Magic Lanthon

               

ইমরান হোসেন মিলন

প্রকাশিত ২০ নভেম্বর ২০২২ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

ফাটাকেষ্ট : সামাজিক অন্যায়ের অবাস্তব সমাধান

ইমরান হোসেন মিলন



এ-কথা স্বীকার করে নেওয়া যায় যে, গত ছয়-সাত বছরের মধ্যে টালিগঞ্জের যে-কটি সিনেমা ব্যবসাসফল ও জনপ্রিয় হয়েছে তার তালিকায় এমএলএ ফাটাকেষ্ট এবং মিনিস্টার ফাটাকেষ্ট উল্লেখযোগ্য। সিনেমা দুটি আমার অনেক আগেই দেখা; এবং বেশ কয়েকবার। তবে সেই দেখার পিছনে আমার দৃষ্টি ছিল দু-রকমের। প্রথম পর্যায়ে কয়েকবার দেখেছি ভালো লাগার কারণে, আর দ্বিতীয় পর্যায়ে দেখেছি সেই ভালো লাগার কারণ অনুসন্ধানে। সিনেমা দুটি আমার বিভিন্নভাবে দেখার সুযোগ হয়। কিন্তু বারবার দেখার পরও প্রথমের দিকে আমার ভিতরে কেনো জানি কোনো একঘেয়েমির জন্ম হয়নি। যেটি হয়েছে যে, কয়েকবার দেখার পর ভেবেছি সিনেমা দুটি সবার কেনো এতো ভালো লাগে? তবে এ-কথা সন্দেহের ঊর্ধ্বে ওঠে খুব সাধারণভাবে বলা যায় যে, এই ধরনের সিনেমাগুলো কোনো না কোনোভাবে দর্শকের আকাঙ্ক্ষা, চেতনা অথবা শক্তিকে ধারণ করে। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা, চেতনা বা শক্তির রকমের ধরন কেমন-তা জানার জন্য যখন সিনেমা নিয়ে একটু পড়াশুনা শুরু করলাম, তখন থেকে কেনো জানি ফাটাকেষ্ট সিনেমা দুটি নিয়ে আমার উল্লিখিত এই সাধারণ ধারণা আরও সম্প্রসারিত হতে শুরু করলো। অবশ্য কেবল পড়াশুনা করেই যে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পেরেছি তা নয়; বিষয়টি সম্পর্কে আমি এর-ওর সঙ্গে কথাও বলেছি। অধিকাংশের মতে সিনেমা দুটি চিত্তাকর্ষক, বলা যায় মনের মতো। কিন্তু এই ভালো লাগার জায়গাটি যে সিনেমার শৈল্পিক ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য-তা কিন্তু নয়। তা অন্য কোনো কারণে। আর এই অন্য কোনো কারণ কী-তা এই লেখায় আমার সিদ্ধান্তে আমি তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

জনপ্রিয় সিনেমা ফাটাকেষ্ট

একটি সিনেমা তার নানান উপাদানের ফলে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে। একটি গান, একটি মারপিটের দৃশ্য কিংবা কেবল নায়ক-নায়িকার জন্য সিনেমা জনপ্রিয়তা পেয়েছে-এমন নজির বিশ্বের যেকোনো দেশের চলচ্চিত্রে নজর দিলেই পাওয়া যাবে। বলিউড, টালিগঞ্জ কিংবা আমাদের ঢালিউডের দিকে তাকালেই আমরা এ-সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা পেতে পারি। আমাদের ঢালিউডের রূপবান, বেদের মেয়ে জোসনা, চাঁদনী কিংবা কেয়ামত থেকে কেয়ামত এখন পর্যন্ত জনপ্রিয়তার কারণে দর্শকমনে অবস্থান করছে। কিন্তু লক্ষণীয়, যে-যে উপাদানের সমন্বয়ে এই সিনেমাগুলো জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছিলো সেই-সেই উপাদান কিন্তু বর্তমান সময়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট নয়। আমি এই সময়ে এসে বেদের মেয়ে জোসনা দেখার পর অনেককেই মন্তব্য করতে শুনেছি যে, ‘এই সিনেমা কেনো এতো জনপ্রিয় ছিল তা বুঝতে পারলাম না।’ কিন্তু বাস্তবতা হলো, বেদের মেয়ে জোসনা জনপ্রিয় ছিলো। আর এখন জনপ্রিয় মনে না হওয়ার কারণ যতো সম্ভব দর্শক রুচির পরিবর্তন। এখনতো চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সেই আগের রুচিবোধে পড়ে থাকাকেই আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের বেহাল দশার অন্যতম কারণ হিসেবে অনেকেই মন্তব্য করেন। আমাদের চলচ্চিত্রের এই প্রতিক্রিয়াশীলতাকে অনেকে ব্যাখ্যা করেন এভাবে-আমরা এখনও ফর্মুলা সিনেমার (‘ছয়টা গান+দশটা মারপিট+একটা প্রেম= বাংলা ছবি?’) বাইরে যেতে পারিনি। একচেটিয়া ফর্মুলা সিনেমা আমাদের চলচ্চিত্রের একটি দুর্বল দিক এ-কথা মানা যায়। আবার এই কথার বিরোধিতাও করা যায় এই বলে যে, তামাম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের অধিকাংশ সিনেমাই এই ফর্মুলা ক্যাটাগরির। বলিউডের সিনেমা দিল ওয়ালে দুলহান ল্যা জায়েঙ্গে (১৯৯৫), যা এখনও ভারতের একটি সিনেমা হলে জনপ্রিয়তার জন্য প্রদর্শিত হয়; এটিও কিন্তু ওই ফর্মুলা সিনেমাই। আজকের দিনে এসেও ফর্মুলা সিনেমা ব্যবসা করে যাচ্ছে, পাচ্ছে দর্শকপ্রিয়তাও। ফাটাকেস্ট- সেই জায়গা থেকে সফল, সেই ফর্মুলাতেই জনপ্রিয়। শুধু ফাটাকেষ্ট- নয়, ফর্মুলা সিনেমার সেই কাঠামো অনুসরণ করে কিন্তু টালিগঞ্জে একের পর এক সিনেমা নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু ফাটাকেষ্ট আলোচ্য, কারণ সমসাময়িক মূলধারার যেসব সিনেমা টালিগঞ্জে নির্মিত হয়েছে তাদের সবগুলোকে ছাপিয়ে গেছে ফাটাকেষ্ট। যদিও লোটে হুকের সেই ছয়টা গান, দশটা মারপিঠ আর একটা প্রেম-এই কাঠামোর বাইরে ফাটাকেষ্ট যেতে পারেনি। এমনকি সিনেমা দুটিতে এমন কোনো শিল্প, সিনেমার নন্দনতত্ত্ব বা এমন কোনো গুণও নেই যার জন্য মানুষ এটা বারবার দেখছে? আমি মনে করি, সিনেমার যে নন্দনতত্ত্ব বা শিল্পগুণ তার দিক থেকে ফাটাকেষ্ট কখনই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি।

স্বপের স্বপ্নীল-বাস্তবায়নে ফাটাকেষ্ট

মানুষমাত্রই সবকিছু নিজের মতো করে চায়; দেখতে চায় তাই, যা তার ভালো লাগে। এই চাওয়া যেমন ব্যক্তির ভিতরে এককভাবে বিরাজ করে, তেমনি কিছু চাওয়া থাকে যা মানুষের ভিতর সামগ্রিকভাবে অবস্থান করে। দু-ধরনের চাওয়ার অধিকাংশরই উৎপত্তি বিরাজমান সমাজব্যবস্থা থেকে। ফাটাকেষ্ট ভালো লাগার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, সিনেমা দুটিতে মানুষের সামগ্রিক কিছু চাওয়া এবং তার বাস্তবায়ন প্রতিফলিত হয়েছে। সিনেমা যেহেতু দৃশ্যের সমষ্টি, সেহেতু এখানে আমরা সেই বাস্তবায়ন দেখতে পাই বেশকয়েকটি দৃশ্যের মাধ্যমে। এই আলোচনার পরবর্তী সবটুকু তাই সেই দৃশ্যগুলোকে ধরেই এগোবে।

দৃশ্য এক : এমএলএ ফাটাকেষ্ট-তে দেখা যায়, প্রমোটররা বস্তি থেকে গরিব-অসহায় মানুষদের উচ্ছেদ করতে হামলা চালায়। কিন্তু সেখানে এসে হাজির হয় রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রণদেব পালের ভাড়াটে গুণ্ডা ফাটাকেষ্ট; সে হামলায় বাধা দেয়। এক পর্যায়ে মেরে সব প্রমোটরদের বস্তি থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করে। এ-সময় প্রমোটরদের ডাকে সেখানে আসে পুলিশ। সরকারি কাজে ফাটাকেষ্ট বাধা দিচ্ছে, এমন অভিযোগে পুলিশের সঙ্গেও তার কথা কাটাকাটি হয়। শেষে ফাটাকেষ্ট সাধারণ জনগণের ভয় দেখিয়ে পুলিশকে সেখান থেকে বিতাড়িত করে।

দৃশ্য দুই : স্টার আনন্দ টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক চৈতালী রায়কে কিছু গুণ্ডার মুখোমুখি হতে দেখি মিনিস্টার ফাটাকেষ্ট সিনেমার প্রথম দিকে। গুণ্ডা মনোতোষ পাচা যেখানে চৈতালীর কাছ থেকে ক্যামেরা ছিনিয়ে নিতে চায়। কেননা সেখানে তার সব অবৈধ কাজের দৃশ্য ধারণ করা ছিলো। গুণ্ডারা যখন চৈতালী রায়কে ধাওয়া করে ঠিক তখনই সেখানে হাজির হয় ফাটাকেষ্ট। সবাইকে মেরে চৈতালীকে উদ্ধার করে ফাটাকেষ্ট।

দৃশ্য তিন : এমএলএ ফাটাকেষ্টতে একটি কলেজে পরীক্ষা বন্ধ করার চেষ্টা করে ‘কলেজ ইউনিয়নের ক্যাডার বাহিনী’। এই খবর চলে যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফাটাকেষ্টর কানে। সে ঘটনাস্থলে হাজির হয়। তারপর যথারীতি সব সমস্যার সমাধান করে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেয় ফাটাকেষ্ট।

এখানে দেখা যাচ্ছে, দর্শক-জনতার সামাজিক বাস্তবতাই হলো ফাটাকেষ্ট বা জনপ্রিয় সিনেমার বিষয়। সামাজিক এসব বাস্তবতার ফলে দর্শকের প্রতিদিনের জীবনে যেসব ইচ্ছে জমায়েত হয়, জনপ্রিয় এসব সিনেমার মাধ্যমে দর্শক সেসব ইচ্ছে মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। প্রকৃতিগতভাবেই মানুষের অনেক চাওয়া অবদমিত থাকে। জনপ্রিয় চলচ্চিত্র এসব অবদমিত ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটায়। সমাজের নিম্নশ্রেণীর মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে হানিমুন করার জন্য সিঙ্গাপুর যাওয়া; কিংবা ক্ষমতার উঁচু স্তরে বসা। এসব বাস্তব ইচ্ছার অবাস্তব প্রতিফলন যখন এই নিম্নশ্রেণীর মানুষ জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে পায় তখন খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও সে তৃপ্তি লাভ করে। ফাটাকেষ্ট সিনেমাতে নিম্নশ্রেণীর এ-রকমই একজন যখন মন্ত্রী হয় কিংবা মন্ত্রীর মুখে মুখে তর্ক করে-তখন এর চেয়ে আনন্দদায়ক আর কী হতে পারে!

জনপ্রিয় সিনেমার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এই সিনেমা সবসময় জনগণের যৌথ আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটায়। এই বৈশিষ্ট্য ধরে আজকের আলোচিত দুটি সিনেমাকে এই জনপ্রিয় সিনেমার কাতারে দাঁড় করানো যায় অতি সহজে। কেননা, উপরে যে-তিনটি দৃশ্যের কথা বললাম, তা সে-চিহ্নই ধারণ করে। এখানে যে-সমস্যাগুলো তুলে ধরা হয়েছে তা ব্যক্তির একক চাওয়া নয়; সমাজের একটি বৃহৎ অংশের সামগ্রিক চাওয়া। ফাটাকেষ্ট সিনেমাতে এই সামগ্রিক চাওয়া বাস্তবায়নের স্রষ্টা হিসেবে আমরা পাই ফাটাকেষ্টকে; যাকে নিম্নশ্রেণীর মানুষ একান্তই নিজেদের ভাবতে পারে। আর এসব ক্ষেত্রে মানুষ সিনেমাতে ফাটাকেষ্টর সবকিছুই সত্য মনে করে। ‘‘কেননা সত্য শব্দটির রয়েছে অমোঘ আকর্ষণ এবং বশ্যতা অর্জনের ক্ষমতা, চলচ্চিত্র তার ভৌত চরিত্রের কারণেই সত্যের আবহ নির্মাণ করে এবং বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। এভাবে ‘সত্য উৎপাদনে চলচ্চিত্র ব্যবহৃত হয়।’ কিন্তু এ-সত্য যে ঘষা দিলে রঙ পরিবর্তন করতে পারে তা সহজ-সরল দর্শক ধরতে পারে না। ধরতে পারার কথাও নয়। কেননা, যে-দর্শক নায়কের জয়ে প্রেক্ষাগৃহের আসন থেকে লাফ দিয়ে উঠে উল্লাসে হাততালি দেয়, সেই দর্শকের পক্ষে সমস্যা, বাস্তবতা কিংবা সিনেমাকে ঘষেমেজে তারপর তার সত্যতা যাচাই করা কঠিন বৈকি। ফাটাকেষ্টর মতো সিনেমাগুলো যুগে যুগে জনপ্রিয় হওয়ার পিছনের অন্যতম কারণ দর্শকের এই সহজ-সরল দৃষ্টিভঙ্গি। সহজ-সরল দৃষ্টিভঙ্গি হওয়ায় দর্শকের আবেগকে পোষ মানানো খুব সহজ হয়ে যায়। এর আগে বেদের মেয়ে জোসনা- কথা বলছিলাম। বেদের মেয়ে জোসনা তাঁর মতে লোককাহিনীর চিরন্তন আবেদনের প্রতীক। এ ছবির জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে যে, সরল যুক্তি আর সহজ জীবনবোধের প্রতি মানুষের রয়েছে সহজাত আকর্ষণ, যা সমকালীন জীবনের সকল বৈপরীত্য ও বিভ্রান্তিকে উপেক্ষা করে অনুপ্রাণিত হতে পারে।’    

এখন জীবনের এসব বৈপরীত্য ও বিভ্রান্তিকে উপেক্ষা করানো মানে দর্শককে এক-রকমের বুঁদ করে রাখা। ফাটাকেষ্টর মতো জনপ্রিয় সিনেমাও তাই করে। এই ফাটাকেষ্ট সিনেমা দেখার সময়ও দেখেছি দর্শক একদম মজে যায়; ওই আড়াই ঘণ্টা মনে হয় দিন-দুনিয়ার সবকিছু ভুলে যায়। তার মানে বলা যায়, জনপ্রিয় সিনেমা হচ্ছে জনতার আফিম। আর ‘এই ধারণা অনুসারে জনপ্রিয় সিনেমা মূলগতভাবেই মন্দ এবং সমাজের ওপর তার কুপ্রভাব রয়েছে। ...জনপ্রিয় সিনেমার বিরুদ্ধে মূল যে অভিযোগগুলো করা হয় তা হলো বাস্তবতার তথাকথিত অভাব, হিংসা ও যৌনতার প্রাধান্য, গ্ল্যামারের বাহুল্য উদ্দেশ্যে নির্মিত এ-ধারণার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়।’

কিন্তু জনপ্রিয় সিনেমার সঙ্গে বাস্তবতাকে বোঝার একটি উপায় সবসময়-ই থাকে। এই সিনেমা আমাদের অনেক সঙ্কটকে উপলব্ধি করায়; সঙ্কটের সমাধানও করে দেখায়। সেই সমাধানের ধরন কেমন তা উপরের তিনটি দৃশ্যে আমরা দেখেছি। এই সঙ্কট উত্তরণের ধরন অনেকটা স্বপ্নের মতোই। তাই স্বপ্নের মতো সিনেমার ক্ষেত্রেও আমাদের বোঝা দরকার, সিনেমার আপাত বাস্তবতার আয়ু ওই দুই থেকে আড়াই ঘণ্টাই। কিন্তু সিনেমা আর স্বপ্নের ভিতর দৃশ্যত বাস্তবতার পার্থক্য রয়েছে। স্বপ্ন ভাঙ্গার পর মানুষ স্বপ্নের বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, কিন্তু সিনেমা দেখার পর সাধারণ দর্শক সিনেমার বাস্তবতা নিয়ে খুব একটা প্রশ্ন তোলে না। এই লেখার পরবর্তী আলোচনায় আমরা সেই প্রশ্নগুলোই তোলার চেষ্টা করবো।

এতো নালি আধ-সের না!

আলোচনার এই অংশে আমরা দেখার চেষ্টা করবো চলচ্চিত্র দুটিতে ফাটাকেষ্ট যেসব সমস্যার সমাধান করে দেশ ও জাতিকে ‘উদ্ধার করেছেন, বাস্তবতার নিরিখে সেই সমস্যা সমাধানই উদ্ধারপ্রকল্পের জন্য যথেষ্ট কি না!

দৃশ্য চার : এমএলএ ফাটাকেষ্টতে সাত দিনের ক্ষমতা পেয়ে দ্বিতীয় দিনের শুরুতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে যখন তার কাজের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন, তখন এক বৃদ্ধা কাঁদতে কাঁদতে তার গাড়িবহর থামান। এরপর বৃদ্ধা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানান, স্বামীর চিকিৎসা করাতে নিঃস্ব হয়ে গেছে সে। হাসপাতালে নেওয়ার পর তার স্বামী মারা গেলেও চিকিৎসার বিল পরিশোধ করতে না পারায় লাশ হস্তান্তর করে না কর্তৃপক্ষ। ঘটনা শোনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছদ্মবেশে হাসপাতালে গিয়ে লাশ ছাড়িয়ে নেয়। পরে সেই লাশকে তিনি তার বাবা বলে চিকিৎসা করাতে আবার ভর্তি করান সেই হাসপাতালে। তারপর ডাক্তাররা তাকে মৃত জেনেও চিকিৎসার নামে টাকা হাতিয়ে নেয়। পরে ফাটাকেষ্ট ডাক্তারদের সেই ব্যক্তি যে আগেই মারা গেছে তার সনদ বা ডেথ সার্টিফিকেট দেখায় এবং তাদের ঘরে তুলে মারধর করে।

দৃশ্য পাঁচ : তৃতীয় দিনে ফাটাকেষ্ট বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করে। একই দিনে একটি পতিতালয়ে রেড দিয়ে গ্রেপ্তার করে বেশ কিছু লোককে। পরে মদের দোকানেও রেড দেওয়া দেখানো হয় এবং পুলিশ সেখানেও ক্রেতাদের মারধর করে।

দৃশ্য ছয়: মিনিস্টার ফাটাকেষ্টতে সমাজের একটা বড়ো সমস্যা হিসেবে দেখানো হয়েছে পুলিশকে। স্টার আনন্দ চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচারিত ‘জনতার আদালত নামের এক অনুষ্ঠানে আসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফাটাকেষ্ট। অনুষ্ঠানে মানসী নামের এক মেয়ে তার বাবার সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার ঘটনায় বিভিন্ন জায়গায় বিড়ম্বনা শিকারের কথা বর্ণনা করেন। এ-সময় ফ্ল্যাশব্যাকে দেখানো হয়-মানসীর বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হওয়ার পর তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। কর্তব্যরত ডাক্তার মানসীকে আগে পুলিশে এফআইআর  করতে বলে। কিন্তু মানসী মুখার্জি এফআইআর  করতে বকুলতলা থানায় গেলে ঘটনাটি কোথায় ঘটেছে জানতে চায় পুলিশ। দুর্ঘটনাটি সিটিরোড এলাকায় বললে পুলিশ ওই এলাকা শিবপুর থানার অধীন বলে সেখানে যেতে বলে। কিন্তু মানসী সেখানে গেলে তারাও বলে সে এলাকা তাদের নয়। এরই মধ্যে তার বাবা মারা যায়। এই ঘটনা শোনার পর ফাটাকেষ্ট নতুন একটি পন্থা অবলম্বন করে। ঘটনাস্থলে লাঠি-শোঠাসহ মানুষ ভর্তি ট্রাক নিয়ে গিয়ে তাকে চোরাই পণ্য বললে দুই থানাই সেটি তাদের এলাকা বলে দাবি করে। পরে পুলিশের ওপর ট্রাকের ভিতরে থাকা ফাটাকেষ্টর লোকজন হামলা চালিয়ে মারধর করে।  

পাঠক, এই সমস্যাগুলো কিংবা সিনেমা দুটিতে যেসব সমস্যার সমাধান দেখানো হয়, সে-গুলো আসলে সমাজের খণ্ডিত বাস্তবতা। রাষ্ট্র থেকে এসব সমস্যা দূর করতে হলে সামগ্রিক বাস্তবতাটাকেই দেখতে হবে। কয়েকটি মাস্তানকে পিটিয়েই শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। রাস্তাঘাটের মাস্তান অপরাধবৃক্ষের একদমই উপরের অংশে বিরাজ করে। সেটি কেটে ফেললে বৃক্ষের কিছুই যায়-আসে না। সময়ের ব্যবধানে তা আবার পরিপূর্ণ হবে। মূলধারার অথবা জনপ্রিয় ধারার এসব সিনেমাতে সামগ্রিক বাস্তবতা দেখা সম্ভব নয়। কারণ, তা দেখতে গেলে প্রতিষ্ঠানবিরোধী কথা বলতে হবে। প্রশ্ন তুলতে হবে, বিরাজমান রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের ভিতরে থেকে তো আর আপনি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যেতে পারবেন না। তাই যেটি করতে হয়, প্রতিষ্ঠানের ভিতর থেকে সিনেমা বানাতে হয়, ব্যবসা করতে হয়, আবার প্রতিষ্ঠানকেও ঠিক রাখতে হয়। ফাটাকেষ্ট বস্তির মানুষকে বস্তিতে থাকার ব্যবস্থাই করে দেয়। সে কেবল বাধা দেয় বস্তিবাসীর বাসস্থানের সেই নূন্যতম অধিকারটুকু কেড়ে নেওয়ার সময়ই। শেষমেশ যা হয়, বস্তিবাসীকে থাকতে হয় বস্তিতেই। কিন্তু গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রে বস্তিই তো থাকার কথা নয়। বস্তি বিষয়টিই সমাজের কিংবা রাষ্ট্রের অনেকগুলো সমস্যার প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু তারপরও আমাদের ভালো লাগে। কারণ, প্রতিনিয়ত মন যা চায় বাস্তবে না হোক, সেলুলয়েডে অন্তত তার বাস্তবায়ন দেখি।

বিশ্বের চলচ্চিত্র ইতিহাসের দু-একজন পথিকৃতকে টেনে এনে অবশ্য উপরের বক্তব্যের বিরোধিতা করা যেতে পারে। চার্লি চ্যাপলিনের কথা বলতে চাচ্ছি; যিনি প্রতিষ্ঠানের ভিতর থেকে দর-কষাকষি করেছেন। তিনি কখনও প্রতিষ্ঠানকে মেনে নিয়েছেন, কখনও প্রতিষ্ঠানকেই মানিয়েছেন। তাহলে এখন মূলধারার চলচ্চিত্র তা পারছে না কেনো-এমন প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক এবং যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু আমার কাঁচা মাথায় যেটি মনে হয়, এখনকার জনপ্রিয় সিনেমা হয়তো চার্লি চ্যাপলিনকে আদর্শ হিসেবে মানতে নারাজ। আর তাদের এই অসন্তুষ্টির পিছনে হয়তো ‘চ্যাপলিন-ইতিহাস থেকে এই উপলব্ধি কাজ করে যে, চ্যাপলিনকে তো শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানকে ভাঙ্গার প্রচেষ্টার দায়ে দেশান্তরি হতে হয়েছিলো। তাই পরবর্তী সময়ে জনপ্রিয় সিনেমার কেউ আর প্রতিষ্ঠানের ভিতরে থেকে প্রতিষ্ঠানকে ভাঙ্গতে চায়নি। এই ধাঁচের চলচ্চিত্র সবসময় গ্র্যান্ড-ন্যারেটিভের মধ্যে থাকতে চেয়েছে। এতে মেনে নিতে হয়েছে প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের শর্ত। আর শর্ত পূরণের পর ফাটাকেষ্ট সিনেমা আমাদের যা দেখায় তা তো নন্দনতত্ত্বের মৌলিক কোনো দিক উন্মোচন করতে পারেই-না; এমনকি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের মধ্যে কোনো উদ্বেগের জন্ম দিতেও অক্ষমতার পরিচয় দেয়। নামডাকহীন নির্মাতা তো আছেই; এ-ধরনের অভিযোগ তো সত্যজিতের বিরুদ্ধেই খুব জোড়ালোভাবে তোলা হয়। বলা হয় ‘‘সত্যজিৎ রায় কি এরকম শিল্পীর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ? তার ছবি প্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ করে নি বড়জোর প্রশ্ন করেছে এবং তার নৈতিকতা এবং শ্রেয়বোধ প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত প্যারাডাইমকে অতিক্রম করে নি। তার জিজ্ঞাসাবাদ তাই প্রতিষ্ঠানকে বিব্রত করলেও বিচলিত করে নি; তিনি ব্যাপকভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন-কিন্তু তার ছবি চলচ্চিত্র নন্দনতত্ত্বের কোনো মৌলিক সম্ভাবনার সূত্রপাত করে নি। তার ছবি এমন বিষয়ে প্রশ্ন করে নি, এমন সব বিষয়ে চিন্তার কোনো নতুন ধারার সূত্রপাত করে নি যা প্রতিষ্ঠানের মাথাব্যাথার কারণ হতে পারে।’

তার মানে এই অভিযোগে অভিযুক্ত চলচ্চিত্র সবসময় প্রতিষ্ঠানের কিংবা ক্ষমতার স্বার্থে কাজ করে। সমাজের নিগৃহীত মানুষের সামনে অত্যাচারের বিরুদ্ধে ভোগাস্‌ একটি জয়মালা উপস্থাপন করে মূলত প্রদর্শন করে এক ধরনের ধান্দাবাজি। আর এই জয়ের দৃশ্য মানুষ বারবার দেখে আর ঠকে। এর অন্তরালে ফাটাকেষ্টর মতো সিনেমা জনপ্রিয় হতে থাকে, হতে থাকে ব্যবসাসফল। কিন্তু আম-দর্শকের কাছে অজানাই থেকে যায় যে, ‘আসলে ‘‘সংস্কৃত ইন্ডাস্ট্রি সংস্কৃতির নামে তৈরি করে এমন বিনোদন যা আর দশটি পণ্যের মতো বিপণন করা যায়। ...এক্ষেত্রে শিল্পমান বা মানবিকীকরণ মূখ্য ব্যাপার নয়। এসব কিছুতে বিপণনের মাধ্যমে পুঁজি বা মুনাফা লাভই মূখ্য।’

অযৌক্তিক উপায়ে সহজ সমাধান

পাঠক, আমার তো মনে হয় ফাটাকেষ্ট সমাজের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে নিজেই সমস্যায় রূপ নেয়। কারণ, তার চলচ্চিত্র দুটিতে তার সবগুলো ইচ্ছার প্রতিফলনে দেখি স্বৈরতান্ত্রিক বিচারবুদ্ধির প্রয়োগ। এই প্রয়োগে সে কখনও প্রক্রিয়ার বৈধতা-অবৈধতা নিয়ে ভাববার প্রয়োজনবোধ করে না। বিভিন্ন দৃশ্য ধরে এখন এই বিষয়গুলো দেখার চেষ্টা করবো-

দৃশ্য সাত : এমএলএ ফাটাকেষ্ট-তে পোড়া বস্তি পরিদর্শনে এসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রণদেব পাল গুণ্ডা ফাটাকেষ্টকে সাত দিনের জন্য মন্ত্রী হওয়ার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। সেই চ্যালেঞ্জকে প্রথমে গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেও পরে তা গ্রহণ করে ফাটাকেষ্ট। এরপর স্টার আনন্দের জনমত জরিপ আর মন্ত্রীসভায় বিরোধীদলের চাপে সাত দিনের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয় ফাটাকেষ্টকে।

দৃশ্য আট : মিনিষ্টার ফাটাকেষ্ট সিনেমাটিতে দেখা যায়, বাজেট-ঘাটতির চার হাজার কোটি টাকা ফাটাকেষ্ট মাত্র সাত দিনে কোনো ঋণ ছাড়া জোগাড় করার চ্যালেঞ্জ নেন। আর সেই জন্য সাত দিনের মেয়াদে অর্থমন্ত্রী হয় ফাটাকেষ্ট। এই সাত দিনেই বাজেটের ঘাটতি চার হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন পদ্ধতির সাহায্যে জোগাড় করে সে। মানুষকে কাজের নিরাপত্তা দিয়ে কাজ করিয়ে, কখনও জিনিস কেনার পর জনগণকে ভ্যাট দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে, আবার কখনও লক্ষীর ভাঁড় পদ্ধতির সাহায্যে সে পুরো টাকাটা সংগ্রহ করে।

দৃশ্য নয়: এমএলএ ফাটাকেষ্টতে ফাটাকেষ্টর মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পঞ্চম দিনে এক ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায় রাস্তার পাশে। অপরাধীর বিচার না করা পর্যন্ত এলাকাবাসী সেই লাশ সরাতে দেবে না বলে জানায়। অপরাধী অনেক ক্ষমতাধর হওয়ায় তাকে গ্রেপ্তার করাও হয় না। ঘটনাস্থলে পৌঁছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফাটাকেষ্ট পুলিশের কাছে সব জানতে চায়। ঘটনা শোনার পর ফাটাকেষ্ট পুলিশকে বলে, ‘পুলিশকে বন্দুক দেওয়া হয় অপরাধী মারার জন্য। অপরাধীদের হাতে মরার জন্য নয়।’ আর পরক্ষণেই দেখা যায়, পুলিশ সবধরনের অপরাধীদের গুলি করে হত্যা করে।

দৃশ্য সাতে আমরা দেখি ফাটাকেষ্ট সাত দিনের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পায়। এই মন্ত্রিত্ব সে নেয় চ্যালেঞ্জ হিসেবে। চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়ার কারণে এই প্রক্রিয়ায় দায়িত্বের বৈধতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, ফাটাকেষ্টকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া হবে কি হবে না-এই সিদ্ধান্ত নিতে যখন মন্ত্রীসভায় হাত তুলে সবার মতামত নেওয়া হয়, তখন প্রতিটি দর্শকই ফাটাকেষ্টর পক্ষে ছিলেন। বাকি দুটি ঘটনার ক্ষেত্রেও দর্শক মনের অবস্থান ওই একই হওয়ার কথা। আর এর পিছনে যুক্তি হিসেবে কাজ করেছে ইচ্ছার বাস্তবায়ন।

দৃশ্য আটের কথা যদি বলি, তাহলে দেখবো ফাটাকেষ্ট মাত্র সাত দিনেই চার হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেন। কিন্তু এই বাস্তবায়ন বাস্তবে মনে হয় এতো সহজ হওয়ার কথা নয়। কারণ, ফাটাকেষ্টর ভাষ্যমতে রাজ্যের লোকসংখ্যা আট কোটি, সে-ক্ষেত্রে চার হাজার কোটি টাকা তুলতে হলে সবার কাছ থেকে মাথাপিছু পাঁচশ টাকা করে নিতে হবে। আর স্বেচ্ছায় কতোজন মানুষ পাঁচশ টাকা দিবে কিংবা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে তা ফাটাকেষ্ট ভেবে দেখে না। কারণ, এই মানুষদের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে গাস্তঁ রোবের্জ বলেছেন, ‘‘...তাদের যদি সত্যিকার ঐতিহাসিক রাজনৈতিক বিন্যাসে বাস্তব অবস্থান নিতে আহ্বান করা হয়, যে অবস্থা অবশ্যম্ভাবী বিরোধিতার, তারা সে আহ্বান মেনে নেবে কিনা।’ আমরা যদি গাস্তঁ রোবের্জ-এর সঙ্গে একমত হই তাহলে ফাটাকেষ্ট সিনেমা দুটি নিয়ে এই আশঙ্কা প্রকাশ করতেই পারি যে, যারা একটা মোহ নিয়ে প্রেক্ষাগৃহের অন্ধকারে বসে ঘণ্টা দুয়েক ধরে ফাটাকেষ্টকে সমর্থন দিয়ে এসেছেন, তারা বাস্তবে ফাটাকেষ্টকে মেনে নিবেন কিনা! যদি মেনে নিতো তাহলে উপরের নয় নম্বর দৃশ্য ধরে বলতে পারি, মানুষ ক্রসফায়ারকে তর্কাতীতভাবে মেনে নিতো; কোনো প্রশ্নই তুলতো না।

উপরের দৃশ্যগুলোতে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, সিনেমা দুটিতে শোষক এবং শোষিত-এই দুইয়ের একটি দ্বন্দ্ব বিরাজমান। আর এই দ্বন্দ্ব দর্শকের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার অংশ। সমাজের যে-সত্তা এই ধরনের সিনেমা দেখে মানসিকভাবে ক্ষণিকের জন্য প্রশান্তি লাভ করে তা মূলত সেই শাসিত শ্রেণীর সত্তা, দাসত্ব শ্রেণীর সত্তা। এখন এই দ্বন্দ্বের সঙ্গে এই জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের একটি প্রত্যক্ষ সম্পর্ক দৃশ্যমান। যে-সম্পর্কে ‘চলচ্চিত্র শাসক শ্রেণীর ভিজ্যুয়াল মনস্তত্ত্বের অভিব্যক্তি (রাজনীতি, ধর্মবোধ, ভোগ্যপণ্য বিপণন এবং সামাজিক প্রপাগান্ডা- যেমন: জন্মনিয়ন্ত্রণ ও উচ্চফলনশীল বীজের ব্যবহার)।’ কিন্তু বারবার একই প্রশ্ন উঠে আসছে শাসকের এই অভিব্যক্তি শোষিতরা মেনে নিচ্ছে কেনো? এর উত্তর ইংরেজ কবি লোকরিজের ভাষায় দেওয়া যেতে পারে। তিনি মনে করেন ‘উইলিং সাসপেনশন অব ডিসবিলিফ অনুসরণে শ্রোতা-দর্শক কোনো প্রশ্ন না করেই সবকিছু গ্রহণ করে। ফাহমিদুল হকের বক্তব্যেও আমরা এর সমর্থন পাই। তার মতে ‘তাদের যা-ই দেওয়া যায়, তা-ই তারা গ্রহণ করে নেয় কোনোরকম অবিশ্বাস ছাড়া। কারণ, তাদের কাছে ‘হিরো হচ্ছে সুপার হিরো-অসাধারণ এবং অমর।’ সেই জায়গা থেকে ফাটাকেষ্ট যা করে আমরা সাধারণ দর্শকরা তা মেনে নিই; কোনো ধরনের বাছবিচার ছাড়া। আর বাছবিচার করবো কী, আমাদের তো কখনও বিষয়টি নিয়ে কোনো খট্‌কা লাগেনি। লাগার কথাও নয়। কারণ ‘‘সংস্কৃত ইন্ডাস্ট্রি’র ধারণা অনুযায়ী-পুঁজিবাদী এই সমাজে ‘‘সংস্কৃত ইন্ডাস্ট্রি’ এমন সব পণ্য তৈরি করে যে-গুলোর লক্ষ্যই থাকে পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রয়োজন মেটানো। আর এই কাজটি করা হয় জীবনকে বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে।

 শেষ কথা

আলোচনা শুরু করেছিলাম ফাটাকেষ্টর জনপ্রিয়তা দিয়ে। মনে করছি, শেষও করবো সেই জনপ্রিয়তার ঘটনা দিয়ে। ‘এ কেমন ‘ফাটাকেষ্ট!’ শিরোনামে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ১০ পড়ে জানা যায়, মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা এবং পৌর মেয়র আহমদ আলী এলাকায় প্রভাবশালী ব্যক্তি। তিনি এলাকার সাধারণ মানুষের বিপদে সাহায্য করেন। আবার তার কথা না শুনলে সাধারণ মানুষ থেকে সরকারি-বেসরকারি সব কর্মকর্তাদের মারধর করেন। তার চরিত্র ফাটাকেষ্টর মতো হওয়ায় এলাকায় তারও পরিচিতি ফাটাকেষ্ট নামে। আর ফাটাকেষ্ট নামে ডাকলেই নাকি তিনি খুশি হন। পাঠক, আজকের আলোচনায় একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে আমার অবস্থানের সঙ্গে এই সংবাদটি মিলিয়ে দেখবেন। পৌর মেয়রের মারধরের এই ঘটনা সমাজের জন্য মোটেই ইতিবাচক নয়। কারণ, এটি সমস্যা সমাধানের কোনো উপায় হতে পারে না। পৌর মেয়র আহমদ আলীর মতো সমাজের সব কর্তাব্যক্তি যদি নিজের মতো করে সমাজ পরিবর্তন করতে যান তাহলে যেটি হবে যে, সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে নতুন সমস্যার সৃষ্টি হবে। কিন্তু চলচ্চিত্র দেখার সময় কিন্তু দর্শক বুঝতে পারে না, পর্দায় বাস্তবতার গড়মিলটা কোন্‌ জায়গায়। কারণ ওই যে একটু আগেই বললাম, জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে জীবনকে তুলে ধরা হয় বাস্তবসম্মতভাবে!



লেখক : ইমরান হোসেন মিলন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।

milonmcru@gmail.com

 

তথ্যসূত্র

১. ‘‘ছয়টা গান+দশটা মারপিট+একটা প্রেম= বাংলা ছবি?’; প্রথম আলো, ২৭ আগস্ট ২০০৯।

২. হোসেন, মাহমুদুল (২০১০ : ৮৫); ‘‘চলচ্চিত্রে মতানৈক্যের কণ্ঠস্বর: বিকল্প চলচ্চিত্র’; সিনেমা; ধানমণ্ডি, ঢাকা।

৩. প্রাগুক্ত; হোসেন, মাহমুদুল (২০১০ : ৯৪)।

৪. রোবের্জ, গাস্তঁ (২০১১ : ৩১); ‘জনপ্রিয় সিনেমার আলোকে ‘শোলে’; চলচ্চিত্র সমালোচনা ১৫; সম্পাদক-অজয় সরকার; বাণীশিল্প, কলকাতা।

৫. প্রাগুক্ত; হোসেন, মাহমুদুল (২০১০ : ৮৬)।

৬. হক, ফাহমিদুল ও শাখাওয়াত মুন (২০০৪ : ৯৬); ‘‘চলচ্চিত্র যখন নেহায়েতই ‘সংস্কৃত ইন্ডাস্ট্রি’র উৎপাদ : পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ’; চলচ্চিত্রের সময়, সময়ের চলচ্চিত্র; ঐতিহ্য প্রকাশনী, ঢাকা।

৭. রোবের্জ, গাস্তঁ (২০০৪ : ১১৬); ‘‘বেদের মেয়ে যোস্‌না : তিন পিতার কন্যা’; সংযোগ সিনেমা উন্নয়ন; বাণী শিল্প, কলকাতা।

 ৮. প্রাগুক্ত; হোসেন, মাহমুদুল (২০১০ : ৮৪)।

৯. ‘প্রিয়া আমার জান, আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের দেয়ালে আরেকটি ইট’; প্রথম আলো, ১৭ নভেম্বর ২০১১।

১০. ‘এ কেমন ‘ফাটাকেষ্ট!’; কালের কণ্ঠ; ১ জুন ২০১২।


বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৩ সালের জুলাইয়ের ম্যাজিক লণ্ঠনের তৃতীয় সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।



এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন