Magic Lanthon

               

ফারুক ইমন

প্রকাশিত ০৪ অক্টোবর ২০২২ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার...অ্যান্ড স্প্রিং

একটি অসমাপ্ত প্রেম! শীত বসন্তের ডাকাডাকি...

ফারুক ইমন


ছোট একটি গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই। বাংলার ভাটি অঞ্চলে এক সময় ফিরাইল নামে একটা চরিত্র ছিলো। লম্বা-লম্বা চুল, আলখাল্লা পরা ফিরাইলের হাতে থাকতো গাছের শাখার বাঁকানো লাঠি। নবান্নের আগে আগে আবির্ভাব হতো ফিরাইলের। ফসলের মাঠে একটা কুটির বানিয়ে দেওয়া হতো তাকে; সেখানে থেকে শিলাবৃষ্টির হাত থেকে ফসলকে রক্ষা করতো সে। এই ফিরাইল মাঠের দেখভাল করতো, ভাটির মানুষের ঘরে শেষ ফসল তোলা পর্যন্ত। একজন সাধক পুরুষ প্রকৃতির সেই-আচরণকে দমিয়ে রাখছে, যা মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ। আকাশে মেঘ গর্জন করছে; ফিরাইল তাকে আঘাত করতে দিচ্ছে না ফসলের মাঠে-এটা একটা সময়ের বিশ্বাস।

প্রকৃতির বিকাশের একটা পর্যায়ে তথাকথিত প্রাণ আসলো। আরও বিকাশের একটা পর্ব হলো মানুষ। তারপর প্রকৃতিকে অবলম্বন করে শুরু হলো মানুষের বিকাশ। মানুষ এক সময় যখন নিজেকে মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করলো, সঙ্গে সঙ্গে চলে আসলো প্রকৃতিকে জয় করার ইচ্ছা; এটা ছিলো একই সঙ্গে টিকে থাকার প্রশ্ন, প্রেমের প্রশ্ন, প্রকৃতিকে জানার প্রশ্ন। মানুষ নতুন পরিচিত প্রকৃতির পুরোটা বুঝতে পারে না; ধরতে পারে না অনেক আচরণের কারণ। এই অচেনা আচরণকে সে তার অর্জিত অভিজ্ঞতা দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চায়। তার চিন্তায় সে তৈরি করে সম্ভাব্য ব্যাখ্যা; তৈরি হয় বিশ্বাস। এক একটা বিশ্বাস, তখন এক একটা অণু-ধর্ম। এই অণু-ধর্ম তাকে দেয় এক ধরনের মানসিক আশ্রয়।

কোরিয়ান চলচ্চিত্রকার কিম কি দুক-এর যে-চলচ্চিত্রটি আমার এই লেখার উপলক্ষ; স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার...অ্যান্ড স্প্রিং আমাকে দেখায়-প্রকৃতি ও তার সহজাত প্রবৃত্তি, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, ধর্মাচরণ, প্রথা, মানুষের প্রবণতার উঠানামা ও মানুষ হয়ে ওঠার অদম্য সংগ্রাম। শেষমেশ মানুষকে ফিরে আনে মানসিক আশ্রয়ের (আমি যেটাকে আগে বলেছি অণু-ধর্ম) দিকেই-আর এখানটাতেই আমার কিছু বলার আছে।


মানুষ ও ধর্ম

প্রকৃতিকে মানুষ জেনেছে তার অধ্যবসায় দিয়ে; তার পর্যবেক্ষণ, নিরন্তন চেষ্টার ফসল, অক্লান্ত শ্রমের ফসল এই বোঝাপড়া; সাধনার পরিফল। কিম-এর চলচ্চিত্রে গুরু-শিষ্যের সাধনা দেখি, গুরু শিষ্যকে সংযম শিক্ষা দিচ্ছে; মানুষের, প্রকৃতির সেবার জন্য তৈরি করছে একজন সেবক হিসেবে। যার সঙ্গে প্রকৃতির থাকবে একটা প্রেমের সম্পর্ক। যে-প্রকৃতিকে নির্ভর করে, ভালোবেসে-সে বসবাস করবে প্রকৃতির মাঝেই। কিম আমাদের একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, যে তার শিষ্যকে দীক্ষা দিচ্ছে সেই প্রেমের।

নারী-পুরুষের সম্পর্ক প্রকৃতির বিকাশের জন্য অপরিহার্য ছিলো, এখনও আছে। মানব প্রজাতি রক্ষার জন্যই যার প্রয়োজন, সৃষ্টির আনন্দের জন্য যা খুব দরকারি। একজন মানুষের জৈবিক তাড়না হিসেবেই চলে আসে সঙ্গমের তাড়না। তার এই জৈবিক তাড়না সে মেটায় বিভিন্ন উপায়ে। ধর্ম এক্ষেত্রে এনেছে অনেক রকম বাধ্যবাধকতা। এই বাধ্যবাধকতা জায়েজ করা হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিকাশের স্বার্থেই। সমাজ বিকাশের সঙ্গে মানুষের শ্রম-চিন্তার প্রশ্ন জড়িত ছিলো। সমাজের বিকাশে সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে ধর্মও। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়-বিভিন্ন সময়ের ধর্মীয় নীতি, ভিন্ন ভিন্ন সমাজে রেখেছে প্রগতিশীলতার ছাপ। কিন্তু ধর্মকে যখন প্রাতিষ্ঠানিক আকারে হাজির করা হয়েছে, তখন তা নিয়েছে ভিন্নরূপ, দাঁড়িয়েছে শোষণ-বৈষম্যের হাতিয়ারে। কিম-এর চলচ্চিত্রে যে-ধর্ম আমরা দেখি, তা আগ্রাসী নয় বরং বিকাশক।

ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিকতা যখন নারীকে নিষিদ্ধ করে একজন ভিক্ষুর জীবন থেকে, তার মানে একজন পুরুষকে বিচ্ছিন্ন্ করা হচ্ছে নারী-প্রকৃতি থেকে, সৃষ্টির আনন্দ থেকে। একইভাবে খ্রিষ্ট ধর্মে সিস্টার বলে যে নারী থাকে, তাকেও কিন্তু বিচ্ছিন্ন রাখা হয় পুরুষ-প্রকৃতি থেকে। প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মানবসেবা, প্রকৃতিসেবা কোনোটাই কি সম্ভব? মোহমুক্তির অজুহাত দেখিয়ে ধর্ম সিদ্ধতা দেয় এই বিচ্ছিন্নতাকে। কথা হলো, যে ভিক্ষু জানলোই না নারী মিলনের সুখ, যে সিস্টার উপলব্ধিই করলো না পুরুষ মিলনের তৃপ্তি-তার মোহমুক্তির পূর্ণতা তাহলে আসবে কীভাবে? আসুন, এবার চলচ্চিত্রে দেখি।

শিষ্য যখন শিশু, সে মাছ, সাপ, ব্যাঙের গায়ে পাথর বেঁধে দিচ্ছে। পাথর বাঁধা প্রাণীগুলোর কষ্ট দেখে সে আনন্দ পায়। তার অধীনস্থ বা নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রাণীর সীমাবদ্ধতা তাকে উল্লসিত করে। চুপিসারে শিষ্যের এসব কাজ-কর্ম দেখে গুরু। শিষ্যকে তার এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করাতে ঘুমন্ত অবস্থায় পিঠে পাথর বেঁধে দেয়। এবং ওই প্রাণীগুলোর খোঁজ নিয়ে আসতে বলে। শিষ্য গিয়ে দেখে মাছটি ততোক্ষণে মরে গেছে, সে পরম মমতায় মাছটির কবর দেয়। আপ্রাণ চেষ্টা করেও নিজেকে রক্ষা করতে না পেরে ভাসতে থাকা ব্যাঙটিকেও শিষ্য মুক্ত করে দেয়। ব্যাঙটি ফিরে যায় তার নিজস্ব আশ্রয়ে। আর অপরিচিত শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে না পেরে মরে পড়ে থাকা রক্তাক্ত  সাপটিকে হাতে নিয়ে ব্যাকুল কাঁদতে থাকে শিষ্য।

প্রকৃতিতে যেমন ঋতু, তার নিয়মের ব্যত্যয় নেই; তেমনই মানুষের জীবনেও চলে পালাবদল। ঋতুর সঙ্গে তা অনেকটাই মিলে যায়। যে-কাজটি করার সময় শিশুটি আনন্দে হাসছিলো, তারই পরিফল দেখে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে, ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে! এটাই অনুশোচনা, এই বোধ মানুষের মনে জাগার প্রয়োজন আছে। এটাই হয়তো মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া। কিন্তু যখন শিষ্য কাজটি করে তখন চিন্তা করেনি বা তার চিন্তায় আসেনি এর পরিফল। সে ছিলো উত্তেজিত, খেলায় মত্ত। একই ঘটনা দেখি চলচ্চিত্রের আরেকটি অংশে। শিষ্য তখন বয়সে কিশোর; প্রকৃতির নিয়মেই তার মধ্যে আসে নতুন প্রবণতা, সাপের সঙ্গম দেখে তার মধ্যেও অনুভূত হয় অজানা অনুভূতির। তার ওপর নারী নামক প্রকৃতিকে সে প্রথম কাছে থেকে দেখে; এই নারী-রহস্য উদ্ঘাটনে তার মধ্যে অস্থিরতা ফুটে ওঠে। কারণ, উদ্ঘাটনের এই আকাঙ্ক্ষা সে পায় প্রকৃতি থেকেই।

এক সময় মানুষ, প্রকৃতি দুজনেই অপরিচিত ছিলো দুজনের কাছে। প্রকৃতির অংশ মানুষ পরিচিত হতে শুরু করলো পৃথিবীর সঙ্গে। এরপর এক সময় আলাদা হয়ে গেলো মানুষ আর প্রকৃতির সম্পর্ক। প্রকৃতিকে আয়ত্ত করতে শুরু করলো মানুষ। শুরু হলো মানুষের অন্য এক ইতিহাসের। প্রকৃতি থেকে সে তার ক্ষুধা-তৃষ্ণা মেটায়, চিন্তাশ্রম দিয়ে সে ক্রমাগত টিকে থাকার অবলম্বন আবিষ্কার করতে থাকে। যেহেতু নতুন পরিচয়, প্রকৃতির সব আচরণ সে বুঝতে পারে না। টিকে থাকার প্রয়োজনেই তার দরকার হয় মানসিক আশ্রয়। আগেই বলেছি, এটি পরবর্তীতে এসে ধর্ম ও প্রথায় রূপ নেয়। কিম-এর চলচ্চিত্রে শিশুটিকে কিছু নিয়ম মানতে শেখানো হয়, যা প্রকৃতি ও মানুষ উভয়ের জন্য সহাবস্থানপূর্ণ। এটা ছিলো অনুজের প্রতি অগ্রজের দায়িত্বের প্রশ্ন, একই সঙ্গে মানুষের অস্তিত্বেরও প্রশ্ন। চলচ্চিত্রে আমরা দেখি চমৎকার একটি পরিবেশ; সবুজ পাহাড়ের মাঝে টলটলে জলে ভাসমান একটি আশ্রম। বনের লতা, ফল সাধারণ আহার্য। অবারিত, মুক্ত, বিশুদ্ধ পরিবেশ। কিন্তু এতো আলাদা আবহের মধ্যে শিশুটিকে লালন করেও কেনো শিষ্যের স্থিরতা পেতে অনেক বসন্ত পেরিয়ে যায়, সে কেনো জীবন জুড়ে তার সাধনা থেকে বিচ্যুত হয়, আসুন এবার সেটা খোঁজার চেষ্টা করি।

মানুষের প্রবণতা 

মানুষ, যার প্রথম প্রবৃত্তি অবারিত কৌতূহল, যার ফলাফল আজকের মানুষ। এই কৌতূহল ছিলো বলেই আকাশের তারা, সাগরের জল, পাহাড়, আগ্নেয়গিরি, আগুন সব তার পরিচিত; যদিও এসবই পুরনো কথা। সেই প্রশ্ন-আপেল কেনো মাটিতে পড়ে, কেনো মেঘ ডাকে, আকাশে রাতের বেলা ওগুলো কী জ্বলে, মানুষ কেনো জরায় আক্রান্ত হয়, মারা যায় ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বিভিন্নভাবে নির্ধারণ করে মানুষের কৌতূহলের পরিসর, নিষিদ্ধ করে অবারিত ভাবনাকে। তবুও থেমে থাকেনি মানুষ। নিষিদ্ধ কৌতূহলের জন্য তাকে মূল্যও দিতে হয়েছে, এখনও হয়। সে জানতে চায়। সব নিয়ম উপড়ে ফেলে সে ব্যাঘ্র হয় প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে। সে যেভাবেই থাকুক প্রবৃত্তি তাকে ডেকে ডেকে যায়। সব শৃঙ্খল ভেঙে ব্যক্তি-মানুষ তাতে সাড়াও দিতে চায়। মোটকথা, সে নিয়ম চায় না। কিন্তু তারপরও মানুষকে কিছু নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, এটা অবশ্য দরকার পড়ে অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই নিয়ম মানুষ প্রশ্নহীনভাবে মেনে নেয়। আবার এই প্রশ্নহীনতা থেকেই শুরু হয় নতুন প্রশ্নের, কৌতূহলের। উত্তর যদি মন মতো হয়, ভালো; আর তা না হলেই মানুষ নিয়ম অস্বীকার করতে চায়, প্রকাশ্যে না পারলে লুকিয়ে।

চলচ্চিত্রে গুরু শিষ্যকে যে-শিক্ষা দেয়, ধরে নিলাম সেটা সংযম। শিশু শিষ্যকে নিয়ে গুরু যখন নৌকায় লতা সংগ্রহ করে, তখন বৃদ্ধ-গুরু তাকিয়ে থাকে তার চোখের দিকে, আগামীর স্বপ্ন, আগামীর পৃথিবীর দিকে। আর শিশুটি তাকিয়ে থাকে কেবলই দেখার চোখে। পৃথিবী তার কাছে একটু একটু মেলতে শুরু করে। শিশুটি অনুকরণ করে। এর মধ্যে সে নিশ্চিন্ততা পায়। শিষ্য গুরুর নৌকা চালানো অনুকরণ করে, সে নিশ্চিত হয়েই এই শিক্ষা নিতে আগ্রহী হয়; গুরুর প্রতি নির্ভরতা, আস্থা থেকে। এ-রকম হাজারো নির্ভরতা ও আস্থার সুযোগে ধর্ম মানুষকে বিভিন্ন প্রথা মানতে শেখায়, নিষিদ্ধ করে তার মুক্ত চিন্তাকে, তাকে আটকে রাখতে চায় শোষণের মধ্যে।

স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার...অ্যান্ড স্প্রিং-এ একই বৈশিষ্ট্যের দুটি দরজা আমরা দেখি; দেয়াল নেই, কেবলই দরজা। কিন্তু চারপাশ ফাঁকা থাকলেও যেতে হবে দরজা দিয়েই। দরজার এই ব্যবহার সাধনারই অংশ। একটি দৃশ্যে গুরু-শিষ্য এক ঘরে ও দেয়ালবিহীন পাশের ঘরে এক কিশোরীকে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। এক পর্যায়ে কিশোরী তার ঘরে আসতে শিষ্যকে আহ্বান জানায়; শিষ্য তার আহ্বানে নির্ধারিত দরজা দিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করে বুঝে ফেলে, গুরু এতে জেগে যেতে পারে। এতে তার উদ্দেশ্য হাসিল হবে না, তখন সে ওই দেয়ালহীন জায়গা দিয়ে কিশোরীর কাছে যায়; তার সঙ্গে মিলিত হয়। ঘুমের ভান করা গুরু কিন্তু শিষ্যকে বাধা দেয় না, তার সামনে দুটি পথই খোলা রাখে। যদিও তাকে শেখানো হয় নির্ধারিত দরজা ব্যবহারের। আবার শিষ্য প্রথা ভেঙে কিশোরীর সঙ্গে যখন মিলিত হয়, গুরু তখনও তাকে বাধা বা শাস্তি দেয় না। তখন আমরা টের পাই, নিষিদ্ধের প্রতি মানুষের এই টান গুরু মেনে নেন। তিনি জানেন, মানুষ ভুল করবে এবং সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই বুঝবে কোনটা তার উপযোগী। যদি এই উপলব্ধি থেকে সে কিছু শেখে, তবে সেটাই টেকসই।

মানুষের বিকাশের পথে যা বাধা, তার স্বার্থের অন্তরায়, তা সে বেশিদিন সহ্য করে না। নিষিদ্ধতা দিয়ে মানুষকে এখানে আটকে রাখা যায় না। তাহলে এই সীমানা, তার উপযোগিতা; সত্যিই কি মানুষের জন্য শুভকর না হুমকি, নাকি অগ্রজের দায়িত্বশীলতার প্রশ্ন-এইসব কিম আমাদের ভাবনায় নিয়ে আসেন গোছালোভাবেই।

প্রকৃতির অসংখ্য প্রজাতির মধ্যে মানুষ একটি। তার চিন্তা-ভাবনা এবং তা কাজে রূপান্তরের শক্তি মানুষকে করেছে অনন্য। মানুষের পৃথিবীতে অনেক ধর্ম-মত এসেছে, এক মতবাদ বাতিল করেছে আরেক মতবাদকে। যা মানুষকে করেছে বিভক্ত, অনেক সময় সহিংস। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম মানুষকে লেলিয়ে দিয়েছে মানুষের পিছনে। যুগে যুগে মানুষের ইতিহাস করেছে কালিমাময়। এই উপমহাদেশের এক রাজার ছেলে সংসারের মায়া ছেড়ে বনে চলে গেলেন। দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, কলহ থেকে মানবজীবনকে কীভাবে মুক্ত করা যায় ভাবতে বসলেন। এরপর এক সময় মোহমুক্তির আহ্বান, জীবের প্রতি দয়া, হিংসার বিপরীতে ভালোবাসার বাণী নিয়ে তিনি ফিরলেন বন থেকে। তার এই চিন্তায় কোনো আকার-নিরাকার ঈশ্বর ছিলো না। কিন্তু মজার (!) ব্যাপার হলো, নিরীশ্বর গৌতম প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মারপ্যাঁচে পড়ে মৃত্যুর পর নিজেই বৌদ্ধ ধর্মের ঈশ্বর হয়ে গেলেন। যিনি নিজে একটিবারও বললেন না-ঈশ্বরের সেবা/পূজা করো, ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিকতা তার মূর্তিকেই পূজা করতে শেখালো মানুষকে। বৌদ্ধ ধর্ম মতে, জীব হত্যা মহাপাপ এবং অহিংসা পরম ধর্ম। কিন্তু বিভিন্ন সময় বৌদ্ধদের ওপর হামলা হয়েছে, তারা প্রতিবাদে অনুমতি চেয়েছেন অস্ত্র ধারণের কিন্তু অনুমতি মেলেনি; তাতে যে-ধর্মের মূল ভিত্তিই নড়ে ওঠে। কিন্তু সেটাই বাস্তবতা নয়, বৌদ্ধ-ধর্মাবলম্বীদের হাতেও লেগেছে রক্তের দাগ। মিয়ানমারে ধর্মীয় দাঙ্গার নামে আরাকান মুসলমানদের রক্তে হোলি খেলে বৌদ্ধরা। তাহলে অহিংসা, জীব হত্যার মহাপাপ গেলো কোথায়! ধর্মব্যবসায়ীরা হয়তো বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে এর ব্যাখ্যা দাঁড় করাবেন। যুগে যুগে এভাবেই ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হয়েছে, এখনও হচ্ছে। যে-ব্যাখ্যার জোরে কক্সবাজারের রামুতে মাইকিং করে হামলা হয় অন্য ধর্মের উপাসনালয়ে; এক ধর্মের ঈশ্বরকে অন্য ধর্মের ঈশ্বর পোড়ায়, এক ঈশ্বরের চোখ উপড়ে নেয় আরেক ঈশ্বরের সন্তান।

কিমের চলচ্চিত্রে বৃদ্ধ-ভিক্ষু সারা জীবনের ধর্ম-সাধনায় অর্জিত জ্ঞান দিয়ে গড়ে তুলতে চান এক মানব শিশুকে। মানুষের হাজার বছরের মানুষ হয়ে ওঠার প্রচেষ্টায়, সে অর্জিত জ্ঞান পৌঁছে দিয়েছে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। কিন্তু মানুষের ধর্মের যে-জ্ঞান, তা কি ধর্ম থেকে অর্জিত? মোটেও নয়। মানুষের বহুকালের নিরন্তর চিন্তাশ্রম এবং অধ্যবসায়ের ফলে অর্জিত জ্ঞান, কালের বিবর্তনে ওই মানুষের কাছেই হাজির হয়েছে ধর্মের জ্ঞান হিসেবে। চলচ্চিত্রে গুরু শিষ্যকে যখন চিনিয়ে দেয়, কোন্ লতাটা ব্যবহার করা যাবে আর কোনটা যাবে না কিংবা মাছ, ব্যাঙ, সাপ প্রকৃতির সঙ্গে এমন আচরণ করা যাবে না-এসব কিন্তু মানুষ শিখেছে তার অভিজ্ঞতা, শ্রম থেকে; ধর্ম থেকে নয়, কোনো আসমানি বাণী থেকে নয়।

কিশোর শিষ্য বারবার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় তার ধর্ম, তার সাধনা থেকে। শিষ্য এক রাতে কিশোরীর সঙ্গে মিলনের সুখে মোহময় এক জগতে চলে যায়। যে-কারণে প্রতিবেশের প্রতি তার খেয়াল কমে যায় অনেকাংশে। মোহের কাছে সাধনা পরাজিত হলে, মানুষের চিন্তার নিয়ন্ত্রণ স্বাভাবিক থাকে না; সিদ্ধান্তগুলো হয় অসামঞ্জস্য। শিষ্য নৌকায় কিশোরীর সঙ্গে মিলনের পর তারা সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে। তাদের মোহ ভাঙে তখন, যখন তারা জলে ডুবে যেতে থাকে।

যদি প্রশ্ন আসে, এই প্রেম প্রকাশ্য হলে, কী সমস্যা হতো? শিষ্যটির সাধনার সঙ্গে, তার বয়সের সঙ্গে-এই প্রেম সিদ্ধ নয়। তাই তাকে লুকিয়ে এটা করতে হয়, ফলে আসে অস্থিরতা, এই অস্থিরতা থেকে হাজির হয় ঘোর। শিশু অবস্থায় যেমনটি মাছ, সাপ, ব্যাঙের গায়ে পাথর বাঁধা তার কাছে নিতান্ত খেলাই ছিলো। তখন সে ছিলো শিশু, তাই বোঝাপড়াটা ছিলো না। কিশোরীর সঙ্গে মিলনের ব্যাপারে তার প্রায় একই ঘটনা ঘটলো, এবারও সঙ্কট বোঝাপড়ার। বোঝাপড়ার সঙ্কট একেবারে অচেনা নারী শরীর নিয়ে, শিষ্যের নিজের শরীরে জাগা নতুন কামভাব নিয়ে। যে-কারণে সে নৌকার মধ্যে মিলনের পর সেখানেই ঘুমিয়ে পড়তে পারে।

মানুষ নানান সময়, নানা কারণে এ-ধরনের অস্থিরতার ভিতর দিয়ে যায়। এটা ঘটে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও। রাশিয়ায় বিপ্লবে জারের পতনে নতুন এক ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচয় হয় রাষ্ট্রের। সোভিয়েত রাশিয়া এক পর্যায়ে শিকার হয় এই অস্থিরতার; আবার সেই বোঝাপড়ার সঙ্কট। এবার অভিজ্ঞতাহীন নতুন ব্যবস্থা, নতুন ক্ষমতা কাঠামো নিয়ে বোঝাপড়ার সঙ্কট। ফলে বিপ্লবের মোহ অনেকক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ হয় বাস্তবের কাছে। দীর্ঘ সময়েও বোঝাপড়ার সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে না পারার ব্যর্থতায় এক সময় ডুবে যেতে হয় সোভিয়েত রাশিয়াকে। প্রতিবিপ্লবীদের ক্রমাগত ষড়যন্ত্রে চোখ এড়িয়ে যায় অনেক ঘটনা। একই ভাবে সঙ্গম ও সঙ্গম-পরবর্তী বোঝাপড়া পরিষ্কার না থাকায় ঘুমিয়ে পড়া শিষ্যকে ডুবে যেতে হয় পানিতে।

তারপরও এর মধ্যেও নতুন এক বোঝাপড়া তৈরি হয় শিষ্যের। ফলে প্রেম অথবা সঙ্গলিপ্সা যাই বলি, শিষ্যটির কাছে তার সাধনা, স্মৃতি, গুরুর প্রতি ভালোবাসা সবকিছু ছাপিয়ে বড়ো হয়ে ওঠে ওই কিশোরী। যে-কারণে  আশৈশব স্মৃতিপূর্ণ বুদ্ধের মূর্তিটি নিয়ে সে পালিয়ে যায় আশ্রম ছেড়ে। গুরু সব টের পেয়েও তাকে বাধা দেয় না। পরবর্তীতে সে যখন ফিরে আসে, তখন সে ফেরারি আসামি। এতো কিছুর পরও গুরু তার শিষ্যকে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করে। এবার অনুতপ্ত, পরাজিত শিষ্য স্বেচ্ছামৃত্যুর (যেটা আসলে তার ক্ষেত্রে আত্মহত্যা) চেষ্টা চালায়; গুরু এই প্রথমবারের মতো কোনো কাজে শিষ্যকে সরাসরি বাধা দেয়, শাসন করে। এবার শিষ্যের মধ্যে অনুশোচনা তৈরি হয়। যে-ছুরি দিয়ে শিষ্য একজনকে খুন করেছিলো, তা দিয়ে নিজের মাথার চুল কেটে গুরুর সামনে হাজির হয়।

কোনো কারণে স্বাভাবিক কোনো বস্তু যখন স্বাভাবিকতা হারায়, পুনরায় সেই অবস্থায় ফিরে আসে না কখনই। হয়তো তার চেয়ে উন্নত কিংবা খারাপ অবস্থায় তাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। গুরু কালো কালিতে যখন কাঠের মেঝে ভর্তি করে লিখছে, শিষ্য তার অনুশোচনাকে শক্তি করে লেখাগুলো খোদাই করতে শুরু করে মরিয়া হয়ে। আশ্রমের ঠিকানায় পুলিশ আসে, গুরু আশ্বাস দেন কাজটা শেষ হলেই শিষ্যকে তাদের হাতে তুলে দেবেন। পুলিশ বসে থাকে পাহারায়, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, রাত গভীর হতে থাকে। সমস্ত লেখা খোদাই করে ক্লান্ত শিষ্য ওখানেই টলে পড়ে। গুরুর ডাকে ঘুম ভেঙে শিষ্য দেখে, তার খোদাই করা লেখাগুলো রঙিন। শিষ্যকে তুলে দেওয়া হয় পুলিশের হাতে। শিষ্যকে নিয়ে পুলিশ নৌকায় ওঠে কিন্তু নৌকা আর এগোয় না, আমরা এখানে বুঝি গুরু-শিষ্যের বন্ধনের গভীরতা।

পুরো চলচ্চিত্র জুড়েই আমরা দেখি-এই বন্ধন, ভালোবাসা ও মানবিকতার প্রতি গুরুর আর্দ্র দৃষ্টি। তিনি মানুষ আর মানবিকতার মধ্যে ধর্মকে বাধা হিসেবে আনেননি কখনই। তিনি মানুষকে বিচার করেছেন মানবিকতা দিয়ে, ধর্ম দিয়ে নয়। মানুষ ভুল করে, ভুল বুঝে ফিরেও আসে। অবৈধ নারী সঙ্গম, মূর্তি নিয়ে পালিয়ে যাওয়া, ফেরারি আসামি হওয়া ইত্যাদি একজন ভিক্ষুর জন্য অসিদ্ধ; এরপর আর সাধনায় ফিরে আসার ন্যায্যতা দেয় না ধর্ম।  কিন্তু গুরু এখানে তার শিষ্যকে মানুষের সম্মানটুকু দিয়েছেন, ধর্ম যা দিতে ব্যর্থ হয়েছে যুগে যুগে। ধর্ম পুড়িয়ে মেরেছে মানুষকে, পাথর ছুড়ে ক্ষতবিক্ষত করেছে, দোররার আঘাতে করেছে জর্জরিত।     

শেষ বিদায়ে দেখি-যাওয়ার সময় হাত নেড়ে শিষ্যকে বিদায় দেন গুরু, মুখে স্মিত হাসি। শিষ্যকে অন্তিম বিদায় জানান তিনি। গুরু হয়তো বুঝে নিয়েছেন, তার কাছ থেকে শিষ্যের পাওয়া শেষ হয়েছে, তিনি তার যোগ্য উত্তরসূরি পেয়ে গেছেন; আজ বিদায় নিলেও একদিন শিষ্য ফিরে এসে তার সিলসিলা-কে এগিয়ে নেবেন। সেজন্যই হয়তো বিদায় বেলা গুরুর মুখে ছিলো এই তৃপ্তির হাসি।

শীতের এক সকালে শিষ্য সাজাভোগ শেষে ফিরে আসে, তখন সে পূর্ণবয়স্ক। আশ্রমকে, দেখা-চোখের আড়ালে থাকা গুরুকে সম্মান জানান। তারপর তিনি সাধনায় আত্মনিবেশ করেন। এর মধ্যে প্রকৃতিতে এসেছে নতুন রূপ, যা ফিরে ফিরেই আসে, বিপর্যয় উতরে সেজে ওঠে শীত-বসন্ত-গ্রীষ্মে। অথচ মানুষের পক্ষে তা কিন্তু অতোটা সহজ নয়। শিষ্য যখন ফিরে আসে, তখন তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে অনেক বসন্ত, অনেক অসম্পূর্ণ থাকা অনুশীলন-যা সে আর ফিরে পাবে না কোনোদিন। আর এই না পাওয়ার অনুশোচনাই তাকে মানুষ হয়ে উঠতে পথ দেখায়। কিন্তু তখন আর প্রদর্শকের প্রয়োজন পড়ে না, সে হয়ে উঠতে থাকে স্বাবলম্বী। 

মানুষ হয়ে উঠার এই পথ মানুষকে আজীবনই পাড়ি দিতে হয়েছে। পরবর্তী ঘটনায় দেখি-একজন নারী একটি শিশুকে নিয়ে আশ্রমটিতে আসে, গুরুর সেই শিষ্যটি, যে এখন ওই আশ্রমেরই ভিক্ষু; স্বসম্মানে নারী ও শিশুটির থাকার ব্যবস্থা করে। নারীটি কাপড়ে তার মুখ পেঁচিয়ে রাখে, এতে কৌতূহল জাগে। কৌতূহলী ভিক্ষুও ঘুমিয়ে থাকা নারীর কাপড় সরিয়ে মুখ দেখতে চায়। কিন্তু ঘুমানোর ভান করা ওই নারী আটকে দেয় তার এই কৌতূহল। শিশুটিকে রেখে পালাতে গিয়ে ওই নারী দুর্ঘটনাক্রমে মারা যায়। শিশুকে মানুষ করার দায় বর্তায় ভিক্ষুর ওপর। আমরা পরিচিত হই নতুন শিষ্যের সঙ্গে।

প্রকৃতিতে অনেকগুলো স্তর অতিক্রম করে বেড়ে ওঠে একটি বৃক্ষ; মানুষও তেমনি। নতুন ভিক্ষু এবার নতুন শিষ্যকে নিয়ে আরেকটি স্তর অতিক্রম করতে যায়; আরেকটু এগোনো মানুষ হয়ে ওঠার পথে। নতুন পথে সেই শৈশবে গুরুর শেখানো সমানুভূতির চর্চা। অন্যদিকে, ক্ষত-বিক্ষত হয়ে হাতে চেতনা (বুদ্ধমূর্তি) আর পেটে পাথর বেঁধে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠা; সত্যিই সেখান থেকে অনেক ছোট দেখায় আমাদের উপাসনালয়গুলো। আর আমরাও যেনো ইঙ্গিত পাই, উপাসনালয় শুধু ওই কাঠ-পাথরের ঘরে বন্দি কিছু নয়, পুরো প্রকৃতিই।

সমপরিমাণ

কিম কি দুক মূলত প্রকৃতি, মানুষের জৈবিক সম্পর্ক ও তার নিজস্ব দর্শন নিয়ে সিনেমা বানান। তার একান্ত চোখে দেখা পৃথিবীকেই তিনি তার দর্শকদের দেখান। মানুষ কে? সে এখন কোথায়? তার হাঁটা পথের সম্ভাব্য গন্তব্য আমি জানি না! কে আমি? আদিম কোনো এক মানুষের মনে এই প্রশ্ন যখন এসেছিলো, আমি টের পাই তার সেই অনুভূতি। সেই অনুভূতির আঁচ পাই কিমের চলচ্চিত্রেও। মানুষ একদিন সত্যিই বেরিয়ে আসবে; প্রকৃতির মাঝে খুঁজে ফিরবে তার পরিচয়। মানুষের জীবন-যাপনের একমাত্র মানদ-হবে প্রকৃতি; কোনো পাথর-কাঠের ঘর, আসমানি কিতাব অথবা কোনো ব্যক্তির একান্ত অর্জিত সাধনা নয়।

লেখক : ফারুক ইমন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। এর পাশাপাশি তিনি ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয়।   

farukemon@gmail.com                                 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন