Magic Lanthon

               

হাবিবুর রহমান খান

প্রকাশিত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

‘৪০ বছরেও যদি একটা ছেলে হাঁটতে না  পারে, তাহলে তাকে রেখে লাভ কী?’

হাবিবুর রহমান খান


স্বাধীন বাংলাদেশে প্রযোজনা শিল্পের অন্যতম পথিকৃত হাবিবুর রহমান খান। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে ১৯৭২ সালে হাবিবুর রহমান খান জড়িয়ে পড়েন চলচ্চিত্র প্রযোজনা ব্যবসায়; গড়ে তোলেন প্রযোজনা ও পরিবেশনা প্রতিষ্ঠান ‘আশীর্বাদ চলচ্চিত্র’ জন্ম ঢাকার বিক্রমপুরে ১৯৪৫ সালে। অসম্ভব মিষ্টভাষী এই মানুষটি যৌবনে যুক্ত ছিলেন বাম রাজনীতির সঙ্গে। তখন থেকেই বিখ্যাত পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের প্রতি দুর্বলতা। তাই প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তাকে দিয়েই। বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ঋত্বিক নির্মাণ করেন বিখ্যাত সেই চলচ্চিত্র তিতাস একটি নদীর নাম। ১৯৯৩ সালে ভারত সরকারের সাথে যৌথ প্রযোজনায় গৌতম ঘোষের পরিচালনায় নির্মাণ করেন পদ্মা নদীর মাঝি। তার প্রযোজিত চলচ্চিত্র বড় ভালো লোক ছিল ১৯৮৪ সালে সর্বমোট আটটি বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়।

২০০২ সালে হাবিবুর রহমান খান, ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট, ইংল্যান্ড ও ভারত সরকার যৌথ প্রযোজনায় অনুপ সিংয়ের পরিচালনায় নির্মিত হয় একটি নদীর নাম। বলা চলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অনেকগুলো ইতিহাস তার হাতে লেখা। ২০১০ সালে এসে তিতাস একটি নদীর নাম ৬৩তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে ওয়ার্ল্ড ক্ল্যাসিক বিভাগে প্রদর্শিত হয়। সর্বশেষ ২০১১ সালে যৌথ প্রযোজনায় আবারও গৌতম ঘোষকে দিয়ে নির্মাণ করান মনের মানুষ। ঘর জামাই, হঠাৎ বৃষ্টি, চুপিচুপি, চুড়িওয়ালাসহ হাবিবুর রহমান খান প্রযোজিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা কমপক্ষে ৩০টি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে প্রবাদপ্রতিম এই মানুষটির সঙ্গে ম্যাজিক লণ্ঠন এর পক্ষ থেকে কথা বলেছেন জাহাঙ্গীর আলম ও রাজীব আহসান

ম্যাজিক লণ্ঠন : প্রযোজক হিসেবে আপনি সুপরিচিত, পরিবেশনার সাথেও আপনি জড়িত। চলচ্চিত্রে আগ্রহী হলেন কবে থেকে? মানে শুরুটা কীভাবে?

হাবিবুর রহমান খান : শুরুটা আসলে অনেক বড় কাহিনী। আমি ঋত্বিক ঘটকের একজন ফ্যান। ১৯৬৪-৬৫ সাল থেকে আমি দেশ স্বাধীনের জন্য, মানে স্বাধীনতার জন্য কাজ করি। আমি মূলত নিউক্লিয়াসে (বাম ঘরানার একটি চক্র। সিরাজুল আলম খান এর অন্যতম সদস্য ছিলেন। যিনি পরবর্তীতে জাসদের তাত্ত্বিক নেতা হিসেবে সমধিক পরিচিত হন) ছিলাম, তাই জানতাম এ দেশটা স্বাধীন হবেই এবং আমার বিশ্বাস ছিল দেশটা স্বাধীন হলে পরে সঙ্গে সঙ্গে আমি যার ফ্যান সেই ঋত্বিক ঘটক; যিনি বাংলাকে ভাগ মানেন নাই, যেটা আমারও খুব কষ্টের জায়গা; যার জন্য মনে করেছিলাম যখনই চান্স পাব তখনই ঋত্বিক ঘটকের ছবি করব। এই হলো আমার ছবিতে আসার মূল প্রেরণা, উৎসাহ; সবকিছুই ঋত্বিক ঘটক।

ম্যাজিক লণ্ঠন : মানে স্টুডেন্ট লাইফ কিংবা সেই সময়ে ফিল্ম সোসাইটি বা এমন কিছু?

হাবিবুর রহমান খান: হ্যাঁ, ফিল্ম সোসাইটি ছিল; কিন্তু এত প্রকটভাবে ছিল না। জাস্ট আর্টিকেল পড়ে ওনার (ঋত্বিক) ওপরে একটা আলাদা ইয়ে মানে, ফ্যাসিনেশন হয়ে গিয়েছিল।

ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনার প্রযোজিত প্রথম চলচ্চিত্র হলো তিতাস একটি নদীর নাম। শুরুতেই ঋত্বিক ঘটককে পছন্দ করতেন কিন্তু তার সম্পর্কে অনেক কথা প্রচলিত ছিল যে তিনি প্রযোজকদের ভোগান। এবং এর আগের দশ বছরে দেখা গেছে যে তিনি ওইরকম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র শেষও করতে পারেন নি। তারপরেও মানে ফ্যাসিনেশনের জন্যই আপনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?

হাবিবুর রহমান খান : আমার কাছে এইটা একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। আমি মুক্তিযুদ্ধ করে এসেছি ১৯৭১ সালে। আর ’৭২-এ ছবি শুরু করি। আমি এত বড় একটা যুদ্ধ করে আসার পরে একটা ছবি শেষ করতে পারব না! এই চ্যালেঞ্জটা নিয়েই আমি ছবি করতে নেমেছি।

ম্যাজিক লণ্ঠন : আচ্ছা, চ্যালেঞ্জ-মাফিক কাজ করতে গিয়ে তেমন কোনো মজার ঘটনা, এমন কিছু?

হাবিবুর রহমান খান : মানে ওনার সাথে কাজ করতে গিয়ে শুধু ঘটনা মানে এতকিছু যে, আমি এ্যগজ্যাক্টলি বলতে পারব না। অসাধারণ, অসম্ভব সব অনুভূতি। মানে ওনাকে নিয়ে একটা ছবি করা তখন ছিল, মানে আমাদের সালাউদ্দিন জাকির ভাষায় অসাধ্য, দুঃসাধ্য, নট পসিবল।

ম্যাজিক লণ্ঠন : তো সেটাই আপনি করে দেখিয়েছেন। প্রথম প্রযোজিত চলচ্চিত্র তিতাস একটি নদীর নাম সম্পর্কে আপনি বলেছিলেন যে, শুধু শিল্প সৃষ্টির জন্য আপনি এ কাজে হাত দিয়েছিলেন। পরবর্তীতেও আপনি অনেক ছবি প্রযোজনা করেন; সেক্ষেত্রে চলচ্চিত্রে একাধারে বিনিয়োগ করতে হয়েছে। তার থেকে টাকাও উঠাতে হয়েছে; তো শিল্প মানে আর্ট ও বাণিজ্য এই দুইটার সমন্বয়কে আপনি কীভাবে দেখেন?

হাবিবুর রহমান খান : সমন্বয় হয় না। বাণিজ্যিক ছবি নির্মাণ করে, যদি সেটা চলে তাহলে দু’টা পয়সা পাওয়া যায়। আর ছবি যে কেবল বাণিজ্যিক হলেই চলবে তা তো কথা না। আর শিল্পসম্মত ছবি- যেহেতু আমাদের দেশে ওইভাবে দর্শক তৈরি হয় নাই। যে কারণে সেভাবে পয়সা পাওয়া যায় না। এগুলো মূলত প্রাণের টানে মনের টানে করা।

ম্যাজিক লণ্ঠন : তাহলে চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিবেশনার ক্ষেত্র বাণিজ্যিক হবে নাকি শিল্পসম্মত হবে- সেটা কীভাবে নির্বাচন করেন?

হাবিবুর রহমান খান : শোনো, তোমাকে একটা কথা বলি, শুধুমাত্র বাণিজ্যিক ছবি নয়, কেউ যখন ছবি বানায়, সে ভাবে তার ছবিটা চলবে। বাস্তবে ৯০ পার্সেন্ট ছবি চলে না। এটাতে কিছুই করার নাই। এটাই তো ইন্ডাস্ট্রি।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এখন মনে করেন বড় বড় যে ইন্ডাস্ট্রি যেমন, ভারত কিংবা হলিউডে ছবি না চললেও মোটামুটি বা মিনিমাম তো একটা টাকা উঠে আসে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন ঘটছে না।

হাবিবুর রহমান খান : বাংলাদেশে ছবি যদি না চলে তো, না-ই চলে। একসময় ছিল আমাদের এখানে, যখন আমরা ছবিতে এসেছিলাম; ফার্স্ট-টাইম একটা ছবি চলল, ফার্স্ট-টাইম মানে প্রথম রিলিজের সময়, আচ্ছা তখন দুই লাখ টাকা লস হলো। তখন অনেকে বলত, সেকেন্ড টাইম টাকা উঠে যাবে। এখন আমাদের এখানে সেকেন্ড টাইম বলে কিছু নাই। আসলে একটা ছবির স্থায়িত্ব বা লাইফ হলো তিন মাস।

ম্যাজিক লণ্ঠন : তিন মাসের মধ্যে টাকা উঠলে উঠবে, না হলে লস। টেলিভিশন প্রযোজিত চলচ্চিত্রে এখন দেখা যাচ্ছে, মানে এটার কারণেই মনে হয় টেলিভিশনে রিলিজ দেয়া, একেবারে বিক্রি করে দেয়া। এককালীন টাকা উঠিয়ে নেয়া।

হাবিবুর রহমান খান : এখানে তো বাইরের কেউ ছবি দেয় না। টেলিভিশনে যারা ছবি রিলিজ দেয়, আসলে ওইসব টেলিভিশন কোম্পানিই ছবিটি বানায়। ওরাই বানায়, ওরাই সেটা বিক্রি করে। কেউ বিশেষ করে কোনো প্রডিউসার ছবি বানিয়ে টেলিভিশনে দেয় না। আমি একটা দুর্ঘটনায় পড়ার কারণে হঠাৎ বৃষ্টি টেলিভিশনে মুক্তি দিয়েছিলাম। এটা তখন বেশ সাফল্য পেয়েছিল।

ম্যাজিক লণ্ঠন : টেলিভিশন প্রযোজিত চলচ্চিত্রই বলি; চলচ্চিত্র বলতে প্রধানত আমরা বুঝি যে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে, যেখানে দর্শকরা গিয়ে ছবি দেখবে। সেক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, টেলিভিশন প্রযোজিত চলচ্চিত্রগুলো সার্বিকভাবে চলচ্চিত্র শিল্পের ক্ষেত্রে কী প্রভাব রাখছে বা ভূমিকাটা কেমন?

হাবিবুর রহমান খান : প্রভাব তো কিছু নাই। ওরা ছবি বানায় টেলিভিশনে। ওরা সিনেমা ওদের টেলিভিশনেই চালায়। আর সিনেমাতে, তুমি যা বললা যে সিনেমা হলের কথা। অর্থাৎ থার্টি ফাইভে সিনেমা বানালে এটা সিনেমা হলেই চলবে, এই জন্যই সিনেমা তৈরি করা হয়।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এবং ওদের কিছু ছবি কিন্তু সিনেমা হলে চলছে।

হাবিবুর রহমান খান: না সেটা চলছে, সেটা আলাদা জিনিস। মানে, সিনেমা ঠিক আছে, কিন্তু সে সিনেমা খুব একটা চলে না। মানে দু’টা-তিনটা হলে চলে, যেটা ঢাকা বেইজড। তাহলে তো আর সেটা সিনেমা হলো না।

ম্যাজিক লণ্ঠন : হ্যাঁ। সেটাই। আপনি ৪০ বছর ধরে ফিল্মে আছেন। দীর্ঘ সময় ধরে। তো একসময় দেখা যেত অনেক সিনেমা হল ছিল, প্রায় ১২০০ টির মতো। আর এখন বন্ধের পর প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। ৬০৮ টির মতো আছে। এর মধ্যে ৪২৬ টা ঝুঁকিপূর্ণ। তো দীর্ঘসময় ধরে দেখলেন আজকের সিনেমার এই করুণ অবস্থা। এটা থেকে উত্তরণের কি কোনো পথ আছে? মনে করেন আপনার কোনো অ্যাডভাইস?

হাবিবুর রহমান খান : উত্তরণ হলো টেকনোলজির সাথে এ্যাডাপ্ট্‌ করতে হবে। সিনেমা হলকে ডিজিটালাইজড করতে হবে। ভারতে বিশেষ করে পশ্চিম ভারতসহ অন্যান্য জায়গায় যেভাবে তারা সারভাইভ করেছে। আর যুগোপযোগী ছবি বানাতে হবে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : যুগোপযোগী ছবি বলতে আসলে যা বোঝাতে চাচ্ছেন, একটু পরিষ্কার করে যদি বলতেন...

হাবিবুর রহমান খান : যুগোপযোগী ছবি বলতে আসলে এখনকার ছবির যারা দর্শক তাদের কথা মাথায় রেখে বানানো। একসময় যখন ছবি হতো, তখন ছবির দর্শক ছিল মধ্যবিত্ত পরিবার। এখন তো কোনো মধ্যবিত্ত পরিবার ছবি দেখতে যায় না; যেতে পারে না। নানা সমস্যার কারণে। অনেক কিছু- যেমন, টিকিটের সমস্যা, ট্রান্সপোর্টের সমস্যা, নিরাপত্তা। সবকিছু মিলিয়ে...

ম্যাজিক লণ্ঠন : হলের পরিবেশের কারণেই মনে হয় তারা আসছেন না বা তাদের নিয়ে আসার মতো ছবিও হচ্ছে না। এখন তো সবচেয়ে বড় একজন ডিস্ট্রিবিউটর আপনি।

হাবিবুর রহমান খান : আমি তো বড় ডিস্ট্রিবিউটর নই। এখন তো কেউ বাইরের ছবি ডিস্ট্রিবিউট করেন না। আমি আছি। আমি চ্যানেল আই এর ছবিগুলো ডিস্ট্রিবিউট করছি; এইটাই। তাতে করে, আমিই একমাত্র ব্যক্তি, যে বাইরের ছবি ডিস্ট্রিবিউট করছি। এখন তো যে ছবি তৈরি করে সে-ই ডিস্ট্রিবিউট করে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : দেশের বাইরেও যারা ছবি বানায় সবাই আপনার কাছে আসে আর কী! সবচেয়ে বেশি ছবি আপনি ডিস্ট্রিবিউট করছেন, এক্ষেত্রে পরিবেশনে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি?

হাবিবুর রহমান খান : পরিবেশনের সমস্যা তো থাকবেই। পরিবেশনের যে সমস্যাটা আছে সেটা হলো, সবাই সব ছবি নিতে চায় না। কারণ, হলের যে মালিক তার তো কোনো শিল্পকর্ম নাই। সে সিনেমা হলটা বানিয়েছে, সেটার পিছনে তার একটা ফিক্সড কস্ট আছে। সেই কস্ট-টা দিয়ে সে দু’টা পয়সা লাভ চায়। এটা তার কোনো অন্যায় না। সে চেষ্টা করে একটা ভাল ছবি নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে সেটাকে কাজে লাগাতে। এই তো।

ম্যাজিক লণ্ঠন : ঢাকার বাইরের প্রেক্ষাগৃহগুলোতে সিনেমা নিতে হলে আগাম অর্থ বা মিনিমাম গ্যারান্টি (এমজি) দিতে হয়। অর্থের অভাবে মফস্বলের হল মালিকদের অগ্রিম টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই। তাদের অভিযোগ, টাকার অভাবে তারা নতুন সিনেমা হলে চালাতে পারে না।

হাবিবুর রহমান খান : এটা তারা ঠিক বলছে না। কারণ হচ্ছে যে, আমি একটা সিনেমা ঢাকায় চালাতে গেলে যা হয় তা হলো, ঢাকাতে আমার কন্ট্রোল থাকে। ঢাকার বাইরে যখন চলে যায়, তখন ওই সিনেমা হলে কী বিক্রি হয়, না হয় আমি বলতে পারি না। এক্ষেত্রে তাদেরকে পার্সেন্টেজে ছবি দিলে তারা আমাকে টাকাই দেবে না ।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এক্ষেত্রেও তো দেখা যাচ্ছে সেই প্রযুক্তির কথাই এসে যাচ্ছে। সেখানে যদি দেখা যেত মাল্টিপ্লেক্স কিংবা এই জাতীয় অটোমেটিক সফটওয়্যার চালু হয়, তাহলে এই অবিশ্বাসটা হয়ত দূর হয়ে যেত।

হাবিবুর রহমান খান : হ্যাঁ। আর তাছাড়া সে যে মিনিমাম গ্যারান্টিটা দেয়, তার অনেক রকম হিসাব কিন্তু আমি জানি না। সে আমার থেকে দূরে। ঢাকার হলগুলোকে আমি জানি। আমার লোক আছে, সেখানে আমি ইচ্ছে করলেই গিয়ে দেখতে পারি। কিন্তু তাদেরকে আমি দেখতে পারব না। আর তাদের তো অনেক ট্যাক্স বেনিফিটও আছে, অনেক সুবিধা আছে, যেটা ব্যবসায়িক সুবিধা। সেটা আমাকে বলে না। তার সঙ্গে তো আমি শেয়ারে যাব না। এবং ওই যে বললেন, পার্সেন্টেজের সাথে তাদের আবার ইয়াও আছে তো। তারা একটা হলের মেইনটেনেন্সের পয়সাও নেয় পার টিকেটে তিন-চার টাকা করে। কিন্তু ওইগুলোকে বাদ দিয়েই তো আমাদের দেয়।

ম্যাজিক লণ্ঠন : টিকিটের উচ্চমূল্য যেটা দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে এখন মনে হয় হান্ড্রেড পার্সেন্ট।

হাবিবুর রহমান খান : উচ্চমূল্য নয়। ট্যাক্সের কারণে উচ্চমূল্য। টিকেটের দাম আরও বাড়ানো দরকার। আমাদের এখানে ট্যাক্সটা অনেক বেশি।

ম্যাজিক লণ্ঠন : হান্ড্রেড পার্সেন্ট। দেখা যাচ্ছে যে, পাশের দেশ ভারতেই ৩০ পার্সেন্ট।

হাবিবুর রহমান খান : ৩০ পার্সেন্ট হিন্দি ছবির জন্য। আর পশ্চিমবঙ্গে ২ পার্সেন্ট ট্যাক্স বাংলা ছবির জন্য ।

ম্যাজিক লণ্ঠন: সরকারিভাবে পলিসির দিক দিয়েও তো এখানে সমস্যা থেকে যাচ্ছে।

হাবিবুর রহমান খান : পলিসির দিক দিয়ে চলচ্চিত্র এগোলোই না। এইটা নিয়ে কেউ চিন্তাই করে না। আমাদেরও ফেইলিওর আছে। আমরা তাদেরকে চিন্তা করাতে পারছি না। কারণ গভর্নমেন্টের কাছে গতানুগতিক কেউ গেল, গভর্নমেন্ট উন্নতি করার জন্য কিছু দিল; এফডিসিতে কিছু যন্ত্রপাতি আনল। এফডিসি যখনই কোনো যন্ত্রপাতি আনে, যে যন্ত্রটা নিয়ে আসে সেটা আরও দশ বছর পিছে চলে গেছে। এই যে এফডিসি মাঝখানে কী একটা আনল, টেলিসিনে মেশিন; সেটা দিয়ে কাজ হচ্ছে না! এটা হলো? এখন এফডিসি কিছু কিনতে গেলেই দেখা যায়, তারা একটা রঙ জিনিস চুজ করে। এইভাবে কোনো উন্নতি হবে বলে আমার মনে হয় না।

ম্যাজিক লণ্ঠন : মানে, সঠিক জায়গায় সঠিক লোকটাও নেই।

হাবিবুর রহমান খান : আর, ম্যান বিহাইন্ড মেশিনারি ইম্পোর্টেন্ট। আজকাল মুম্বাইতে বা কলকাতায় এখানকার লোকেরা প্রিন্ট করতে বা নেগেটিভ প্রসেস করতে যাচ্ছে। সেইম প্রিন্টার, সেইম জিনিস, সেইম কোম্পানির মেশিন। মুম্বাই কলকাতার সেইম জিনিস। সেইম কোম্পানির মেশিন। তো, আমাদের এখানে কেন চলে না?

ম্যাজিক লণ্ঠন : লোকের অভাবেই চলছে না।

হাবিবুর রহমান খান : লোকের অভাব, প্রোপার ট্রিটমেন্ট, প্রোপার অনেক কিছুই দরকার। এগুলি দেয় না।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এখানে পরিবেশনার ক্ষেত্রে একটা কথা আছে যে, বুকিং এজেন্টরা সিনেমা হিট করায় বা এরকম যে, ওদের অনেক ক্ষমতা।

হাবিবুর রহমান খান : এটা একদম বাজে কথা। ওরা কোনো রকমেই হিট-ফ্লপ কিছুই করতে পারে না। ওরা যেটা করতে পারে সেইটা হলো, একজোট হয়ে কিছু একটা করা। কিন্তু একটা ছবি যদি চলে তাহলে তাদের বাপেরও ক্ষমতা নাই কিছু করার। কেননা, ছবি সিনেমা হলে একবার চলে গেলে, ওরা তো ওখানে ফ্লপ করাতে পারে না। যে ছবিটা কম চলে সেখানে ওরা একটু গিয়ে মাতব্বরী করে। ওরা মানে, বুকিং এজেন্টরা একপ্রকারের দালাল, ইন বিটুইন মিডল-ম্যান। ওরা এখান থেকে নিয়ে গিয়ে ছবিটা হলে লাগালো। ছবির দর্শক তো ওরা ঢুকায় না। দর্শক ইটসেলফ ছবিটার জন্যই হলে যায়। ওরা এখানে কিছু কন্সপাইরেসি করে, কিন্তু করে খুব একটা লাভ হয় না।

ম্যাজিক লণ্ঠন : আল্টিমেটলি, দর্শকরাই কিন্তু শেষ কথা। আবার এক্ষেত্রে দেখা যায়, এফডিসিকেন্দ্রিক ফর্মূলাভিত্তিক যে ছবি এর বাইরে দেখা যাচ্ছে, আলাদা কোনো কাহিনী কিংবা শিশু চলচ্চিত্র কিংবা ডিফারেন্ট-টাইপের যদি কিছু একটা হয়; বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই বানানো হয়েছে, এখন কোনো কারণে দেখা যাচ্ছে যে, ওইরকম মারপিট নাই, সহিংসতা নাই, স্টারইজম নাই- এরকম সিনেমার প্রতি পরিবেশকদের তেমন আগ্রহ থাকে না।

হাবিবুর রহমান খান : ছবি নেয় না, এই তো? সেটা ঠিক আছে। তো আমার এখানে যারা আসে, আমার ক্ষেত্রে যা হয়, তা হলো হলের বুকিং এজেন্ট, হলের মালিক; এদের সাথে সম্পর্ক ভাল থাকার কারণে আমার কথা শোনে। এরা কিছু ছবি চালায়। এটা পার্সোনাল রিলেশনের ওপর। ধরেন, ছবিটা দিয়ে আমি বললাম যে, ছবিটা চালায় দাও। এই কথাটা তো আমি তাদের বলতে পারি। অন্য কেউ তো এটা বলতে পারবে না। কেননা, আমি ওকে আরও দুইটা ছবি দিচ্ছি সেখান থেকে তার এভারেজ ব্যবসা হয়। সেটার জন্যই তারা চালায়।

ম্যাজিক লণ্ঠন : চলচ্চিত্র একসময় দেখা যাচ্ছে মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিগুলো দেখত। তারা এখন আর আসে না। তো এই সময়টা কখন থেকে শুরু হলো?

হাবিবুর রহমান খান : এখন আর আসবে না। মূলত এই সময়টা ছিল ৭০ এর পর থেকেই।

ম্যাজিক লণ্ঠন : তো ৯০ এর দশকে সালমান শাহ্‌’র সময়ে তখনো তো বেশ কিছু দর্শক ছবি দেখত, তাই না?

হাবিবুর রহমান খান : হ্যাঁ। কিছু কিছু দেখত। তখন কিছু ইয়াং ছেলেমেয়েরা ছবি দেখতে যেত। এখনো কিন্তু ঢাকাভিত্তিক ছবি দেখতে এরাই যায়। আর ডে-আর্নার’রা যায় অর্থাৎ যারা শ্রমিক, কৃষক- এরাই ছবি দেখে। কারণ এদের ভিতর সেই সহজলভ্য এন্টারটেইনমেন্টটা নেই, যেমন- টেলিভিশন নেই, ভিসিআর নেই। এরাই টাকা পয়সা জোগাড় করে ছবিটা দেখে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : দেখা গেল যে, সিনেমা হলের বাইরে চায়ের দোকানে অনেক লোক সিনেমা দেখছে। ভিসিআরে দেখছে। মানে এই লোকগুলোকে টেনে নেয়া যাচ্ছে না। এটা কী নির্মাতাদের সৃজনশীলতার সমস্যা।

হাবিবুর রহমান খান : আমাদের চলচ্চিত্র-নির্মাতাদের সমস্যা রয়েছে। সিনেমাতো কোনো ফর্মূলা বা ফ্যাক্টরি না যে কোনো জিনিস দিয়ে দিলাম আর হয়ে গেল। টোটাল বিষয়টা ক্রিয়েটিভিটি। এই ক্রিয়েটিভিটি যদি তাদের মধ্যে কাজ না করে, তাহলে তো কিছু করার নেই।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, মাঝে কিছু আন্দোলন হয়েছে অশ্লীলতার বিরুদ্ধে। অনেকে বলছে ঢাকাই চলচ্চিত্রের অধঃপতনের মূল কারণ অশ্লীলতা। অনেকের মতে, অশ্লীলতা মূল কারণ নয়, বরং এটা ফলাফল হিসেবে আসছে। মূলত চলচ্চিত্র শিল্পে সৃজনশীলতার অভাবই দর্শক টানতে পারছে না। পাশাপাশি সিনেমা হলের পরিবেশ...।

হাবিবুর রহমান খান : হ্যাঁ। সৃজনশীলতার অভাব, হলের পরিবেশ, মানুষের বাড়ির বাইরে বের হওয়ার নিরাপত্তা, প্লাস টিকেটের দাম, সবকিছু মিলে সাথে অল্টারনেটিভ অ্যামিউজমেন্টের সুযোগতো আছেই; যেমন- স্যাটেলাইট টেলিভিশন। মানুষ ঘরে বসে ১০০টা সিনেমা দেখতে পারে। দর্শক যদি সারা দিন দশটা বাংলা ছবি দেখতে চায়, তাহলে সে তা দেখতে পারে। ঘরে বসে রিমোট টিপে সিনেমা দেখবে, তো হলে যাবে কেন?

ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনারা যখন শুরু করেছিলেন, তখন থেকে আস্তে আস্তে চলচ্চিত্রের সংখ্যা বাড়ছিল। বাড়তে বাড়তে একটা-সময় প্রায় শতাধিক ছবি রিলিজও হলো। তারপর আবার কমতে শুরু করল। তো কমতে কমতে এখন এই পর্যায়ে আছে যে হলের মালিকরা ছবি পাচ্ছে না। তো এখন তো তারা ইন্ডিয়ান ছবি আনার পক্ষে- এই বিষয়টা কীভাবে দেখছেন? অনেকে তো এটার বিরুদ্ধেও আছেন।

হাবিবুর রহমান খান : আমার প্রথম কথা হলো, আমাদের তো কোনো কিছুরই ইমপোর্ট বন্ধ না। আমি একজন দর্শক হিসেবে, মালয়েশিয়ান বিস্কুট কিনতে পারি। আমরা খাচ্ছি না মালয়েশিয়ান বিস্কুট? হংকং থেকে বিস্কুট আসতেছে। আমি বাজারে গেলে আমার চয়েজ আছে যে, আমি এখানকার নাবিস্কো নেব, নাকি অন্যকিছু। আমার অপশন আছে। এগুলো না নিয়ে আমি মালয়েশিয়ানটা নিলাম, কেউ হকের টা নিল। এই জন্য কিন্তু কোনো বিস্কুটের ফ্যাক্টরি বন্ধ হয় নাই। বরং আরও নতুন নতুন ফ্যাক্টরি হচ্ছে। ৪০ বছর ধরে আমাদের দেশে এটা প্রটেকশন হচ্ছে। এখনো এই প্রটেকশন আর কী জন্য হবে?

ম্যাজিক লণ্ঠন : তবে এখনো ভারতে বাংলাদেশের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো দেখানো হয় না।

হাবিবুর রহমান খান : সেটা হয় আসলে ওদের নিয়মের কারণে। ওদের যারা স্যাটেলাইট টেলিভিশন চালানোর কাজটা করে তারা মানে কেবল অপারেটররা, তারা কিন্তু এ কাজটা পয়সার বিনিময়ে করে। বাংলাদেশ টাকা দিলে ওরা কেন প্রচার করবে না? ওখানে গভর্নমেন্ট ওটা আটকায়ে রাখে নি। আটকে রেখেছে কেবল অপারেটররা। কেবল অপারেটররা পয়সা নেয়। ওদের পয়সা দিলেই ওরা ওই চ্যানেলটা চালাবে। আমরা পয়সা দিতে পারি না, তাই তারা দেখায় না। এখন প্রশ্ন হলো ওদেরটা আমরা দেখাই কেন?

আমরা যেহেতু মনে করি ওদেরটা চলবে, তাই ওদের চ্যানেল আমাদের দেশে দেখানো হচ্ছে। ওদের টাকা দিলেই এটা সম্ভব। কেননা, ওখানে যারা স্যাটেলাইট চালায় তারাও টাকা দিয়েই চালায়। যে চ্যানেলগুলো তারা দেখায়, তার জন্য তারা টাকা নেয়। এখন অবশ্য তাও আর হচ্ছে না। আস্তে আস্তে তারা কেবল অপারেটরের ওপর আর নির্ভর করছে না। এখন ডিটিএইচ (ডিরেক্ট টু হোম অর্থাৎ এই প্রযুক্তিতে কেবল অপারেটরদের ওপর গ্রাহকদের নির্ভরশীল থাকতে হবে না। ইন্টারনেটের মডেমের মতো একটি ডিভাইস কিনে গ্রাহক একাই ঘরে বসে স্যাটেলাইট চ্যানেলের সেবা নিতে পারবেন। ভারতে জি নেটওয়ার্ক, এয়ারটেল টিভি, টাটা স্কাই বর্তমানে এ সেবা দিচ্ছে) সার্ভিস এসে যাওয়াতে গ্রাহক সরাসরি স্যাটেলাইট থেকে টেলিভিশনের সংযোগ নিচ্ছে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : ভারত থেকে চলচ্চিত্র আমদানির নীতিমালা কেমন হতে পারে ?

হাবিবুর রহমান খান : আসলে ওইভাবে আমদানির কোনো নীতিমালা করতে পারা সম্ভব নয়। ওই যে অনেকে বলে, আমরা ওদের বাংলা ছবি নেব, আর ওরা আমাদের বাংলা ছবি নেবে- এটা আসলে হবে না। প্রথম কথা এটা হয় না। কেননা, ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট এটা কখনো করবে না যে, শুধু বাংলা ছবি যাতায়াত হোক। কারণ গভর্নমেন্ট এই চুক্তিটা করতে চায় না। আর এখন ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট যে ইতে আছে তা অনেকেই জানে না। ওদের ওখানে কিন্তু ছবির ইমপোর্ট বন্ধ নাই।

ম্যাজিক লণ্ঠন : মানে ইচ্ছা করলে চালানো যাবে, এমন কী? বাংলাদেশের মাটির ময়না কিন্তু তারা চালিয়েছিল।

হাবিবুর রহমান খান: হ্যাঁ। তারা ছবি ইমপোর্ট করে চালাতে পারে। আসলে হয় কী, ওখানকার ইন্ডাস্ট্রির লোকজন চালাতে দেয় না। এখন সেখানে একটা আইন হয়েছে ‘কম্পিটিটিভ আইন।’। সে আইনে বলা হয়েছে, কেউ যদি ছবি ইমপোর্ট করে চালাতে থাকে, তাহলে তা পারবে। কেউ তাকে বাধা দিতে পারবে না। মানে ‘ল অব কম্পিটিটিভ’ আইন। এই আইনটা সেখানে চলে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : বাংলাদেশেও কি এই আইনটি চালু হওয়া উচিত বলে মনে করেন?

হাবিবুর রহমান খান : নিশ্চয় চালু হওয়া উচিত। সমস্যাটা অন্যখানে। অনেকে ভিতর না দেখে বলে। আমরা যদি আমাদের ছবি সেভাবে বানাতে পারি, তাহলে ওদের ওখানে তা যাবে। ওরা তো প্রোডাক্ট নেবে। তাই না? ছবি যদি চলে। আরে আমি করলাম না। আমি আমার বেদের মেয়ে জোস্‌না ছবিটা এখানে চলার পর ইন্ডিয়াতে এক বন্ধুকে বললাম রিমেক কর। ও করলও। তো সেটাতো সেখানে চলল। এমনকি ছবি সুপারহিট হলো। কারণটা কী? মাল-মসলা ছিল বিধায় ছবি চলছে, তাই না? এখন এই ধরনের ছবি যদি চলে, তাহলে তারা নেবে না কেন? নিতে বাধ্য। নিতেই হবে। কেননা, ওদের তো ব্যান নাই। ওরা চাইলে বাংলাদেশের ছবি নিয়া চালাতে পারত। এখন এটা তো অনেকে জানে না যে, এখন এখান থেকে বাংলা ছবি ইমপোর্ট হচ্ছে ওখানে। ইমপোর্ট করার পরে হলে যেহেতু চালাতে দেয় না; তাই ওরা ওখানে সিডি করে চালাচ্ছে। মাটির ময়নাসহ অনেক বাংলা ছবির সিডি করে ওরা চালিয়েছে। এই যে কয়েকদিন আগে আকাশ বাংলা বাংলাদেশের কয়েকটা সিনেমা দেখাল।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এগুলোতো কপিরাইট আইন মেনেই হয় তাই না?

হাবিবুর রহমান খান : অবশ্যই। ওরা তো ইমপোর্ট করে চালাচ্ছে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : সেক্ষেত্রে এখানকার প্রযোজক-পরিচালক তারা লাভবান হবে।

হাবিবুর রহমান খান : এখন প্রশ্নটা হলো যে, যদি তুমি বাজারে কিছু কিনতে চাও তাহলে, তুমি তো তোমার চয়েজ মতো কিনবে, তাই না? এখন যেমন তুমি ঢাকায় কোনো ছবি দেখতে চাইলে ঢাকায় বানানো ছবি ছাড়া তা সম্ভব না। এটা হলো? এটা তো আনফেয়ার। আর তুমি যদি ওইটা কম্পিট করতে না পার তাহলে কে তোমাকে প্রটেকশন দেবে? ৪০ বছর তো হয়ে গেছে প্রটেকশনের।

ম্যাজিক লণ্ঠন : অবস্থাতো মানে খারাপের দিকেই। তো আপনি কি মনে করেন, এই ব্যবস্থায় আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জন্য এটা উপকার হবে?

হাবিবুর রহমান খান : শোনো, একসময় এই বাংলাদেশে, ’৬৫ সালের আগে ইন্ডিয়ান ছবি আসত, পাকিস্তানি ছবি আসত, তারপরেও তো ঢাকাই ছবি চলতই।

ম্যাজিক লণ্ঠন : মানে হিন্দি, উর্দু ও কলকাতার বাংলা তিনটিই আসত?

হাবিবুর রহমান খান: তারপরেও আমাদের বাংলাদেশের ছবি চলত। আসলে ঘটনা হলো কী, একটা ইন্ডাস্ট্রি যদি ৪০ বছরেও না দাঁড়াইতে পারে, তাহলে কবে দাঁড়াবে? আরেকটা প্রশ্ন হলো যে, কেন ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়াবে? কেনইবা প্রটেকশন দিবে? কারণ বাংলাদেশে যে ছবিগুলো হয়, এর কালচার কী? আমরা ছবিগুলোতে কোন কালচারটা দেই। যদি একটা প্রশ্ন আসত যে আমাদের কালচার নষ্ট হবে, তা তো না। আমাদের তো কোনো কালচারই নেই। আমাদের ছবিতে কোনো কালচার আছে? ৪০ বছরেও যদি একটা ছেলে হাঁটতে না পারে, তাহলে তাকে রেখে লাভ কী? একটা মানুষ যদি ৪০ বছরেও না হাঁটতে পারে তাহলে কবে হাঁটতে শিখবে?

ম্যাজিক লণ্ঠন : এখানে এফডিসির অবকাঠামো যদি না থাকে, তাহলে সেভাবে তো চলচ্চিত্র বানানোও সমস্যা। মানে অবকাঠামোর সমস্যা।

হাবিবুর রহমান খান : অবকাঠামো? অবকাঠামো আসলে হয়ে যাবে। এগুলো এফডিসি থাকলেও কোনো সমস্যা না, না থাকলেও কোনো সমস্যা না। এখন ডিজিটাল প্রযুক্তি এসে কেউ আর এফডিসিতে ডাবিং করতে যায় না। এখন অনেক ডাবিং স্টুডিও হয়ে গেছে। এমনকি শুটিং করতেও যায় না। এটা আল্টিমেটলি সরকারের ওপর ডিপেন্ড করেও কিছু হবে না। আমরা খুব অদ্ভুত যুক্তি দিই, বলি যে, আমাদের ছবি ওরা নেয় না। আরে, আমাদের ছবি যোগ্য চলচ্চিত্র হলে তো নেবে। ওরাতো বহু ছবি ইমপোর্ট করে। ওরা হলিউডি ছবি, জাপানি ছবি, কোরিয়ান ছবি সবকিছুই চালায়।

ম্যাজিক লণ্ঠন : চলচ্চিত্র প্রযোজনার ক্ষেত্রে অভিযোগ রয়েছে কালো টাকার প্রভাবে বাংলাদেশে এর অধঃপতন হয়েছে।

হাবিবুর রহমান খান : কালো টাকা বলে কিছু নাই। এটা ভুল। এই কনসেপ্টটাই তো রঙ।

ম্যাজিক লণ্ঠন : কালো টাকা অর্থাৎ অপ্রদর্শিত অর্থের কথা বলছি।

হাবিবুর রহমান খান : হ্যাঁ, অপ্রদর্শিত টাকা তো ছবিতে ব্যবহার করা যাবে না। কারণ, একটা নিয়ম হলো কী, আমি যদি ১০ লাখ টাকাও ওখানে লাগাই, তাহলে ইনকাম ট্যাক্স এসে আমাকে ধরবে, ওই ১০ লাখ টাকা আমার কাছে ছিল কী ছিল না- তার হিসাব আমাকে দিতে হবে। আমার কাছে তো বৈধ ১০ লাখ টাকা থাকতে হবে। আমি ১৫ লাখ লাগিয়ে হিসাব দিলাম ৫ লাখ কম করে। কিন্তু ক্যাপিটাল তো থাকতে হবে আমাদের। কালো টাকা, সাদা টাকা তো কোনো ব্যাপার না। আর কালো টাকা সাদা হবে কীভাবে? কেউ টাকা ছবিতে লাগিয়ে যদি লস করে; এটা আমি বহুদিন শুনেছি। কিন্তু হিসাবটা বুঝি নি।

ম্যাজিক লণ্ঠন : তাহলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎটা কী? এটা কি এভাবেই শেষ হয়ে যাবে?

হাবিবুর রহমান খান : এটা শেষ হবে না। এটা আলাদা একটা শেপ নেবে। তবে জানি না সেই শেপটা কেমন হবে। তবে এভাবে চলবে না। এখন যেভাবে চলছে, সেভাবে চলবে না। হলগুলো ডিজিটালাইজড হবে, সিনেমা ডিজিটাল হবে। তারপরেই এটা চলবে। এটা আসলে প্রযুক্তির পরিবর্তন। কাজেই এটা হবেই।

ম্যাজিক লণ্ঠন : মানে একটা উদ্যোগ তো শুরু করতে হবে। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয়গুলো যেমন- প্রেক্ষাগৃহ তৈরির ক্ষেত্রে কর অবকাশ, কিংবা টিকিটের ক্ষেত্রে যে কর এগুলো হ্রাস- সমিতির পক্ষ থেকে আপনারা তেমন কিছু কী ভাবছেন?

হাবিবুর রহমান খান : সমিতির পক্ষ থেকে আমি এরকম তেমন কিছু দেখি না। তবে ইন্ডিভিজুয়্যাল লোকজন চেষ্টা করছে গভর্নমেন্টকে বোঝানোর। গভর্নমেন্ট কিছু বুঝতেও পারছে। এবং রাজী হয়ে গভর্নমেন্ট বলছে, প্রত্যেক ডিস্ট্রিক্টে একটি করে সিনেপ্লেক্স করা হবে। এবং সেখানে গভর্নমেন্ট টাকা দেবে, জমি দেবে; মানে কাজ হচ্ছে আর কী।

ম্যাজিক লণ্ঠন : তাহলে সমিতির পক্ষ থেকে সাম্প্রতিক কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না।

হাবিবুর রহমান খান: আমি যেটুকু শুনেছি বা ব্যক্তিগতভাবে আমি কয়েকজনের সাথে কথা বলে বুঝতে পেরেছি, কিছু লোক কাজ করছে। সেইভাবে আমার জানা মতে সমিতিতে তেমন কোনো সিদ্ধান্ত হয় নি।

ম্যাজিক লণ্ঠন : আরেকটা বিষয় হলো, বাইরের ছবি আসছে আমাদের দেশে, ভাল কথা। কিন্তু সেন্সরের নীতিমালার জায়গায় দেখা গেছে যে, বাইরের ছবিতে অনেক কিছু অ্যালাউ, দেশের ছবি বানাতে গেলে মানে- চুম্বন, আলিঙ্গন, জড়াজড়ি করা এসব নিষিদ্ধ। সেক্ষেত্রে আমাদের ছবির কোনো আইন বা নীতিমালা কি পরিবর্তন করা উচিত?

হাবিবুর রহমান খান : একটা বিষয় কী, সিনেমা বানিয়ে তুমি তোমার মা ও বোনকে যদি দেখাতে না পারো। ওই সিনেমা হলে চলবে না। সুতরাং এইটা কোনো কথা হতে পারে না।

ম্যাজিক লণ্ঠন : আমরাতো হিন্দি ফিল্ম দেখছি, তো ওইটাই যদি বাংলায় করা হয় তাহলে তখনি তো কথা উঠছে?

হাবিবুর রহমান খান : না। বাংলায় ওটা আসবে না। কারণ ইংলিশে একটা ছবিতে কিসিং অ্যালাউ করে, এখানে সেন্সর করল- ওইটা ওদের কালচার।

ম্যাজিক লণ্ঠন : আমাদের দেশও তো অনেক আগাইছে। প্রেম-ট্রেমও হচ্ছে ইদানিং।

হাবিবুর রহমান খান : না না । প্রেম-ট্রেম হোক সেটাতে তো কেউ মানা করছে না। সারটেইন ছাড়তো দিচ্ছেই। সারটেইন ছাড় দিচ্ছে না তা না। অশ্লীল বা ভালগার কিছু দিচ্ছে না। তবে ছাড় তো দিচ্ছেই।

ম্যাজিক লণ্ঠন : মানে সেন্সর নীতিমালা আর যুগোপযোগী করার দরকার আছে কি?

হাবিবুর রহমান খান : না না। আর যুগোপযোগী করার দরকার নাই।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এই যৌথ প্রযোজনার ছবি তো অনেক দিন থেকেই শুরু হয়েছে। কিন্তু ওই ক্ষেত্রে পরিমাণ তো বাড়ছে না, এক্ষেত্রে বাধাগুলো কী কী?

হাবিবুর রহমান খান : বাধা অনেক।

ম্যাজিক লণ্ঠন : প্রধান বাধা কোনগুলো? আর কেনইবা পরিমাণ বাড়ছে না?

হাবিবুর রহমান খান : অনেক ছবিই চলে নি। আর সেজন্যই বাড়ছে না।

ম্যাজিক লণ্ঠন : কিন্তু বিনিয়োগে তো কিছু লাভ-লোকসান হবেই। তাই না?

হাবিবুর রহমান খান :  না না অনেকগুলো ছবিই মানে ম্যাক্সিমাম ছবিই তো চলে নি, তাই এমনটা হয়েছে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : তাহলে লাভ কী হলো? বলা হয় যে, বাজার বাড়ছে...

হাবিবুর রহমান খান : এটার কন্টিনিউয়িটি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু হয় নাই। এটা কন্টিনিউয়িটি হয় নাই, সেজন্য বাজার বাড়ে নাই। আর বাজার তো একদিনে বাড়ে না। আর কয়েকটা ছবি পরপর হলে ইন্ডিয়ান আর্টিস্টদের কাছে তা পরিচিত হতো। আমাদের আর্টিস্টরা সেখানে পরিচিতির সুযোগ পেত। এই টাইমটা তো পায় না।

ম্যাজিক লণ্ঠন : তো, সামনে এটা বাড়বে কি না, মানে বাড়ার সম্ভাবনা।

হাবিবুর রহমান খান : হতে পারে। সামনে বাড়ার সম্ভাবনাও থাকতে পারে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনি ছাড়া তো কম প্রযোজকই এই ধরনের রিস্ক নিয়েছে।

হাবিবুর রহমান খান : অনেকে আইন-কানুনের ঝামেলায় যেতে চায় না। আর একটুখানি রিস্ক তো নিতেই হয়। কেননা, দু’টা সংস্কৃতিতে ছবিটা চালাতে হবে। যাতে দু’টা জায়গায় চলতে পারে এই ধরনের একটা চিন্তা করতে হয়। গল্পটা সেইভাবে নিতে হয়। যেগুলো করতে একটু কষ্ট হয় এবং তা সময়সাপেক্ষও। তো আর কিছু?

লেখক : জাহাঙ্গীর আলম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ  সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী। বর্তমানে দৈনিক বণিক বার্তায় সহ-সম্পাদক হিসেবে কর্মরত। রাজীব আহসান চলচ্চিত্রের একনিষ্ঠ কর্মী

alam_rumc05@yahoo.com

rajibaahsan@gmail.com

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন