আশফাক দোয়েল
প্রকাশিত ২০ নভেম্বর ২০২২ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
কিউবার চলচ্চিত্র : উপনিবেশবাদের গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসা স্বাধীন ভ্রুণ
আশফাক দোয়েল
উপনিবেশবাদ ইতিহাসের খুবই পুরনো এক অভিজ্ঞতা। বহু প্রাচীন থেকে দেশে দেশে কালে কালে উন্নত দেশগুলো আগ্রাসন চালিয়ে অনুন্নত দেশগুলোকে তাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিতে গড়ে তুলতো। প্রাচীন সুমেরীয়, মিসরীয়, আসিরীয়, পারস্য, রোম এবং চীনেও উপনিবেশ বা উপনিবেশবাদের অস্তিত্ব ছিলো বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। এই কিছুদিন আগেও উপনিবেশবাদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিলো পৃথিবীর অনেক দেশ। এমনকি এখনও তা আছে নতুন পথে, নতুন মাধ্যমে। তবে পঞ্চদশ শতকের শেষ ভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ছিলো এই উপনিবেশবাদের স্বর্ণযুগ ।এ-সময়ে ইউরোপের কিছু দেশ পৃথিবীর অধিকাংশ ভূখণ্ড দখল করে সেখানকার মানুষদের উপনিবেশিক শাসনের নিয়ন্ত্রণে আনে। আধুনিক ইতিহাসের আলোকে বলা যায়-ইংল্যান্ড, হল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, পর্তুগাল, স্পেন গোটা দুনিয়াটাকে যেনো ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছিলো।
পরে অবশ্য বহু দেশ উপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হলেও বের হয়ে আসতে পারেনি দীর্ঘদিনের উপনিবেশিক চর্চার মধ্যে থেকে। তাই এসব দেশের শিক্ষা, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প-সংস্কৃতি আজ পর্যন্ত বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে উপনিবেশবাদের ঝাল। ‘আইনের চোখেই হোক বা শাসনের প্রাত্যহিক নিয়মের মধ্যে দিয়েই হোক, উপনিবেশবাদ বা নয়া উপনিবেশবাদের মূল কথাই হলো অসাম্য।’১ এই অসাম্য শুধু রাজনীতি বা অর্থনীতিতেই ছিলো না; শিল্প, সংস্কৃতি, রাষ্ট্রব্যবস্থা সবকিছুর মধ্যেই বিদ্যমান ছিলো।
একটি জিনিস খেয়াল রাখা গুরুত্বপূর্ণ; উপনিবেশবাদের অন্যতম লক্ষ্য ছিলো কিন্তু শিল্প-সংস্কৃতির দিকে। কারণ উন্নত দেশগুলো উপনিবেশী দেশগুলোর সাংস্কৃতিক রূপান্তর করে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইতো যাতে জনগণ বুঝতে না পারে, তারা উপনিবেশবাদের আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে। একই সঙ্গে তারা এ-ও অনুভব করতে দিতো না যে, এই রূপান্তর পাল্টানোর প্রয়োজন আছে। এই শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উপনিবেশবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো চলচ্চিত্র। কারণ চলচ্চিত্র এমন একটি মাধ্যম যাতে কোনো দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প-সংস্কৃতি সবকিছু ফুটে ওঠে। তাই এই চলচ্চিত্র জনগণের কাছে শুধুমাত্র একটি বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি একটি পরিচয়ও। কিন্তু একেই কখনও কখনও করে তোলা হয় আর দশটি পণ্যর মতোই। আর এই চলচ্চিত্র-পণ্যকে নিয়োজিত করা হয় পুঁজি ও স্বার্থ সংরক্ষণে। কিন্তু এটিই সর্বাঙ্গে সত্য নয়, উপনিবেশিকতার জাল কেটে বেরিয়ে আসা দু-একটি দেশ তাদের নিজ পরিচয়ের জানান দিয়েছে; নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে বিশ্ব-দরবারে। গোটা পৃথিবীতে এ-বৈশিষ্ট্যের দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম লাতিন আমেরিকার দ্বীপ রাষ্ট্র কিউবা। দেশটির চলচ্চিত্র নিয়ে আজকের এ-আলোচনা।
উপনিবেশবাদের ঘেরাটোপে বন্দি লাতিন চলচ্চিত্র
অনেকদিন ধরে স্পেনিয় ও পর্তুগীজদের উপনিবেশে বন্দি ছিলো লাতিন আমেরিকা। উনিশ শতকের প্রথম তিন দশকের মধ্যেই স্পেন ও পর্তুগীজদের থেকে লাতিন আমেরিকা মুক্ত হতে শুরু করে। এর প্রধান কারণ ছিলো পর্তুগালের সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা ক্রমে দুর্বল হয়ে আসা। আর অন্যদিকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়া। এদের মধ্যে লাতিন আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে তাদের খুব কাছে থাকা দেশ যুক্তরাষ্ট্র। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রভাবের সঙ্গে সঙ্গে শিল্প মাধ্যমেও তারা খুব প্রভাব বিস্তার করে। যেমন : আর্জেন্টিনার ছাব্বিশটি টিভি চ্যানেল, দশ লক্ষ টিভি সেট, পঞ্চাশোর্ধ বেতার কেন্দ্র, শ’খানেক সংবাদপত্র ও সাময়িকী, হাজার হাজার রেকর্ড ও চলচ্চিত্র শুধু সংস্কৃতির বিলোপ এবং বোধ ও রুচির উপনিবেশকরণ সাধনে মত্ত ছিল।’২
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে লাতিন আমেরিকার চলচ্চিত্রে বিশেষ আগ্রহ ছিলো হলিউডের নেতিবাচক ধ্যান-ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী ছবি নির্মাণে। এখানকার চলচ্চিত্রনির্মাতারা চেয়েছিলেন, মানুষের চোখ বাস্তবতা যেভাবে প্রত্যক্ষ করে ঠিক তারই অনুরূপ ছবি করতে। অর্থাৎ ‘ক্যামেরাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন ‘সত্য’ ঘটনা সংরক্ষণের এক আধুনিক পদ্ধতি হিসেবে। তবে গোড়ার দিক থেকেই চলচ্চিত্র আর উপনিবেশবাদ এক হয়ে পরস্পর একে অপরের বিজয় ঘোষণা করে মিশে যেতে থাকে সিনেমায়।’৩ যার ফলে কিছুদিনের মধ্যেই লাতিন আমেরিকা থেকে সম্পূর্ণভাবেই উঠে যেতে থাকে ইউরোপিয়, ইতালিয় সিনেমাগুলো, অন্যদিকে এই বাজার দখল করতে শুরু করে হলিউডধর্মী সিনেমা।
১৯২০ সাল নাগাদ দেখা যায়, লাতিন আমেরিকায় প্রদর্শিত সমস্ত ছবির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দখলে ছিলো ৯৫ শতাংশ চলচ্চিত্র। যদিও এই দশকে লাতিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশ সাহিত্য ও শিল্পের বহু প্রাণবন্ত আন্দোলনে প্লাবিত হয়েছিলো, তবুও চলচ্চিত্রকে হলিউডের প্রভাব থেকে তুলে আনতে পারেনি। অর্থাৎ ২০-এর দশক থেকে ৪০ দশক পর্যন্ত লাতিন আমেরিকায় যেসব চলচ্চিত্রের উদ্ভব হয়েছে সে-গুলো ছিলো মূলত হলিউডি মডেলে তৈরি। তফাৎ শুধু এতোটুকু ছিলো যে, এই ধরনের চলচ্চিত্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলো লাতিন আমেরিকার দেশিয় ও আঞ্চলিক নানান ভাবধারা।
এবার আসা যাক ৫০ দশকের দিকে, এই দশকটা ছিলো সমগ্র লাতিন আমেরিকা কাঁপানো বিরাট রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময়। ভেনিজুয়েলা, নিকারাগুয়া, কিউবায় একনায়কত্বের পরাজয় হলো। গুয়াতেমালা, কিউবায় চলছিলো বামপন্থি আন্দোলন। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলো। আর অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ঘটলো পরির্বতন। কোনো দেশের যদি সমাজ ব্যবস্থা বা সমাজ কাঠামো পরিবর্তন হয় তাহলে সে-দেশের বিভিন্ন মাধ্যমেও পরিবর্তন আসে। ৫০ দশকের গোড়ার দিকে লাতিন আমেরিকাতেও তাই ঘটলো।
ফলে ইতালিয় নব্য-বাস্তববাদ ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী হয়ে উঠলো লাতিন আমেরিকা। এ-দিকে এই দশকে ব্রাজিলে বাউবার রচা, নেলসন পেরেরা দস সান্টোস, এরা ‘সিনেমা-নোভো’ নামে আন্দোলন শুরু করে। ইতালিয় নব্য-বাস্তববাদ ও ফরাসি নবতরঙ্গ দ্বারা প্রভাবিত এই আন্দোলন ৬০-এর দশকে এসে প্রগতিবাদী বৈপ্লবিক চরিত্র ধারণ করে। এ-ক্ষেত্রে অবশ্য ব্রাজিলের দুর্ভিক্ষ, অনাহারে মৃত্যু ও সামাজিক অবিচার অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিলো। এই ধারার পরিচালকরা তাদের সিনেমার বিষয় করে তুললেন ব্রাজিলের ইতিহাস, মিথকথা, প্রাধান্যবিস্তারকারী জনপ্রিয় সংস্কৃতি, ভূমিহীন কৃষকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম ইত্যাদি। এই আন্দোলন এরপর ছড়িয়ে পড়ে পুরো লাতিন আমেরিকায়।
তবে ৭০ দশকের শুরুতে লাতিন আমেরিকার সিনেমায় দুর্যোগের ঘনঘটা দেখা দিতে থাকে। ইকুয়েডর, উরুগুয়ে ও চিলি একনায়কতন্ত্রের কবলে পড়ায় এবং আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলে চলচ্চিত্র সে-দেশের সরকারের হাতে কুক্ষিগত হওয়ায় চলচ্চিত্র নির্মাণ কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। এ-সময় মিলিটারি সেন্সরশিপের দরুন চলচ্চিত্র পরিচালকেরা প্রায় বাধ্য হয়ে চলচ্চিত্রে জটিল সব প্রতীকতা গ্রহণ করেছিলো। এমন হলো, ‘চলচ্চিত্র শুধুমাত্র বুদ্ধিজীবীদের আলোচ্য এবং আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছিল; কেননা ছবির নিগূঢ় বক্তব্যটি একমাত্র তাদের কাছেই বোধগম্য হয়েছিল।’৪ পরে অবশ্য এ-ধারাও রাখতে পারেনি চলচ্চিত্রকাররা, শেষ পর্যন্ত সামরিক চাপে চলচ্চিত্রকে নিয়ে যেতে হয়েছিলো নাচ-গান, মেলোড্রামা ও হাস্য-রসাত্মক পর্নোছবির অশ্লীল জগতে। কিন্তু এ-অবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ৭০ দশকের মাঝামাঝি চলচ্চিত্র নতুন রূপ পেতে থাকে। ছোট ছোট দেশ পানামা, কোস্টারিকা ও হাইতিতে এ-সময় জাতীয় চলচ্চিত্রের উদ্ভব ঘটে। এছাড়া চিলির সিনেমার পুনর্জন্ম ঘটে প্রবাসে এবং পেরুতে দ্রুত প্রসার ঘটতে থাকে প্রামাণ্যচিত্রের। আসলে শিল্পের সঙ্গে প্রতিরোধের একটি অদৃশ্য সম্পর্ক আছে, শাসকশ্রেণী এটি না বুঝেই শিল্প সৃষ্টিতে বাধা দেয়; ফল হয় হিতে বিপরীত।
আর ৮০ দশকে লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে আমরা দেখতে পাই বিদেশি প্রযোজনায় বা অর্থায়নে চলচ্চিত্র নির্মাণ। এ-সময় ইউরোপিয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো চলচ্চিত্র প্রযোজনায় অর্থলগ্নি করতে শুরু করে। তারা যে এ-জন্য খুব বেশি টাকা বিনিয়োগ করতেন বিষয়টি এমন ছিলো না, তবে ভঙ্গুর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এই টাকায় হালে পানি আসে। এসব প্রযোজক শিল্পসম্মত সিনেমা তৈরির কথা বললেও এর আড়ালে তারা উদ্ভট সব সিনেমা নির্মাণ করতে থাকেন। এতে করে জনপ্রিয় ধারার চলচ্চিত্র প্রসার ঘটতে থাকে।
৯০-এর দশকের শুরুতে বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এ-সময় ব্রাজিলে টিভি গ্লোবো চ্যানেলটি চলচ্চিত্র নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। চলচ্চিত্র দেখা অনেকখানি ব্যয়বহুল হওয়ায় সে-সময় জনগণের কাছে সামাজিক অসংগতি প্রকাশের সবচেয়ে বড়ো মাধ্যম হয়ে ওঠে টেলিভিশন। তাই টেলিভিশন কোম্পানিগুলো সিনেমা প্রযোজনা করতে থাকে। তবে এ-অবস্থা বেশিদিন চলেনি। ৯০ দশকের শেষের দিকে বিভিন্ন দেশে ‘আর্ট ফিল্ম’ তৈরিতে খুব আগ্রহ দেখা যায়। বলা যায় যে,৬০ কিংবা ৭০ দশকে ‘বিল্পবী চলচ্চিত্র’ নির্মাণের যে আঙ্গিক চলচ্চিত্রে দেখা গিয়েছিলো তা ৯০ দশকে এসে পরিবর্তন হয়। আর এ-সময়ে সমসাময়িক জাতীয় ইস্যুগুলো চলচ্চিত্রে স্থান পেতে শুরু করে।
কিউবায় উপনিবেশবাদ ও তার চলচ্চিত্র
পাঠক, এখন আসা যাক কিউবার দিকে। কিউবা লাতিন আমেরিকার একটি প্রতিবাদী নাম, কারণ কিউবাই লাতিন আমেরিকার একমাত্র দেশ যেখানে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হয়। তবে এই দেশের উপনিবেশিক শাসনের ইতিহাস ছিলো অনেক পুরনো। এখানে উপনিবেশ শাসনের শুরু হয়েছিলো ইউরোপিয়দের হাত ধরে। ১৪৯২ সালে স্পেন এই দেশটি দখল করে এবং তারা তাদের মতো করে দেশ পরিচালনা শুরু করে। এরপর স্পেনকে বিতাড়িত করে ১৮৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষভাবে কিউবা শাসনের ভার হাতে তুলে নেয়। যার আধিপত্য অর্ধ-শতকের বেশি সময় বিস্তৃত ছিলো।
যুক্তরাষ্ট্রের মদদে বাতিস্তা সরকার ১৯৩৩ সালে দেশটিতে স্বৈরশাসন চালাতে থাকে। আর এই স্বৈরশাসন অব্যাহত থাকে ১৯৫৯ সালে বিপ্লবের আগ পর্যন্ত। বাতিস্তা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক সরকার দেশটি পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। আর এই বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক সরকার সমাজের সব ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে শুরু করে। আর এ-ধারায় সবচেয়ে বড়ো পরিবর্তনটা দেখা যায় চলচ্চিত্রে। তবে বিপ্লব পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের কু-নজর কিউবার ফিল্মকে অনেক ভুগিয়েছে।
কিউবানদের সঙ্গে চলচ্চিত্রের পরিচয় ঘটে লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের ছায়াচিত্রগুলো জনসম্মুখে প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে। চলচ্চিত্র আবিষ্কারের অল্প সময় পরই অর্থাৎ, ১৮৯৭-এ তা প্রথম প্রদর্শিত হয়েছিলো ‘পেসো দেল প্রাদো# ১২৬’ নামে হাভানার অন্যতম সিনেমা ঘরে। আর তা থেকেই কিউবার মানুষ রূপালি পর্দার প্রেমজালে বাঁধা পড়ে যায়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে কিউবার বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত সিনেমাঘরগুলোকে কেন্দ্র করে ওইসব অঞ্চল পরিচিত ও প্রসার হতে থাকে। হাভানায় প্রথম দিকের সিনেমাঘরগুলো স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন হোসে কামাসুস। তিনি একাধারে ছিলেন অভিনেতা, প্রযোজক ও উদ্যোক্তা।
আট বছর ধরে বিদেশি সিনেমা নিয়ে ব্যবসা চললেও ১৯০৫ সালে কিউবানরা নিজেরাই এই শিল্প সৃষ্টিতে এগিয়ে আসে। এখানেও অগ্রণী ভূমিকা রাখলেন হোসে কামাসুস। তৈরি হলো কিউবার প্রথম সিনেমা এল ব্রুহো দেসাপারিয়েন্দো (১৯০৫)। পরের বছর এনরিক দিয়াজ কাসাদা নির্মাণ করলেন দুটি সিনেমা- লা হাভানা এন আগস্ত্যে (১৯০৬) ও এল পার্কে দি পালাতিনো (১৯০৬)। কামাসুস ও কাসাদা দুজনেই ছিলেন ব্যবসায়ী, তাই শিল্পের সঙ্গে ব্যবসার দ্বন্দ্ব হারিয়ে দেয় শিল্পকে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছর আগ পর্যন্ত লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে চলচ্চিত্র একটি লাভজনক ব্যবসা হিসেবে গড়ে উঠতে থাকে। আর এর হাওয়া এসে লাগে কিউবাতেও। কিন্তু একদিকে নিজ দেশে প্রযোজকের অভাব এবং অন্যদিকে ইউরোপিয় চলচ্চিত্রের অবাধ প্রবেশ; কিউবার চলচ্চিত্রকে ভালোভাবে দাঁড়াতে দেয়নি। যার ফলে এই চলচ্চিত্রে বিপণন প্রক্রিয়া হাত বদল হয়ে এসে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। আর এতে করে কিউবার সিনেমাঘরগুলো কুক্ষিগত করে ফেলে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেমা। ততোদিনে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে হলিউড ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে।
এতো চাপের মুখেও কিউবান চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি অনেকটা ইতিবাচকতার মুখ দেখতে থাকে এনরিক দিয়াজ কাসাদা-এর হাত ধরে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একেবারে আগের মুহূর্তে ১৯১৪ সালে তিনি নির্মাণ করলেন এল কাপিতান মাম্বি ও লিবার্তাদোরেস ও গেরিলারোস। গুণগত মানের দিক থেকে এ-দুটি এগিয়ে থাকলেও তা কিউবার গোটা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি।
তারপরও নির্বাক যুগে কিউবার চলচ্চিত্র ছিলো অনেকখানি লাভজনক। কিন্তু সবাক যুগে এসে পরিস্থিতি পুরোপুরি উল্টে যায়। হলিউডের রঙচঙা ছবি, মেক্সিকান র্যাঞ্চার ছবি ও আর্জেন্টাইন গাউচের ছবির ব্যাপক প্রসার ঘটে কিউবা চলচ্চিত্রে। বলা চলে যে, ২০-এর দশক থেকে প্রায় ৫০-এর দশক পর্যন্ত কিউবার চলচ্চিত্র ছিলো মূলত অলীক কাহিনী, উদ্ভট দৃশ্যসজ্জা, যৌনতা এবং বিকৃত ইতিহাসে ভরপুর। মূলত এ-সময় হলিউডের ও মেক্সিকান বস্তাপঁচা চলচ্চিত্রের সফল ব্যবসার জায়গা হয়ে ওঠে কিউবা। তবে মূল ইন্ডাস্ট্রি ভালোভাবে না চললেও বিপ্লব-পূর্ব কিউবায় পর্নো ছবির বাজার ছিলো রমরমা। ‘বলা হয় এখানকার পর্নো ছবির সংখ্যা জনসংখ্যার অনুপাতে বেশিই ছিল।৫
৫০-এর দশকের প্রথম দিকে এসে আবারও কিউবান চলচ্চিত্রে বাতাস লাগানোর চেষ্টা করেন টমাস গুতিয়ারেজ আলিয়া ও হুলিয়া গার্সিয়া এসপিনোজা নামের দুজন পরিচালক। অলীক কাহিনী, উদ্ভট দৃশ্যসজ্জা, যৌনতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তারা নির্মাণ করেন দেশের প্রথম অবাণিজ্যিক চলচ্চিত্র এল মেগানো। বলা হয়, আদর্শ ও রূপের দিক দিয়ে বিপ্লব-পূর্ব সফল সিনেমা ছিলো ওই একটিই। কিউবান চলচ্চিত্রে এরপরের ইতিহাস আটকে যায় বিপ্লবের লাল পতাকায়।
বিপ্লবের রঙে কিউবান চলচ্চিত্র
বিপ্লব কিউবান চলচ্চিত্রে এক নাটকীয় পরিবর্তন আনে। অনেক তাত্ত্বিক এই বিপ্লবকে নতুন কিউবান চলচ্চিত্রে মৌল উপাদানরূপে বিবেচনা করেন। কারণ বিপ্লবের পর এতো অল্প-সময়ের মধ্যে চলচ্চিত্রের এমন পরিবর্তন হবে তা অনেকে কল্পনাই করতে পারেনি। বিপ্লবের আগে প্রায় ৬০ বছরে কিউবায় নির্মিত ছবির সংখ্যা ছিলো যেখানে মাত্র ১৫০টি, সেখানে বিপ্লব পরবর্তী ২৪ বছরে নির্মিত হয়েছে ১১২টি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি, ৯০০টি স্বল্পদৈর্ঘ্য ও ১০০০ এর বেশি সাপ্তাহিক সংবাদচিত্র।৬
বিপ্লবী সরকার ক্ষমতায় আসার পর কাস্ত্রো প্রথম যে-কাজটা করে তা হলো, ইন্সটিটিউট অব সিনেমাটিক আর্ট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ICAIC) নামে একটি চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে। দেশের সব ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ ও পরিদর্শনের দায়িত্ব দেওয়া হয় ওই ইন্ডাস্ট্রির ওপর। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি চমক দেখাতে শুরু করে। এমন-সব ছবি উপহার দিতে থাকে যা পুরো মহাদেশে কিউবান চলচ্চিত্রশিল্পকে মডেলে পরিণত করে। একই সঙ্গে দেশের মানুষের কাছে চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে বিনোদনের প্রধান মাধ্যম।
আইসিএআইসি প্রথম মনোযোগ দেয় ইতালিয় নব্য-বাস্তববাদ ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে। ইতালিতে এই ধারা গড়ে উঠেছিলো মূলত যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে। কম অর্থে ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ এর অন্যতম লক্ষ্য ছিলো। আইসিএআইসি যতোদূর সম্ভব এই পথটি বেছে নিয়েছিলো। একই সঙ্গে তাদের উদ্দেশ্য ছিলো, উন্নয়নের মুখোশের অন্তরালে থেকে সমাজ ও সময়ের প্রকৃত রূপটি খুঁজে বের করা বা বের করে নিয়ে আসা। আর বিপ্লব-পরবর্তী কিউবার সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এই ধরনের ছবি তৈরিকে সমর্থন করেছিলো।
শুধু পূর্ণদৈর্ঘ্য নয়, এর পাশাপাশি তথ্যচিত্র,স্বল্পদৈর্ঘ্য শিক্ষা, বিজ্ঞান ও কাহিনীভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণেও আইসিএআইসি মনোযোগ দিতে থাকে। তথ্যচিত্র,স্বল্পদৈর্ঘ্য ও সংবাদচিত্র মূলত ব্যবহৃত হতে থাকে দেশের সাধারণ জনগণকে সরকারের নানা কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত করার ব্যাপারে। তেমনি একটি চলচ্চিত্র ছিলো This is our land। এই সিনেমাটি দিয়ে জনগণকে সরকার ভূমি মালিকানা আইন সম্পর্কে অবহিত করে।
সময়ের পরিক্রমায় বিপ্লবী সরকারের অগ্রগতি ও কার্যকলাপের ফলে নব্য-বাস্তববাদ ধারার প্রয়োজনীয়তা ফুরাতে থাকে। ১৯৬৪ সালে টমাস গুতিয়ারেজ আলিয়া কুমবাইট ছবি নির্মাণের মধ্য দিয়ে কিউবায় নব্য-বাস্তববাদ ধারা চলচ্চিত্রের ইতি টানেন। যদিও কুমবাইট-এ একটি ঐতিহাসিক সময়কে অনেকটা নব্য-বাস্তববাদী আঙ্গিকেই উপস্থাপন করা হয়েছিলো, তারপরও এই ছবির মাধ্যমেই এ-ধারার সমাপ্তি ঘটে।
আগেই বলেছি কাহিনীচিত্রের পাশাপাশি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণেও আইসিএআইসি-এর মনোযোগ ছিলো। এই প্রামাণ্যচিত্রের নান্দনিকতা ও অভিনয়ের ধরনে পরিবর্তনের ফলে নতুন আরেকটি ধারা সৃষ্টি হয় যা ‘‘ফ্রি সিনেমা’৭ নামে পরিচিত। এ-ধারার সিনেমাগুলোতে শৈলীগত বিস্তারে অভিনবত্বের রূপ ছিলো। কিন্তু এ-নিয়ে অনেক পরিচালকের কিছুটা আপত্তি ছিলো। তাদের অভিযোগ ছিলো, এই ধারায় ফ্রি এক্সপ্রেশন দেওয়া এবং কারিগরি দিকে খেয়াল রাখতে গিয়ে চলচ্চিত্রনির্মাতারা দশর্কদের কথা ভুলে যায়। তবে ফ্রি-সিনেমা ধারাটি খুব বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। আর এরপর ‘‘সিনেমা ভেরিতে’৮ ধারায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে অনেক নির্মাতা। এই ধারা কমিউনিস্ট চিত্রনির্মাতাদের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণকে আরও বেগবান করে তোলে। যার ফলে ১৯৫৯ সালে যেখানে প্রামাণ্যচিত্রের সংখ্যা ছিলো চারটি সেখানে চার বছরের মধ্যে তা দাঁড়ায় ৪০টিতে।
৬০-এর দশকে কিউবা চলচ্চিত্রকে যতোটা না বাণিজ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, তারচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় নিরীক্ষা হিসেবে। কারণ নির্মাতারা সবসময় চাইতেন সিনেমা যেনো দর্শকের কাছে শুধুমাত্র একটি বিনোদন বা উপভোগের বস্তু না হয়ে দাঁড়ায়; এটি যেনো দর্শকের কাছে ভাবনার খোরাক হয়। তাই তারা সিনেমা নির্মাণে নানা প্রকার কৌশল ব্যবহার করতে থাকেন। আর এই নিরীক্ষা প্রধান সিনেমা প্রথম দেখা যায় ১৯৬০ সালের আলিয়া নির্মিত স্তরিয়াস দে লা রেভ্যুলেসিওন। এরপর ১৯৬৮ সালে আলিয়া কিউবাকে একটি চমৎকার ছবি উপহার দেন। যেটি ছিলো এ্যডমান্ডো দেসনোক (Edmundo Desnoc) উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত মেমোরিয়াস দেল সুবদেজারোয়ো। এই ছবিটি দিয়ে আলিয়া জায়গা করে নেন চ্যাপলিন, বার্গম্যান, বুনুয়েলদের কাতারে।
৬০-এর দশকের চলচ্চিত্রে তখনকার সমসাময়িক ইস্যুগুলো খুব গুরুত্ব-সহকারে স্থান পেতে থাকে। কিন্তু ৭০-এর দশকে সমসাময়িক ইস্যুগুলোর পরিবর্তে গুরুত্ব পায় ঐতিহাসিক বিষয়গুলো। এর প্রধান কারণ ছিলো সেই সময়ে কিউবার অর্থনৈতিক মন্দা। এই চলচ্চিত্রগুলো মূলত সতেরো-আঠারো শতকে যখন কিউবা স্পেন বা ইউরোপের উপনিবেশে ছিলো তখনকার ইতিহাস দ্বারা নির্মিত হতে থাকে। তবে ৮০ কিংবা ৯০ দশকে এসে আর এই ঐতিহাসিক ধারার চলচ্চিত্র দেখা যায়নি। এ-সময় চলচ্চিত্রে ফুটে ওঠে মানুষের প্রেম, সম্পর্ক, শ্রেণীগত অবস্থান ও আকাঙ্ক্ষা। উদাহরণ হিসেবে আলিয়ার স্ট্রবেরি এন্ড চকলেট সিনেমাটির কথা বলা যায়। সিনেমাটির মূল বিষয় ছিলো বন্ধুত্ব এবং কিউবান সমাজের সমলিঙ্গীয় ও বিপরীত লিঙ্গীয় যৌন সম্পর্ককে ঘিরে দ্বিধাদ্বন্দ্ব। এই ছবিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সে-সময় খুব প্রভাব ফেলেছিলো ।এমনকি ১৯৯৪ সালে অস্কারে বিদেশি সিনেমা শাখায় শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে মনোনয়ন পায়। আর এ-ছবির মাধ্যমেই কিউবায় প্রথম কোনো চলচ্চিত্র নির্মাতা সমকামিতা ও গণিকাবৃত্তি সম্পর্কে খোলাখুলিভাবে আলোচনা করেন।
১৯৯৬ সালে লিও ইচাসো বিপ্লব-পরবর্তী কিউবার চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বিটার সুগার নামে একটি সমালোচনামূলক সিনেমা মুক্তি দেন। বিপ্লবের পর মোহভঙ্গ হওয়া এক তরুণ কমিউনিস্ট ও তার মেয়ে-বন্ধুকে নিয়ে সিনেমার কাহিনী গড়ে ওঠে। সিনেমাটি সে-সময় চরম সমালোচনার মুখে পড়ে। শেষ পর্যন্ত জেনেভায় মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ছবিটি প্রদর্শিত হয়। এই সময়ের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে একটি কথা না বললেই নয়, সোভিয়েত-আমেরিকা স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর থেকে কিউবায় অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। এর প্রভাব পড়ে দেশটির চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি আইসিএআইসি-তে। কিউবান সরকার ভাবতে থাকে তাদের শিল্পী, পরিচালক ও বুদ্ধিজীবীরা আর্থিকভাবে সচ্ছল হবে, সরকারি ভর্তুকির ওপর তারা নির্ভরশীল হবে না। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের পরবর্তী বিশ্ব-অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় চলচ্চিত্রের লোকজন বাধ্য হলো প্রযোজনার জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারী খুঁজতে। এ-ছাড়া দেশ ছেড়ে বাইরে চলে যাওয়ার কোনো উপায় তাদের ছিলো না। পরিস্থিতি এমন হয়েছিলো যে, ১৯৯৬ সালে আইসিএআইসি একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের সিনেমাও মুক্তি দিতে পারেনি। অবশ্য এ-অবস্থা বেশিদিন ছিলো না, দ্রুতই কিউবান সরকার তা কাটিয়ে ওঠে। ২০০১ সালে হামবার্তো সোলাস তার হানি ফর ওশোন সিনেমার মাধ্যমে দেশে প্রত্যাবর্তন করা কিউবান-আমেরিকান ও স্থায়ী কিউবানদের মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়টি তুলে ধরেন। একই সিনেমায় তিনি এ-সমস্যার সমাধানও দেখান। সিনেমায় তিনি তুলে ধরেন, কিউবায় ফেরতরা যদি দেশটির আভ্যন্তরীণ নিয়ম মেনে চলে এবং দেশের জনগণকে কোনো পুঁজিবাদী আদর্শ গ্রহণে চাপ না দেয় তাহলে কোনো সমস্যার সৃষ্টি হবে না।
একটি প্রতিষ্ঠান এবং একটি স্বপ্নযাত্রা
১৯৮৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর দিনটি কিউবান চলচ্চিত্রের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। এ-দিন হাভানা থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে সান অ্যান্তোনিও ডি লস বানোস-এ প্রতিষ্ঠা পায় লাতিন আমেরিকান চলচ্চিত্র স্কুল। পরে এটির নাম হয় ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অব ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন (ইআইসিটিভি)।শুরুতে এর আসন সংখ্যা ছিলো ৩০০টি। চলচ্চিত্র স্কুলটির চারজন প্রতিষ্ঠাতার মধ্যে ছিলেন নোবেল বিজয়ী লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কুয়েজ, কিউবার সংস্কৃতি-মন্ত্রী ও প্রাক্তন চলচ্চিত্র পরিচালক হোলিও গার্সিয়া এসপিনোজা, আর্জেন্টিনার চলচ্চিত্র নির্দেশক ফার্নান্দো বিরি এবং কিউবার চলচ্চিত্র পরিচালক টমাস গুতিয়ারেজ আলিয়া। চারজনই রোমের এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমাটোগ্রাফি সেন্টারের এবং ইতালির সিজার জাভাত্তিনি-র প্রাক্তন ছাত্র।
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কুয়েজ তার একটি লেখায় ফিল্ম স্কুলের কাজ নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন এভাবে, ...লাতিন আমেরিকান, এশিয়ান এবং আফ্রিকান পেশাদারদের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট প্রযুক্তিগত উপায়ে এখানে অনুশীলিত করা হবে। এছাড়া তারা লাতিন আমেরকিার চলচ্চিত্রের দৃশ্য-শ্রাব্য তথ্য অধিকোষ (ডাটাব্যাঙ্ক) নির্মাণ এবং সর্বপ্রথম স্বাধীন তৃতীয় বিশ্বের ফিল্ম আর্কাইভের জন্য পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। লাতিন আমেরিকার চলচ্চিত্রের একটা বৃহৎ ইতিহাস রচনা এবং চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের বর্ণমালা সম্বলিত একটি স্প্যানিশ ভাষার অভিধান রচনার জন্য পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে।৯
এই প্রতিষ্ঠানটি কিউবাকে লাতিন আমেরিকার সংস্কৃতি ল্যাবরেটরিতে পরিণত করেছে। প্রতি দুই বছর অন্তর এখানে আর্ট ফেস্টিভ্যাল ও চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন শুরু হয়। আর এসব ভেস্টিভালে গ্রেগরি পেক, ফ্রান্সিস ওপোলা এবং রবার্ট ডি নিরোর মতো মার্কিন শিল্পীরা অংশগ্রহণ করতে থাকেন। এসব চলচ্চিত্র উৎসবে যেসব চলচ্চিত্র দেখানো হয় এর মধ্যে থেকে বাণিজ্যিক ব্যবহারের উপযোগী ছবিগুলোকে কিনে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে থাকে কিউবা সরকার। এ-ব্যাপারে অবশ্য কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রোর নিজের আগ্রহই ছিলো সবার আগে।
তার ভাষ্য এ-রকম,‘‘প্রতি বছর প্রচুর ফিচার কিংবা ডকুমেন্টারি আমরা কিনেও থাকি। বাস্তবজীবনে এ-ধরনের চলচ্চিত্র আন্দোলনের মূল্য আমি উপলব্ধি করছি। একে আরও ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। অল্পকিছু থিয়েটার হলে উৎসবের ছবিগুলো প্রদর্শিত হয়। আমি অন্যান্য থিয়েটার হলগুলো ব্যবহার করে বেশি সংখ্যক দর্শকের কাছে সেগুলো পৌঁছানোর পক্ষে মত দেই। পরে সে-অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হয়।’১০
এ-ছাড়া লাতিন আমেরিকা বর্তমানে তাদের সিনেমাগুলো ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রদর্শনের জন্য বেশকিছু থিয়েটার কেনার কথা ভাবছে। ইতিমধ্যে তারা বিভিন্ন দেশে থিয়েটার হল বরাদ্দ নেওয়া শুরু করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ইউরোপ, আমেরিকা যেমন তাদের চলচ্চিত্র দিয়ে সারা পৃথিবীতে বাজার করেছে তারাও সেটিই করবে।
প্রত্যাশার শুরু যেখান থেকে
বর্তমান বিশ্বের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে লাতিন আমেরিকার চলচ্চিত্র এক নতুন মাত্রা নিয়ে আবির্ভূত। একমাত্র লাতিন আমেরিকার চলচ্চিত্রকারেরাই পেরেছেন সেলুলয়েডের প্রাণহীন ছবিতে প্রাণ সৃষ্টি করতে; আবার মৃত্যুশোক ফুটিয়ে তুলতে, পেরেছেন দর্শক-হৃদয় উষ্ণ করতে, ঐক্যবদ্ধ করতে। আর তারা এসব করেছেন বস্তুনিষ্ঠ থেকেই, বিষয়বস্তু থেকে দূরে সরে না গিয়ে-যা কখনই তাদের এক সময়ের উপনিবেশ হলিউডের সিনেমায় দেখা যায়নি। এ-ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকা কিউবার চলচ্চিত্রকারদের কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সন্ধান মেলে লাতিন আমেরিকার চলচ্চিত্রের প্রকৃত রূপ। কিউবায় বিপ্লব হয়েছিলো ১৯৫৯ সালে, আমাদের থেকে প্রায় এক যুগ আগে। এরপর গত অর্ধ-শতকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মদদে নিজেদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কিউবার চলচ্চিত্র আজ বিশ্ব-দরবারে দাঁড়িয়ে গেছে। নিজ চেষ্টায় হলিউডের রঙচঙ্গা সিনেমাকে পাশ কাটিয়ে তারা আওয়াজ তুলেছে। আর আমরা স্বাধীনতার আগ থেকে প্রতিষ্ঠিত একটি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি পেয়েও ৪০ বছর পরে এসে সব হারাতে বসেছি। এক আইসিএআইসি কিউবার চলচ্চিত্রকে বিশ্ব দরবারে নিয়ে গেছে আর আমাদের এফডিসি এখন চলচ্চিত্রের জাদুঘরে পরিণত হয়েছে। আমাদের শাসক, চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্টদের সময় এসেছে দূরের দেশ হলেও কিউবা থেকে শিক্ষা নেওয়ার। উপনিবেশ থেকে বেরিয়ে কীভাবে উপনিবেশকে হারিয়ে দেওয়া যায়।
লেখক : আশফাক দোয়েল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
ashfaquldoyel@yahoo.com
তথ্যসূত্র
১. চক্রবর্তী, রংগন (২০১০ : ১৫৯); ‘‘কলোনিয়ালিজম’; বুদ্ধিজীবীর নোটবুক; নবযুগ প্রকাশনী, ঢাকা।
২. সোলানাস, ফার্নান্দো, অকতাভিও গেতিনো; ‘‘তৃতীয় চলচ্চিত্রের লক্ষ্যে’; অনুবাদ-কাইজার চৌধুরী; চলচ্চিত্র বুলেটিন; সম্পাদনা-জুবায়ের আল মাহমুদ নাদিম ও অন্যান্য; ২য় সংখ্যা চলচ্চিত্র আন্দোলন, মার্চ-২০০৯, পৃ-৯৩, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
৩. চক্রবর্তী, ইন্দ্রনীল; ‘‘লাতিন আমেরিকার চলচ্চিত্র : শিল্প, ‘সমাজ ও ইতিহাস চেতনা’; ফ্ল্যাশব্যাক; সম্পাদনা-নাহাদ-উল-কাশেম ও অন্যান্য; বর্ষ-১৪, সংখ্যা-১, সেপ্টেম্বর-2010, পৃ-০৪, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ, ঢাকা।
৪. প্রাগুক্ত; চক্রবর্তী, ইন্দ্রনীল (২০১০ : ১২)।
৫. ফিরদাউস, ইমরান; ‘‘কিউবার চলচ্চিত্র ও একজন সক্রিয় দর্শক তৈরির কারিগর’; ফ্ল্যাশব্যাক; সম্পাদনা-নাহাদ-উল-কাশেম ও অন্যান্য; বর্ষ-১৪, সংখ্যা-১,সেপ্টেম্বর-2010, পৃ:২৬-২৭, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ, ঢাকা।
৬. প্রাগুক্ত; ফিরদাউস, ইমরান (২০১০ : ২৭)।
৭. ফ্রি সিনেমা : সিনেমা ভেরিতে ফর্মটির সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে ব্রিটেনের ফ্রি সিনেমার। বলা হয়, সিনেমা ভেরিতের ব্রিটিশ রূপ হলো ফ্রি সিনেমা।
৮. সিনেমা ভেরিতে : এই ধারায় সিনেমায় স্বতঃর্স্ফূত সত্যনিষ্ঠ সিনেমা অর্থাৎ ধরাবাঁধা প্লট ও মনোগ্রাহী বর্ণনা ভঙ্গির পরিবর্তে যেখানে যেমন আছে সেইভাবে বাস্তবতাকে তুলে ধরা হয়। সোভিয়েত রাশিয়ার পরিচালক ঝিগা ভের্তভ এই কিনোআই আন্দোলন দ্বারা সিনেমা ভেরিতে প্রভাবিত। ৬০-এর দশকে ফ্রান্সের সমাজবিজ্ঞানী ও নৃতাত্ত্বিকরা এ নিয়ে কাজ করেন।
৯. মার্কুয়েজ, গ্যাব্রিয়াল গার্সিয়া; ‘‘লাতিন আমেরিকার জন্য একটি ফিল্ম স্কুল’; ভাষান্তর-দেবাশিস হালদার; ফ্ল্যাশব্যাক; সম্পাদনা-নাহাদ-উল-কাশেম ও অন্যান্য; বর্ষ-১৪, সংখ্যা-১,সেপ্টেম্বর-2010, পৃ-৫৫, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ, ঢাকা।
১০. ফিদেল কাস্ত্রোর একটি সাক্ষাৎকার থেকে উদ্ধৃতিটি নেওয়া। গিয়ান্নি মিনা এ সাক্ষাৎকারটি নেন। জাহানারা মুন্নী অনূদিত ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মুখোমুখি (২০০৯) শীর্ষক বই থেকে সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছে। প্রকাশক-শ্রাবণ প্রকাশনী, ঢাকা।
বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৩ সালের জুলাইয়ের ম্যাজিক লণ্ঠনের তৃতীয় সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন