বাঙালি লেখক যেমন-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ সাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। যদিও তাদের সাহিত্যকর্মের পাঠক ছিলো সীমিত। বেশি শ্রোতার আগ্রহ না থাকায় বড়ে গোলাম আলী কিংবা বিসমিল্লাহ খানকে কেউ দোষারোপ করেনি অথবা রামকিনার বা বিনোদবিহারীকে এমন ছবি আঁকতে বলা হয়নি যা গণমানুষকে বিনোদন দেয়। কিন্তু একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা দর্শক টানতে ব্যর্থ হলে তিনি উপযুক্ত নন বলে বিবেচনা করা হয়।    

প্রকৃতপক্ষে, এটি একেবারেই ভিন্ন, সেই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ একটি জগৎ। গণমাধ্যম ক্রমেই লতা থেকে মহিরুহে পরিণত হচ্ছে, যা পর্দার আড়ালে থেকে প্রতিটি বিষয় পরিচালনা করছে। ব্যবহারিক দিক থেকে সারাবিশ্বে বিষয়টি একই রকম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দ্বিধাগ্রস্ত ও নৈরাজ্যপূর্ণ ইউরোপিয় দেশগুলো ভারতে একধরনের আধ্যাত্মিক আশ্রয় খোঁজে। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রে তারা বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়। নিঃসন্দেহে সেগুলো স্মরণীয় চলচ্চিত্র, কিন্তু এটাও সত্য যে, তারা (ইউরোপিয়ান) তাদের দ্বিধাগ্রস্ত চিন্তার উত্তর ওই চলচ্চিত্রে পেয়েছে এবং সেগুলো নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এর মাত্র দুই দশকের মাথায় ইলেকট্রনিক মিডিয়া এক নতুন সংস্কৃতির পথ দেখায় যা সবকিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।

কয়েক মাস আগে যখন আমি লন্ডনে ছিলাম, তখন সেখানে চলচ্চিত্র ও মঞ্চ নাটক বিষয়ক প্রকাশনা বের করে এমন একটি জনপ্রিয় বইয়ের দোকানে যাই। বিস্ময় ও আতঙ্ক নিয়ে আমি দেখি, মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দোকানটিতে গে ও লেসবিয়ান ভিডিও উপচে পড়ছে; যেগুলো ইউরোপ ও আমেরিকার সব চলচ্চিত্র উৎসবে বড়ো ধরনের জায়গা করে নিয়েছে। গে জীবনধারা ও লেসবিয়ান এখন শুধু একটি ধারণা নয়, সেগুলো জীবনের বিশ্বাস ও অনুশীলনে পরিণত হয়েছে। চিত্রশিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী ও চলচ্চিত্রনির্মাতারা সেগুলো থেকে অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন। তবে ভারতের নতুন চলচ্চিত্রনির্মাতাদের সেখানে পৌঁছানো খুব কঠিন। আবার এসব চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে ভিডিও পাইরেসি আরেকটি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে কাজ করছে। আর স্যাটেলাইট চ্যানেলের হামলার কথা না হয় না-ই বললাম!

নতুন প্রজন্মের তরুণ নির্মাতারা হয়তো ছোটো পর্দায় কাজ করতে পারে। কিন্তু আমাদের অনেকের কাছে এখনো চলচ্চিত্রই প্রথম প্রেম। যখন জাদুময় আলোকরশ্মি অন্ধকার পর্দাকে আলোকিত করে, তখন প্রেক্ষাগৃহের অন্ধকার রহস্যময় করিডোর কতোই না চমৎকার হয়ে ওঠে! বাস্তব ও অবাস্তবের এই মিশ্রণ কিন্তু বিরামহীন নয়, এখানে বিষয়বস্তু দ্রুত ও সদা পরিবর্তনশীল। আমি ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি না, চলচ্চিত্র কতোদিন বাঁচবে এবং কী আঁকড়ে ধরবে-সম্ভবত ৫০ বা একশো বছর, কিন্তু এটি টিকে থাকতে কঠিন যুদ্ধ করবে। কারণ ভালো ও দায়িত্বশীল চলচ্চিত্রের ভাগ্য সর্বত্রই এক, তা সে বাংলা বা বিশ্বের যেকোনো স্থানেই হোক।

সাহিত্যের মতো চলচ্চিত্রও গণমানুষের চেয়ে ব্যক্তির কথা বেশি তুলে ধরে। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য চলচ্চিত্রের আরো বেশি বাণিজ্যিকীকরণ ঘটবে এবং কাহিনি ভিত্তিক হবে। কিন্তু সাহিত্যকে চলচ্চিত্রের মানানসই হওয়ার প্রয়োজন নেই। অতৃপ্ত জনগণকে তৃপ্ত করতে চলচ্চিত্রকে নতুন থেকে নতুনতর থিম খুঁজে বের করতে হয়।

সত্যিকার সৃষ্টিশীল চলচ্চিত্রনির্মাতা যেমন চ্যাপলিন, জিগা ভের্তভ, কার্ল ড্রেয়ার, রেঁনোয়া, ককতো, বুনুয়েল, আন্তোনিওনি কিংবা ফেলিনি ধীরে ধীরে কমে যাবে। ব্যক্তির নিজস্ব মেজাজ প্রমাণের পরিশ্রান্তকর প্রক্রিয়া এবং বাণিজ্যিক সাফল্য লাভের বিনাশী প্রতিযোগিতা আগ্রহী পরিচালকের চেতন বা অবচেতন সৃষ্টিশীল স্তরকে ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু করে ফেলে। কিন্তু অল্প সংখ্যক মানুষ, অল্প সংখ্যক পরিচালক তাদের কাজ চালিয়ে যাবেন। সম্ভবত তখন সেলুলয়েডের পরিবর্তে টেপ (এখন অবশ্য টেপকে ছাড়িয়ে ইলেকট্রিক সিগনাল মেমোরি কার্ডে সংরক্ষণ করা হচ্ছে) ব্যবহার হবে। কিছু সংবেদনশীল পরিচালক কেবল বুদ্ধিজীবীদের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন, যেমনটি ঘটছে আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে। 

হয়তো কেউ জরাজীর্ণ পুরনো বইটির পুনরুত্থান ঘটাবে এবং ‘প্রমিলার প্রথম ফুলশয্যা’ নামের সাহিত্যকর্মটি টেলিভিশনে সম্প্রচারের জন্য তৈরি করবে। পুরো উপমহাদেশ হাসিতে ফেটে পড়বে ... তাদের আবেগ জেগে উঠবে, জিহ্বা শুকিয়ে যাবে। অল্প কয়েকজন প্রথাবিরোধী, যারা এই পরিবর্তনশীল খেয়াল ও আবেগকে ধারণ না করার জন্য অভিযুক্ত হবেন। পরীক্ষানিরীক্ষার দিকে তাদের ঝোঁক থাকবে এবং স্বপ্নের রংধনুর নীচে বসে তারা নিজস্ব চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন। ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্ন দর্শকশ্রোতা যারা চলচ্চিত্রকে সৃষ্টিশীল শিল্প হিসেবে দেখেন, তারা বৃহৎ বিশ্বের এক কোনায় বসে সেগুলো উপভোগ করবেন।

 

দায়স্বীকার :‘Cinema sans mystery’ শিরোনামে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত’র এই প্রবন্ধটি প্রবোধ মৈত্র সম্পাদিত 100 Years of Cinema (১৯৯৫) গ্রন্থ থেকে নেওয়া। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে নন্দন, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

 

অনুবাদক : তাকিয়া সুলতানা একটি মানবাধিকার সংস্থায় জাহাঙ্গীর আলম বণিক বার্তায় সহ-সম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছেন।

rumitakia@gmail.com

alam_rumc05@yahoo.com

 


বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ম্যাজিক লণ্ঠনের তৃতীয় সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন