জাফর পানাহি
প্রকাশিত ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
‘সিনেমা সংশ্লিষ্ট লোকদের মুখোমুখি হওয়া সহজ হবে না, একথা সরকার জানতো’
জাফর পানাহি
পৃথিবীর কিছু অঞ্চলে চলচ্চিত্র এখনও আমলাতন্ত্রকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিতে ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের কাছে হুমকি হয়ে উঠতে পারে। ‘মূল্যবান’,‘প্রাচুর্যময়’ছবি হিসেবে মুক্তির আনন্দে সেন্সরবোর্ড গলে লাফিয়ে বেরোনো ছবিগুলোর বাইরে সিনেমাকে কিছু কিছু জায়গায় গুরুতর রাজনৈতিক পর্যালোচনা হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব। বিশ্বের খুব বেশি দেশে এ ধরনের ছবি নির্মাণ করার ‘সাহসী’মানুষ দেখা যায় না। বর্তমান বিশ্বে এ গুণাবলীর যে অল্প কয়েকজন নির্মাতা আছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ইরানের জাফর পানাহি।
ইরানের মিয়ানেহতে ১৯৬০ সালের ১১ জুলাই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই চলচ্চিত্রকারের জন্ম। ১০ বছর বয়সে ক্যামেরার সঙ্গে পরিচয় পানাহির। সেই বয়সেই আট মিলিমিটারে নির্মাণ করে ফেলেন একটি সিনেমা। এরপর শুরু করেন ফটোগ্রাফি। কিছু দিন চাকরি করেছেন সেনাবাহিনীতেও। চলচ্চিত্রের ঝোঁক থেকে পরে ভর্তি হন তেহরানের কলেজ অব সিনেমা এন্ড টেলিভিশনে। সেখানে পড়াশোনা করেছেন চিত্রপরিচালনা বিভাগে। এরপর কিছুদিন সহকারি পরিচালক হিসেবে কাজ করেন ইরানের আরেক বিখ্যাত পরিচালক আব্বাস কিয়োরোস্তামির সঙ্গে।
ইরানের নতুন ধারার সিনেমায় অত্যন্ত প্রভাবশালী পরিচালক পানাহি। নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু করে পানাহি অসামান্য কিছু চলচ্চিত্র বানিয়েছেন। তার সব কিছুই ইরানি সমাজের নানা বিষয়ে সরাসরি বা অনুচ্চভাবে ক্রিটিক্যাল। তাই সরকার ও পানাহির মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল শুরু থেকেই। এ কারণে গ্রেপ্তারও হয়েছেন কয়েকবার। ২০১০ সালের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত ছিলেন কারাগারে। সেখানে অনশন করেন,পরে মুক্তি পান জামিনে। একই বছর ইরান সরকার দেশের জাতীয় নিরাপত্তার বিরুদ্ধে অপরাধ করার অভিসন্ধি নিয়ে সমাবেশ ও ষড়যন্ত্রে যুক্ত হওয়াসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে অভিযোগ তোলে পানাহির বিরুদ্ধে। এই অভিযোগে ২০১০ সালের ২০ ডিসেম্বর পানাহির বিরুদ্ধে ছয় বছর কারাদন্ডের রায় দেন আদালত। একই সঙ্গে আগামী ২০ বছর সিনেমা নির্মাণ,চিত্রনাট্য লেখার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। জাফর পানাহির সঙ্গে একই সাজা হয়েছে তার দীর্ঘদিনের সহকারি ও আরেক ইরানি পরিচালক মোহাম্মদ রাসুলভের। পানাহি ২০০০ সালের ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে‘গোল্ডেন লায়ন’ও ২০০৩ সালে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে‘সিলভার বেয়ার’পুরস্কার পান। তার নির্মিত সিনেমাগুলো হলো দ্য য়ূনডেড হেড (১৯৮৮),কিস (১৯৯১),দ্য ফ্রেন্ড (১৯৯২),দ্য লাস্ট এক্সাম (১৯৯২),দ্য হোয়াইট বেলুন (১৯৯৫),আরদিকুল (১৯৯৭),দ্য মিরর (১৯৯৭),দ্য সার্কেল (২০০০),ক্রিমসন গোল্ড (২০০৩),অফসাইড(২০০৬)। তার শেষ তিনটি ছবি দি সার্কেল,ক্রিমসন গোন্ড,এবং অফসাইড নিজ ভূমিতেই নিষিদ্ধ হয়।
২০০৯ সালে মন্ট্রিল চলচ্চিত্র উৎসবে জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য যান পানাহি। সেখানে পিটার ক্যু দোভাষীর সহায়তায় পানাহির এ সাক্ষাৎকারটি নেন। পিটার ক্যু বর্তমানে বোস্টন ফিনিক্সে চলচ্চিত্র সম্পাদনার কাজে নিয়োজিত আছেন। ম্যাজিক লণ্ঠন এর জন্য ইংরেজী থেকে সাক্ষাৎকারটি ভাষান্তর করেছেন রুবেল পারভেজ।
পিটার ক্যু: ‘সবুজ স্কার্ভ’(সবুজ রংটি মূলত ইরানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদের শাসন ব্যবস্থার বিরোধিতার একটি প্রতীক। মন্ট্রিল চলচ্চিত্র উৎসবে মঞ্চে বিচারক হিসেবে ওঠার সময় জাফর পানাহি অন্যদের নিয়ে এই সবুজ স্কার্ভ পড়েই উঠেছিলেন) সম্পর্কে কিছু বলুন?
জাফর পানাহি: এটা ছিল আমার নিজস্ব চিন্তা। আমি স্কার্ভগুলো তেহরান থেকে কিনে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি বিচারকদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম স্কার্ভগুলো যদি তোমাদের পড়তে দেয়া হয়,তোমরা পড়বে কিনা। সৌভাগ্যবশত তারা স্কার্ভ পড়তে রাজি হয়েছিল এবং তা পড়ে উৎসব মঞ্চে উঠেছিল।
পিটার ক্যু: এর আগে অনুষ্ঠানের শুরুতে আপনি যখন লাল গালিচার ওপর দিয়ে হেঁটে আসছিলেন তখন বেশকিছু মানুষ আপনাকে অভিনন্দিত করেছিল। এই স্বতঃস্ফুর্ততার কারণ কী?
জাফর পানাহি: এটা ছিল আসলেই একটা স্বতঃস্ফুর্তঘটনা। যদিও আমি মনে মনে এটাই চেয়েছিলাম। আমি কিছু লোককে দেখলাম তারা উৎসবে সবুজ রঙে মুখ এঁকে এনেছে। তাদেরকে আমার তেহরানের লোক বলে মনে হলো। সবুজ মুখগুলো কিংবা সবুজ স্কার্ভ পড়া লোকগুলো কোনো ব্যক্তি বা দলের প্রতিনিধিত্ব করে না। তবে সবুজ রংটি আমাদের মাঝে ভবিষ্যতের আশা,আকাঙ্খার চিহ্ন হিসেবে কাজ করে। এটা (সবুজ রং) সরকার বিরোধিতা ও স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে কাজ করে। যা ইরানের জনগণের মৌলিক অধিকার।
আমি ওই সমাজেরই অংশ। আমারও কিছু না কিছু সমস্যা আছে। চার বছর ধরে আমার সিনেমা তৈরির কোনো অধিকার ছিল না। আমি ভেবেছিলাম তারা (সরকার) আমাকে অতি শিগ্গিরই সিনেমা বানাতে দেবে। এর ঠিক দেড় বছর পর আমি উৎসবে গিয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম সবার সামনে যাওয়া ও আমার অনুভূতি প্রকাশের এটিই উপযুক্ত সময়। আমার মতো ইরানে অনেক নির্মাতাই এখন সিনেমা বানাতে পারছেন না। আমরা এরকম হাজারখানেক নির্মাতা তেহরানের রাস্তায় নেমেছিলাম। যাদের প্রত্যেকেই সিনেমা নির্মাণের পর সেটা সেলফোনে,অনলাইনে ছেড়ে দিতে পারতো।
ইরানের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে সরকার নিয়ন্ত্রণ করে না। এখানে ব্যক্তি মালিকানাধীন কোনো টেলিভিশন চ্যানেল নেই। সিনেমা,সংবাদপত্র ও সাময়িকী সবকিছু সরকারের নিয়ন্ত্রণে। এর বাইরে কিছু আছে যেগুলো আধা-স্বায়ত্বশাসিতকিন্তু তারা যদি সামান্য পরিমাণও কিছু করে (সরকার বিরোধী) তাহলে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। দেশের বেশিরভাগ সাংবাদিকই এখন জেলে। এমন পরিস্থিতিতে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের উচিত জনগণের পাশে এসে দাঁড়ানো।
পিটার ক্যু: এখানে আমাদের সাথে এরকম খোলামেলা বক্তব্যের পর আপনি কি তেহরানে ফিরে যাবার ব্যাপারে শঙ্কিত?
পানাহি: দেখুন,আমি যখন ইরানে থাকি তখনও এইভাবেই কথা বলি। এক সপ্তাহ আগে আমি সেখানে (ইরানে) গিয়েছিলাম। সেসময় আমি,আমার পরিবারের সদস্য ও আরো কিছু লোক মিলে নিদার (নিদা আগা-সলতান হচ্ছেন সেই নারী,যিনি ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট আহমেদিনেজাদের বিরোধী আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। এরপর থেকে নিদা হয়ে উঠেন সরকার বিরোধী আন্দোলনের প্রতীক) সমাধিতে গিয়েছিলাম। এই অভিযোগে পরিবারের সদস্যসহ আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ধরনের অত্যাচার,নিপীড়ন দেশজুড়ে চলছিল। আপনি সেই মুহূর্তে দেশের যেকোনো স্থানে গেলেই একই রকম অবস্থা দেখতে পেতেন।
পিটার ক্যু: গ্রেপ্তার হওয়ার পর আপনার কেমন মনে হচ্ছিল?
পানাহি: সেদিন বেলা ১১টার দিকে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সিনেমা জগতের বাইরেও আমি এমন অনেককেই চিনতাম,যাদেরকে সেই মুহূর্তে আমার গ্রেপ্তারের বিষয়টি জানানো দরকার ছিল। সেসময় ওই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য আমাকে কিছু কৌশল গ্রহণ করতে হয়েছিল। আমাকে যে জায়গায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল,সেখানে বেশ কিছু লোক জড়ো হয়। তারা আমাকে মুক্ত করার চেষ্টা চালাতে থাকে। এজন্য তাদের নানা চাপ ও হুমকির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। সম্ভবত,সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে আমাকে ছেড়ে দেয়া হয়। ওই আট ঘন্টা সময় ওখানে যা ঘটেছিল তা আমাদের মিডিয়াগুলো খুব ভালোভাবে তুলে ধরেছিল। এটা সিনেমার ক্ষমতারই বহিঃপ্রকাশ। সিনেমা সংশ্লিষ্ট লোকদের মুখোমুখি হওয়া এত সহজ হবে না,একথা সরকার জানত। সরকারি গণমাধ্যম ঘোষণা করেছিল যে,এ ঘটনায় ভুলক্রমে পানাহি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তারা জানে সত্য কীভাবে আড়াল করতে হয়।
পিটার ক্যু: এই চাপ কি আন্তর্জাতিক বিশ্ব কিংবা ইরানের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের পক্ষ থেকে ছিল?
পানাহি: আমি শুনেছিলাম সারা বিশ্ব থেকেই এ নিয়ে চাপ আসছিল। যদি আমাকে দীর্ঘ সময় গ্রেপ্তার রাখা হয়- এমনটি ভেবে অনেক বিখ্যাত নির্মাতাই বড় ধরনের কিছু করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল।
পিটার ক্যু: ইরানের সাধারণ জনগণই যেখানে নির্যাতিত,নিপীড়িত সেখানে একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আপনি নিজেকে কতখানি স্বাধীনমনে করেন?
পানাহি:ইরান সরকার জনগণের সঙ্গে তাদের খুশিমতো যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। এর ফলে তারা এমন এক জায়গায় পৌঁছাবে সেখান থেকে পিছনে ফিরে আসা খুবই কঠিন হবে। এসব ক্ষেত্রে ওই ধরনের সরকার শুধুমাত্র গণহত্যার কথাই চিন্তা করতে পারে। আমরা জানি এখানে ঠিক কি কি ঘটতে যাচ্ছে,শুধু জানি না তা কখন ঘটবে।
পিটার ক্যু: আপনি তো তাহলে খুব বেশি আশাবাদী নন?
পানাহি: দেখুন,ক্ষমতাধররা কখনোই ক্ষমতা হারাতে চায় না। ইরানের সরকার জেলখানায় যে আচরণ করেছিল তা ছিল বিভীষিকাময়। কারাবন্দীদের বাইরের সাথে কোনো যোগাযোগ করতে দেয়া হয়নি। খুব জোরালোভাবে তারা জেলখানার ভেতরে চালানো অত্যাচার ও গোলাগুলির ঘটনাকে অস্বীকারকরেছে। সেইসব নির্যাতন ও গোলাগুলির ছবি সেলফোন দিয়ে ধারণ করে বাইরে পাঠানো হয়েছিল। এর মাধ্যমে এ সংক্রান্ত কিছু সাক্ষ্য-প্রমাণাদিও হাতে পাওয়া গিয়েছিল। জেলখানার মধ্যে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা বাইরের কেউ কোনদিন জানত না,যদি সেলফোনের সাহায্যে সেগুলো ধারণ করে বাইরে পাঠানো না হতো।
পিটার ক্যু: আপনার নির্মিত The Circle ইরানের সমসাময়িক ঘটনার ওপর নির্মিত একটি প্রতীকী ছবি। এই সিনেমায় ইরানের ত্রিশ বছর আগের এবং বর্তমান বিপ্লবের কোনো দমন-পীড়নমূলক বিষয় প্রকাশ পেয়েছে কী?
পানাহি: একদম ঠিক। কিন্তু এটাকে ৩০ বছর আগের সাথে তুলনা করা ঠিক হবে না। কারণ এখন ইরান শাসন করছে গোঁড়া মতবাদে বিশ্বাসী সরকার।স্বৈরশাসনএর চেয়ে অনেক ভাল। কারণ গোঁড়া মতবাদে বিশ্বাসী সরকারের স্বৈরাচারী স্বভাবেরসঙ্গে থাকে ধর্মীয় আদর্শ। যার ফলে তারা তাদের স্বৈরশাসনকেসহজেই ব্যবহার করে জনগণের ওপর জুলুম ও নিপীড়ন চালাতে পারে।
পিটার ক্যু: তার মানে এখানে যদি পরিবর্তন আনতে হয়,তাহলে শাহের পতনের জন্য যা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি রক্ত দিতে হবে?
পানাহি: এটা ভবিষ্য নয়। গ্রীষ্মের সময় অভ্যুত্থানের আগে (শাহ এর বিরুদ্ধে) আপনি যদি কাউকে জিজ্ঞাসা করতেন,এখানে কি অভ্যুত্থান হওয়ার সম্ভাবনা আছে?তখন একজন চরম আশাবাদী লোকও বলত,এটা এই শতাব্দীতেও হতে পারে,আবার ছয় মাস পরও হতে পারে। আমার আশাবাদ এই জন্য যে,এখন ইরানের জনগণ রাস্তায় নেমে গণতন্ত্র চর্চা করছে। আমিও তাদের মতই একজন ছিলাম। সেখানে সমাগত হয়েছিল প্রায় ২০ লাখ লোক। আমি তাদের সাথে প্রায় এক ঘন্টা ধরে হেঁটেছিলাম। সেখানে কেউই কিছু বলেনি,সবাই ছিল নীরব। আপনি এমনটি বিশ্বের কোথাও খুঁজে পাবেন না। যদিও ঐক্যবদ্ধ জনগণকে একে অপরের বিরুদ্ধে লাগানোর জন্য সেসময় সরকার সব ধরনের চেষ্টাই চালিয়েছে।
আমি আশা করি,ধৈর্য্য ধরার ব্যাপারে আমাদের যে অভিজ্ঞতা আছে সেটা সংগ্রাম চালিয়ে যাবার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। এবং আমরা আমাদের জাতীয় ঐক্য ধরে রাখতে সমর্থ হব। কিন্তু আমি শংকিত এজন্য যে,এতে তারা (সরকার) যদি সফল না হয়,তাহলে পুরো দেশ ধ্বংস করে ফেলবে। কারণ ইরানে অনেক জাতিসত্তার মানুষ রয়েছে।
অন্যদিকে ইউএসএসআর (দ্য ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশালিস্ট রিপাবালিকস্),সাবেক যুগোস্লাভিয়া,আফগানিস্তান ও ইরাকে যে ধরনের সমস্যা দেখা গিয়েছিল ঠিক একই ধরনের বড় সমস্যার উদ্ভব আমাদের এখানেও হতে পারে। আমাদের এখন প্রধান লক্ষ্য হলো পরস্পর এক হওয়া এবং ধৈর্য্য ধারণ করা। জনগণকে কোনোভাবেই তাদের ক্ষমতা থেকে সরানো যাবে না,শুধুমাত্র ওই একটি পথেই আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি। যার জন্য সবুজ রঙ সকল আশা আকাঙ্খার প্রতীক।
এগুলো মৌসাভীকে (পুরো নাম মীর হোসাইন মৌসাভী। বিরোধীদলীয় এই নেতাকে আহমেদিনেজাদ একটি বিতর্কিত নির্বাচনে পরাজিত করেছিলেন) সমর্থনের জন্য নয় অথবা অন্য কারো পক্ষে নয়। আমরা আন্দোলন করছি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য। সুতরাং সবার এই সবুজ রংয়ের নিচে শামিল হওয়া উচিত। আমরা কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা সরকারের সমর্থনে কাজ করছি না। আমাদের দায়িত্ব অনেক বড়। মাঝে মাঝে আমি শংকিত হই,এসব কী হচ্ছে?যেমনটি আমি The Circle এ দেখিয়েছিলাম। আমার নির্মিত আরেকটি সিনেমা Offside| যেখানে বন্দীত্ব থেকে মুক্তির বাসনা তুলে ধরা হয়েছে।
পিটার ক্যু: কিন্তু দুটি সিনেমাইতো ইরানে নিষিদ্ধ হয়েছে। আমরা কী এরপরও আশা করতে পারি এ জাতীয় আরও ভাল সিনেমা হবে?
পানাহি: ইরানের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে চলচ্চিত্র বানানো কখনো থামবে না। এখানে আগে থেকেই অনেক সস্তা সরকারি সিনেমা পাওয়া যায়। এক বছর আগে আমি একটি সাক্ষাৎকারে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম ইরানে আন্ডারগ্রাউন্ড সিনেমা নির্মিত হবে। এমনি একটি সিনেমা আমরা কানউৎসবে দেখেছিলাম। সেটি বহমান গবাদি’র Nobody knows about the persian cats| এটি সান সেবাসটিয়ানে (স্পেনের সান সেবাসটিয়ান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব) আবার দেখানো হবে। একই পথ ধরে এমনি আরও অনেক ছবি নির্মিত হচ্ছে। এই দেশে যদি তারা চলচ্চিত্র নির্মাণ বন্ধ করে দেয়,তবে পরিচালকরা আমাদের মতো করে অন্য পথ খুঁজে নেবে।
পিটার ক্যু: এবার আপনার চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে কিছু বলুন?
পানাহি: আমি ইরান-ইরাক যুদ্ধের শেষ দিনটি নিয়ে একটি সিনেমা নির্মাণ করতে চাই। গল্পটি প্রস্তুতই আছে। আমি এটি অবশ্যই তৈরি করতে চাই। আশা করি আমি ইরানেই এটি করতে পারব। যদি এখানে করতে না পারি তবে ইরানের ভৌগলিক অবস্থার মতো দেখতে অন্য কোনো জায়গা বেছে নেব। কিন্তু আমি আশাবাদী এটি ইরানেই করতে পারব। আমার সবসময় মনে হয় ইরানের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কোনোভাবেই দেশের বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না।
অনেককে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। কিন্তু আমি মনে করি আমাদের এখানেই থাকা উচিত। এবং ইরানের বর্তমান পরিস্থিতির ওপর সিনেমা বানানো উচিত। সম্ভবত,একদিন আমাকে সিনেমা বানাতে দেশের বাইরে যাওয়া লাগতে পারে। কিন্তু আমি আবার ফিরে আসব। যাহোক এখন আমার লক্ষ্য ইরানে থেকেই সিনেমা বানানো। আমি গল্পের অনেকটাই ইতিমধ্যে প্রস্তুত করে ফেলেছি। যদি তারা আমাকে সিনেমাটি করতে দেয়,তাহলে আমি ফিরে আসব এবং কাজ শুরু করব।
পিটার ক্যু: এই যে এখানে আপনি এতো খোলামেলা কথা বলছেন এবং যতদূর সম্ভব আগামী মাসে আপনি মুম্বাইচলচ্চিত্র উৎসবে প্রধান বিচারকের দায়িত্ব পালন করবেন- এগুলো কী আপনার পরবর্তী ছবি নির্মাণের ব্যাপারে কোনো সমস্যার সৃষ্টি করবে?
পানাহি: এখানে সমস্যা সব সময়ের জন্যই। কিন্তু আমি নিজেকে আটকে রাখতে পারি না। অন্য কেউ আমার ছবির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করুক তাও আমি চাই না। আমি সবসময় বলেছি,কাউকে আমি একটি কাঠামোও পরিবর্তন করতে দিব না। এটা আমার বিশ্বাস যদি আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করি তখন সিনেমাগুলো আর আমার থাকবে না। এবার আমি যখন আমেরিকাতে গিয়েছিলাম তারা আমার হাতের চিহ্ন নিতে চেয়েছিল। যদিও আমি তা করতে দিইনি। বিশ্বের যেকোনোখানে আমি আমার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো ধরনের অন্যায় মেনে নেব না।
পিটার ক্যু: আপনি কী (আমেরিকা নিয়ে) আপনার অভিজ্ঞতার কথা কিছু বলবেন। ইরানে আপনার গ্রেপ্তার হওয়ার সঙ্গে এর তুলনা করে কিছু বলুন।
পানাহি: এটা তুলনা করার মতো বিষয় নয়। আমেরিকায় তাদের নিজস্ব আইন আছে। যদি আমি সেখানে একজন ভ্রমণকারী হিসেবে যাই,তাহলে আমার উচিত তাদের আইন মেনে চলা। কিন্তু আমি সেখানে গিয়েছিলাম একজন নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে। এটা ছিল আমার ও আমার কাজের প্রতি এক ধরনের অপমান। কিন্তু আমি যেকোন জায়গার চেয়ে আমার দেশে কষ্ট সহ্য করতে রাজি আছি। কারণ এখানে আমি অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে চাই এবং কিছু আদর্শিক জায়গা তৈরি করতে চাই। কিন্তু অন্য দেশের আইন তাদের নিজস্ব| আমি তাদের বিরুদ্ধে যেতেই পারি। আমার দেশে আমার কার্যকলাপ শুধু প্রতিবাদ করাই নয়,কোনকিছু তৈরি করার একটি চেষ্টাও বটে। যদি আপনি কিছু তৈরি করতে ব্যর্থ হন,তবে আরও বেশি কষ্ট সহ্য করতে হবে।
পিটার ক্যু: গ্রেফতার হওয়ার পর আপনি কি কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন?
পানাহি: না,কোন সমস্যা হয়নি। তাদের কোনো অনুমতিও আমার দরকার নেই।
পিটার ক্যু: এই উৎসবে ইরানের কিছু ছবি দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে আপনার ছেলের তৈরি একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমাও রয়েছে। এগুলো নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?
পানাহি: এর আগে আমি অন্য সিনেমাগুলো দেখিনি। তবে আমি আমার ছেলের তৈরি সিনেমাটি দেখেছি। আমার ভালো লেগেছে। সিনেমার কাহিনী গড়ে উঠেছে,প্রতিবেশীর কাছ থেকে এক ব্যক্তির স্যাটেলাইট টেলিভিশনের সংযোগ চাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। আমার ছেলে তেহরানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সে ক্যামেরা হাতে নিয়েছিল এবং এই বিষয়টি নিয়েই একটি প্রামাণ্যচিত্রের কাজ শুরু করেছিল।
পিটার ক্যু: পশ্চিমারা সিনেমাকে শুধু বিনোদন হিসেবে দেখে। আপনি কি বিশ্বাস করেন সিনেমার রাজনৈতিক ভুমিকা আছে?
পানাহি: হ্যাঁ,এখানে সবকিছুই সরকারের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু সিনেমা এমন একটি মাধ্যম যা বাস্তবতা তুলে ধরতে পারে এবং জনগণ তাতে বিশ্বাসস্থাপন করতে পারে এ কারণেই সরকার এতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। হয়ত আপনার দেশের একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা কোন সমস্যায় পড়ে না,কিন্তু আমাদের দেশে সেই সম্ভাবনা প্রবল। হয়তবা ইউরোপে এটি শুধু বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা। তাই দুই দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এটি তুলনাযোগ্য নয়। আমাদের দেশে এটি শুধু টাকার প্রশ্ন নয়;এখানে আপনার পোশাক কেমন,আপনি কী খান,কী করেন এগুলোই প্রশ্নবিদ্ধ। সবকিছুই ইরানে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যখন আপনি ইরানে যান তখন এগুলো মেনে চলেন। যখন আপনি ইরানে গিয়ে তাদের আইনের কোনো বিচ্যুতি করেন তখন সরকার সাথে সাথে শক্ত হাতে তা বন্ধ করবে। কিন্তু জনগণ এগুলো খুঁজবে এবং দেখবেই। তারা স্যাটেলাইট ও অবৈধ ডিভিডি থেকে এগুলো পেয়ে যাবে। যখন Offsideনিষিদ্ধ হয়েছিল তার দুদিন পর পুরো দেশেই ডিভিডির মাধ্যমে এটি ছড়িয়ে পড়েছিল। এতে করে সরকার নিষিদ্ধ ছবির বিরুদ্ধে কঠোর হয়েছিল। এটি আমাকে The White Balloonএর কয়েকটি সংলাপ মনে করিয়ে দেয়। যেখানে একটি ছোট মেয়ে কিছু দেখতে যেতে চায়। কিন্তু তার বাবা-মা তাকে অনুমতি দেয় না। তখন তার দাদী তাকে জিজ্ঞাসা করে,সে কী দেখতে যেতে চায়?সে বলে,আমি তাই দেখতে চেয়েছিলাম,যা আমাকে দেখতে দেয়া হয়নি।
পিটার ক্যু: হলিউডের স্টুডিওর মতো না,তারপরও আপনি আপনার কাজকে পাইরেসি করার ব্যাপারে বাঁধা দেননি।
পানাহি: আমি আমার সিনেমা সবাইকে দেখাতে চাই। এতটুকুই আমার আশা। যদি আমার সিনেমা বিশ্বের সব জায়গায় প্রচার করা হয়,তাহলে আমার নিজের দেশেও তা দেখানো উচিত। আসলে সরকার মনে করে,পাইরেসির পেছনে আমার হাত আছে। আমি সরকারকে বিশ্বকাপ খেলার শুরুর আগেই Offside এর মুক্তি দেয়ার কথা বলেছিলাম। তারা আমার কথা রাখেনি,কিন্তু বিশ্বকাপ শুরুর ২০ দিন আগেই অননুমোদিত কপি সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। তারা মনে করেছিল এটি আমার পরিকল্পনা। আমি বলেছিলাম,‘আমার মনে হয়,আমাকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার জন্য আপনাদের পরিকল্পনার একটি অংশ এই অভিযোগ।’
পিটার ক্যু:এই উৎসবে আন্দ্রেজ ওয়াজদার Sweet Rush ছবিটি ছিল। এটা আমাকে অবাক করেছে যে,এখানে Man of Iron এর মতো এমন অনেক ছবি নির্মিত হয়েছে। এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
পানাহি: এটি সম্পূর্ণই অবিশ্বাস্য! ছবিতে অনেক কিছুই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এটা শেষ হয়েছে রক্তাক্ত হত্যাযজ্ঞ এর মধ্য দিয়ে। যদি এটা এই পথে চলে তাহলে সেখানে দুই দিক দিয়েই বিপর্যয় নেমে আসবে।
পিটার ক্যু: এর পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের বাইরের মানুষ কোন সাহায্য করতে পারে কি?
পানাহি: অবশ্যই না। ইরানের বাইরের জনগণ যদি কিছু করতে চায় তাহলে ইরানের সবাই এক হয়ে এর বিরুদ্ধে যাবে। স্বাধীনতাও গণতন্ত্রের জন্য ইরানের জনগণ মৃত্যুর বিনিময়ে যে কোনে কিছু করতে প্রস্তুত। যদি কোন শক্তিশালী দেশ হস্তক্ষেপ করে তাহলে ইরানের শাসক শ্রেণী আরো বেশি স্বৈরাচারিহয়ে উঠবে।
পিটার ক্যু: আপনি এমন কোনো সিনেমা দেখেছিলেন যা আপনাকে চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে উৎসাহিত করেছিল?
পানাহি: অনেক দিন আগের কথা,একটি সিনেমা আমার উপর দারুণ প্রভাব ফেলেছিল। সিনেমাটির নাম Bicycle thieves| নির্মাতা ছিল ভিত্তোরিও ডি সিকা। ছবির শুরুতে রিকির সাইকেলটি চুরি হয়। এবং শেষে সে নিজেই অন্য একটি বাইসাইকেল চুরি করার চেষ্টা করে। এটা ছিল আমার উপর অনেক বড় একটি প্রভাব। এই জন্যই আমি The Circle কে অন্যভাবে তৈরি করতে চেয়েছি। একই থিমের উপর একটি নতুন গল্পের মাধ্যমে।
পিটার ক্যু: সবুজ স্কার্ভের জন্য শুভ কামনা।
পানাহি: আমি আশা করি,সবুজ স্কার্ভের এই আন্দোলন কিছু সফলতা পেয়েছে। আমাকে জানানো হয়েছিল,তেহরানে এর বেশ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এই ঘটনায় তেহরানের একটি পত্রিকার প্রথম পাতায় স্বাধীনতারসম্পূর্ণতাকে নিয়ে একটি ছবি ছাপা হয়। যা ওই পরিস্থিতিতে সত্যিকার অর্থে কিছু নিয়ে এসেছে।
অনুবাদক:রুবেল পারভেজ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন