আকিরা কুরোসাওয়া
প্রকাশিত ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
‘যুদ্ধের সময় যিশু-দেবদূত সবাই সামরিক বাহিনীর প্রধানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়’
আকিরা কুরোসাওয়া
১৯৫০ সালের কথা। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ইতালির ‘এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্ম স্কুল’-এর ছাত্র; স্বপ্ন, নির্মাতা হবেন। যদিও পরে নির্মাতা না হয়ে লেখক হয়েছিলেন মার্কেজ। তার পরও চলচ্চিত্র তাকে ছাড়েনি, বন্ধুদের নিয়ে ১৯৫৪ সালে লা লেনগুস্তা আউল নামে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং পরে অভিনয়ও করেছেন। জীবনের শুরুতে চলচ্চিত্রের প্রতি যে ভালোবাসা জন্মেছিলো, তা তিনি বয়ে চলেন সারাজীবন। তাইতো নোবেল পুরস্কারের অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অব সিনেমা অ্যান্ড টেলিভিশন’, কিউবা। তার প্রায় প্রতিটি উপন্যাস থেকে বিভিন্ন দেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে।
অন্যদিকে আকিরা কুরোসাওয়া; ২০১৪ সালের ৬ সেপ্টম্বর ছিলো তার ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। জাপানের প্রখ্যাত এই নির্মাতা ৫৭ বছরের কর্মজীবনে নির্মাণ করেছেন ৩০টি চলচ্চিত্র। কুরোসাওয়া’র রাশোমন ১৯৫১ সালে ভেনিস উৎসবে ‘গোল্ডেন লায়ন’ পুরস্কার অর্জন করে। রাশোমন-এর সফলতায় পাশ্চাত্যের বাজার জাপানের চলচ্চিত্রশিল্পের জন্য প্রথমবারের মতো উন্মুক্ত হয়; যা জাপানি নির্মাতাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও এনে দিয়েছিলো। এছাড়া কুরোসাওয়া ১৯৯০ সালে আজীবন সম্মাননা হিসেবে ‘অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। ‘এশিয়ান উইক’ ম্যাগাজিন এবং সি এন এন তাদের ‘শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি’ বিভাগে কুরোসাওয়াকে মরণোত্তর ‘এশিয়ান অব দ্য সেঞ্চুরি’ নামে আখ্যায়িত করে; গত একশো বছরে এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা পাঁচ জনের একজন হিসেবেও তাকে স্বীকৃতিও দেয়।
কুরোসাওয়া নির্মিত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হলো—দ্য মোস্ট বিউটিফুল (১৯৪৪), নো রিগ্রেটস ফর আওয়ার ইয়ুথ (১৯৪৬), ওয়ান ওয়ান্ডারফুল সানডে (১৯৪৭), ড্রাঙ্কেন অ্যাঞ্জেল (১৯৪৮), স্ক্যান্ডাল (১৯৫০), দ্য ইডিয়ট (১৯৫১), টু লিভ (১৯৫২), সেভেন সামুরাই (১৯৫৪), আই লিভ ইন দ্য ফেয়ার (১৯৫৫), দ্য ব্যাড স্লিপ ওয়েল (১৯৬০), দ্য বডিগার্ড (১৯৬১), হাই অ্যান্ড লো (১৯৬৩), রেড বিয়ার্ড (১৯৬৫), দোদেসকাদেন (Dodesukaden, ১৯৭০), ডার্সু উজালা (Dersu Uzala, ১৯৭৫), দ্য শ্যাডো ওয়ারিয়র (১৯৮০), রান (১৯৮৫), ড্রিমস (১৯৯০), নট ইয়েট (১৯৯৩)।
১৯৯০ সালের অক্টোবরে রাহ্পসোডি ইন অগাস্ট (Rhapsody in August) চলচ্চিত্রের শুটিং চলাকালে টোকিওতে কুরোসাওয়ার এই সাক্ষাৎকারটি নেন মার্কেজ।
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ : আমি চাই না, আমাদের দুই বন্ধুর এই কথোপকথন গণমাধ্যমের সাক্ষাৎকারের মতো হয়ে উঠুক। কিন্তু আপনার এবং আপনার কাজকর্মের অনেক বিষয় নিয়ে আমার জানার বেশ আগ্রহ আছে। শুরুতেই আমার জানতে ইচ্ছে করছে, কীভাবে আপনি চিত্রনাট্য লেখেন সেই বিষয়টি। কারণ, আমি নিজেও চিত্রনাট্য লিখি। দ্বিতীয়ত, আপনি বিখ্যাত অনেক সাহিত্যকর্ম অত্যন্ত চমৎকারভাবে চিত্রনাট্যে রূপ দিয়েছেন। আমি যেসব চিত্রনাট্য তৈরি করেছি কিংবা তৈরি করতে চেয়েছিলাম, সেগুলোর অভিযোজ্যতা (সাহিত্যকর্ম থেকে চিত্রনাট্যে রূপ দেওয়া) নিয়ে আমার বেশ সন্দেহ আছে।
আকিরা কুরোসাওয়া : আমি যখন চিত্রনাট্য লেখার জন্য কোনো মৌলিক বিষয় নিয়ে চিন্তা করি, তখন পেন্সিল আর কাগজ নিয়ে সোজা কোনো হোটেলে গিয়ে উঠি। এই সময়ে চলচ্চিত্রটির কাহিনি সম্পর্কে আমার একটা সাধারণ ধারণা থাকে এবং চিত্রনাট্যটি কীভাবে শেষ হবে সে সম্পর্কেও মোটামুটি একটা জানাশোনা থাকে। যদি কোনো ক্ষেত্রে এগুলো আমার জানা না থাকে, মানে ঠিক কোন্ দৃশ্য দিয়ে চিত্রনাট্যটি লেখা শুরু করবো; সেক্ষেত্রে আমি চিন্তার গতানুগতিক ধারাই অনুসরণ করি, যা প্রকৃতিগতভাবেই বেড়ে ওঠে।
মার্কেজ : আচ্ছা, আপনি যখন কোনো চিত্রনাট্য লেখেন, তখন আপনার মনে প্রথমে ধারণা আসে নাকি দৃশ্য?
কুরোসাওয়া : আমি বিষয়টি ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবো না; কিন্তু আমি মনে করি, চিত্রনাট্য শুরু হয় বিভিন্ন ধরনের বিচ্ছিন্ন দৃশ্য দিয়ে। যেমন দেখুন, আমি জানি জাপানের চিত্রনাট্যকাররা প্রথমে চিত্রনাট্যের একটি সামগ্রিক রূপরেখা তৈরি করে দৃশ্য অনুযায়ী সেগুলো সাজান। এভাবে পুরো কাহিনি সাজানোর পর তারা লিখতে শুরু করেন। কিন্তু আমার মনে হয়, একমাত্র ঈশ্বর হলেই এ পদ্ধতিতে চিত্রনাট্য লেখা যেতে পারে!
মার্কেজ : শেক্সপিয়ার, গোর্কি বা দস্তয়ভস্কির সাহিত্যকর্মকে চিত্রনাট্যে রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রেও কি আপনি একই নিয়ম বা কৌশল অনুসরণ করেন?
কুরোসাওয়া : যেসব নির্মাতা অন্যের করা চিত্রনাট্য দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, তারা হয়তো বুঝতেই পারেন না, সাহিত্যকে চলচ্চিত্রে রূপায়ণের মাধ্যমে দর্শকের কাছে তুলে ধরা কতোটা জটিল। উদাহরণস্বরূপ চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হবে এমন কোনো গোয়েন্দা উপন্যাসের কথা বলা যেতে পারে, যেখানে রেল লাইনের ধারে একটি মৃতদেহ পড়ে আছে; একজন তরুণ নির্মাতা উপন্যাসে যে জায়গায় যেভাবে লাশের বর্ণনা দেওয়া আছে ঠিক সেভাবেই চলচ্চিত্রে তুলে ধরার ওপর জোর দিয়ে থাকেন। আমি বলি, ‘সে ভুল করছে।’ সমস্যাটি হলো আপনি এরই মধ্যে উপন্যাসটি পড়েছেন এবং আপনি জানেন, রেললাইনের ধারে একটি মৃতদেহ দেখা গেছে। কিন্তু যে লোক উপন্যাসটি পড়েনি, তার জন্য ওই জায়গাটি বিশেষ কোনো গুরুত্ব বহন করে না। অথচ ওই তরুণ নির্মাতা কোনো কিছু না বুঝে সাহিত্যের জাদুকরী ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়। চলচ্চিত্রে দৃশ্যটিকে অবশ্যই ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
মার্কেজ : আপনার বাস্তব জীবনের এমন কোনো ঘটনার কথা মনে পড়ে, যা চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়া অসম্ভব বলে মনে হয়?
কুরোসাওয়া : হ্যাঁ। খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ শহর ইলিডাচি’তে (Ilidachi) আমি তরুণ বয়সে একবার সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলাম। নির্মাতা সেখানে পৌঁছে প্রথম দেখাতেই দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, আবহটা চমৎকার ও অদ্ভুত; সে কারণেই আমরা শহরের কিছু দৃশ্য শুট করি। কিন্তু ধারণ করা দৃশ্যগুলো দেখতে গিয়ে দেখা গেলো, শহরটাকে কেনো জানি একদমই সাদামাটা লাগছে। এই শহর সম্পর্কে আমরা যেমনটি জেনেছিলাম তা মোটেও সেলুলয়েডে আসছে না। মূলত ওই শহরে কাজের পরিবেশ ছিলো খুবই ভয়ানক এবং নারী ও শিশু খনিশ্রমিকরা নিরাপত্তা নিয়ে সর্বদা আতঙ্কের মধ্যে থাকতো। এই ধরনের একটি মানসিক অবস্থা নিয়ে কোনো শ্রমিক যখন গ্রামের দিকে তাকায়, তখন সেখানকার বিশাল খোলা মাঠ দেখে সে দ্বিধান্বিত হয়। ফলে সেটা বাস্তবের চেয়ে অদ্ভুত হয়ে তার চোখে ধরা দেয়; ঠিক আগন্তুক হিসেবে যেমনটি আমাদেরও হয়েছিলো। কিন্তু ক্যামেরার চোখে বিষয়টি ঠিক ওইভাবে উঠে আসছিলো না।
মার্কেজ : সত্য হলো, আমি খুব কম ঔপন্যাসিককে দেখেছি যারা তাদের সাহিত্যের চলচ্চিত্রায়ণ দেখে সন্তুষ্ট হতে পেরেছেন। এক্ষেত্রে আপনার অভিজ্ঞতার কথা আমাদের যদি বলতেন?
কুরোসাওয়া : তার আগে আমাকে একটি প্রশ্ন করার অনুমতি দিন—আপনি কি আমার রেড বিয়ার্ড দেখেছেন?
মার্কেজ : এই চলচ্চিত্রটি আমি ২০ বছরে কমপক্ষে ছয়বার দেখেছি। যতোদিন পর্যন্ত আমার সন্তানরা এই চলচ্চিত্রটি দেখেনি, ততোদিন প্রায়ই আমি তাদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতাম। তাই এটি শুধু আমার ও আমার পরিবারের কাছে আপনার সেরা চলচ্চিত্রগুলোর একটিই না; আমার কাছে পুরো চলচ্চিত্র ইতিহাসের সেরা চলচ্চিত্রের একটি।
কুরোসাওয়া : নির্মাতা হিসেবে আমাকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে রেড বিয়ার্ড একটি ভালো উদাহরণ। রেড বিয়ার্ড-এর আগের সব চলচ্চিত্রই এটি থেকে আলাদা। এটি ছিলো একটি অধ্যায়ের শেষ এবং আরেকটি অধ্যায়ের শুরু।
মার্কেজ : হ্যাঁ, এটি পরিষ্কার বোঝা যায়। তাছাড়া এই চলচ্চিত্রে দুটি দৃশ্য আছে, যার সঙ্গে আপনার প্রায় সব কাজের একটি গভীর সম্পর্ক পাওয়া যায়। দৃশ্য দুটির একটিও ভুলবার মতো নয়; যার একটি ম্যান্টিস-এর (পতঙ্গবিশেষ) প্রার্থনা আর অন্যটি হাসপাতালের সামনে ক্যারাটে মারামারির দৃশ্য।
কুরোসাওয়া : হ্যাঁ, কিন্তু আমি আপনাকে বলতে চেয়েছিলাম এই উপন্যাসের লেখক শুগুরো ইয়ামামোতো (Shuguro Yamamoto; জাপানি লেখক, ১৯০৩-১৯৬৭) সম্পর্কে, যিনি বরাবরই তার সাহিত্যকর্ম থেকে চলচ্চিত্র-নির্মাণের বিরোধিতা করতেন। কিন্তু রেড বিয়ার্ড-এর ক্ষেত্রে বিষয়টি অন্যরকম হয়েছিলো। আমি মূলত চলচ্চিত্রটি নির্মাণের জন্য চরম জেদ নিয়ে সফল না হওয়া পর্যন্ত দিনের পর দিন কঠোর পরিশ্রম করেছি। তারপর শুগুরো ইয়ামামোতো একদিন চলচ্চিত্রটি দেখলেন; দেখা শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভালো, এটা আমার উপন্যাসের চেয়ে অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক।’
মার্কেজ : আমার জানতে ইচ্ছে করছে, কেনো তিনি চলচ্চিত্রটি এতো বেশি পছন্দ করেছিলেন?
কুরোসাওয়া : কেননা, চলচ্চিত্রটির অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তার স্পষ্ট ধারণা ছিলো। তিনি শুধু আমাকে একটি অনুরোধই করেছিলেন, মূল চরিত্রটি মানে একজন নারীর ব্যর্থতার বিষয়টি চিত্রায়ণে যেনো আমি সতর্ক থাকি। চলচ্চিত্রে তিনি ওই নারী চরিত্রটিকে সেভাবেই দেখতে চেয়েছিলেন, যেভাবে তিনি ওই নারীকে দেখেছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ব্যর্থ সেই নারী চরিত্রটি তার উপন্যাসেই স্বতঃস্ফূর্ত ছিলো না।
মার্কেজ : সম্ভবত, ইয়ামামোতো’র ভাবনায় ওই নারী ছিলো। আমাদের মতো ঔপন্যাসিকদের ক্ষেত্রে প্রায়ই এ ধরনের কিছু আশ্চর্য ঘটনা ঘটে।
কুরোসাওয়া : হয়তো এমনটিই হয়েছে। এমনকি, কিছু লেখক তাদের সাহিত্য অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র দেখে বলেন, ‘আমার উপন্যাসের ওই অংশটি সুন্দরভাবে চিত্রায়ণ হয়েছে।’ আবার সেই লেখকরা এমন কিছু দৃশ্যের প্রশংসা করেন, যেগুলো সরাসরি তার সাহিত্যে নেই, নির্মাতা নিজে হয়তো চিত্রনাট্য করার সময় যোগ করেছেন। আমি তখন বুঝতে পারি—তারা ঠিক কী বলছেন, কেননা পর্দায় তারা এমন কিছুর পরিচ্ছন্ন প্রকাশ দেখেন, যা হয়তো তিনিই লিখতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি।
মার্কেজ : এটা জানা কথা— ‘পোয়েটস্ আর মিক্সারস্ অব পয়জন্স।’ কিন্তু এবার আপনার বর্তমান চলচ্চিত্রের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এই চলচ্চিত্রে টাইফুন-এর বিষয়টি কি সবচেয়ে কঠিন হবে?
কুরোসাওয়া : না। চলচ্চিত্রে প্রাণী নিয়ে কাজ করা সবচেয়ে জটিল; জলে থাকা সাপ, গোলাপ খেকো পিঁপড়া—এগুলো। গৃহে পোষা সাপ মানুষের সঙ্গে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে উঠে যে, তারা সহজে পালাতে চায় না; আর তাদের আচরণ হয় অনেকটা বাইন মাছের মতো। এ সমস্যা সমাধানের জন্য আমাকে প্রচুর বন্য সাপ ধরতে হয়েছিলো। সাপগুলো সবসময় পালানোর চেষ্টা করতো, যাতে সত্যিই ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার মতো বিষয় ছিলো। তার পরও সাপগুলো দিয়ে ভালোভাবেই কাজ হয়েছিলো।
এবার পিঁপড়া প্রসঙ্গে আসি, সারিবদ্ধভাবে পিঁপড়া গাছ বেয়ে একটি গোলাপ পর্যন্ত পৌঁছাবে কি না তা নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছিলো। কারণ আমরা গোলাপ গাছের কাণ্ডে মধু দিয়ে পরীক্ষা করার আগ পর্যন্ত পিঁপড়াগুলো গাছে উঠতে দীর্ঘ সময় নারাজ ছিলো। অথচ মধু দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পিঁপড়াগুলো গাছ বেয়ে উঠে গিয়েছিলো। মূলত এ কাজ করতে গিয়ে আমাদের অনেক জটিলতা ছিলো। আর ওই জটিলতাগুলো ছিলো চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে খুবই মূল্যবান। কারণ ওই প্রাণীগুলো নিয়ে আমাকে প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়েছিলো।
মার্কেজ : হ্যাঁ, সেটা আমি লক্ষ করেছি। কিন্তু এটা কোন্ ধরনের চলচ্চিত্র যেখানে পিঁপড়া নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন, যেমনটি পড়েছেন টাইফুন নিয়েও? চলচ্চিত্রের কাহিনি কী?
কুরোসাওয়া : অল্প কথায় এর কাহিনি বলা খুবই কঠিন।
মার্কেজ : সেখানে কেউ কি কাউকে হত্যা করেছে?
কুরোসাওয়া : না, ঠিক তা নয়। চলচ্চিত্রটি নাগাসাকি থেকে আসা এক সাধারণ বৃদ্ধ নারীকে নিয়ে, যিনি পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পরও বেঁচে ছিলেন এবং গত গ্রীষ্মে তার নাতি-নাতনিরা তাকে দেখতে এসেছিলো। তবে চলচ্চিত্রটিতে দর্শককে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করে বা তাদের জন্য দুঃসহনীয় হবে—এমন কোনো বিষয় আমি তুলে ধরিনি। এমনকি এগুলোর বিস্তারিত কোনো ব্যাখ্যা বা লোমহর্ষক বর্ণনাতেও আমি যাইনি। আমি কেবল দেখানোর চেষ্টা করেছি, পারমাণবিক বোমা সাধারণ মানুষের মনে কী ধরনের ক্ষত তৈরি করেছিলো এবং ধীরে ধীরে মানুষ তা কীভাবে ভুলে গেছে তা-ই।
যেদিন পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটে, সেই দিনের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। এমনকি আমি আজও বিশ্বাস করতে পারি না, দুনিয়ায় এমন কিছু ঘটতে পারে। কিন্তু ভয়ানক ব্যাপার হলো, জাপানিরা ইতোমধ্যে সেই স্মৃতি ভুলে গেছে।
মার্কেজ : জাপানের ভবিষ্যৎ এবং জাপানিদের পরিচয়ের ক্ষেত্রে এই ঐতিহাসিক বিস্মৃতি কী অর্থ বহন করে?
কুরোসাওয়া : জাপানিরা পরিষ্কার করে পারমাণবিক বোমা সম্পর্কে কোনো কথা বলে না। আমাদের রাজনীতিবিদরাও যুক্তরাষ্ট্রের ভয়ে মুখ খোলেন না। তারা মনে হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যানের ব্যাখ্যা মেনে নিয়েছেন—কেবল বিশ্বযুদ্ধের দ্রুত ইতি টানার জন্যই পারমাণবিক বোমার আশ্রয় নেওয়া হয়েছিলো। আসলে, আমাদের যুদ্ধ এখনো চলছে। সরকারি হিসাবে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে মৃতের সংখ্যা দুই লক্ষ ৩০ হাজার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মৃতের সংখ্যা ছিলো পাঁচ লক্ষের বেশি। এমনকি বোমা নিক্ষেপের ৪৫ বছর পর এখনো ২৭ হাজার রোগী ‘পারমাণবিক বোমা হাসপাতালে’ রেডিয়েশনের (তেজস্ক্রিয় বস্তু থেকে বিচ্ছুরিত গামা রশ্মির সংস্পর্শ থেকে যে অসুস্থতার সৃষ্টি হয়) প্রভাবে প্রচণ্ড শারীরিক যন্ত্রণা নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। অন্যভাবে বললে, পারমাণবিক বোমা এখনো জাপানিদের হত্যা করছে।
মার্কেজ : যুক্তরাষ্ট্রের আগেই সোভিয়েত ইউনিয়ন জাপান দখল করে নেবে—এমন ভয় থেকেই তারা বোমা মেরে দ্রুত যুদ্ধ শেষ করেছে। মনে করা হয়, এটাই এর পিছনে এখন সবচেয়ে যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা।
কুরোসাওয়া : হ্যাঁ, কিন্তু ওই শহর দুটোতে বসবাসকারী বেসামরিক লোকজনের সঙ্গে যুদ্ধের কোনো সম্পৃক্ততাই ছিলো না, তাহলে কেনো তারা এ রকম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো? বস্তুত হিরোশিমা-নাগাসাকিতেও যুদ্ধ চলার কারণে মার্কিন বাহিনীর একটা মনোযোগ সেদিকে ছিলো।
মার্কেজ : মার্কিনিরা কিন্তু ইম্পেরিয়াল প্যালেসে বোমা ফেলেনি, যা টোকিওর প্রাণকেন্দ্রে অরক্ষিত অবস্থায় ছিলো। আমার মনে হয়, এই ঘটনাই সবকিছু ব্যাখ্যা করে, যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চেয়েছিলো। আর সামরিক ক্ষমতা অক্ষত রেখে যুদ্ধে লুণ্ঠিত সম্পদের ভাগ মিত্রদের না দিয়ে, দ্রুত একটা সমঝোতায় পৌঁছাতে চেয়েছিলো। সমগ্র মানব ইতিহাসে পৃথিবীর আর কোনো দেশের এ রকম অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি। আর যদি পারমাণবিক বোমা ফেলার আগেই আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটতো, তবে আজকের জাপান আর সেই জাপান কি এক হতো?
কুরোসাওয়া : এটা বলা খুবই মুশকিল। নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণে বেঁচে যাওয়া লোকজন তাদের অতীত অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করতে চায় না। কারণ তাদের অধিকাংশ শুধু বেঁচে থাকার জন্যই মা-বাবা, ভাই-বোন ও সন্তানদের ছেড়ে একেবারে সেখান থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলো। তারা আজও সেই অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পায়নি। এদিকে মার্কিন সেনাবাহিনী যুদ্ধের পরও জাপানকে ছয় বছর দখলে রেখে বিভিন্নভাবে তাদের যুদ্ধস্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে দখলদারদের সহযোগিতা করেছিলো জাপান সরকার। তাৎক্ষণিকভাবে আমার যেটা মনে হয়েছে, এ সবই যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অবশ্যম্ভাবী মর্মান্তিক ঘটনার অংশ। কিন্তু আমি মনে করি, যুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে যারা এই হামলা চালিয়েছিলো, তাদের অন্ততপক্ষে জাপানিদের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত এই নাটক শেষ হবে না।
মার্কেজ : তার মানে এর থেকে কি মুক্তির কোনো উপায় নেই? আর জাপানিদের এই দুর্ভাগ্যের খেসারত কি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত দিতে হয়নি?
কুরোসাওয়া : পারমাণবিক বোমা বিশ্বে স্নায়ুযুদ্ধ ও অস্ত্র প্রতিযোগিতার ভিত তৈরি করেছিলো। আর এর শুরুটাই বলে দিয়েছিলো পারমাণবিক শক্তি তৈরি ও ব্যবহার প্রক্রিয়া কেমন হবে। শুরুটাই যার এ রকম সেখান থেকে ভালো কিছু আশা করার প্রশ্নই ওঠে না।
মার্কেজ : বিষয়টি আমি বুঝতে পেরেছি। পারমাণবিক শক্তির জন্মই হয়েছিলো একটি অভিশপ্ত শক্তি হিসেবে, আর সেই শক্তির জন্ম হয় আরেকটি অশুভ শক্তির অধীনে—এই তত্ত্ব আপনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু আমার কাছে উদ্বেগের বিষয় হলো আপনি শুরু থেকেই পারমাণবিক শক্তির অপব্যবহারের কথা বললেও, এর কোনো দোষ দিচ্ছেন না। বোমার মতো বৈদ্যুতিক চেয়ারে বসিয়ে মানুষ হত্যা করা হলেও এখন পর্যন্ত বিদ্যুতকে কিন্তু ভালো শক্তি হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।
কুরোসাওয়া : দেখুন, দুটি বিষয় এক নয়। আমি মনে করি, পারমাণবিক শক্তি নিয়ন্ত্রণ করা অতোটা সহজ নয়। কিন্তু মানবজাতি চাইলে তা সম্ভব। আর পারমাণবিক শক্তি ব্যবস্থাপনার কোনো একটা ভুলের কারণে তাৎক্ষণিক মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। পরে এর তেজস্ক্রিয়তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বা শত শত প্রজন্মকে বয়ে বেড়াতে হবে। অন্যভাবে বললে, পানি ফুটানোর সময় পর্যাপ্ত গরম হয়ে গেলে তা ঠাণ্ডা করার জন্য অন্যত্র রাখা যায়। আমাদের উচিত শত হাজার বছর ধরে এটা ফুটাতে পারে এমন উপাদানের ব্যবহার বন্ধ করা।
মার্কেজ : মানবতার প্রতি আমার যে বিশ্বাস, তার বড়ো একটা অংশের জন্য আমি আপনার চলচ্চিত্রের কাছে ঋণী। চলচ্চিত্রগুলো দেখে আমি এও বুঝতে পেরেছি যে, বেসামরিক মানুষের বিরুদ্ধে পারমাণবিক বোমার ভয়ঙ্কর ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে আপনার অবস্থান কোথায়; আর সেই মর্মান্তিক স্মৃতি ভোলাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জাপানের কিছু মানুষের ষড়যন্ত্রের কথাও। কিন্তু একই সঙ্গে আমার কাছে এটাও অন্যায় মনে হয় যে, কোনো রকম বাছবিচার না করে পারমাণবিক শক্তিকে সবসময় একটা অভিশপ্ত বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ এই পারমাণবিক শক্তি মানবতার খাতিরে ব্যাপক বেসামরিক সুবিধা দিতে পারে। জানি, এসব কারণে আপনি দ্বিধান্বিত, উত্তেজিত হয়ে পড়বেন; কারণ আপনি জানেন, জাপানিরা অপরাধবোধ থেকে যুদ্ধের স্মৃতি ভুলে গেছে। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য যুদ্ধ শেষেও এর দায় স্বীকার করেনি। তাই জাপানিদের দাবি, তাদের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
কুরোসাওয়া : মানব জাতি আরো বেশি মানবিক হয়ে উঠবে যখন তারা প্রকৃত ঘটনা উপলব্ধি করবে; হয়তো তখন তারা নিজ উদ্দেশ্য সাধনে আর এমন কিছু করবে না। আর আমি মনে করি না, পায়ু ছাড়া কিংবা আট পা-ওয়ালা ঘোড়ার মতো প্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম দেওয়ার অধিকার আমাদের আছে; ঠিক যেমনটা ঘটছে চেরনোবিল-এ (১৯৮৬ সালের ২ এপ্রিল চেরনোবিলের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে স্মরণকালের ভয়াবহ পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটে; বর্তমানে এটি ইউক্রেনের একটি শহর)। আমি মনে করি, খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আলোচনা হলো এখানে, যা আমার ধারণাতেই ছিলো না।
মার্কেজ : আমরা সঠিক কাজটিই করেছি। একটা বিষয় যখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তখন গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এখন আপনার যে চলচ্চিত্রের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে, সেখানে কি এ বিষয়ক কোনো চিন্তার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে?
কুরোসাওয়া : সরাসরি না। যখন বোমা ফেলা হয়েছিলো, তখন আমি তরুণ সাংবাদিক। ওই সময় যা ঘটেছিলো সে সম্পর্কে লেখালেখি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সাংবাদিকতার চাকরি থাকা অবস্থায়, এ কাজ করা আমার জন্য প্রায় নিষিদ্ধই ছিলো। এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করার জন্য প্রথমে আমি এ বিষয়ে গবেষণা ও পড়াশোনা শুরু করি। এ নিয়ে জানাশোনার পরই কাজে হাত দিই। আমি যদি এই চলচ্চিত্রে সরাসরি আমার চিন্তাভাবনা ফুটিয়ে তুলি, তাহলে আজকের জাপান কিংবা পৃথিবীর কোথাও এটি প্রদর্শন করা সম্ভব হবে না।
মার্কেজ : আপনার কি মনে হয়, এই কথোপকথনটি ট্রান্সক্রিপ্ট করে প্রকাশ করা সম্ভব?
কুরোসাওয়া : আমার কোনো আপত্তি নেই। তাছাড়া এটি এমন একটি বিষয় যেখানে এ পৃথিবীর ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে সব ধরনের বাধা উপেক্ষা করে তাদের মতামত দেওয়া উচিত।
মার্কেজ : আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এসব বিষয় বিবেচনার পর মনে হয়, আমি যদি জাপানি হতাম সেক্ষেত্রে আপনার মতো একজন আলোকবর্তিকা হতাম। সে যাই হোক, আমি হয়তো আপনাকে বুঝতে পেরেছি। কোনো যুদ্ধই কারো জন্য ভালো না।
কুরোসাওয়া : ঠিক তা-ই। সমস্যাটা হলো, যুদ্ধের সময় যিশু-দেবদূত সবাই সামরিক বাহিনীর প্রধানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
সূত্র :
http://articles.latimes.com/1991-06-23/entertainment/ca-2154_1_akira-kurosawa
অনুবাদক : প্রদীপ দাস, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
pradipru03@gmail.com
বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জানুয়ারির ম্যাজিক লণ্ঠনের অষ্টম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন