মাহামুদ সেতু
প্রকাশিত ২৬ জানুয়ারী ২০২৩ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
দিস ইজ নট অ্যা ফিল্ম
বৃত্তবন্দি জাফরের বৃত্ত জয়
মাহামুদ সেতু
ভূমিকার পরিবর্তে
জাফর পানাহির ছয় বছরের কারাদণ্ড; ২০ বছরের জন্য চিত্রনাট্য লেখা, চলচ্চিত্র-নির্মাণ, সাক্ষাৎকার দেওয়া ও দেশত্যাগ নিষিদ্ধ—খবরটি পুরনো। তিনি গৃহবন্দি, যদিও ‘দেশের ভিতর তাকে স্বল্পমাত্রায় চলাফেরার অনুমতি দেওয়া হয়েছে’১। নতুন খবর হলো এতো কিছু কিন্তু জাফরের চলচ্চিত্র নির্মাণ বন্ধ করতে পারেনি। ২০১৩ সালেও তিনি ক্লোজড কার্টেন নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। আর বরাবরের মতো এটিও ইরান সরকার নিষিদ্ধ করেছে। তাতে কি! আনন্দের কথা হলো ক্লোজড কার্টেন ওই বছর বার্লিন উৎসবে প্রথমবারের মতো প্রদর্শন হয় এবং শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যের পুরস্কারও লাভ করে।
তার মানে শিল্পী জাফরকে ছুঁতে পারা রাষ্ট্রের জন্য একটু কঠিনই। তারা জাফরকে বার বার যে বৃত্তেই আবদ্ধ করতে চায়, জাফর সেই বৃত্তকেই তার স্টুডিও বানিয়ে ফেলেন। এর আগেও ২০১১ সালে যখন জাফর গৃহবন্দি, মামলার আপিল শুনানি চলছে উচ্চ আদালতে, তখনো তিনি চার দেয়ালের মধ্যে থেকেই নির্মাণ করেছিলেন তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র দিস ইজ নট অ্যা ফিল্ম। আবার ২০১৩’র জুলাইয়ে জাফর স্কাইপ-এর মাধ্যমে ইরান থেকেই যোগ দেন চেক প্রজাতন্ত্রের কারলোভি ভেরি চলচ্চিত্র উৎসবে।২ অবশ্য জাফরকে এসব ‘স্পর্ধা’ দেখানোর সুযোগ করে দিয়েছে প্রযুক্তি—এটা মনে রাখাও জরুরি। অর্থাৎ শোষকের হাতিয়ার প্রযুক্তিকে তিনি ব্যবহার করেছেন তাদের বিরুদ্ধেই। এটাই মনে হয় স্বার্থগত-সঞ্চালন। আর আমরা যারা বলি, চলচ্চিত্র ভয়ঙ্কর রকমের পুঁজিঘনিষ্ঠ মাধ্যম—এটা তাদের জন্য একটা চপেটাঘাতও বটে।
গত একশো বছরে চলচ্চিত্রের যে দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য দাঁড়িয়ে গেছে তার একটি হলো সমাজের প্রবলতর কণ্ঠস্বরের সঙ্গে মানিয়ে চলা, আর অন্যটি বাণিজ্যের সঙ্গে সমঝোতা করে চলা।৩ কিন্তু জাফরের মতো অনেকেই মানিয়ে চলতে পারেননি। তারা সমাজের ওই প্রবলতর কণ্ঠস্বরের পিছনে যে যুক্তি আছে তা নিরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছেন। যখন দেখেছেন ওই প্রবল কণ্ঠস্বর আসলে ফাঁপা, এর ভিতরে সত্যের লেশমাত্র নেই, তখন তারা এর সঙ্গে আর মানিয়ে চলেননি। মানুষকে বলতে চেয়েছেন, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন সমাজকাঠামোর ফাঁক-ফোকরগুলো। কিন্তু যখনই কেউ এ কাজ করেছে, তখন তা আর সমাজ-রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের সহ্য হয়নি। তারা এর পিছনে রাষ্ট্রদ্রোহিতার ছায়া দেখতে পেয়েছেন, আইনের খড়্গ নিয়ে ছুটেছেন সেই ব্যক্তির পিছনে। এই খড়গেই ‘বলি’ হয়েছেন ইলমাজ গু’নে, চার্লি চ্যাপলিন, জাফর পানাহি কিংবা অ্যাসাঞ্জ’রা—এরা মানুষকে দেখাতে চেয়েছিলেন কীভাবে তারা শোষিত হচ্ছে। এজন্য জাফরের চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তুই এমন যেখানে শোষণ সাধারণীকৃত।
দেশ, সমাজ কিংবা পরিবার—এই কাঠামোগুলোর নির্মাণ হয়েছে মানুষকে ‘ভালো’ রাখার স্বপ্ন দেখিয়ে। কিন্তু নির্মম সত্য হচ্ছে, এগুলোর ফাঁক-ফোকরের শেষ নেই। যে ফাঁকগুলো উপরের জনকে সুযোগ করে দেয় নীচের জনকে (ক্ষমতার দিক থেকে—ক্ষমতাটা অর্থবল, লোকবল বা দণ্ডবল [পুংদণ্ড] হতে পারে) শোষণের। শোষণটা অবশ্য শোষণ নামে সবসময় ঘটে না, প্রায়শই সেটা কাঠামোকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সমঝোতা ও মানিয়ে চলার নামে করা হয়। তবে এই মানিয়ে চলতে গিয়ে ছাড় দিতে হয় পরের জনকেই। যেমনটা আমরা দেখি দ্য মিরর-এ (১৯৯৭)। ইরানি সমাজে নারীর অবস্থা তুলে ধরার জন্য এখানে জাফরকে শুধু ক্যামেরা চালু রাখতে হয়েছে; আলাদা করে কিছু নির্মাণ করতে হয়নি। অনেকটা লাতিন আমেরিকার চলচ্চিত্রকারদের মতো, যারা তাদের চলচ্চিত্রে শোষিতের বাস্তব জীবনকে তুলে ধরেছেন। তাদের কাছে শোষিতের বাস্তব জীবনের গল্পই জীবন্ত চলচ্চিত্র, নির্মিত বাস্তবতা নয়। কারণ ‘কাহিনি তৈরি করে মানুষের প্রকৃত বাস্তব সংগ্রামকেই আড়াল করে দেয়া হয় এবং জীবন্ত সামাজিক ঘটনাকে কল্পনার আশ্রয়ে কাহিনি নির্মাণের পুরানো-পদ্ধতি দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়।’৪
সেজন্যই জাফর প্রথমে কাহিনি বলতে চাইলেও পরে তা জারি রাখেননি। দ্য মিরর-এর প্রথম অংশটি ফিকশন, যেখানে জাফর কেন্দ্রীয় চরিত্র বাচ্চা মেয়েটির (আসল নাম মিনা) স্কুল থেকে একা একা বাড়ি ফিরা দেখাতে চান। কিন্তু চলচ্চিত্রের মাঝামাঝি হঠাৎ মেয়েটি বেঁকে বসে; সে আর অভিনয় করবে না। এমন পরিস্থিতিতে জাফর ক্যামেরাকে কাট্ না বলে রোলিং করে যেতে বলেন; নির্মাণ করেন অর্ধেক ফিকশন, অর্ধেক ‘ডিরেক্ট সিনেমা’৫। আসলে এভাবে ক্যামেরা চালু রেখে তিনি বাস্তবতাকে তুলে আনতে চেয়েছিলেন মাত্র, যে বাস্তবতা নিজেই একটি চলচ্চিত্র। তাইতো মিনা অভিনয় বাদ দিয়ে একা একা বাড়ি ফিরে যেতে চাইলে জাফর তাতে বাধা দেননি। তিনি ক্যামেরা নিয়ে আড়াল থেকে তাকে অনুসরণ করতে থাকেন। যেটা তিনি ফিকশন করতে চেয়েছিলেন সেটা বাস্তবেই ঘটতে থাকে। একপর্যায়ে মিনা যে ট্যাক্সিতে ওঠে, সেখানে তার সহযাত্রী নারী-পুরুষের কথোপকথন থেকেই সেই সমাজে নারীর অবস্থা বোঝা যায়। চরম পরাধীন নারী সেখানে (আমাদের দেশেও বটে!) পুরুষের দাসীর ঊর্ধ্বে নয়! এমন একটি সামাজিক পরিমণ্ডলে জাফর ঠিক উল্টো পথে হাঁটলেন। মিনার একা একা বাড়ি ফিরা তারই ইঙ্গিত দেয়।
তবে শুধু দ্য মিরর নয়, সমাজে নারীর অবস্থান নিয়ে অভিন্ন পরিস্থিতি দেখা যায় দ্য সার্কেল (২০০০) কিংবা অফসাইড-এও (২০০৬)। চলচ্চিত্র দুটিতে প্রত্যেক নারীর গল্পই আলাদা কিন্তু শোষণের গল্প এক। সেখানে নারী শুধু নারী হওয়াতেই পুরুষের অধীন, শোষণের শিকার। একই কারণে নারীরা ইরানি সমাজে একা চলতে পারেন না, মাঠে গিয়ে খেলা দেখতে পারেন না, পারেন না একান্ত ব্যক্তিগত কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেও। জাফর তার চলচ্চিত্রে এ বিষয়গুলোই তুলে ধরলেন; কখনো বা এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে নারীকে দাঁড় করিয়ে দিলেন। অফসাইড-এ পুরুষের ছদ্মবেশে নারীদের মাঠে গিয়ে খেলা দেখা এমনই এক ঘটনা। আর এ সবই ইরানি সমাজের ‘প্রবল কণ্ঠস্বর’, নারীকে পরাধীন থাকতে হবে—আর এর বিরুদ্ধাচরণই জাফরের চ্যালেঞ্জ।
এমন কাজ জাফর বার বার করেছেন। দ্য সাইক্লিস্ট-এ (১৯৮৭) দেখা যায়, শোষকের কাছে যেটা খেলা, শোষিতের কাছে সেটা বাঁচা-মরার লড়াই। আর এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ভুল সামাজিক ব্যবস্থার কারণেই। এভাবে শোষিত হতে হতে একসময় শোষিতের কাছে শোষণই স্বাভাবিক মনে হয়। সাইকেল চালাতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় দ্য সাইক্লিস্ট-এর ওই চ্যাম্পিয়ন যেমন বাজির সময় শেষ হওয়ার পরও সাইকেল চালিয়ে যেতে থাকেন, তেমন আর কি। আবার ওই সব পুঁজিপতিরা যখন কোটি কোটি ডলার ব্যয় করে শুধু আরাম-আয়েশ, বিনোদনের জন্য, বিপরীতে অনেকে মাত্র এক ডলার ব্যয় করেই অকৃত্রিম সুখের সাগরে ভেসে যায়। দ্য হোয়াইট বেলুন-ও (১৯৯৫) একই কথা বলে। সেখানকার বাচ্চা মেয়েটি নববর্ষ উদ্যাপনের জন্য একটি গোল্ডফিশ কিনতে চায়, যার দাম এক ডলারও নয়। এ নিয়ে জাফরের ভাষ্য এ রকম, ‘পৃথিবীতে যেখানে কোটি কোটি ডলারে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়, সেখানে আমরা এমন এক মেয়েকে দেখাতে চাচ্ছি যার কাছে এক ডলারের ওই মাছটিই সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দের উপলক্ষ।’৬
জাফরের এসব চলচ্চিত্র ‘সিস্টেম’কে হুমকির মুখে ফেলেছিলো। তাই সিস্টেমেরও জাফরকে আঘাত করার প্রয়োজন পড়ে; জাফরদের নির্মূল করতে হয়। কিন্তু রাহু সূর্যকে গ্রাস করলেও, কিছু আগে-পরে সূর্য ঠিকই তা থেকে বেরিয়ে আসে। জাফরের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। রাষ্ট্র আইনের বলয়ে তার চলচ্চিত্র-নির্মাণ নিষিদ্ধ করলেও তা বন্ধ হয়নি। বলয়ের মধ্যে থেকেই তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে যাচ্ছেন, লড়াই জারি রেখেছেন; বলয় ভেদ করে তা আমাদের কাছে পৌঁছেও যাচ্ছে। নিষিদ্ধ হওয়ার পর গৃহবন্দি অবস্থায় জাফরের প্রথম চলচ্চিত্র দিস ইজ নট অ্যা ফিল্ম মূলত তার আত্মকথন। প্রামাণ্যচিত্রটিতে তার সঙ্গে কাজ করেন তার সহকারী মোজতাবা মিরতাহমাস। এখানে তিনি তার চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলেছেন, কথা বলেছেন তার প্রতি শাসকশ্রেণির ক্ষোভের জায়গা নিয়েও। তাই তার সম্পর্কে তার মুখ থেকে শুনতে চাইলে দিস ইজ নট অ্যা ফিল্ম দেখা অত্যাবশ্যক।
কারণ জাফর এমন এক পরিস্থিতিতে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন, যখন তার জন্য চলচ্চিত্র-নির্মাণ নিষিদ্ধ। মূলত তিনি তার রচিত সর্বশেষ (তখন পর্যন্ত) চিত্রনাট্যটি পড়ে শোনাতে এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। তিনি বলেন, ‘যতোদূর শুনেছি, ২০ বছর চলচ্চিত্র নির্মাণ, চিত্রনাট্য লেখা, বিদেশে যাওয়া, সাক্ষাৎকার দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যাক বাবা, অভিনয় করা বা চিত্রনাট্য পড়ার কথা কোথাও বলা হয়নি!’ আর এই ফাঁকটুকুই নিয়েছেন তিনি। আইনের এই ফাঁকটুকুই তার জন্য যথেষ্ট।
দিস ইজ নট অ্যা ফিল্ম ২০১১ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবের ১০ দিন আগে প্রদর্শনের ঘোষণা দেওয়া হয়। সেটি একটি কেকের ভিতরে পেন-ড্রাইভে করে ইরানের বাইরে ‘পাচার’ করা হয়েছিলো। জাফরের স্ত্রী ও মেয়ে সেই উৎসবে উপস্থিত ছিলেন। আর ৮৫তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে চলচ্চিত্রটি সেরা ১৫ প্রামাণ্যচিত্রের তালিকায় স্থান করে নেয়।
অন্যদিকে কাম্বোজিয়া পারতোভি’র (ইরানি চলচ্চিত্র-নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার) সঙ্গে করা জাফরের ক্লোজড কার্টেন তার মতোই নিগৃহীত এক লেখকের কাহিনি, যিনি কাস্পিয়ান সাগরের কাছে এক বাড়িতে তার পোষা কুকুর ‘বয়’কে নিয়ে আত্মগোপনে থাকেন। বাড়িটির সব দরজা-জানালা মোটা পর্দা দিয়ে ঘেরা। যেহেতু ধর্মীয় কারণে ইরানে কুকুর পালন নিষিদ্ধ, তাই তিনি এভাবে আত্মগোপন করেন। কিন্তু একদিন এক মেয়ে (মালাইকা) ও তার ভাই পুলিশের কাছ থেকে বাঁচতে ওই বাড়িতে আশ্রয় নেয়। বাড়িতে এসেই মেয়েটি পর্দাগুলো খুলে ফেলতে চায়। কিন্তু লেখক এতে বাধা দেন। এর পর হঠাৎ করেই মালাইকা গায়েব হয়ে যায়। আর জাফর তার পুরো ইউনিট নিয়ে পর্দায় হাজির হন। জাফরকে খেতে, গল্প করতে দেখা যায়। এরপর ক্লোজড কার্টেন-এর চরিত্রগুলো তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, বিশেষ করে মালাইকা। মালাইকাকে দেখা যায়, সে পানিতে নামছে; জাফরও তাকে অনুসরণ করে পানিতে নামে। হঠাৎ-ই আবার চলচ্চিত্রের মোড় ঘুরে যায়। জাফরকে বাড়িতে দেখা যায়। তিনি লেখককে মুঠোফোনে চলচ্চিত্রটির দৃশ্য ধারণের ছবি দেখাচ্ছেন, যেখানে মালাইকা ও তার ভাইয়ের সঙ্গে জাফরের প্রথম দেখা হয়েছিলো। চলচ্চিত্রটির শেষে জাফর বাড়ি ছেড়ে চলে যান। পর্দা পড়ে বন্ধ পর্দার (ক্লোজড কার্টেনের বাংলা তরজমা করা হয়েছে বন্ধ পর্দা—লেখক)।
তবে তার চলচ্চিত্রের পর্দা পড়লেও কাজে পর্দা পড়ে না। আর অক্লান্ত এই শিল্পীর সম্পর্কে তার মুখ থেকে শুনতে (পড়তে) আমরা এবার চোখ বুলাবো তার দিস ইজ নট অ্যা ফিল্ম-এর সংলাপ ও চিত্রনাট্যে। চলচ্চিত্রটির মূল সংলাপগুলো ফার্সি ভাষায়; ইংরেজি সাব-টাইটেল থেকে সংলাপগুলো বাংলায় ভাষান্তর করা হয়েছে।
দিস ইজ নট অ্যা ফিল্ম
সংলাপ ও চিত্রনাট্য
নাস্তার টেবিলে এসে বসেন জাফর পানাহি। জাফর রুটি মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে ফোন করেন সহকারী মোজতাবা মিরতাহমাস’কে। বাইরে সাইরেন বাজছে।
মোজতাবা : হ্যালো...। (ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে)
জাফর : হ্যাঁ, হ্যালো...।
মোজতাবা : কেমন আছেন?
জাফর : ভালো। তুমি?
মোজতাবা : এইতো আছি। কী করছেন?
জাফর : তেমন কিছু না; নাস্তা করছি আর কি। তুমি কি অফিসের বাইরে?
মোজতাবা : হ্যাঁ, একটু কাজ করছি।
জাফর : ও, তাহলে তো ব্যস্ত...।
মোজতাবা : একটু ব্যস্তই বলা যায়...।
জাফর : শোনো, একটা নতুন সমস্যায় পড়েছি। আর ওই ব্যাপারটার কী করলে?
মোজতাবা : আমি আরো খোঁজ নিচ্ছি। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছি। আসলে, আমি অপেক্ষা করছি সঠিক সময়ে শুরু করার জন্য।
জাফর : ও, তাহলে এখনো শুরু হয়নি।
মোজতাবা : না, আমি এদিক-ওদিক সুযোগ খুঁজছি। সিরিয়াসলি প্রোডাকশনের কাজ শুরু করিনি, টুকটাক কিছু করছি।
জাফর : শোনো, আমি... আসলে ফোনে এতো কিছু বলা যাবে না। বাসায় আসতে পারবে?
মোজতাবা : কি, কিছু হয়েছে?
জাফর : না, তেমন কিছু না। চলে এসো। নতুন একটা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, সেটাই বলতাম আর কি। আসো, দেখি দুজনে মিলে কী করতে পারি।
মোজতাবা : আচ্ছা, তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করবো।
জাফর : তাহলে আধ ঘণ্টার মধ্যে দেখা হচ্ছে?
মোজতাবা : আশা করছি। ট্রাফিকের অবস্থা তো জানেনই...।
জাফর : আচ্ছা ঠিক আছে। আর শোনো, এখানে আসার কথা কাউকে বলো না কিন্তু।
মোজতাবা : কেনো, সমস্যা?
জাফর : না, তা না। আচ্ছা আসো তো; রাখছি।
মোজতাবা : খোদা হাফেজ।
(পর্দা অন্ধকার হয়ে যায়। ফোনের রিং বাজে; টাইটেল কার্ডে চলচ্চিত্রটির নাম দেখা যায়। জাফরের শোবার ঘর; বিছানার এক কোণে টেলিফোন সেট রাখা। জাফর ওয়াশরুমে, আনসারিং মেশিনে তার স্ত্রী তাহেরে সাইদি’র বার্তা রেকর্ড হতে থাকে।)
তাহেরে : হ্যালো জাফর, ঘুম থেকে উঠেছো? শোনো, পানাহ্ (ছেলে) আর আমি আম্মার (জাফরের মা) ওখানে যাচ্ছি নববর্ষের উপহার দিতে। ওখান থেকে যাবো তোমার বোনের বাসায়। (পানাহ্’র উদ্দেশে) বাবার সঙ্গে কথা বলবে? নাও ধরো।
পানাহ্ : হ্যালো বাবা, আমি ক্যামেরা অন করে চেয়ারের উপর রেখে দিয়েছি। ব্যাটারিতে চার্জ মনে হয় বেশি নেই, যেকোনো সময় ফুরিয়ে যেতে পারে, বুঝেছো? রাখছি। (জাফর ওয়াশরুমের দরজা থেকে উঁকি মারেন)
তাহেরে : আর শোনো, বাড়ি ফিরতে দেরি হলে চিন্তা করো না। আবার ফোন করবো। ওহ, ইগি’কে (পোষা সরীসৃপ) খাওয়াতে আবার ভুলো না কিন্তু। আর এখনই বিছানা থেকে ওঠো। বেলকোনিতে ইগি’র খাবার রাখা আছে, ভালো করে ধুয়ে নিও। ইগি অসুস্থ হলে মেয়ে কিন্তু রাগ করবে। মনে করে ফুল গাছে পানি দিও। ফোন করতে দেরি হলে বা যদি ফোন করতে না পারি, চিন্তা করো না। (জাফর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসেন) আজ এমনিতেই সবাই ব্যস্ত, ফোন কেটে যেতে পারে। আর রাতে বাসায় আসতে দেরি হবে। পারলে ফোন করবো, ঠিক আছে। ভালো থেকো, রাখি।
(জাফর শোওয়ার ঘরের দরজা খুলে অন্য ঘরে গিয়ে দাঁড়ান। ফিরে এসে ক্যামেরা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। পরের দৃশ্যে তিনি রান্না ঘরে চায়ের পানি বসান। এরপর বেসিনে ইগি’র খাবার ধুয়ে একটি থালায় তুলে নেন। পরের দৃশ্য : মেঝেতে বসে ইগি’কে মুখে তুলে খাওয়াতে থাকেন।)
(ইগির খাওয়ানোর ছবি যাবে)
জাফর : তাড়াতাড়ি খাও এগুলো, জেদ করো না। (উঠে গিয়ে পনির নিয়ে এসে ইগি’র মুখের সামনে ধরে) পনির খাবে? (পনির ডানে-বাঁয়ে নাড়িয়ে) এইতো এখানে...।
(ইগি’কে খাইয়ে এসে, সামনে চা নিয়ে বসে তার আইনজীবী ঘেইরাত’কে ফোন করেন জাফর; চা পান করতে করতে কথা বলতে থাকেন।)
ঘেইরাত : হ্যালো? (ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে)
জাফর : হ্যালো, মিসেস ঘেইরাত।
ঘেইরাত : স্যার, কেমন আছেন?
জাফর : ভালো। আপনি কেমন আছেন?
ঘেইরাত : ভালোই।
জাফর : কোনো নতুন খবর আছে?
ঘেইরাত : না নেই। আপিল বিভাগ এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
জাফর : তাহলে আমার অবস্থা কী? মানে এই বছরেই ঝামেলাটা মিটে যাবে তো?
ঘেইরাত : এটা নির্ভর করছে বাইরে থেকে কোনো চাপ আসে কি না তার ওপর। চাপ আসলে তারা দ্রুত রায় দিতে পারে; না হলে দেরি হবে।
জাফর : আচ্ছা, আপিল বিভাগের বিচারকই কি চূড়ান্ত রায় দিবেন? আমার জানা দরকার।
ঘেইরাত : আমার বিশ্বাস সম্পূরক শাস্তি...।
জাফর : সেটা কী?
ঘেইরাত : মানে ৩০ বছরের ওই নিষেধাজ্ঞা।
জাফর : ২০ বছরের।
ঘেইরাত : ও হ্যাঁ, ২০ বছরের। আমার বিশ্বাস এটা ফিরিয়ে নেওয়া হবে। আর ছয় বছরের কারাদণ্ড কমানো হতে পারে। সবটাই অবশ্য আমার অনুমান।
জাফর : তার মানে আমাকে কারাগারে যেতেই হচ্ছে?
ঘেইরাত : হ্যাঁ, সেটা যেতেই হবে। তারা আপনাকে ছাড়বে না। অবশ্য খুব বড়ো ধরনের কোনো চাপ আসলে ভিন্ন কথা। তবে এটা ঠিক, আপনাকে একেবারে খালাস দিবে না।
জাফর : চাপ মানে? আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার কথা বলছেন?
ঘেইরাত : হ্যাঁ, দেশের ভিতরের চাপের কথাও বলছি। জনগণ চাইলে বড়ো ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। রাকশানও (Rakhshan Bani-E'temad, ইরানের প্রথম নারী চলচ্চিত্রকার, যিনি ইরানি চলচ্চিত্রের ‘ফার্স্ট লেডি’ হিসেবে পরিচিত) আমার সঙ্গে কথা বলেছেন।
জাফর : ও আচ্ছা।
ঘেইরাত : আমি তাকে সব বলেছি। বুঝতে পারছি না, কী করলে, কার সুপারিশে যে কাজ হবে!
জাফর : দেশের চলচ্চিত্রকর্মীরা কাজে লাগার মতো কোনো পদক্ষেপ এখনো নেয়নি, না? মানে, তারা যদি তেমন কিছু করে তাহলে তাদেরকেও নিষিদ্ধ করা হবে। অবশ্য আমি তাদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য আশা করছি না।
ঘেইরাত : বুঝেছি কী বলতে চাচ্ছেন। আমি চার মাস আগের একটা মামলার সাজা এই আদালতেই দুই বছর থেকে কমিয়ে এক বছর করেছি; তো বুঝতেই পারছেন।
জাফর : হ্যাঁ, কিন্তু...।
ঘেইরাত : না, কোনো আপিলেই বিচারক আগের সাজা একেবারে মওকুফ করেন না। তারা শুধু এটা বহাল রাখা বা কমাতে পারেন মাত্র।
জাফর : তাহলে আমি...।
ঘেইরাত : কিন্তু আমার যতোদূর মনে হয়, আপিল বিভাগ ২০ বছরের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে আর ছয় বছরের কারাদণ্ড কিছু কমাবে।
জাফর : ও, তার মানে আমি ব্যাগ গুছিয়ে দরজার কাছে রেখে দিই, নাকি?
ঘেইরাত : আসলে কী বলবো বলুন? আমি সত্যিই লজ্জিত। কী যে হবে বলতে পারছি না। আর বিচারটিও তো পুরোপুরি বেআইনি। এজন্য আদালত আমাদের বক্তব্যও শোনেনি। খোলাখুলি বললে—এটা একশো ভাগ রাজনৈতিক বিচার, আইনি নয়। গোটা ব্যাপারটাই আসলে সামাজিক অবস্থা, চাপ আর প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করছে।
জাফর : আচ্ছা, ধন্যবাদ। আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।
ঘেইরাত : না না, এভাবে বলবেন না।
জাফর : রাখছি এখন, খোদা হাফেজ।
(কথা শেষ করে মাথা চুলকিয়ে সামনে ক্যামেরা ধরা মোজতাবা মিরতাহমাস’কে লক্ষ্য করে হাসতে হাসতে বলেন)
জাফর : আমার ইচ্ছে হয় এই খোলসটা ছুড়ে ফেলি। আমার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র দ্য মিরর-এর কথা মনে আছে তোমার? ওটা একটি বাচ্চা মেয়ে মিনার গল্প। ওর মা ওকে স্কুল থেকে নিতে আসেনি। তাই সে নিজে নিজেই বাড়ি ফিরতে চায়। (দ্য মিরর-এর প্রাসঙ্গিক অংশটুকু ডিভিডিতে দেখিয়ে) এজন্য সে একটি বাসে ওঠে। বাসটি চলতে শুরু করলে সে বুঝতে পারে, বাসটি ভুল পথে যাচ্ছে। এটা সে মানতে পারেনি। তাই সে হঠাৎ বেঁকে বসে—আর অভিনয় করবে না। সে নিজে যা, তা-ই হতে চায়; বলে, ‘তোমরা যেটা দেখাচ্ছো (চলচ্চিত্রে) সেটা মিথ্যা। জানি না—তোমরা আমার কাছে কী চাও।’
(এল সি ডি টিভির সামনে দাঁড়িয়ে জাফর) আমার মনে হয়, আমিও এখন মিনার মতো সেই একই পরিস্থিতিতে পড়েছি। আমারও তার মতো এই অভিনয়ের খোলসটা ছুড়ে ফেলতে হবে। আজ সকালে আমি আমার চলচ্চিত্রগুলো দেখছিলাম। বুঝলাম, এগুলোতে বিচক্ষণতার ভান করা হয়েছে। এটাকে এখন মিথ্যা মনে হচ্ছে, এটা আমি না। যাহোক, যতোদূর মনে পড়ছে তুমি এমন একটি বিষয় নিয়ে চলচ্চিত্র বানাতে চাচ্ছো। আসলে বিষয়টা যেনো কী?
মোজতাবা : হ্যাঁ, ইরানি নির্মাতাদের চলচ্চিত্র না নির্মাণের পিছনের কারণ নিয়ে।
জাফর : এজন্যই আমি তোমাকে আসতে বলেছিলাম। তাহলে চলো, (হেঁটে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যান জাফর) এই বাড়িতেই আমরা একটা কিছু করতে পারবো আশা করছি। আর হ্যাঁ, আমি কিন্তু প্রযুক্তিতে অজ্ঞ। এখানে কি আলাদা আলোর ব্যবস্থা করতে হবে?
মোজতাবা : এখানে স্যাচুরেশনটা খুব বেশি। অতিরিক্ত এক্সপোজারও আসলে সমস্যা। জানালা দিয়ে অনেক বেশি আলো আসছে।
জাফর : (চিত্রনাট্য হাতে নিয়ে রান্নাঘরে যেতে যেতে) তাহলে আলাদা আলো লাগছে না? দাঁড়াও রান্নাঘর থেকে আসি।
মোজতাবা : রান্নাঘরে কী?
জাফর : (রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে) চা পান করতে করতে ভাবি কী করা যায়। (খাওয়ার টেবিলে বসে চিত্রনাট্যটি চোখের সামনে ধরে) যে জন্য এই চিত্রনাট্যটা নিয়েছি...।
মোজতাবা : একটু দাঁড়ান, জায়গাটা বদল করে নিই। (ক্যামেরা নিয়ে একপাশ থেকে অন্যপাশে যান মোজতাবা; ক্লোজ শটে জাফর)
জাফর : যে চিত্রনাট্যটা হাতে নিয়েছি, তুমি মনে করতে পারছো কি না জানি না—সর্বশেষ আমি এই চলচ্চিত্রটা বানাতে চেয়েছিলাম। এটাকে অনুমতির জন্য জমাও দিয়েছিলাম, দুর্ভাগ্যবশত তা অনুমোদন পায়নি। তাদের কথা মতো চিত্রনাট্যটা আরেকটু পরিমার্জনও করি। কিন্তু তার পরও আমাকে কাজ করতে দেওয়া হয়নি। তবে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে না পারলেও এটা আমি পড়তে তো পারি। চিত্রনাট্য পড়ে, ব্যাখ্যা করে এর একটা প্রতিচ্ছবি তো তৈরি করতে পারি। এতে দর্শক অন্তত দেখতে পাবে, এই চলচ্চিত্রটা বানানো হয়নি।
চলচ্চিত্রটা এক মেয়েকে নিয়ে, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা অনুষদে ভর্তি হতে চাচ্ছে। কিন্তু তার পরিবার তাকে কলা পড়তে অনুমতি দেয় না। (টেবিল থেকে উঠে গিয়ে কাপে আরো চা নেন জাফর) পরিবারের বিনা অনুমতিতেই সে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয় এবং পত্রিকায় তার নামও আসে। এটা দেখে মেয়েটির বাবা তার বাড়ির বাইরে বের হওয়া বন্ধ করে দেয়। (মোজতাবা’র উদ্দেশে) তোমার চা’টা কি গরম করে দিবো?
মোজতাবা : না, লাগবে না।
জাফর : (আবার টেবিলে এসে বসেন জাফর) তার বাবা-মা ছুটি কাটাতে বাইরে যাওয়ার সময় তাকে বাড়িতে তালাবদ্ধ করে রেখে যায়। এ অবস্থায় সে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজতে থাকে। কারণ, সময় মতো তেহরান যেতে না পারলে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না।
গোটা চলচ্চিত্রটাই একটি বাড়ির ভিতর ধারণ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা তো আর করতে পারলাম না। তাই চিত্রনাট্যটা বর্ণনা করতে সাহায্য করার জন্য তোমাকে এখানে ডেকেছি।
মোজতাবা : ও, তাহলে আপনি আপনার শেষ চিত্রনাট্য পড়ে শোনাতে চাচ্ছেন, যেটা নিয়ে আপনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারেননি?
জাফর : হ্যাঁ, সেটাই। কিন্তু এটা আমি বসে বসে পড়ে শোনালে সবাই বিরক্ত হবে। তাই আমি এটা করে দেখাতে চাই, যাতে সবাই সহজে বুঝতে পারে। এজন্য ভিতরে (বড়ো ঘরে) যেতে হবে, যাতে সেই পরিবেশটা তৈরি করা যায়। (তুড়ি মেরে) কাট্, কাট্...।
মোজতাবা : কাট্ বলে লাভ নেই। আপনি আর পরিচালক নন। এটা এখন অপরাধ! আপনি শুধু চিত্রনাট্য পড়ে শোনাতে পারেন মাত্র!
জাফর : (হাসতে হাসতে) তাহলে আমি আর পরিচালক নই!
মোজতাবা : না। আচ্ছা, আপনি শুধু চিত্রনাট্যটা বর্ণনা করবেন তো, ঠিক আছে বাকিটা আমি সামলাচ্ছি।
জাফর : আশা করছি এতে কাজ হবে। আচ্ছা, আমি যে চিত্রনাট্য পড়ে শোনাবো—এটা আবার অপরাধ হবে না তো?
মোজতাবা : হওয়ার কথা না।
জাফর : (হাসতে হাসতে) না, তা হবে না। যতোদূর শুনেছি, ২০ বছর চলচ্চিত্র-নির্মাণ, চিত্রনাট্য লেখা, বিদেশে যাওয়া, সাক্ষাৎকার দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যাক বাবা, অভিনয় করা বা চিত্রনাট্য পড়ার কথা কোথাও বলা হয়নি! (চিত্রনাট্য হাতে নিয়ে উঠে যান জাফর)
(বড়ো ঘরে গিয়ে) হ্যাঁ, এই জায়গাটা আমাদের কাজের জন্য উপযুক্ত হবে। যদিও এটা আমাদের প্রধান চরিত্র মরিয়মের সঙ্গে মিলে না, কারণ সে গরিব ঘরের মেয়ে। আমরা এখানে শুধু সেই আবহটা তৈরি করবো যাতে তার অবস্থাটা বোঝা যায়। একটু দাঁড়াও। (দ্রুত পাশের ঘরে যান জাফর। সেখান থেকে স্কচটেপ নিয়ে আসেন। টেপ এনে মেঝেতে দাগ টেনে ঘর বানিয়ে, বালিশ রেখে মরিয়মের শোওয়ার জায়গা দেখিয়ে এবং চেয়ার এনে জানালা হিসেবে দেখিয়ে)
(চেয়ারের সামনে বসে) প্রথম শটে দেখা যাবে মেয়েটি জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। এটা মোটামুটি ছয় সেকেন্ড ধরে দেখানো হবে। আমরা শুধু গলিটা দেখতে পাবো।
(স্কচটেপ দিয়ে মেয়েটির ঘরে প্রবেশের পথ ও বাড়িতে প্রবেশের দরজা দেখিয়ে) বাড়িতে ঢুকেই প্রথমে এটা হল রুম। আর সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ উঠে মেয়েটির ঘরে ঢুকতে হবে। (স্কচটেপ দিয়ে সিঁড়ির জায়গা চিহ্নিত করে দেখান জাফর। এরপর মুঠোফোনে শুটিং স্পট হিসেবে ঠিক করা বাড়িটির ভিডিওচিত্র দেখান। ভিডিওচিত্রে বাড়ির পাশের গলি ও একটি ছেলের দাঁড়িয়ে থাকার জায়গা দেখান।) ইস্পাহানে বেড়াতে গিয়ে আমি এই বাড়িটির সন্ধান পেয়েছি। বাড়িটির কিছু পরিবর্তন অবশ্য করতে হবে।
আমার গত পাঁচটি চলচ্চিত্র হয়েছে রাস্তায়। মূলত পর্দা প্রথার কারণে কখনো বাড়ির ভিতরে দৃশ্য ধারণ করিনি। এরপর মন্ত্রণালয়ে রিটার্ন নামে একটি চিত্রনাট্য জমা দিই। কিন্তু তারা এটার অনুমোদন করেনি। আমি বেশ কয়েক বছর ধরে এটার জন্য চেষ্টা করেছি, কিন্তু লাভ হয়নি। মূলত ইরাক-ইরান যুদ্ধের শেষ দিন নিয়ে লেখা একটি ছোটো গল্প অবলম্বনে রিটার্ন-এর কাহিনি। যুদ্ধ শেষে সৈনিকরা বাড়ি ফিরছে, কিন্তু তাদের জন্য পর্যাপ্ত যানবাহন নেই। ফলে কিছু সৈনিক রেল-লাইনে শুয়ে ট্রেন থামায়। তারা ট্রেনে ওঠার পরই দেখা যাবে যুদ্ধের বিভিন্ন সমস্যা। কিন্তু সরকার এটা নির্মাণের অনুমতি না দেওয়ায় আমি ভাবতে শুরু করি—কী করা যায়। চিন্তা করি যাতে এক জায়গাতেই গোটা চলচ্চিত্রটা শেষ করা যায়। এরপরই সিদ্ধান্ত নিই বাড়ির ভিতরে কাজ করার।
আমার পরের চিত্রনাট্য সি সমুদ্র পাড়ের এক হোটেল নিয়ে। সেখানে মাত্র তিন-চারটি চরিত্র ছিলো, এটিরও অনুমতি পাওয়া না গেলে বাড়ির ভিতরেই ধারণ করা যেতো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই বুদ্ধিটাও কাজ করেনি। এর পরের চলচ্চিত্রে আমি রাসুলভ্-এর (জাফর পানাহির সঙ্গে রাসুলভ্’কেও দণ্ড দেওয়া হয়েছে) সঙ্গে কাজ শুরু করি। এই বাড়িতেই চলচ্চিত্রটির ৩০ ভাগ কাজ হয়। কিন্তু একদিন হঠাৎ তারা এসে সব বন্ধ করে দিয়ে সব ফুটেজ বাজেয়াপ্ত করে। যাক সেসব কথা।
(আবারো চেয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে সেটাকে জানালা হিসেবে দেখিয়ে) চলচ্চিত্রের শুরুতে জানালা দিয়ে গলি দেখা যাবে। সেখানে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে থাকবে। একজন বৃদ্ধা গলি দিয়ে আসবেন। গলির মাঝপথে বৃদ্ধাকে তার বহন করা ভারী জিনিসটা নিয়ে যেতে ছেলেটা সাহায্য করবে। তারা আমাদের ফ্রেমের নীচ দিয়ে বের হয়ে যাবেন। আমরা গলির ওপরই স্থিরভাবে ক্যামেরা ধরে রাখবো। একটু পরে দোরঘণ্টির আওয়াজ পাওয়া যাবে আর ছেলেটি চলে যাবে। (চেয়ারের কাছ থেকে হেঁটে টেপ দিয়ে আঁকানো ঘরের সিঁড়ির কাছে আসেন জাফর; সিঁড়ি দিয়ে বৃদ্ধা কীভাবে উঠবেন তা হেঁটে দেখান) বৃদ্ধা বাড়িতে এসে সিঁড়ি দিয়ে উঠে মরিয়মের ঘরের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকবেন। দেখবেন মরিয়ম ঘুমিয়ে আছে। বৃদ্ধা মরিয়মের দাদি। আমরা তাদের কথোপকথন শুনতে পাবো।
(মিড ক্লোজ; জাফর ওই চেয়ারে বসে চিত্রনাট্য থেকে পড়তে থাকেন)
মরিয়ম বলবে, দাদি, আমাকে একটা মুঠোফোনের সিমকার্ড জোগাড় করে দিবে? (জাফর : অবশ্যই স্বাভাবিক কণ্ঠে না। সবে ঘুম থেকে উঠেছে, এখনো ঘুম জড়িয়ে আছে এমন কণ্ঠে বলবে।)
দাদির উত্তর, তোমার বাবা নিষেধ করেছে; তাকে বলেছো?
মরিয়ম বলবে, আমার ফোনের দরকার থাকতে পারে না?
দাদি বললেন, হয়েছে, এবার ওঠো ওঠো। (জুম ইন করে জাফরের ক্লোজ
জাফর : শারীরিক দুর্বলতার কারণে বৃদ্ধা ঘ্যানঘেনে সুরে বলবেন, এই শরীর নিয়ে প্রতিদিন তিনি আর আসতে পারবেন না। তার কথা থেকে আমরা এটাও বুঝতে পারি, তিনি বাড়িতে একা থাকেন। আর একমাত্র তিনিই মেয়েটিকে দেখতে আসেন। তিনি মরিয়মকে সেই ছেলেটির কথাও বলেন যে, ছেলেটি ভালো। আর ছেলেটি হয়তো তাদের প্রতিবেশী মেয়েটির প্রেমিক। চলে যাওয়ার আগে তিনি মরিয়মকে বলে যান, তিনি এক সপ্তাহ তাকে দেখতে আসতে পারবেন না। এরপর আমরা তার হেঁটে যাওয়ার শব্দ শুনি। আগের ওই গলির ফ্রেমেই আবার ক্যামেরা ধরা হয়। বৃদ্ধা যে পথে এসেছিলেন সে পথেই ফিরে যান। (জুম আউট, চেয়ার থেকে উঠে যান জাফর) দরজা খোলার শব্দ পাই আমরা, সঙ্গে সঙ্গে গলির শেষপ্রান্তে দাঁড়ানো ওই ছেলেটি সরে যায়। পর পরই বৃদ্ধাকে ওই গলি দিয়ে যেতে দেখা যায়। গলির শেষ মাথায় গিয়ে তিনি ডানে চলে যান। একটু পরেই ছেলেটি আবার আগের জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে এই জানালার দিকে তাকায়। এই হচ্ছে আমাদের প্রথম দৃশ্য।
(পরের দৃশ্য : মেঝেতে বসে স্কচটেপ দিয়ে দেখানো ঘরের এক জায়গায় বাথরুম দেখিয়ে)
আমাদের দ্বিতীয় শট্ হবে বাথরুমে। ক্যামেরা থাকবে বাথরুমের দরজার বাইরে, ভিতর থেকে পানির শব্দ পাওয়া যাবে। (বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে) এরপর দরজা খুলে যাবে আর আমরা এই প্রথম মেয়েটিকে দেখতে পাবো—তার মাথা কামানো! সে বিছানায় গিয়ে এক কোণায় বসবে। তারপর শুয়ে পড়ে মুখের উপর হাত বুলাবে সে (জাফর টেপ দিয়ে বানানো ঘরের এক জায়গায় বিছানা দেখিয়ে সেখানে বসেন এবং শুয়ে নিজের মুখে হাত বুলিয়ে দেখান)। এর পরই ফোন বেজে উঠবে। (শোয়া থেকে উঠে হাঁটু মুড়ে বসেন; ঘরের এক কোণায় নিজের মুঠোফোন রেখে সেটাকে টেলিফোন টেবিল দেখিয়ে) মেয়েটি টেলিফোন ধরবে কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ কথা বলবে না। সে মেঝের উপর রিসিভারটি ছুড়ে ফেলে নিজেকে বিছানায় এলিয়ে দিবে (আবারো আগের জায়গায় শুয়ে দৃশ্যটি বর্ণনা করতে থাকেন জাফর)। তার পর উপুড় হয়ে পড়ে বিছানায় মুখ লুকিয়ে কাঁদবে। এরপর চিত হয়ে কিছুক্ষণ সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে থাকবে। (দাঁড়িয়ে সিলিং-এর জায়গা দেখিয়ে) এই জায়গা থেকে একটি শক্ত দড়ি ঝুলবে। (একটি চেয়ার টেনে এনে বসেন জাফর) ক্যামেরা টিল্ট করে দেখাবে দড়ির নীচে একটি চেয়ারে মেয়েটি বসে আছে এবং একাগ্রচিত্তে তাকিয়ে আছে যেনো আত্মহত্যা করার আগে এটাই তার শেষ কাজ। আগের দৃশ্যে টেলিফোনটি ছুঁড়ে ফেলায় তা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিলো। এখন মেয়েটি সেই টুকরোগুলোর দিকেই তাকিয়ে আছে। কাট্...।
(পরের দৃশ্য, চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে মেঝেতে বসেন জাফর; টপ শটে তাকে ধরা। নিজের মুঠোফোনটি মেঝেতে রেখে) ভাঙা টুকরোগুলো এখানে আছে; এটা মূলত মেয়েটির পিওভি (point of view)। মেয়েটি টেলিফোনের ভাঙা টুকরোগুলো জোড়া দিচ্ছে। এমন সময় টেলিফোনটি বেজে উঠবে। সে রিসিভারটি কানে ধরবে। (জাফর তার মুঠোফোনটি কানে ধরেন)
মরিয়ম বলবে, হ্যালো, হ্যালো? আবার রিঙ বাজার শব্দ শোনা যাবে। সে এবার সেটের কাছে গিয়ে সুইচ চাপবে।... (ক্লোজ শট্; বিরক্ত হয়ে জাফর চশমা খুলে ফেলেন)
মোজতাবা : কী হলো? আর বলছেন না যে?
জাফর : হ্যাঁ, বলছি। আমরা ফোন কেটে যাওয়ার শব্দ শুনতে পাই। মরিয়ম এক মুহূর্ত ভাবে, যদিও সে বিভ্রান্ত...।
(কিছুক্ষণ থেমে থেকে) যদি এটাকে চলচ্চিত্র বলাই যায়, তাহলে তা কেনো বানাই আমরা? (চিত্রনাট্যটি ছুড়ে ফেলে পাশের ঘরে চলে যান তিনি)
(লঙ্ শট্) জাফর বেলকোনিতে দাঁড়িয়ে ধূমপান করছেন। এমন সময় দোরঘণ্টি বেজে ওঠে। সিগারেট নিভিয়ে দরজা খুলতে যান তিনি। (দরজায় দাঁড়িয়ে আগন্তুকের সঙ্গে কথা বলেন, আগন্তুককে দেখা যায় না।)
আগন্তুক : আস সালামু আলাইকুম, স্যার।
জাফর : ওয়া আলাইকুম সালাম।
আগন্তুক : এই যে আপনার খাবার।
জাফর : কতো টাকা?
আগন্তুক : টাকা লাগবে না, মনে করুন আপনি আজ আমাদের অতিথি।
জাফর : বাইরের অবস্থা কেমন?
আগন্তুক : তেমন কিছু না। এইতো কেবল শুরু হয়েছে (নববর্ষ উদযাপন উৎসব)। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরো জমজমাট হয়ে যাবে। জিজ্ঞেস করছেন যে?
জাফর : না, এমনি। এই যে আপনার টাকা। ঠিক আছে?
আগন্তুক : জ্বি, ধন্যবাদ।
জাফর : খুচরাটা আপনি রেখে দিন।
আগন্তুক : ধন্যবাদ স্যার।
(দরজা বন্ধ করে এসে টেবিলের উপর খাবার রেখে)
জাফর : এই যে আমাদের খাবার চলে এসেছে।
(পরের দৃশ্যে দেখা যায়, জাফর ডিভিডি প্লেয়ারে তার চলচ্চিত্র ক্রিমসন গোল্ড (২০০৩) চালিয়ে দিয়ে সোফায় বসেন। ডিভিডি প্লেয়ার ফাস্ট ফরোয়ার্ড করতে করতে)
জাফর : আমি ওই সিকোয়েন্সটা খুঁজছি, যেখানে হুসেন একটি জুয়েলার্সে যায় আর দোকানি তাকে অপমান করে। দৃশ্যটাতে সে এমনভাবে অভিনয় করেছিলো যে, আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিলো। একটু দাঁড়াও... (আবারো ফাস্ট ফরোয়ার্ড করতে করতে) এইতো... না, না এটা না। (দৃশ্যটা পেয়ে তা চালিয়ে দেন জাফর।)
(ডিভিডিতে চলা ক্রিমসন গোল্ড-এর দৃশ্যটি)
[দোকানি : না, আমাদের কাছে নেই। আপনি এটা গালুবান্দাক বাজারে পাবেন। জানেন, ওখানে একটি স্বর্ণের বাজার আছে। আমার মেয়ের বিয়ে হলে আমি তাকে বলতাম স্বর্ণালঙ্কার না কিনে কিছু সোনা কিনতে। সোনা থাকলে তা যেকোনো সময় টাকা বানিয়ে ফেলা যায়।
হুসেনের ভাবী স্ত্রী : ও আচ্ছা। খোদা হাফেজ।
দোকানি : শাদি মোবারক।
(দোকান থেকে বেরিয়ে আসেন হুসেন, তার ভাবী স্ত্রী ও ভাবী শ্যালক)
হুসেনের ভাবী স্ত্রী : কী হয়েছে তোমার?
ভাবী শ্যালক : কী হলো আপনার?
হুসেনের ভাবী স্ত্রী : আলির কসম, ও আমাকে এই রকম পোশাক পরতে বলেছিলো। আমি পরতে চাইনি।
ভাবী শ্যালক : দোকানি জানে না কার সঙ্গে কথা বলেছে। সিগারেট খাবেন?
হুসেন : না, আমার ঠাণ্ডা লাগছে।
ভাবী শ্যালক : আমি জ্যাকেট এনে দিচ্ছি।
হুসেনের ভাবী স্ত্রী : তুমি কি আমার ওপর বিরক্ত?
হুসেন : না, না।
ভাবী শ্যালক : এই যে আপনার টুপি আর জ্যাকেট। আপনাকে কি বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে?
হুসেন : না। তুমি চলে যাও।
ভাবী শ্যালক : আপাকে কি আপনি পৌঁছে দিবেন?
হুসেন : হ্যাঁ, পৌঁছে দিবো। তুমি যাও।
ভাবী শ্যালক : খোদা হাফেজ।
হুসেনের ভাবী স্ত্রী : খোদা হাফেজ।]
(হুসেনের দুই হাত দিয়ে মাথা ধরে থাকার দৃশ্যে স্থির করে, সোফা থেকে উঠে এল সি ডি টিভির সামনে গিয়ে দাঁড়ান জাফর; ক্যামেরা প্যান করে)
জাফর : এই জায়গাটা দেখো। যখন তুমি চলচ্চিত্রের গল্পটা বলছো তখন অবশ্যই ডিটেইলে সব বলতে হবে। কিন্তু হুসেনের মতো অপেশাদার অভিনেতার ক্ষেত্রে ডিটেইল আগে থেকে অনুমান করা সম্ভব না। তুমি লিখবে এক রকম, কিন্তু লোকেশনে গিয়ে যখন অপেশাদার কেউ কাজটা করবে তখন সে-ই তোমাকে পরিচালনা করবে। ও তার মতো করে তোমাকে দিয়ে গল্পটা বলাবে। মানে বলতে চাচ্ছি, চলচ্চিত্র প্রথমে নির্মাণ হয় আমাদের জন্য, যাতে পরে তা ব্যাখ্যা করতে পারি। তাহলে চলচ্চিত্রটা নির্মাণের আগেই আমি তা কীভাবে ব্যাখ্যা করবো? দৃশ্যটাতে হুসেনের কাজ ছিলো দেয়ালের উপর মুষড়ে পড়া (যাতে ওর করুণ অবস্থা বোঝা যায়)। আর ও সেটা করেছে তার চোখ দিয়ে, যেটা আমি আগে থেকে কল্পনা করিনি। মানে, আমি যখন তাকে অভিনয় করতে বলেছি সে নিজের মতো করেই করেছে।
আমি জানি না, হয়তো আমি সময়টাকে ধরে রাখছি (ক্যামেরা প্যান করে; আবারো সোফায় গিয়ে বসেন জাফর)। তবে যেটা করছি সেটাকেও মিথ্যা বলেই এখন মনে হচ্ছে, প্রথম যে সিকোয়েন্সটা দেখেছি তার মতোই। বাকিটুকুও একসময় যেভাবেই হোক মিথ্যা বলে প্রতীয়মান হবে। (উঠে গিয়ে ডিভিডির তাক খুঁজতে খুঁজতে) সার্কেল-এর কথাই ধরো, কোথায় রেখেছি...।
মোজতাবা : কিন্তু আপনি তো এখন আর চলচ্চিত্রই বানাতে পারবেন না!
জাফর : চলচ্চিত্র বানাতে পারবো না তো কী হয়েছে (জাফর ডিভিডি চালিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ান)! সেজন্যেই তোমাকে দিয়ে আমার নিজের চলচ্চিত্র ধারণ করাচ্ছি। কিন্তু এটা কি কোনো শিল্প হবে? (সোফায় গিয়ে বসেন)
মোজতাবা : ও, এজন্যই ডেকেছিলেন?
জাফর : কী জন্য?
মোজতাবা : এই যে, আমাকে আসতে বললেন। আপনি নাকি কয়েকটা শট্ (চলচ্চিত্র-ধারণ) নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তার পর চলচ্চিত্র বানানোর অপরাধে আপনার বিচার চলছে, আপিলের রায়ের জন্য আপনি অপেক্ষা করছেন। আপনার ওপর ২০ বছরের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, ছয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
জাফর : তো?
মোজতাবা : আর আমরা এখানে যেটা করছি সেটাও এক প্রকারে চলচ্চিত্র সম্পর্কিত একটা কাজ—আপনি করেছেন, করছেন; আমিও করবো।
জাফর : কী করবে?
মোজতাবা : এই যে চলচ্চিত্রটা বানাচ্ছি।
জাফর : তুমি এটাকে চলচ্চিত্র বলছো?
মোজতাবা : এটাকে আমি চলচ্চিত্রই বলবো।
(ডিভিডিতে চলা সার্কেল-এর দৃশ্য দেখিয়ে)
জাফর : আচ্ছা আসো। এই সিকোয়েন্সটা দেখো। (সোফা থেকে উঠে আবারো টিভির কাছে যান জাফর) এই দৃশ্যটিতে লোকেশনই কিন্তু সব বলে দিচ্ছে। (ডিভিডিতে চালানো সার্কেল-এ এক মেয়ের দৌড়ানোর দৃশ্য দেখিয়ে মোজতাবা’র উদ্দেশে বললেন, দৃশ্যটা ধারণ করো) উদ্বেগ বোঝানোর জন্য অভিনেত্রীকে কোনো ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন দিতে হয়নি। এখানকার (দৃশ্যতে দেখানো) এই উল্লম্ব পিলারগুলো তার মানসিক অবস্থা প্রকাশ করে। এগুলো বিষয়টাকে খুব সুন্দর করে উপস্থাপন করেছে। তাহলে আমি এখানে এই বদ্ধ ঘরে, আঁকানো রেখার সাহায্যে কীভাবে আমার চিন্তাটাকে প্রকাশ করবো? এটা অসম্ভব! চলো, আবার চেষ্টা করি। দেখি আগের চেয়ে আরেকটু ভালোভাবে করা যায় কি না। (টিভি বন্ধ করে ল্যাপটপ হাতে নিয়ে ওই ঘর থেকে বের হয়ে যান জাফর)
(টপ শট্; ইগি মেঝেতে হাঁটছে, ক্যামেরা ইগি’কে অনুসরণ করে সামনে এগিয়ে গিয়ে সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করতে থাকা জাফরকে ধরে। ইগি হাঁটতে হাঁটতে সোফায় উঠে জাফরের কাছে যায়।)
জাফর : (ইগি’কে লক্ষ্য করে) কী চাও? (ইন্টারনেটে সার্চ দিতে দিতে) যেখানেই যাই সেটাই ব্লক করা। অধিকাংশ সাইটই ফিল্টার করা হয়। যেগুলো ফিল্টার করা হয় না, সেগুলোতে অবশ্য কিছু থাকেও না।
(ইগি গায়ের ওপর ওঠে) ইগি, তোমার নখগুলো খুব ধারালো। যাও, নীচে নামো। তোমার নখ ব্যাথা দিচ্ছে। এই যে এখানে (একটি ওয়েবসাইট থেকে পড়ে শোনাচ্ছেন) বলা হচ্ছে, আমরা আনন্দিত যে হাউজ অব সিনেমা দেশের পরিবর্তনের ব্যাপারে সচেতন। চলচ্চিত্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র জানাচ্ছেন, দেশের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য সরকারের নেওয়া কর্মসূচি বাস্তবায়ন প্রথমবারের জন্য হাউজ অব সিনেমার পরিচালকদের নজরে আসায় আমরা আনন্দিত। (ক্যামেরা জাফরের পিছনে চলে আসে, লো অ্যাঙ্গেল শটে জাফরকে দেখা যায়। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে হাসতে হাসতে মোজতাবা’কে বলেন) তিনি দাবি করেছেন, ‘বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব আমরাই নাকি আয়োজন করেছি।’
(লঙ্ শট্; বেলকোনিতে দাঁড়িয়ে জাফর মুঠোফোনে শহরের ছবি তোলেন, গাছে পানি দেন।)
(পরের দৃশ্য, আবারো ল্যাপটপ নিয়ে জাফর বসে আছেন; কিছু দূরে অন্য একটি সোফার উপর ইগি’কে দেখা যায়। এমন সময় ফোন বেজে ওঠে। মিড ক্লোজে জাফর।)
জাফর : হ্যালো, রাকশান।
রাকশান : হ্যালো, কেমন আছেন? (ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে)
জাফর : আছি কোনো রকম।
রাকশান : কোনো নতুন খবর?
জাফর : আমি আমার উকিলের সঙ্গে কথা বললাম; সে নাকি আপনার সঙ্গে কথা বলেছে?
রাকশান : হ্যাঁ, তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে।
জাফর : তিনি কী বলেছেন?
রাকশান : কোন্ আদালতে বিচারটি হবে সে ব্যাপারে আমি তাকে বিস্তারিত জানিয়েছি। আমরা অন্তত যেটুকু পারতাম, ১২ জন বিশিষ্ট চলচ্চিত্রনির্মাতা যে আপিল করেছেন তা আদালতে উপস্থাপন করা, তা করেছি। আর নতুন কিছু?
জাফর : না, আমি ঘেইরাতের সঙ্গে কথা বলেছি। তাকে খুব বেশি আশাবাদী মনে হয়নি। তার ধারণা, চলচ্চিত্রকর্মীদের প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া রায়ের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। সেটা দেশে, বিদেশে দুই জায়গাতেই হতে পারে। কিন্তু আমি বলেছি, ইরানি নির্মাতারা সমস্যায় পড়ুক তা আমি চাই না। এটা তো জানা কথা, সবাই কম-বেশি সমস্যায় আছে।
রাকশান : হ্যাঁ, সমস্যা তো অনেক আছে। সবাই ভয়ে আছে। আমার চেয়ে আপনিই ভালো জানেন। আপনার পক্ষ নিয়ে এক ধাপ এগোলেই তারা বিপদে পড়ে যাবে। তাই কেউই আসলে সাহস পাচ্ছে না প্রতিবাদ করার। গত রাতেই ভেবেছিলাম আপনাকে ফোন করে বলবো—মামলাটি আপিল বিভাগে উঠেছে। অন্যান্য চলচ্চিত্রনির্মাতারাও জোরালোভাবে আপিল করেছে। সরাসরি জুডিসিয়ারি বেঞ্চ এটা দেখবে।
জাফর : ও, ধন্যবাদ। খোদা হাফেজ। (দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে) ভালো! (মোজতাবা’র উদ্দেশে) চলো ওঠা যাক। আবারো কাট্ বলে ফেললাম! জানিনা আসলে কী করবো। আচ্ছা এবার চিত্রনাট্যটার আরেকটা অংশ বলি, কি বলো? জানি, এটাকে সত্যিকারের চলচ্চিত্রের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না, তার পরও আরেকটা দৃশ্য বলি; দেখা যাক কেমন হয়।
(সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে) এই দৃশ্যে মেয়েটি...; ওহ, তোমাকে তো মেয়েটির ছবিই দেখাইনি। (ক্যামেরা ক্লোজ শটে জাফরের মুখ থেকে মুঠোফোনে ধরা হয়, পাশাপাশি দুইটি মেয়ের ছবি দেখা যায়।) এই মেয়ে দুইটি ইস্পাহানি উচ্চারণে কথা বলে। আমরা ৩০—৪০ জন মেয়ের অডিশন নিয়েছি, যে ধরনের মেয়ে আমরা খুঁজছি এরা দুজন প্রায় তার কাছাকাছি। এরা যদি মাথা কামায়, বিশেষ করে গভীর চোখওয়ালা এই মেয়েটিকে দেখো (মুঠোফোনে ডান পাশের মেয়েটিকে দেখিয়ে), দেখেই মনে হয় এর জীবনে অনেক ঝড় বয়ে গেছে (ক্যামেরা জাফরকে ধরে পিছনে সরে যায়)। আমার মনে হয়েছে ও এই চলচ্চিত্রটার জন্য যথার্থ হবে। তাছাড়া ওর ইস্পাহানি উচ্চারণও খুব ভালো। ও, তার আগে বলে নিই চলচ্চিত্রে মেয়েটি গলির শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির সঙ্গে একটা গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলবে (জাফর আবারো টেপ দিয়ে চিহ্নিত ঘরের জানালা হিসেবে রাখা চেয়ারটিতে গিয়ে বসেন)। মেয়েটি চার—পাঁচ দিনের মধ্যেই বুঝতে পারবে, সে ছেলেটির প্রেমে পড়ে গেছে। তাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠবে, আর মেয়েটি তেহরান যাওয়ার আগ্রহ ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলবে। চলচ্চিত্রের শেষে আমরা জানতে পারবো, ছেলেটি আসলে মেয়েটির জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো না বরং তার একটা বিশেষ উদ্দেশ্য ছিলো। সে ছিলো মূলত গুপ্তচর! মূল গল্পে যেটা আছে মানে চেকভ-এর ‘অ্যা গার্লস নোটস’ নামের এক পাতার গল্পটি; যেটা নিয়ে কাম্বোজিয়া আর আমি এর আগে একসঙ্গে কাজ করেছি।
(জাফর চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে) যাহোক, আমার পছন্দের একটা দৃশ্য হচ্ছে, মেয়েটির বোন তাকে দেখতে আসে। (ভুল করে স্কচটেপ দিয়ে দেখানো দাগ পার করে জাফর) আহা, আমি এই দাগ পার হচ্ছি কেনো, অভ্যাস! আগের বার আমি দাগের বাইরে টেলিফোন সেট দেখিয়েছি। তো ওর বোন দরজার কাছে আসে; আমরা জানি, সে রাগ করে স্বামীকে ছেড়ে এসেছে, এখন তার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। এদিকে দরজায় তালা দেওয়া, চাবি আছে দাদির কাছে। তখন মেয়েটি জানালা দিয়ে তার বোনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। তাই সে সিঁড়ি দিয়ে নেমে (জাফর নিজেও স্কচটেপ দিয়ে আঁকানো ঘরে ঢোকার সিঁড়ি দিয়ে নেমে দরজার কাছে যান, বসে পড়েন) বাড়ির দরজার কাছে চলে আসে। যেহেতু আগে সে একবার চেষ্টা করেও দরজা খুলতে পারেনি, তাই এবার দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ে (জাফর দরজায় হেলান দেওয়ার ভঙ্গি করেন)। আমরা (দর্শক) অবশ্য দরজার বাইরে দাঁড়ানো বোনকে দেখতে পারবো না। কারণ আমাদের ফ্রেম কেবল ঘরের ভিতরেই থাকবে। দর্শক শুধু বোনের কথা শুনতে পাবে। দুই বোন নিজেদের সমস্যার কথা একে অন্যকে বলবে; বোঝা যাবে, তারা দুজনেই কঠিন সমস্যায় আছে। বোন কিন্তু ওই ছেলেটিকে লক্ষ করে। বোন মরিয়মকে বলে, ‘শোন, তুই ওর সঙ্গে চলে যা’—এটা কিন্তু আমার প্রিয় একটা সংলাপ।
(বাইরে জোরে পটকা/গুলির আওয়াজ, জাফর হকচকিয়ে ওঠেন; উঠে গিয়ে জানালা খোলেন। সাইরেনের আওয়াজ পাওয়া যায়। জানালা দিয়ে মুঠোফোনে রাস্তার দৃশ্য ধারণ করেন। এরপর লঙ্ শটে দেখা যায়, জাফর তড়িঘড়ি করে মেঝে থেকে স্কচটেপ তুলে ঘরটা আগের মতো সাজিয়ে রাখেন। একই সময় তিনি মুঠোফোনে একটা নম্বরে ডায়াল করেন কিন্তু ফোনটা বন্ধ পাওয়া যায়। ঘর গুছিয়ে তিনি টিভিতে খবর দেখতে বসেন।)
(খবরে বলা হয়) গত বছরই প্রথম ‘বুধবারের আতশবাজি’ (ফায়ারওয়ার্কস ওয়েনজডে) পালন করা হয়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরে আন্দোলন শুরু হলে ইরানের ধর্মীয় নেতা একে বিধর্মী কাজ বলে ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, বুধবারের আতশবাজি পালনের কোনো ধর্মীয় ভিত্তি নেই। গত বছর থেকে পৃথকভাবে...
(এমন সময় দোরঘণ্টি বেজে ওঠে; জাফর উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেন; লঙ্ শটে আগন্তুক ও জাফরের কথোপকথন, তবে আগন্তুককে দেখা যায় না।)
প্রতিবেশী আগন্তুক : আস সালামু আলাইকুম। চাচি বাসায় আছেন?
জাফর : না, সে তো বাইরে গেছে।
প্রতিবেশী : আর পানাহ্?
জাফর : পানাহ্ ওর মায়ের সঙ্গে দাদির ওখানে গেছে, নববর্ষের উপহার দিতে।
প্রতিবেশী : ওরা কখন আসবে?
জাফর : মনে হয় রাত হবে।
প্রতিবেশী : একটা উপকার করতে পারবেন?
জাফর : শুধু একে (সঙ্গে আনা কুকুরটিকে) রাখতে বলো না, তাহলেই হবে।
প্রতিবেশী : আসলে বাসায় মিকি’কে (কুকুরটি) দেখে রাখার মতো কেউ নেই। আর আমি শারজাদের সঙ্গে আতশবাজি দেখতে যাচ্ছি, তাকে কথা দিয়েছি।
জাফর : তাহলে ওকে নয় তলায় রেখে যাও।
প্রতিবেশী : রাখতাম, কিন্তু শারজাদ তার বিড়ালটা ওখানে রেখে গেছে! মাত্র এক ঘণ্টার জন্য রাখুন। কথা দিচ্ছি, তাড়াতাড়ি চলে আসবো।
জাফর : কিন্তু আমি একে কীভাবে রাখবো?
প্রতিবেশী : আমি তাড়াতাড়ি আসবো।
জাফর : তুমি কখন আসবে?
প্রতিবেশী : এক ঘণ্টার মধ্যেই।
জাফর : আচ্ছা রেখে যাও।
প্রতিবেশী : আমি সত্যিই তাড়াতাড়ি চলে আসবো। (কুকুরটিকে) যাও মিকি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
জাফর : আচ্ছা যাও, তাড়াতাড়ি এসো। (মিকিকে) এসো, এদিকে এসো।
(মিকি ঘরে ঢুকে ইগিকে দেখে ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করে। এটা দেখে জাফর দ্রুত দরজা খুলে প্রতিবেশী মেয়েটিকে ডাক দেন।)
জাফর : শিমা, শিমা। শিমা, একে বাইরে নিয়ে যাও; ইগি ভয় পাচ্ছে। দুঃখিত, মিকি’কে রাখতে পারলাম না।
(দরজা লাগিয়ে এসে জাফর আবার সংবাদ দেখতে বসেন। এমন সময় ফোন আসে।)
জাফর : হ্যালো?
ফোনকারী : হ্যালো, স্যার। কেমন আছেন? (ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে)
জাফর : ভালো।
ফোনকারী : কোথায় আছেন?
জাফর : বাসায়।
ফোনকারী : তাহেরে আর পানাহ্ কোথায়?
জাফর : তারা মাকে নববর্ষের উপহার দিতে গেছে।
ফোনকারী : বাইরে অনেক আনন্দ হচ্ছে। দেখতে যাবেন, আপনাকে নিতে আসি?
জাফর : না, আমি যেতে পারবো না।
ফোনকারী : সবাই বলছিলো আপনাকে ফোন করে ডাকতে, যদি আসতেন।
জাফর : না, ঠিক আছে। আমি তাহেরে আর পানাহ্’র জন্য বসে আছি। ওরা যে এখন কতোদূর আছে?
ফোনকারী : রাস্তায় অনেক জ্যাম। রাস্তা ভর্তি মানুষ আর চারপাশে শুধু পুলিশ।
জাফর : কোথায়? (জাফর উঠে গিয়ে জানালা খুলে বাইরে দেখতে থাকেন)
ফোনকারী : আজ তো সব জায়গাতেই একই রকম উৎসবমুখর পরিবেশ। মনে হচ্ছে, পুলিশই আগুন জ্বালাতে সাহায্য করছে! (কথা বলতে বলতে আবার সোফায় এসে বসেন জাফর)
জাফর : তুমি কোথায়? (সোফা থেকে উঠে দাঁড়ান জাফর)
ফোনকারী : অফিস থেকে বাসায় ফিরছি। তাহেরে আর পানাহ্’কে কি বাসায় পৌঁছে দিয়ে যাবো?
(ক্যামেরা জাফরকে ধরে প্যান করে, জানালার সামনে দাঁড়ানোর পর ক্লোজ শটে একপাশ থেকে তার পিঠ দেখা যায়; কথা বলতে বলতে এগিয়ে গিয়ে জানালা খুলে রাতের শহর দেখেন জাফর।)
জাফর : না, আমি ওদেরকে রাস্তা ফাঁকা না হওয়া পর্যন্ত থামতে বলেছি।
ফোনকারী : রাখছি, পুলিশ গাড়ি থামিয়েছে, পরে ফোন দিচ্ছি। (ক্যামেরা ঘুরে সোজা জাফরের পিছনে চলে আসে। এরপর ওএস শটে বাইরে ফোকাস করে, শহরের আতশবাজি দেখা যায়।)
জাফর : হ্যালো, কী হয়েছে? (ফোন কেটে যায়। জাফর আবার সোফায় গিয়ে বসেন।)
(পরের দৃশ্য : জাফর আবার জানালার সামনে দাঁড়িয়ে। ওএস শটে বাইরের আতশবাজি দেখা যাচ্ছে। জাফর ফোন দিতে দিতে মোজতাবা’কে বাইরের আতশবাজি দেখিয়ে) আতশবাজি দেখতে পাচ্ছো? (মোজতাবা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে ক্যামেরা ধরেন। কয়েক সেকেন্ড পর ক্যামেরা পিছনে সরে আসে, জাফরের পিঠ দেখা যায়। ফোনের কলটোন শোনা যায়, কিন্তু আগের ওই ফোনকারী ফোন ধরেন না। জাফর জানালা বন্ধ করে আবার টিভির সামনে বসেন; ক্যামেরা তার পিছু পিছু যায়। সোফায় বসার পর আবার ফোন আসে।)
জাফর : হ্যালো, থামো টিভিটা বন্ধ করে নিই। (রিমোট কন্ট্রোলে টিভি বন্ধ করেন)
ফোনকারী : তেমন কিছু না, আমার ক্যামেরা চেক করলো। চিন্তা করবেন না, আমাকে ছেড়ে দিয়েছে।
জাফর : কারা ছিলো?
ফোনকারী : পুলিশ চেক পয়েন্ট বসিয়েছে, যাকে ইচ্ছা থামিয়ে চেক করছে। আমার কাছে ক্যামেরা দেখতে পেয়ে থামতে বললো। জিজ্ঞেস করলো, কেনো ক্যামেরা নিয়ে ঘুরছি। বললাম, আমার কাজ এটাই। এখন অফিস থেকে বাসায় ফিরছি। তারপর ক্যামেরাটা দেখে ছেড়ে দিলো।
জাফর : শোনো, সাবধানে থেকো।
ফোনকারী : জ্বি, ঠিক আছে। স্যার, আপনি চাইলে আমি তাহেরে আর পানাহ্কে বাসায় পৌঁছে দিতে পারি। বাইরে কিন্তু প্রচণ্ড জ্যাম। আর রাস্তায় প্রচুর পুলিশ।
জাফর : না না, তোমাকে কিছু করতে হবে না। তুমি সাবধানে থেকো, তাহলেই হবে। (কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়ান জাফর। আবারো গিয়ে জানালা খোলেন; ক্যামেরা জাফরকে অনুসরণ করে ক্লোজ শটে তার ঘাড়ের পিছনে ফোকাস করে।)
ফোনকারী : আচ্ছা, আমি সোজা বাড়ি যাচ্ছি।
জাফর : হ্যাঁ, সাবধানে যেও।
ফোনকারী : আচ্ছা স্যার। রাখছি এখন।
(বাইরে আতশবাজির শব্দ পাওয়া যায়। ক্যামেরা আবারো বাইরে ফোকাস করে রাতের শহর দেখায়। কিছুক্ষণ পর ক্যামেরা পিছনে সরে আসলে জাফরকে মুঠোফোনে বাইরের দৃশ্য ধারণ করতে দেখা যায়।)
মোজতাবা : কী করছেন?
জাফর : আর ভালো লাগছে না, ভিডিও করছি। তাহলে শেষ পর্যন্ত আমরা চলচ্চিত্রটা নির্মাণ করতে পারলাম না। এখন ভাবছি মুঠোফোনে কিছু করা যায় কি না। (জাফর মুঠোফোনের ক্যামেরা প্যান করে মোজতাবা’র দিকে ধরেন)
মোজতাবা : (হাসতে হাসতে) নাপিতদের যখন কিছু করার থাকে না, তখন তারা একে অন্যের চুল কেটে দেয়। সুন্দর, আপনিও তাই করুন।
জাফর : কিন্তু এ দিয়ে কী হবে? এর মান যথেষ্ট খারাপ! (মোজতাবার দিকে জাফর ক্যামেরা ধরে সরে গিয়ে চেয়ারে বসেন)
মোজতাবা : কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, যেকোনো প্রামাণ্য জিনিসেরই দাম আছে। যেদিন থেকে আপনার এসব সমস্যা শুরু হয়েছে, তারপর আপনি যেভাবে কারাগার থেকে ছাড়া পেলেন—এ সবই যদি মুঠোফোনের ক্যামেরায় রেকর্ড করতেন তবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময় ধরতে পারতেন। (মোজতাবাও ক্যামেরা নিয়ে জাফরের মুখোমুখি বসে পড়েন) জানি না সেসব চলচ্চিত্র হতো কি না কিংবা আজ যা করছি তাও চলচ্চিত্র হবে কি না। আজকের এগুলো নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যাবে কি না সন্দেহ আছে। তবে যদি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করতে চান, এগিয়ে যেতে পারেন।
জাফর : আমি জানি না, আমরা আসলে কী করছি। আমার রায় যেকোনো দিন হতে পারে আর গত কয়েক মাস ধরে বাসায় বসে থেকে আমি ক্লান্ত। তাই ভাবলাম, কিছু একটা তো অন্তত করি।
মোজতাবা : হ্যাঁ, সেটা করতেই পারেন।
(জাফর মুঠোফোনে দৃশ্য ধারণ বন্ধ করেন)
মোজতাবা : চলুক না ওটা...।
জাফর : কেনো?
মোজতাবা : ওটা চলতে থাকুক।
জাফর : (মুঠোফোনের ক্যামেরা চালু করতে করতে) আর কী ভিডিও করবো?
মোজতাবা : (হাসতে হাসতে) ভিডিও করতে থাকুন, আমি যদি গ্রেপ্তার হয়ে যাই তাহলে আমার কিছু ছবি তো অন্তত থাকবে। (এতক্ষণে মোজতাবা’কে পর্দায় দেখা যায়; তিনি জাফরের দিকে ক্যামেরা ধরে আছেন।)
জাফর : এপাশ থেকে বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
মোজতাবা : যেহেতু আমি ফটোগ্রাফার না, তাই আমার এগুলোও (ধারণ করা দৃশ্য) তেমন কিছু না।
জাফর : তার পরও তুমি টেকনিকাল বিষয় কিছু জানো; আমি তো কিছুই জানি না।
মোজতাবা : কি, আরো ভিডিও করবো?
জাফর : জানি না। রাতে থাকতে পারবে? (আবার জাফরকে ফ্রেমে দেখা যায়) দেখতাম এটা কেমন হয়।
মোজতাবা : আপনি চাচ্ছেন, আমরা দুজন এভাবে একে অন্যের দিকে ক্যামেরা তাক করে সারারাত বসে থাকি; আর কিছুই না করি? আমার মনে হয়, এখন যাওয়া দরকার। ইয়াসনা’কে (ছেলে) নিয়ে আমি চিন্তিত। ও অনেকগুলো পটকা নিয়ে আতশবাজিতে গেছে। আর দেরিও হয়ে গেছে অনেক। কাল আবার আসবো। (আবারো ফ্রেমে মোজতাবা; জাফরের সামনে টেবিলের উপর ক্যামেরা রাখতে রাখতে) ক্যামেরাটা এখানে আপনার সামনে রেখে যাচ্ছি, যেখান থেকে আমি ভিডিও করছিলাম সেখানেই থাকলো।
জাফর : তোমার কি মনে হয় আমি কিছু ভিডিও করবো?
মোজতাবা : না, কিন্তু ক্যামেরাটা চালুই থাকলো। ক্যামেরাটা চালু থাকা দরকার; এটাকে স্থির করে রাখি। (মোজতাবা’র ক্যামেরাকে ফোকাস করেন জাফর; ওটার নীচে মোজতাবা একটা লাইটার রাখেন)
জাফর : তুমি কি এর নীচে লাইটারটা দিয়ে একে স্থির করবে?
মোজতাবা : হ্যাঁ, লাইটারটাকে ট্রাইপড হিসেবে ব্যবহার করবো। আপনার সিগারেটের প্যাকেটটা দিন।
জাফর : (ফ্রেমে জাফর, সিগারেটের প্যাকেট এনে মোজতাবা’কে দেন) এই যে নাও।
মোজতাবা : আমি যাওয়ার পর আপনি শুধু ক্যামেরার সামনে বসে কথা বলতে থাকবেন।
জাফর : আমরা পরে একসঙ্গে বসে এটাকে সম্পাদনা করে দেখবো কেমন হয়।
মোজতাবা : (আবারো ফ্রেমে মোজতাবা; চেয়ার থেকে উঠে জ্যাকেট পরেন) ঠিক আছে। কিন্তু আমার মনে হয়, এখন প্রধান কাজ হচ্ছে এটাকে প্রামাণ্যচিত্র করে তোলা।
জাফর : তাহলে তুমি সত্যিই যাচ্ছো?
মোজতাবা : আপনি অনুমতি দিলে যাচ্ছি।
জাফর : চলো, তোমাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিই আর যাওয়াটাও ভিডিও করে ফেলি। (জাফরের মুঠোফোনের ক্যামেরা মোজতাবা’কে অনুসরণ করে)
মোজতাবা : আমার মুঠোফোনটা কোথায় রাখলাম?
জাফর : তোমার স্ত্রীকে আমার নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিও। আর কষ্ট দেওয়ার জন্য দুঃখিত। (হাসতে হাসতে) স্ত্রীকে বলো, দুই অকর্মা লোক এতক্ষণ বসে বসে একে অন্যের চলচ্চিত্র ধারণ করছিলাম।
মোজতাবা : (মোজতাবা দরজা খুলে লিফ্টের কাছে যান) না, ঠিক আছে।
জাফর : ও, একবার রাকশানের সঙ্গে গল্প করছিলাম। তখন তেমন কিছু করার ছিলো না। সে বুদ্ধি দিলো ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান দেওয়ার। জিজ্ঞেস করলাম, কেমন দোকান? বললো, আমরা একটা গাড়ি ভাড়া নিবো, তাতে লিখে দিবো ‘অকর্মা চলচ্চিত্রনির্মাতার ভ্রাম্যমাণ খাবার গাড়ি’। ঠিক করলাম দুজনই রান্না করবো। রাকশান জিজ্ঞেস করলো, আমি কী রান্না করবো? বললাম, রান্না কীভাবে করে তাইতো জানি না। তখন মনে পড়লো, আমার মা খুব ভালো কোপ্তা রান্না করতে পারে। সে তখন বললো, মেনুতে তাহলে লিখবো ‘জাফরের মায়ের কোপ্তা’!
(লিফ্ট চলে আসে। মোজতাবা লিফ্টের দরজা খুলতেই ভিতর থেকে এক যুবক বের হন।)
যুবক : আস সালামু আলাইকুম।
জাফর : ওয়া আলাইকুম সালাম। আমি কি আপনাকে চিনি?
যুবক : আমি হাসান, নাসরিনের ভাই; মানে কেয়ারটেকার আকবর -এর শ্যালক।
জাফর : ও, আচ্ছা।
হাসান : আবর্জনা নিতে এসেছি।
জাফর : ও, আবর্জনা নিবে?
মোজতাবা : আমি তাহলে যাচ্ছি।
জাফর : (মোজতাবা’কে) দাঁড়াও... (হাসানের উদ্দেশে) রান্নাঘরে সিঙ্কের নীচে দেখো ময়লাগুলো রাখা আছে, নিয়ে যাও। না না, জুতা খুলতে হবে না। (মোজতাবা’কে) তুমি চলে যাচ্ছো?
মোজতাবা : হ্যাঁ। আর আগামীকাল ফোন দিয়েন, চলে আসবো। (মোজতাবা লিফ্টের দিকে এগিয়ে যান)
হাসান : স্যার দাঁড়ান, লিফ্টের ভিতর থেকে ময়লাগুলো বের করে নিই। (হাসান লিফ্টে উঠতে যায়।)
মোজতাবা : থাকুক, সমস্যা নেই।
হাসান : এগুলো নোংরা, আর দুর্গন্ধ বের হচ্ছে।
মোজতাবা : থাক, ব্যাপার না। (জাফরকে) আসি। ভাবিকে আমার শুভেচ্ছা জানাবেন।
জাফর : শোনো, কাল কখন দেখা হচ্ছে?
মোজতাবা : কাল তো ফোন করছেন? ঘুম থেকে উঠেই ফোন করবেন। তারপর আমি এসে মানে দুজনে এটার রিভিউ করবো।
হাসান : (রান্নাঘর থেকে) স্যার, আবর্জনাগুলো কোথায়? (টেবিলের উপর মোজতাবার রাখা ক্যামেরায় লঙ্ শটে দরজায় দাঁড়ানো জাফরকে দেখা যায়।)
জাফর : ওখানেই আছে, সিঙ্কের নীচে।
হাসান : (আবর্জনা খুঁজে পেয়ে) শুধু এগুলোই?
জাফর : হ্যাঁ।
হাসান : বেলকোনিতে কিছু আছে?
জাফর : না, নেই।
মোজতাবা : তাহলে আমি আপনার ফোনের অপেক্ষায় থাকবো।
জাফর : আমি ঘুম থেকে উঠবো...।
হাসান : (ময়লা নিয়ে আসতে আসতে) স্যার, আপনার ক্যামেরা চলছে। (ক্যামেরার দিকে দেখতে দেখতে সামনে দিয়ে হেঁটে যায় হাসান)
জাফর : চলুক, সমস্যা নেই। (ফ্রেমে মোজতাবা ও হাসানকে দেখা যায়।)
মোজতাবা : (হাসান ময়লা নিয়ে লিফ্টে উঠতে যায়) আমি আগে যাই, তুমি পরে আসো। (হাসানের হাতের ময়লাগুলো দেখিয়ে) ওগুলো থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে।
হাসান : তাহলে লিফ্টেরগুলোও নামিয়ে রাখি?
মোজতাবা : ওগুলো থাক। ওর উপর তো ঢাকনা আছে। (জাফরকে) যাচ্ছি। (লিফ্টের দরজা লাগিয়ে দেন মোজতাবা)
হাসান : (মোজতাবাকে) দয়া করে লিফ্টটা ১০ তলায় ফেরত পাঠাবেন। (জাফরকে) এটাও তো মনে হয় আবর্জনা? (হাসান লিফ্টের সামনে থেকে সরে পাশের ফ্ল্যাটের দরজার কাছে যায়; জাফর ওর ওপর ক্যামেরা ধরেন।)
জাফর : না না, এই মিউজিক প্লেয়ারটা বোধ হয় কারো জন্য রেখে দেওয়া হয়েছে।
হাসান : আপনি কি ভিডিও করছেন? আমি তাহলে শার্টটা একটু ভালো করে গায়ে দিয়ে নিই। (হাসান উবু হয়ে হাতের ময়লার ব্যাগ মেঝেতে রেখে দাঁড়িয়ে শার্টের বোতাম লাগান।)
জাফর : তুমি কি কেয়ারটেকারের পরিবর্তে কাজ করছো?
হাসান : হ্যাঁ, আমার বোন নাসরিনের বাচ্চা হবে তো...।
জাফর : ও, ওরা তাহলে ইস্পাহান গেছে?
হাসান : হ্যাঁ। ওরা চায় বাচ্চাটা যেনো ইস্পাহানে হয়।
জাফর : তাহলে তুমি তেহরানে কী করো? অন্য কোথাও কেয়ারটেকারের কাজ করো?
হাসান : না, আমি ওরা না আসা পর্যন্ত আকবরের বদলে কাজ করবো।
জাফর : না, মানে বলছিলাম যে, তুমি কী করো?
হাসান : আসলে আমি সবই করি, পাশাপাশি লেখাপড়াও!
জাফর : লেখাপড়া করো?
হাসান : হ্যাঁ।
জাফর : কোথায়?
হাসান : কলা বিশ্ববিদ্যালয়ে (আর্টস ইউনিভার্সিটি)।
জাফর : তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ো?
হাসান : হ্যাঁ।
জাফর : খুব ভালো। তা কোন্ বিষয়ে পড়ো?
হাসান : শিল্পকলা গবেষণায়।
জাফর : গবেষণা?
হাসান : শিল্পকলা গবেষণা।
জাফর : তুমি তাহলে মাস্টার্স করছো?
হাসান : হ্যাঁ। (হাসতে হাসতে) আমাকে এ পোশাকে দেখে অবশ্য তা মনে হবে না! এটা তো কাজের পোশাক। ময়লা নিতে এসেছি, ভালো পোশাক পরে আসলে তো ময়লা হয়ে যাবে। (লিফ্ট আসছে না দেখে) আমার মনে হয়, উনি লিফ্ট ফেরত পাঠাতে ভুলে গেছেন। উনাকে আমার চেনা চেনা লাগছিলো। উনি কি রেড-হ্যাট-এর সেই লোক?
জাফর : না না, ও না।
হাসান : আমি ভেবেছিলাম উনি হয়তো সেই লোক। শুধু গোঁফগুলো এখন নেই।
জাফর : না, ও আমার বন্ধু মোজতাবা মিরতাহমাস; প্রামাণ্যচিত্র-নির্মাতা। ওর বেশ কয়েকটা ভালো প্রামাণ্যচিত্র আছে। আমরা দুজনে এতক্ষণ গল্প করছিলাম।
হাসান : ও, আমি ভেবেছিলাম, তিনি হয়তো অডিশন দিতে এসেছেন। ভাবলাম, হয়তো আপনার চলচ্চিত্রের মাঝে উড়ে এসে জুড়ে বসেছি! ওখানে দেখলাম একটি দামি ক্যামেরা পড়ে আছে, আর আপনি এই ক্যামেরা (জাফরের হাতে থাকা মুঠোফোন দেখিয়ে) দিয়ে ভিডিও করছেন?
জাফর : তাতে কী?
হাসান : না, ওটা তো প্রফেশনাল ক্যামেরা।
জাফর : মানে, তোমার এটা (মুঠোফোনের ক্যামেরা) পছন্দ হচ্ছে না?
হাসান : আমার পকেটেও এ রকম একটা আছে। (পকেট থেকে বের করে) এই যে। আপনার কি মনে হয়, আমি এটা দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারবো? আপনি অবশ্য এটা দিয়েই চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারবেন।
জাফর : আচ্ছা দাঁড়াও, আমি ওই ক্যামেরাটা নিয়ে আসি। (ফ্রেমে জাফর; মুঠোফোন হাতে তাকে ঘরের ভিতর আসতে দেখা যায়।)
হাসান : আমি কি তাহলে ময়লাগুলো নীচে নিয়ে যাবো?
জাফর : না দাঁড়াও, আমিও নীচে যাবো। (ক্যামেরা হাতে নিয়ে জাফর দরজার কাছে এসে হাসানকে ফোকাস করেন) তাহলে চলো...।
হাসান : (শার্ট ঠিক করতে করতে) ও বাবা!
জাফর : (ময়লাগুলো দেখিয়ে) এগুলো নিয়েই চলো। একসঙ্গে নীচে যাই। থামো, আমি আগে (লিফ্টের) ভিতরে যাই। (হাসানকে ডিঙিয়ে লিফ্টের ভিতরে ঢোকেন জাফর। প্যান করে আবারো হাসানের ওপর ক্যামেরা ধরেন।)
হাসান : ময়লাগুলো থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে তো! ওগুলো বের করে নিই আগে...।
জাফর : না, থাক।
হাসান : আপনি তো আমাকে অভিনেতাই বানিয়ে ফেললেন। কিন্তু যে অভিনয় করছি তাতে শুধু লজ্জাই পেতে হবে।
জাফর : না, এটা তেমন কিছু না। আচ্ছা, আমি তো তোমাকে এর আগে কখনো এখানে দেখিনি।
হাসান : দেখেননি! কিন্তু আমি তো অনেকবার এসেছি। ২০—২৫ বার তো হবেই।
জাফর : তুমি আর কিছু করো না?
হাসান : হ্যাঁ, অনেক কিছুই করি। এখন যেটা করছি সেটাও তো কাজেরই একটা অংশ। আমার বোনের দরকার...।
জাফর : এ কাজে কি তুমি টাকা পাও?
হাসান : না না। এটা তো আকবর আর নাসরিনকে সাহায্য করার জন্য।
জাফর : তোমার পড়াশোনার খরচ জোগাও কীভাবে?
হাসান : কাজ করে।
জাফর : কী কাজ?
হাসান : অনেক ধরনের কাজ। এই যেমন... (লিফ্ট অন্য তলায় আসলে, হাসান সে তলার আবর্জনা আনতে যান) দাঁড়ান এসে বলছি। (আবর্জনা নিয়ে ফিরে) এগুলো থাকলে গোটা বিল্ডিং-ই দুর্গন্ধে ভরে যাবে। কাজের কথা বলছিলাম, যেমন টেক্সটাইল কারখানায় কুরিয়ারের কাজ করি, মাল সরবরাহ করি। (লিফ্টের বোতাম চেপে) আমরা আট তলায় আছি, সাত তলায় নামবো।
তারপর আমি বিজ্ঞাপনের ডিজাইনও করেছি কিছুদিনের জন্য। টেক্সটাইল কারখানার কাজের ব্যাপারে আপনার কোনো ধারণা আছে? ওখানে কাজের মানে হচ্ছে ফুসফুস আর কানের বারোটা বাজানো। আমি তো ছয় মাসও কাজ করতে পারিনি।
জাফর : তাহলে তুমি যে বিষয়ে পড়ছো, সে ধরনের কোনো কাজ করো না কেনো?
হাসান : (আরেক তলায়) এ তলায় কোনো আবর্জনা নেই। হ্যাঁ, আমি ওই ধরনের কাজও করি। তবে এটা সময়ের ওপর নির্ভর করে। অনেক সময় বিজ্ঞাপনের কাজ পাওয়া যায়, অনেক সময় পাওয়া যায় না। এটা তো আর নিয়মিত কাজ না। কোনো কিছুই আসলে নিশ্চিত করে বলা যায় না। (আরেক তলায় এসে আবর্জনা না পেয়ে) কী ব্যাপার, আজ আবর্জনা নেই কেনো? এখন যাবো পাঁচ তলায়। মনে হচ্ছে, আমি আপনার সঙ্গে ভ্রমণে বের হয়েছি। (হাসতে হাসতে) দুর্গন্ধ নিয়ে ভ্রমণ! সেই রাতে আপনাকে যখন ধরে নিয়ে যায়, আমি তখন এখানে ছিলাম।
জাফর : তাই?
হাসান : সত্যি।
জাফর : তুমি এখানে ছিলে?
হাসান : হ্যাঁ, আমি তো প্রায়ই এখানে আসি গোসল করতে। সেদিনও এসেছিলাম। আসলে আমাদের ছাত্রাবাসে তো গোসলখানা নেই, তাই বোনের বাসায় আসি গোসল করতে। সেদিন হঠাৎ ওরা এসে দরজা খুলতে বলে। তো আকবরের বদলে আমি দরজা খুলি... (অন্য তলায় এসে হাসান আবারো আবর্জনা খোঁজে, কিন্তু কিছুই পায় না।)
জাফর : ওদেরকে (অ্যাপার্টমেন্টের লোকদের) ডাকো। হয়তো আবর্জনা ঘরে রাখা আছে।
হাসান : (দোরঘণ্টি বাজিয়ে) কিন্তু আবর্জনা থাকলে তো বাইরেই রেখে দিতো। আজ হয়তো সবাই আতশবাজি দেখতে গেছে। (লিফ্টে ফিরে এসে) এই তলার লোকজন এতো পিৎজা খায়! আমি তো কিছুদিন পিৎজা ডেলিভারির কাজ করেছি। তো এদের জন্য ১০ মিনিট পর পর পিৎজা আনতে হতো। কীভাবে যে ওরা এতো পিৎজা খায়! (অন্য তলায় এসে আবর্জনা না পেয়ে দোরঘণ্টি চেপে লিফ্টের দরজায় দাঁড়ান হাসান।) এদের সবসময়ই আবর্জনা থাকে। (কুকুরের ঘেউ ঘেউ শোনা যায়) সালাম...।
বাসিন্দা : (ফোনে) আমি তোমাকে একটু পরেই ফোন করছি। (দরজার ওপাশে থাকায় বাসিন্দাকে দেখা যায় না।)
হাসান : আবর্জনা থাকলে নিয়ে আসুন।
বাসিন্দা : আবর্জনা? তুমি কি রাতে বাড়িতে থাকবে?
হাসান : অবশ্যই, বাড়িতেই তো থাকবো।
বাসিন্দা : না, বলছিলাম, আজ রাতে কোথাও যাচ্ছো না তো?
হাসান : না। সারারাত বাড়িতেই থাকবো।
বাসিন্দা : তাহলে তুমি কি মিকি’কে (কুকুর) কয়েক ঘণ্টার জন্য রাখতে পারবে?
হাসান : না না, মাফ চাই। গতবার আপনি এক সপ্তাহের জন্য মিকি’কে আমাদের কাছে রেখে গিয়েছিলেন। (মিকি ঘেউ ঘেউ করছে দেখিয়ে) দেখেছেন কেমন করছে?
বাসিন্দা : দেখো, ও তোমাকে একদম বিরক্ত করবে না।
হাসান : না, আকবর আসুক তারপর ওর কাছে রাখবেন।
বাসিন্দা : কিন্তু দেখো বাসায় আজ কেউ নেই।
হাসান : তো ওকে পানাহির ওখানে রেখে আসুন।
বাসিন্দা : পানাহির ওখানে রাখতে গিয়েছিলাম, কিন্তু ও দুই মিনিটও থাকেনি। দেখো, আমাকে যেতেই হবে। আর ও তোমাকে একটুও বিরক্ত করবে না।
হাসান : আর কোনো উপায় নেই! সকাল পর্যন্ত থাকলে হয় আমি মরবো, না হয় মিকি মরবে।
বাসিন্দা : আমি দুই ঘণ্টার মধ্যেই চলে আসবো।
হাসান : আপনি আগে আবর্জনাগুলো তো আনুন।
বাসিন্দা : তারপর তুমি ওকে (মিকিকে) রাখবে?
হাসান : না, কিন্তু ওকে লবিতে নিয়ে আসুন।
বাসিন্দা : সত্যি!
হাসান : হ্যাঁ।
বাসিন্দা : তাহলে একটু দাঁড়াও।
হাসান : ওকে লবিতে নিয়ে আসুন। আর আবর্জনাগুলো আনুন। (বাসিন্দা চলে যায়। এবার জাফরের উদ্দেশে) কুকুরটাকে দেখেছেন?
জাফর : তুমি আমার কথা বললে কেনো?
হাসান : ওটা (কুকুরটি) আপনার ভালো সাবজেক্ট হতে পারে তাই। আমাকে ভিতরে গিয়ে মিকি’কে আনতে বলছে। (বাসিন্দাকে) ব্যাগে কোনো ক্যান ফেলবেন না। আগেরবার ওতে আমার হাত কেটে গেছে।
বাসিন্দা : ওহ, সত্যিই আমি দুঃখিত। আর মিকি’কে লবিতে নিয়ে আসছি।
হাসান : হ্যাঁ, আনুন। (লিফটে এসে জাফরকে) কুকুরগুলো না...।
জাফর : তাহলে তুমি সেই রাতে এই বাড়িতেই ছিলে?
হাসান : হ্যাঁ, ওরা দরজা খুলতে বললে আমিই দরজা খুলতে যাই। (অন্য তলায় লিফ্ট থামে) দাঁড়ান এখানকার আবর্জনাগুলো নিয়ে আসি। তো আমি যখন দরজা খুলতে যাই, তখন কয়টা বাজে—আটটা থেকে ১০টা—ঠিক মনে করতে পারছি না। খালি মনে আছে, আমি কেবল গোসল করে বের হয়েছি, শরীর তখনো ভিজা। তারা দরজায় কড়া নাড়লে আমি দরজা খুলতে যাই। (লিফ্ট আরেক তলায় পৌঁছে যায়। হাসান নেমে আবর্জনা নিয়ে ফিরে আসে) আসলে গোটা ঘটনাটাই ছিলো ভয় পাওয়ার মতো।
জাফর : এখন তো ভয় নেই।
হাসান : আর এক-দুই তলা বাকি আছে। তো যখন আমি দরজা খুলি...।
জাফর : তোমার পড়াশোনা শেষ হচ্ছে কবে?
হাসান : আমার সেকেন্ড টার্ম চলছে। (লিফ্ট নীচে এসে থামে) আপনি আগে নেমে পড়ুন, তাহলে আর ময়লা গায়ে লাগবে না।
জাফর : না, তুমি আগে যাও। আমি পিছনে আসছি।
হাসান : আচ্ছা। (হাসান ময়লার ঝুড়ি নিয়ে ভবনের বেসমেন্টে নেমে যায়। জাফর ক্যামেরা নিয়ে তাকে অনুসরণ করেন।)
জাফর : লেখাপড়া শেষ করে কী করবে?
হাসান : লেখাপড়া শেষে তো অনেক কিছুই করার আছে। প্রথমেই কী করবো জানেন? (হাসান দাঁড়িয়ে পড়ে পিছনে ঘোরে) একটা জায়গা খুঁজে বের করবো যেখানে শুধু শান্তি আর শান্তি! প্রকৃতির কাছে চলে যাবো কয়েক মাসের জন্য। (আবারো হাঁটতে শুরু করে হাসান) এই ময়লা-আবর্জনা, দূষণ, গাড়ি-ঘোড়া সব থেকে দূরে পালাবো; (হাসতে হাসতে) মিকির কাছ থেকেও! কিন্তু সবচেয়ে খারাপ কী জানেন? সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে, আপনি মাস্টার্স করলেন কিন্তু কোনো চাকরি পেলেন না। (বেসমেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়ে হাসান। তার পিছু পিছু ক্যামেরা হাতে জাফর। বাড়ির মূল ফটকের কাছে চলে আসে দুজন। হাসান দাঁড়িয়ে পিছনে ঘুরে জাফরকে বলেন) স্যার, বাইরে আসবেন না। তাহলে ওরা (পুলিশ) কিন্তু ক্যামেরা হাতে আপনাকে দেখে ফেলবে।
(ফটকের বাইরে লোকজন আগুন জ্বালিয়ে আনন্দ করছে। হাসান দরজা খুলে বাইরে চলে যায়। জাফর তার ওপর ক্যামেরা ধরে রাখেন। হাসান চলে যাওয়ার পরও জাফর দরজার উপর ক্যামেরা ধরে রাখেন। দরজার বাইরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে।) সমাপ্ত
লেখক ও অনুবাদক : মাহামুদ সেতু, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। সম্প্রতি তিনি হীরকের রাজা ২০১৪ নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।
msetu.mcj@gmail.com
তথ্যসূত্র
১. বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে ক্লোজড কার্টেন-এর প্রিমিয়ারে উপস্থিত থাকা তার মেয়ে সোলমাজ পানাহি জানিয়েছেন, তার বাবাকে আটকে রাখা হলেও তিনি দেশের ভিতরে অল্পমাত্রায় ঘুরে বেড়াতে পারছেন। তবে তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। http://www.pirancafe.com/2013/11/13/a-look-behind-jafar-panahis-closed-curtain/
২.http://www.theguardian.com/film/2013/jul/04/jafar-panahi-ban-film-festival-skype
৩. হোসেন, মাহমুদুল (২০১০ : ৮৪); সিনেমা; ফ্ল্যাট ১/বি, বাড়ি ২৮, সড়ক ১৫ (নতুন), ধানমণ্ডি, ঢাকা-১২০৯।
৪. আউয়াল, সাজেদুল (২০১১ : ২৭); চলচ্চিত্রকলার রূপ-রূপান্তর; দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা।
৫. ডিরেক্ট সিনেমা হচ্ছে প্রামাণ্যচিত্রের একটি ধরন, এখানে ক্যামেরাকে ব্যবহার করা হয় অনুঘটকের মতো, যা বাস্তবতার মধ্য দিয়ে কোনো প্রশ্ন, মন্তব্য বা সত্যকে তুলে ধরে। অর্থাৎ বাস্তবে যা ঘটে তা-ই ক্যামেরাবন্দি করে এনে প্রদর্শন করা হয়।
৬. www.wikipedia.org/wiki/The_White_Balloon
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন