Magic Lanthon

               

একরামুল ইসলাম ও অমি রুবেল পারভেজ

প্রকাশিত ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

টালিগঞ্জের চলচ্চিত্র : ‘শ্লীলতা’, ‘অশ্লীলতা’র  দ্বন্দ্বে পরাভূত বাস্তবতা

একরামুল ইসলাম ও অমি রুবেল পারভেজ


সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষ ক্রমশ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করেছে। আধুনিক, শিক্ষিত, বিবেকবান ও সামাজিক মূল্যবোধের অধিকারী এ মানুষ সর্বত্র স্বীকৃত। সমাজের নির্ধারিত আইন-কানুন যথারীতি মেনে চলার মধ্যে দিয়ে ব্যক্তি-মানুষ নিজেকে শালীনতাবোধসম্পন্ন সামাজিক জীব হিসেবে বারবার প্রমাণিত করতে চায়। কিন্তু ঠিক কোন মানদণ্ড দিয়ে সমাজের এসব পরিচালিত হয়, তা খুব কম সময়ই ভাবা হয়েছে। সমাজ নির্ধারিত আইন-কানুনগুলোর মধ্যে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া অনেক বিষয়কে সমাজ আড়াল করতে চায়; আবার অনেক কিছুকে পারলে বেশি করে তুলে ধরতে চায়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে থাকে পুরুষ প্রাধান্যশীলতা। তারা ক্ষমতা স্থায়ী করতে তাদের স্বাভাবিক অথচ ব্যক্তিগত প্রবৃত্তিগুলোকে গোপন করতে দ্বিধা করে না। প্রয়োজন মতো অনেক বিষয়ের ওপর পাপাচার, অবৈধ ও নিষিদ্ধ তকমা এটে দেয়। যার কারণে বিষয়গুলো নিয়ে সৃষ্টি হয় ক্রমাগত জটিলতার। ফলে মানুষ স্বীয় প্রবৃত্তি প্রকাশের অধিকারটুকুও অনেক সময় হারিয়ে ফেলে।

চলচ্চিত্রও এর বাইরে নয়। আমরা সাধারণত যে ধরনের চলচ্চিত্র দেখে আসছি সেখানে এই ‘পাপাচার’, ‘অবৈধ’ বা ‘নিষিদ্ধ’ বিষয়গুলোর উপস্থাপনা নেই বললেই চলে। আর যেখানে এর উপস্থাপনা চোখে পড়েছে, সেখানে পাপাচার, অবৈধ বা নিষিদ্ধ তার প্রথাগত অর্থের বাইরে গিয়ে নতুন কোনো অর্থ নির্মাণ করতে পারে নি। তবে বাইরে যে একেবারে কিছুই হয় নি, বিষয়টি মোটেও এমন নয়। মানুষের প্রবৃত্তির সঙ্গে সম্পর্কিত, জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ-এমন সব বিষয় যখন চলচ্চিত্রে হুবহু উঠে আসে, তখন আর তা সাধারণ চলচ্চিত্র থাকে না; হয়ে যায় বিকল্প ধারা। অথচ চলচ্চিত্র যদি জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়, শিল্প যদি জীবনের জন্য হয়-তাহলে চলচ্চিত্রের মূলধারা আর বিকল্পধারা বলে তো কিছু থাকার কথা নয়। তার নাম হওয়ার কথা ছিল কেবলই চলচ্চিত্র।

কিন্তু তা আর হয় নি। লুমিয়েরদের হাত ধরে যে চলচ্চিত্রের সূচনা হয়েছিল তা সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আধেয়ের ভিত্তিতে নানাভাবে বিভক্ত হয়েছে। সিনেমাতে তৈরি হয়েছে নতুন মাত্রা; যা সমাজ ও বাস্তবতাকে নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে। পরিচিত হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের সাথে। টালিগঞ্জের সাম্প্রতিক (বেশিরভাগ চলচ্চিত্র ২০০৯, ২০১০ ও ২০১১ সালের মধ্যে নির্মিত) এ ধরনের বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের বিষয় ও তা নিয়ে মূলধারা বিকল্পধারার দ্বন্দ্ব এ লেখায় বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে।

মূলধারা বনাম বিকল্পধারার চলচ্চিত্র

প্রথাগত কাহিনী, ফমুর্লাভিত্তিক চিত্রনাট্য, দর্শকদের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীলতা মূলধারার চলচ্চিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ ধারায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছবির কাহিনী থাকে কাল্পনিক, দর্শককে ভাবার কোনো সুযোগ দেওয়া হয় না। গৎবাঁধা নায়ক-নায়িকা নির্ভর কাহিনী দেখে দর্শক কিছু সময়ের জন্য আবেগ প্রবণ হয়। দর্শককে কাহিনীর সঙ্গে একাত্মকরণে পরিচালকের থাকে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। বিষয়টা এমন হয়- দর্শককে যৌনতা, সহিংসতা, মন ভোলানো গল্পের মাধ্যমে বিনোদন দেয়া যাবে কিন্তু ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, আচারগত জায়গায় ঝাঁকুনি দেবে এমন কাহিনী উপস্থাপন করা যাবে না। কারণ স্টুডিওনির্ভর এসব ছবির জন্য থাকে বড় ধরনের বাজেট, প্রযোজক এবং পরিবেশক; মোটের ওপর বড় ব্যবসা। ছবি নির্মাণের প্রধান উদ্দেশ্যই থাকে বাণিজ্য; পরিচালকের চাইতে অধিক প্রাধান্য দেওয়া হয় প্রযোজকের মতামতকে।

অন্যদিকে প্রযোজক ও পরিবেশক ছাড়াই স্টুডিওর বাইরে গিয়ে পরিচালকের নিজের মতো করে নির্মিত চলচ্চিত্রের নাম স্বাধীন ধারা। এ ধারা মূলত চলচ্চিত্র নিয়ে ব্যবসা করতে চায় না। ‘তার চাইতে বড়ো কথা ছবি বানানোর যে বিশাল খরচ তা যোগাড় করার সার্মথ্য যাদের নেই তারা বড়ো কোনো স্টুডিও, পরিবেশকের কাছে না গিয়ে খানিকটা নিজের পয়সায়, নিজেদের পরিবেশনায় ছবি নির্মাণ ও প্রদর্শন করেন।’ তার মানে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বাইরে গিয়ে নিজের মতো করে পরিচালক যে সিনেমা নির্মাণ করবে তাই স্বধীন চলচ্চিত্রের। আমাদের আলোচনা অবশ্য এই স্বাধীন ধারা নিয়ে নয়।

আর চলচ্চিত্রের বিকল্প ধারাকে প্রচলিত ধ্যান-ধারণা প্রয়োগের বিরোধী মনে করা হয়। ‘মূলধারার ছবিগুলো সমাজে প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে অবলম্বন করেই নির্মিত হয়ে থাকে, প্রচলিত ধারণার বাইরে এসে কেউ যদি ছবি নির্মাণ করে থাকে তাকে বিকল্প ধারা বলা যেতে পারে।’ এখানে স্টুডিওর ভিতর বা বাহির গুরুত্বপূর্ণ নয়, আধেয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিনিয়ত ঘটছে কিন্তু সামাজিকভাবে স্বীকৃত নয়, যা প্রকাশ পেলে সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামো সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শেখায়- সেই বিষয়গুলো তুলে ধরা হয় বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রে।

‘সামপ্রতিক বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বিকল্পধারার ছবিগুলোর বিষয়বস্তু হলো আদিবাসী বা জাতিগত সংখ্যালঘু, সমকামী, তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া ইত্যাদি। সমকামীদের নিয়ে ছবি করাটা সেক্ষেত্রে একেবারেই ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যের নয়, সমকামীদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানকে তুলে ধরা, প্রচলিত সমাজে এই পরিচয় নিয়ে বাস করতে গিয়ে যে সংকট তাদের জন্য নির্ধারিত থাকে তা তুলে ধরা এসব ছবির লক্ষ্য।’ এছাড়া আভাঁ গার্দ, ফরাসী নবতরঙ্গ ধারা, ইরানের বেশকিছু চলচ্চিত্র বিকল্প ধারার সংজ্ঞায়নকে সমর্থন করে। অনেক সময় আঙ্গিকের অনন্যতাও বিকল্পধারা হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রধান বিষয় থাকে এর আধেয়।

মূলধারার সিনেমার ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, সমাজে যে বিষয় প্রচলিত, তাই এর আধেয়। আর বিকল্পধারার বিষয়বস্তু অপ্রচলিত। তাহলে সমকামিতা, পরকীয়া, হস্তমৈথুন, পুরুষ যৌনকর্মী, হিজড়া ইত্যাদি বিষয়গুলো চলচ্চিত্রের কোন ধারার মধ্যে পড়বে? এগুলো প্রচলিত, নাকি অপ্রচলিত? মূলধারাওয়ালারা বলতে পারেন অপ্রচলিত। তখন প্রশ্ন, তাহলে প্রচলিত কোনগুলো? উত্তর- কোনো বিষমকামিতা, দাম্পত্য সম্পর্ক, নারী যৌনকর্মী ইত্যাদি। পাঠক একটু খেয়াল করলে লক্ষ্য করবেন, প্রচলিত-অপ্রচলিত’র সঙ্গে এক ধরনের ‘শ্লীলতা’ ‘অশ্লীলতা’ বিষয়টি জড়িত। হস্তমৈথুন বিষয়টির কথাই ধরুন, যখন কাম অনুভব হয় তখন থেকে এর শুরু। নর-নারী উভয়ের জীবনের ক্ষেত্রে এর প্রচলন বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ তা কিন্তু চলচ্চিত্রে অপ্রচলিত। একইভাবে পরকীয়া; বাজারি ব্যবস্থায় দাম্পত্য জীবনের ব্যর্থতা থেকে উঠে আসা এক প্রপঞ্চের নাম পরকীয়া। আপনি-আমি চাই বা না চাই এর প্রচলনও সমাজে চোখে পড়ার মতো। এই ধরনের কথা সমকামিতার ক্ষেত্রেও খাটে। কিন্তু এগুলো আধেয় হয়ে ওঠে বিকল্পধারার।

এখন প্রশ্ন, চলচ্চিত্রের আধেয়-নির্ভর এই ধারার যৌক্তিকতা কতখানি। একথা ঠিক সব সিনেমা মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য নির্মিত হয় না। কিন্তু ভারতে মনি কাউল ও কুমার সাহানিরা এসে এমন সব দুর্বোধ্য সিনেমা বানানো শুরু করলেন সেগুলো দেখার মতো দর্শক ছিল না। তখন আঙ্গিক দিক দিয়ে অবর্ণনাত্মক বা নন-ন্যারেটিভ ফর্মে সিনেমা তৈরি হতে থাকে। অবর্ণনাত্মক ফর্মে বানানো এসব চলচ্চিত্রগুলোকে আর্ট সিনেমা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মূলত এর মাধ্যমেই ভারতে বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রের শুরু।

আগে যেটা শুধু উপস্থাপনের আঙ্গিকের কারণে আর্ট ফিল্ম ছিল; সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তা আধেয়কে স্পর্শ করল। ফলে টালিগঞ্জের এসব সিনেমা নামত আর্ট ফিল্ম হলেও তা আধেয়গত কারণে বিকল্প ধারার মধ্যে পড়ে যায়। এক সাক্ষাতকারে ভারতের বিখ্যাত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ বলেন, ‘কলকাতায় কিন্তু আমরা কখনোই আর্ট বা প্যারালাল শব্দটি ব্যবহার করি নি। এ ধরনের সব সিনেমাকে আমরা ইন্টেলেকচ্যুয়াল সিনেমা বলতাম, এটা কেবল বলার জন্য নয়, সবাই সংজ্ঞা বুঝে তারপরই সেগুলোকে ইন্টেলেকচ্যুয়াল সিনেমা ডাকত। সুতরাং যে সিনেমা করতে গিয়ে আপনাকে বুদ্ধিবৃত্তির ব্যবহার করতে হবে, যেটা কেবল মনোরঞ্জনের জন্য নির্মিত হবে না সেটা বুদ্ধিবৃত্তিক সিনেমার শ্রেণীতে ফেলে দেয়া যায়।’

আমরা মূলত এই চলচ্চিত্রকে মূল, বিকল্প কিংবা আর্ট, এমনকি ঋতুপর্ণের ভাষায় ইন্টেলেকচুয়্যালও বলতে চাই না। চলচ্চিত্র মানে চলচ্চিত্রই। চলচ্চিত্রের জন্য ধারার দরকার নাই। বরঞ্চ এই ধারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত নানা বিষয়কে শ্লীল-অশ্লীল হতে সহায়তা করেছে। ফলে বাস্তব অবস্থা বারবার নিজেকে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে। টেকনিক্যাল কিংবা অর্থ বিনিয়োগের আড়ালে চলচ্চিত্রকে বিভক্ত করা যেতে পারে, তবে তা মোটেও আধেয় দিয়ে নয়।

যৌনতা, অশ্লীলতা  বিকল্প ধারা

যৌনতা মানুষের দুর্দমনীয় প্রবৃত্তি। যৌন সুখলাভের অধিকারও বটে। আর এর মধ্য দিয়েই মানুষের জন্ম। যৌনতাকে তাই কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। আদিম কালে যৌনতা নিয়ে মানুষের আড়ষ্টতা ছিল না। আজকের সমাজে আমরা যৌনতা বলতে যা বুঝি তা কিন্তু একটা বিশেষ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে দিয়ে নির্মিত হয়েছে। তাই যৌনতার কোনো একক নিরপেক্ষ সংজ্ঞা আছে- এরকম ভাবলে ভুল হবে। মানুষের এক আলাদা ও অপরিহার্য যৌনসত্তার অস্তিত্ব রয়েছে যৌনতার মধ্যে, যা মানুষের লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে। সুতরাং আমরা বলতে পারি, যৌনতা ব্যক্তির ব্যক্তিগত কামনা-বাসনার একটি সক্রিয় ধারা নির্মাণ করে।

সমাজে যৌনতা শব্দটির সাথে একধরনের লজ্জা, ভয়, সম্মানহানি, সম্ভ্রমহানি, সংকোচ, গোপনীয়তা জড়িত। স্বাভাবিকভাবে এটিকে এড়িয়ে যাওয়ারই চেষ্টা করা হয়। এ প্রসঙ্গে মিশেল ফুকোর বক্তব্যটা এমন- ‘সেক্স হল পারিবারিক বিষয়। সেক্সের সম্পর্ক হল বস্তুত সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠা ও বিস্তার করার সম্পর্ক। ... অপরদিকে, যৌনতা হল এক ব্যক্তিগত বিষয়, এর সম্পর্ক শুধু ব্যক্তির গোপন কামনা, বাসনা, শরীরের বিপজ্জনক প্রবণতা, গুপ্ত ফ্যান্টাসিকে কেন্দ্র করে। বস্তুত এই হল ব্যক্তি-মানুষের সত্ত্বাসার। তার ব্যক্তিত্ব ও আইডেনটিটির অন্তস্থল।’

বিষয়টি বর্তমানে এমন দাঁড়িয়েছে যে, এ নিয়ে যে কথা বলার সাহস দেখাবে সমাজের কাছে সে একধরনের ‘খারাপ’ উপাধি পাবে। বিষয়টি নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনা অনেক ক্ষেত্রে একটু বেশি বোঝারই নামান্তর! যৌনতার কোন জায়গাগুলি স্বীকৃত আর কোন জায়গাগুলো অবৈধ তা নির্ধারিত হয় প্রথাবদ্ধ সমাজনেতাদের দ্বারা। ফুকোর ভাষায় বিষয়টি এমন যে, ‘যারা যৌনতার মুক্তির কথা বলছেন, অথবা এই অবদমনকে প্রতিরোধ করার কথা বলছেন, তারা প্রতীয়মান হন যেন ক্ষমতার বিরুদ্ধেই লড়াই করছেন। কেউ যখন যৌনতার স্বপক্ষে কথা বলছেন, তখন যেন তিনি প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার বিরুদ্ধেই কথা বলছেন।’  

অথচ দেখুন, সৃষ্টির আদি থেকে আজ অবধি মানুষ বসবাস করছে যৌন ও যৌনতার মধ্যে। প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে তারা একে অপরের সাথে মিলিত হয়ে যৌনতার বিকাশ ঘটিয়েছে। ফলে সমাজে সৃষ্টি হয়েছে বহুগামিতা। নারী-পুরুষ উভয়ের মাঝেই বহুগামিতার আকর্ষণ রয়েছে। এবং সেই বহুগামিতাকে প্রশ্রয় দিতেই বারবনিতার সৃষ্টি। অথচ দেখুন, বহুগামিতা কিন্তু শোভন যৌনতা নয়। যখন সামাজিক রীতিনীতি মেনে যৌনতা চালিত হয়, তখন সেটা অন্যায় বা অশ্লীল নয়। কিন্তু যখন যৌনতা স্বেচ্ছাচারিতা পরিণত হয়, সামাজিক বাধা-নিষেধ উপেক্ষা করে, তখন যৌনতা হয় অশ্লীল। ‘স্বামী-স্ত্রীর যৌনতা স্বাভাবিক, কিন্তু সেই যৌনতাও অস্বাভাবিক হতে পারে, যদি তাদের কেউ একজন মিলনে অনিচ্ছুক হয়।’

আদিতে মানুষ নগ্নভাবে জীবন-যাপন করত। সেখানে কিন্তু আজকের মতো অশ্লীলতা ছিল না। ‘একটি উলঙ্গ শরীর কখনো পর্নো হয় না, যদি না তাতে আরোপ করা হয় অস্বাভাবিক গুরুত্ব, ধোঁয়াটে বিচার ও কিছু বহিরাগত ফ্যাক্টর, যেগুলি শরীরটিকে নগ্ন করলেও প্রকৃতপক্ষে ঢেকেই রাখে। সম্পূর্ণ নগ্নতা পর্নোগ্রাফিতে অসম্ভব, কারণ তা পর্নোগ্রাফির উদ্দেশ্য বানচাল করে দেয়। অর্ধ-আলোক, ছায়াময়তা এবং আধা-দেখা-যাওয়া নগ্নতাই পর্নোগ্রাফির উপজীব্য, কারণ সম্পূর্ণ নগ্নতায় যে অন্যমনস্কতা ও সারল্য আছে, তা সুড়সুড়ি দেয় না।’ তার মানে নগ্নতা মানেই অশ্লীলতা নয়। সময়ের আবর্তনে মানুষ অন্যের কাছে আকর্ষিত হওয়ার জন্য নিজেকে আবৃত করেছে। মানুষ ব্যতীত সৃষ্টির কোনো জীবই কিন্তু আবৃত থাকে না, তাই বলে তাদেরকে আমরা অশ্লীল বলি না।

তার মানে যৌনতা, অশ্লীলতা ও নগ্নতা সবকিছুই আপেক্ষিক। গর্ভনিরোধকের প্রথম প্রবক্তা মার্গারেট স্যাঙ্গারকে জেলে যেতে হয়েছিল। কারণ তার সময়ে মেয়েদের গর্ভনিরোধের কথা, শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণের কথা বলাও ছিল অশ্লীলতার সামিল। কিন্তু দেখুন, আজকের সময়ে গর্ভনিরোধ কোনোভাবেই অশ্লীল নয়। সময়ের প্রেক্ষাপটে গর্ভনিরোধ এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিধি হিসেবে সমাজ মেনে নিয়েছে। রাষ্ট্র, সমাজ নারীদের উদ্বুদ্ধ করছে গর্ভনিরোধে।

মার্গারেট স্যাঙ্গারের সময়ে গর্ভনিরোধ নিয়ে যদি চলচ্চিত্র নির্মিত হতো তা হতো বিকল্পধারা। কিন্তু বর্তমানে তা হয়ে গেছে মূলধারা। আগেই বলেছি যা প্রচলিত ধ্যান-ধারণা প্রয়োগের বিরোধিতা করে তাই বিকল্প। এক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে সমকামিতা, পরকীয়া, হস্তমৈথুন, পুরুষ যৌনকর্মী এ ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে যদি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয় তা হচ্ছে বিকল্পধারা। অনেক ক্ষেত্রে তা সংজ্ঞায়িত হচ্ছে অশ্লীল হিসেবেও। কিন্তু প্রশ্ন হলো, একসময়ের অশ্লীল গর্ভনিরোধ আজকে এসে যেমন আইন করে নারীকে বাধ্য করা হচ্ছে। ঠিক একইভাবে সেই আদিমকাল থেকে চলে আসা সমকামিতা, হস্তমৈথুন’র মতো বিষয়গুলো আমাদের মানব জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত হওয়ার পরও এগুলোকে ভাবা হচ্ছে বিকল্প হিসেবে। আর পরকীয়া ও পুরুষ যৌনকর্মীর ধারণাতো এখন সময়ের দাবি।

আমরা একটা জিনিস কেন বুঝতে চাই না যে, সমকামিতা কারো ওপরে আরোপ করা কোনো বিষয় নয়। এটি নারী-পুরুষের সাধারণ সম্পর্কের মতোই নারী-নারী কিংবা পুরুষ-পুরুষের একধরনের সম্পর্ক। হস্তমৈথুনকে ইতিবাচকভাবে দেখার যথেষ্ঠ কারণ আছে। নারী-পুরুষ উভয়ের জীবনের অপরিহার্য ব্যাপার হস্তমৈথুন। কিন্তু এত অপরিহার্য বিষয়ের উপস্থাপন করা হচ্ছে অশ্লীল হিসেবে!

দেখুন বিয়ে, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, যুদ্ধ, রাজনীতি, সন্ত্রাস এখন মূলধারার চলচ্চিত্রের বিষয়। দর্শককে সেক্স ও ভায়োলেন্সের মাধ্যমে বিনোদন দেয়া যাবে, কিন্তু ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, আচারগত জায়গা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এমন কোনো কাহিনী বলা যাবে না। নারীর দেহকে একটু আগ বাড়িয়ে উপস্থাপনার বিষয়টি তারা ঠিকই মেনে নেবে। কিন্তু নারী বা পুরুষের একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হস্তমৈথুন কিংবা সমকামিতাকে তুলে ধরতে দেবে না। অন্যদিকে বাজারি সংস্কৃতিতে মানুষ যখন ছুটছে কাড়ি কাড়ি টাকার পিছনে, তখন দিনে দিনে ঢিল হয়ে পড়ছে তাদের পারিবারিক জীবনের সম্পর্কগুলোও। ব্যক্তি পুরুষ ঘরের বাইরে মিশছে নানা নারীর সঙ্গে, একই সঙ্গে নারী-স্ত্রীও তার ভাল লাগা, জৈবিক চাহিদা শেয়ার করছে অন্য পুরুষের সঙ্গে। যার পুঁথিগত নাম হচ্ছে পরকীয়া। দিনের পর দিন এই সমস্যা শহুরে ব্যক্তি জীবনের অন্যতম সমস্যা হয়ে উঠলেও তা চলচ্চিত্রে তুলে ধরা নিয়েই যত ‘ধারা’র কথা।

মূলধারার সিনেমার সাথে বিকল্প ধারার সিনেমার যে বিষয়গত পরিবর্তন এসেছে তা মানুষকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। সেই ভাবনা থেকেই মূলধারা আর বিকল্প ধারার যে দ্বন্দ্ব তাই নিয়েই আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রয়াস। কেন বিকল্প ধারার সিনেমার বিষয়বস্তু মূলধারার সিনেমার বিষয়বস্তু হবে না?

অন্য এক সম্পর্কের নাম সমকামিতা

‘সুপ্রাচীন কালে সোডম ও গমোরা নামে দুটো নগর ছিল। কোনো এককালে এই দুই নগরের পুরুষেরা আকর্ষণবোধ করতে থাকে সমলিঙ্গের প্রতি। নারীরা উপেক্ষিত হয় প্রবলভাবে। কিন্তু পুরুষদের মধ্যে মিলন নতুন প্রজন্মের আগমন ঘটায় না। ফলে এই মানসিকতার বিস্তার হলে হয়ত মানব জাতি ধ্বংস হবে। ঈশ্বরের এমন আশঙ্কায় নগর দুটোকে ধ্বংস করা হয়।’১০

নগর ধ্বংস হয়েছে ঠিকই কিন্তু মানুষের মৌলিক যৌন-আচরণের মধ্যে সমকামিতা ধ্বংস হয় নি বরং জোরালোভাবে স্থান করে নিয়েছে। আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত এর চর্চা যেমন হয়েছে, এর বিপরীতে একে দমনের জন্যও প্রয়োগ করা হয়েছে কঠোর শাস্তি। কিন্তু জন্মগত পাওয়া এ বৈশিষ্ট্য থেকে নারী কিংবা পুরুষের মুক্তি মেলে নি। দেশে দেশে সব সমাজে জন্ম নিয়েছে সমকামি ব্যক্তি। সব বয়সের, সব গোষ্ঠীর ও সব ধর্মীয় বিশ্বাসের সমাজে তারা রয়েছে। কোনো যৌক্তিক পন্থায় তাদের এড়িয়ে যাওয়ার অবকাশ নাই। ‘গত শতকের বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পশ্চিমে সমকামিতার প্রসঙ্গটি সামনে চলে আসে। আগে যেখানে বিষমকামিতাকে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক মনে করা হতো তাতে ফাটল ধরে তখনই। আসলে মনোঃসমীক্ষণের জ্ঞানতাত্ত্বিকতা সমকামিতাকে বিকৃতি হিসেবে দেখলেও উত্তর আধুনিক দার্শনিক মিশেল ফুঁকো জানান প্রাচীন গ্রিসে সমকামিতাকে ট্যাবুর জায়গা থেকে দেখা হতো না। বরং এর সামাজিক স্বীকৃতি ছিল।’১১

কিন্তু চিরাচরিত সমাজ সমকামিতার সম্পর্ককে স্বাভাবিকভাবে নেয় না। বরং পরস্পরের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাশীল আচরণকে নিষিদ্ধ ও বেআইনি বলে ঘোষণা করে। সাধারণত তারা সমাজ স্বীকৃত নারী-পুরুষের মধ্যে যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক তার বাইরে মেনে নেয় না। সমকামি সমর্থকদের মতে, শারীরিক সম্পর্ক করতে গেলে তা যে শুধু নারী-পুরুষের মধ্যেই হতে হবে তা নয়। এ সম্পর্ক মূলত পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোতে গড়া এক সংস্কৃতি। পুরুষ তার জৈবিক চাহিদা মেটাতে নারীর শরীরকে ভোগ করবে এই নিয়মকে নারীবাদীরা পিতৃতান্ত্রিক প্রভুত্ব বলে মনে করেন। নারীবাদীরা মনে করেন নারীর যৌনসুখ মেটাতে পুরুষের কোনো ভূমিকার প্রয়োজন নেই। যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা সমকামিতাকে এক বৈষম্যহীন চর্চা বলে ঘোষণা করেন। যাতে সমর্থন দেয় নারীবাদী পুরুষেরাও। এবং যা পরবর্তীতে রূপ নেয় সমকামিদের অধিকার আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে। কিন্তু তারা সেই আদি থেকে বর্তমান পর্যন্ত স্বাধীন হতে পারে নি।

তারা সব সময় কট্টরপন্থীদের বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। ৭০’র দশকে সমকামি সমাজের যে নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, তা সমকামিতার ইতিহাসে অভূতপূর্ব। প্রায় রাতারাতি তৈরি হয় সমকামিতার নিজস্ব ভাষা, প্রকরণ, রীতিনীতি, বেশভূষা প্রসাধন। নারী-পুরুষ যৌন সম্পর্কের বহির্ভূত সব রকমের যৌন সম্পর্ক সমকামিতার আওতায় অন্তর্ভূক্ত হয়; পুরুষ সমকামিতা, লেসবিয়ানিজম, উভকামিতা, বিপরীত-বেশ, লিঙ্গ-পরিবর্তন ইত্যাদি। আধুনিক ভারতবর্ষেও সমকামিতার চর্চা হচ্ছে এবং তা খুবই গোপনীয়ভাবে। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথাগত সমাজ সমকামিতার চর্চাকে স্তব্ধ করে দিতে তৎপর হয়। বিশেষ করে ভারতীয় সংস্কৃতির জন্য তা হুমকি হিসেবে ধরা হয়। সে দেশের দণ্ডবিধি অনুযায়ী পায়ুকাম এখনো শাস্তিযোগ্য অপরাধ (ধারা ৩৭৭)।১২ কিন্তু সমস্যা হলো আইন করে সমকামিতাকে রোধ করা যায় নি, রোধ করা সম্ভবও নয়। যেটা হয়েছে সমকামিতাকে ‘অশ্লীল’ করে ফেলা হয়েছে। সেই সুযোগে সমকামিতা হয়ে উঠেছে বিকল্পধারার চলচ্চিত্রের বিষয়।

চলচ্চিত্র সমাজের বাস্তব অবস্থা তুলে ধরতে সাহায্য করে। কিন্তু প্রথাগত সমাজকে পাশ কাটিয়ে চলচ্চিত্র সমকামিতা বিষয়টিকে খুব সহজে সাধারণ মানুষের সামনে আনতে পারে নি। প্রাচীন গ্রিসে থাকা সমকামিতা ইউরোপে মূলত যুক্তরাজ্যে সী মাস্ট কী সীয়িং থিংস (১৯৮৭),  সূঃন (১৯৯২) চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সামনে আসে।১৩ স্বাধীন ধারায় নির্মিত এ দু’টি চলচ্চিত্র আর্ট ফিল্মের নানা টেকনিকের মাধ্যমে কামনার ভিন্নতার ধরনকে সামনে নিয়ে আসে। কিন্তু মূলধারার চলচ্চিত্রে এ জাতীয় বিষয়গুলো মোটেও উঠে আসে নি। কারণ সমাজবিরোধী ও চিরাচরিত প্রথার বাইরে এসে চলচ্চিত্র নির্মাণ হলে তা ব্যবসায়ের জন্য হুমকির কারণ হয়ে উঠতে পারে। বিকল্প ধারার যেসব চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে তা পুরোপুরি মূল ধারার বিপরীতে গিয়ে নির্মিত।

ভারতে এর মধ্যে অন্যতম দীপা মেহতার ফায়ার (১৯৯৬)। এ ছবি মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে ভারতে রা রা ওঠে। অনেকে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তবে পরিস্থিতির এখন পরিবর্তিত হয়েছে। ভারতের মূলধারা ও বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রেও এখন সমকামিতা অল্পবিস্তর আসছে। তেমনি টালিগঞ্জের একটি সিনেমা পিনাকি চৌধুরীর আরোহন। চলচ্চিত্রটির মূল কাহিনী অন্য বিষয় নিয়ে হলেও এর একটি বড় অংশ জুড়ে আছে সমকামিতা। সন্তান-প্রত্যাশী কস্তুরি সঙ্গমে আগ্রহী হলেও তার স্বামী তাতে আগ্রহ দেখায় না। কারণ স্বামীর আগ্রহ থাকে পুরুষ শরীরের দিকে। এক রাতে ছাদে কস্তুরি সেটা দেখেও ফেলে। একপর্যায়ে আরেক পুরুষের সঙ্গে প্রথমে প্রেম ও পরে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে কসু্তরি। গর্ভবতী হয়, এই কথা জানাজানি হলে স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়। স্বামীর অনীহা থেকে কস্তুরির এ ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু প্রথাগত যে সমাজ তার কাছে কস্তুরির এ উপাখ্যান অশ্লীল, পাপাচার ও নিষিদ্ধ। এমনকি কস্তুরির স্বামীর এ ধরনের প্রবৃত্তি আরও অশ্লীল। কস্তুরির পর-পুরুষের সাথে এ ধরনের সম্পর্ক মূলধারার চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলেও সমকামি স্বামীর আচরণ মোটেও নয়।

অন্যদিকে সমকামিতার ওপর ২০১১ সালে নির্মিত হয় আরেকটি চলচ্চিত্র মেমোরিজ ইন মার্চ। চলচ্চিত্রটিতে কলকাতায় চাকরি করা সমকামি দু’জন পুরুষের একজন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। তাদের একজনের মা ছেলের সব কিছু নিতে দিল্লি থেকে কলকাতায় আসে। সেখানে এসে নতুনভাবে ছেলেকে আবিষ্কার করেন মা। পরিচয় হয় ছেলের সমকামী সঙ্গীটির সঙ্গে। সবকিছু জেনে তিনি প্রথমে বিষয়টি মেনে না নিলেও পরে সম্পর্কটি স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। শেষে মা ও ওই পুরুষ সঙ্গীটির সঙ্গে অসাধারণ এক সম্পর্ক হয়। লক্ষ্য করুন, চলচ্চিত্রের এই কাহিনী কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। দেশে দেশে যেকোনো সমাজে সমকামিতা এভাবে না হলেও বিষয়টির উপস্থিতি কিন্তু অহরহ। খেটে খাওয়া মানুষ থেকে সমাজের উচ্চ শ্রেণী কোথায় নেই এই সম্পর্কের কাঠামো। কিন্তু সাধারণের কাছে তা ‘অশ্লীল’, অনাকাঙ্খিত। আমরা সব জানি বুঝি কিন্তু তা চলচ্চিত্রে দেখানো যাবে না। শুরু হয় শ্লীলতা-অশ্লীলতার দ্বন্দ্ব; মূলধারা-বিকল্পধারার দ্বন্দ্ব। ফলে গোপন এই বিষয়গুলো সমাজে একপর্যায়ে নির্মিত হয় ‘অপরাধ’ হিসেবে।

পরকীয়া : ন্যায়, অন্যায়ের দোলাচল

পুরুষতন্ত্র ব্যক্তিগত মালিকানা টিকে রাখতে, সম্পত্তির সংরক্ষণ ও উত্তরাধিকারের স্বার্থে বিয়ে প্রথা চালু করেছে। মূলত বিয়ে হলো একধরনের চুক্তি, যৌনচুক্তি। সাধারণভাবে যা নারী-পুরুষের যৌনক্রিয়ার বৈধ অনুমতি দেয়। তবে সমাজভেদে এর ভিন্নতা আছে। এই উপমহাদেশে বলা হয়, পুরুষ বিয়ে করে আর নারী বিয়ে বসে বা তাকে বিয়ে দেয়া হয়। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই বিবাহ প্রথার মধ্যে দিয়ে নারী তার সব স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে যৌনদাসীতে পরিণত হয়। পুরুষতন্ত্রের ব্যাখ্যা মতে, নারীর শরীর নিয়মিত ভোগের উপাচার। এর ফলে নারীকে পুরুষ ব্যবহার করেছে যৌনশোষণের হাতিয়ার হিসেবে। সিমোন দ্য বোভোয়ারের ভাষায়, ‘তাকে পরাভূত করা হয়, সম্মত হতে বাধ্য করা হয়, জয় করা হয়। নারী থাকে পরাজয়ের ভঙ্গিতে; ... পুরুষটি তার উপর চাবুক হাতে এমন অবস্থান নেয় যেন সে কোনো পশুর উপর চড়ে বসে।’১৪

অবস্থা এমন হয়, পুরুষ যখন খুশি তখন তাকে নিপীড়ন করে। যখন নারী একটু স্বস্তি চায়, ভালোবাসা চায়, তখন দেখা যায় পুরুষ তাকে তার প্রত্যাশিত প্রাপ্যটুকু দিতেও অনিহা প্রকাশ করে। কিন্তু সময় পাল্টেছে এখন বিয়ে বলতে শুধু ভোগ বা যৌনক্রিয়াকে বোঝায় না। সেখানে থাকে ভালোবাসার ছোয়া। বিয়ের চুক্তির মাধ্যমে ভালোবাসার মিলন ঘটে। আর বিয়ের উদ্দেশ্য দাঁড়ায় নারী-পুরুষ উভয়ের যৌনতৃপ্তি, সন্তানপ্রাপ্তি, বন্ধুত্ব ও সহচার্যলাভ। কিন্তু নারী-পুরুষ যদি বিয়ে নামক এই কাঠামোর মধ্যে দিয়ে এগুলো পেতে ব্যর্থ হয়, তখন তারা হয় ঘরবিমুখ। তাদের মধ্যে দেখা দেয় বিয়ে বহির্ভূত নানা ধরনের সম্পর্ক। আর এ ধরনের নানা সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কটির নাম পরকীয়া।

এক্ষেত্রে একজন বিবাহিত পুরুষ বা নারী অন্য কোনো বিবাহিত বা অবিবাহিত নারী বা পুরুষের সাথে গোপন প্রণয়ে জড়িয়ে পড়ে। এ ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্য অনেকগুলো কারণের মধ্যে প্রধানত যে দু’টি দেখা যায়-

প্রথমত, যৌনজীবনে অশান্তি থেকে পরকীয়া। বিবাহের পর স্বামী বা স্ত্রী যদি শারীরিকভাবে একে অপরকে সন্তুষ্ট করতে না পারে, তখন শুধু জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্য স্বামী বা স্ত্রী অন্য পুরুষ বা নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় লিপ্ত হয়। এক্ষেত্রে জৈবিক চাহিদাকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। প্রেম ভালোবাসার অবকাশ কম থাকে। শারীরিক চাহিদাই মূখ্য হয়ে ওঠে।

দ্বিতীয়ত, পারিবারিক অশান্তি থেকে পরকীয়া। আগেই বলেছি, আগের দিনের মতো বিবাহ এখন কেবল জৈবিক চাহিদা নয়। এর বাইরেও একজন মানুষ হিসেবে তার কিছু চাওয়া পাওয়া থাকে, এটা অনেক টাকা দিয়েও পূরণ করা সম্ভব হয় না। একধরনের মানসিক সমর্থনের জন্য নারী বা পুরুষ অন্য কারো শরণাপন্ন হয়। এক্ষেত্রে শারীরিক চাহিদা মূখ্য হয় না। তবে একপর্যায়ে এটা শারীরিক সম্পর্কে রূপ নিতে পারে, আবার নাও নিতে পারে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো, যে কারণেই এই পরকীয়া সম্পর্ক তৈরি হোক তা আমাদের সমাজের কাছে ঘৃণিত। সমাজ কোনোভাবেই এই সম্পর্ককে মেনে নেয় না। কেন এ ধরনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, এ সমস্যার সমাধান কোথায়- একথা চিন্তা না করে সমাজের বেশিরভাগ মানুষ একে খারাপভাবে দেখতে শুরু করে। অনেক ক্ষেত্রে এ নিয়ে আলোচনাও অশ্লীলতার পর্যায়ে পড়ে। অথচ দাম্পত্যের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ এ সম্পর্কের খুবই নিয়মিত এ সমস্যার সমাধান নিয়ে খোলাখুলি কথা বলে না। যে যত পারে, কী পুরুষ কী নারী, রসিয়ে-রসিয়ে এ নিয়ে কথা বলেন অনেক।

দাম্পত্য দ্বন্দ্ব চলছে, চলবে। পরকীয়া এখন বিশেষ করে শহুরে জীবনের একটা সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রতিদিন এর ফলাফল হিসেবে নির্যাতন, জীবনের ক্ষয় দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে গণমাধ্যমের যেন একধরনের অনীহা। আর গণমাধ্যমের অন্যতম শাখা চলচ্চিত্রে যখন পরকীয়া বিষয় হিসেবে আসে, সেটাও হয় তখন বিকল্প ধারা। আর মূলধারায় যদি কখনো আসেও সেখানে বিষয়ের গুরুত্বের চেয়ে প্রাধান্য পায় যৌনতার রগরগে উপস্থাপনা।

এ বিষয়গুলো বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রে এখন অনেকটাই স্থান দখল করে নিয়েছে। এমনই একটি চলচ্চিত্রের নাম দ্বন্দ্ব। সুমন ঘোষ পরিচালিত এই সিনেমার গল্প ঠিক এরকম- দাম্পত্য জীবনের টানাপোড়নের একপর্যায়ে অসুস্থ হয় অনিক। স্ত্রী সুদীপ্তা তাকে শহরের নামকরা ক্লিনিকে ভর্তি করায়। ক্লিনিকে অনিকের অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না। সুদীপ্তা অনিককে নিয়ে ভয়াবহ রকমের সমস্যায় পড়ে। সুদীপ্তা ডাক্তারের কাছে বার বার জানতে চায় অনিক বাঁচবে কি না? কারো কাছ থেকে নিশ্চিত উত্তর না পেয়ে তিনি দেখা করেন প্রধান চিকিৎসক ডা. মুখার্জীর সঙ্গে, তার বাসায়। সুদীপ্তা সব কথা খুলে বলে ডা. মুখার্জীকে। সুদীপ্তা জানান, তিনি গর্ভবতী; কিন্তু এ সন্তানের বাবা অনিক নয়। বন্ধু রানার সাথে তার সম্পর্ক। যদি অনিক বেঁচে থাকে তাহলে তিনি সন্তানটা নষ্ট করবেন। আর যদি অনিক মারা যায় তবে সন্তান ভুমিষ্ঠ হবে।

বাস্তবে এ ধরনের সম্পর্ক এর চেয়ে জটিল পর্যায়ে যায়। এর বলি হতে হয় অনেক নারী ও পুরুষকে। কিন্তু তা চলচ্চিত্রে এলেই হয় বিকল্প ধারা। অনিকেত চট্টোপাধ্যায়ের সিনেমা বাই বাই ব্যাংকক। অনেকগুলো পরকীয়া সম্পর্ক নিয়ে চলচ্চিত্রটির কাহিনী। শহুরে এসব দম্পতি নর-নারীরা ছুটছে অর্থ, যশ, খ্যাতির পিছনে। ছুটতে গিয়ে কখন যে তারা দাম্পত্য জীবন থেকে ছিটকে পড়েছে- তা বুঝতেই পারে নি। তাই ধনশীল স্বামীর স্ত্রী সম্পর্ক গড়ে তোলে বাড়ির গাড়িচালকের সঙ্গে। বাড়ি বাড়ি ফেরি করা বিস্কুট বিক্রেতার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে চলচ্চিত্র পরিচালকের স্ত্রীর। আর ধনবান স্বামীর নারীনেত্রী স্ত্রী, চলচ্চিত্র পরিচালকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। তারা প্রত্যেকেই তাদের অপূর্ণতার পূর্ণতা খুঁজতে চায়। শহুরে জীবনের এই যে বিচ্ছিন্নতা তা কোনোভাবেই বাস্তবতা বহির্ভূত নয়। যত দিন যাচ্ছে এই অবস্থার অবনতি হচ্ছে।

আমরা একে খারাপ বলছি, কিন্তু কেন এ অবস্থা তা নিয়ে ভাবছি না। এ পরিস্থিতিতে এই বিষয়টিকে এখন আর খারাপ বলে, অশ্লীল বলে বিকল্প ধারার উপর চাপিয়ে দেওয়ার অবকাশ নাই। এটা নিয়ে এখন খোলামেলা কথা বলার সময় এসেছে। সেই কথাটা সবার আগে চলচ্চিত্র যেমন বলেছে, আরও বলবে; শুধু বিকল্প নয় মূলধারার কাছেও প্রত্যাশা এই।

বিকল্প তৃপ্তির নাম হস্তমৈথুন

হস্তমৈথুন মানব যৌনাচারের এক সহজ ও সাধারণ পদ্ধতি। হাজার বছর আগে থেকে মানুষ নিজেদের জৈবিক তৃপ্তি লাভের জন্য হস্তমৈথুন শুরু করেছিল। হস্তমৈথুন যৌন উত্তেজনার সেই স্তর যেখানে নারী-পুরুষ নিজে নিজে তার বীর্যপাত ঘটায়। হস্তমৈথুন মানব শরীরের উত্তেজনা প্রশমন করে শরীরকে স্বাভাবিক করে। এটা একটা প্রাকৃতিক ঘটনা। মানব মনের যৌন চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে হস্তমৈথুন একটি সঙ্গীবিহীন নিরাপদ যৌন ব্যবস্থা। অথচ যখন কেউ হস্তমৈথুন করে তখন এ বিষয়টিকে একান্ত গোপনীয় বিষয় হিসেবে মূল্যায়ন করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটিকে ‘অশ্লীল’ প্রপঞ্চ হিসেবে তুলে ধরা হয়।

দেখুন, হস্তমৈথুন মানব জীবনের একটি স্বাভাবিক বিষয় হলেও সমাজে এর প্রকাশ কিন্তু স্বাভাবিক নয়। বিষয়টি সমাজে একধরনের সোস্যাল ট্যাবুতে পরিণত হয়েছে। সমাজে বিয়ে ব্যবস্থা গড়ে ওঠার মূল কারণ হিসেবে যৌনতাকেই নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু হস্তমৈথুনকে আমরা স্বাভাবিক যৌনক্রিয়া হিসেবে মেনে নিতে পারি না। গোপনে হস্তমৈথুনের সাথে সম্পৃক্ত থাকার পরও আমরা প্রকাশ্য তা থেকে নিজেদের দূরে রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু কেন? কারণ আমরা সেটাই গ্রহণ করি আপাতদৃষ্টিতে যেটা সমাজ স্বীকৃত| যদিও বর্তমানে হস্তমৈথুন বিষয়টি সোস্যাল ট্যাবুর জায়গা থেকে কিছুটা হলেও বেরিয়ে এসেছে।

সমসাময়িক চলচ্চিত্রে হস্তমৈথুন বিষয়টি বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে। ধরুন, অর্পণা সেনের দ্য জাপানিজ ওয়াইফ এর কথা। সিনেমাটির কেন্দ্রীয় চরিত্র স্কুল-শিক্ষক স্নেহময়। ঘটনাক্রমে তার জানাশোনা হয় জাপানি নারী মিয়াগির সঙ্গে। একপর্যায়ে প্রেম। বিশাল দূরত্বে যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় চিঠি, কালে-ভদ্রে টেলিফোন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে দুই প্রান্তের দুইজন নিজেকে মানসিকভাবে ভাবতে থাকে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে। এই নর-নারীর দেখা হয় নি কোনোদিন। চিঠির এই সম্পর্কের জোরে স্নেহময় বিয়ে করা থেকে বিরত থাকে। ফলে তার জৈবিক তাড়নাকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন বিকল্প পথে। তাই একদিন দেখা যায়, ত্রিশোর্ধ স্নেহময় নদীতে বাঁধা নৌকায় উঠে সবার আড়ালে গিয়ে জৈবিক তাড়না মেটায় হস্তমৈথুন করে। এটি কিন্তু স্নেহময়ের অপরাধ নয়। কিন্তু স্নেহময় ভাবে এটি অনৈতিক। তাই তিনি যতটা পারেন নিজেকে আড়াল করে এ কাজে লিপ্ত হন। চলচ্চিত্রে অপর্ণার উপস্থাপনাটাও পরিষ্কার নয়। খুব ভালোভাবে না দেখলে দর্শক বুঝতেই পারবে না ওখানে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটছে কি না।

প্রশ্ন হলো কেন এ গোপনীয়তা? ঠিক সময়ে বিয়ে না করলে স্বাভাবিক জৈবিক চাহিদা থেকে যেকোনো নর-নারীর হস্তুমৈথুনের মতো বিকল্প যৌনসুখের প্রয়োজন পড়ে, এটাই স্বাভাবিক| এর জন্য এত রাখঢাক কেন? যেটা হতে পারে সেটা হলো উপস্থাপনের শৈল্পিকতা। যদিও দিপা মেহতার ফায়ার এ হস্তমৈথুনের দৃশ্যটি অনেকটাই পরিষ্কার ছিল।

এরপর কথা কৌশিক মুখার্জি পরিচালিত সিনেমা গান্ডু নিয়ে। সিনেমার গল্প এগিয়ে চলে গান্ডু নামের এক টিনএজারকে কেন্দ্র করে। প্রেমের আড়ালে দেহ-বিক্রির টাকায় চলে গান্ডু ও তার বোনের সংসার। পর-পুরুষের সঙ্গে বোনের এই অবাধ মেলামেশা প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করে গান্ডু। বাইরে সাইবার-ক্যাফেতে বসে সে দেখে কামুক এক নারীর ভিডিও-চ্যাটিং। আরও কিছু এ ধরনের ব্যাপার দেখে একপর্যায়ে গান্ডু হস্তমৈথুনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু সমস্যা হলো এখানে আবার যতখানি খোলামেলাভাবে হস্তমৈথুন উপস্থাপন করা হয়, তা অশ্লীলতার পর্যায়ে পড়ে। চলচ্চিত্র হলো বাস্তবে যা ঘটে তার একধরনের শৈল্পিক উপস্থাপন এবং একই সঙ্গে এটি মানুষের পারিবারিক বিনোদন মাধ্যমও। অথচ যেভাবে গান্ডুতে এই হস্তমৈথুন তুলে ধরা হয়েছে সেটা কোনোভাবেই পারিবারিক বিনোদনের উপযোগী নয়। তার মানে হলো, এক জায়গায় হস্তমৈথুন দেখানো হচ্ছে এমনভাবে যে দর্শক বুঝতে পারছে না; অন্য জায়গায় এমন খোলামেলা উপস্থাপন করা হচ্ছে যা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এর কোনোটিই তো হওয়ার কথা ছিল না।

আরেকটি সিনেমার বর্ণনা এ পর্যায়ে প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। সেটি দাদু পরিচালিত বাউল বয়। এই সিনেমাটিতে হস্তমৈথুনের দু’টি দৃশ্য আছে। আর্ট কলেজে পড়া একটি ছেলে প্রেম করে একটি মেয়ের সঙ্গে। মেয়েটির সঙ্গে সে ঘোরে, জৈবিক তাড়নাবোধ করে কিন্তু তার যৌনসুখের কোনো উপায় থাকে না। বাসায় ফিরে সে প্রেমিকার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতে হস্তমৈথুনে লিপ্ত হয়। হাল আমলে যা ফোন-সেক্স নামে টিনএজারদের কাছে পরিচিত। এই সিনেমায় হস্তমৈথুনের উপস্থাপন অনেকটা শৈল্পিক ও বাস্তব-সম্মত। সেখানে বাড়াবাড়ি যেমন নেই, নেই উগ্রতাও। অনেকখানি বাস্তবতার শৈল্পিক উপস্থাপন বলা যায়। গান্ডু আর বাউল বয় এর মধ্যে কোনটা শ্লীল আর কোনটা অশ্লীল- এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক| আসলে শ্লীল, অশ্লীল বিষয়ের মধ্যে থাকে না, থাকে উপস্থাপনের ধরনের উপর। আর সেটাই অনেক সময় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।

যৌনকর্মী, নারী বনাম পুরুষ

‘আমার মা নাকি চাইতেন আমি আর্টিস্ট হই। যখন খুব ছোট ছিলাম বাবা-মার নাকি অনেক স্বপ্ন ছিল আমায় ঘিরে। বাবার খুব শখ ছিল ছেলে পাইলট হবে। যখন আমার দশ বছর বয়স বাবা-মার ডিভোর্স হয়ে গেল। কয়েক বছরের মধ্যে দু’জনেই আবার বিয়ে করলেন। ফরচুনেটলি অর আনফরচুনেটলি..., আমি কী হব সেটা ভাবার জন্য আর কেউ রইল না।’

সংলাপগুলো অতনু ঘোষ পরিচালিত অংশুমানের ছবির নীল চরিত্রের। যিনি পেশায় একজন পুরুষ যৌনকর্মী। প্রথাগত সমাজে যৌনকর্মী শব্দটির সঙ্গে একধরনের নারী বিষয়টি জড়িয়ে আছে। আমাদের কাছে অর্থাৎ পুরুষের কাছে যৌনকর্মী মানেই নারী। আমাদের মাথার সেই ডিসকোর্স ভেঙে দিয়ে তৈরি হয়েছে পুরুষ যৌনকর্মী। আর বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রে পুরুষ যৌনকর্মী একটি গুরুত্বপূর্ণ আধেয়। কারণ পুরুষ প্রাধান্যশীল সমাজে পুরুষকে যৌনকর্মী হিসেবে মেনে নেয়া খুব কঠিন। ভোগের বস্তু হিসেবে নারী যখন যুগ যুগ ধরে তাদের দেহকে বিকিয়েছে পুরুষের কাছে; পুরুষ নারীকে পণ্য করে কিনেছে, প্রয়োজনে নারীর ক্ষমতায়নের নামে বিশ্বসুন্দরী বানিয়ে বিক্রি করেছে। সেই নারীর সমান্তরালে এখন দাঁড়িয়ে আছে সেই ‘মহা পুরুষ’। সে হয়েছে নারীর ভোগের বস্তু!

চলচ্চিত্রে পুরুষের এ রূপ এখন উপস্থাপিত হচ্ছে। অংশুমানের ছবিতে জনপ্রিয় নায়িকা মথুরা সেন ভাড়া করেন নীলকে। যৌনকর্মী নীল একসময় হয়ে যান মথুরার ভালোবাসার মানুষ। যদিও সেখানে দু’জনের মধ্যে ছিল না কোনো শারীরিক সম্পর্ক। নীল ঘটনাক্রমে খুন করে মথুরার স্বামীকে| ধরা পড়ে তিনি জেলে যান, সেখানেই এইডস্‌/এইচআইভি আক্রান্ত নীল মারা যান। অতনু ঘোষ অবশ্য অত্যন্ত সুচারুভাবে পুরুষ যৌনকর্মীর চরিত্রটি তুলে ধরেছেন। শ্লীলতা, অশ্লীলতা এখানে খুব একটা দ্বন্দ্বের কারণ হয়ে দাঁড়ায় নি। তবে তা রূপ নিয়েছে চলচ্চিত্রের বিকল্প ধারায়। কিন্তু কথা হলো কেন এটি বিকল্প ধারা হবে, চলচ্চিত্রে নারী যৌনকর্মীর উপস্থাপন যদি মূলধারা হয়, তাহলে পুরুষ যৌনকর্মী কেন বিকল্প ধারা হবে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের হয়ত ঘুরে-ফিরে আবার সেই পুরুষ প্রাধান্যশীলতাতেই যেতে হবে। তার মানে চলচ্চিত্রের ধারাতেও কাজ করেছে পুরুষ প্রাধান্যশীলতা।

ক্রিস এ্যালিন পরিচালিত অন্তিম শ্বাস সুন্দর এ আমরা দেখতে পাই পুরুষ যৌনকর্মী। ঘরের কর্তা বড় ব্যবসায়ী। ব্যবসায় এতটাই ব্যস্ত যে, স্ত্রীকে কোনো সময় দিতে পারেন না। ফলে স্ত্রী দিনের পর দিন জৈবিক সম্পর্ক থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। স্ত্রী যখন দেখে তার সব আছে কিন্তু যাকে সে ভালোবাসে, যাকে সে কাছে পেতে চায়- সেই লোকটি দিনের পর পর দিন তাকে দূরে রাখে; সেও স্বামীর কাছ থেকে দূরে সরে যায়। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায় যে, জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্য একজন পুরুষ যৌনকর্মীকে টিভি মেকানিকের নাম করে সে ঘরে নিয়ে আসে। কোনো নারীর দাম্পত্য জীবনের পরিস্থিতি এ অবস্থায় গেলে পুরুষ যৌনকর্মী আনা অস্বাভাবিক নয়। কারণ স্বামী কিন্তু মোটেও যৌনসুখবিহীন থাকছেন না। দিনের পর দিন ট্যুরে গিয়ে ব্যক্তিগত সহকারীকে তিনি ভোগ করেছেন।

বিষয়টা হলো ট্যুরে গিয়ে ব্যক্তিগত সহকারীকে স্বামীর ভোগ করার কাহিনী কিন্তু মূলধারার চলচ্চিত্রের অংশ। আর স্ত্রীর ঘরে পুরুষ যৌনকর্মী এনে জৈবিক চাহিদা মেটানো কিন্তু বিকল্পধারা। এখানেও দ্বন্দ্ব কিন্তু পরিস্থিতির। আর সেই পরিস্থিতি যুগ যুগ ধরে তৈরি করে রেখেছে পুরুষ। তাই পরাভূত করেছে বাস্তবতাকে।

লেখক : একরামুল ইসলাম অমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ  সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী। আর রুবেল পারভেজ একই বিভাগের তৃতীয় বর্ষে পড়াশুনা করছেন

ome.akram08@gmail.com

rubelmcj@gmail.com

 

তথ্যসূত্র

১. হক, ফাহমিদুল ও শাখাওয়াত মুন (২০০৬:৪১); ‘বাংলাদেশের এইসব চলচ্চিত্র :‘বিকল্প’ নাকি ‘স্বাধীন’; চলচ্চিত্রের সময়, সময়ের চলচ্চিত্র, ঐতিহ্য প্রকাশনী, ঢাকা।

২. প্রাগুক্ত, হক ও শাখাওয়াত (২০০৬:৪৪)।

৩. প্রাগুক্ত, হক ও শাখাওয়াত (২০০৬:৪০)।

৪. ঋতুপর্ণ ঘোষের এই সাক্ষাতকারটি সামহয়ারইন ব্লগ থেকে নেয়া। ইংরেজি ভাষার এই সাক্ষাতকারটি মুহাম্মদ নামে একজন ব্লগার বাংলায় অনুবাদ করেছেন। ২০০৫ সালের ৯ এপ্রিল ৩য় বার্ষিক South Asia Human Rights Film Festival উপলক্ষে এশিয়া সোসাইটি ঋতুপর্ণের চোখের বালি চলচ্চিত্রটির প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এ উপলক্ষে ঋতুপর্ণ নিউ ইয়র্ক গিয়েছিলেন। সেখানে Asia Source এর Nermeen Shaikh তার এই সাক্ষাতকারটি নেন।

৫. বসু, প্রদীপ (২০০২:১৮); ‘যৌনতা ও সংস্কৃতি’; যৌনতা  সংস্কৃতি; সম্পাদক- সুধীর চক্রবর্তী, পুস্তক বিপনি, কলকাতা।

৬. প্রাগুক্ত, বসু, প্রদীপ (২০০২:২২)।

৭. রায়চৌধুরী, নিশাত; ‘প্রেম অশ্লীলতা ও যৌনতা’; তেহাই, সম্পাদক- সপ্তর্ষি ভট্টাচার্য্য; বর্ষ-১, সংখ্যা-১, পৃ-২৩৮,।

৮. রায়চৌধুরী, যশোধরা; পর্নোগ্রাফির মেয়েরা; তেহাই, সম্পাদক- সপ্তর্ষি ভট্টাচার্য্য; বর্ষ-১, সংখ্যা-১, পৃ:২৫৫।

৯. ঘোষ, শাশ্বতী; ‘দর্পণে কার ছবি? পর্নোগ্রাফির পক্ষে দু’চার কথা’; তেহাই, সম্পাদক- সপ্তর্ষি ভট্টাচার্য্য; বর্ষ-১, সংখ্যা-১, পৃ:২৪৯।

১০. হোসেন, জব্বার; ‘সমকামিতা এবং অন্যান্য প্রশ্নে মিডিয়ার যৌন সাম্প্রদায়িকতা’; মিডিয়া ওয়াচ, সংখ্যা- ৪৫, ২৫ অক্টোবর, ঢাকা।

১১. মজিদ, ইমরান; ‘চলচ্চিত্র ও নিষিদ্ধ কামনা’; মাধ্যম; সম্পাদক- তুষার আব্দুল্লাহ, বর্ষ-২, সংখ্যা-১, পৃ-৫৩, ঢাকা।

১২. গুপ্ত, অভিজিৎ (২০০২:১৪৯); ‘সমকামিতা ও সংস্কৃতি : দেশ ও বিদেশ’; যৌনতা  সংস্কৃতি; সম্পাদক- সুধীর চক্রবর্তী, পুস্তক বিপনি, কলকাতা।

১৩. মজিদ, ইমরান; ‘চলচ্চিত্র ও নিষিদ্ধ কামনা’; মাধ্যম; সম্পাদক- তুষার আব্দুল্লাহ, বর্ষ-২, সংখ্যা-১, পৃ-৫৩, ঢাকা।

১৪. হক, মাহমুদ শামসুল (২০০৫:৩৪৯); ‘যৌনতা’; নারীকোষ, হাতেখড়ি, ঢাকা।

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন