ইমরান হোসেন মিলন
প্রকাশিত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
ঢাকাই চলচ্চিত্রের কাহিনি
‘চরকায় করে গুনগুনাগুন নাটাই ধরে টানা’
ইমরান হোসেন মিলন
যেই মানুষ ভাবলো বৃষ্টি হ। আন্তরিকভাবেই ভাবল বৃষ্টি হ, তাতে বৃষ্টি হতে বাধ্য। এমনকি
শালিক পাখিও যদি ভাবে বৃষ্টি হ, তাতে বৃষ্টি হতে বাধ্য। এমন কি পিঁপড়েও যদি ভাবে বৃষ্টি হ,
তাহলে হতে বাধ্য। ... একটা বিড়াল যদি ঘণ্টাখানেক ধরে ভাবে ‘ভূমিকম্প হ, পৃথিবী কেঁপে
ওঠ’ তাহলে ভূমিকম্প হতে বাধ্য, ভূমিকম্প হবেই।
-বিনয় মজুমদার১
যেকোনো প্রাণীই নাকি আন্তরিকভাবে কিছু প্রত্যাশা করলে তা পূরণ হয়, হতে বাধ্য। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। তবে সেই ভাবনা বা চাওয়ার মধ্যে অবশ্যই ভক্তি থাকতে হয়। সেই ভক্তিভরেই বাংলাদেশের মানুষ চায় এদেশের চলচ্চিত্রশিল্প এগিয়ে যাক। তাদের চাওয়া, সবার সঙ্গে একাত্ম হয়ে চলচ্চিত্র শিল্প অর্থাৎ আর্ট হয়ে উঠুক। একই সঙ্গে শুধু নামেই ইন্ডাস্ট্রি না-থেকে কাজেও ইন্ডাস্ট্রি হোক।
অনেক চেষ্টার পরও কিন্তু বিজ্ঞানীরা ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেয় এমন কোনো লক্ষণ বের করতে পারেননি। তবে ভূমিকম্পের কারণ কারো কাছেই অজানা নয়। আমরাও এখন পর্যন্ত তেমন কোনো লক্ষণ বের করতে পারিনি, যে লক্ষণ চলচ্চিত্র নিয়ে অতীত ও বর্তমানের আলোকে ভবিষ্যতে আমাদের আশার সঞ্চার করাতে পারে। যে আশা আমাদের চলচ্চিত্রকে বিশ্ব দরবারে না হোক বাংলার দর্শকের কাছে পৌঁছে দিবে।
অন্য দেশগুলোর চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির দিকে তাকালে আমাদের চলচ্চিত্রের দৈন্যদশা খুঁজে পেতে কষ্ট হয় না। হলিউড-বলিউড-টালিগঞ্জ কিংবা অন্য যেকোনো ইন্ডাস্ট্রির কথাই বলি, সেগুলোতে কিন্তু চলচ্চিত্রের বিষয় উঠে এসেছে নানা দিক থেকে। একই সঙ্গে এই ইন্ডাস্ট্রিগুলো নির্দিষ্ট কোনো গল্পকাঠামোতে আটকে থাকেনি। হলিউডের কথাই ধরুন, বিষয় হিসেবে কী নেই সেখানে—ইতিহাস, মিথ, যুদ্ধ, অ্যাকশন, সায়েন্স ফিকশন, সত্য ঘটনা, মেলোড্রামা, কমেডি, প্রেমকাহিনি, ভৌতিক নানা বিষয়ে সেখানে চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। যেগুলোর একটার গল্পের সঙ্গে আরেকটার মিল খুব কমই লক্ষ করা যায়।
চলচ্চিত্র ইতিহাসের ৫৮ বছরে (১৯৫৬—২০১৪) ওই সব ইন্ডাস্ট্রির মতো আমরা কিন্তু চলচ্চিত্রে সেই বিচিত্রতা আনতে পারিনি; পারিনি ইতিহাস, যুদ্ধ, সায়েন্স ফিকশন কিংবা ভৌতিক ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে। এই দীর্ঘ সময়ে দু-একটি ছাড়া দেশে ইতিহাসভিত্তিক চলচ্চিত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। সামাজিক মেলোড্রামা, অ্যাকশন, প্রেম ও লোককাহিনির বাইরে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে তেমন কোনো বিষয় নেই বললেই চলে। এর বাইরে যা দু-একটি হয়েছে তা চলচ্চিত্রশিল্পে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। ফলে দর্শক নিরুপায় হয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে বিষয় বিচিত্রতা না খুঁজে কেবল গল্প খুঁজেছে। সেই গল্পের মধ্যে তারা চেষ্টা করেছে ভিন্নতা খোঁজার।
যে গল্পের শুরু হয়েছিলো ১৯৫৬ সালে মুখ ও মুখোশ দিয়ে, সময়ের সঙ্গে নতুন নতুন গল্পের দর্শক-চাহিদা বেড়েছে সত্যি; কিন্তু নির্মাতারা বের হতে পারেননি গল্পের সেই ন্যারেটিভ থেকে। আদি-মধ্য-অন্ত মিলিয়ে যে ন্যারেটিভ তারা দাঁড় করিয়েছেন, তা থেকে বের হওয়া বলতে কেবল কখনো গল্প একই রেখে ভিন্নতা আনা হয়েছে এর উপস্থাপনে। কোনো কোনো দশকে সামাজিক, অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলচ্চিত্রের গল্প বা কাহিনি একটু এদিক-ওদিক করে ছদ্মপ্রাতিস্বিকীকরণ, কখনোবা নির্দিষ্ট মান প্রমিতকরণ করা হয়েছে।
এমনও দেখা গেছে, প্রত্যেক দশকেই এমন দু-একটি গল্প বলা হয়েছে, যা সেই দশকের চলচ্চিত্রের মোড়-ই ঘুরিয়ে দিয়েছে। দর্শকদের নজর কেড়েছে, আগ্রহ বাড়িয়েছে, ব্যবসাও করেছে। কিন্তু পরক্ষণে আবারও আগের গল্পের কাঠামোতে ফিরে গেছেন নির্মাতারা। উদ্দেশ্যমূলকভাবে তেমনই কয়েকটি চলচ্চিত্র নিয়ে এগোতে থাকবে এই আলোচনা। আবদুল জব্বার খানের মুখ ও মুখোশ (১৯৫৬), জহির রায়হান নির্মিত জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০), জহিরুল হকের রংবাজ (১৯৭৩), চাষী নজরুল ইসলামের ওরা ১১ জন (১৯৭২), সালাহউদ্দিনের রূপবান (১৯৬৫), তোজাম্মেল হক বকুলের বেদের মেয়ে জোস্না (১৯৮৯), কাজী হায়াতের আম্মাজান (১৯৯৯) এবং মতিউর রহমান পানুর মনের মাঝে তুমি (২০০৩) গল্প বলার ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনেছিলো কি না সেটা নিয়ে যদিও কথা বলার অবকাশ আছে, তবে এটা ঠিক, যে কারণেই হোক চলচ্চিত্রগুলো ভালো ব্যবসা করেছে।
২.
বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ। জব্বার খান এখানে গল্প বললেন, গ্রামের এক জোতদার বাবার সন্তান হারানো; ডাকাত দলে সেই সন্তানের বেড়ে ওঠা; পুলিশ ও ডাকাত দলের মধ্যে সখ্য। আর কাহিনির পরিণতি ছেলেকে ফিরে পাওয়ার মধ্য দিয়ে। খেয়াল করলে দেখা যায়, মুখ ও মুখোশ-এর গল্পে দ্বন্দ্ব আছে, আছে নাটকীয় উপাদান। গ্রামীণ মানুষের জীবনের কথাও আছে; আছে নৃত্য, গীত। প্রথম চলচ্চিত্র, তাই ছবির আধেয় কী হবে কিংবা শিল্পমান কেমন হবে, নন্দনতাত্ত্বিক চিন্তা থাকবে কি না, এ নিয়ে পরিচালক হয়তো তেমন মাথা ঘামাননি। তিনি হয়তো কেবলই মনোযোগ দিয়েছেন নির্মাণের দিকে। যা দিয়ে দাঁড় করিয়েছেন একটা গল্প।
সামাজিক ড্রামা ও অ্যাকশন নির্ভর কাহিনি বলা শুরু হলো সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তার নানা ডালপালা বের হয়েছে। সেই ডাল কেটে নিয়ে অনেকে অন্য গাছে কলম করেছেন কেবল, ফলে নতুন স্বাদের কোনো ফল আসেনি। অবশ্য সাহস করে যে কেউ টিস্যুকালচার করেননি এমন নয়, তবে সেই নতুন গাছ কেউই বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারেননি। ফলে শেষ অবধি চলচ্চিত্রের কাহিনি নামের ওই ফল স্বাদে-গন্ধে-আকারে হয়ে উঠেছে একই রকমের। এর মধ্যে কয়েকটি জনপ্রিয় কাঠামো এমন :
ক) চলচ্চিত্র শুরুর কিছু পরেই সন্তান হারিয়ে যায়, অন্যের কাছে বড়ো হয়। সবশেষে কোনো একটি বিশেষ চিহ্নের (গান, লকেট) মাধ্যমে বাবা-মার কাছে ফিরে আসে সন্তান।
খ) ছোটোবেলায় বাবা-মা খুন হয় খলনায়কের হাতে। সেই খুনের বদলা নিতে সন্তান বড়ো হতে থাকে। একসময় খুনের বদলা নেওয়া হয়, একই সঙ্গে যতো বড়ো সহিংসতাই হোক নায়ক শেষ দৃশ্যে পাপ মোচন করে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসে।
গ) গরিব নায়ক/নায়িকা; স্বাবলম্বী হতে শহরে গিয়ে কাজ শুরু করে। এরপর অল্পবিস্তর চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দু-তিন মিনিটেই (কয়েকটা জাম্প শটে) সম্পদশালী হয়ে ওঠে। যদিও নায়িকার ক্ষেত্রে এমনটি কমই দেখা যায়।
ঘ) নায়ক গুণ্ডা কিন্তু সৎ ও পরোপকারী। ধনীদের অর্থসম্পদ লুট করে সে গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়।
জব্বার খান তার প্রথম চলচ্চিত্রে সন্তান হারানো, অন্যের কাছে সেই সন্তানের বড়ো হওয়া, শেষে বাবা-ছেলের মিলনের গল্প বললেন। এই দশকে অন্য যে চলচ্চিত্রগুলো নির্মাণ হয়, সেগুলো সামাজিক ড্রামা ও অ্যাকশন ধরনের হলেও গল্পের কাঠামোতে কিছুটা ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। পরিচালকরা আনকোরা হলেও তারা খান সাহেবের দেখানো পথে হাঁটেননি। অবশ্য ভিন্ন পথে হেঁটেও তারা যে বেশি দূর এগোতে পেরেছেন মোটেও তা নয়। তারা মূলত গল্প বললেন, পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়ে দেশাত্মবোধ জাগ্রত করার। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ৪৭-এর দেশভাগ ও পরবর্তীকালের সঙ্কটগুলো উঠে আসলো তাদের গল্পে। যে গল্পের সমাপ্তি ঘটে ১৯৫৯-এ আকাশ আর মাটি, মাটির পাহাড় ও এদেশ তোমার আমার নির্মাণের ভিতর দিয়ে।
পরের দশকের শুরুর দিকে উর্দু চলচ্চিত্র নির্মাণের ঝোঁক লক্ষ করা গেলেও অল্পদিনেই তা থেকে বেরিয়ে এসে সামাজিক ঘরানার চলচ্চিত্র নির্মাণ বেড়ে যায়। বলা যায়, এই দশকেই বাংলা চলচ্চিত্র শক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে চেষ্টা করে কিছু প্রতিভাবান নির্মাতার হাত ধরে। জহির রায়হান, এহতেশাম, খান আতাউর রহমান, সালাহউদ্দিনের মতো নির্মাতারা এ সময় চলচ্চিত্র-নির্মাণে মনোনিবেশ করেন। রাজধানীর বুকে (১৯৬০), কখনো আসেনি (১৯৬১), কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩), যে নদী মরু পথে (১৯৬১), সূর্যস্নান-এর (১৯৬২) মতো চলচ্চিত্রে দেখানোর চেষ্টা করা হয় সামগ্রিক সামাজিক অবস্থার ভিতর দিয়ে পারিবারিক দ্বন্দ্ব। পাশাপাশি প্রকাশ পায় রাজনৈতিক অবস্থা।
তবে সামাজিক ড্রামা ও অ্যাকশন ধরনের চলচ্চিত্রের পূর্ণকাল বলা যায় ৭০ দশককে। ১৯৭০ সালে জহির রায়হান নির্মাণ করেন জীবন থেকে নেয়া। তিনি সেখানে দেখালেন রাজনীতি ও সমাজ সচেতন একটি পরিবারের গল্প। এখানে জহির রাজনৈতিক টানাপড়েনের সঙ্গে রূপক অর্থে পারিবারিক সম্পর্কের টানাপড়েন ও দ্বন্দ্ব তুলে ধরেন অসাধারণভাবে। কিন্তু রূপকভাবে যে পারিবারিক ও সামাজিক দ্বন্দ্বকে জহির তুলে ধরলেন জীবন থেকে নেয়াতে, দ্বন্দ্বের সেই রূপই আসল হয়ে রাজত্ব করলো ৭০ পরবর্তী দু’দশকের বেশি সময় ধরে, যদিও গল্প উপস্থাপনে কিছুটা পার্থক্য ছিলো।
জীবন থেকে নেয়া নির্মাণের পরের বছর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়। এবার গল্পের বিষয় হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধ। যার শুরু চাষী নজরুল ইসলামের ওরা ১১ জন দিয়ে। রাজনৈতিকভাবে উত্তাল দেশ, ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ২৫ মার্চ হানাদার বাহিনীর হামলা, সারি সারি লাশ, দাড়ি-টুপিওয়ালা রাজাকার, ধর্ষণ, নয় মাসের যুদ্ধ, মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ আর ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে রাস্তায় নেমে আসা দেখালেন চাষী নজরুল ওরা ১১ জন-এ। বলা যায়, তিনি মুক্তিযুদ্ধের গল্পের একটা কাঠামো দাঁড় করালেন এর মধ্য দিয়ে। দু-একটি ছাড়া গল্পের এই কাঠামো ধরে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র-নির্মাণে সর্বোচ্চ মনোনিবেশ করেন নির্মাতারা।
মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রকে একটা ধরন বলে আলাদা করেছেন অনেকেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রথাগত কাহিনি থেকে মুক্তিযুদ্ধের যে চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে তা সামাজিক ড্রামা ও অ্যাকশন থেকে আলাদা হতে পেরেছে কি? মুক্তিযুদ্ধের চলতি গ্রান্ড ন্যারেটিভের বাইরে দাঁড়িয়ে ক’জনইবা গল্প বলতে পেরেছেন? বরং যখনই গ্রান্ড ন্যারেটিভের বাইরে গিয়ে কেউ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তাদেরকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩) থেকে হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৯৫), মুক্তির গান (১৯৯৫), মুক্তির কথা (১৯৯৯), রাবেয়া (২০১১) তার পরও নতুন কাঠামোতে নতুন গল্প বলেছে। আবার নতুন গল্প বলতে গিয়ে মেহেরজানকে কোনো আইনি বাধা ছাড়াই প্রেক্ষাগৃহ থেকে নামিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন নির্মাতা ও পরিবেশকরা।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্য একটা অন্যতম সময় বলা যায় ১৯৭৩ সালকে। এ বছরই জহিরুল হক নির্মাণ করেন রংবাজ। যদিও অনেকে এ সময় অভিযোগ তোলেন ‘অধিকাংশ চলচ্চিত্র পরোক্ষভাবে হলিউড এবং প্রত্যক্ষভাবে বলিউড বা বোম্বের হিন্দি কাহিনীর অনুকরণ ও অনুসৃত’২ বলে এর কাহিনি বা গল্প আমাদের সামাজিক কাঠামোর একেবারে বিপরীত। যে কারণে রংবাজ সমালোচকদের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। বস্তিবাসীদের ভগবান রাজা, অন্যদের চোখে মাস্তান-পকেটমার; একদিন চাকুরিজীবী নিম্নমধ্যবিত্ত এক ব্যক্তির পকেট কাটেন। পুলিশের তাড়া খেয়ে ঘটনাচক্রে তারই বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি; ঘটনার পরিসমাপ্তি রাজার ভালো হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। গল্পে একটু ভিন্নতার স্বাদ দেন পরিচালক। মারপিট, চটুল গান, পারিবারিক দ্বন্দ্ব সঙ্গে নায়ক, যে গুণ্ডা হয়েও ভালো মানুষ তা উঠে আসে এই গল্পে। চলচ্চিত্রটি ব্যবসাসফলও হয়। সামাজিক ড্রামার বদলে মানুষ প্রথম উপভোগ করে সামাজিক অ্যাকশন ধাঁচের চলচ্চিত্র। গল্পের মোড় ঘুরে যায় বাংলা চলচ্চিত্রের। সবাই এ সময় এই কাহিনি কাঠামোতে চলচ্চিত্র নির্মাণের দিকে ঝুঁকে পড়েন। পরের দিকে ৭০ থেকে ৯০ দশকে এই সামাজিক অ্যাকশন ধরনের চলচ্চিত্রের অতি আধিক্য চোখে পড়ে। যেখানে একই চলচ্চিত্রে নায়ককে গুণ্ডা হয়েও ‘ভালো মানুষ’ চরিত্রের তকমা দেওয়া হয়।
১৯৯২ সালে চলচ্চিত্রে আরেকটি মোড় ঘোরে কাজী হায়াতের দাঙ্গার মধ্য দিয়ে। যার অনুকরণে চলতে থাকে মারপিট নির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণ। এই কাজী হায়াৎ যখন ১৯৯৯ সালে আম্মাজান নির্মাণ করেন, তখন সামাজিক অ্যাকশন চলচ্চিত্র কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছে। কাজী হায়াৎ এই গল্পে দেখালেন-ছেলের সামনে মাকে ধর্ষণ, প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ধর্ষককে খুনের মধ্য দিয়ে ছেলের বড়ো হওয়া, এলাকার ত্রাস বনে যাওয়া; সঙ্গে গরিব ও অসহায়ের আশ্রয় বলে পরিচিতি পাওয়া। এর মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি প্রবেশ করে একটি নতুন গল্পকাঠামোয়। যে কাঠামোতে পরের বছরগুলোয় চলচ্চিত্র নির্মাণের হিড়িক পড়ে যায়। শুধু ২০০০ সালে বাংলাদেশে মুক্তি পেয়েছিলো প্রায় ৮৮টি চলচ্চিত্র। যার একটি বড়ো অংশের কাহিনি বা গল্প ছিলো-ছোটোবেলায় বাবা-মাকে খুন ও তার বদলা; যেকোনো কারণেই হোক সন্ত্রাসী হয়ে ওঠা; বস্তির ছেলে হয়ে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে বিরোধ আর খুনোখুনি করা। তবে ৯০ দশকেই এই অ্যাকশন বা মারপিট চলচ্চিত্রের সমান্তরালে নির্মাণ শুরু হয় টিনএজ প্রেমকাহিনি নির্ভর চলচ্চিত্র।
৩.
৬০-এর দশক বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গন দুটি বিপরীতমুখী ঘটনার সাক্ষ্য বহন করে। একদিকে উর্দুর আধিক্যে ঢাকাই চলচ্চিত্রের অস্তিত্ব সঙ্কট; অন্যদিকে কিছু নতুন গল্পে চলচ্চিত্রের ভিত মজবুত হয়। সেই সময় যে হারে বাংলার পাশাপাশি উর্দু চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়েছিলো, তাতে করে বড়ো ধরনের হুমকির মুখে পড়েছিলো বাংলা চলচ্চিত্র।
১৯৬২ সালের নির্মাণাধীন চলচ্চিত্রসমূহের পরিসংখ্যানদৃষ্টে উপলব্ধি করা যায়, সে বছর ঢাকায় মোট ১৬টি চলচ্চিত্র নির্মাণাধীন ছিলো। তন্মধ্যে মাত্র তিনটি ছিলো বাংলা ভাষায়, আর বাকী সবগুলোই উর্দু। এক বছরের ব্যবধানে এই অবস্থার আরো অবনতি ঘটে। সে বছর ঢাকায় নির্মাণাধীন চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে শতকরা প্রায় ৯০% ভাগই ছিলো উর্দু ভাষার।৩
অথচ বাংলাদেশের দর্শক কিন্তু তার জীবনের গল্পকে ভিন্ন ভাষায় দেখাটা সমীচীন মনে করেনি। এই অবস্থায় চলচ্চিত্রশিল্প একটা দোটানায় পড়ে। আবদুল জব্বার খান সামাজিক ড্রামা ও খানিকটা অ্যাকশন দিয়ে যে কাঠামো দাঁড় করিয়েছিলেন কেউই তার বাইরে বের হতে পারছিলেন না। তাই একদিকে যেমন চলচ্চিত্রের গল্প সঙ্কট, অন্যদিকে উর্দুর প্রাদুর্ভাব; ফলে দর্শক চলচ্চিত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। কিন্তু দর্শক-চাহিদা ছিলো চলচ্চিত্রের নতুন গল্প ও কাহিনির প্রতি। চাহিদার সেই দিকটিই হয়তো আঁচ করতে পেরেছিলেন নির্মাতা সালাহউদ্দিন। চলচ্চিত্রে নতুন গল্প বলে তিনি একটা নতুন ধরন দর্শকের সামনে তুলে ধরলেন। ১৯৬৫ সালে নির্মাণ করলেন এই ইন্ডাস্ট্রির প্রথম লোককাহিনি ভিত্তিক চলচ্চিত্র রূপবান। গল্পটা এমন-এক অলৌকিক বিশ্বাসকে ধারণ করে ১২ বছরের মেয়ের সঙ্গে ১২ দিনের নবজাতকের বিয়ে দেওয়া হয়। শর্তানুযায়ী সেদিনই তাদের পাঠানো হয় বনবাসে। এরপর দুজনের বেড়ে ওঠা, সময়ের আবর্তে সম্পর্কের টানাপড়েনই রূপবান-এর গল্প।
রূপবান পর্দায় ফেলা হলে দর্শক তা লুফে নেয়। নিজের ভাষায় নিজের জীবনের কথা-দর্শক যেনো মুখিয়ে ছিলো এমন একটি চলচ্চিত্রের জন্য। কিন্তু এই সাফল্যই যেনো কাল হলো; লোককাহিনি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য গল্পের একটি কাঠামো পেলো ইন্ডাস্ট্রি। যে কাঠামোর আদিতে পাপ, মধ্যে ফলভোগ এবং অন্তে রয়েছে মিলন। এই পাপ কখনো অলৌকিক, কখনো অপবাদ কিংবা ষড়যন্ত্রের ফল। রূপবান-এ দেখা গেলো পাপে রাজা-রানির সন্তান না হওয়া, সন্তান হওয়ার পর তাদের বনবাসে পাঠিয়ে প্রায়শ্চিত্ত এবং সব শেষে ফিরে আসার মধ্য দিয়ে মিলন।
ঠিক একই কাঠামোতে গল্পের আধেয়তে পরিবর্তন এনে জহির রায়হান ১৯৬৬ সালে নির্মাণ করেন বেহুলা। দেবীর কথা অমান্য করা অর্থাৎ পাপ; সন্তান হারানোর মধ্য দিয়ে তার ফলভোগ এবং শেষে স্বামীকে ফিরে পাওয়ার মাধ্যমে সুখে শান্তিতে বসবাস। এই কাঠামোয় একে একে নির্মাণ হয় রহিম বাদশা ও রূপবান, রাজা সন্ন্যাসী, আবার বনবাসে রূপবান, গুনাই বিবি, গুনাই, মহুয়া, ভাওয়াল সুন্দরী, আপন দুলাল, জরিনা সুন্দরীর মতো চলচ্চিত্র। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি আজ অবধি লোককাহিনি নির্ভর চলচ্চিত্রের গল্পকাঠামো এর বাইরে বের হতে পারেনি।
তবে এই দীর্ঘ সময়ে লোককাহিনি ভিত্তিক গল্পকাঠামোর সমান্তরালে অন্য দু-একটি গল্প পাওয়া যায়। যে গল্প ভিন্ন এই গল্পগুলোতে লোককাহিনির সঙ্গে সামাজিক ড্রামা ও অ্যাকশন চলচ্চিত্রের গল্পকাঠামোর সংমিশ্রণ ঘটেছে। ১৯৮৯ সালে তোজাম্মেল হক বকুল নির্মিত বাংলাদেশের অন্যতম ব্যবসাসফল বেদের মেয়ে জোস্নাকে এই সমান্তরাল গল্পকাঠামোর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ বলা যায়। যেখানে নির্মাতা একই সঙ্গে মিশ্রণ ঘটিয়েছেন কয়েকটি দিকের-মারপিট, লোককাহিনি ও প্রেম। এখানে লোককাহিনি কাঠামোর পাপ বা ভুল, ফলভোগ শেষে সর্বমিলনের সুখ যেমন আছে, তেমনই বাদ যায়নি সামাজিক ড্রামার সেই ছোটোবেলায় হারিয়ে পরে ফিরে পাওয়া আর সঙ্গে মারপিটে হেরে যাওয়া খলনায়ক। যদিও বেলা শেষে বেদের মেয়ে জোস্না অবশ্য লোককাহিনির অন্তর্ভুক্তই থাকে, কেবল অন্য দিকে খানিক বুদ্বুদ তোলে। বেদের মেয়ে জোস্না ব্যবসাসফল হলেও এর পরে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে লোককাহিনি কাঠামো ভিত্তিক আর কোনো চলচ্চিত্র এতো ব্যবসা করতে পারেনি, একই সঙ্গে এ ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণেও ভাটা পড়ে।
৪.
শিল্পমানসমৃদ্ধ চলচ্চিত্রের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প ৮০’র দশকে তীব্র সঙ্কটের মধ্যে প্রবেশ করে। একদিকে প্রত্যেক বছরান্তেই নির্মিত চলচ্চিত্রের সংখ্যাধিক্য, অন্যদিকে শিল্পমানের অধোগামিতায় সৃষ্ট এ সঙ্কট ৮০’র দশকের সূচনালগ্ন থেকেই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।৪ এই শিল্পমান কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে অবশ্য বলা হয়েছে চলচ্চিত্রের গল্প বা কাহিনি কোনোভাবেই বাস্তবানুগ নয়। এইসব চলচ্চিত্রে কাহিনির সামঞ্জস্য না থাকায় তা দর্শক টানতে ক্রমাগতভাবে ব্যর্থ হতে থাকে। যদিও এ সময় সামাজিক ঘরানার কিছু চলচ্চিত্র দর্শকনন্দিত হয়। আবার সেই সামাজিক ঘরানার মধ্যে ধনী-গরিবের প্রেমের মতো অসামঞ্জস্য বিষয়গুলোও ঢের উঠে আসে চলচ্চিত্রগল্পে। তবে শুধু প্রেমনির্ভর চলচ্চিত্র তখনো খুব কমই দেখা গেছে।
৯০ দশকের গোড়ার দিককে বাংলা চলচ্চিত্রের নতুন করে শুরু বলা যায়। ৮০ দশকের চলচ্চিত্রের শিল্পমানের অধোগামিতা দূর করে এই দশকের নতুন কিছু গল্প। লোককাহিনি, মুক্তিযুদ্ধ, অ্যাকশন থেকে এ সময় চলচ্চিত্র প্রবেশ করে প্রেমের গল্পে। তাই বলে এমনটি ভাবা যথার্থ হবে না যে, শুধু প্রেমনির্ভর চলচ্চিত্রই তৈরি হতো। অন্য গল্পের সমান্তরালে প্রেমকাহিনি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে আধিক্য দেখা যায়। যদিও চলচ্চিত্রের অন্যান্য ধরনের ভিতর প্রেম ছিলো। কিন্তু একেবারে নির্দিষ্ট করে প্রেমকে প্রধান গল্প হিসেবে পর্দায় হাজির করা হয় এ সময়। দাঁড় করানো হয় গল্প বলার নতুন কাঠামো।
প্রেমকাহিনি নির্ভর এসব চলচ্চিত্রে দেখা যায় :
ক) দুই পরিবারের দ্বন্দ্ব, অথচ সেই পরিবারের ছেলে ও মেয়ের মধ্যে প্রেম; প্রথমে মেনে না নেওয়া, পরে মিলন।
খ) খেলার সাথির হারিয়ে যাওয়া; পরিণত বয়সে দেখা, কোনো নির্দিষ্ট স্মৃতি ধরে পরিচয়-প্রেম, অতঃপর সুখে বসবাস।
গ) ত্রিভুজ প্রেম; নায়ক এক হলে নায়িকা দুই, অথবা নায়িকা এক হলে নায়ক দুজন। একজনের ত্যাগের মধ্য দিয়ে বাকি দুজনের মিলন।
১৯৯১ সালে এহতেশামের চাঁদনী একটি ভিন্নতা আনে চলচ্চিত্রগল্পে। নতুন ঢঙে এ সময় প্রেমের গল্প বলা শুরু হয়। ইন্ডাস্ট্রিতে তখন নায়ক-নায়িকার সঙ্কট তীব্র। যারা ছিলেন তারা ততোদিনে দর্শকের কাছে একঘেয়েমিতে পরিণত হয়েছেন। এমন সময় প্রেমের গল্প ও নবাগত জুটি নিয়ে হাজির হয় চাঁদনী। এর গল্পকাঠামো গড়ে ওঠে তরুণ-তরুণীর প্রেমকে কেন্দ্র করে। এটিও ব্যবসাসফল হয়। বিশেষ করে এর গানগুলো বেশ দর্শকপ্রিয়তা পায়। ফলে প্রেমনির্ভর কাঠামোয় চলচ্চিত্র নির্মাণের হিড়িক পড়ে। এ সময় ভারতের বেশকিছু গল্প নকল করে চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়। এই দশকের বেশিরভাগ চলচ্চিত্রের কাহিনিতে স্থান পেয়েছে প্রেম ও রোমান্স। কেয়ামত থেকে কেয়ামত (১৯৯৩), স্বপ্নের পৃথিবী (১৯৯৬), স্বপ্নের নায়ক (১৯৯৭), প্রেম যুদ্ধ (১৯৯৬), তুমি আমার (১৯৯৪) এর মতো চলচ্চিত্র ভালো ব্যবসা করলেও প্রেমের গল্পকাঠামোর উপরের তিন বৈশিষ্ট্যের বাইরে যেতে পারেনি। কলেজে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় নায়ক-নায়িকার ধাক্কা লেগে প্রেমে পড়া, আর চোখাচোখি হতেই কল্পনায় মাঠ-ঘাট-নদী-বন-পাহাড়ে গিয়ে গান গাওয়া-প্রেমনির্ভর চলচ্চিত্রের জন্য অনেকটা ‘স্ট্যান্ডিং ম্যাটার’ হয়ে পড়েছিলো। প্রেমনির্ভর চলচ্চিত্রে এমন উদ্ভট আচরণ পৃথিবীর খুব কম দেশের চলচ্চিত্রেই দেখা যায়।
২০০৩ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ প্রযোজনায় নির্মাণ হয় প্রেমনির্ভর আরেকটি চলচ্চিত্র—মনের মাঝে তুমি। এটিও চরম ব্যবসাসফল হয়। এখানেও দেখানো হয় ছোটোবেলার বন্ধুত্ব, ঘটনাচক্রে পৃথক হয়ে যাওয়া, বড়োবেলায় প্রেম, নতুন করে পরিচয়, সম্পর্কের ওঠানামায় মহামিলনে সমাপ্তি। এই চলচ্চিত্রের গানও দর্শকপ্রিয় হয়। যদিও এর গল্প চলতি কাঠামোকে অতিক্রম করতে পারেনি।
৫.
একদিকে মূলধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে চলচ্চিত্রশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা, অন্যদিকে সেই চলচ্চিত্রের শৈল্পিক উন্নয়ন-এই দুই স্রোতে এগিয়ে গেছে প্রায় প্রতিটি দেশের চলচ্চিত্রশিল্প। কেউ চলচ্চিত্র শিক্ষার ওপর বেশি জোর দিয়েছেন, তো কেউবা আবার এর নির্মাণের দিকটিকে প্রধান করে তুলেছেন। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন এই দুই দিককে নিয়েই ভেবেছিলো। তবে প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো বিখ্যাত সব চলচ্চিত্র দেখে তা পাঠ এবং চলচ্চিত্র-নির্মাণ। কিন্তু সেখানে খুব বেশি সার্থক হতে পারেনি চলচ্চিত্র সংসদ কর্মীরা। তাইতো আক্ষেপের সুর সংসদের অন্যতম সংগঠক মুহাম্মদ খসরু’র কণ্ঠে,
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর আমরা ভেবেছিলাম ইতালী অথবা ক্যুবার [কিউবা] ন্যায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রেও একটা যুগান্তকারী ঘটনা ঘটবে। যেমন ঘটেছিল সত্যজিৎ গুরু রেনোয়াঁর আগমনে পশ্চিম বাংলায়। কিন্তু এই দুই বিশিষ্ট চলচ্চিত্র-পুরুষ সত্যজিৎ-ঋত্বিকের বাংলাদেশে পদার্পণ একটা শুভ সূচনার ইঙ্গিত বহন করলেও তা ফলবর্তী হতে ব্যর্থ হয়।৫
যে কারণে আমরা খুব বেশি চলচ্চিত্র পাইনি এই সংসদ কর্মীদের কাছ থেকে। তবে এটা ঠিক, তাদের সেই অল্পের ভিতরেই লুকানো ছিলো চলচ্চিত্রের হরেক রকম গল্পের কাঠামো। একটা সময় অবশ্য চলচ্চিত্র সংসদ কর্মীরা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের আগে হাত পাকাতে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। এজন্য অবশ্য তারা ‘শর্ট ফিল্ম ফোরাম’-এর মতো পাটাতনে সমবেত হয়েছিলেন। তবে ‘শর্ট ফিল্ম ফোরাম’-এ কাজ করার আগেই সংসদ আন্দোলনের দুই কর্মী মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলী সূর্য দীঘল বাড়ি (১৯৭৯) নির্মাণ করে অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছেন। ৫০ দশকের দুর্ভিক্ষে মানুষের সামাজিক অবস্থার গল্পের ওপর নির্মাণ হয় সূর্য দীঘল বাড়ি। একদিকে স্বামী পরিত্যক্তা জয়গুণের সন্তান-স্বজন নিয়ে বেঁচে থাকার আপ্রাণ লড়াই, অন্যদিকে জয়গুণকে পাওয়ার তীব্র বাসনায় গ্রামের মোড়লের হিতাহিত জ্ঞানশূন্য কর্মকাণ্ডের ভিতর দিয়ে চলচ্চিত্রটির কাহিনি গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের দর্শকরা প্রথমবারের মতো একটা গল্প পায়, যেটা চলতি ধারা থেকে সহজে আলাদা করা যায়।
সেসময় বেশ কয়েকটি সংসদ কাজ করতে থাকে একসঙ্গে। সেই প্লাটফর্ম থেকে সবাই একত্রে ভালো গল্পনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণে মনোযোগ দেয়।
‘বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদ’-এর পক্ষ থেকে স্থাপন করে ‘ফিল্ম কো-অপারেটিভ’। চলচ্চিত্রম-এর মোরশেদুল ইসলাম, ঋত্বিক ফিল্ম সোসাইটি-র তানভীর মোকাম্মেল, অরোরা চলচ্চিত্র সংসদ-এর এনায়েত করিম বাবুল, ক্যাটওয়া ফিল্ম সোসাইটি-র তারেক মাসুদ, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ-এর শামীম আখতার ছোট ছবি নির্মাণ করে ভিন্ন ধারার নতুন বাতাবরণ সৃষ্টি করে।৬
যে বাতাবরণ থেকে আমরা পাই হুলিয়া (১৯৮৫), আগামী (১৯৮৪), দহন (১৯৮৫), চাকা (১৯৯৩), চিত্রা নদীর পারে (১৯৯৮), লালসালু (২০০২), মাটির ময়না (২০০২), কীত্তনখোলা (২০০০), বৃত্তের বাইরের (২০০৬) মতো চলচ্চিত্র। এগুলোর গল্পকাঠামো কিন্তু কোনোটার সঙ্গে কোনোটার মিল নেই। তবে সংসদ কর্মীরা সূচনালগ্ন থেকেই চলচ্চিত্রের তাত্ত্বিক দিক নিয়েই বেশি ব্যস্ত থেকেছেন। ফলে তাদের নির্মিত চলচ্চিত্র খুব বেশি আমরা পাইনি। এসব চলচ্চিত্রের কাহিনির ভিন্নতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই ঠিক। কিন্তু তার পরও প্রশ্ন আছে, তারা যে কাঠামোতে গল্প বলেছেন সেটা কার জন্য? পরিষ্কার করে বললে, কোন্ শ্রেণির দর্শকের জন্য? বাংলার আপামর যে দর্শক সারাদিনের কাজের শেষে একটু বিনোদন প্রত্যাশায় প্রেক্ষাগৃহে যান, সে গল্প কি তাদের তুষ্ট করতে পেরেছে?
৬.
‘সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ্’ জুড়ে দেওয়ার পর বাংলাদেশের চলচ্চিত্রেও মহান শক্তিমান আল্লাহর নামে যথেচ্ছাচার শুরু হয়ে যায়। এই যথেচ্ছাচারের শেষ উপসর্গ ছিল নকল ছবি।’৭ গত দশকের শুরুর দিকে আমাদের চলচ্চিত্রের দিকে তাকালে এই কথার সত্যতা পাওয়া যায়। সেসময়ের চলচ্চিত্রের গল্প বা কাহিনির দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে তার ভিতর কোনো নতুনত্ব নেই। গল্প নকলের হিড়িক পড়ে, যে নকল আজ পর্যন্ত চলছে।
নীতিগতভাবে শিল্পকলা চিরকালই পুনরুৎপাদনযোগ্য। একের শিল্পকর্ম বরাবরই অন্যের দ্বারা অনুকৃত হতো। শৈলীচর্চার অংশ হিসেবে শিষ্যরা ওস্তাদের কাজের নকল বানাতো, ওস্তাদ নিজেও নিজ শিল্পকর্মের প্রতিলিপি করতো প্রচার-প্রপাগান্ডার অংশ হিসেবে, আর অন্যরা করতো লাভের আশায়।৮
যে লাভের আশা আমাদের তরুণ চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে একটু বেশিই বলা যায়। তাই তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ওস্তাদদের কাজ নকল করতে। সম্প্রতি নির্মিত কিছু চলচ্চিত্রে এর সত্যতা পাওয়া যায়। চোরাবালি (২০১২), অগ্নি (২০১৪) ব্যবসাসফল ও দর্শকনন্দিত। এর কাহিনি-কাঠামোর দিকে খেয়াল করলে আমাদের ফিরে যেতে হবে গত তিন দশকের চলচ্চিত্রগল্পের দিকে। কী আছে এই চলচ্চিত্রগুলোতে বা কী নতুন কাহিনি বলতে পেরেছেন এই নির্মাতারা, যা দেখে দর্শক বাহবা দিচ্ছে!
ছোটোবেলায় বাবা-মার মৃত্যুর পর অসহায় ছেলের সন্ত্রাসী হয়ে ওঠা, একটা সময় সাংবাদিক নায়িকার প্রেমে পড়া, হত্যার বদলা নিতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের খুন এবং শেষে কারাগার থেকে বের হওয়া দেখালেন রেদওয়ান চোরাবালিতে। অগ্নিতেও একই গল্প বললেন ইফতেখার, ছোটোবেলায় বাবা-মার খুন হওয়া এবং প্রতিশোধ নিতে ‘সংকল্পবদ্ধ’ মেয়ের বেড়ে ওঠা; বদলা নেওয়া শেষ মানে চলচ্চিত্রও শেষ। এই দুই চলচ্চিত্রই সামাজিক অ্যাকশন ও ড্রামার চিরাচরিত সূত্র ধরে উৎপাদিত। তার পরও নিরুপায় দর্শক এগুলো দেখেছে।
৭.
তরুণ ও নতুন নির্মাতাদের মধ্যে একটা প্রবণতা প্রবলভাবে লক্ষ করা যায়, তাদের চলচ্চিত্র দেশের মানুষ দেখলো কি না তাতে তাদের তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। উদ্দেশ্যই থাকে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে পাঠানো। দেশের কোনো প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্রটি মুক্তি দেওয়া হলো কি না সেদিকে তাদের কোনো নজর নেই। অবশ্য বর্তমান সময়ে এই বিষয়টিকে স্বাভাবিক করার জন্য অনেক ‘ঘাগু’ নির্মাতা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিজ ব্যবস্থায় প্রদর্শন করছেন। এর ফলে যেটা হচ্ছে,
অলটারনেটিভ ছবি যতটা আমাদের দর্শকদের মূলস্রোত থেকে দূরবর্তী করেছে, বিদেশে প্রশংসিত বা বিদেশের পয়সায় নির্মিত ছবি আমাদের নৃতাত্বিক ও রাজনৈতিক পরিচয়কে বিদেশীদের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হতে দিয়েছে তারো চেয়ে বেশি। এটা এমন একটা গুলামগিরি- যা দেশের অশ্লীল ছবির জোয়ারের চেয়েও বেশি প্রাণঘাতি। এটার কুফল গিয়ে বর্তাবে আমার সন্তান সাধুর ওপর ... বিদেশনির্ভর ও ফেস্টিভ্যাল-ভিত্তিক সিনেমা নির্মাণ-প্রক্রিয়া ছোট ছোট দেশের বড়-ছোট নির্মাতাদের সম্ভাবনাকে একটা চোরাস্রোতের মধ্যে টেনে এনেছে হরহামেশাই।৯
ফল হচ্ছে এসব চলচ্চিত্রের গল্প নতুন হলেও তা আর সাধারণের জন্য থাকছে না। সাধারণ দর্শক যদি চলচ্চিত্র না দেখতে পায়, তাহলে সেটা নির্মাণ করে নির্মাতার কী লাভ? শুধুই কি পুরস্কার আর বিদেশখ্যাতি? এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো এই মাধ্যমটির মধ্য দিয়ে আমরা তাহলে আমাদের সন্তান-সাধুর জন্য কী রেখে যাচ্ছি? শুধুই কি গোলামগিরি?
লেখক : ইমরান হোসেন মিলন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিয়েছেন।
milonmcru@gmail.com
তথ্যসূত্র
১. বিনয় মজুমদার, উদ্ধৃত; আতিক, নূরুল আলম (২০০৯ : ২০); নতুন সিনেমা, সময়ের প্রয়োজন; পাণ্ডুলিপি কারখানা, ঢাকা।
২. ইসলাম, আহমেদ আমিনুল (২০১৪ : ১০৮); বাংলাদেশের চলচ্চিত্র : চলচ্চিত্রে বাংলাদেশ; ভাষাচিত্র, ঢাকা।
৩. প্রাগুক্ত; ইসলাম, আহমেদ আমিনুল (২০১৪ : ২৩)।
৪. ইসলাম, আহমেদ আমিনুল (২০০৮ : ২২৮); বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আর্থসামাজিক পটভূমি; বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
৫. খসরু, মুহম্মদ (২০১১ : ১৫৬-১৫৭); ‘শেষ সাক্ষাৎকার প্রথম নমস্কারের আগে’; সুবর্ণরেখা : প্রসঙ্গ ঋত্বিক; সম্পাদনা : মনিস রফিক; ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটি, রাজশাহী।
৬. আউয়াল, সাজেদুল (২০১৪ : ২৩৯); ‘নির্মল চলচ্চিত্র নির্মাণে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ভূমিকা’; সুবর্ণজয়ন্তী স্মারকগ্রন্থ : বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ইতিবৃত্ত [১৯৬৩-২০১৩]; সম্পাদনা : সাজেদুল আউয়াল; সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্যাপন পরিষদ, ঢাকা।
৭. আলম, মাহবুব (২০০৯ : ৫০); চলচ্চিত্র ভাবনা; ভাষাচিত্র, ঢাকা।
৮. মজুমদার, জাকির হোসেন ও মোহাম্মদ আজম; ‘যান্ত্রিক পুনরুৎপাদনের যুগে শিল্পকলা’; যোগাযোগ; সম্পাদনা : ফাহমিদুল হক ও আ-আল মামুন; সংখ্যা ৮, ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃ. ৫৪, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী।
৯. আতিক, নূরুল আলম (২০০৯ : ২৭); নতুন সিনেমা, সময়ের প্রয়োজন; পাণ্ডুলিপি কারখানা, ঢাকা।
বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জানুয়ারির ম্যাজিক লণ্ঠনের অষ্টম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন