তামান্না মৌসী
প্রকাশিত ২২ আগস্ট ২০২৩ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
শরীরের দামে কেনা জীবিকা
বলিউডের লাস্যময়ী হাস্যময়ীরা
তামান্না মৌসী
বলিউডের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রের তালিকায় থ্রি ইডিয়টস্-এর অবস্থান তৃতীয়। এর ঝুলিতে রয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ৪০টি পুরস্কার। এখানেই শেষ নয়, ইন্টারনেট মুভি ডাটাবেজ-এর (আই এম ডি বি) শ্রেষ্ঠ দুইশো ৫০টি চলচ্চিত্রের তালিকায় এর অবস্থান একশো ২৪। নিঃসন্দেহে চলচ্চিত্রটি ‘ভালো’। জীবনের লক্ষ্য, সূক্ষ্মভাবে বললে কর্মজীবনের লক্ষ্য নিজের পছন্দে বেছে নেওয়ার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের ছবক দেওয়াই ছিলো চলচ্চিত্রটির উদ্দেশ্য। মহৎ উদ্দেশ্য! কারণ, ভালোবেসে কোনো কাজ করলে তাতে সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু সমস্যা হয় তখন, যখন সেখানে শুধু পুরুষদের জীবনের লক্ষ্যই ঠিক করার কথা বলা হয়; যেনো নারীর জীবনে কোনো লক্ষ্যই নেই। যদিও বা থাকে তা ঠিক করার ভার বাবা-স্বামীর ওপরেই বর্তায়। থ্রি ইডিয়টস্-এ নায়িকা থাকলেও তার অবস্থান এমনই! যদিও শেষে তিনি জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত—বিয়ে নিজের পছন্দ মতোই করেন, সেটিও পুরুষ-বন্ধুদের পরামর্শেই! এ লেখার উদ্দেশ্য থ্রি ইডিয়টস্-এর বিশ্লেষণ নয়, বরং বলিউডের মূলধারার চলচ্চিত্রে নারীর অবস্থান—সেটা আর্ট ও ইন্ডাস্ট্রি উভয় জায়গাতেই।
চলচ্চিত্র মুক্তির দিন পেজ-থ্রি রিপোর্টাররা ঘটা করে লেখেন—অমুক নায়কের বিপরীতে অভিনয় করেছেন তমুক নায়িকা। কিন্তু মূলধারার কয়েকটি বলিউডি চলচ্চিত্র বেশ মনোযোগের সঙ্গে দেখেও তো দাপুটে নায়কের বিপরীতে নায়িকার অভিনয় পেলাম না! প্রথমে ভাবলাম হয়তো দেখার ভুল। অগত্যা, বার বার দেখলাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে; না, আছে তো নায়িকার অভিনয়! ‘সমাজ সংস্কারক’ নায়কের পাশে আবেদনময়ী নায়িকারা যৌবন দেখাতেই ব্যস্ত—সেটা আইটেম সঙ কিংবা নায়কের কোমর জড়িয়ে রোমান্টিক সঙ যাই হোক না কেনো। কারিনা কিংবা ক্যাটরিনা—নায়িকার নাম যাই হোক, কাজ কিন্তু একটাই—হালকাট জাওয়ানি/শিলা কি জাওয়ানি’র তালে তাল ঠোকা। তা সে যে নায়কের ‘বিপরীতেই’ হোক। আচ্ছা, এ গানগুলো হিরোইন ও অগ্নিপথ নামে যে দুটি চলচ্চিত্রের, সেগুলোতে নায়িকাদের আর কোনো অভিনয় কি দেখেছেন কেউ? অথবা দেখলেও সে কথা মনে আছে? আমার বিশ্বাস, নেই; থাকার কথাও না। নায়িকারা করেছেনটাই বা কী যে মনে থাকবে! এ কথা কিন্তু থ্রি ইডিয়টস্-এর মতো ‘দিগ্বিজয়ী’ চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও খাটে।
আফসোস করেই কথাগুলো বলতে হচ্ছে। কিন্তু না বলেও উপায় নেই! বিষয়গুলো সম্প্রতি যে পর্যায়ে গেছে তা চোখে লাগছে। ভারতের এক সময়কার বিখ্যাত সব অভিনেত্রী—সুচিত্রা, মাধবী, শর্মিলা ঠাকুর, অপর্ণা সেন, শাবানা আজমি, নন্দিতা দাশ, দেবশ্রীরা কিন্তু চলচ্চিত্রে কেবল শরীর দেখাতে আসেননি, এর বাইরে শিল্পী হিসেবে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছিলেন। তারা বিখ্যাত হয়েছেন, শিল্পী হিসেবে, শরীর দিয়ে নয়। শর্মিলা ঠাকুর তো যে সময় অপুর সংসার-এ অভিনয় করেন, সেসময় নেহাত বালিকা। তার পরও সত্যজিতের চলচ্চিত্রে সুযোগ পেয়েছিলেন। এবং সবাইকে মুগ্ধ করেন অভিনয় দক্ষতা দিয়েই।
শাবানা আজমি যে কেবল অভিনয় করেছেন তা নয়, নারী অধিকার নিয়েও সচেতন থেকেছেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের শুভেচ্ছা দূত হয়েছেন। অথচ এখন নায়িকাদের সম্মান বাড়ে আইটেম সঙ্-এ নাচলে! অবশ্য সম্মান কতোটুকু বাড়ে জানা কঠিন, তবে সম্মানী যে বাড়ে তা হলফ করেই বলা যায়। আর মোটা অঙ্কের সম্মানী আছে বলেই বলিউডে এখন নায়িকা বাদেও মালাইকা অরোরাদের মতো ‘আইটেম গার্ল’ নামক প্রজাতির উদ্ভব হয়েছে। যদিও আইটেম গার্ল হওয়ার দৌড়ে এখন নায়িকারাও পিছিয়ে নেই। বস-এর (২০১৩) এক আইটেম গানে নেচেই সোনাক্ষি সিনহার ছয় কোটি রুপি আয় সেটাই প্রমাণ করে।১ আইটেম সঙে তার এই আয় কোনো চলচ্চিত্রে অভিনয় করা আয়ের সমানই। তার মানে চলচ্চিত্রে নায়িকা আর আইটেম গার্লের মূল্য সমান! ৯০ থেকে দেড়শো মিনিট—যে দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রই হোক না কেনো, বিনোদনের এ মাধ্যমটিতে শুধু বিনোদন দিতেই থাকেন নায়িকা, আইটেম গার্লরা। এককালে দক্ষিণা চলচ্চিত্রগুলোকেই শুধু এমন ভাবা হতো। অথচ বলিউডিরাও এ থেকে পিছিয়ে নেই।
জাতিসংঘের সহযোগী সংগঠন ইউ এন উইমেনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও বিষয়টি উঠে এসেছে। তাদের মতে, নারীকে দেহসর্বস্ব করে সবচেয়ে বেশি উপস্থাপন করা হয় ভারতীয় চলচ্চিত্রেই। সংস্থাটির গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত সমীক্ষায় বলা হয়, বিশ্বে নারীদের যৌন আবেদন সর্বস্ব ভূমিকায় সবচেয়ে বেশি দেখানো হয় ভারতীয় চলচ্চিত্রে। বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা রাজনৈতিক নেতার শক্তিশালী ভূমিকায় মেয়েদের রাখা হয় না মোটেও। এ ইন্ডাস্ট্রিতে ৩৫ শতাংশ নারী চরিত্রই কোনো না কোনোভাবে নগ্নতা প্রদর্শন করে। সমীক্ষাটিতে আরো দেখানো হয়, ভারতীয় চলচ্চিত্রে পরিচালক, চিত্রনাট্যকার বা প্রযোজক হিসেবেও নারীর সংখ্যা হাতেগোনা। গড়ে নয় শতাংশ পরিচালক, ১২ শতাংশ চিত্রনাট্যকার এবং ১৫ শতাংশ প্রযোজক নারী।
‘রকফেলার ফাউন্ডেশন’-এর পাশাপাশি ‘জিনা ডেভিস ইন্সটিটিউট অন জেন্ডার ইন মিডিয়া’ সমীক্ষাটি চালাতে সহায়তা করে। অস্কারজয়ী অভিনয়শিল্পী জিনা ডেভিস এ বিষয়ে মন্তব্য করেন এভাবে—নারীরা যদি আরো বেশি করে পরিচালনা, প্রযোজনা ও চিত্রনাট্য লেখেন, তবে তার প্রভাব পড়বে চলচ্চিত্রে। নারীদের হাতে তখন নারী চরিত্রগুলো বেশি গুরুত্ব পাবে। সেই চলচ্চিত্রগুলো লিঙ্গ বৈষম্য দূর করায় কার্যকর হবে বলেও আশাবাদী তিনি।২
এ পর্যায়ে বলিউডে তুলকালাম ঘটানো ‘দিপিকার ক্লিভেজ বিতর্ক’ না এনে পারছি না। কারণ, তারকাদের এসব নাখরা দেখে দেখে দর্শক অভ্যস্ত। চলচ্চিত্র মুক্তির ঠিক আগেই সহ-অভিনয়শিল্পীর সঙ্গে প্রেম, ব্রেক-আপ, ডিভোর্স, সমাজসেবায় মনোযোগ দেওয়ার পাশাপাশি তাদের পোশাক-আশাকও অসংলগ্ন হয়ে পড়ে। যিনি ক্যামেরার সামনে যাওয়ার আগে মেকআপ নিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নেন, তার পোশাক অসতর্কতাবশত এদিক-ওদিক হওয়াটা কতোটা যৌক্তিক, সেটা না ভেবেও বলা যায়। তবে দোষ সাংবাদিকদেরও আছে। সেলিব্রেটিদের সঙ্গে কথোপকথনের সময় সাংবাদিকদের মনোযোগ—তিনি কী বলছেন বা বোঝাতে চাইছেন, তার চেয়ে বেশি থাকে তার বেফাঁস কোনো মন্তব্য বা অসতর্ক মুহূর্তের ছবি তোলার দিকে। শুরুটা অবশ্য সাংবাদিকরাই করেছিলো। তবে তারকারাও এর ফায়দা নিতে ছাড়েননি। বেখেয়ালে ঘটে গেছে এমন অনেক ছবি বা মন্তব্য প্রকাশের পর তা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ করে দিয়েছেন তারকারাই। তাছাড়া জানা কথা, বিতর্কিত বিষয় নিয়ে মানুষ আলোচনা একটু বেশিই করে। ফলে প্রচারও পায় বেশি বেশি। কিন্তু কথা হলো, উপরের বেশিরভাগ ঘটনায় নারীরাই কেবল সাবজেক্ট হিসেবে থাকেন।
তাছাড়া গ্ল্যামারের ছড়াছড়ির মধ্যে নিজের স্বকীয়তাটাও টিকিয়ে রাখা নারীদের পক্ষে অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। তাইতো নারী শুধু ভোগ্যপণ্য হিসেবেই ‘সম্মান’ পায় এখানে। আলাদা কোনো পরিচয় নেই। গজ-ফিতা আর চামড়ার রঙের মাপকাঠিতেই এখানে বিচার করা হয় যোগ্যতা। ইংরেজিতে ‘ডাম্ব উইমেন’ বলে একটা ধারণা আছে। এটাকে মাকাল ফলের ইংরেজি ভার্সন বলতে পারেন। জন্মের পর থেকেই ‘সুন্দরী’ নারীদের তাদের পরিচিতরা বুঝিয়ে দেয়—যেহেতু তুমি সুন্দর, কাজেই তোমার আর কোনো গুণ না থাকলেও চলবে।
আর ঘষেমেজে চেহারা ছবি ঠিক রাখাটা কষ্টকর হলেও পড়াশোনার চেয়ে নিশ্চয় কম! তাছাড়া বর্তমানের এই সাদার বাজারে (সাদারাই তো এখন দুনিয়া চালাচ্ছে! যে জন্য সবাই সাদা হতে চায়) যদ্দুর বুঝি ভালো পাত্র জোটানোর আশায় বাবা-মায়েরাও এতে খুব একটা বাধ সাধেন না। এগুলোকে উৎসাহ দিতে বাহারি বিজ্ঞাপন তো রয়েছেই, যেখানে বার বার দেখানো হয় ফরসা হওয়া মানেই সফল হওয়া! সঙ্গে তো রয়েছেন পছন্দের নায়িকারা। বাজারের সর্বশেষ ডিজাইনের জামা-জুতো খুঁজতে হলেও দেখুন মুভি কিংবা টেলিভিশন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাসরীন খন্দকার লাবণী তার ‘পুতুলখেলার রাজনীতি : বার্বি কাহিনী’ প্রবন্ধে বিষয়টি বেশ পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন। স্লিম ফিগার আর গ্ল্যামারই এখন নারীর পরিচয়ের মূল (root)। বার্বি বা ডলকে পুঁজি করে এটাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলেছে প্রতিনিয়ত। এর কোনো বিকল্প চিন্তা আমাদের সমাজে নেই বলে মজ্জাগত ধারণা হয়ে উঠেছে এটি। অন্যদিকে, বিপ্লবী নারী সংহতির সমন্বয়ক শ্যামলী শীল বিষয়টিকে পুরোপুরি ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বলে দাবি করেছেন। তার মতে, পুঁজিবাদ নারীর দেহকে তিনভাবে কাজে লাগায়। প্রথমত, একধরনের আত্মপ্রেম জাগিয়ে তোলে। কেউ একটু বেশি মুটিয়ে গেলে যেমন খোটা দেওয়া হয়, তেমনি বেশি পাতলা হলেও সমস্যা। দ্বিতীয়ত, শরীরকে সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করতে শেখায়। এতে কিন্তু লাভ হচ্ছে ব্যবসায়ীদেরই। চাহিদা বাড়ে প্রসাধন সামগ্রীর। বিজ্ঞাপনের ভাষা হয় ‘সৌন্দর্যই শক্তি’। তৃতীয়ত, যৌন উত্তেজনা বাড়াতে অস্বাভাবিক যৌনতা প্রদর্শন করা হয়।
মূলত ‘হট উইমেন’ ধারণা তৈরি করতে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয় যৌনাবেদন। বিশ্বটা এখনো যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক, তাই বলির পাঁঠা হিসেবে খাড়া করানো হচ্ছে নারীদের। আর এসবের বিজ্ঞাপন তৈরিতে ব্যবহার করা হয় হালের মডেল-সুপার মডেলদের। এ ফন্দির সূচনা এখন নয়, ১৯৮৪ সালে প্রথম মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতা আয়োজনের মাধ্যমেই। পরিস্থিতি এমন করা হয় যে, ‘দেখি তো কী আছে’—এমন মনোভাব নিয়েই দেখতে বসে অনেকে। একই ব্যক্তির নাম বার বার শুনতে শুনতে তার ব্যাপারে আগ্রহ তৈরি হওয়াটাও স্বাভাবিক। তো চলচ্চিত্র ‘প্রমোশন’-এর জন্য এর চেয়ে ভালো প্ল্যাটফর্ম আর কী হতে পারে বলুন?৩
অবশ্য এ পেশায় পুরুষদের অবস্থাও তেমন সুবিধার নয়। সংক্ষিপ্ত পোশাকে নারী দেহের খাঁজ-ভাঁজ দেখিয়ে না হয় পুরুষদের আকৃষ্ট করলেন, কিন্তু নারীদের হবেটা কী? দর্শক সংখ্যায় তারাও যে নেহাত কম নয়! তাইতো পুরুষদেরও খুলতে হচ্ছে কাপড়। সেটা যতোটা না চরিত্রের প্রয়োজনে, তার চেয়ে বেশি দেহ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে। নইলে কোনো চলচ্চিত্রের শুটিং শুরুর আগেই কোনো নায়ক কেনো সিক্স প্যাক বানালেন তা নিয়ে মাতামাতি!
তবে এসব ঘটনার সঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে জড়িত অর্থনৈতিক বিষয়, সেটার হালহকিকত জানা দরকার। এখানেও বৈষম্য প্রবল। বলিউডের নামিদামি নারী অভিনয়শিল্পীরা এখনো তাদের পুরুষ সহকর্মীদের চেয়ে কম পারিশ্রমিক পান। উদাহরণ হিসেবে এখানে বলিউডের শীর্ষস্থানীয় ১০ অভিনয়শিল্পীর পারিশ্রমিকের হিসাব না দিয়ে পারছি না। সেরা পাঁচ পুরুষ অভিনয়শিল্পী শাহরুখ খান, সালমান খান, আমির খান, অক্ষয় কুমার ও রণবীর কাপুর গেলো বছর চলচ্চিত্র প্রতি পারিশ্রমিক নিয়েছেন যথাক্রমে ৩৫, ৩০, ২৮, ২৫ ও ২০ কোটি রুপি। আর সেরা পাঁচ নারী অভিনয়শিল্পীর পারিশ্রমিকের দিকে তাকালে দেখা যায়, চলচ্চিত্র প্রতি দিপিকা আট থেকে নয়, কারিনা আট থেকে সাড়ে আট, প্রিয়াঙ্কা সাত থেকে আট, ক্যাটরিনা ছয় থেকে সাড়ে ছয় এবং সোনাক্ষি পাঁচ কোটি রুপি এ বছর পকেটে পুরেছেন।৪ অথচ দিপিকা ও সোনাক্ষি বাদে তিনজনই ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছেন রণবীরের আগে।
অবশ্য পারিশ্রমিকের এ বৈষম্যের পাশাপাশি চলচ্চিত্রে গুরুত্বের দিক থেকেও নায়িকা অনেক পিছনেই পড়ে থাকেন। আর গুরুত্বহীন বলেই হয়তো এক থা টাইগার-এর মতো ব্লকবাস্টার চলচ্চিত্রে নায়িকাকে এককভাবে মাত্র ৫৯ সেকেন্ড দেখানো হয়!৫ অন্যদিকে পারিশ্রমিকের এ বৈষম্যও বলিউডে নারীর অধস্তনতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে বেশ। এ ফারাক নিয়ে রানি মুখার্জি ও বিপাশা বসু কথা বলেছেন বহুবার। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। বিষয়টা অনেকটা আমাদের দেশের নারী কৃষিশ্রমিকদের মতো, পুরুষের সমান (অনেক ক্ষেত্রে বেশি) যোগ্যতা নিয়ে কাজ করছেন, কিন্তু শুধু নারী বলেই পারিশ্রমিকটা কম।
তবে অনেক নারী পরিচালক-প্রযোজক ইন্ডাস্ট্রিতে থাকলেও তারা কি পেরেছেন এমন মানসিকতার বাইরে যেতে? মনে হয় না। আর মূলধারার চলচ্চিত্রে যেমন থাকে টাকাকড়ির লেনদেন, তেমনি স্বাধীনধারায় থাকে পুরস্কার আর আন্তর্জাতিক প্রদর্শনের হিসাবনিকাশ। সব শ্রেণির দর্শকের কথা মাথায় রেখে সেই একই বিষয় নিয়ে চলচ্চিত্র বানান ব্যবসায়ী ঘরানার পরিচালকরা। আর নিজেদের বিদ্যা জাহির করতে গুটিকয়েক স্বাধীনধারার পরিচালক যা বানান, তা তো বোদ্ধামহলেই ঠাঁই পায় শুধু।
ফলে দুই ধারা থেকেই সযত্নে বাদ দেওয়া হয় এ ব্যাপারগুলো। সমস্যাটা সর্বস্তরের হলেও যাদের জানা দরকার তাদেরই থেকে যায় অজানা। গাড়ি থেকে নেমেই বাড়িতে কিংবা শপিং মলে ঢোকেন যেসব নারী তারা কিন্তু ইভটিজিংয়ের শিকার হন না। তাদের দেখে উৎসাহী (আমি বলবো কুরুচিপূর্ণ) পুরুষদের যে যৌনতাড়না জাগে তার ভুক্তভোগী হতে হয় গণপরিবহণ ব্যবহারকারীকে। সানি লিওনকে দেখেছেন পর্দার ওপাশে, নিজের ঘরে; তাই বলে তো আর আপনি পাশের সিটে বসা নারীর অসতর্ক মুহূর্তের অসংলগ্ন পোশাকের দিকে উঁকিঝুঁকি মারতে পারেন না!
ধর্মের দোহাই দিয়ে ঢেকেঢুকে থাকতে বলবেন জোর গলায়, জানি। কিন্তু কথা সেটা না, অপর অর্ধেকের সহায়তা না পেলে নারী শুধু নিজেকে ঢেকে রেখে রক্ষা করবে কীভাবে? পথের কথা বাদ দিলাম। বাড়িতেও কি নারীরা আত্মীয়শ্রেণির পুরুষদের অভদ্র আচরণের মুখোমুখি হয় না? সেটা থামাতে পোশাকের প্রশস্ততা নয়, মানসিকতা প্রসারিত করতে হবে। আর আপনি জেনে বুঝেই চলচ্চিত্র দেখতে বসেন। বদলানোর কথা এলে বলেন, এসব শুধু চলচ্চিত্রেই সম্ভব, আর নারীদের ভাবেন চলচ্চিত্রের নায়িকা! দিন শেষে যেটা যেমন সেটা তেমনই দেখতে যে বড্ড ভালোবাসেন দর্শকরা। নিজের ঘরদোরও তো সামলাতে হয় তাদের! তাই ‘অতঃপর তাহারা সুখেশান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো’ দেখেই সুখী মনে দর্শক ঘরে ফিরতে চান। গাঁটের পয়সা খরচ করে চলচ্চিত্রও দেখবেন, আবার সেটা নিয়ে ভাববেনও—অতো সময় কই তাদের? তার চেয়ে নায়কের অতিমানবীয় কাজ কারবার আর নায়িকার মোহনীয় রূপ দেখে প্রেক্ষাগৃহ থেকে বের হওয়া মাত্র সেটা ভুলে যাওয়াটাই কাজের। বিনোদনের মধ্যে এতো কাহিনি কে-ই বা করতে চায় বলুন!
নইলে কেনো হিরোইন বক্স অফিসে জায়গা পায় না! আবার রা.ওয়ান (২০১১) রেকর্ড গড়ার পাশাপাশি শুধু ‘ছাম্মাক ছাল্লো’ গানে নেচেই নায়িকাও প্রশংসার বন্যায় ভাসেন। নায়িকা তো সেই একই, কারিনা। তার অভিনয় প্রতিভা নিয়ে কারো মনে সংশয় থাকার কথা নয়, নেইও। সমস্যা সেখানে না, সমস্যা চলচ্চিত্রের বিষয় ভাবনায়। সাধারণত নারী প্রধান চলচ্চিত্রগুলোকে কখনোই আগ্রহের সঙ্গে নেয়নি এ উপমহাদেশের দর্শকরা। উদাহরণ আরো আছে। বলছি একে একে সবগুলোর কথাই।
সমালোচকদের নিজস্ব ব্লগে প্রকাশিত লেখা থেকে এবার কিছু নারীপ্রধান চলচ্চিত্রের তালিকা দিচ্ছি। পাকিস্তানের ‘দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন’ পত্রিকার সমালোচক মেহেক মাথানি তার সেরা ১০ নারীকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রের তালিকায় জায়গা দিয়েছেন মাদার ইন্ডিয়া (১৯৫৭), ভূমিকা (১৯৭৭), অর্থ (১৯৮২), মির্চ মাসালা (১৯৮৭), আস্থা (১৯৯৭), অস্তিত্ব (২০০০), লজ্জা (২০০১), ডোর (২০০৬), কাহানি (২০১২) ও দ্য ডার্টি পিকচার (২০১১)। অন্যদিকে, চলচ্চিত্র সমালোচক লেত্তি মরিয়ম আব্রাহাম ‘বলিউড হাঙ্গামা নিউজ নেটওয়ার্ক’-এ প্রকাশিত তালিকায় রেখেছেন চাক দে! ইন্ডিয়া (২০০৭), লজ্জা, ডোর, অস্তিত্ব ও মাদার ইন্ডিয়াকে।
সমালোচক শ্বেতা কুশলের দাবি কিন্তু আলাদা। ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র এ সমালোচকের মতে, বলিউডি নারীপ্রধান চলচ্চিত্রগুলোতে চরিত্রকে ‘স্টেরিওটাইপ’ করে উপস্থাপন করা হয়। ’৫৭ সালে মাদার ইন্ডিয়াতে নারীর যে উপস্থাপন ছিলো, ২০০০ সালের পর মুক্তি পাওয়া রানি, কাজল কিংবা প্রীতি জিনতা অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোও সেই একই ধাঁচের।
তবে বলিউড যে শুধু হতাশই করছে এমনটি ভাবার কিছু নেই। এখন সচেতন দর্শক একটা চলচ্চিত্র দেখে একটু হলেও মাথা ঘামায়। তাইতো ২০১৪-তে নারীপ্রধান কুইন ব্যবসাসফল হয়। মধুর ভান্ডারকর’রা ফ্যাশন-এর মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। কেউ কেউ বিকিনি পরা মডেলদের জন্য সেটা দেখতে গেলেও তা শোবিজ নিয়ে টনক নাড়িয়েছে অনেকেরই। দিপিকা-কারিনার মতো প্রথম সারির অভিনয়শিল্পীরা এখন প্রকাশ্যে নিজেদের শোপিস ইমেজের বিরুদ্ধে কথা বলছেন কিন্তু।
লেখক : তামান্না মৌসী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী। বর্তমানে সমকাল-এ শিক্ষানবিশ সহ-সম্পাদক হিসেবে কর্মরত।
tammcj@gmail.com
তথ্যসূত্র
১. http://www.bollywoodmantra.com/news/sonakshi-sinha-paid-6-crore-for-an-item-song/12438/
২. http://www.ebela.in/paper/23-9-24@09@2014.html#
৩. এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আগ্রহী হলে ‘একাত্তর টিভি’ প্রযোজিত ডকুমেন্টারি থার্টি সিক্স টুয়েন্টি ফোর থার্টি সিক্স (৩৬ ২৪ ৩৬) দেখে নিতে পারেন। চাইলে দেখতে পারেন : https://www.youtube.com/watch?v=CDd7lKc8twQ&spfreload=10)
৪. সেতু, মাহামুদ ও মাহমুদ বাবু; ‘বলিউডের পাগলাঘোড়া ছুটছে, তবে জায়গায় দাঁড়িয়ে’; ম্যাজিক লণ্ঠন; সম্পাদনা : কাজী মামুন হায়দার; বর্ষ ৩, সংখ্যা ১, জুলাই ২০১৩, পৃ. ৯১, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ম্যাজিক লণ্ঠনের তৃতীয় সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন