Magic Lanthon

               

কাওসার বকুল

প্রকাশিত ১৩ জুন ২০২৩ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

দ্য রিভার : দৃকমাধ্যমে রেঁনোয়া’র প্রাচ্যনির্মাণ

কাওসার বকুল

প্রায় দুশো বছর ব্রিটিশদের শাসন-শোষণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো ভারতবর্ষের মানুষ। নানারকম দমনপীড়নের শিকার এই মানুষগুলোর ভিতরে দীর্ঘদিন ধরে জমেছিলো ক্ষোভ; সেই সঙ্গে উন্মুখ হয়ে ছিলো মুক্তির অপেক্ষায়। মুক্তিকামী এই মানুষদের এক কাতারে যিনি এনেছিলেন তার কথা হয়তো অনেকেরই জানা। নানা ত্যাগ ও কণ্টকাকীর্ণ পথ পেরিয়ে অবশেষে ভারতবর্ষের মানুষদের নিয়ে তিনি যে আন্দোলন গড়ে তোলেন, ৪৭-এ এসে ব্রিটিশরা সেই ধাক্কা সামলাতে না পেরে এদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। ব্রিটিশরা চলে গেলো, তবে বীজ বুনে গেলো আরেকটি কলঙ্কময় ইতিহাসের। রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় একদিকে বিভক্ত হলো ভারতবর্ষ, অন্যদিকে তারই জের ধরে ১৯৪৮-এ আততায়ীর গুলিতে নিহত হলেন ভারতীয়দের মুক্তির নায়ক গান্ধী।

গান্ধীর মৃত্যুর পর হাঙ্গেরির এক চলচ্চিত্রনির্মাতা ও প্রযোজক গ্যাব্রিয়েল প্যাস্‌কাল (Gabriel Pascal) তার জীবন নিয়ে চলচ্চিত্র-নির্মাণে আগ্রহী হন। এজন্য তিনি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে একটি চুক্তিও করেন। কিন্তু ১৯৫৪-তে হঠাৎ-ই প্যাস্‌কাল মারা গেলে গান্ধীকে নিয়ে চলচ্চিত্র-নির্মাণের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। পরবর্তী সময়ে ডেভিড লিয়েন ও স্যাম স্পিগেল গান্ধীকে নিয়ে চলচ্চিত্র-নির্মাণের কথা বললেও শেষ পর্যন্ত তারাও সেটি করতে পারেননি। অবশেষে ১৯৮২ সালে স্যার রিচার্ড অ্যাটেনবরো নির্মাণ করেন বহুকাঙ্ক্ষিত চলচ্চিত্র গান্ধী

ভারতবর্ষ যতোদিন থাকবে ততোদিন গুরুত্ব থাকবে গান্ধীকে নিয়ে প্রথম নির্মিত এই চলচ্চিত্রের; গান্ধীর সঙ্গে বেঁচে থাকবেন অ্যাটেনবরোও। একজন চলচ্চিত্রনির্মাতার একজীবনে এর চাইতে বড়ো পাওয়া আর কী হতে পারে! এটা একটা দিক; অন্যদিকে, যাদের জন্য এতো রক্তপাত, জীবনের এতো অবগাহন; যাদের উপনিবেশের বিষবাষ্প বয়ে বেড়াতে হচ্ছে আজ অবধি; যাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়ে সেই সাধারণ মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী আজকের গান্ধীজি—সেই ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের হাতেই নির্মাণ হলো গান্ধীর জীবনের ইতিহাস!

অন্যদিকে হীরালাল থেকে শুরু করে দাদাসাহেব ফালকে হয়ে আরো ৩০ বছর পেরিয়ে গেলেও ভারতীয় চলচ্চিত্র কেনো জানি মানুষের জীবনের কাছাকাছি পৌঁছতে পারছিলো না। এই যে প্রকৃতি, নদী, নদীর ঘাটে বাচ্চাদের লাফিয়ে পড়া, কলসি কাঁখে মেয়েদের বাড়ি ফেরা কিংবা নদীর তীরে গড়ে ওঠা সবুজে ঘেরা গাছপালা—এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কেনো জানি কারো চোখেই পড়লো না। এগুলো যে শিল্প হতে পারে কিংবা চলচ্চিত্রের আধেয়তে আসতে পারে, সেটির জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হলো ১৯৪৮ সাল অবধি, ফরাসি চলচ্চিত্রনির্মাতা জ্যঁ রেঁনোয়া আসা পর্যন্ত। ভারতবর্ষের এই অপরূপ সৌন্দর্যকে তিনিই প্রথম তুলে ধরেন দ্য রিভার-এ (১৯৫১)।

রেঁনোয়া’র আসাটা ভারতবর্ষের চলচ্চিত্রে কেবল নতুন মাত্রাই যোগ করেনি, শুরু করেছে এক নতুন অধ্যায়েরও। এই প্রভাবের ব্যাপকতা এতো যে, ভারতীয় চলচ্চিত্রকে যদি মোটাদাগে ভাগ করি তবে এর একভাগে পড়বে রেঁনোয়া আসার আগের চলচ্চিত্র আর অন্যভাগে পড়বে এর পরের চলচ্চিত্র। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের চারপাশের সৌন্দর্যকে বোঝার জন্য কেনো রেঁনোয়ার প্রয়োজন পড়ে? রেঁনোয়া আসার আগেও এই পুকুর, নদী, ঘাট সবই ছিলো, তখন কেনো আমরা এই সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারিনি? তাহলে রেঁনোয়া এসে কী এমন চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেন যেটা পুরো ভারতবর্ষের চলচ্চিত্রে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসলো!

এ কথা সত্য, ভারতের সমসাময়িক চলচ্চিত্রগুলোর সঙ্গে দ্য রিভার-এর একধরনের ভিন্নতা আছে। যে কারণেই নির্মাণের এতো বছর পরও চলচ্চিত্রটি নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন পড়ে। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এ রকম চিন্তা সত্যিই নতুন করে ভাবায়। আমার আলোচনার বিষয় রেঁনোয়া’র সেই দ্য রিভার

চলচ্চিত্রের রেঁনোয়া

দ্য রুলস অব দ্য গেম-এর (১৯৩৯) উদ্বোধনী প্রদর্শনীতে দর্শকের ক্ষোভের মুখে পড়েন রেঁনোয়া। চলচ্চিত্রের পর্দায় নিজেদের অন্তঃসারশূন্যতা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলো না ফরাসি অভিজাতরা। দর্শকের এ রকম প্রতিক্রিয়ায় ঝামেলা এড়াতে রেঁনোয়া একশো ১৩ মিনিটের চলচ্চিত্রকে কাটাছেঁড়া করে একশো মিনিটে কমিয়ে আনেন। তার পরও দর্শক চলচ্চিত্রটি ভালোভাবে গ্রহণ করছে না দেখে, দ্বিতীয়বারের মতো দৃশ্য ছাঁটাই করে ৯৪ মিনিট করা হয়। বিষয়টির সুরাহা এতেও হয়নি। অবশেষে প্রদর্শন করা হয় ৮১ মিনিটের খাপছাড়া দ্য রুলস অব দ্য গেম। এতকিছুর পরেও চলচ্চিত্রটি বিতর্ক এড়াতে পারেনি; ক্ষুব্ধ এক দর্শক প্রেক্ষাগৃহে আগুন ধরিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা করে। একপর্যায়ে সব প্রেক্ষাগৃহ থেকে নামিয়ে দেওয়া হয় দ্য রুলস অব দ্য গেম। উচ্চবিত্তের কথা বিবেচনায় রেখে ফরাসি সরকারও চলচ্চিত্রটি নিষিদ্ধ করে দেয়। ঘটনা এখানেই শেষ হয় না, ফ্রান্স ছেড়ে ইতালিতে পালিয়ে যেতে হয় রেঁনোয়া’কে।

দর্শকের এ রকম প্রতিক্রিয়ায় থেমে যাননি রেঁনোয়া; ইতালিতে পালিয়ে গিয়ে টসকা (Tosca) নামের এক চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্যের কাজ শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যে চলচ্চিত্র বিষয়ে পাঠদানের দায়িত্বও পেয়ে যান ‘সেন্ট্রো এক্সপেরিমেন্টালে দি সিনেমাটোগ্রাফিয়া’য় (Centro Sperimentale di Cinematografia)। এ সময় প্রথমবারের মতো হলিউডে গিয়ে সোয়াম্প ওয়াটার (Swamp Water, 1941) নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণেরও সুযোগ হয় রেঁনোয়া’র। ৪৫-এ এসে ডায়েরি অব অ্যা চেম্বারমেড নির্মাণের পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি রেঁনোয়া’কে। ততোদিনে অবশ্য ফ্রান্সে কিছু চলচ্চিত্রপ্রেমী ও সমালোচক দাঁড়িয়ে গেছে। তাদের লেখনীতে রেঁনোয়া’র ৩০ দশকের সঙ্কটগুলোও আস্তে আস্তে কেটে যেতে থাকে, ফলে এ সময়ে যশ, খ্যাতি, মর্যাদা সবই পেয়েছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্র-নির্মাণে তার সদিচ্ছার কোনো কমতি ছিলো—এ কথা বলবো না, তবে ৩০ দশকের চলচ্চিত্রের মতো এগুলো সমৃদ্ধ হয়ে ওঠেনি।

বিষয়বস্তু ও উপস্থাপন কৌশলের ভিত্তিতেও রেঁনোয়া’র চলচ্চিত্রকে মোটাদাগে দুটি ভাগে ফেলা যায়। এর একভাগে ২০ শতকের ৩০ দশকে নির্মিত চলচ্চিত্র, আর অন্যভাগে ৫০ ও ৬০ দশকের চলচ্চিত্র। তবে তার ৬০ দশকের চলচ্চিত্রে একধরনের অস্থিরতার আভাস পাওয়া যায়। মূলত ফ্রান্সের বাইরে হলিউড, ইতালি, ভারতসহ নানা দেশ ঘুরে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে তার চলচ্চিত্রে এ অস্থিরতা ঢুকে পড়ে। তিনি আসলে কোনো ছকে আটকে না থেকে নিজের বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও বিচক্ষণতায় নির্মাণ করেছিলেন এ সময়ের চলচ্চিত্রগুলো।

যুক্তির চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই আবেগকে প্রাধান্য দিতেন রেঁনোয়া। তার মানে এই নয়, তিনি যুক্তিহীন মানুষ ছিলেন। তিনি প্রাধান্য দিতেন মানুষের ভিতরের মানুষটাকে। যে কারণে

উনি শিল্পীদের চরিত্র এবং ঘটনাগুলিকে সবিস্তারে বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিতেন, তারপর অত্যন্ত গভীরভাবে নতুনদের নিয়ে মহলা করতেন। মহলা ছাড়াও সমস্ত সময় নতুন শিল্পীদের প্রতিটি হাব-ভাব তিনি গোপনে লক্ষ করে রাখতেন। সংলাপ বলার সঙ্গে ঐ হাব-ভাবগুলিকেও উনি-প্রয়োজন মতো ব্যবহার করতেন।

অভিনয়টাকে রেঁনোয়া জীবনের বাইরের কিছু মনে করতেন না। ব্যক্তিজীবনে একজন মানুষ যে রকম আচরণ করে, তিনি চাইতেন অভিনয়টাও যেনো স্বাভাবিক জীবনের মতোই হয়। বার বার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বলতেন, অভিনয়কে অভিনয় না ভেবে নিজের জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলতে হবে। এজন্য তিনি অভিনয়ের সময় ক্যামেরার সামনে স্বাভাবিক থাকারও উপদেশ দিতেন। তাছাড়া গুরুত্বপূর্ণ অনেক চরিত্রে অভিনয় করাতেন অপেশাদার অভিনেতা-অভিনেত্রী দিয়ে; এক্ষেত্রে অভিনয়ের সময় তাদেরকে কোনো রকম চাপ না দেওয়ার কথাও বলতেন সেটের অন্যদের।

নিজস্ব অভিনয় কৌশলে রেঁনোয়া বেশ কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রসহ নির্মাণ করেছেন ৪০টিরও বেশি চলচ্চিত্র। এর মধ্যে নানা (১৯২৬), দ্য বিচ (১৯৩১), তোনি (১৯৩৫), গ্রান্ড ইলিউশন (১৯৩৭), দ্য রুলস অব দ্য গেম (১৯৩৯), ডায়েরি অব অ্যা চেম্বারমেড (১৯৪৫), দ্য রিভার (১৯৫১), দ্য গোল্ডেন কোচ (১৯৫২), ফ্রেঞ্চ ক্যান ক্যান (১৯৫৪), পিকনিক অন দ্য গ্রাস (১৯৫৯) উল্লেখযোগ্য। তার এই শিল্পময় দীর্ঘজীবনে বিভিন্ন অবদানের স্বীকৃতি—সম্মানসূচক অস্কার ও ফ্রান্স থেকে পান ‘লিজন অব অনার’। ১৯৭৯ সালে বিখ্যাত এ নির্মাতা আমাদের ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে।

‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, তাদের মোরা ছাত্র’

দ্য রিভার-এর শুটিংয়ের সময় রেঁনোয়া যে নৌকায় ছিলেন তার পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে অন্য একটি নৌকা। নৌকার উপর উবু হয়ে বসে একজন কুলকুচি করে পিচকিরির মতো মুখের জল নদীতে ফেলছে। রেঁনোয়া মোহিত হয়ে সেদিকে তাকান। সাধারণ এই দৃশ্যে কী এমন থাকতে পারে, রেঁনোয়ার মতো চলচ্চিত্রনির্মাতা দেখে মুগ্ধ হন? রেঁনোয়ার ভাষায়, ‘যে দেশে মানুষ যুদ্ধ দেখেনি শুধু তাদের পক্ষেই সম্ভব এমন নিশ্চিন্তে উবু হয়ে বসে থাকা, তাছাড়া প্রকৃতি ও জীবন এখানে এমন শিথিল ছন্দে আবদ্ধ যে, ওভাবে বসাটাই লোকটির পক্ষে অবশ্যম্ভাবী।’

সাধারণ এই বিষয় তিনি ভাবনায় আনলেন ঠিক আছে, কিন্তু এখানকার মানুষদের তিনি কোন্‌ দৃষ্টিতে দেখলেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আগের যুগে মালিকরা দাসদের পেশীবহুল সুঠাম দেহের ছবি এঁকে তাদের ভালো থাকার বয়ান দিতো। কিন্তু দাস তো দাসই থেকে যেতো। ঔপনিবেশিক ভারতে এসে রেঁনোয়া নৌকায় উবু হয়ে বসাটাকে তুলনা করলেন যুদ্ধ না-দেখা মানুষের সঙ্গে। আবার সুখ-শান্তিরও খোঁজ করলেন উবু হয়ে বসার মধ্যে। অথচ ভারতবর্ষের হাজার বছরের ইতিহাস কিন্তু তার উল্টো কথা বলে। নিরীহ দেখালেও সবসময় সংগ্রামের মধ্যেই ছিলো এই মানুষেরা। বিজাতীয়দের দ্বারা শোষিত হতে হতে সবশেষ ব্রিটিশদের শোষণে একেবারে কাঁকড়ার খোসা হয়ে গেছে এই জনপদের মানুষ। ‘নিরীহ’ এই মানুষগুলোর সংগ্রামে হয়তো বোমা-বন্দুক ছিলো না; কিন্তু হাজারো মানুষের রক্ত ছিলো। রেঁনোয়া কি সেটা জানতেন না, নাকি ইচ্ছে করেই এমনটা করলেন! তিনি কিন্তু উবু হয়ে বসাটা দেখালেও ব্রিটিশ উপনিবেশের কথা একবারও আনলেন না। কারণ ভারতীয়দের সুখের কথা তো ব্রিটিশ উপনিবেশকেই জায়েজ করে!

রেঁনোয়া’র দৃষ্টিভঙ্গি আর ভারতবর্ষ তথা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়। উনি এখানে এসেছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ করে আবার চলেও গেছেন। যে অল্প সময় তিনি ভারতবর্ষে কাটিয়েছেন, তার অধিকাংশ সময়ই ব্যয় করেছেন দ্য রিভার-এর কাজে। এজন্য হয়তো ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারেননি এখানকার সমাজ, প্রকৃতি ও মানুষকে। জানতে পারেননি (নাকি জানতে চাননি?) খালি গায়ে বসে কুলকুচি করা মানুষটার ওই দশা কার শোষণে! কিন্তু তার পরও বলতে আপত্তি নেই, রেঁনোয়া’র আসাটা ভারতবর্ষের চলচ্চিত্রের মোড় ইতিবাচক দিকেই ঘুরিয়ে দিয়েছিলো। কারণ এই উপমহাদেশে চলচ্চিত্র মানেই ছিলো প্রেম, নায়কের শৌর্যবীর্য, খলনায়কের চিৎকার, মারপিট এবং সবশেষে মিলন; সঙ্গে গোটাকয়েক গান। এখানকার চলচ্চিত্রের সঙ্গে মূলত জনপ্রিয় লোকমাধ্যম যাত্রাপালার বড়ো ধরনের সম্পৃক্ততা ছিলো; অন্যভাবে বললে যাত্রার যান্ত্রিক পুনরুৎপাদনই ভারতীয় চলচ্চিত্র। সুতরাং এই যে প্রকৃতি, লাঙল দিয়ে চাষ করে কিংবা বাড়ির উঠানে কৃষানির ধানের কাজ—এগুলোও যে শিল্প হয়ে উঠতে পারে, উপমহাদেশের নির্মাতারা সেটা কখনো ভাবেনওনি। তাদের মধ্যে এই বোধটা ঢুকিয়ে দিলেন রেঁনোয়া।

দ্য রিভার-এ তিনিই প্রথম দেখালেন নদী, নদীর ঘাটে মেয়েদের স্নান কিংবা নৌকায় বসে মুখ ধোয়ার সেই দৃশ্যের সৌন্দর্যটাকে। সেই অনুপ্রেরণা থেকেই পরবর্তী সময়ে সত্যজিৎ এবং সত্যজিৎ হয়ে আরো অনেকেই প্রাকৃতিক এই সৌন্দর্য বোঝার চেষ্টা করেছেন। যার প্রমাণ পাওয়া যায় বিখ্যাত প্রামাণ্যচিত্রনির্মাতা হরিসাধন দাশগুপ্তের সহজ-সরল স্বীকারোক্তিতে, ‘রেঁনোয়ার আসাটা আমাদের, পার্সোনালি আমার, সত্যজিৎ রায়ের এবং সারা ভারতবর্ষের ফিল্মের জগতে একটা পরিবর্তন আনলো। সেটাতে আমি বা আমরা ইন্সপায়ার্ড হই। ... সত্যজিৎ রায়ও খুব ইনফ্লুয়েন্স হয়েছিলেন।’ যদিও সত্যজিতের ক্ষেত্রে ডি সিকা’র বাইসাইকেল থিভস্‌-এর প্রভাবের কথাটা বেশি শোনা যায়, তার পরও রেঁনোয়ার প্রভাব যে তার ওপর একেবারেই পড়েনি-এ কথা অস্বীকার করার জো নেই। রেঁনোয়া এখানে এসেছেন, নিজের ভাবনা-চিন্তাকে উন্মুক্ত করে দেখিয়েছেন, সেরকম চিন্তা করবার বীজ বপন করেছেন এখানকার চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ নক্ষত্রদের মাঝে।

দেহ গেলে কী যায় বলো, মন গেলে তো সবই যায়

বিখ্যাত মার্কিন চলচ্চিত্রনির্মাতা মার্টিন ক্রুসেস-এর পছন্দের তালিকায় পৃথিবীর সেরা দুটি রঙিন চলচ্চিত্রের একটি দ্য রিভার। চলচ্চিত্রটি মার্টিন-এর কেবল পছন্দের তালিকায় সীমাবদ্ধই ছিলো না,এর প্রেমে পড়ে পুনরায় প্রিন্ট তৈরিতে আর্থিক সহায়তাও দিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে দ্য রিভার-এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে ভারতে এসে দ্য দার্জিলিং লিমিটেড (২০০৭) নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন আরেক মার্কিন নির্মাতা ওয়েস অ্যান্ডারসন। এর বাইরেও দ্য রিভার নির্মাণ করে বোদ্ধামহল থেকে বন্ধুমহল সব জায়গায় রেঁনোয়া পেয়েছিলেন সম্মান-খ্যাতি; পাশাপাশি ১৯৫২ সালের বক্স অফিসেও হিট ছিলো দ্য রিভার।এখন দেখে নিই বিখ্যাত এতো মানুষের পছন্দের তালিকায় থাকা চলচ্চিত্রটিতে রেঁনোয়া ঠিক কী দেখিয়েছেন—

ভারতে বাস করা উচ্চ-মধ্যবিত্ত এক ব্রিটিশ পরিবারকে ঘিরে গড়ে উঠেছে দ্য রিভার-এর কাহিনি। পরিবারটিতে সবার বড়ো মেয়ে হ্যারিয়েট। তাদের ছয় বোনের আদরের একমাত্র ভাই বগি। প্রতিবেশী গরিব কানুর সঙ্গে খেলাধুলায় বগি সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে। কচ্ছপ,পাখির বাসা খোঁজার পাশাপাশি গোখরা সাপ ধরার জন্য মাঝে মাঝেই দুই বন্ধু নলের বাঁশি আর দুধ নিয়ে জঙ্গলে ছুটে যায়।

হ্যারিয়েটের বাবা গঙ্গার তীরে একটি পাটকল চালান। ভারতে বসবাস করলেও তাদের বাড়িতে বিশুদ্ধ পাশ্চাত্য পরিবেশ;তবু প্রাচ্য,পাশ্চাত্য মিলিয়েই বড়ো হতে থাকে তারা। বাড়িতে সবসময় চঞ্চল বুদ্ধিমতী হ্যারিয়েট,তার বান্ধবী ভ্যালেরি’র আচরণে কিছুটা নাটকীয়তা চোখে পড়ে;অন্যদিকে পাশের বাড়ির মেলানি অনেকটা ধীরস্থির। হ্যারিয়েটদের দেখভালের জন্য রাখা ন্যান-এর সঙ্গে সবাই মিলে নানারকম চঞ্চলতায় সময় বয়ে যায়;অন্যদিকে মেলানির বাড়িতে বেড়াতে আসে যুদ্ধে এক পা হারানো ক্যাপ্টেন জন।

ক্রাচ ব্যবহার না করায় জনকে দেখে অবশ্য বোঝা যায় না, তার পা নেই। প্রথম দেখাতেই জনের প্রেমে পড়ে যায় হ্যারিয়েট। জনকে একপর্যায়ে বাড়িতে আমন্ত্রণও জানায় দেওয়ালি উৎসবে। ক্রমশ দুর্বল হতে থাকা হ্যারিয়েট একদিন গোপনে জনকে অনুসরণ করে; কলাবাগানের মাঝের এক ডোবার ধারে গিয়ে দেখে ভ্যালেরি’কে চুমু খাচ্ছে জন। এদিকে সাপের দংশনে মারা পড়ে বগি। একদিকে ভাইয়ের মৃত্যু, অন্যদিকে ভালোবাসার মানুষকে হারানো—আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয় হ্যারিয়েট। কিন্তু নদীতে ডুবে তার আর মরা হয় না; কানুর সহায়তায় হ্যারিয়েট বেঁচে যায়। অবশেষে জানা যায়, হ্যারিয়েট কিংবা ভ্যালেরি নয়, জন ভালোবাসে মেলানিকে। বয়ঃসন্ধিতে আসা তিন নারীর গল্পের ফাঁকে ভারতের অধিবাসীদের দর্শন,ধর্মীয় মূল্যবোধ,সংস্কৃতি সর্বোপরি নদীর চিত্রায়ণ করেছেন রেঁনোয়া।  

দ্য রিভার-এর আগ পর্যন্ত নাচে-গানে ভরপুর ভারতের চলচ্চিত্রে রাজা-জমিদার কিংবা দেবদেবীর সরব উপস্থিতি থাকলেও আড়ালে-আবডালে ছিলো এখানকার প্রকৃতির স্বাভাবিক অপরূপ সৌন্দর্য। চলচ্চিত্রে যে দু-একজন নিম্নবর্ণের মানুষ উঠে আসতো সেটাও কোনো না কোনোভাবে উচ্চবর্গ-দেবদেবীর বদৌলতে। নিত্যদিনের কাজকর্ম চলচ্চিত্রে উঠে আসাটা ছিলো কল্পনার বাইরে। সেই তুলনায় দ্য রিভার নির্মাণ করে রেঁনোয়া প্রশংসা কুড়াবেন এটাই স্বাভাবিক। নদী, নদীতে চলা নৌকা, পাটকলে নৌকা থেকে পাট নামানো কিংবা বাজারে জনসাধারণের নিত্যদিনের কেনা-বেচা, সাপ খেলা সর্বপ্রথম চলচ্চিত্রে দেখালেন তিনিই। তাছাড়া এখানকার মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস, পূজা-পার্বণ কিংবা উৎসবগুলোর চিত্রও ফুটে উঠেছে চলচ্চিত্রটিতে। সর্বোপরি ভারতের প্রকৃতি, এখানকার মানুষের সংস্কৃতিকে দৃকমাধ্যমে তুলে ধরার সূচনা করায় রেঁনোয়া সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।

কিন্তু অবাক লাগে, রেঁনোয়া চলচ্চিত্র-নির্মাণের আশায় সুদূর ফ্রান্স থেকে ভারতবর্ষে আসলেন; অথচ যে চলচ্চিত্র  নির্মাণ করলেন তার কেন্দ্রে রাখলেন এখানকার এক ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ পরিবারকে। দ্য রিভার-এ এখানকার নদী, জল, প্রকৃতি সবই ঠিক থাকলো, ‘শুধু’ কেন্দ্রের মানুষগুলো ভিন্ন। বলতে পারেন, উনি তো ভারতে থাকা ব্রিটিশদের চিত্রায়ণ করছেন, ব্রিটিশদের কথা বলতে গেলে এখানকার লোকজনও তো উঠে আসবে; উঠে এসেছেও। কিন্তু সেই উঠে আসাটা কেমন?

রেঁনোয়া’র উপস্থাপনে প্রাচ্য

সৈয়দ মুজতবা আলী একবার আফ্রিকা যাবেন বলে ঠিক করলেন। গৃহপরিচারিকাকে সঙ্গে নিতে চাইলে কেনো জানি তিনি যেতে রাজি হচ্ছিলেন না। অনেক জোরাজুরির পরেও তিনি বলছিলেন না, ঠিক কেনো যাবেন না। একপর্যায়ে মুজতবার কাছে আসল কারণ জানালেন গৃহপরিচারিকা। তার ধারণা—শারীরিকভাবে যেহেতু তিনি একটু মোটা, আফ্রিকার লোকজন তাকে খেয়ে ফেলতে পারে, তাই তিনি কোনোভাবেই আফ্রিকা যাবেন না। দীর্ঘদিন ধরে পাশ্চাত্য-প্রাচ্যে আফ্রিকা নিয়ে যে চর্চা তারই ফসল গৃহপরিচারিকার এ ভয়। পাশ্চাত্য আফ্রিকা নিয়ে যে ধরনের চর্চা করেছে, তাতে করে আসলে যে কারোরই পক্ষে এর বাইরে গিয়ে ভাববার অবকাশ কম।

একইভাবে প্রাচ্য নিয়েও ব্রিটিশরা দীর্ঘ সময় ধরে চর্চা করেছে এবং তা ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী। সেই ধারণার মূলে আছে ব্রিটিশদের শ্রেষ্ঠত্ব এবং প্রাচ্যের নিকৃষ্টতার বোধ। এই বোধই আসলে ব্রিটিশদের উপনিবেশকে বৈধতা দিয়েছে। প্রাচ্য যেহেতু বাইরের গবেষকদের কাছে দূর ও অজানা; তাই তারা যখনই প্রাচ্যকে চিন্তা করেছে অমনি বাস্তব প্রাচ্যকে তারা নির্মিত ‘প্রাচ্য’ রূপেই দেখেছে। এমনকি বাস্তবের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে কল্পনার প্রাচ্যকে।

কার্ল মার্কসের মতো বিচক্ষণ ব্যক্তিও প্রাচ্যবাদের প্যাঁচে পড়েছিলেন। একসময় তারও ধারণা ছিলো, প্রাচ্যসমাজের ঐতিহাসিক বিবর্তন হাজার বছর ধরে একই জায়গায় থেমে আছে এবং এই গতিহীনতার বীজ তার গ্রাম-সমাজের বিশিষ্ট গড়নের মধ্যেই নিহিত। প্রাচ্য নিয়ে মার্কসের বক্তব্য ছিলো—‘সমাজের অভ্যন্তরে এমন কোনও শক্তি নেই সেখানে যা এই অনড়তা কাটিয়ে দেশকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারে ঐতিহাসিক বিবর্তনের রাজপথে। একমাত্র বহিরাগত কোনও শক্তির ধ্বংসাত্মক আক্রমণেই কাটতে পারে সেই স্থাণুত্ব।’ সুতরাং মার্কসের চিন্তাতেও ব্রিটিশ শাসন ভারতবর্ষে বিপ্লবই নিয়ে এসেছিলো। বিশ্ববাসীর কাছ থেকে ব্রিটিশরা ‘অসভ্য’, ‘বর্বর’ ভারতবর্ষ শাসনের বৈধতা আদায় করেছিলো এই চর্চা দিয়েই। যেমনটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা করেছিলো লাল পতাকার জুজুর ভয় দেখিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে; আরো পরে ৯/১১-এ টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনায় জঙ্গি ডিসকোর্স নিয়ে। যার খেসারত গত দেড় দশক ধরে সারা পৃথিবীর মুসলিমকে দিতে হচ্ছে।

যাই হোক, ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন শেষ হওয়ার চার বছর পরে এসে রেঁনোয়া কেনো জানি প্রাচ্যবাদের সেই ধারাতেই কথা বললেন। চলচ্চিত্র শুরুর পাঁচ মিনিট ৫২ সেকেন্ডে কয়েকজন নারীর কাজে যাওয়ার দৃশ্যে, আড়ালে থেকে গল্প বলা হ্যারিয়েটের কণ্ঠে প্রথম শোনা যায় কার্ল মার্কসের ভাষায় বাংলার সেই ‘অনড়তা’র কথা, ‘জীবন ধারণের জন্য নদীর তীরের গ্রামগুলোর মানুষজনদের গায়ে খাটতে হয়; হাজার বছরের ঐতিহ্যে সেটা অপরিবর্তনীয়।’

ব্রিটিশ যে পরিবারকে ঘিরে দ্য রিভার, সে পরিবারের ছয় বোনের আদরের একমাত্র ভাই বগি। আট-দশ বছরের বগিকে সবসময় হাফপ্যান্ট পরে হাফহাতা শার্ট ইন করে জুতা পায়ে দেখা যায়। ফুটফুটে চেহারার এই ছেলের ইতিবাচক উপস্থাপনই চোখে পড়ে। তার খেলার সাথী কানু। খালি গায়ে ধুতি পরে সেটা নেংটি মেরে, খালি পায়েই বগির সঙ্গে দেখা যায় কানুকে। বাজারে সাপ খেলা দেখা থেকে জঙ্গলে সাপ ধরতে যাওয়া—সবই তারা করে একসঙ্গে।

ব্রিটিশ পরিবারের ফুটফুটে বগির বন্ধু কৃষ্ণকায় দরিদ্র কানু। এই কানু এতটাই কৃষ্ণকায়, ভারতবর্ষে যার মতো আরেকটি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এটা হয়তো ঠিক, ভারতবর্ষে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর লোকের উপনিবেশ থাকায় গায়ের রঙ, শারীরিক গড়নে একধরনের প্রভাব পড়েছে। কিন্তু এটাও তো সত্য, আমরা গড়পড়তা অতোটা কালো নই, যতোটা কালো কানু। হয়তো বলতে পারেন, কানু কালো হয়েছে তাতে ক্ষতি কীসের? ক্ষতি ছিলো না, কানু যদি এখানে ভারতের প্রতিনিধিত্ব না করতো। কিন্তু এখানে কানু তো আর শুধু নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না; পুরো ভারতবর্ষের প্রতিনিধিত্ব করছে এই বালক। যেমনভাবে ব্রিটিশদের প্রতিনিধিত্ব করছে বগি। অথচ রেঁনোয়া কেনো জানি এই রকম কানুকেই খুঁজে আনলেন! কাহিনি এখানে শেষ হলেই ভালো হতো; কানুকে দিয়ে নির্মাতা আর যা যা করালেন সেটা দেখে রেঁনোয়াকে আরো ভালো বোঝা যায়।

 

বগিকে বার বার বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায় কানু। এমনকি সাপ ধরার জন্য যে দুধের প্রয়োজন সেটার জোগাড়ও কানুই করে। প্রথমবার জঙ্গলে সাপ দেখতে যায় দু’বন্ধু। কিন্তু সাপের যখন দেখা মিলে, অমনি বগিকে একা রেখে দূরে সরে যায় কানু। একপর্যায়ে সে বগিকে রেখে দেয়ালের ওপাশে পার হয়ে যায়। সাধারণ চোখে অবশ্য মনে হতেই পারে, বিপদে পড়লে তো এমন হয়। কিন্তু একটু অন্যভাবে চিন্তা করলে বিষয়টা দাঁড়ায়, ভারতীয় কানু ব্রিটিশ বগিকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বিপদের মুখে ফেলে সরে যাচ্ছে। আর পরের বার সাপ ধরতে গিয়ে মারা পড়ে বগি। প্রথম থেকেই কানুকে ন্যাংটা করে দর্শকের সামনে হাজির করে আস্তে আস্তে স্বার্থপর হিসেবে উপস্থাপন করে, অবশেষে খুনি চিহ্নিত করলেন রেঁনোয়া। এই হলো রেঁনোয়ার ভারতবর্ষ উপস্থাপন!

সাপ ধরতে যাওয়ার এই পুরো বিষয়টিকে অন্যভাবেও চিন্তা করা যায়। সাপটিকে যদি একটি বিপদ হিসেবে কল্পনা করি; তাহলে সাপের কাছে যাওয়া মানে বিপদের কাছে যাওয়া। কারণ সাপের হাতে জীবন চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু সব জেনেও সেখানে যাওয়াটা নিঃসন্দেহে সাহসিকতার পরিচয় বহন করে। ডিসকভারি চ্যানেলে এখন হরহামেশাই দেখানো হচ্ছে, ভারতবর্ষে কারো বাড়িতে সাপ আছে, সাপটিকে ধরার জন্য নিয়ে আসা হচ্ছে সেই ব্রিটিশদেরই কাউকে। তারা এসে খালি হাতে সাপটিকে ধরে ফেলছে (সাপের কামড়টাও কোনো ব্যাপার না তাদের কাছে)। সাপটিকে ভয় হিসেবে না দেখে দাঁড় করাচ্ছে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। সর্বোপরি তাদের সাহসিকতা এবং মানুষের কল্যাণে তাদের অবদানকে তুলে ধরছে। চলচ্চিত্রেও বগিকে সেরকম সাহসী বলেই মনে হয়। অন্যদিকে সাপ দেখে পালিয়ে যায় কানু। এছাড়া, দৃশ্যটিতে এক নারীকে সাপের পূজা করতেও দেখা যায়। তাহলে বিষয়টি দাঁড়ায়, ভয় পাওয়াটা আমাদের কাজ, বাঁচার জন্য উপায় না দেখে আমরা সাপের পূজা করি; আর তাদের কাজ হলো ভয়টা জয় করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। এই বিবেচনায়ও তো রেঁনোয়া উচ্চস্থান বরাদ্দ রেখেছেন ব্রিটিশদের জন্যই!

ব্রিটিশ ‘মহান’, বাকি সব ইন্ডিয়ান

হ্যারিয়েটের বাবা পাটকল থেকে বাড়ি ফিরবেন। তার আগে বাজারের এক দোকানে গেছেন বাচ্চাদের জন্য ঘুড়ি কিনতে। কয়েক রকমের ঘুড়ি দেখে অবশেষে একটা পছন্দ হয় তার। একই রকম কয়েকটি ঘুড়ি দিতে বলে দাম জিজ্ঞেস করেন দোকানির কাছে। দোকানির উত্তর, ‘চার আনা।’ পকেট থেকে টাকা বের করে না দেখেই দোকানির হাতে তুলে দেন তিনি। টাকা হাতে পেয়েই দোকানি বিনয়ের সঙ্গে যেভাবে দুহাত কপাল অবধি উঁচিয়ে নমস্কার জানান; তা দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না প্রাচ্যের এই মানুষগুলোর কাছে ‘দেবতুল্য’ ইংরেজের স্থান।

পরের শটে তা আরো নতুন মাত্রা পায়; ঘুড়ি হাতে এবার হ্যারিয়েটের বাবাকে দেখা যায় বাঁশের সাঁকোর উপর। এ সময় কয়েকজন নারী, শিশু কাজে যাচ্ছিলো। ইংরেজের চোখ আটকে যায় ছোটো একটি কন্যাশিশুর দিকে। নাম ধরে ডাকতে দেখে বোঝা যায়, শিশুটি তার চেনা। কাছে এলে একটি ঘুড়ি তার হাতে দেন তিনি, সেটি হাতে নিয়েই চলে যায় শিশুটি। অবশ্য চলচ্চিত্র শুরুর পাঁচ মিনিট দুই সেকেন্ডের মাথায় বাবা সম্পর্কে হ্যারিয়েটের যে বর্ণনা তাতেও এমন তথ্যই পাওয়া যায়—‘মানুষ হিসেবে তিনি একজন বন্ধুর মতো; মানুষজনদের তিনি খুব ভালোবাসতেন, লোকেরাও তাকে খুব পছন্দ করতো।’ প্রথম শটে দোকানদারকে দামের অতিরিক্ত দেওয়া; পরের শটে শিশুটিকে ঘুড়ি দেওয়া—দুটো ঘটনাতেই মানুষ হিসেবে ইংরেজ ও ভারতীয়দের স্থান রেঁনোয়া পরিষ্কার করেন।  

ঘটনা আরো একটু এগিয়ে নিই। ঘুড়ি তিনি কার হাতে তুলে দিলেন? এই শিশু তো বিধবা। বাল্যবিবাহ, বাল্যবিধবা ও বিধবাবিবাহ না হওয়া—নিঃসন্দেহে এই উপমহাদেশের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। রামমোহন, বিদ্যাসাগররা দীর্ঘ সময় ধরে সমাজ সংস্কারের মধ্য দিয়ে এই সমস্যাগুলো সমাধানের ব্যবস্থা করেন, যদিও ব্রিটিশদের সহযোগিতা ছাড়া এর সমাধান হয়তো অতোটা সহজ হতো না। ব্রিটিশদের সহায়তায় ১৮২৯ সালে আইনিভাবে বন্ধ হয় সতীদাহ প্রথা এবং বিধবা-বিবাহ চালু হয় ১৮৫৬ সালে। অথচ প্রায় একশো বছর পর ১৯৫১ সালে ঠিক সেই ভারতবর্ষেই রেঁনোয়া দেখালেন বাল্যবিবাহ, বাল্যবিধবা; যদিও ততোদিনে ব্রিটিশরা চলে গেছে এবং ভারতবর্ষও অনেকটাই আগের অবস্থা থেকে সরে এসেছে। পুরুষশাসিত সমাজে নারীর যে অবস্থান ছিলো দেড়-দুশো বছর আগে, সেখানেও এসেছে অনেকটাই পরিবর্তন। পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে ততোদিনে জনজীবনের সর্বত্রই নারীরা লক্ষণীয়ভাবে বিচরণ শুরু করে অবদানও রেখেছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে। তবু রেঁনোয়া কেনো জানি ভারতীয় নারীর সেই পুরনো ছকের বাইরে বের হতে পারলেন না। এখানেই শেষ নয়, চলচ্চিত্রজুড়েই ভারতবর্ষের নেতিবাচক উপস্থাপন, একটু খেয়াল করলেই সেটা চোখে পড়ে। মি. জন যখন নদীর তীরে বসে ভাবনায় মগ্ন ছিলেন, ঠিক সেই সময়েও তার পাশ দিয়ে ঘটিতে জল নিয়ে এক বিধবাকে যেতে দেখা যায়। এই বিধবাও শিশু।