Magic Lanthon

               

কিবরিয়া জুয়েল

প্রকাশিত ০৯ জানুয়ারী ২০২৩ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

ফারেনহাইট ফোর ফাইভ ওয়ান

মন্ট্যাগ থেকে স্নোডেন, আত্মার মুক্তির কথা বলে

কিবরিয়া জুয়েল


মতাদর্শ মানেই চোখের ঠুলি, উল্টা-ইমেজ, ক্যামেরা-অবস্কিউরা। মতাদর্শ মানেই সত্য-মিথ্যা নির্ণয়ের মাতব্বরি। কোড অব কন্ডাক্ট। মতাদর্শ মানেই শাস্ত্র। শাস্ত্র চিরকাল শাসন-সাধনের উপায়-যন্ত্র-হাতিয়ার। মানুষের ওপর মানুষের শাসন আমার কাছে অগ্রহণযোগ্য। তা সে যে শাস্ত্র-মতাদর্শ-থিওক্রেসির দোহাই দিয়েই চালানো হোক না কেন।

পৃথিবীতে ধর্মই সর্বপ্রথম মতাদর্শ তথা শাস্ত্র নিয়ে হাজির হয়েছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীতে যে মতাদর্শ নিয়ে রাষ্ট্র ধারণার জন্ম হয়, তা ধর্মকে ছাড়িয়েও আরো সুদৃঢ় অবস্থানের জানান দেয়। ফলে চালকের আসনে চলে আসে রাষ্ট্র; আর মানুষের ওপর মানুষেরই শাসন আরো জোরালো হয়। কিন্তু জনগণের কল্যাণের ধোঁয়া তুলে রাষ্ট্রের ধারণা আসার আগে মানুষ সংহতির ভিত্তিতে নিজেরাই নিজেদেরকে পরিচালনা করেছে। শুরু থেকেই রাষ্ট্র নামের এই নতুন রাজনৈতিক ক্ষমতা ক্রমাগত নিজের অবস্থান সুসংহত করেছে। তাই আমরা আজ রাষ্ট্রব্যবস্থার বিকল্প চিন্তাও করতে পারি না। সবার ওপর নজরদারির প্রশ্নে রাষ্ট্র ব্যক্তির চেয়ে গোষ্ঠীর তথা সমগ্রতার গুরুত্ব বাড়িয়ে তুললেও কিছু ব্যক্তি, গোষ্ঠী তথা শ্রেণি তার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অর্থাৎ রাষ্ট্রই সর্বপ্রথম অদ্ভুতভাবে একই সঙ্গে সমগ্রতা ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনার জন্ম দেয়। আর এরই ফলে সৃষ্টি হলো শ্রেণি বিভাজনের।

রাষ্ট্র তথা শাসকশ্রেণি নিজেদের কর্তৃত্ব জাহিরের পাশাপাশি মানুষের মনোজগতের ওপরেও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, শাসকশ্রেণির ধারণাসমূহে দীক্ষিত করে। আর একই সঙ্গে ভিন্ন মত নিয়ে থাকে চিন্তিত, তার দর্শন তথা মতাদর্শ সঙ্কটে পড়তে পারে এই আশঙ্কায়। রাষ্ট্র কখনোই চায় নাভিন্ন কোনো মতাদর্শের সঙ্গে মানুষ পরিচিত হোক। তাই কল্যাণকামী এই রাষ্ট্র সবসময় গণমানুষের মুক্তির বুলি আওড়ায়; কিন্তু অত্যন্ত সুকৌশলে করে তার উল্টোটা।

ফারেনহাইট ফোর ফাইভ ওয়ান-এ ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো এমনই এক ভবিষ্যৎ কল্যাণকামীআধুনিক রাষ্ট্রকে দেখিয়েছেন, যেখানে শাসকশ্রেণি সাধারণকে ডুবিয়ে রাখে ভোগ-বিলাসের মধ্যে। ওই রাষ্ট্র সাধারণকে বোঝাতে সক্ষম হয়, বই-পুস্তক মানুষকে অসুখি করে, গড়ে তোলে সমাজ বিরোধী হিসেবে। আর তাই সেখানে কেউ বই-পত্রের ধারেকাছেও ঘেঁষে না। বিপরীতে রাষ্ট্রিক ব্যবস্থায় সাধারণের বিনোদনের জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকেন ভার্চুয়াল কাজিন (টেলিভিশন স্ক্রিনে বিনোদনমূলক বিভিন্ন অনুষ্ঠান নিয়ে হাজির হওয়া উপস্থাপিকা, নিজেকে যিনি দর্শকের কাজিন হিসেবে পরিচয় দেন)। কিন্তু তার পরও কিছু মানুষের মগজ ধোলাই করতে অর্থাৎ আধুনিক করতে ব্যর্থ হয় রাষ্ট্র। এই মানুষগুলো তখন রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে হয়ে ওঠে অ্যান্টি-সোশ্যাল। ত্রুফো সেই ১৯৬৬ সালে, এমনই এক ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের স্বরূপ উন্মোচন করলেন সেলুলয়েডে। 

 

সমালোচক থেকে চলচ্চিত্রকার

দেশে দেশে তখন ফরাসি উপনিবেশ; আলজেরিয়ায় যখন এর বিরুদ্ধে চলছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম; ফরাসি বুদ্ধিজীবীরাও তখন নিজ দেশের এই ঔপনিবেশিক নীতির বিরুদ্ধে বেশ সোচ্চার। রাজনীতি, সংস্কৃতি, চলচ্চিত্রের ওপরে তখন চলছে রাষ্ট্রের খবরদারি। আর একই ছকে চলছে চলচ্চিত্র বানানোর প্রবণতা। এমন সময় ফ্রান্সের প্যারিসে বসে অঁদ্রে বাযাঁ সম্পাদিত কাইয়্যে দ্যু সিনেমা পত্রিকার কিছু তরুণ লেখক চেষ্টা করছিলো সেখান থেকে বেরিয়ে আসার, চলতি ন্যারেটিভটাকে ভাঙার। সেই দলে ক্লদ শ্যাব্রল, ডাক রিভেত্তে, জ্যঁ লুক গদারদের সঙ্গে ছিলেন ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো। চলচ্চিত্র নিয়ে লেখার পাশাপাশি তারাই এবার ক্যামেরা হাতে নেমে পড়লেন মাঠে। এই ধারা ফরাসি নবতরঙ্গ নামে পরিচিত। প্রকৃতপক্ষে ফরাসি নুভেল ভাগ বা নবতরঙ্গের জন্ম স্টুডিও চত্বরে নয়। কাইয়্যের সম্পাদকীয় দপ্তরে। প্রতিষ্ঠানবিরোধী এই লেখক-সমালোচকরা এবার নিজেরাই প্রতিষ্ঠানবিরোধী চলচ্চিত্র নির্মাণে মনোযোগ দিলেন।

চলচ্চিত্রকারদের কাছে যখন বাণিজ্যিক সফলতাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিলো নিউওয়েভ ধারার নির্মাতারা তখন নিজস্ব নন্দন-রুচি-অভিজ্ঞতা দিয়ে স্বাধীনভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণেই ছিলেন বেশি আগ্রহী। ফিল্ম নির্মাণের কৃৎকৌশলের দিক থেকে এঁরা অনেক সময়ে আলফ্রেড হিচকককে (১৮৯৯১৯৮০) অনুসরণ করতেন। লক্ষ্য ছিলো অল্প খরচে ছবি করা। সিনেমা শিল্পে মন্দা চলায় অনেক প্রযোজক কম খরচের ছবির জন্য টাকা যোগান দিতে সহজেই রাজি হতেন। ...বিরাট বাণিজ্যিক সাফল্য এঁরা আশা করতেন না, কিন্তু রুচির হাওয়া বদলে যাওয়ায় দর্শক পাওয়া যেতো। তৎকালীন সাম্রাজ্যবাদী ফ্রান্সের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই নিউওয়েভ আন্দোলন তার প্রথম পর্যায় অতিক্রম করে। এ সময় অর্থাৎ ১৯৫৮৬২র দিকে এসব চলচ্চিত্রে রাজনীতিকে ভিন্নভাবে নিয়ে আসা হলো, দেখা গেলো প্রতিষ্ঠানকে নানাভাবে বিব্রত করার প্রবণতা। অর্থাৎ প্রথম পর্যায়ের বিষয় সরাসরি রাজনৈতিক না-হলেও এতে অ্যান্টি-বুর্জোয়া মনোভাব সক্রিয় ছিলো, ক্লদ শ্র্যাব্রলের চলচ্চিত্র তার প্রমাণ।

৬০ দশকে স্বৈরশাসক চার্লস দ্য গল-এর শাসনামলের শেষ দিকে ফ্রান্সে রাজনৈতিক অস্থিরতা চরম আকার ধারণ করে। এর প্রভাব পড়ে চলচ্চিত্রেও, তাই ১৯৬৬৬৮র দিকে যেসব চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় সেগুলোতে ছিলো রাজনীতির ব্যাপক উপস্থিতি। অর্থাৎ দ্বিতীয় পর্বে ন্যুভেল ভাগ আন্দোলনে সরাসরি রাজনৈতিক আন্দোলনের তীক্ষè বিতর্কিত বিষয় এসে গেছে এবং এনেছেন গোদার (গদার)। যাবতীয় সামাজিক রাজনৈতিক অনাচার, ভ্রষ্টতা, নীতিহীনতাকে আঘাত করা গোদারের সৃজন-নীতির অঙ্গ। শুধু গদার নয়, নিউওয়েভের চলচ্চিত্রকারদের সবাই এ সময় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগেন। যেমন গদারের মাসকুলিন ফেমিনিন, মেড ইন ইউএসএ; ক্লদ শ্যাব্রলের লাইন অব ডিমাকেইশন কিংবা ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর ফারেনহাইট ফোর ফাইভ ওয়ান। মজার ব্যাপার হলো রাজনৈতিক এই সবগুলো চলচ্চিত্রই কিন্তু মুক্তি পায় একসঙ্গে অর্থাৎ ১৯৬৬ সালে।

এবার আসি ত্রুফোর চলচ্চিত্রে অর্থাৎ ফারেনহাইট ফোর ফাইভ ওয়ান-এ; নবতরঙ্গধারার একমাত্র এই ছবিটি ত্রুফো স্টুডিওতে শুট্ করেন। নবতরঙ্গের আরো একটি বৈশিষ্ট্য ভেঙে ফারেনহাইট-এ অভিনয় করেন দুজন পেশাদার অভিনেতাঅস্ট্রেলিয় অস্কার ওয়ার্নার ও ব্রিটিশ জুলি ক্রিস্টি। অবশ্য ত্রুফো এমনটা করতে চাননি। কিন্তু ব্রাডবুরির উপন্যাস অবলম্বনে এই চলচ্চিত্রের জন্য ফ্রান্সে প্রযোজক পাচ্ছিলেন না তিনি। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই যুক্তরাজ্যের স্টুডিওতে তাকে শুটিং করতে হয়, কারণ সেখানে থেকেই ত্রুফো আসলে চলচ্চিত্রটিতে ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চলকে দেখাতে চেয়েছিলেন। তবে অভিনেতা হিসেবে অস্কার ওয়ার্নার ত্রুফোর প্রথম পছন্দ ছিলেন না। ত্রুফো মোটেও জার্মান উচ্চারণভঙ্গির অভিনয় চাননি, কিন্তু ওয়ার্নার নাৎসিদের ভঙ্গিতে অভিনয় করেন। এছাড়া চলচ্চিত্রটি ত্রুফোর মাতৃভাষায় না হওয়ায় এর সংলাপের ওপর তার পুরো নিয়ন্ত্রণ ছিলো না; কিন্তু তার পরও সবকিছু ছাপিয়ে চলচ্চিত্রটি এতো বছর পরেও এক মহাবার্তা নিয়ে হাজির হয় আমাদের সামনে। সেই বার্তাগুলো ধরার চেষ্টা থাকবে এই লেখায়।

 

কেরোসিনের গন্ধও যেখানে সুগন্ধি

সবাই ছুটছে। মন্ট্যাগ পরিবারও এর বাইরে নয়। তাই মন্ট্যাগ নিষ্ঠার সঙ্গে বই পোড়ান অর্থাৎ ফায়ারম্যানের কাজ করেন; উদ্দেশ্য দ্রুত কর্মকর্তা পর্যায়ে পদোন্নতি। অন্যদিকে মন্ট্যাগের স্ত্রী লিন্ডা সারাদিন রূপচর্চা আর সোপ অপেরা নিয়ে ব্যস্ত; তার স্টার হওয়া চাই-ই চাই! এজন্য সন্তান ধারণেও তার আপত্তি, পাছে শরীর নষ্ট হয়; ওজন কমাতে দিনের পর দিন চলে উপোস, আর রাষ্ট্রের সরবরাহ করা রকমারি পিল তো আছেই। সুসজ্জিত বড়ো বাড়ি, ঘরে ঘরে ওয়াল-সেট টেলিভিশন, মোট কথায় প্রাচুর্য না থাকলেও কোনো কিছুর অভাব নেই। কিন্তু এতো কিছুর পরও কিসের একটা অভাব যেনো মন্ট্যাগকে সবসময় তাড়া করে ফেরে। এমন সময় শিক্ষিকা ক্লেরিসের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। ফায়ারম্যানের পোশাক দেখে নিজ থেকেই তার সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করেন ক্লেরিসে। মন্ট্যাগের সঙ্গে কথা বলে তার ভিতরের মানুষটিকে ধীরে ধীরে জাগাতে চান ক্লেরিসে। একপর্যায়ে তার চেষ্টায় পদোন্নতির পিছনে ছোটা মন্ট্যাগের জীবনের মোড় ঘুরে যায়, যেনো সম্বিত ফিরে পান তিনি। একসময়ের বই-বিদ্বেষী মন্ট্যাগ হয়ে ওঠেন বইপড়ুয়া। বই পোড়ানোর বদলে তা রক্ষায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। এখন তিনি বইপড়ুয়াদের গ্রেপ্তার বা হয়রানির বদলে পালানোর সুযোগ করে দেন। একপর্যায়ে ফায়ারম্যান মন্ট্যাগ রাষ্ট্রের মতাদর্শেই আগুন দেন। কিন্তু রাষ্ট্র সেটা মেনে নেয় না, কারণ রাষ্ট্রের কঠোর রাষ্ট্রীয়শাস্ত্র দরকার। আর তাই অনিবার্যভাবেই নেমে আসে চিরাচরিত দমন-পীড়ন। কিন্তু রাষ্ট্র মন্ট্যাগদের থামাতে ব্যর্থ হয়, সব বাধা উপেক্ষা করে মন্ট্যাগরা চলে যান ভিন্ন এক দেশে। 

গুটিকয়েক ক্লেরিসে-মন্ট্যাগরা আধুনিক রাষ্ট্রে ঠাঁই না পেলেও লিন্ডাদের কিন্তু সেখানে কোনো সমস্যা হয় না। লিন্ডারা শাস্ত্রের বাইরে যেতে পারেন না বলেই একান্ত আপনজনের বিরুদ্ধেও ফায়ার-স্টেশনে অভিযোগ দেন। প্রকৃতপক্ষে, রাষ্ট্রই লিন্ডাদেরকে শাস্ত্রের বাইরে যেতে দেয় না। বিষয়টা মার্কসের ভাষায়, মানুষের ধ্যান-ধারণা, উপলব্ধি ও চৈতন্য প্রথমত এবং সরাসরি তাদের বস্তুগত তৎপরতা ও লেনাদেনার সাথে মিথজৈবিক সম্পর্কে আবদ্ধএটাই হলো বাস্তব জীবনের ভাষা। ...মানব-চৈতন্য সক্রিয় যাপিত জীবনের অতিরিক্ত কিছু নয়। আর এজন্যই মন্ট্যাগের কাছেও একসময় বই পোড়ানো কেরোসিনের গন্ধ সুগন্ধি হয়ে ধরা দিতো। গ্রামসি একেই বলছেন আধিপত্য অর্থাৎ সাধারণ মানুষের সঙ্গে কোনোরকম সংঘাতে না গিয়ে সম্মতি আদায়, আর এক্ষেত্রে তাদের হাতিয়ার একদল ধারণা-নির্মাতা তথা সিভিল সোসাইটি। চলচ্চিত্রে ত্রুফো এই ভূমিকায় দেখালেন, দেওয়ালে সাঁটানো বিশাল ওয়াল-সেট টেলিভিশন তথা মিডিয়াকে।

কিন্তু তার পরও ক্লেরিসেদের মতো অনেকেই রাষ্ট্রের ওই আধিপত্যর বিরুদ্ধে লড়াই করে। তাদের স্টার হওয়ার, রূপবতী হওয়ার বাসনা থাকে না। এমনকি যে ভার্চুয়াল কাজিন লিন্ডাদের সবসময়ের সঙ্গী, সেই কাজিনও ক্লেরিসেদের কাছে পাত্তা পায় না মোটেও। তাই সবার বাড়ির ছাদে টেলিভিশনের অ্যান্টেনা জায়গা করে নিলেও  থাকে না কেবল ক্লেরিসেদের ছাদে। প্রচলিত কাঠামোকে একেবারে উল্টোভাবে দেখার এই প্রবণতা কিন্তু যুগে যুগে ছিলো। মহামতি লেনিন আর জার দ্বিতীয় নিকোলাসের কথাই ধরুন। বিপ্লবের আগে একই চলচ্চিত্র দেখে নিকোলাস শিল্প হিসেবে মানতেই নারাজ ছিলেন চলচ্চিত্রকে। কারণ তিনি যে সমাজব্যবস্থার অংশ তার সঙ্গে ওই চলচ্চিত্রের পুরোপুরি সঙ্গতি ছিলো। অন্যদিকে লেনিনের দৃষ্টিতে পুঁজিবাদী চলচ্চিত্র মনবিক্ষেপক অর্থাৎ যা সামাজিক সমস্যা, অসঙ্গতি, শ্রেণি-শোষণ প্রভৃতি থেকে দর্শকের দৃষ্টিকে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেয়। তাই লেনিন চলচ্চিত্রকে নিছক বিনোদন বা সময় কাটানোর উপায় হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন না; তার দৃষ্টিতে চলচ্চিত্র সাধারণ মানুষের মুক্তির হাতিয়ার। একইভাবে লিন্ডার কাছে টেলিভিশন ছিলো তার জীবনেরই অংশ, অন্যদিকে ক্লেরিসের দৃষ্টিতে টেলিভিশন রাষ্ট্রীয় শাস্ত্রে বুঁদ করে রাখার এক মহাঅস্ত্র। একই মানুষ, কেবল পরিস্থিতির বোঝাপড়ায় বৈপরীত্য। ত্রুফো হয়তো এজন্যই ক্লেরিসে ও লিন্ডা চরিত্রে অভিনয় করিয়েছিলেন একই মানুষ জুলি ক্রিস্টিকে।

 

ফ্যাসিজম থেকে বলশেভিজম পৃথক করা দায়

ফারেনহাইট ফোর ফাইভ ওয়ান-এ ত্রুফো এমন এক ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রকে দেখিয়েছেন, যার সঙ্গে সেই ২০ দশকের ইতালি কিংবা বিপ্লবত্তোর সোভিয়েত ইউনিয়নকে পৃথক করা দায়। কী, খটকা লাগলো! লাগারই কথা। ফ্যাসিস্ট ইতালির সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের তুলনা! খটকা আমারও যে লাগেনি তা নয়। কিন্তু স্বয়ং রবী ঠাকুর ফ্যাসিজম ও বলশেভিজম দুটোকেই যখন অস্বাস্থ্যের লক্ষণ হিসেবে দেখছেন তখন বিষয়টা মোটেও এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয় বৈকি। সংগ্রামের জন্য ঐক্য’—এই ধোঁয়া তুলে ইতালিতে সাম্যবাদী আন্দোলনকে দমন করার জন্য ক্যাথলিক চার্চের মদদে ফ্যাসিস্ট সরকার যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালায়; কমিউনিস্ট পার্টি, শ্রমিক, নির্বাচিত প্রতিনিধি অর্থাৎ ভিন্নমতকে যেভাবে দমন করে; তা-ই মুসোলিনির পতনের জন্য যথেষ্ট ছিলো।

একই কথা বিপ্লবত্তোর সোভিয়েতের বেলায়ও বলছেন ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির অবহেলিত নেতা গ্রামসি। তার মতে, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বিশ্ববীক্ষায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক শাসন প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বের রূপ নেয়, যা মূলত দমনমূলক কর্তৃত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত।১০ আর এমনটাই ঘটেছিলো সোভিয়েতে। এর ফলাফলও সবার জানা। গ্রামসি অবশ্য এর সমাধানও দিয়ে গেছেন। তিনি এমন এক পার্টির ধারণা দেন, যা কিনা প্রকৃত অর্থে হবে শ্রমিক শ্রেণির পার্টি; যে পার্টির সঙ্গে নিম্নবর্গের থাকবে ঘনিষ্ঠ ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। আর তাহলেই হয়তো এই পার্টি নিম্নবর্গের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক এবং ফ্যাসিস্ট সরকারের বিকল্প ও গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যবস্থা হয়ে উঠবে।

ত্রুফোর কল্পিত ওই আধুনিক রাষ্ট্রে বই পোড়ানো হয় বেশ উৎসবের আমেজে। রাষ্ট্রের পোষ্য ফায়ারম্যানরা ভেঁপু বাজিয়ে বিপুল আগ্রহের সঙ্গে কাজটি করেন দ্রুত উপরে ওঠার আশায়। আর বই পোড়ানোর আনুষ্ঠানিকতাই একে বৈধতা দান করে। মুক্তবুদ্ধির চর্চা ওই রাষ্ট্রে নিষিদ্ধ; আর তা নিষিদ্ধ জনগণের কল্যাণের জন্যই! আধুনিক রাষ্ট্র মুখে মুক্তচিন্তার কথা বললেও কর্মে তা সমর্থন করে না। ফলে আবারো রবীন্দ্রনাথেই ফিরে যেতে হয়, মানুষের স্বাধীন বুদ্ধিকে মেরে তার উপকার করা যায় এ-সব কথা সুস্থচিত্ত লোকে মনে ভাবতেই পারে না। ...মানুষের পক্ষে মানুষ যে কি ভয়ংকর তা দেখলে শরীর শিউরে ওঠে - মারের প্রতিযোগিতায় কে কাকে ছাড়িয়ে যাবে সেই চেষ্টায় আজ সমস্ত পৃথিবী কোমর বেঁধেছে - মানুষের হাত থেকে বাঁচবার জন্যই মানুষ কেবলই ভয়ংকর হয়ে উঠছে - এর আর শেষ নেই...।১১ রাষ্ট্র এখানেই সাধারণের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে। হাঁটা-চলা থেকে শুরু করে সবকিছুতেই তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ফারেনহাইট-এ তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জোর করে সাধারণ মানুষের চুল কেটে দেয়, সেখানেও আবার আনুষ্ঠানিকতা! আর ভার্চুয়াল কাজিন এর বৈধতা দিয়ে ওই দৃশ্য টেলিভিশনে সম্প্রচার করে কৌতুকের ছলে।

রাষ্ট্র সেন্সরশিপের মাধ্যমে মুক্তচিন্তায় যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলো তারই প্রেক্ষাপটে রে ব্রাডবুরি ১৯৫৩ সালে ফারেনহাইট ফোর ফাইভ ওয়ান উপন্যাসটি লিখেন। ৪৫১ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় বই-পুস্তক তথা কাগজ আগুনে পুড়ে যায়। প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকেই দেশে দেশে কর্তৃত্বপরায়ণ সরকার ভিন্নমতকে বিভিন্নভাবে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করে। মধ্যপ্রাচ্যের গোঁড়া রক্ষণশীল দেশগুলোয় যখন ধর্মের দোহাই দিয়ে চলছিলো রাজপরিবারের শাসন-শোষণ (এখনো অনেক দেশে চলছে); সেখানে আধুনিক ইউরোপেও ফ্যাসিজম বা বলশেভিজম সাধারণ মানুষকে নতুন কিছু দিতে পারেনি। সামান্য খেয়াল করলেই বোঝা যাবে : ফ্যাসিবাদ এবং বলশেভিক-রাষ্ট্রপন্থা উভয়ই আদতে চূড়ান্ত কর্তৃত্বপরায়ণ তথা সর্বাত্মক-স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্রপ্রণালী। উভয়েরই গোড়ার জোরটা গায়ের জোর, বলপ্রয়োগ, সঙ্গে সমাজতন্ত্রের বুলি (হিটলারও নিজেকে সমাজতন্ত্রী বলতেন)। এদের উভয়েরই মূল শত্রু জনসাধারণের স্বাধীনবুদ্ধি।১২  

 

বিশাল ওয়াল স্ক্রিনই যখন পরিবার

ত্রুফো যে আধুনিক রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করেছেন সেই ১৯৬৬ সালে, তার সঙ্গে আজকের একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক রাষ্ট্রকে তেমন পৃথক করা যায় না। তিনি সেই সময়ই দেয়ালে সাঁটানো যে বিশাল টিভি স্ক্রিন, ফ্যামিলি থিয়েটার কিংবা সরাসরি টিভি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ কল্পনা করেছেন তার অনেকটাই আজ মিলে যায়। টেলিভিশনের পারিবারিক অনুষ্ঠান অবিরাম দেখতে দেখতে পরিবারকেই আজকের লিন্ডারা ভুলতে বসেছেন। পারিবারিক বন্ধন দিনকে দিন যেনো শিথিল-খেলো হয়ে যাচ্ছে। সন্তান ধারণে অনীহা, স্মৃতি ভ্রষ্টতা কিংবা মন্ট্যাগদের প্রতি লিন্ডাদের উদাসীনতাআমাদেরকে সেই বার্তাই দেয়। হাল আমলের সোপ অপেরার সঙ্গে ফারেনহাইট-এর ফ্যামিলি থিয়েটারকে তাই আমরা আলাদা করতে পারি না। ত্রুফো দেখান, সেই সময়ই ফ্যামিলি থিয়েটার কীভাবে পরিবার-এর সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে; বাজারের সঙ্গে কীভাবে সবাই রীতিমতো পাল্লা দিয়ে চলছে। সর্বোপরি টেলিভিশন সবার ওপর বিস্তার করেছে আধিপত্যর জাল। লিন্ডাদের সার্বিক জীবনাচরণ ও চিন্তা কিংবা ওই সমাজের নারী-পুরুষের ঘোর দেখে অন্তত সেরকমই মনে হয়।

কিন্তু সুখের আশায়-নেশায় দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা ওই মানুষেরা আদৌ সেই সুখের সন্ধান কি পেয়েছে? তাহলে মন্ট্যাগরা এতো কিছুর পরও কেনো সেই সুখের জন্যই কাতরাতে থাকে। মন্ট্যাগদের মতো অনেক পরিবারেই নতুন সদস্য হিসেবে কাজিন এসেছে। আর ওই ভার্চুয়াল কাজিনই একপর্যায়ে ব্যক্তি-মানুষ, পারিবারিক-মানুষ কিংবা সামাজিক-মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এই বিচ্ছিন্নতা এতোটাই ভয়াবহ যে, শেষ পর্যন্ত ফায়ারম্যান মন্ট্যাগও এই ছকে বাঁধা জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে তৎপর হয়েছেন, এই জীবন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমনকি স্ত্রী লিন্ডা যখন টেলিভিশনকে পরিবার হিসেবে বেছে নিয়েছে, মন্ট্যাগ তখন নিষিদ্ধ বই-পত্রের মধ্যেই খুঁজে ফিরেছেন তার নতুন পরিবার, তার অস্তিত্ব, তার অতীতকে।  

 

প্রতিষ্ঠানই যখন প্রতিষ্ঠান ভাঙে

ফায়ারম্যানদের ড্রাগনাকৃতি প্রতীক সম্বলিত পোশাক অনেকটাই নাৎসি বাহিনীর সঙ্গে মিলে যায়; আর অস্কার ওয়ার্নারের নাৎসি ভঙ্গিতে অভিনয় চলচ্চিত্রে নতুন মাত্রা যোগ করে। কিন্তু এই ফায়ারম্যানরা কীভাবে ফায়ারম্যান হয়ে ওঠেন তা দেখাতেও ভোলেননি ত্রুফো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেখানে শিক্ষানবিশ ফায়ারম্যানদের প্রতিনিয়ত হুমকি-ধামকি দিয়ে প্রশিক্ষিত করা হয়। আগামী দিনের ফায়ারম্যানদেরকে যে প্রক্রিয়ায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় কিংবা তাদেরকে যে পরিবেশে রাখা হয়, তাতে স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে অনুশাসন কাজ করে। একপর্যায়ে শিক্ষানবিশরা হয়ে ওঠেন এক একজন মন্ট্যাগ, ফ্যাবিয়ান কিংবা ক্যাপ্টেন। কিন্তু তাদের পুরনো ক্ষোভ-ক্ষত যে একেবারেই শুকিয়ে যায়, তা নয়। এদেরই অনেকে আবার অনুশাসনের বেড়া ভেঙে জ্বলে ওঠে, বিদ্রোহ করে। দু হাজার বছর আগেও সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করায় জুলিয়াস সিজারের বিরুদ্ধে একটি অংশ বিদ্রোহ করেছিলো। যুগে যুগে পৃথিবীর সব কর্তৃত্ববাদী বাহিনীর বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ হয়েছে, হচ্ছে।

কিন্তু এই বিদ্রোহগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার কোনো অবকাশ নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন কারণে, বিভিন্ন মাত্রায় যে সামরিক বিদ্রোহগুলো হয়েছে সেগুলোকে কতিপয় সামরিক সদস্যের রাষ্ট্রীয় শাস্ত্রের বিরুদ্ধাচরণ হিসেবে দেখলে বোধহয় ভুল করবো আমরা। কারণ বিদ্রোহের সঙ্গে কোনো সিস্টেমের মৌলিক পরিবর্তনের বিষয়টি খুবই ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। মন্ট্যাগের বিদ্রোহের কথাই ধরুন, তিনি যে সিস্টেম ভাঙার অভিপ্রায় নিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গেছেন তা সফল হলে পুরো রাষ্ট্র কাঠামোই হুমকির মুখে পড়বে। হয়তো তার স্থলে নতুন কোনো সিস্টেম, নতুন কোনো শাস্ত্র আসবে। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে কর্নেল তাহের ও কর্নেল জিয়াউদ্দিন মিলে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ব্রিটিশ আর্মি পদ্ধতির বদলে চাইনিজ স্টাইলে উৎপাদনমুখী পিপলস আর্মি গঠনের চেষ্টা করছিলেন।১৩ সব প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাহের যদি শেষ পর্যন্ত সফল হতেন, তাহলে সেনাবাহিনীর পুরো সিস্টেমের একটা মৌলিক পরিবর্তন হতো। আর ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহও নিঃসন্দেহে ভারতবর্ষের রাজনীতির একটি টার্নিং পয়েন্ট ছিলো। তবে এই বিদ্রোহ সামরিক ও বেসামরিক ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন রূপে দৃষ্ট হয়। ...সমাজের বেসামরিক এলাকায় তো কখনো কখনো এমনকি জিজ্ঞাসা-ভ্রুকুটি-ভিন্নমত এবং বেয়াদবিও বিদ্রোহ।১৪

২০ শতকের শুরু থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে ওঠে জানা-অজানা বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী; ভিন্নমতকে দমন করাই ছিলো যাদের প্রধান কাজ। সেই রুশ বলশেভিকদের চেকা, পূর্ব জার্মানির স্ট্যাসি, হিটলারের গেস্টাপো কিংবা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রেভ্যুলুশনারি গার্ডসবার কাজই ছিলো এক; ভিন্নমতকে দমন করা।১৫ আর এখন তো আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর গোয়েন্দা সংস্থাই এই কাজটি পর্দার আড়ালে থেকে দেদারসে করে যাচ্ছে। চলচ্চিত্রে একই ভূমিকায় দেখা যায় ফায়ারম্যানদের। যুগ যুগ ধরে সব সামরিক বাহিনীরই একই চরিত্র দেখা যায়, তারা যেনো আবেগ-অনুভূতিহীন যন্ত্রমানব; এদের কেউ কেউ তো আবার হিংস্রতার গুণে অর্জন করে  নেয় কসাই খেতাবও (যেমনবলকানের কসাই স্লোবোদান মেলোসোভিচ)। এসব বাহিনীতে যারা কাজ করেন, তারা একটা পর্যায়ে ওই সিস্টেমের অংশ হয়ে যান। তখন মানুষ মারতে আর বুক কাঁপে না তাদের; কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে উপরে ওঠার সিঁড়ি। শিক্ষানবিশদের সঙ্গে ক্যাপ্টেনসহ অন্য প্রশিক্ষকদের আচরণ দেখে মনে হয়, শিক্ষার্থীদের অনেকটা জোর করেই ওই সিস্টেমে অভ্যস্ত করানো হয়। শেখানো হয় বল প্রয়োগের নিত্য-নতুন কৌশল, তৈরি হয় নতুন নতুন মন্ট্যাগ-ফ্যাবিয়ান। কিন্তু যখন কোনো সিস্টেম সীমা অতিক্রম করে, তখনই মন্ট্যাগদের ভিতরের মানুষটি জেগে ওঠে, ভাঙতে চায় সমস্ত শৃঙ্খল।

চার্লি চ্যাপলিনের দ্য গ্রেট ডিক্টেটর-এ (১৯৪০) আমরা দেখিদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছিলো, প্রতিপক্ষের ওপর যে অমানবিক নিপীড়ন চালানো হয়েছিলো; তার মূলে ছিলো অংশগ্রহণকারী প্রতিটি বাহিনীর অসহিষ্ণু ও জিঘাংসামূলক মনোবৃত্তি এবং ক্ষমতার মোহ। এর কারণ অনুসন্ধান করলে আবারো সেই শাস্ত্রের কাছেই যেতে হয়। রাষ্ট্রীয় শাস্ত্র তাদেরকে ক্রীতদাস বানিয়ে ফেলেছিলো, এমনকি তাদের চিন্তা-কর্ম-অনুভূতিগুলোকেও নির্ধারণ করে দিয়েছিলো। শাস্ত্রীয় দীক্ষায়ণের ফলে তাই তাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব আর থাকেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে চার্লি অন্য এক হিটলারকে দিয়ে তাই সৈন্যদেরকে শাস্ত্রীয় দীক্ষার বাইরে আনার চেষ্টা করেন, Don't give yourselves to these unnatural men-machine men with machine minds and machine hearts!১৬ তিনি একই সঙ্গে ওই সৈন্যদের ভিতরের মানুষটিকে জাগাতে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, তারা যেনো নিজের আত্মাকে শাস্ত্রের কাছে বিক্রি করে না দেয়। নিজের মানুষ পরিচয়টি যেনো ভুলে না যায়। তার ভাষায়, You are not machines! You are not cattle! You are men! You have the love of humanity in your hearts!১৭

পরাক্রমশালী রাষ্ট্রের প্রতাপশালী বাহিনীর হাতে ক্রমাগত নিপীড়নের শিকার ক্লেরিসেরা তাই মন্ট্যাগদের খোঁজে। শাস্ত্রীয় দীক্ষার বাইরে এনে মুক্তচিন্তা করার সুযোগ করে দেয়, মন্ট্যাগদের চোখের সামনে থেকে রাষ্ট্রের টানানো পর্দা সরাতে চায়। জাগ্রত মন্ট্যাগ তাই আর কাউকে বই পড়তে বাধা দেয় না, বই জব্দ করার বদলে বই নিয়ে পালাতে সাহায্য করে; এমনকি নিজেও গোপনে বই পড়ে। কর্মকর্তা পদে প্রমোশন, বড়ো বাড়ি, নতুন টেলিভিশন সেট কিংবা রাষ্ট্র নিয়ে তার আর মাথা ব্যাথা নেই। একসময়ের একনিষ্ঠ ফায়ারম্যান মন্ট্যাগ এখন নিজের অতীত জানার জন্য, নিজেকে জানার জন্য রাত জেগে পড়াশোনা করেন। কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের পেটোয়া বাহিনীকে তিনি আর পরোয়া করেন না। তার মতে, The system will eat itself... এর মধ্য দিয়ে মন্ট্যাগরা রাষ্ট্রকেই চ্যালেঞ্জ করে বসেন।

 

দর্শনকে কি আর আগুনে পোড়ানো যায়!

চেতনার বিকাশের একটা পর্যায়ে মানুষ তার পরিবেশ, জীবন, জগৎ-সংসার নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করে। পরবর্তী সময়ে মানুষ নিজের দেহ ও চেতনার সঙ্গে সমাজ-প্রকৃতিকে মেলাবার সক্ষমতা অর্জন করে। একপর্যায়ে কীভাবে মানুষ তার জীবন চালনা করবে তা নিয়ে বিভিন্ন মত-পথের সৃষ্টি হয়। আর পৃথিবীতে প্রায় সব মত-পথ তথা দর্শনই এসেছে মানুষের কল্যাণের কথা বলে। সবাই যে যার মতো করে হয়তো মানুষ ও সমাজের কল্যাণই করতে চায়। ফলে ভিন্ন ভিন্ন পথ খুলে যায় মানুষের সামনে, আর সেখান থেকেই কোনো একটা পথ কিংবা কোনো পথের অংশবিশেষ বেছে নিতে হয় তাকে। কিন্তু যখনই কোনো একটি মত-পথ নিজেকে একমাত্র, অভ্রান্ত এবং অবশ্য অনুসরণীয় উপায় হিসেবে দাবি করে বসে, তখনই সৃষ্টি হয় শাস্ত্র তথা মতাদর্শ; আর এখান থেকেই মূলত সঙ্কটের সূচনা। কারণ আমি যদি কারো মতের প্রতিবাদ করতে চাই, কাউকে অসার প্রতিপন্ন করতে চাই, তাহলে তাঁকেও আমার মতটার প্রতিবাদ করতে, আমাকে অসার প্রতিপন্ন করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তখন ক্যাচাল বাধে।১৮

ত্রুফো ফারেনহাইট-এ দেখান, রাষ্ট্র তার শাস্ত্র রক্ষায় কতোটা বেপরোয়া হতে পারে। আধুনিকতার ধোঁয়া তুলে ভিন্ন চিন্তা-পথ-মতের অস্তিত্বকেও সে কীভাবে অস্বীকার করে। কারণ সেখানে নিজের মতাদর্শ চ্যালেঞ্জে পড়ার ঝুঁকি আছে, আছে শাস্ত্রের ফাঁক-ফোকর বেরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। কিন্তু এতো কিছুর পরও রাষ্ট্র বইপড়ুয়াদের থামাতে পারেনি। মন্ট্যাগরা রাষ্ট্রের নির্মিত সত্য থেকে বেরিয়ে তাই প্রকৃত সত্যকে উপলব্ধি করতে চায়। ত্রুফোর দেখানো সেই আধুনিক রাষ্ট্র শাস্ত্রীয় একত্ববাদের কথায় ভিন্ন মতের অস্তিত্বকে একেবারেই অস্বীকার করে। কিন্তু প্রত্যেক ব্যক্তিই যুক্তিবোধসম্পন্ন বিচারবুদ্ধিতে পৌঁছাতে সক্ষম, এবং সমাজ ব্যবস্থার উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রত্যেক ব্যক্তিকে এই সক্ষমতার বিকাশ ঘটাতে দেওয়া।১৯ তার মানে মানুষকে স্বাধীন করে দেওয়া। পৃথিবীর কোনো মতাদর্শই সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে না, তখন অন্যটার দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে। কাজেই যখনই কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কোনো মতাদর্শের মৌলবাদী অনুসারী হয় বা হয়ে পড়ে, তখন সে বা তারা ভিন্ন মতাদর্শগুলোতেই আগুন দিতে চায়, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে একেবারে শেষ করে দিতে চায়।

কিন্তু কোনো মতাদর্শকে একেবারে মুছে ফেলা যায় কি? ধর্মীয় মতাদর্শের কথাই ধরুন, পৃথিবীর বুকে শত শত ধর্ম টিকে আছে হাজার হাজার বছর ধরে। শত চেষ্টা করেও একটি অন্যটিকে একেবারে বাতিল করতে বা নিজেকে একমাত্র পথ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। একইভাবে ত্রুফোর কল্পিত রাষ্ট্রও পারেনি বইপড়ুয়াদের থামাতে। তাই বই পুড়িয়ে ফেললেও, যার জন্য এই বই, সেই মানুষের মস্তিষ্কে থাকা প্লেটোর রিপাবলিককে কেউ পোড়াতে পারে না।

 

শেষ কথা

মানুষ ন্যায়-অন্যায় বা ভালো-মন্দকে আলাদা করতে শিখেছে সেই আদিকাল থেকেই; যখন তারা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে শুরু করেছিলো প্রাক-সভ্যতার যুগে। তখন ব্যক্তি মানুষের কোনো আচরণ অসঙ্গত বা সমাজের জন্য ক্ষতিকর মনে করলে গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে আপত্তি তোলা হয়েছে। একইভাবে সমাজের বেঁধে দেওয়া কোনো নিয়ম-কানুন ব্যক্তি মানুষের কাছে বাড়াবাড়ি মনে হলে সেখানেও তোলা হয়েছে প্রশ্ন। কিন্তু তারপরও সাম্যবাদী সমাজে কোনো ধরাবাঁধা নীতিশাস্ত্রের উদ্ভব হয়নি। দাস সমাজের শুরু থেকেই যে নীতিশাস্ত্রের উদ্ভব হয় তা সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। আর একপর্যায়ে এই নীতিশাস্ত্রই রাষ্ট্রীয় অনুশাসনের প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয়। রাষ্ট্রও দোর্দ- প্রতাপের সঙ্গে এই নীতিশাস্ত্রের ধোঁয়া তুলে মানুষের আচার-আচরণ এমনকি চিন্তার জগতকেও বেঁধে ফেলছে নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে।২০ কিন্তু বিধিবদ্ধ শাস্ত্র দিয়ে তো আর মনুষ্যত্ব টেকে না; রবীন্দ্রনাথও এমনটাই বলছেন, শিক্ষাবিধি দিয়ে এরা ছাঁচ বানিয়েছেকিন্তু ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেঁকে নাসজীব মনের তত্ত্বের সঙ্গে বিদ্যার তত্ত্ব যদি না মেলে তা হলে হয় একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিম্বা কলের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে।২১ 

ত্রুফো যে আধুনিক রাষ্ট্র আমাদেরকে দেখালেন সেখানেও ছাঁচে বাঁধা শাস্ত্র শেষ পর্যন্ত ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে রাষ্ট্রেরই শিক্ষাবিধি দিয়ে তৈরি মন্ট্যাগ। ঠিক যেমন কদিন আগে করলেন এডওয়ার্ড স্নোডেন। তারা রাষ্ট্রের কলের পুতুলে পরিণত হননি। ব্যক্তিক বা যৌথ যেটাই হোক, যাবতীয় রকমের যুক্তিসিদ্ধ মানব-আচরণের উদ্দেশ্য হচ্ছে সদা-ক্রমবর্ধমানভাবে স্বাধীনতা অর্জন করা। ব্যক্তির সম্ভাবনাসমূহের উন্মোচন ঘটার পথ থেকে সর্বপ্রকার বাধা-নিষেধের ক্রমাগত অপসারণ ঘটতে থাকাটাই হচ্ছে স্বাধীনতা।২২ আর এই কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার জন্যই মন্ট্যাগ-স্নোডেনরা বারবার বিদ্রোহ করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। 

 

লেখক : কিবরিয়া জুয়েল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্বের শিক্ষার্থী।

kibriamcj@gmail.com

 

তথ্যসূত্র

১. নিউটন, সেলিম রেজা; মতাদর্শ নয়, পথ; সোনার দেশ, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৩।

২. আউয়াল, সাজেদুল (২০১১ : ৮১); চলচ্চিত্রকলার রূপ-রূপান্তর; দিব্য প্রকাশ, ঢাকা।

৩. চৌধুরী, সত্যজিৎ (২০১০ : ৩৪৫); নিউওয়েভ বা ন্যুভেলভাগ; বুদ্ধিজীবীর নোটবই; সম্পাদনা

সুধীর চক্রবর্তী; নবযুগ, ঢাকা।

৪. প্রাগুক্ত; আউয়াল, সাজেদুল (২০১১ : ৮২)।

৫. প্রাগুক্ত; চৌধুরী, সত্যজিৎ (২০১০ : ৩৪৫)।

৬. স্যামুয়েলস্, চার্লস থমাস (২০১১ : ৪৮৫০); ত্রুফোর মুখোমুখি : ফিল্মমেকিংয়ের নানা ভাঁজ উন্মোচন; ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো : প্রেম ও দেহগ্রস্ত ফিল্মমেকার; গ্রন্থনা ও অনুবাদরুদ্র আরিফ; ভাষাচিত্র, শাহবাগ, ঢাকা।

৭. মার্কস, উদ্ধৃত; মামুন, আ-আল; মার্কসবাদী মৌল ধারণা ও মিডিয়া বিচারে তার প্রয়োগ; অপ্রকাশিত প্রবন্ধ, ২৮ জুলাই ২০০৬।

৮. রোবের্জ, গাস্তঁ (১৯৮৪ : ১১৭১৮); নতুন সিনেমার সন্ধানে; অনুবাদসুস্মিতা ভট্টাচার্য; বাণীশিল্প, কলকাতা।

৯. নিউটন, সেলিম রেজা; রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিজম বলশেভিজম; সোনার দেশ, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৩।

১০. রহমান, সাদিকুর (২০০৯ : ৬৬৬৭); আন্তোনিও গ্রামসির সহজ পাঠ : জীবন চিন্তা ও সংগ্রাম; ঘাস ফুল নদী, শাহবাগ, ঢাকা।

১১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, উদ্ধৃত; নিউটন, সেলিম রেজা; রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিজম বলশেভিজম; সোনার দেশ, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৩।

১২. নিউটন, সেলিম রেজা; রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিজম বলশেভিজম; সোনার দেশ, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৩।

১৩. মাসকারেনহাস, অ্যান্থনী (২০১১ : ১৪০); বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ; অনুবাদমোহাম্মদ শাহজাহান; হাক্কানী পাবলিশার্স, ধানমণ্ডি, ঢাকা।

১৪. নিউটন, সেলিম রেজা; সামরিক বিদ্রোহ চিরন্তন; সোনার দেশ, ৬ জুলাই ২০১৩।

১৫. নিউটন, সেলিম রেজা; রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিজম বলশেভিজম; সোনার দেশ, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৩।

১৬. http://www.charliechaplin.com/en/synopsis/articles/29-The-Great-Dictator-s-Speech

১৭. http://www.charliechaplin.com/en/synopsis/articles/29-The-Great-Dictator-s-Speech

১৮. নিউটন, সেলিম রেজা; মতাদর্শ নয়, পথ; সোনার দেশ, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৩।

১৯. এম. এন. রায়, উদ্ধৃত; নিউটন, সেলিম রেজা (২০১৩ : ৭৯); নয়া মানবতাবাদ ও নৈরাজ্য : এম. এন. রায়ের মুক্তিপরায়নতা প্রসঙ্গে; আগামী প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা।

২০. করিম, সরদার ফজলুল (২০০৬ : ১৫৯); দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, শাহবাগ, ঢাকা।

২১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, উদ্ধৃত; নিউটন, সেলিম রেজা (২০১৩ : ১৫৭); নয়া মানবতাবাদ ও নৈরাজ্য : এম. এন. রায়ের মুক্তিপরায়নতা প্রসঙ্গে; আগামী প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা।

২২. প্রাগুক্ত; এম. এন. রায়, উদ্ধৃত; নিউটন, সেলিম রেজা (২০১৩ : ১৫৭)।

 

বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৪ সালের জানুয়ারির ম্যাজিক লণ্ঠনের ষষ্ঠ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন