নুরুল আলম আতিক
প্রকাশিত ১০ এপ্রিল ২০২৩ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা-১
‘জহির রায়হানের খোঁজ পাওয়া গেছে’
নুরুল আলম আতিক
ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা-১
বিষয় : ‘জহির রায়হানের খোঁজ পাওয়া গেছে’
কথা উপস্থাপনায় : নুরুল আলম আতিক
স্থান : ১২৩, রবীন্দ্র কলাভবন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
সময় : ১৪ মে ২০১২, বিকেল সাড়ে চারটা।
সঞ্চালক-১: সিনেমা, স্বপ্ন ও বাস্তবতা। এই তিন নিয়ে পথচলা শুরু। সিনেমাকে মাঝখানে রেখে স্বপ্ন আর বাস্তবতা নিজেদের মাঝে ছুটোছুটি করে। কখনও একে অন্যের কাছে ধরা দেয়, কখনও পালিয়ে যায়। তবুও চেষ্টা অব্যাহত থাকে। আর এই চেষ্টা থেকেই যাত্রার শুরু।
সঞ্চালক-২: আজ ১৪ই এপ্রিল (প্রকৃতপক্ষে হবে ১৪ মে) ২০১২, ৩১শে বৈশাখ ১৪১৯। অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় আমি জিয়াউল হক।
সঞ্চালক-১: ও আমি হালিমা খুশি।
সঞ্চালক-২: সম্মাননীয় উপস্থিতি, ম্যাজিক লণ্ঠন মূলত একটি চলচ্চিত্রবিষয়ক জার্নাল। তবে এখানে টেলিভিশন, রেডিও এবং নিউ মিডিয়ার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। জার্নালটি ষাণ্মাসিকভাবে প্রকাশিত হয়।
সঞ্চালক-১: মূলত এই জার্নালে লেখক হিসেবে রয়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এর পাশাপাশি আগ্রহী শিক্ষক ও সাবেক শিক্ষার্থীরাও রয়েছেন।
সঞ্চালক-২: এই জার্নালটিকে ঘিরে আমরা নানা কর্মকাণ্ড করে থাকি। যেমন : চলচ্চিত্র ও গণমাধ্যম বিষয়ক পড়াশুনা, পাঠচক্র, সেমিনার এবং সিনেমার নিয়মিত প্রদর্শনী। এছাড়াও ভবিষ্যতে আমাদের স্বল্পদৈর্ঘ্যের সিনেমা নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। স্বপ্নযাত্রার এই পথে আমাদের ইচ্ছে ছিলো-চলচ্চিত্র সম্পর্কিত কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির অভিজ্ঞতাপূর্ণ কথা শোনার। আর সে-থেকেই আজকের এই আয়োজন।
সঞ্চালক-১: সম্মাননীয় উপস্থিতি, ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা-১ এর কথা উপস্থাপনার বিষয় : জহির রায়হানের খোঁজ পাওয়া গেছে। কথা উপস্থাপন করবেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্রনির্মাতা নূরুল আলম আতিক।
সঞ্চালক-২: এবার আমি সম্মাননীয় অতিথিকে মঞ্চে আসন গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করছি। (অতিথির আসন গ্রহণ এবং দর্শকদের হাততালি) ধন্যবাদ সম্মাননীয় অতিথি। এবার সম্মাননীয় অতিথিকে ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা-১ শুভেচ্ছা-স্মারক দিয়ে বরণ করে নেবেন ম্যাজিক লণ্ঠন-এর সম্পাদক কাজী মামুন হায়দার। জনাব কাজী মামুন হায়দারকে শুভেচ্ছা-স্মারকটি দিয়ে সম্মাননীয় অতিথিকে বরণ করে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। (স্মারক দিয়ে বরণ এবং দর্শকদের হাততালি) ধন্যবাদ সম্মাননীয় অতিথি এবং সম্পাদককে।
সঞ্চালক-১: এবারে ম্যাজিকলণ্ঠন পরিবারের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেবেন সহকারী সম্পাদক জনাব আসাদ লাবলু। জনাব আসাদ লাবলুকে কিছু বলবার জন্য অনুরোধ করছি।
আসাদলাবলু : উপস্থিত সবাইকে শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ। আর বিশেষ করে শুভেচ্ছা জানাতে হচ্ছে আজকের যিনি আলোচক, কথা উপস্থাপক নূরুল আলম আতিককে; যিনি তার অনেক ব্যস্ততার মধ্যে আমাদের এখানে এসেছেন। সেই জায়গা থেকে ওনাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আর আমি পরিস্থিতিকেও একটা ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কারণ, আমরা যখন পরিকল্পনাটা করছিলাম বা ওনার সঙ্গে যোগাযোগগুলো করছিলাম এই অনুষ্ঠানটা নিয়ে; তখন যে-পরিস্থিতি দাঁড়াচ্ছিলো যে হরতাল পড়ে যায় কিনা। আমরা একধরনের আশঙ্কার মধ্যে ছিলাম। সেই জায়গাগুলা বা সেই ঘটনাগুলো ঘটেনি; আমরা খুব সফলভাবে অনুষ্ঠান শুরু করতে পেরেছি। আশা করি, শেষও করতে পারব। তো আমি চলচ্চিত্রের একটি-দুটি বিষয় নিয়ে কথা বলবো। যেহেতু আমাদের স্বপ্ন, আমাদের চিন্তাভাবনা, আমাদের এগিয়ে যাওয়া সবকিছু চলচ্চিত্রকে নিয়ে। তো এই ম্যাজিক লণ্ঠন-এ আসার পরে আমার চলচ্চিত্রবিষয়ক একটা নিজস্ব ভাবনা আমার ভিতরে তৈরি হয়েছে। এটা ম্যাজিক লণ্ঠন-এর পাঠচক্র, সবার সঙ্গে বোঝাপড়া, লেনদেন বিভিন্ন কিছু। তারপরও আমার এমএসএস বর্ষে চলচ্চিত্রবিষয়ক একটা কোর্স আছে-সেখানেও আমি অল্পবিস্তর পড়াশুনা করেছি। সেখান থেকে আমার যেটা মনে হইছে যে, মানে এক কথায় যদি আমি বলি যে-বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অবস্থা খুব একটা ভালো বা সন্তোষজনক না।
তো আমি বিভিন্নধারার সিনেমা সেখানে দেখেছি-সুরিয়ালিজম, নিউরিয়ালিজম, আঁভ গার্দ তারপরে সিনেমানোভো, থার্ডসিনেমা, বিভিন্ন ক্যাটাগরির। ১৬ মিলিমিটার, ৩৫ মিলিমিটার, শর্টফিল্ম, ফিচারফিল্ম এই সিনেমাগুলো হচ্ছে এবং বিভিন্ন ধারায় বিশ্বাসী, বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে বিশ্বাসী মানুষজন এই যে সিনেমাগুলো করছে আর-কি। তো আমাদের দেশেও এই প্রচেষ্টাগুলো আছে ১৬ মিলিমিটার, ৩৫ মিলিমিটার, ডিজিটাল ফিল্মে কাজ হচ্ছে। তো ফলত যেটা আমরা চাই সেটা হচ্ছে না। শেষপর্যন্ত সাধারণ মানুষ সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখবে সেই জায়গাটা হচ্ছে না। হ্যাঁ, বিভিন্নধারার সিনেমাগুলো হচ্ছে। তো এটা আমার ব্যক্তিগতভাবে আমার সন্দেহ বা আমি যেটা মনে করি, আসলে পরিবর্তনটা যেটা করতে চাচ্ছি বা যারা পরিবর্তন করতে চাচ্ছেন, তারা শুধু কাঠামোগত জায়গা থেকে বিষয়গুলো দেখছেন আর-কি। আমার যেটা মনে হয়, এটা মানে আমাদের এখানকার যে বাম রাজনৈতিক সংগঠনগুলা আছে যে-বিষয়টা তাদের মতো। তারা যে-আন্দোলনগুলো করে সেখানে শুধু রাষ্ট্রের কাঠামোতে তারা চেঞ্জ করতে চায়। ফলে যেটা হয় যে, তাদের চেতনা বা আন্দোলন শুধু রাষ্ট্রের কাঠামো পর্যন্ত যায়; বাইরের মানুষজন জানে না। যেহেতু চেতনা বাহিরের মানুষের নাই, সেই জায়গা থেকে জিনিসটা কিন্তু এক্সপ্লোইড করতেছে না, প্রসারিত হচ্ছে না। চলচ্চিত্র আন্দোলনটা ঠিক সেই জায়গায় আটকে আছে কিনা যে, যারা চলচ্চিত্র জানেন-বোঝেন, হু তারা বিষয়টা নিয়ে ভাবছেন। কিন্তু সবার ভিতর সেই চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি মনে হয় হয়নি। যেমন আমরা এখানে রাজশাহীতে এখন একটা সিনেমা হল, অনেকগুলো ছিলো, বন্ধ হয়ে গেছে। একটা আছে রাজতিলক যেখানে আমরা যাই।
দেখা যাচ্ছে, একটা সিনেমা হচ্ছে সেখানে কেবল একধারার দর্শক। কোনো কোনো সিনেমাতে শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই দর্শক। দেখা যাচ্ছে সবাইকে চিনি, যারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে এর বাইরে দর্শক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার একটা সিনেমা হচ্ছে, যেখানে নিম্নবর্গ বা যারা শ্রমিক, যারা দিনমজুর তারা সিনেমাগুলো দেখছে। কিন্তু কম্বিনেশনটা হচ্ছে না, দুটার জায়গায়। এই কম্বিনেশন না হওয়াটাই সমস্যা। তো আমি যেটা বলতেছিলাম যে শুধু কাঠামোর জায়গা থেকে বিষয়টা দেখলে হবে কিনা, শুধু তাত্ত্বিক জায়গা থেকে দেখলে হবে না।
আমরা মানে এই কথাটা চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশুনা বা আলোচনায় সর্বপ্রথম একটা কথা জোর দিয়ে বলা হয়, সেটা চলচ্চিত্র একটা যৌগিক মাধ্যম। তার মানে এটা নিশ্চিত যে, একটা নির্দিষ্ট বিষয় বা একটা নির্দিষ্ট কলা, একটা নির্দিষ্ট শিল্প এর অন্তর্ভুক্ত নয়। বিভিন্ন কিছু এর ভিতরে আছে। এখন আবার সঙ্গীত এটা একটা ফ্যাক্ট। গান, একজন দর্শক একটা গানের কারণে একটা সিনেমা দেখতে পারে। এবং আবার একটা গানের কারণে সেই সিনেমাটা বারবার দেখতেছে। অথবা একটা দৃশ্যের জন্য দেখছে অথবা একটা অভিনয়ের জন্য দেখছে, একটা ব্যক্তিকে দেখার জন্য দেখছে। তার মানে এটা প্রমাণিত যে, এটা একটা যৌগিক মাধ্যম। তো সেই শিল্প মাধ্যমগুলো সম্পর্কে সবার আগে জানতে হবে। এখন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে যদি আমার গান শোনার রুচিবোধ পরিবর্তন করতে না পারেন; আমি যদি বালাম, তাহসান এগুলা শুনি, আপনি যদি আমাকে রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনাতে না পারেন-তাহলে চলচ্চিত্রে যখন আপনি রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজাবেন তখন আমি শুনব না; এবং সেই সবগুলো উপাদান যখন আমি চলচ্চিত্রে না পাবো, তখন আমি সেই চলচ্চিত্র দেখবো না।
এইরকম আমার শিল্পবোধ আমার যে ওয়ালে একটা ছবি আছে বা একটা শিল্পকর্ম আছে; তো এই শিল্পকর্ম যদি আমার ভালো না লাগে বাস্তবজীবনে-তাহলে চলচ্চিত্র জীবনেও আমি সে শিল্পকর্ম দেখতে পছন্দ করবো না। অর্থাৎ, আমি বলতে চাচ্ছি যে, আমাদের বাস্তবিক চেতনা, আমাদের রুচিবোধ, আমাদের সংস্কৃতি-সবকিছুর সমন্বয়ে সবগুলো উপাদানের সমন্বয়ে সবগুলো রুচিবোধ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রটাকে পরিবর্তন করা উচিত। কোনো নির্দিষ্ট ফর্ম বিকল্পধারা বা ভিন্নধারা, স্বাধীনধারার-এগুলার চেয়ে আমার মনে হয় যে সেই সামগ্রিক জায়গাটা ধরা উচিত। একটা সমাজ যে-রকম বিভিন্ন উপাদানের সংমিশ্রণ; তার একটা উপাদান চেঞ্জ করে যেমন সমাজ চেঞ্জ করা যায় না, সবগুলোর সুষমবণ্টন, সুষম পরিবর্তনের মাধ্যমে যেমন সমাজের পরিবর্তন হতে পারে; আমি মনে করি একটা চলচ্চিত্র যে-সমস্ত উপাদান নিয়ে সংগঠিত, যে-সমস্ত উপাদানের অন্তর্গত-সবগুলো উপাদানের সুষম পরিবর্তন এবং সে-গুলার সমন্বয়ে চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নতি হতে পারে। সবাইকে ধন্যবাদ।(দর্শকদের হাততালি)
সঞ্চালক-২: ধন্যবাদ, আসাদ লাবলু। সম্মাননীয় উপস্থিতি, আমাদের আজকের এই আয়োজনকে দুই পর্বে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমত, আমরা আমাদের সম্মাননীয় অতিথির কথা-উপস্থাপনা শুনবো। পরে রয়েছে প্রশ্নোত্তর পর্ব। আমরা দুইভাবে প্রশ্ন করতে পারবো-লিখিত অথবা মৌখিক। আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যরা কর্ডলেস-মাইক্রোফোন নিয়ে আপনাদের কাছে যাবেন এবং প্রশ্ন সংগ্রহ করবেন।
হ্যাঁ বন্ধুগণ, এবার আর বিলম্ব নয়। আমরা সরাসরি এখন বিশিষ্ট চলচ্চিত্রনির্মাতা নূরুল আলম আতিকের কাছে চলে যাচ্ছি। এবার জনাব নূরুল আলম আতিক তার কথা উপস্থাপন করবেন।
নূরুল আলম আতিক : সবাইকে শুভেচ্ছা। আমার অনেক বিব্রত হবার কারণ-মাইক্রোফোন। (মাইক্রোফোন থেকে সরে এসে) শেষে যিনি বসে আছেন পিছনের দরজায়, ‘আমার কথা কি শোনা যায়?’ (পেছন থেকে দর্শকদের হ্যাঁ-সূচক উত্তর) আমি খুশি হবো যদি মাইক্রোফোনের বাইরে আপনার সঙ্গে, আপনাদের সঙ্গে কথামালাটা চালু রাখা যায়। আজ এখানে এসে আমি বিব্রত বোধ করছি। আমার বিব্রত হবার কারণ দুটি। প্রথমত, এই মাইক। দ্বিতীয়ত, আমি নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরোতে পারি নাই। আপনাদেরকে আমি কোনো শিক্ষা দিতে আসি নাই। ঢাকা থেকে রাজশাহী পর্যন্ত আসবার কয়েকটি কারণের একটি কারণ, এই শহরে আপনাদের এই আয়োজক সংগঠন এবং গণযোগাযোগ বিভাগের তিনজন মানুষের লেখা আমি পড়ে থাকবো। পাঠক হিসেবে তাদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগের আকাঙ্ক্ষা আমাকে এখানে টেনে আনবে। আর, একটা শিরোনাম এখানে লেখা আছে, ‘জহির রায়হানের খোঁজ পাওয়া গেছে।’ আপনারা জানেন, জহির রায়হানের খোঁজ পাওয়া সম্ভব নয়। এটি উল্লেখ করবার কারণ বিবিধ। সেই কারণগুলো নিয়ে বরং আমি আপনাদের সঙ্গে কিছু কথামালা চালাচালি করতে চাই। আপনাদের কাছ থেকেও শুনতে চাইবো। কী সেই কথা? তার আগে আমি আমার মুগ্ধতা এবং কৃতজ্ঞতা জানাই-এই বিকেলবেলা এতোগুলো মানুষ জহির রায়হানের খোঁজ নিতে এলেন! জহির রায়হানের খোঁজ নেওয়া আমাদের কেনো প্রয়োজন পড়লো?
৩০ তারিখ জানুয়ারি ৭২-এ উনি বড়ো ভাইকে খোঁজ করতে গেলেন মিরপুরে। তার আগে উনার দশা খুব খারাপ ছিলো। কী খারাপ ছিলো? প্রিয় বড়ো ভাই শহীদুল্লাহ্ কায়সারকে হারিয়ে ওনার মাথাটা গেলো... আজমির শরিফ পর্যন্ত উনি দৌড়াদৌড়ি করলেন। হঠাৎ করে জহির রায়হান আবিষ্কার করলেন, তার মাথার উপরে কোনো ছায়া নেই। শহীদুল্লাহ্ কায়সার নেই। আমরা জহির রায়হান সম্পর্কে জানি, তার সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে জানি কিন্তু আজকে আমাদের একটা লক্ষ্য আছে। ম্যাজিক লণ্ঠন যে-আয়োজন, যে-কথামালা চালু রাখতে চান, আমি যতোটুকু আন্দাজ করি-কথামালা চলুক সিনেমা প্রসঙ্গে। আমরা কেনো চাইলাম জহির রায়হানের খোঁজ করতে? আমাদের সিনেমায় জাতীয় কোনো চরিত্র তৈরি সম্ভব কি না, জাতীয় সিনেমা বলে আদৌ কিছু সম্ভব কি না তা নিয়ে কিছু আলাপ-আলোচনা শুরু করা যাক। আপনারা অনেকেই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত, শিক্ষকতার বাইরে যারা আছেন মানে ছাত্রাবস্থায়, মানে এখনও যারা ছাত্র; রাজনৈতিক দর্শন আছে আপনাদের প্রত্যেকের, জীবনযাপনের নিজস্ব রীতিমালা আছে... আমরা ঠিক কেবলমাত্র ১৬ই ডিসেম্বর, ২৬শে মার্চ নিয়ে তৃপ্ত থাকবো বা নিজের যে রাজনৈতিক দর্শন তার স্লোগান নিয়ে ব্যস্ত থাকবো, না আমি ৩৬৫টা দিন এই দেশ আমার; ‘আমার পরিপার্শ্বের সব মানুষ আছে বলে আমি আছি...’ এই বোধ থেকে সবার সঙ্গে সহাবস্থানে একটি জীবনযাপন রীতি খুঁজে নেব।
চলচ্চিত্র আমাদের কেনো প্রয়োজন পড়লো বা কেনো প্রয়োজন পড়ে? সিনেমা না থাকলে কিচ্ছু আসবে-যাবে না। টেকনোলজির যে অ্যাডভান্সমেন্ট হচ্ছে প্রতিদিন, বছর পঞ্চাশেক পরে হয়তো অন্য কোনো অনুষঙ্গ এসে হাজির হতে পারে। তখন এই সিনেমা বিনোদন আপনার জন্য অনিবার্য না-ও হতে পারে। ‘কিন্তু আমি-তো সিনেমার পথে পথ হারাইয়াছি। এ-কারণে আমাকে সিনেমা নিয়ে কথা বলতে হয়... কিন্তু করে খাই টেলিভিশন। সিনেমা হয় না।’ ...একটু আগে আমাদের এক বন্ধু বলছিলেন-দুর্দশার কথা, সিনেমার দুর্দশার কথা। আমরা যখন সিনেমার কথা বলি; বলি রূপালি পর্দার সোনালি অতীতের কথা। কোন্ সময় সেটি? সাদা-কালো সিনেমা, বাংলাদেশের। এই আমাদের এফডিসি থেকে যে-ছবিমালাগুলো তৈরি হলো, আজতক... ‘আমাদের এই সিনেমার চল্লিশা যদি বলি’ ...আজকে সিনেমা হল, আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি, আমাদের সিনেমা তৈরি করবার জন্যে যে-হাজিরা সেখান থেকে আমরা টের পাই-‘এগুলো মাটি চাপা দেওয়ার সময় হয়ে এলো।’ তবু কিন্তু আমরা স্মৃতিচারণ করতে চাই, কারণ সিনেমার অবসেশন থেকে আমাদের রেহাই নাই। আমরা এখনও পারি না সিনেমা নিয়ে কথা না-বলে থাকতে। ‘সিনেমা খারাপ, খারাপ সিনেমা হচ্ছে’ অন্তত... তা নিয়েও আমরা কথা বলতে চাই। তুলনা করতে চাই, ‘ভারতে এরকম সিনেমা তৈরি হয়, আমরা কেনো পারি না? ইরানে কেনো এত জীবনের কাছাকাছি সিনেমা হয়, আমাদের দেশে কেনো তৈরি হয় না?’
এইসব প্রশ্ন নিয়ে নিজেরা ভাবিত হই বলে, আমরা এই কথামালাগুলো চালু রাখতে চাই। এইসব কথামালার আর প্রয়োজন পড়বে না। তখন এমন টেকনোলজি হাজির হওয়া সম্ভব। আপনি একলা। যেমন, একটা ছোট্ট ডিভাইস থেকে কানে হেডফোন লাগিয়ে একা একা গান শুনতে পান। এমন যদি হয় কোনোদিন, অবাক হবার কোনো কারণ দেখি না-আপনি একটা চশমার মতো ডিভাইস পড়লেন, একলা একলা সিনেমাটা দেখলেন, শুনতেও পেলেন কিংবা আপনার মনে হলো যে আপনি ফাঁকা মাঠে বসে আকাশের মধ্যে প্রজেক্ট করে দেখবেন নিজের পছন্দের সিনেমা; সেইটিও ঘটবার সম্ভাবনা রাখে। প্রতিদিন টেকনোলজি যতো দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে তাতে একদিন, কোনোদিন যদি এ-রকম সুযোগ হয় আমরা অবাক হবো না।
‘আকাশে চোখ মেলে যতোটুকুন দেখা যায়, ততো বড়ো করে আমি আমার নিজের সিনেমা দেখতে চাই।’ সামান্য ছোট্ট কোনো ডিভাইস তৈরি হওয়া সম্ভব। আপনি আপন ছবি একলা দেখছেন অন্য কেউ দেখতে পাচ্ছে না। আকাশের পর্দায় মুদ্রিত হচ্ছে, প্রজেকটেড হচ্ছে, সে-রকম দিন কোনোদিন আসবে না বলতে পারবো না। ‘তবু কেনো আমার সিনেমার রোগ কাটে না?’ কোন্ সিনেমা? আমরা বারবার কেনো সিনেমা সিনেমা করি? সেই সিনেমা-একটা রিচুয়াল... আমার মার সঙ্গে, খালার সঙ্গে, বাবার সঙ্গে, বন্ধুর সঙ্গে একটা ঘরে এসে হাজির হবো। মসজিদ-মন্দির যে-রকম, প্রতিটা শহরে সে-রকমভাবে সিনেমা হল তৈরি ছিলো কোনো এক কালে, আমার শৈশবে, আমার কৈশোরে। প্রার্থনালয়ের মতো করে পর্দায় উদ্ধৃত হতো জীবনের থেকে বড়ো কিছু। আজকে আমরা সেই সিনেমা হারিয়ে ফেললাম। তাই নিয়ে আমাদের এতো দুঃখবোধ, তাই নিয়ে এতো কথা বলাবলি, এতো কথা চালাচালি। তবু আজ সিনেমার জন্যে প্রাণপাত করবার কোনো কারণ দেখি না। টেকনোলজি প্রতিদিন পাল্টাচ্ছে, আমরা বোকা-বাক্স বলে যে টেলিভিশনকে দূরে সরানোর কথা বলে থাকবো, যাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে থাকবো... সিনেমা-প্রেমিকেরা আমরা এতোদিনে জানি, এই ‘বোকা-বাক্স’ ওই আপনার স্বপ্ন দেখানোর... লার্জার দেন লাইফ বা পর্দার চেয়ে বড়ো কিছু দেখানোর শক্তি ধারণ করে। কেনো এতোগুলো টেলিভিশন চ্যানেল হয় আমাদের দেশে? শুধু বিজ্ঞাপন দেখানোর জন্যে নয়। যারা টেলিভিশন চ্যানেল হাজির করেন, তাদের আকাঙ্ক্ষা অন্যতর। আপনাকে আমাকে বিনোদন দেবার জন্যে নয়। কী উপলক্ষ? লক্ষ্য হচ্ছে তার অন্যত্র কোনো সুবিধা যেনো তৈরি হয়। সেটি রাজনৈতিক সুবিধা, সেটি ব্যবসায়িক সুবিধা। কী অর্থে ব্যবসায়িক? উনি এমন কোনো কাণ্ডকারখানা করবেন কিন্তু তাকে ধরতে পারবে না। কে ধরতে পারবে না? আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, রাষ্ট্র। কেনো? তার হাতে জবরদস্ত একটি ক্ষমতা রয়েছে। এ-গুলো নিয়ে চিন্তা করতে হয়। টেলিভিশন আমাদের বিনোদনের জন্য থোড়াই-কেয়ার করে, তার দরকার সম্প্রচার চালু রাখা, তার দরকার নিজের অন্যতর সুবিধাকে নিশ্চিত করা।
আচ্ছা, আমাদের প্রসঙ্গ সিনেমা। সিনেমা নিয়ে হাহাকার করবার প্রয়োজন দেখি না। সিনেমা শেষ হয়ে যাক না! প্রায়ই শুনি এই যে, দেবালয়ের মতন, মসজিদের মতো, মন্দিরের মতো হলগুলো ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। তাই নিয়ে আমাদের হাহাকারেরও কোনো প্রয়োজন নেই; যে যাবার সে যাবে। কিন্তু যাবার আগে কেনো যাচ্ছে সেটা যদি আমরা জানতে চাই, তাহলে সেই সব কথামালা নিয়ে আমরা হাজির থাকি। ...এভাবে কেনো যাবে? কার প্রয়োজনে? কার সুখে? আমাদের সিনেমা দেখবার একটি ক্লাব ছিলো, কেনো একটা ক্লাবের প্রয়োজন ছিলো? সিক্সটি ফোরে যখন এই ভূ-খণ্ডে একটি সিনে-ক্লাব সূচিত হল, তৎকালীন ‘পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি’... তখন আমাদের দেশে ইউরোপ-আমেরিকার সিনেমাগুলো এদেশের রেগ্যুলার সিনেমা হলগুলোতেই দেখানো হচ্ছে। ভারত-পাকিস্তানতো আছেই, নানান ভাষার নানান দেশের ছবি। তবুও একটি ক্লাব তৈরি করার প্রয়োজন পড়লো। আমরা সিনেমা নিয়ে কথা বলি, যেনো আমরা নিজেরা আমাদের নিজেদের সিনেমার একটি চেহারা দাঁড় করাতে পারি। যদিও এটি একটা মেকানিক্যাল প্রসেস। আমরা যেনো এই মেকানিক্যাল প্রসেসটা নিজেদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তুলতে পারি এবং ‘নিজেদের অঙ্গ সঞ্চালনের মতো করে আমরা যেনো আমাদের সিনেমাটা আমরাই নির্মাণ করে নিতে পারি।’
পাকিস্তানিরা চান নাই। তারা বলতে চাইলেন, ‘এ-দেশের আবহাওয়া সিনেমা নির্মাণ উপযোগী নয়।’ আমরা এতোদিনে জানি ‘মুখওমুখোশ’। মুশকিলটা হচ্ছে, আমরা যখন ‘মুখও মুখোশ’ তৈরি করি, ততোদিনে ‘পথেরপাঁচালী’ তৈরি হয়ে গেছে। আমাদের পথ তৈরি হতে আরও কিছুকাল সময় লাগে, লাগবে। সিনেমার ইতিহাস যখন বলতে চাই, বলতে মানে কাগজে-কলমে-বই-পুস্তকে পাই, সেই ইতিহাস সিনেমার একমাত্র ইতিহাস নয়। কিছু মানুষজন তাদের প্রয়োজনে ইতিহাস রচনা করে থাকেন। আমাদের সে-ক্ষমতা ছিলো না, জানান দেবার। এই যে, ‘ভারতবর্ষ’ বলি... এটা আরেক আশ্চর্য শব্দবন্ধ-ভারতবর্ষ। ভোলায় হীরালাল সেন ছবি দেখানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। এই যে সিনেমা, এই পৃথিবীতে হাজির হয় তার মাত্র দুই বছর বাদে... ‘সিনেমা তৈরি হয় বলতে কী,’ আসলে সিনেমা তৈরির প্রক্রিয়া তারও অনেককাল আগের। স্থিরচিত্রের পর চলচ্চিত্রের কেনো প্রয়োজন পড়লো, কেনো দরকার হলো এই প্রযুক্তির? ম্যাজিক। এবং ব্ল্যাক ম্যাজিক। সে-বিষয়ে আরও সময় দিয়ে, মনোযোগ দিয়ে পঠন-পাঠনের প্রয়োজন পড়বে আমাদের। আমরা চলে যাই জহির রায়হানকে কেনো প্রয়োজন পড়লো, সেই কথায়। জহির রায়হান ৫২ সালের ওই প্রথম ১০ জনের একজন। কোন্ ১০ জন? যখন মিছিলে ১০ জনের বেশি হাজির হওয়া সম্ভব ছিলো না, তখন। সেরকম সম্ভবত ইয়ে ছিলো পাকিস্তানিদের, উনি ছিলেন নয় নম্বর মানুষ। নিজে হাত তুলে অন্যের উঁচু করে ধরে প্রথম ১০ জন পূরণ করলেন। আমরা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গবো। গ্রেপ্তার হলেন। তারপরে আরও বিভিন্ন সময় উনি জেলখানায় কাটাইছেন। তার এই যে বড়ো ভাইয়ের কথা বলছিলাম, শহীদুল্লাহ্ কায়সার, তাকে ধরতে এসে জহির রায়হানকে বেঁধে নিয়ে গেছে পাকিস্তানি রাষ্ট্রের তাঁবেদাররা।
এই লোক, লোক বলছি... উনি সাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকার... এর বাইরে যেকোনো লোক হিসেবে তাকে হাজির করতে চাইলে-উনি রাজনীতিবিদ। আপনাদের কারও কি তার প্রথম ছবিটা দেখা আছে? (দর্শকদের উদ্দেশ্য) কখনো আসেনি। কখনো আসেনি, বাংলাদেশের একজন নির্মাতা এ-রকম একটা সিনেমা তৈরি করলেন... কেনো জহির রায়হানের খোঁজ পেতে চাই? কারণ, আমি ফিল্ম সোসাইটিতে এই আপনাদের মতো ফিল্ম-ক্লাব... সেই সংগঠনে বছরের পর বছর... আমার সমস্ত তারুণ্য, সমস্ত যৌবন দিয়ে হাজির থেকেছি, আমি জানি নাই। কারণ, আমার নজর ছিলো রাশিয়ার তারকোভস্কির দিকে, আইজেনস্টাইন জানি, না আরও একটু কনটেম্পরারি কাউকে চাই, দার্শনিক কাউকে চাই। জাপানের ওজুকে চাই। ইয়াসুজিরো ওজুকে আপনারা জানেন... প্রথম দিকে ওনার ছবিতে আমরা দেখি নানান মুভমেন্ট থাকে। তারপর তিনি ছবি তৈরির একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন। সনাতন জাপানিরা যে-রকমভাবে নিচু টেবিলে বসেন, হাঁটু গেড়ে বসেন; ক্যামেরাটা ও-রকম জায়গায় থাকবে স্থির। নড়বে-চড়বে না। যেনো ধ্যান, ধ্যানমগ্ন। তারপর নজর আসে ব্রেসোঁর দিকে। ফ্রেন্স নিউওয়েভের আগে ও পরে আমরা নানান কিছু দেখতে চাই। কিন্তু জহির রায়হানের দিকে নজর দেই নাই আমরা। অথচ, একজন জহির রায়হান আমাদের জন্য খুব প্রয়োজন। যে-অর্থে আমরা বুঝছিলাম যে, আমাদের সিনেমা কেনো জাপানি কিংবা রুশ সিনেমার মতন হয় না। আমরা কেনো বলতে পারি না, এই সিনেমা আমার দেশের, বাংলাদেশের। আমরা ইরানি সিনেমা দেখে যেভাবে আপ্লুত হই, আমাদের সিনেমা দেখে কেনো হই না? ‘সামান্য বিষয় নিয়ে, সহজ সরল বিষয় নিয়ে এরা এতো সুন্দর করে এভাবে সিনেমা কী করে তৈরি করে?’ তাই নিয়ে আমরা ভাবিত হই। প্রথমত মগ্ন হই, তারপর বিষণ্ন হই-‘আমরা কেনো পারি না?’
এই ভাবনাগুলো আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। এবং চাই আপনারা, আপনাদের মনে যেকোনো ধরনের প্রশ্ন তৈরি হয়, সেই প্রশ্নগুলো নিয়ে চলুন আমরা কথা বলি। প্রশ্ন করি। হয়তো উত্তর জানা নেই সেইসব প্রশ্নের... তবুও প্রশ্ন আসে মনে। এবং সেগুলো আমরা বলে ফেলি। মুগ্ধ শ্রোতার অবকাশ আছে, যখন আমি সিনেমা দেখবো তখন কথা না বললে ভালো লাগে, আশপাশের লোকদের সমস্যা হয়। এই বেলায় বরং আমরা কথা বলি। কথামালাগুলো চালু থাকুক। আমি জানি, আন্দাজ করি বা এটা বিশ্বাস করতে চাই আপনাদের মনেও নানান প্রশ্ন জারি আছে। আমার কাজ নয়, সকল প্রশ্নের উত্তর দেবার। ‘কী অর্থে আমার কাজ নয়?’ কারণ, আমার তো এতো দম নাই। বড়োজোর আমি গলা উঁচিয়ে আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে পারবো। ‘এই-এই করতে চাইলাম আমরা। ব্যর্থ হইলাম। কিন্তু সম্ভাবনাটা আপনাদের কাছে...’
আমরা এতোগুলো মানুষ এই দুপুর বেলা হাজির হয়ে গেলাম। তার মানে কোনো না কোনোভাবে সিনেমা প্রসঙ্গে আমাদের প্রেমটা আছে। আমরা সেই প্রেমের একটা ফসল দেখতে চাই। এটা আমাদের আকাঙ্ক্ষা। আমাদের একভাই এখানে বললেন, আমাদের সিনেমার দুরাবস্থার কথা। কারণ নিষ্ফলা সময় আমাদের। আমরা ফসল ফলুক সেটা প্রতিক্ষণ চাই, কিন্তু তার কী উপায়? আমরা কী করলাম, আমরা ‘গোয়াল-ভরা গরু, গোলাভরা ধান’ তার গপ্পো ইতিহাস বইয়ে লিখে রাখলাম। কিন্তু ‘হাঁড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশি’ চর্যাপদে হাজার বছর আগে কেনো এই কথা আসে? কারণ, চিরকাল আমাদের বেশিরভাগ মানুষের এই অবস্থা। আর কিছু মানুষ আমাদের বেশিরভাগ মানুষকে বিভ্রান্ত করে রাখবে। আর আমরা বিভ্রান্ত থাকতে পছন্দ করি। রাজশাহীতে এতো আম ফলে, গরম হয়, আমাদের ঘুম পায়, কাঁঠাল খাই আর ভাতপঁচাই তাই খেয়ে ঝিম... আমরাতো একবেলা খেতে পারলেই খুশি। কেনো খুশি থাকলাম? আমাকে পাথরের সেই সভ্যতা নির্মাণ করতে হয় নাই... সেচ ব্যবস্থার কথা আমাকে চিন্তা করতে হয় নাই... দুর্গম জায়গায় আমাকে পানির ব্যবস্থা করে ফসল ফলাইতে হয় নাই... ধান কাটবার সময় ধানেধানে বাড়ি লেগে নতুন করে ধান গজাবে, এতোটাই উর্বর হাজার নদীর অববাহিকা, পলি মাটির এই বাংলাদেশ। এখন আমাদের ইরি, বোরো ওমুক-তমুক কতোগুলো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রয়োজন পড়লো, কেনো? আমাদের অনেক মুখ, অনেক পেট তাদের নাকি খাবার যোগান দিতে হবে। এতো খাবার কোত্থেকে তৈরি হবে, জায়গা জমিনতো কম। কী ঘটলো? আমরা আমাদের বীজ সংরক্ষণ করতে শিখলাম না। যে-বীজে কম ধান হয়, সে-ধান নস্যাৎ করতে হবে...
আমরা কী করে নদী শাসন করবো সেই টেকনোলজিও আমদানি হলো ফিফটিজ, সিক্সটিজে। কেমন করে বাঁধ দিতে হয়, সেচ দিতে হয়, সার দিতে হয়... কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় তাও শিখলাম আমরা। তবু আমরা এতোদিনে জানি, আমাদের মৌমাছিরও প্রয়োজন আছে, কোলাব্যাঙ প্রয়োজন, সব প্রাণ প্রয়োজন। এই পৃথিবীতে আমার যেভাবে বাঁচবার অধিকার আছে, কীটপতঙ্গেরও বাঁচবার অধিকার আছে। এমনকি আমরা যাদের ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া বলি, তাদেরও বাঁচবার অধিকার আছে। দুঃখের কথা হলো, আমরাতো ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ সেইটাও আমাদের জানানো হইছে। তাই ভেবে কেবলমাত্র নিজেদেরকে হাজির করতে চাইলাম। কিন্তু নিজের সর্বনাশের রাস্তাটাও আমরা নিজেরাই আমন্ত্রণ করে ফেললাম।
জহির রায়হানকে কেনো প্রয়োজন পড়ছে আমাদের? কারণ, আমরা সিনেমায় গল্প বলতে ভুলে গেছি। সিনেমায় শেষ পর্যন্ত একটি গল্প বলা হয়। জহির রায়হান এই ক্ষেত্রে আমাদের জন্য একটি প্রতীকি মানুষ। তার নিখোঁজ হওয়ার ৩০ তারিখের একটি রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। আমরা বলছিলাম, তার বিভ্রান্তির কথা, আজমির শরীফ দৌড়ানোর কথা। যিনি লেট দেয়ার বিলাইট নামে একটি ছবি তৈরি করতে চেয়েছিলেন। সেই ছবি অসমাপ্তই থেকে গেল, ৭০ সালে উনি নির্মাণকাজ শুরু করছিলেন। ৭১-এ তার তত্ত্বাবধানে চারটি ছবি তৈরি হয়। যার দুটি উনি নিজে নির্মাণ করেন, স্টপ জেনোসাইড। এই ছবিটি কি আপনাদের দেখবার সুযোগ ঘটে থাকবে কোনোভাবে? (একজন দর্শকের উত্তর-হলে দেখিনি, ইন্টারনেটে আংশিক দেখা যাচ্ছে)। কোনোদিন যদি সম্ভব হয় আমাদের... স্টপ জেনোসাইড দেখবেন। টেলিভিশনে এখন প্রায়ই দেখানো হয়। ১৬ ডিসেম্বর নইলে ২৬ মার্চ কিংবা ২১ ফেব্রুয়ারি দেখা যায় তার জীবন থেকে নেয়া। আমাদের আজকের যে জাতীয় সঙ্গীত-রবী ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা...’ ৭০ সালে উনি তার জীবন থেকে নেয়া ছবিতে পিক্চারাইজ করলেন। ৬৯-এর গণআন্দোলন, অসহযোগ, পাকিস্তানি সামরিকজান্তার নিষ্পেষণ... আমি তার লিখা ছোট্ট একটা বক্তব্য আপনাদেরকে পড়ে শোনাতে চাই। আন্দাজ করি সেই সময় জহির রায়হানের এই জীবন থেকে নেয়া এর একটা বড়ো ভূমিকা থাকবে ৭০-৭১’এ।
সঙ্কট আছে, আপনারা বিভিন্ন রাজনৈতিক-দর্শন ভাবনার মানুষজন। এই যে উনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সিনেমা তৈরি করলেন। পশ্চিমবঙ্গে আমাদের যে-গভমেন্ট, প্রবাসী গভমেন্ট ছিলো, এটি কিন্তু প্রবাসী গভমেন্টের ফসল নয়, এই চারটি ছবি। উনি হাত পেতে, চাঁদা তুলে এই চারটি ছবি নির্মাণ করেছিলেন। আমাদের গভমেন্টের একটি ১৪ মিনিটের প্রোডাকশন ছিলো। সেটি কে করলেন? এই-যে আমাদের পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রথম চলচ্চিত্র যিনি তৈরি করলেন মুখ ও মুখোশের পরিচালক, আব্দুল জব্বার খান, উনি প্রবাসী সরকারের চলচ্চিত্র বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। আমাদের প্রবাসী গভমেন্ট-এর একাংশ এবং তাদের তাঁবেদারেরা এই স্টপ জেনোসাইড যেনো চিরতরে স্টপ হয়ে যায়, তার জন্যে লিখিতভাবে অভিযোগ তুললো জহির রায়হানের বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গের এইসব চলচ্চিত্রের শ্যুটিং এর সময় আমাদের সরকারের প্রতিনিধিরা তাকে রণাঙ্গনে ঢুকতে দেন নাই। যাই হোক, পরে সম্ভবত আগষ্ট-সেপ্টম্বরের দিকে তারই বড়ো ভাই শহীদুল্লাহ্ কায়সারের কিছু বন্ধুজন, যাদের ভারতীয় সরকারের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্টতা ছিলো, তাদের রিকুয়েস্টে ইন্দিরা গান্ধী স্টপ জেনোসাইড ছবিটাকে ভারতে দেখানোর অনুমোদন দিলেন-এ ছবি দেখানো হলো। অথচ আমাদের এই স্বাধীন দেশ নিয়ে যাদের এতো বড়ো বড়ো কথা-তাদের মাঝে অনেকেই সেদিন চান নাই ছবিটা দেখানো হোক। কেনো চান নাই? এই স্টপ জেনোসাইড শুরু হয় ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের একটা উক্তি থেকে। আমাদের জাতির পিতার ছবি সেখানে কেনো নাই, তাই নিয়ে তাদের সঙ্কট। কিন্তু যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে যখন একটা বিপন্নতার গল্প অন্যদেরকে জানান দিতে হয় তখন বিপন্ন গণমানুষের গল্পটাই যে বলা জরুরি তা তাদের কে বোঝাবে? আমরা সব জায়গায় হাজির করে ফেলতে চাই-আমি, আমিত্ব, আমার হাজিরা। সমস্ত জায়গায় চর দখলের মতো। এখন আমাদের প্রয়োজন একজন জহির রায়হানকে খোঁজ করা-যিনি এই বোধটুকু রাখেন। দেশি সিনেমার এই বিপন্নতার সময়ে আমাদের জানান দেওয়ার প্রয়োজন-দেশের প্রয়োজনে এই জাতি-গোষ্ঠীর মানুষজন কীভাবে হাজির আছে অথচ আমার নিজের হাজিরা নাই।
আজকে প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ, ২১-এ ফেব্রুয়ারি প্রয়োজন পড়ে জীবনথেকেনেয়া হাজির করার টেলিভিশন চ্যানেলে। আমি একবার দেখলাম চারটা টেলিভিশন চ্যানেল একদিনে দেখালো। জীবন থেকে নেয়া কেনো দেখানোর প্রয়োজন পড়লো? আজকে আমাদের ক্যাথারসিস হয়ে গেছে। আর প্রয়োজন নেই, এই বিপন্নতার গল্প বলবার। কিন্তু আজকে এই শোক আনন্দের হয়ে উঠুক। ২১-এ ফেব্রুয়ারি সেখানে আছে, আছে আমাদের ১৬ ডিসেম্বর, তার আগে ৭১-এর সমস্ত দুঃস্বপ্নের কথামালা। তার ইঙ্গিতগুলো পুরোপুরি এখানে আছে।
জহির রায়হান অনেক আওয়াজি মানুষ ছিলেন, দুই দিন পরপরই এক-একটা ঘোষণা দিতেন-ওমুক ছবি বানাচ্ছি তমুককে নিয়ে। এবং উনি আমাদের প্রথম রঙিন ছবি তৈরি করলেন সঙ্গম। প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি এবং সেটা বাহানা। তখন এখানে, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে সে-রকম ব্যবস্থা নাই; তবু ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ঘোষণা দিয়ে ফেললেন, ২১-এ ফেব্রুয়ারি নিয়ে তিনি ৬৫ সালে সিনেমা বানাবেন। মুর্তজা বশির একটি স্ক্রিপ্ট লিখলেন, সেই স্ক্রিপ্ট হারিয়ে গেলো। ছয়-সাত বছরে কোনো খবর নাই। ...দুই দিন পরপরই উনি বিভিন্ন রকম আওয়াজ তুলতেন। তার আওয়াজটা পাকিস্তানি সরকার, মিলিটারি সরকার বিভিন্ন সময় মনিটর করতো। তাকে এক দিন তুলে নিয়ে যাওয়া হলো এফডিসি থেকে। শ্যুটিং ফ্লোর থেকে। জীবন থেকে নেয়ার শ্যুটিংয়ের সময়। এফডিসির ডিরেক্টর, দেখেন আজকের ডিরেক্টর হলে-‘স্যার নিয়ে যান। হ্যাঁ এ্যরে বাইন্ধ্যা নিয়া যান।’ কিন্তু সে-সময় এফডিসির ডিরেক্টরকে রাও ফরমান আলী খান বলছেন-‘এর প্রোডাকশন ক্যানসেল করে দাও,’ ‘স্যার আমরাতো ক্যানসেল করতে পারি না। আমাদের সে-রকম এখতিয়ার নাই। ওটা সেন্সর বোর্ডের দায়িত্বে... এখানে একটা প্রডাকশন শুরু হয়। এটা শেষ করাটাই আমাদের কাজ।’ আজকের আমাদের স্বাধীন দেশের পতাকা ওড়ানো দেশে, যার একটি নিজস্ব মানচিত্র আছে... সেখানে কাউকে যদি এ-রকম বলা হয়? ‘ওকে বেঁধে নিয়ে যান... ক্রসফায়ারে দিয়ে দেন।’ তো উনাকে সেট থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো। মিষ্টি করে উনি সবাইকে বললেন, ‘আমি আসবো, তোমরা থাকো, ফিরে আসছি। আবার কাজ শুরু হবে।’
উনি কী কথা বলছিলেন? ৭০ সালে উনার একটা লেখার থেকে দুইটা লাইন আমি পড়তে চাই। আমি হয়তো অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথা বলবো। আর আমি আপনাদের কাছ থেকে সেই অপ্রাসঙ্গিক কথার প্রাসঙ্গিক প্রশ্নমালা শুনতে চাইবো। ৭০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি উনি একটা প্রেস কনফারেন্স করছিলেন। ওই আওয়াজি প্রকল্প; দুই দিন পরপরই যা করতেন। এবার লেট দেয়ার বিলাইট বানানোর কথা। ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ স্ক্রিপ্ট লিখবেন। তার ভাই শহীদুল্লাহ্ কায়সার ইংরেজিতে ডায়লগ লিখবেন। কেউ রুশ ডায়লগ লিখবেন। এ-রকম বিবিধ রকমের গপ্পো উনি দুই দিন পরপরই আওয়াজ দিতেন। আর ওনার জীবনটাও ছিলো অন্যরকম, তখনতো পত্রিকায় সিনেমাবিষয়ক নায়ক-নায়িকা বিষয়ক অনেক রকমের কৌতূহল ছিলো আমাদের। সেই সূত্রে উনিও অনেক গসিপের কেন্দ্রেই ছিলেন। যাই হোক উনি ১২ ফেব্রুয়ারি ৭০ সালে এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলছেন-আমি প্রাসঙ্গিকতা তৈরি করতে চাই গণযোগাযোগ প্রসঙ্গে। উনি কী বলছেন, উনি বলছেন, ‘আমাদের ছবিতে আজ অবধি রাজনৈতিক জীবন স্থান পায়নি। অথচ জনতার সঙ্গে এ-জীবনের একটা গভীর যোগাযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক উত্থান-পতনের সঙ্গে দেশের সব কিছু নির্ভরশীল। তাই এ-দেশের কথা বলতে গেলে রাজনৈতিক জীবন তথা গণআন্দোলনকে বাদ দিয়ে চলচ্চিত্র সম্পূর্ণ হতে পারে না। আমি তাই গণআন্দোলনের পটভূমি নিয়ে ছবি করতে চাই, বাধা চলবে না। পত্রিকা জনতার সঙ্গে কথা বলে। চলচ্চিত্রও জনতার সঙ্গে কথা বলে। জনতার আন্দোলন, জনতার মিছিল, গুলির সামনে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক এদেশের জনতার ঢলে পড়বার ছবি আর খবর পত্রিকার পাতায় ছাপা হতে পারলে সেলুলয়েডে কেনো ধারণ করা যাবে না।’ এই ছিলো তার প্রত্যাশার কথা।
৭০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি উনি যা প্রত্যাশা করলেন বা যা দাবি করলেন সেই দাবি আজ পর্যন্ত সিনেমা করিয়েরা অর্জন করতে পারেন নাই। খবরের কাগজে আপনি রাজনৈতিক যেকোনো অনুষঙ্গ নিয়ে হাজির হতে পারেন। মন্ত্রীর ঘুষ খাওয়া, র্যাব কখন কাকে তুলে নিয়ে গুলি করলো, কোন্ নেতা বা ব্যবসায়ী গুম হলো সে গল্প। বোমাবাজি, মৌলবাদের আগ্রাসন-আস্ফালন, ওমুক সেলিব্রেটির মৃত্যু বা তার অন্যতর এলেবেলে গপ্পো। যে-গুলো কাগজে ছাপা হয়, যে-গুলো টেলিভিশনে দেখা যায়; কিন্তু আপনি নাটক, সিনেমায় দেখতে পাবেন না। টক-শোতে দেখতে পাবেন, এই টক-শোগুলো সাজানো গোছানো বানানো কথামালা। এবং যে-কথা এই চ্যানেলে, সে-কথা অন্য চ্যানেলে, যে-ইনি এখানে তিনি আবার অন্য সেখানে। সমস্তই একটি সাজানো গোছানো আয়োজন মাত্র। সহজ সাধারণ জীবনের সংবেদনা, পরিপার্শ্বের এই বিপন্নতার গল্প আপনি যদি বলতে চান সিনেমায় সম্ভব নয়। তাহলে আপনি কী করে সিনেমা করবেন? আমাদের জন্যে সিনেমা একটা বড়ো সম্ভাবনা। সমস্ত আয়োজনকে নস্যাৎ করবার ক্ষমতা আমাদের নাই। কিন্তু এই সমস্ত আয়োজনকে পাশ কাটিয়ে নিজের মতো করে হাজির থাকবার সম্ভাবনা আছে। টেকনোলজি। সিনেমা করতে কোটি কোটি টাকার প্রয়োজন। এবং সব সিনেমা করতে কোটি টাকার প্রয়োজন নাই। আপনাদের যদি মনে পড়ে সময় টেলিভিশন-এ একটা ছোট ফিচার, একজন কেউ সেলফোনে ধারণ করলো। কী সেটা? ছিনতাইকারী বা ইয়ে সন্দেহে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হলো। পুলিশ নিয়ে এলো। জনগণের হাতে তুলে দিয়ে বলা হলো ‘একে মার!’ আমজনতা গায়ের ঝাল মিটিয়ে, ইটা দিয়ে ছেঁচে পুলিশের গাড়িতে তুলে দিলো; পুলিশ পুরো ঘটনাটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো। একটি সামান্য সেলফোন। আমি বলছি না যে সেলফোনেই আপনাকে সিনেমা তৈরি করতে হবে। সম্ভব, হাজার হাজার মানুষের আকাঙ্ক্ষা এখন সিনেমা তৈরিতে। এটি সবচেয়ে বড়ো সম্ভাবনার জায়গা... সম্ভাবনার জায়গাটা করে দিলো টেকনোলজি।
এখন আমাদের আরেকটু খেয়াল রাখতে হবে... আমি টেলিভিশনে কাজ করি, আমি টেলিভিশন করে খাই। বলা ভালো টেলিভিশনে নাটক বানাই। আর কী কথা বলছি? সিনেমার কথা। সেই টেলিভিশন যার কথা বলছি, যার কোনো ভিশন নাই। আবার বলছি টেলিভিশন কিন্তু বোকা-বাক্স নয়। টেলিভিশন ভীষণ চালাক। এই বিভীষণের হাত থেকে রেহাই নাই; এদিকে লঙ্কা পুড়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রয়োজন নিজেদের সংরক্ষণ। কী সংরক্ষণ করবো আমরা? সময়, তারুণ্যের শক্তি, আর অন্তর্গত ভালোবাসা। ভালোবাসা ছাড়া রেহাই নেই। ভালোবাসার অ্যাক্টিং নয়। আমি সিনেমা বানাবো-সিনেমা বানাবো বলে ঘুরে বেড়াবো, বন্ধুদের কাছে থেকে পাট নিয়ে বলবো আমিতো ওমুক সিনেমা বানাচ্ছি। ‘আরে দেখছিস ওমুকের ছবি? আর ব্রেঁসো কী বলছে শোন... আর তারকোভস্কি-অ্যা গুরু একখান’ এই করে নিজেকে না ঠকাই। এই কাজটা আমরা করতাম, আমি নিজে করে আসছি। আর তার জন্যেই হয়তো আপনাদের কাছে এই হাজিরা... আপনারা সময় অপচয় না করে আমার মতো এই ভঙ্গির-রাস্তায় হাজির না হোন। আর তারুণ্যের অপচয় মানে আমাদের কোনো বেড়ে ওঠা নেই। আপনার দায় নেই সিনেমা বানানোর। সিনেমা নিয়ে যদি আপনি স্বপ্ন দেখেন, আপনি তো অন্তত আন্দাজ করতে পারবেন কোন্ সিনেমা আমার (নিজের)। কোন্ সিনেমা আমার পরিপার্শ্বের জন্যে; এই দেশের জন্যে, জীবনের জন্যে। কোন্টা ধ্বংসগামী, কোন্টা বেড়ে উঠবার, লালন করবার। আমরা কী লালন করতে চাই? কী চাইবো? সবাই মিলে ভালো থাকি, তাইতো? আচ্ছা সিনেমা শিল্প, সিনেমা আর্ট সেইগুলো আপনারা নিজেরা জানেন। আরও আরও বিবিধ আর্টের সঙ্গে কী ফারাক, কতোটা সম্মিলন, কতোটা দূরত্ব, কী সম্ভাবনা, কী অসম্ভাবনা? আপনাদের আমার বলবার কথা শুধু সিনেমা আগামীকাল না থাকলেও কিছু আসে যায় না, কিন্তু আপনি যদি মনে করেন কোনোভাবে সিনেমা আপনাকে টানে এবং সিনেমায় আপনার সেই প্রেমের প্রকাশটুকুন দেখতে পান-তাহলে সেই সিনেমার জন্যে আরেকটু যত্নশীল হই, একটু কথা কই, একটু প্রেমালাপ করি, যদি পারি ঝাঁপাইয়া পড়ি। আর না পারলে দূরে থাকি, দূর থেকে তাকে লালন করি।
আমরা জহির রায়হানে আবার ফেরত যেতে চাইবো। জহির রায়হানের প্রথম ছবি নিয়ে আমরা কথা বলছিলাম কখনো আসেনি। কিন্তু তার আগে ৫৯ সালে মুক্তি পাওয়া আকতার জং কারদারের জাগো হুয়া সাভেরায় তিনি সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। সম্ভবত ৫৭-তে ছবিটির কাজ শুরু হয়। কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ পদ্মা নদীর মাঝি নিয়ে স্ক্রিপ্ট লিখলেন জাগো হুয়া সাভেরার। সাধন রায় নামে আমাদেরই একজন ক্যামেরাপার্সন কাজ করলেন সেই ইউনিটে। তৃপ্তি মিত্র এলেন অ্যাক্টিং করতে, খান আতা সেখানে মেজর ক্যারেক্টার করলেন, আর জহির রায়হান ছিলেন ওই ছবির একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট। তখন জহির রায়হান বাংলা ডিপার্টমেন্টে পড়েন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। কোনো না কোনোভাবে সম্ভবত শহীদুল্লাহ্ কায়সারের সূত্রেই তার সেই হাজিরা। তো উনি সিনেমা বানাবেন এ-রকম কোনো ইয়ে তার ছিলো না তখন। এমন কোনো আকাঙ্ক্ষা বড়ো কোনো আকাঙ্ক্ষা, সিনেমা করে তাকে বড়ো হতে হবে, ফিল্মমেকার হতে হবে সে-রকম কোনো বিষয় তার ছিলো না। যাই হোক জাগো হুয়া সাভেরার অভিজ্ঞতা তাকে সিনেমায় টেনে আনতো। উনি প্রথম কী সিনেমা তৈরি করলেন? একজন শিল্পীর অন্তর্দ্বন্দ্ব। কীসের সেই অন্তর্দ্বন্দ্ব, আমরা আর্টিস্ট নিয়ে আরও বিভিন্ন ধরনের কাণ্ড-কারখানা আমাদের সিনেমায় দেখবো কিন্তু একজন শিল্পী, একজন পেইন্টারের জীবন নিয়ে এই কতো সাল হবে, উনিশশো একষট্টিতে কখন ও আসেনি সিনেমাটা করলেন। আর কোনো সিনেমা করিয়ে একজন ব্যক্তি হিসেবে, শিল্পীর জীবনযাপন, তার অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে সিনেমা তৈরি করেন নাই। এটা দুঃসাহস, একটা নতুন ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে থেকে এই ধরনের একটি ছবি এবং প্রথম ছবি করা মুশকিলের কথা। উনি এ-ধরনের দুঃসাহস বারবার করে থাকবেন।
তারপরের বছরই সম্ভবত উনি একটা ছবি করলেন। আমি সেই ছবিটি দেখি নাই। সোনার কাজল ৬২ সালে। কাঁচের দেয়াল যদি আপনাদের দেখবার সুযোগ হয়... আমার দেখা থাকবে। মিডল্ ক্লাস ফ্যামিলির অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, তার সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক চাপ সেই সিক্সটি থ্রিতে। কী সেই চাপ? আমরা কিছুকালের মধ্যেই জানবো, আমাদের কেনো রবী ঠাকুরকে ঠাকুর পূজা করতে হবে, কারণ আরেকজন ঠাকুরকে হঠাইতে হবে। আবার হারমোনিয়াম, তবলা থাকে প্রতি বাড়িতে, গান তারা শিখবেন, যদিও মুসলমানের পুত্র-কন্যা। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণ যুগপৎ মধ্যবিত্তে একটা সঙ্কট তৈরি করবে। অন্য ধর্মাবলম্বীদের এই সঙ্কট ছিলো না, মুসলমানেদের মধ্যে এই প্যাঁচ ছিলো...। আমরা দেখতে পাবো সে-রকম একটি মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে টানাপোড়েনের গল্প। অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক টানাপোড়েনের গল্প, প্রায় পুরোটা এফডিসির সেটে তৈরি। একটা-দুইটা শট আউটডোরে এবং কখনও আপনার মনে হবে না এটা চেম্বার মুভির জায়গা থেকে যে, এটি বোরিং বা আপনাকে কোনো না কোনোভাবে মনে করিয়ে দিচ্ছে আমি একটা বাক্সের মধ্যে আছি। কারণ এর প্রত্যেকটা মুহূর্ত আপনার চেনা। এই বাঙালি জানে, বাঙালি মুসলমান জানে, এই দেশের মানুষজন প্রত্যেকটা মুহূর্ত জানে। ওই শোবার ঘরে, পড়ার ঘরে, রান্না ঘরে যেই মানুষটা এই মুহূর্তে হাজির আছে তাদের উপস্থিতিতে আমরা বুঝি বাইরের কী গল্প-চাকরি-বাকরির হালচাল, রাজনীতি, বাজার-সদাই... আমরা জানি দুই বোন পরস্পরের সঙ্গে কী আচরণ করে, কার কী সাধ, কী ঘটে অন্তরে।
যাই হোক, কাঁচের দেয়াল-এরপরে আমরা একই জিনিস আমরা পরবর্তীতে জীবন থেকে নেয়া-তেও দেখবো। কাঁচের দেয়াল-এর পরে ওনার সেই ছবিটি (সংগম ৬৪-তে) আমার দেখার সুযোগ হয় নাই। হঠাৎ করে উনি আওয়াজ তুললেন, রঙিন ছবি বানাবেন। উনি একুশ দিনে একটা রঙিন ছবি তৈরি করে ফেললেন। এবং সেই ছবি পশ্চিম পাকিস্তানি মেকারের আগেই কমপ্লিট করবেন। পশ্চিম পাকিস্তানে সেটা শো হচ্ছে, পাকিস্তানে নির্মিত প্রথম রঙিন ছবি হিসেবে... ঢাকায় হচ্ছে মানে বাংলাদেশে কয়েকটা হলে। আপনারা চাইলে ইন্টারনেটে এই সঙ্গম-এর গান দেখতে পাবেন, এখন কেউ সেটা আপলোড করে থাকবে। অদ্ভূত সুন্দর তার পিকচারাইজেশন। আচ্ছা যাই হোক আমরা হিন্দি ছবি দেখে আপ্লুত হই সেই সময়... আপনি জহির রায়হানের ছবি দেখলেও একই রকমভাবে আপ্লুত হবেন। কারণ এই ছবিগুলো আমরা দেখতে পাই না, দেখার সুযোগ ঘটে না। পরের বছর ৬৫ সালে পাকিস্তানের প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি বাহানা নির্মাণ করলেন। উনি বাহানা করলেন সিনেমাস্কোপ ছবি, আবারও তাকে সিনেমাস্কোপে ছবি করতে হবে। কিন্তু আমাদের এখানে কোনো টেকনিক্যাল ইয়ে নাই, আয়োজন নাই। এফডিসিতে লেন্স নাই। উনি সিনোমাস্কোপ ছবি করবেন। কোনো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান তাকে বলে থাকবেন যে আমরা এগুলা অ্যারেঞ্জ করবো। আলটিমেটলি উনি এগুলো নিয়ে অনেক হাঙ্গামা করতে শুরু করলেন। এরপর হঠাৎ করে তার বেহুলা বানানো, ৬৬ সালে। তার আগের ছবিগুলির প্রায় সবকটি একেবারেই ফ্লপ। কখনো আসেনি, কাঁচের দেয়াল কোনোটাই ব্যবসা করতে পারেনি। সঙ্গম করে তিনি কোনোরকমভাবে একটু ফেরত আসতে পারলেন। বাহানা করে কিন্তু উনি রূপবানের পথে পা বাড়ানো শুরু করলেন।
রূপবান একটা বড়ো ঘটনা বাংলাদেশের সিনেমায়। এতোকাল আমাদের সিনেমা দর্শক ছিলো শুধুমাত্র মিডল-ক্লাস। রূপবান নিম্ন আয়ের মানুষজন, কৃষিভিত্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষজনকে সিনেমা হলে নিয়ে আসলো। সিনেমা হলগুলো হঠাৎ করে চাঙ্গা হয়ে গেলো। নৌকার মধ্যে খাবার-টাবারের আয়োজন করে তিন গ্রাম, পাঁচ গ্রাম পরে কোথাও একটা সিনেমা হল আছে, হয়তো টিনের একটা ঘর-সেখানে গিয়ে মানুষ হাজির হলো। তিন দিনের জার্নি করে এসেও মানুষ সিনেমা দেখেছে। রূপবান বাংলাদেশের সিনেমার জন্য একটা অনেক বড়ো ব্যাপার। উনি সেই পথে পা বাড়াইলেন-এগুলো আমাদের মাথায় রাখা জরুরি। কারণ যেই লোক ৫২ সালের ১৪৪ ধারা ভাঙতে প্রথম ১০ জনের মধ্যে হাজির হন, ৫৮ সালে সামরিক আইনের কবলে জেলখানায় যান তিনিই আবার উর্দুতে ছবি বানান। একটু পরিষ্কার করে বলে রাখা প্রয়োজন, আমরা এই আজকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করি। কী করি? আমার দেশের কতোগুলো জনগোষ্ঠী আছে যারা বাংলা ভাষাভাষী নন। তাদের মাতৃভাষায় আমরা শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারি নাই। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করি আমরা, শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাই। কী কথা, কী আচরণ করে যাচ্ছি আমরা? একজন মান্দির (আদিবাসী গোষ্ঠীর নাম) কী সঙ্কট যে তাকে আমরা কেনো তার ভাষায়, মাতৃভাষায় পড়তে দিতে পারলাম না; অন্তত প্রাথমিক শিক্ষাটুকু? অনেকে দাবি করলেন, আমি অনেকের সঙ্গে ইন্টারভিউ করছিলাম, ভাষা নিয়ে একটা এপিসোড, ‘চন্দ্রবিন্দু’ নামে একটা অনুষ্ঠানের জন্য। সিলেটের মণিপুরী একজন শিক্ষক বলছেন, ‘দেখেন আমরাতো বাংলা ভাষায় কথা বলি, বাংলাভাষাতো ঠিক আছে, এটা প্রয়োজন। কিন্তু আমার এ বাচ্চাগুলোকেতো হঠাৎ করে বাংলায় টেনে আনা মুশকিল... প্রথম, প্রাইমারি স্কুলটাতে আমরা যদি আমাদের নিজেদের মণিপুরী ভাষায় পড়াতে পারতাম। তাহলে বাংলা ভাষায় এদের জন্য পরবর্তী শিক্ষা সহজ হতো’-সহজ সাধারণ কথা। ৫২-তে এই একই দাবি নিয়ে আমরা হাজির হলাম, অথচ আজ আমরা অন্য কারও কথা শুনতে রাজি না।
আমরা মাতৃভাষা দিবস, আন্তর্জাতিকতা করি... আচ্ছা কী প্রসঙ্গে যেনো এটা বলতে গেলাম? অ্যা জহির রায়হান, উনি উর্দুতে ছবি তৈরি করতে গেলেন। আবার দেখেন এখন আজকে বেশিরভাগ মানুষের কাছে, উর্দু মানেই হচ্ছে-আমরা সেজান জুস খাবো না-পাকিস্তানি; আচ্ছা ক্রিকেট টিমকে কে সমর্থন করলো? আমরা উর্দু ভাষা পড়া বন্ধ করে দিলাম। এটা আরেক রকমের খারাপ আচরণ। এটা আবারও একটা খারাপ রাজনীতির অংশ। এ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে আমাদের বের হবার প্রয়োজন, যেনো এ-গুলো আমরা আমাদের কাজের মধ্যে, সিনেমার মধ্যে দেখতে পাই, সেইটুকুন। আচ্ছা জহির রায়হানকে হাজির হতে হলো। উনি উর্দুতে সিনেমা তৈরি করতে থাকেন। শুধু উর্দুতে না, উনি এমন আয়োজন করলেন-চাইনিজ ভাষায়, রুশ ভাষায় কী কী যেন... ডাবিং করে উনি লেট দেয়ার বিলাইট করবেন।
তখন আওয়াজ দিয়ে ফেলছে, সিক্সটি ফাইভে; ওই সময় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় কেবলমাত্র ভারতীয় বাংলা সিনেমার আসা একটু বন্ধ হলো। কিন্তু ততোদিনে আমাদের সারাদেশে কলকাতার বাংলা ছবি, হিন্দি ছবি, ইউরোপিয়ান ছবি, ফ্রেঞ্চ বলেন, ইতালিয়ান বলেন, রুশ বলেন-সেগুলো এই দেশে শো হচ্ছে। যখন সিক্সটি ফোরে আমরা আবার ফিল্ম সোসাইটিও তৈরি করলাম, পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি পরবর্তীতে বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটি... তো এই ফাঁদে পা দিয়ে নিজে কিছুদিন বাদে হয়তো টের পেলেন, তিনি একটা ফাঁদে পা দিয়েছেন। সেটা হচ্ছেরূপবানের ফাঁদ। কী সেই ফাঁদ? যে মানুষটা এই দেশে বঙাল দেশের একজন নির্মাতা, একজন আর্টিস্টের ক্রাইসিস নিয়ে সিনেমা করতে পারেন; কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি বেহুলা তৈরি করলেন, আনোয়ারা তৈরি করলেন। একই ধরনের কিছু ছবি প্রযোজনাও করলেন। কী করবেন, কারণ তার প্রোডাকশন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, টাকা-দেনার দায়ে তিনি অস্থির। আবার রূপবান-এর সাফল্যে সেই রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলেন। বেহুলাটা ডিভিডি পাওয়া যায়; সেইটাও দেখতে পাবেন, কখনো আসেনি ও পাওয়া যায়, কাঁচের দেয়ালও সম্ভবত পাওয়া যায়, আর জীবন থেকে নেয়া তো পাওয়াই যায়। তারপরও দেখেন ডিলেমাটা কী, ওনাকেই বেশকিছু ছবি উর্দু ভাষায় নির্মাণ করতে হলো। যেখানে তিনি নিজে সরাসরি বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এই হলো সিনেমার প্যাঁচ।
একটা মাফিয়া চক্র... সিনেমা গরীব লোকের কাজ না, তার মানে বড়োলোকের কাছে গিয়ে বুঝাইতে হবে, যদি নিজে বড়োলোক না হও। আর বড়োলোক, কী করে বড়োলোক হবে, আর এই দেশে কী করে বড়োলোক হবে, এই দেশে কারা বড়োলোক হলো, আমাদের দেশে কী কোনো ইন্ডাস্ট্রি ডেভলপ করা গেলো?... স্বাধীনতার ৪০ বছর পর আজকের এই সুঁই-সুতার ইন্ডাস্ট্রি, আর ঘাম ঝড়ানো মিডিল-ইস্টে গিয়ে শ্রম বিক্রি, তার ইন্ডাস্ট্রি। আমরা রডের কারখানা বানাইলাম। আমাদের গভমেন্টের স্টিল মিলস ছিলো সেটাকে বন্ধ করতে পারলেই বিএসআরএম, আরএসআরএম এর পথ সুগম হয়। আমরা যদি আমাদের পাটের কাণ্ডকারখানাটা ধ্বংস করতে পারি তাহলে অন্যদের সুবিধা হয়, সেইখান থেকে আমি কিছু সুবিধা পাই। কী করবো, আবার আমরা পাটের জিন নিয়ে আমাদের জ্বীন-পরীর দশা। এখন হঠাৎ করে আমরা সমুদ্রের সন্তান হইলাম। এতোদিন কি খেয়াল ছিলো না, সমুদ্র ছাড়া যে তোমার অন্য কোনো গতি নাই? ...মুশকিলটা হচ্ছে আমরা তো অভিযাত্রী নই; আমরা পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যাওয়া মানুষ। একবার শুধু ঘাড় ফিরে তাকানোর চেষ্টা... ৭১-এ। মুক্তিযুদ্ধ-এই জাতির সবচেয়ে বড়ো অর্জন। সেটাকে নিয়েই আবার টানা হ্যাঁচড়া করে যাচ্ছে, করে খাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। কী করবো আমরা! কিন্তু আমরাতো চাই প্রত্যেকে সকলে মিলে কী করে ভালো থাকি, থাকতে পারি, এতো চাহিদা তো নাই আমাদের আসলে। কিন্তু কিছু মানুষের অনেক চাহিদা। কিছু মানুষের কারণে আমাদের গ্যাড়াকলে পড়তে হবে। আর জহির রায়হানকে আমরা খুঁজে পাব না, তাকে আমাদের উধাও করে দিতে হবে।
আপনারা এতোদিনে হয়তো জানেন উধাও করার গল্পটা কী? ৩০ তারিখের যে-গল্পটা। কী সে, ভোরের কাগজ-এ চারটা স্লটে রিপোর্ট করছিলেন; ভুলে গেছি ওনার নাম। গত ৪-৫ বছর আগে জানা গেলো। জহির রায়হান যখন এতো উতলা, তার ভাইকে খুঁজবার নাম করে উনি উধাও হয়ে গেলেন, মিরপুরে গিয়ে। উধাও হয়ে গেলেন, পরে জানলাম তিনি আসলে কনফ্রনটেশনের মধ্যে মারা গেছেন। বিহারি ভাইদের সঙ্গে আমাদের বাঙালি মুসলমান ভাইয়েরা ছিলো, আর্মি-পুলিশ এসবের চক্রের মধ্যে উনি মারা গেছেন। সরকারিভাবে আমরা তা জানি না। সেটা জানতে আমাদের একজন রিপোর্টারের ওপর ভরসা করতে হয়। উনি যদি এটা খুঁজে বার না করতে পারতেন, তাহলে আমরা জানতেই পারতাম না। চিরকাল নিখোঁজ দিবস, ৩০ জানুয়ারি নিখোঁজ দিবস। জহির রায়হান অন্তর্ধান দিবস। আমরা তা-ই করে আসছি ফিল্ম সোসাইটিতে। জহির রায়হানের অন্তর্ধান দিবস। তাকে নিয়ে আমরা ২-৪টা আবোল-তাবোল গপ্পো বলে গল্প শেষ...জহির রায়হানের খোঁজ আমাদের প্রয়োজন। কারণ উনি জানেন, আমাদের স্বাধীন এই রাষ্ট্রটি কোন্ভাবে গঠিত হইছে।
সার্বভৌম রাষ্ট্র, সার্বভৌমত্ব নিয়ে আমাদের বিভিন্ন রকম অস্থিরতা তৈরি হয়। এটা যদি এইরকম হয়, তাহলে কেনো এই রকম? সেই গল্পটা উনি পুরোটা জেনে গেছিলেন। কারা এই কাণ্ডকারখানার মধ্যে জড়িত। গোঁয়াড় গোবিন্দ। যে-রকমভাবে এর আগে বলছিলাম, দুদিন পরপরই ঘোষণা দিয়ে ফেলতেন-এটা করবো, ওটা করবো। এই ছবি, ওই ছবি। একইরকমভাবে ভাই হারানোর পরে মাথাটা গেলো, প্রেসক্লাবে উনি আওয়াজ দিয়ে ফেললেন-যদি ২৭ তারিখের মধ্যে আমার ভাইকে খুঁজে না দেওয়া হয়, তাহলে আমি এই গভমেন্টের লোকেরা কলকাতায় গিয়ে কে কী করছে সব বলে দেবো। বিপদের কথা, ভয়ঙ্কর বিপদের কথা। গোঁয়াড় গোবিন্দ লোক উধাও হয়ে গেলেন। কিন্তু আমরা শুধু তার এই খোঁজখবর করতে চাই না। আমরা চাই আরও কিছুর খোঁজখবর করতে। সিনেমার একটা জাতীয় চরিত্র, স্বভাব, সম্ভব কিনা? সিনেমাতো নিজেই একটি আন্তর্জাতিক চেহারা। তবু কেনো আমরা বলি ইরানি ছবি, কেনো আমরা বলব জাপানি ছবি, কোরিয়ান ছবি, কেনো আমরা বলি রুশ ছবি? বাংলাদেশের ছবি কেনো বলতে পারি না? আমরা বাংলাদেশের সিনেমার নিজস্ব চেহারাটা কী হতে পারে, তাই নিয়ে যদি কথা বলতে চাই। তার জন্যে, বিশ্বের বড়ো বড়ো সিনেমাকরিয়ের নাম নেওয়ার আগে জানা প্রয়োজন জহির রায়হান এই দেশে কোন্ সিনেমাগুলো রচনা করছেন।
দেখেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...’ ঠাকুরের এই গান, কতোকাল ধরে ওই ছায়ানটের আগে থেকেই তো চালু আছে। যখন উনি জীবনথেকেনেয়া হাজির করেন তখন উনি আমাদের নজরে আনেন। যেটা আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হতে পারে। এবং একই জায়গায় উনি ইকবালের কবিতার গানের চিত্রায়ণ করেন, একই সঙ্গে উনি নজরুলের ‘কারার ওই লৌহ-কপাট...’ নিয়ে এসে হাজির করেন। তাই জহির রায়হান আমাদের পাঠ করা প্রয়োজন। যদি আমরা বাংলাদেশের সিনেমার নিজের কোনো চরিত্র দেখতে চাই বা স্পষ্ট করে সেটাকে আমাদের আকাঙ্ক্ষায় রাখি যে, ‘আমাদের সিনেমাটা হবে এইরকম।’ এতোদিনে আপনারা জানেন যে, কলকাতার বাংলা ভাষা আর ভাটির বাঙাল দেশের আমাদের বাংলা ভাষার মধ্যে ফারাক তৈরি হয়ে আছে; হবার সঙ্গত কারণও রয়েছে। আমরা নিজেদের এই পরিচয়টুকুন উদ্ধার করতে চাই। উদ্ধারের কেনো প্রশ্ন আসলো? কারণ, এলেবেলে করে আমরা লেপ্টে রেখে দিতে চাই। কেব্লা আমাদের প্রথমে পশ্চিম, আবারও পশ্চিম তারপরে আবারও পশ্চিম। কেব্লাটা নিজের দিকে কবে আনতে পারবো? আমরা যেনো কেব্লাটা ঠিক করে ফেলতে পারি।
সিনেমা যদি আপনার করবার ইচ্ছে থাকে বা সিনেমা নিয়ে আপনি কোনোভাবে ভাবিত হন তাহলে আপনাকে ভাবতে হবে, এইটুকুন... বা অনুমোদন করতে হবে কিংবা ইনভাইট করতে হবে। কী ছবি আমি দেখবো? এই ছবি কি আমার ছবি? এই ছবি কি আমাকে বিপন্ন করে? এই ছবি কীটনাশক কি না? আর আমি কি কীট? আপনারা জেনে থাকবেন, মনেরমানুষ; ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় একটি ছবি কিছুকাল আগে দেখলাম। আমার কুষ্টিয়ার ওই বড়োভাই বন্ধুরা-যাদেরকে আপনারা বাউল বলেন, সাধক বলেন, তাদের মধ্যেও আমি কোনোরকম প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলাম না। এই প্রতিক্রিয়া না পেয়ে আরও রাগ করি-তারা জানলেন গল্পটা কী, তারপরও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই! কারণ দুটি রাষ্ট্রের একটি বড়ো ঘটনা... কী ঘটনা? ওই-যে সাঁইজির গান দেখাইছে। ওই গানে কী বলা হইছে? গান তো আছে। গানের লাইনের ফাঁকফোকরে কী আছে? তাদের সাঁইজিরে একবার হিন্দু, একবার মুসলমান বানানো হইলো, আবার তারে হিন্দু বানানো হইলো-সেই গপ্পো তাদের চোখে পড়লো না। কী করবো, আমাদের কোনো বুদ্ধিজীবীরা কথা বললেন না। দুই-একজন লেখালেখি করে বলার চেষ্টা করলেন যে বিষয়টা এতো আরামের নয়। ভারত-বাংলাদেশ বা লালন ফকির নিয়ে একটি সিনেমা তৈরি হয়েছে-বাহ্, যা হবে তাই ‘বাহ্ বাহ্’ বলে আমরা হাজির থাকবো। এমনকি সকলে লাইন ধরে গিয়ে টিকেট কেটে আমরা ছবিটা দেখবো। আচ্ছা খুব ভালো। লাইন ধরে টিকেট কেটে ছবি দেখা সেতো সুলক্ষণ। কিন্তু দুর্লক্ষণ হচ্ছে এই সিনেমার বিষয় নিয়ে আমাদের কোনো প্রতিক্রিয়া কেনো তৈরি হবে না? তাহলে আমিত্বের জায়গাটুকুন? সারাক্ষণ ‘আমি আমি’ করি, কিন্তু আমি মানে সমগ্র মিলে যে-আমিত্ব পুরোটা ধ্বংস করে দিয়ে গেলো, সে-বিষয়ে কথা কেনো থাকবে না?
যাই হোক আমরা বলছিলাম জীবন থেকে নেয়া...এখন লেট দেয়ার বিলাইট, তার অসমাপ্ত ছবি। আমি তার ভাবনার জায়গা থেকে কয়েকটা লাইন উদ্ধার করে একটুখানি পড়তে চাই। উনি ৬৫ সালে এই ছবিটা তৈরি করতে চাইলেন, পরবর্তীতে বিভিন্ন আওয়াজ-টাওয়াজের পর ৭০ সালে এটার শ্যুটিং শুরু করলেন। তারপরে তো ৭০-এ এসব অস্থির অবস্থার মধ্যে উনি এটা শেষ করতে পারলেন না। শুধু আওয়াজ না, সেখানে পাঁচটা ভাষায় সেটি ইয়ে হবে, একটু আগে বলছিলাম ডাব হবে, কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ সেটার স্ক্রিপ্ট লিখবেন। মিখাইল সলোকভ তার রুশ সংলাপ লিখবেন এসব এসব চলছে। আচ্ছা ওনার কাহিনীটা কী ছিলো?
‘তবু মানুষের এই দীনতার বুঝি শেষ নেই...’ আর উনিতো লেখক, কিন্তু শেষ দিকে... না, প্রায় শুরুর দিকে একটা ভঙ্গি নিলেন উনি লিখতেন না, লিখতেন ওনার এসিস্ট্যান্টরা, উনি বলে যেতেন আর ওনারা একাধারে লিখে যেতেন। একসঙ্গে একাধিক স্ক্রিপ্ট লিখতেন। কারণ, অজস্র আইডিয়া। তাকে দুই দিন পরপরই নতুন নতুন সিনেমার ঘোষণা দিতে হবে। এবং বেশির ভাগই হবে না। তো একসঙ্গে উনি ৩-৪টা স্ক্রিপ্ট লিখতেন। মানে, মানে ইয়ে উনিই হিরো, মানে জীবনের হিরো। ...আচ্ছা, উনি বলছেন-
‘তবু মানুষের এই দীনতার বুঝি শেষ নেই। শেষ নেই মৃত্যুরও, তবু মানুষ মানুষকে হত্যা করে। ধর্মের নামে, বর্ণের নামে, জাতির নামে, সংস্কৃতির নামে। এই বর্বরতায় অনাদিকাল ধরে আমাদের পৃথিবীর এই শান্তি বিপন্ন করেছে। হিংসার এই বিষ, লক্ষ কোটি মানব সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। জীবনকে জানবার আগে, বুঝবার আগে, উপভোগ করবার আগে। ঘৃণার আগুনে পুড়িয়ে নিঃশেষ করেছে অসংখ্য প্রাণ। কিন্তু মানুষ মরতে চায় না, ওরা বাঁচতে চায়। এই বাঁচার আগ্রহ নিয়েই গুহামানব তার গুহা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। সমুদ্রে সাঁতরেছে, তপ্ত মরুর পথে পাড়ি জমিয়েছে, পাহাড়পর্বত পেরিয়েছে ইতিহাসের এক দীর্ঘ যন্ত্রণাময় পথ পেরিয়ে সেই গুহামানব এগিয়ে এসেছে অন্ধকার থেকে এই আলোতে। বর্বরতা থেকে সভ্যতার পথে। মানুষের এক চিরন্তন যাত্রা। জ্ঞানের জন্য, আলোর জন্য, সুখের জন্য। তবু আলো নেই; শুধু অন্ধকার। তারপর তারপর অন্ধকার পথের শেষে সহসা নিজের সেই অফুরন্ত মিছিলের মাঝখানে আবিষ্কার করল ওরা। একটা সীমহীন সমুদ্রের পাড় ধরে মানুষগুলো এগিয়ে চলেছে সামনে। ছেলে, বুড়ো, মেয়ে, শিশু, যুবক-যুবতী দীর্ঘ পথচলায় ক্লান্ত অবসন্ন, জীর্ণ, শীর্ণ, বিবর্ণ, ক্ষত-বিক্ষত দেহ আর অবয়ব। আমরা কোথায় ভিয়েতনামে না ইন্দোনেশিয়ায়? জেরুজালেমে না সাইপ্রাসে? ভারতে না পাকিস্তানে? আমরা কোথায়? জানো-ওরা আমার ছেলেটাকে হত্যা করেছে হিরোশিমায়। ওরা আমার মাকে খুন করেছে জেরুজালেমের রাস্তায়, ওরা আমার বোনটাকে ধর্ষণ করে মেরেছে আফ্রিকায়। ওরা আমার বাবাকে মেরেছে ওপেন হোল্ডেড গুলি করে, আর ভাই তাকে ওরা ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। কারণ সে মানুষকে ভীষণভাবে ভালোবাসত।’
এ-রকম একটি ভাবনা থেকে তার এই অসম্পূর্ণ ছবি শুরু করেছিলেন। আমার কিছু ফুটেজ দেখবার অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে; তাও অনেককাল আগে। ৯০-৯২ এর দিকে। উনি যদি ছবিটা শেষ করতে পারতেন, সেটা কতো ভালো ছবি হতো না খারাপ ছবি সে-গুলোর বাইরে যে-টুকুন আন্দাজ করতে পারি... আমরা যে-জহির রায়হানকে জানতাম এর আগের সিনেমা পর্যন্ত, থেকে অন্যতর একটা শিল্পী মানুষকে অন্তত খুঁজে নেওয়া সম্ভব ছিলো। আপনারা জানেন এতোক্ষণে, উনি ওনার চিত্রনাট্যের যে-ভাষা... কম-বেশি ওনার সাহিত্যের ভাষার কাছাকাছি। এ-রকম ছোট-ছোট বাক্য দুই এক শব্দের, তিন শব্দের বাক্য দিয়ে সাহিত্য তিনি লিখেছেন।
আমরা কি ব্রেক দিবো, নাকি চলবে; আমরা কি ছোট একটা ব্রেক দিবো (একজন দর্শক বললেন-ব্রেক দিতে রাজি) ৫ মিনিটের একটা ব্রেক নিবো তারপরে আমাদের ডিসকাশন চালিয়ে যাবো... (একজন দর্শক বললেন-না আপনি চালিয়ে যান) আচ্ছা তাহলে থাক্। তো ওই একই রকমভাবে স্টপ জেনোসাইড প্রতি বছর টেলিভিশনে দেখায়। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র এই ছবিটিকে ওয়েলকাম করে নাই, তার জন্মের সময়। আজকে তাকে সে লালন করে, পালন করে। আমরা জহির রায়হানকে খুঁজতে চাই, কারণ আমরা দেশটারে ভালোবাসতে চাই। এই মানুষটা বিপন্ন হয়েও সেইসময় হাজির ছিলেন... যেনো তার দেশের অন্যসব বিপন্ন মানুষের একজন হিসেবে নিজেকে দেখছেন। এর বাইরে আর কিছু নয়। আগে উনি অনেক আওয়াজি মানুষ ছিলেন। ৭১-এ উনি জনগণ হয়ে গেলেন। এর আগে সুচন্দার সঙ্গে তার প্রেম, সুমিতা দেবীর সঙ্গে তার ইয়ের সঙ্কট-এই সব গল্প চালু আছে। ওমুক চিত্রালি-তে এই গপ্পো চালু হচ্ছে।
পূর্বাণী-তে এটা হাজির হচ্ছে, সংবাদ-এ এইরকম সংবাদ চালু হচ্ছে। সেলিব্রেটি। কিন্তু উনি ৭১-এ এসে জনগণের হয়ে গেলেন... স্টপজেনোসাইড-এ এসে। এই কারণে জহির রায়হানের খোঁজ আমাদের করবার প্রয়োজন। যদিও তার ইঙ্গিতটা তৈরি হয় জীবন থেকে নেয়া-তে। উনি সেই-‘পাকিস্তানে প্রথম রঙিন ছবি’, ‘পাকিস্তানের প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি’ এইসব আওয়াজে আর থাকলেন না। উনি তখন কেবলই জনতার। উনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন... একটি রাষ্ট্র তৈরি হচ্ছে... এখন এই রাষ্ট্র, এই জাতি কী করে তার নিজের সিনেমাকে নিয়ে অগ্রসর হবে? যেনো সকলের জন্য সেই সিনেমা কোনো না কোনোভাবে কল্যাণ বয়ে আনে। কী সেই কল্যাণের কথা উনি ভাবতে চাইলেন? রাজনীতিবিদরা মাইক্রোফোনে যা বলেন (যা করেন না) উনি তাই ভাবলেন। আমরা কিছুক্ষণ আপনাদের কথা শুনি, তারপরে আবার কিছু কথামালা... এবং যে-কোনো ধরনের প্রশ্ন... আমি তারপরে চাইবো আরও কিছু অনুষঙ্গ নিয়ে কথা বলতে। জহির রায়হান আমাদের উপলক্ষ, লক্ষ্য নয়।
...এতোক্ষণ আমি কী আবোল-তাবোল বললাম জানি না। এখানে অনেক শিক্ষক আছেন, আপনারা অনেক ছাত্র আছেন; আপনারা পরস্পরে প্রতিদিন নানান আলাপচারিতা করে থাকেন। আমি সেটা করবার মানুষ নই... সেটা শুরুতেই বলে নিয়েছি... তবুও আপনাদের প্রশ্ন যদি থাকে-
সঞ্চালক-১: ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা প্রশ্নোত্তর পর্বে চলে যাচ্ছি। আমি দায়িত্বরতদের কর্ডলেস মাইক্রোফোন নিয়ে শ্রোতাদের কাছে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। তবে এখানে বলে রাখি, প্রশ্নকর্তা অবশ্যই তার পরিচয়টি দিয়ে প্রশ্ন করবেন।
সঞ্চালক-২: আমাদের প্রশ্নোত্তর পর্বটি শুরু করা যাক, লিখিতভাবে এবং সরাসরি প্রশ্ন করা যাবে। আমি শ্রোতাদের অনুরোধ করছি যারা লিখিত প্রশ্ন করতে চান, তারা কাগজ সংগ্রহ করে প্রশ্ন লিখে আামাদের প্রতিনিধিদের কাছে দিতে পারেন অথবা কর্ডলেস মাইক্রোফোনে বলতে পারেন। ধন্যবাদ।
প্রশ্নকারী: আমি ফারুক ইমন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। আমার একটু জানার ব্যাপার ছিলো; সেটা হচ্ছে, আপনি আপনার আলোচনায় বললেন যে, সিনেমার জাতীয় একটা চরিত্র দাঁড় করানোর কথা বা এ-বিষয়ে কিছুটা কথা বললেন। তো এ-ক্ষেত্রে আপনার নিজস্ব দর্শন একটু পরিষ্কার করবেন, আপনি কী মনে করেন, জাতীয় চরিত্রটা কীরকম হতে পারে বা কোন্ জায়গায় আমাদের চেতনার অভাব? আর চেতনার অপচয়ের কথা বললেন, সেটা কীভাবে হচ্ছে, আর রোধ করাইবা কীভাবে সম্ভব? ধন্যবাদ।
নূরুল আলম আতিক: আচ্ছা, বিপদের কথা।আমি নিজেই আসলে আপনাদের কাছ থেকে এই বিষয়ে জানতে চাইবার জন্য এ-প্রসঙ্গ হাজির করেছি। সিনেমার আদৌ কোনো জাতীয় চরিত্রের প্রয়োজন আছে কি? তবু কেনো আমরা ইরানি ছবি বলি, কেনো বলি না আব্বাস কিয়োরোস্তমির ছবি বা মাখমালবাফের ছবি। কেনো আমরা ইরানি ছবি বলি, কারণ আমরা চিনে নিই, দেখতে দেখতে কেনো যেনো আমরা জেনে যাই ইরানি ছবি। ফার্সি ভাষা আমরা জানি না, সাবটাইটেল দেখছি কিন্তু দেখতে দেখতে আন্দাজ করি। নাকি খালি বোরকা পরা মেয়েদের দেখে, না কিছু কন্সট্রাকশন দেখে? না (দর্শক সারি থেকে-নাকি জাতিগত সঙ্কট দেখে?) সঙ্কট নয়, আমরা যাকে সঙ্কট বলে হাজির করি তা সঙ্কট নয়, সম্ভাবনাও হতে পারে... এটা হাজার বছর ধরে জীবনযাপন রীতি থেকে তৈরি হবার কথা। তো আজকে বাংলাদেশে হবে না? আপনি ইরানি ছবি দেখলে আন্দাজ করতে পারবেন ওদের কার্পেট শিল্প কেনো এ-রকম হবে বা ওদের ক্যালিগ্রাফি কেনো এ-রকম বা জালাল উদ্দিন রুমি কেনো হাজির হন। বা আপনি জানবেন... ওই হচ্ছে সুফি দর্শন, কেনো? যেখান থেকে আপনি আন্দাজ করতে পারবেন সিনেমার চরিত্র কেনো এ-রকম?
কী সহজ সাধারণভাবে তারা গল্পটা বলে ফেলতে পারে। এর জন্য সিনেমার আঙ্গিকে অনেক আয়োজন-প্রয়োজন নেই। তার জন্য প্রয়োজন সময়ের সঙ্গে, নিজের দেশের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। আমি আপনাদেরকে একটু আগে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলছিলাম। আমার প্রথম কেব্লা পশ্চিমবঙ্গে, তারপরের কেব্লা হচ্ছে মিডল-ইস্টে, তারপরের কেব্লা হচ্ছে আমেরিকা-ইউরোপে... শুধু নিজের দিকে তাকাই না কোনোদিন চোখ মেলে। নিজের দেশে থাকি চোখ বন্ধ করে। আমি খালি কেব্লা রেখে যাই পশ্চিমে, আছেতো আরও অনেক দিক। আমি কেনো খালি পশ্চিম দিকে তাকাবো? এই নিজের দিকে তাকানোর রাস্তা যদি আমরা খুঁজে পাই তাহলে ইরানি ছবির রাস্তাটা তৈরি করতে পারবো।
অতঃপর, উদাহরণ শেষে বলি-হিসেবে আমার দেশে, এই বঙাল দেশে, ভাটি অঞ্চলের বাঙাল... বাঙালিরাও সিনেমা তৈরি করতে পারবে। আমরা সিনেমা-যন্ত্র আবিষ্কর্তা নই। আমরা ক্যামেরা আবিষ্কার করি নাই, ব্যবহারকারী মাত্র। আমরা লাইট আবিষ্কার করি নাই। লাইট মানে কী-ওই যে আলো ফেলা হয় সেটা... এডিটিং মেশিন আবিষ্কার করি নাই, প্রজেক্টর আবিষ্কার করি নাই; আমরা ব্যবহারকারী মাত্র। এভাবে আমরা কম্পিউটারও ব্যবহারকারী মাত্র। কিন্তু আমরা জানি লাঙ্গলের ব্যবহার। তবু মুশকিল হচ্ছে খুব করে পাল্টে যাচ্ছে। একশ বছরে কতো দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে, আমাদের এইটুকুনও জানবার প্রয়োজন। এই দুইভাই ওই যে কি, লুমিয়ের ব্রাদার্স, তাইতো। তার আগেও আরও দুইভাই ছিলো, না না অন্যরাও ছিলো তাদের কাছ থেকে লুমিয়ের ভাইরা সেই টেকনোলজি কিনে নিছে। তারা যখন এই কাণ্ডটা করছেন, তার দুই বছরের মধ্যে আমরা এই অঞ্চলের মানুষ সিনেমার সঙ্গে সম্পৃক্ত। হীরালাল সেন, এই মানিকগঞ্জের। আমরা যেনো সিনেমার ভাষাটুকুন... নিজেদের ভাষা অর্জন করতে পারি, রচনা করতে পারি।
আজকে কোরিয়া ছবি তৈরি করে। কোরিয়ান সিনেমা আপনারা যদি দেখেন, কিম কি দুক-কে আপনারা জানেন। শুধু কিম কি দুক না, কোরিয়ান যেকোনো ছবি দেখলে আপনি এখন বলতে পারবেন এটা কোরিয়ান সিনেমা। যদি আপনার একটা-দুইটা ছবি আগে দেখার অভিজ্ঞতা থাকে। তার মানে হচ্ছে সম্ভব না... আপনি হলিউডের ছবি দেখলে নিশ্চিত আলাদা করতে পারেন এটা হলিউডের ছবি। যেভাবে বোম্বের ছবি, বলিউডের ছবি। সেখানে আমার ছবি কেনো আলাদা করে আমি চিহ্নিত করতে, এ্যাট-লিস্ট আমি ফিল করতে পারবো না... বাংলাদেশের ছবি? পশ্চিমবঙ্গের ছবি না। বঙাল দেশের-এই বাংলার, ভাটির বাংলার, নদীর দেশের প্যাঁক-কাদার দেশের মানুষের ছবি। এটা দেখা যায়... ইমেজে দেখা যায়। আওয়াজ... কথায় বোঝা যায়। গল্প বলার ঢঙে বোঝা যায়। সেটি আমরা রচনা করার রাস্তা কিন্তু পাইনি।
(লিখিত প্রশ্ন হাতে নিয়ে) আচ্ছা, জহির রায়হানের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে জানতে চাই... (আতিক হেসে) খুঁজে নেন, আমি জানি না।
(আরেকটি প্রশ্ন হাতে নিয়ে) প্রশ্ন, আমার বলবার কথা হচ্ছে এ-বিষয়ে নাটক বা সিনেমার ক্ষেত্রে একজন চিত্রনাট্যকারের স্বাধীনতার পরিসর কতোটুকু?
কেবলমাত্র চিত্রনাট্যকার স্বাধীন, সিনেমায় আর কেউ স্বাধীন নয়। সকলেই চিত্রনাট্যের অধীন। চিত্রনাট্যকার যা লিখবেন তার অধীন। চিন্তায় যা যা ঘটে প্রতিদিন, তাই-তাই আমাদের চিত্রনাট্যে দেখি। আকাঙ্ক্ষা থাকুক (দর্শকদের উদ্দেশ্যে)। যা ঘটা সম্ভব কিংবা সম্ভব নয়, যা স্বপ্নেও দেখা যায় না, তাই নিয়ে চিন্তা করে চিত্রনাট্যকার। তা আমরা হাজির করে ফেলি। এখন দায়টুকু নির্মাতার, পারবেন তো উনি তার রূপায়ণ? সম্ভব কি আমাদের এই স্বল্প আয়োজনে? এইতো, আমার এতো টাকা নাই। এইতো হচ্ছে, আকাশের ঠিকানা খুঁজতে চায়, উড়াল দিতে চায়। আচ্ছা, আপনাদের কারও যদি চিত্রনাট্য লিখবার আকাঙ্ক্ষা থাকে তাদের জন্য আমি মূলত... আমি আজকে আপনাদের সঙ্গে যেসব কথাবার্তা বলেছি এটাতে আমি অনভ্যস্ত।
কিন্তু আমি চিত্রনাট্য নিয়ে কথা বলতে অভ্যস্ত। বছর ছয়েক ধরে আমি এই বিষয়ে কথাবার্তা বলে যাচ্ছি... আমি প্রত্যাশা করি অসংখ্য চিত্রনাট্যকার আমার দেশে হাজির হোক। (একজন দর্শকের সম্পূরক প্রশ্ন: আজকের কথার মধ্যে কি এটা আসবে?) একটুখানি বলতে চাই চিত্রনাট্য নিয়ে। যদি কেউ লিখতে চান চিত্রনাট্য... মানে রচনা করতে চান... আমি নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে শিখেছি, আমি আবারও বলছি-আমিতো ভাগোয়াট ছাত্র। আপনারাতো ইউনিভার্সিটি পার হয়ে গেছেন, অনেকেই শিক্ষকতা করছেন, এখন আপনারা কেউ কেউ পড়ছেন। আমি ইউনিভার্সিটি পার হতে পারি নাই। আমি নিজের এই বার-চৌদ্দ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে যেটা বুঝি... যখন আপনি চিত্রনাট্য লিখবেন তখন ভাববেন-কী আমার বলবার কথা, যা কেউ আগে বলে নাই। আচ্ছা, গল্পতো নাই নতুন কিছু... তাহলে আমার কেনো এই দায় ঠেকলো? ...আপনি কী এমন নতুন গল্প বলবেন? গল্প বলবার ঢঙ আপনার, ওইটুকুনই স্বাতন্ত্র্য... যেভাবে আপনার টিপসই, যেভাবে আপনার চেহারা স্বাতন্ত্র্য-একই রকম। বলবার ভঙ্গি। এই ভঙ্গিটুকুন নেবার জন্য নিজেকে কিছুটা প্রস্তুতি নিতে হবে। কী সেই প্রস্তুতি?
প্রথমত, হচ্ছে-দেখা। কী দেখা? সিনেমা দেখা নয়। চোখ মেলে দেখা। দেখার চোখ জরুরি... যা আপনি নিজে, সকলে আমরা... আমি নিজেও যখন প্রথম লিখতে বসবো আমার নিজের যা অভিজ্ঞতা তাই আমি খুঁজে নিতে চাইবো চিত্রনাট্যে, চরিত্রের মধ্যে, ঘটনার মধ্যে। কিন্তু চিত্রনাট্যকারের কাজ তা নয়। আমি কোনোদিন খুন করি নাই, কিন্তু একজন খুনির চরিত্র আমাকে লিখতে হবে। আমি কোনোদিন একলা থাকি নাই, একলা থাকা দ্বীপবাসীর গল্প আমাকে লিখতে হবে। আমার মাথা খারাপ হয়ে যায় নাই, কিন্তু আমাকে একজন মানসিক রোগীর জায়গা থেকে লিখতে হবে। তার গল্প বলতে হবে। আমি অশীতিপর বৃদ্ধা নই, কিন্তু তার গল্প আমাকে বলতে হবে।
আমি জানি, আমার পূর্ববর্তী সময়টুকুও। আমার জন্মের পর থেকে কিছুকাল পর থেকে আজ পর্যন্ত রিড করতে পারি... আমি যেনো অন্যদের দেখে আন্দাজ করতে পারি... আন্দাজ। আন্দাজ আপনা-আপনা। নিজে নিজে আন্দাজ করে নিতে হবে, যে-এরকম হোক... সম্ভব এটা। দ্বিতীয়ত কথা হচ্ছে-যা কিছু দেখি, যা কিছু শুনি, শুধুমাত্র তাই লিখি চিত্রনাট্যে; বাদ বাকি সাহিত্যকর্ম। চিত্রনাট্য লেখা সাহিত্যের কাজ নয়, সাহিত্যিকের কাজ নয়। চিত্রনাট্য একটা প্রোডাকশনের প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। এটা ডিরেক্টরের জন্য, প্রডিউসারের জন্য, ইউনিটের অন্যসব লোকেদের জন্য। তাদেরকে কনভিন্স করবার জন্য। সো, আমি অহেতুক বিবরণ দিয়ে, অনেক কথামালা বলে তা যেনো ধ্বংস না করি। তিন নম্বর যে জিনিস... অনেক জরুরি-এই চিত্রনাট্য আর কেউ লিখবে না... এই চিত্রনাট্য কেবলমাত্র আমার হাতেই লেখা হচ্ছে। এইটুকুন জেনে যাওয়া, তারপরে লিখতে শুরু করে দেন। আর কারও একটা প্রশ্ন ছিলো...
(প্রশ্ন লেখা কাগজ হাতে নিয়ে) বাংলা চলচ্চিত্রের ভালো চিত্রনাট্যের অভাবগত সমস্যা আছে? মিল্টন ভাই, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ।
আচ্ছা, মিল্টন ভাই, প্রথমত হচ্ছে চিত্রনাট্য এখন আর কেউ লেখেন না... একটা সময়, ওই সিক্সটিজে মুর্তজা বশির যেমন নদী ও নারী লিখছেন। এমনকি জহির রায়হানের জন্য লেট দেয়ার বিলাইট, একুশে ফেব্রুয়ারি নামে যে ছবিটা করতে চেয়েছিলেন সেটারও তিনি চিত্রনাট্যকার। সৈয়দ শামসুল হক লিখতেন একসময়। অসংখ্য সাহিত্যিক সিনেমায় হাজির ছিলেন চিত্রনাট্যকার হিসেবে। আজকে তেমন কেউ নাই। আর চিত্রনাট্যকারের পয়সা নাই। এদিকে চিত্রনাট্যের প্রয়োজনও পড়ে না। এমনি যে কেউ-আচ্ছা আইডিয়া... এখানে দাঁড়াও হ্যাঁ, এইটা করো ওটা করো, এমন করে বইলা ফেলো, আমরা দুজন, তোমার চরিত্র এই আমার চরিত্র এই, আসো চলো আমরা কথা বলি শ্যুট নিতে থাকুক (অভিনয় করে দেখান)।
তাহলে আর চিত্রনাট্যকারের প্রয়োজন পড়ে না। ...এতোকাল ধরে আমরা যা জানলাম গল্পের একটা শুরু আছে, ডেভেলপমেন্ট আছে, কনফ্লিক্ট আছে, রেজুলেশন আছে এর পুরোটা এখন এক অংকের গল্পই বলেন, নাটকই বলেন... যেটাই বলেন আর তিন অংকের কিংবা পাঁচ অংকের বলেন... কিন্তু লাগবেতো। এই রীতিটুকুন জানবার প্রয়োজন আছে। ...আচ্ছা আমি এইভাবে গল্প বলবো না। লেজ-মুণ্ডু সব একাকার করে দিবো। কোত্থেকে শুরু করে কোত্থেকে শেষ কাউকে আমি জানান দিতে চাই না। তাই বলবার আগে আপনাকে এই অংক বিভাজন... এখন মানসাঙ্ক করতে হবে। উপায় নাই, এ-ছাড়া আমাদের অন্যকোনো রাস্তা নাই।
আচ্ছা আরেকটা কী? চিত্রনাট্য অনেক কষ্টের... একলা। অনেক পরিশ্রমে লিখতে হয়, ভাবতে হয়। ডিরেক্টরের কাজ অনেক ফুর্তির... ৪০টা-৫০টা মানুষ থাকে তাদেরকে ওই ঘোড়া দাবড়ানোর মতন বিষয়। তারপর আবার নায়ক-নায়িকাও থাকে, তাদের সঙ্গে পাট নেওয়ার বিষয়
থাকে। আবার একটা ক্যামেরাও থাকে, ছবিও তোলা যায়, উফ্। কিন্তু চিত্রনাট্যকারের সঙ্গে কেউ নাই, সে একলা। তাকে একলা অসংখ্য মানুষকে রচনা করতে হয়। এই কাজ বিনা পয়সায় কে করবে? এই কারণে নতুন কোনো চিত্রনাট্যকারের পয়দা হচ্ছে না আমাদের।
(আরেকটি কাগজে লেখা প্রশ্ন হাতে নিয়ে) আপনার চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রধান উদ্দেশ্য কী?
আচ্ছা। আমি অন্যদের মতো পাট নিয়ে বলে ফেলবো-‘আর তো কোনো কাজ পাইনি ভাই, তাই সিনেমা নিয়ে কথা বলি আর টেলিভিশন করে খাই।’
আচ্ছা, আরেকটা প্রশ্ন আছে-সিনেমা আর্ট না বিজনেস? ‘আর্ট’ আর বিজনেস এই গপ্পো আমার সময়ে ছিলো, ২৫ বছর আগে। সিনেমা কী আর্ট না সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি? প্রথমেই রেহাই নেন, পুরোটাই আন্দাজ করে নেন। কী আন্দাজ? সিনেমা আর্টও না, ব্যবসাও না। যদি আপনি সিনেমা নিয়ে ব্যবসা করতে চান তবে সিনেমা ব্যবসা। আর যদি আর্ট হিসেবে ভঙ্গি নিতে চান তো সিনেমা আপনার আর্ট। একটু প্যাঁচায়া বললাম কথাটা। এ-গুলো নিয়ে এখন আর কেউ মাথা ঘামায় না।
(দর্শকের প্রশ্ন পড়ে বলছেন) চলচ্চিত্রের মানুষ হিসেবে মেহেরজান নিষিদ্ধ হওয়াকে আপনি কীভাবে দেখেন?
মেহেরজান ভালো ছবি না খারাপ ছবি তা আমাকে আঘাত করে না, কিন্তু রাজনৈতিক কারণে সিনেমা নামায়া দেওয়ার এখতিয়ার কারও নাই। খারাপ কাজ। ভিন্ন মত ওয়েলকাম করবার দাবি আমরা রাখবো। বিবিধ মত... কাউকে নস্যাৎ করার ওই মধ্যযুগীয় কায়দা আমরা এপ্রিশিয়েট করতে চাই না। ব্যক্তিগতভাবে আমার পছন্দ না।
এখন আমি আপনাদের সঙ্গে আমার নিজের পছন্দের কিছু মানুষের কথামালা শেয়ার করতে চাইবো, কারও যদি আর প্রশ্ন না থাকে। (লিখিত প্রশ্ন দেখতে দেখতে) ও আচ্ছা আপনার চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রধান উদ্দেশ্য... এটা আমি বলে ফেলছি। আমি ধরেন আর যদি সিনেমা তৈরি নাও করতে পারি, আমার কোনো আফসোস নাই জীবনে। বরং আমি যদি কিছু নতুন সিনেমা দেখতে পাই, তাতেই খুশি!
আচ্ছা একজন প্রশ্নে লিখেছেন চারুকলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ৭০ সালে সেই পরিস্থিতিতে যখন জীবন থেকে নেয়া তৈরি করে মুক্তি দিতে পারে, অথচ এখন আমরা এই পরিস্থিতিতে দেবদাস সিনেমা মুক্তি দিতে পারি না, তাহলে আমরা সিনেমা তৈরির কথা ভাববো কী করে?
ভাববেন, কারণ আপনার তো ওই পর্যন্ত যেতে হবে না। আপনি নিজে সিনেমা বানান, কম পয়সায় বানান, ইউটিউবে আপলোড করে দেন (দর্শকের হাসি ও তালি)।
(আরেকটি প্রশ্ন হাতে নিয়ে) আশপাশের যারা বর্তমানে সিনেমা নিয়ে কাজ করছে তারা কি সিনেমাকে সবার জন্য করতে ব্যর্থ নয়? এজন্য যে বিকল্প ধারার অনেকে সিনেমায়...।
আচ্ছা। বিকল্প ধারা একটা সময় প্রয়োজন পড়ে, সকল কিছুর বিকল্প রাস্তা... ছোটবেলায় মনে পড়ে ভাতের আয়োজন ছিলো না, ছাতু খাইতে হইছিলো। বিকল্প ব্যবস্থা, কী করবো। ৭০ মাঝামাঝি সময়, এইটাকে আমি অস্বীকার করবো কী করে? প্রয়োজন আছে, আপনার রেগ্যুলার আয়োজনে যদি হাজির থাকতে না-ই পারি, অন্য রাস্তাতো খুঁজতে হবে। ব্যথা তো আছেই... পেটের ক্ষুধা যেমন, মনের ক্ষুধাও। তাই আমাদের খোরাক লাগবে। আর সবার জন্য সিনেমা করতে ব্যর্থ আমরা। সবার জন্য সিনেমা হবে না। সকলে পারবেন না। সবার জন্য সিনেমা হয়তো কেবলমাত্র চার্লি চ্যাপলিন করে থাকবেন। সকলের জন্য সিনেমা, এ-কারণে সিনেমা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন বয়সীদের জন্য আলাদা রেটিং করা থাকে।
বাচ্চাদের জন্য একরকম সিনেমা, বড়োদের জন্য আরেক রকম সিনেমা। সিনেমার আরও আছে ডকুমেন্টারি, ফিচার ফিল্ম, শর্ট ফিল্ম এ-গুলো হবে। কিন্তু সকলের জন্য আসলে সিনেমা করা সম্ভব না। কিন্তু সকলের জন্য সিনেমা একটা দিন ছিলো। সেইটি আমাদের সঙ্কটের সবচেয়ে বড়ো কারণ। কী ছিলো? আপনারা যদি আন্দাজ করেন শুধুমাত্র প্রেক্ষাগৃহে... বেলকোনি, ডিসি, রিয়ারস্টল, স্টল। বিভিন্ন আয়ের মানুষেরা বিভিন্ন দামে টিকিট কেটে একই ছবি দেখতেন। কিন্তু আমরা সেই রাস্তা হারাইয়া ফেলছি। এখন সেই রাস্তা তৈরি করে দিছে টিভি। এটা আমরা হারাইয়া ফেলছি কেনো? প্রথমত, এই যে সকলে বলেন সিনেমা হলের পরিস্থিতি খারাপ। আপনি ঘর থেকে বউ-বাচ্চা নিয়ে বের হবেন, যেতে লাগবে ১০ মিনিট, আপনি জ্যামে তিন ঘণ্টা রাস্তার মধ্যে আটকে থাকলেন। তারপরে আবার সেই বউ-বাচ্চা নিয়ে রাস্তায় আসছি, ছিনতাইকারীর কবলে পড়লেন। তারপরে যে-ছবি আপনি দেখতে গেলেন সেই ছবির যে চেহারা আপনার নিজেরই ভালো লাগতেছে না। একসঙ্গে আরও দু একজন বন্ধু-বান্ধবকে নিয়ে আসছেন। এখন আপনার ভালো লাগছে না, কী করে হবে?
সকলের জন্য সিনেমার রাস্তাটা আমরা হারাইয়া ফেলছি। এইটা সকলের জন্য; সিনেমাটা আর আমাদের পক্ষে তৈরি করা সম্ভব নয়। এই কারণে সিনেমা হলগুলো উচ্ছেদ হচ্ছে, সেগুলো ভেঙ্গে যাবে, সেখানে নতুন নতুন মার্কেট তৈরি হবে। বরং সেখানে আপনি আমি গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরবো। কিন্তু সকলকে নিয়ে আর সেই দেবালয়ের মতন, প্রার্থনা গৃহের মতন সকলে একত্রে হাজির হওয়া সম্ভব নয়। কারণ আমরা সিনেমাটা আর আগের মতো তৈরি করতে পারি না।
(আরেকটি প্রশ্ন হাতে নিয়ে) আচ্ছা অনেক মিষ্টি করে লিখেছেন বকুল। আমাদের একটি প্রবণতা আছে অতীত ও বর্তমান ছেড়ে দিয়ে ভবিষ্যৎ গ্রহণ করার। কী কারণে বা কোন্ সঙ্কটের কারণে আমাদের জহির রায়হানের কাছে ফিরে যেতে হচ্ছে? বাংলা সিনেমাকে সে-রকম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কি আর কেউ নেই?
নেই। চল্লিশ বছরে কাউকে দেখা গেলো না। তার জন্যেই জহির রায়হানের প্রয়োজন পড়লো। আর কেউ যারা-যারা, তারা-তারা, যা খুশি করে গেলেন, তাই দিয়ে সিনেমা, বাংলাদেশের সিনেমা আমার দেশের সিনেমা বলে সেটাকে বুক ফোলায়, গর্ব করে বললেন-বেকার। বিলঙগিং এর জায়গা, আমার একটা বিলঙগিং চাই। সিনেমা বিলঙগিং। এই সিনেমায় দেখা জীবন আমার, এই বিলঙগিং... কেউ পারলেন না। আমি কিন্তু একই রকমভাবে বললাম আপনাদের। অতীত দিনের, সোনালী দিনের, ‘রূপালী পর্দার সোনালী অতীত’। আচ্ছা, অতীত এবং বর্তমান ছেড়ে দিয়ে নয়, জহির রায়হান যেইরকমভাবে ডায়নামিক কাণ্ডকারখানার মধ্যে হাজির ছিলেন... সেইভাবে হাজির করা... ও এই দেশে সিনেমা হবে না, তিনি হাজির করলেন। রঙিন সিনেমা, পাকিস্তানিরা বললেন বানাচ্ছেন, উনি বললেন আমি বানায়া ফেলবো। তিন সপ্তাহের মধ্যে রঙিন সিনেমা তৈরি করে ফেললেন। সিনেমাস্কোপ হয় না বললেন-আমি করবো, করে ফেললেন। এখন আপনাদের কাছে টেকনোলজি আছে। যে টেকনোলজি অন্যদের কাছে আছে আপনার কাছেও আছে।
(আরেকটি প্রশ্ন হাতে নিয়ে) আচ্ছা, একজন চিত্রনাট্যকার কীভাবে স্বাধীন, বলবেন কী? জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যা ভাবি তাই প্রকাশের স্বাধীনতা কোথায়?
নাই। আপনি প্রকাশ কী করে করবেন। আপনি ভাবছেন, আপনার ভাবনার গলা টিপে দিবে। কথা পর্যন্ত বলতে হবে না, ভাবনারই গলা টিপে দিবে। কিন্তু গলাটা খুলতেও হবে। টিপা গলার মধ্যে আর্তনাদটুকুনও হাজির করা দরকার। শুধু দরকার না... এইটুকুনই হচ্ছে জীবন... যাপন করবার জায়গা। স্বাধীনতা নাই। আবারও জানেন, দেখেন এই শহরে, এই ইউনিভার্সিটিতে আপনারা এতোগুলো মানুষ এই তারুণ্য, এই দুপুরবেলা আরাম করে, আয়েশ করে গাছতলায় থাকতে পারলে ভালো লাগতো একটুখানি যদি হাওয়া লাগে। অন্যতর আরও আরও অনেক অনেক প্রায়োরিটি আছে জীবনে... তবুও হাজির আছেন সিনেমার জন্যে। কেউ কেউ হয়তো আছেন শুধুমাত্র বন্ধুর জন্যে। কিন্তু এই যে এতোগুলো মানুষ, তার মানে আমাদের প্রেম আছে সিনেমার জন্যে, আমরা এই প্রেমের প্রকাশের জন্যে গলা চিপে দিলেও আমরা আওয়াজটা করতে চাই। চিত্রনাট্যকার স্বাধীন এই অর্থে। আমার প্রত্যেকটা টুকরা ওই ‘আ-নাল হক’, যেরকম ভাবে টুকরা টুকরা... (মনসুর হাল্লাজ) তবুও কথা বলবে চিত্রনাট্যকারের নিজস্ব ভাষা। আমি, আরও কিছু ঘোষণা থাকলে নিজে অন্যদের কিছু কথা বলতে চাইবো।
(আরেকটি প্রশ্ন হাতে নিয়ে) বর্তমানে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটছে। এই বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন এবং পরবর্তী প্রভাব কী হতে পারে?
আচ্ছা, পশ্চিমা কী? আপনি আসলে ভারতের কথা কইতেছেন আর ওই আমেরিকার কথা, তাই তো? নাকি আরও কিছু? পশ্চিমা অন্যকোনো ধারণা কী? লিমন ভাই, ও আচ্ছা সাংবাদিকতা প্রথম বর্ষের... লিমন ভাই কে (দর্শকদের উদ্দেশ্য)? (একজন দর্শক উঠে দাঁড়ায়) আপনি আর একটু বললে আমার জন্য সহজ হয় আপনার কথা, শুনি কথা বলা (প্রশ্নকারীকে উদ্দেশ্য করে)।
লিমন : পশ্চিমা হচ্ছে যে ভারত তারপর যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র-এসব দেশের যে-সংস্কৃতি অনুপ্রবেশ হয়ে বাংলাদেশে চর্চা হচ্ছে, তার পরবর্তী প্রভাব কী হতে পারে...?
আতিক : আচ্ছা। আমি এখন আন্দাজ করলাম। দেখেন পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ নয়। আমরা বরং অনুপ্রবেশ করতে চাই। কী অর্থে? ওহ্ আমেরিকা। যদি আমেরিকার একটা সিল পাই তাইলে আমি হচ্ছে... যদি কোনো ধরনে আমেরিকার ভিতরে ঢুইকা পড়তে পারি তাহলে আমার ভবিষ্যৎ পরিষ্কার। যুক্তরাজ্যেও তাই, ভারতে এখন মুশকিল হচ্ছে, আমেরিকার থাইক্যাও ডিফিক্যাল্ট হইয়া গেছে। কারণ ওখান থেকে পুশব্যাক। এবং আরও অনেক ঝামেলা আছে। তারের মধ্যে ফ্যালায়া দিবে, গুলি কইরা মাইর্যা দিবে। যদি একটু এ্যাঁউ শোনে। আমাদের আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে অন্যদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া, সেই তো? আমরা কেনো সিনেমা করতে চাইবো? তার মানে হচ্ছে আমার কিছু বলবার কথা আছে, কাউকে শোনানোর কিছু কথা আছে; সেই শোনানোর কী কথা? আমার নিজের কিছু অনুভূতি... তার কারণে আমি অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চাই।
আর এই যে বিদেশি সংস্কৃতি, ভিন্ন সংস্কৃতি এ-গুলো নিয়ে এখন আর অহেতুক কালক্ষেপণ না করেন। কারণ রাষ্ট্র এতো বড়ো-যন্ত্র এবং সেই রাষ্ট্র তাদের কাছে কতো ক্ষুদ্র-যন্ত্র! ষড়যন্ত্র। পশ্চিমাদের নিয়া আপনার-আমার এ-গুলা চিন্তা না করলেও চলবো। কী করতে পারবেন, জীবাণুর মতন করে হাজির হওয়া... বীজাণুর মতন করে হাজির হওয়া। একটা বটগাছের বীজ কখনও দেখছেন? আপনি দেখতে পাবেন না, এতো ছোট বীজ। আমের আঁটির মতন বড়ো না, ছোট্ট একটা দানা। কখনও যদি ইয়ের ডিম দেখে থাকেন, তার কাছাকাছি, ইলিশের ডিম। আরে পদ্মার ইলিশ। পদ্মা নয়, পদ্মায় কোত্থেকে ইলিশ আসবে, ইলিশ হওয়ার জন্য তো পানি লাগে, কোত্থেকে পানি আসবে? পুকুরে চাষ করবো আমরা। ওই চিন্তা আর না করেন বরং কী করে জীবাণু হয়ে, বীজাণু হয়ে হাজির হওয়া যায়; তা-ই শিল্পীর কাজ। কী কাজ? কথামালাগুলো চালু রাখা। জারি রাখা, কাজের মধ্য দিয়ে এবং অন্যদের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের মধ্য দিয়ে। সেই সংযোগটুকু চালু থাকুক। আপনার এখন বয়স কম, এখনই আপনার যুদ্ধে যাবার শ্রেষ্ঠ সময়। যুদ্ধে যাইতে হবে না, ইয়ে লাগান, গাছ লাগান!
(আরেকটি প্রশ্ন হাতে নিয়ে) ডার্টিপিকচার-এর নষ্ট ছোঁয়া আজ আমাদের চলচ্চিত্র জগতের এক অনুসরণীয় বিষয়। আমরা কী সামাজিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে ভুলে গেছি, আমরা কী ভারতের সিনেমার বিষয়কে নিজের করে নিয়েছি?
শোনেন, আজ এতোদিনে আমাদের মনোজগতে ভারতের সংস্কৃতি, যদি বলি তারই অংশীদারিত্বের মধ্যে চলে আসছে... আচ্ছা তাতে আপনার সমস্যাটা কী? আপনি পেঁয়াজ খান ভারতের, ডাল খান ভারতের, ফেনসিডিল না; এই মসুরের ডাল আসে ভারত থেকে। আপনি গাড়ি ইমপোর্ট করেন ভারত থেকে তাও আবার কী? ভাঙ্গা-চোরা গাড়ি, ও-গুলা আবার আরেক ব্যবসা। শুধু তাই না, রাজনীতিবিদদের মাথাও ভাড়া করে আনেন সেখান থেকে। তো আপনার সিনেমা আসলে অসুবিধা কী? আর আসে না? কই, সকলইতো এসে গেছে চোরাচালানের মধ্যে, কিছুই তো বাকি নাই। এখন ডার্টিপিকচার ততোটা ডার্টি নয়, আর কে প্রশ্ন করেছেন জানি না। ডার্টি, এখন ওই প্যাঁক-কাদা আমার বড়ো ভালো লাগে। ছুনানা ছুনানা আমার ভালো লাগছে (দর্শকদের হাসি)।
কী বলবো? এখন এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা যেভাবে জরুরি একইরকমভাবে এ-গুলো মোকাবেলা করা কঠিন, অসম্ভব; এই অসম্ভবটা আমরা ছেড়ে দিতে চাই না। এই অসম্ভব কাণ্ডটা আমাদেরই ঘটাইতে হবে। ওই আপনার পশ্চিমা সংস্কৃতি না, পশ্চিমা টেকনোলজি... আপনার হাতে নিয়ে গেছে সেই সম্ভাবনা; চ্যালেঞ্জ করবার। ওই সামান্য একটি হ্যান্ডিক্যাম, তাই দিয়ে এই চ্যালেঞ্জটা আপনার হাতের কাছে। সকলকিছু মেনে নেওয়ার নাই। প্রয়োজন নাই। কিন্তু আপনাকে এইটুকু সহ্য করে নিতে হবে। সহ্য করতে পারবেন না... কিন্তু এটা আপনি চাইলেও ছেড়ে দূরে সরাইতে পারবেন না। এগুলো আছে জীবনে। থ্যাংক ইউ।
আমি আর পাঁচ মিনিট ১০ মিনিটের বেশি সময় নেবো না। কিছু-কিছু লেখা আমার নিজের অনেক পছন্দ। এইরকম দুই চারজনের কথামালা আমি আপনাদের সঙ্গে একটু শেয়ার করতে চাইবো। তারপর আবারও যদি কোনো প্রশ্ন থাকে আমরা কথা বলতে পারি। যদি সময়ও থাকে। আচ্ছা, যারা যারা জীবনে প্যাঁচের মধ্যে পড়ে গেছেন, তাদের জন্য আমার কিন্তু কোনো হাত তোলা নাই। কারণ, আমি নিজেই একধরনের প্যাঁচের মধ্যে আছি... আমি জানি না পথের শেষ কোথায় বা কোনো রাস্তা আদৌ আছে কিনা। আমিও সেই গিঁটের মধ্যে আটকা পড়া মানুষ। জীবনানন্দ দাশের কয়টা লাইন আবারও আপনাদের সামনে,
সকল লোকের মাঝে বসে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা
আমার চোখেই শুধু ধাঁধা
আমার পথেই শুধু বাধা...
প্রতিক্ষণ আপনার মনে হবে এই কথা। আপনি যখন কাজ করতে চাইছেন... ‘সবাই পারে আমারে দিয়ে কেনো হচ্ছে না?’ সকলেই তো কী কী জানি করে ফেললো। আমার জীবনে কিছুই হয় না... এখানে সিনেমা করলেই না, অন্য কাজেও মনে হবে; কিন্তু সিনেমা করতে গেলে আরও বেশি করে মনে হবে। যেহেতু এতোক্ষণে যারা চলে যান নাই, যারা আছেন তারা যদি সিনেমা করেন, তাহলে এই প্যাঁচ শিখতে পারবেন। তো আমি বিনয় মজুমদারের কয়েকটা লাইন আপনাদেরকে...। তার আগে ঠাকুর পূজার... রবী ঠাকুর... নারে ঠাকুর নিয়ে কীযে অস্থিরতা আমাদের! গোটাটাই বদমাইশি সংস্কৃতির অংশ। কী সেই বদমাইশি সংস্কৃতি? রাজনৈতিক লাভালাভের অংশ। ঠাকুরের নাম করে। কীসের কী! কে পড়ে? কিন্তু ১৮ খণ্ড, ২২ খণ্ড ঘরে রাখে। সাজাইয়া গোছাইয়া। আচ্ছা গান শুনি। শুনি ঠাকুরের গান। প্রাণে কিন্তু ঠাকুর নাই। গানে আছে, প্রাণে নাই। কী করবো আমরা? আচ্ছা, ঠাকুর সিনেমা নিয়ে সেই বয়সে... ওনার অনেক একটা খারাপ অভিজ্ঞতা আছে নটীরপূজানিয়ে... উনি হচ্ছে ওটা শ্যুটিংয়ের সময় ছিলেন; ওনার ভালো লাগে নাই। সিনেমা নিয়ে কয়েকটা অদ্ভুত কথা কইছিলেন। আমি সেইটা চিঠির মধ্যে পড়ছি। সেটা আমি আপনাদের একটু শেয়ার করতে চাই। ১৯২৯ সালে ২৬ নভেম্বর আমাদের যে নাট্যাচার্য শিশির ভাদুরী তার ভাই মুরারী ভাদুরীকে একটা চিঠি লিখছিলেন। তাও বুঝি দেশের বাইরে কোথাও ছিলেন সেখান থেকে চিঠি লিখেছিলেন...
‘ছায়াচিত্রের প্রধান জিনিসটা হচ্ছে দৃশ্যের চলৎপ্রবাহ।’ ২৯ সালে রবী ঠাকুর মিষ্টি করে কিন্তু বুঝে গেছেন-‘ছায়াচিত্রের প্রধান জিনিসটা হচ্ছে দৃশ্যের গতিপ্রবাহ।’ আচ্ছা, দৃশ্য নাই, আপনি একটি স্ট্যাটিক শব্দ আঁকলেন... ‘কিছুই নড়ে না গাছের পাতাটিও নড়ে না, আপনি যদি এমনটি বলতে চান তাহলে তো আপনার এ-রকম একটা ফ্রিজ-শট লাগবে... একটা মোমেন্ট লাগবে। আবার পড়বো আমি, দেখেন সাহিত্যের লোক, শব্দের লোক উনি কী করে ভাবলেন-কী করে জেনে গেলেন-‘ছায়াচিত্রের প্রধান জিনিসটা হচ্ছে দৃশ্যের গতিপ্রবাহ। এই চলমান রূপের সৌন্দর্য বা মহিমা এমন করে পরিস্ফুট করা উচিত যা বাক্যের সাহায্য ব্যতীত আপনাকে সম্পূর্ণ সার্থক করতে পারে। আর নিজের ভাষায় মাথার উপরে আর একটা ভাষা কেবলি চোখে আঙুল দিয়ে মানে বুঝিয়ে যদি দেয় তবে সেটাতে তার পঙ্গুতা প্রকাশ পায়। সুরের চলমান ধারায় সংগীত যেমন বিনা বাক্যেই আপন মাহাত্ম্য লাভ করতে পারে তেমনই রূপের চলৎপ্রবাহ কেনো একটি স্বতন্ত্র রসসৃষ্টি রূপে উন্মেষিত হবে না? হয় না যে সে কেবল সৃষ্টিকর্তার অভাবে এবং অলসচিত্ত জনসাধারণের মূঢ়তায়, তারা আনন্দ পাবার অধিকারী নয় বলেই চমক পাবার নেশায় ডোবে।’... তার মানে সিনেমায় আওয়াজই একমাত্র বিবরণ নয়। সিনেমায় আরও কিছু বলবার আছে। বিবরণ উত্তীর্ণ একটা জায়গা সিনেমা... ডায়লগের বাইরে কিছু কথা আছে। শুধুমাত্র ডায়লগ। আমরা যদি সিনেমা করতে গিয়ে সারাক্ষণ বলতে চাই এটা ওমুক এটা তুমুক এটা এরকম সেটা সেরকম-সারাক্ষণ বলতে যদি চাই, তাহলে সিনেমা বানানোর প্রয়োজন নাই। এটা ২৯ সালে ঠাকুরও বুঝে গেছেন। যদি এতোকাল বাদে আমরা সিনেমা করতে এসে এটা আন্দাজ না করি তাহলে আমাদের জন্য সমূহ বিপদ। তাহলে এ-রাস্তায় না হাঁটাই ভালো। ঠাকুর আরও কিছুকাল বেঁচে থাকলে হয়তো সিনেমায় নামতেন!
আচ্ছা, আমরা জহির রায়হান নিয়ে বলছিলাম। একই-রকমভাবে আহমদ ছফার কয়েকটি কথা পড়তে চাই... বহুল প্রচলিত, বহুল উচ্চারিত সকলে আপনারা জানেন তবুও আমি আবার বলতে চাই, ‘বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এখন যা বলছেন শুনলে বাংলাদেশের সমাজকাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না।’ এইকথা এখনকার এই সময়ের জন্যও প্রযোজ্য। কথাগুলো বলছেন তিনি ৭২-৭৪ সালের ঘটনা। পাল্টায় নাই কিছুই, পাল্টায় না এতো সহজে; কিন্তু নদীগুলো মরে যায়, আমাদের কীটপতঙ্গ ধ্বংস হয়ে যায়, মাছ নাই, নদী নাই, পানি নাই। আচ্ছা যাই হোক, আমি আরও কিছু কথা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। হ্যাঁ, বিনয় মজুমদার... তার কবিতা জানেন। তার ছোটগল্পের সংকলনে আপনারাহাসুন নামে একটি গল্প লিখা আছে। বেসিক্যালি এটি থিয়েটারের গল্প। থিয়েটারের একজন প্রম্পটার থাকে এবং কিছু চরিত্র থাকে। আমি মাত্র দুটা লাইন বলবো... বাদবাকি গল্পটা কী... আমেরিকা থেকে আসছেন কিছু ডেভেলপার। তারা আলাস্কা এসে এই বরফবাসীদের আমেরিকায় নিয়ে যেতে চান। তাদের জন্য বিবিধ আয়োজন। তাদেরকে এসি রুমে রাখতে চান, তাদেরকে ফ্ল্যাট বাড়িতে রাখতে চান, তাদের জন্য টেলিভিশন থাকবে... আরও আরও বিবিধ আয়োজন। প্রম্পটার বলছে, ‘আমরা তোমাদের মতো মিথ্যা কথা বলি না যে, গোলাপ ফুল অতি সুন্দর।’ তারপরে পিঙ্গুহুয়া বলছে, ‘পিঙ্গুহুয়া’ হচ্ছে আলাস্কাবাসী চরিত্র। ‘আমরা তোমাদের মতো মিথ্যা কথা বলি না যে, গোলাপ ফুল অতি সুন্দর’-প্রম্পটার বলছে। তারপর পিঙ্গুহুয়া বলছে, ‘পৃথিবীর সমস্ত ফুলের চেয়ে সুন্দর আমার ছেলের পায়ের নখগুলি।’ এইটি জানবার প্রয়োজন আমাদের... গোলাপ ফুলের বিপণন সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে আমরা প্রতিদিন জীবনযাপন করবো, কিন্তু আমার বাচ্চার পায়ের পাঁচটা আঙ্গুল দেখে মনে হবে, এর থেকে সুন্দর ফুল পৃথিবীতে ফোঁটে নাই কোনোদিন। কারণ এর সঙ্গে বিপণনের কোনো সম্পর্ক নাই, অন্তরের সম্পর্ক, রক্তের সম্পর্ক, প্রেমের সম্পর্ক, স্বপ্নের সম্পর্ক-আমরা এখনও যেনো স্বপ্ন দেখতে পাই। প্রতিদিনের এতোসব দুঃস্বপ্নের মধ্যে স্বপ্নটুকুন জারি থাকুক। কিন্তু সুন্দরের ধারণা... পিকাসোর এই ছবি ভালো, গুয়ের্নিকায় কেমন করে দেখানো হয়েছে সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার। আপনি মাতিসের ছবি দেখে, বুনুয়েলের সিনেমা দেখে প্রশংসা করেন... কিন্তু আপনি কোনোদিন যদি আপনার বাচ্চার দিকেই না তাকান তাহলে এই আর্টের কী মানে? আমি আরও পাঁচটা মিনিট সময় নিই, যদিও থাকে? সময় বুঝি শেষ...
কেনো যেন স’রে যাও, রৌদ্র থেকে তাপ থেকে দূরে।
ভেঙ্গে যেতে ভয় পাও; জাগতিক সফলতা নয়,
শয়নভঙ্গীর মতো অনাড়ষ্ট স্বকীয় বিকাশ
সকল মানুষ চায়-এই সাধনায় লিপ্ত হতে
অভ্যন্তরে ঘ্রাণ নাও, অযুত শতাব্দীব্যাপী চেয়ে
মস্তিষ্কে সামান্যতম স্বাদ নিয়ে ক্লিষ্ট প্রজাপতি
পাখাময় রেখাচিত্র যে নিয়মে ফুটিয়ে তুলেছে
সে নিয়ম মনে রাখ; ঢেউয়ের মতন খুঁজে ফেরো।
অথবা বিম্বের মতো ডুবে থাক সম্মুখীন মনে।
এমনকি নিজে নিজে খুলে যাও ঝিনুকের মতো,
ব্যর্থ হও, তবু বালি, ভিতরে প্রবিষ্ট বালিটুকু
ক্রমে ক্রমে মুক্ত হয়ে গতির স্বার্থ কীর্তি হবে।
শয়নভঙ্গির মতো স্বাভাবিক সহজ জীবন
পেতে হলে ঘ্রাণ নাও, হৃদয়ের অন্তর্গত ঘ্রাণ।
এই পাগল লোকটা কী মিষ্টি করে বললেন-শয়নভঙ্গির মতো স্বাভাবিক সহজ জীবন পেতে হলে ঘ্রাণ নাও, হৃদয়ের অন্তর্গত ঘ্রাণ। আমাদের তো ঘামের গন্ধ বলেননি; অন্তর্গত ঘ্রাণ শুঁকবার মতো এতো সুখতো আমাদের নাই। কী করবো আমরা? বিপদের কথা। তার জন্যে তাকানো প্রয়োজন। এইজন্য চোখের কথা বলছিলাম শুরুতে। দেখা। দৃষ্টিপাত নয় কেবল। আমরা কেবল তাকাই; দেখি না। আমাদের তাকানোর হাত থেকে রেহাই নেই। চোখ বন্ধ করেও যেনো কিছু দেখতে পাই। কেনো এই আয়োজন, প্রয়োজন? এই পৃথিবীতে অনেকে চোখে দেখেন না। তাকে সেলাম করে আমাদের চোখ বন্ধ করে আমাদের দেখবার, শিখবার প্রয়োজন। আমরা খালি তাকাবো-কিছুই দেখবো না... তা তো হবে না। চোখ বন্ধ করে আমরা যেনো দেখতে পারি। সেই কাজটুকুন চিত্রনাট্যকারের, সেই কাজটুকুন চলচ্চিত্রকারের। আমরা আজ... আমি অনেক আওয়াজ দিতেছি-এইটুকুন আওয়াজের কাছাকাছি প্রজেক্শন আমি পর্দায় বসাতে চেয়ে পারি না। এটা আমার নিজের ব্যর্থতা, আমার নিজের না পারার সঙ্কট। কিন্তু আপনি আজকে যখন চিন্তা করবেন এই বিষয়ে, তখন যেনো এই ভাবনাটা মাথায় থাকে-‘দেখা মানে শুধু তাকানো নয়।’
আচ্ছা, আর কথা না বলি। বরং, আপনারা কিছু বলেন। আর কথা না বলি। (দর্শকসারিতে বসা সম্পাদককে উদ্দেশ করে) আপনি আসেন, আপনিই আসেন...
কাজী মামুন হায়দার :ধন্যবাদ আসলে আতিক ভাইকে। দুই ঘণ্টার মতো চললো। আমাদের ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা। শুরু হয়েছিলো জহির রায়হানকে দিয়ে-আমাদের ফিল্মের জাতীয় চরিত্র নির্মাণ নিয়ে। কথা আতিক ভাই বলছেন। আমরা হয়তো কথা বেশিদূর এগুতে পারিনি। তারপরও কিছু বোধ, কিছু বোঝাপড়া, আমাদের মধ্যে নিশ্চয় তৈরি হয়েছে। যে-গুলো বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র নির্মাণে হয়তো ভূমিকা রাখবে এবং আমরা হয়তো কোনো একসময় বলবো বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, আমাদের চলচ্চিত্র। যেটির শেষকথা বিনয় মজুমদার তার ছোটগল্পে বলেছিলেন যে, নিজের ছেলের নখের দিকে আমরা তাকাতে পারি না। আমরা নিশ্চয় আমাদের নিজের ছেলের নখের দিকে তাকাবো, তার সৌন্দর্য বুঝবো। আজ এখানে এই মূহুর্তে শেষ করা হচ্ছে- ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা-১। নিশ্চয় আগামীতে আবার আমরা ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা-২, ৩, ৪, ৫... করবো; আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকবেন।
নূরুল আলম আতিক :না না আরও কথা আছে। আমি আরও দুজন মানুষের সঙ্গে কথা বলবার জন্যে আসছি। তাদের কিছু কথা শুনতে চাইবো। নিউটন স্যার আর মামুন স্যার। আমরা কিছু কথা... না বাহিরেই শুধু নয়; অন্যদের সঙ্গেও কিছু কথামালা হোক (কাজী মামুন হায়দার :স্যার কিছু কথা বলেন মামুন স্যারকে বলছি একটু...নিউটন স্যার আর মামুন স্যার একটু) আর সুস্মিতা আপা যাই হোক... নিউটন ভাই আপনার দুইটা লাইন হইলেও বলেন।
সেলিম রেজা নিউটন : পাগলের পাল্লায় পড়লে পাগলামির উসকানি বেড়ে যায়। আমি এখানে বসে আছি যে, কখন তাকে একটু আলাদা করে পাবো। এবং প্রকৃত অভিব্যক্তি পায়ের নখের দিকে তাকানোর সুযোগ পাবো। যেখানে এ-ধরনের একটি আনুষ্ঠানিক পরিবেশে এটাকে আমি অভিযোগই করে ফেলি রানার (কাজী মামুন হায়দারের ডাকনাম) কাছে প্রকাশ্যে। খুব আনুষ্ঠানিক লাগলো আজকে আমার এখানে। আমি এইরকম ভাবিইনি। অনেক আনুষ্ঠানিক মনে হলো। কিন্তু গণযোগাযোগের অন্তত এইরকম চেহারা দেখতে আমি তৈরি ছিলাম না; আমি তৈরি না থাকলে কী হবে, যাই হোক আতিককে আমাদের মাঝে পাওয়া গেলো, আমরা খুব কাছাকাছি মানুষ ছিলাম এককালে সে বহু বহু বহু বহুকাল আগে। (কথার মাঝে নূরুল আলম আতিক বললেন,আমাকে আপনার মনে থাকবার কথা না) না না ওইটুকু মনে আছে আতিক। আর হলো এইতো আজকের অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাক। সামাদী স্যার, ওনারা-বিধান দা আমাদের অন্যান্য শিক্ষকরা যারা এখানে এসেছেন তারা খুব ভালো লাগলো; এদের জন্য। আর রানাকে প্রশংসা করবার কিছু নাই, মানে এর সবটাই প্রশংসার।
আর তার মধ্যে আনুষ্ঠানিকতা, আর মারাত্মক আকারের ব্যানারটুকু আর (নূরুল আলম আতিক বললেন,এতোবড়ো টেবিলটুকুন [শুনে নিউটন স্যারের হাসি], আমি যে কারণে আমি মাইক্রোফোন বিসর্জন দিলাম, আমি নিজে আওয়াজ নিয়ে কথা বলছিলাম। কিন্তু আমি নিজে থেকে কথাটা...) আনুষ্ঠানিকতাটুকু বাদ দিলে গোটাটাই... রানা এখানে অন্ধকারের মধ্যে বাতি জ্বালিয়ে বসে আছে আমাদের ডিপার্টমেন্টে; এটা খুব স্বস্তির কথা, শান্তির কথা। এই ভরসায় আমরা কিছুদিন একটু এদিক-সেদিক এলেবেলে...(আতিক মুচকি হেসে বললেন, এলেবেলে কথামালা) এলেবেলে ঘুরে বেড়াতে পাচ্ছি। থাক্, এইতো। সবাইকে ধন্যবাদ আর উনি যে এখানে এসে এভাবে এই পাগলামিটুকু বজায় রাখতে পারছেন এটা দুর্দান্ত ব্যাপার। জোশ্ । থ্যাংক ইউ। (দর্শকদের হাততালি)
নূরুল আলম আতিক : আরেকজন (আ. আল মামুনকে উদ্দেশ্য করে) আপনার কথা শুনতে চাই।
কাজী মামুন হায়দার :(আ. আল মামুনকে উদ্দেশ্য করে) স্যার আসেন। আমি আশা করতেছি সামাদী স্যার কিছু একটু বলবেন। স্যার আসছেন, আমাদের মাঝে।
আ. আল মামুন :আমি আসলে এক মিনিটে শেষ করে ফেলবো। ফিল্ম নিয়ে আমি উৎসাহী এবং বিশেষ উৎসাহী ছিলাম আতিক ভাইয়ের কথা শোনার জন্য। শুনলাম। এতো ছেলেমেয়ে এখানে জড়ো হয়েছে সেটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার। আমাদের আলোচনা আসলে আতিক ভাই যে উসকানিগুলো দিয়ে গেলেন সেই উসকানিগুলো যেনো আমাদের মাথার মধ্যে কাজ করে পরবর্তীতে। এখন আমিতো এ-গুলো কম দেখতে পাই। এবং আশা করি আরও বেশি দেখতে পাবো। ক্রিয়েটিভিটির চেষ্টা করা, পড়া, ভাবা, লেখা-সেই জায়গাগুলা আমি দেখতে পাই না। অনেক বড়ো রকমের মানে উৎসাহ, প্রণোদনা এবং নিজের উপর রাগ হিসেবেও কাজ করে। ধন্যবাদ।
কাজী মামুন হায়দার: নিউটন স্যারের অভিযোগটা মাথায় নিয়ে বলছি, আসলে অনেকটা সেই প্রযুক্তির সুবিধাটুকু নেওয়া আর কী। আর একটা বিষয় যে আমরা আজকের এই বক্তৃতাটা ট্রান্সক্রিপ্ট করে আগামী সংখ্যায় ছাপবো। এটা একটা আমাদের চিন্তা। (বিদ্যুৎ চলে যায়) জেনারেটর আছে, সমস্যা নাই, দুই মিনিট লাগবে। সামাদী স্যার (সফিকুন্নবী সামাদী) কিছু বলবেন না একটু?
সফিকুন্নবী সামাদী: না, না ঠিক আছে।
নূরুল আলম আতিক : স্যার ওখান থেকেই যদি বলেন অন্ধকারের মধ্যে...
কাজী মামুন হায়দার : স্যার অন্ততপক্ষে শেষ করে যান।
সফিকুন্নবী সামাদী: আমি আসলে সিনেমা পাগল লোক। আমি সিনেমা দেখতে পছন্দ করি। সিনেমা ভক্তদের, সিনেমা নির্মাতাদের পছন্দ করি। কথা শুনতে ভালো লেগেছে। আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।(দর্শকদের হাততালি)
কাজী মামুন হায়দার : আসলে এই ক্ষুদ্র আয়োজন আমাদের ছিলো, স্যারেরা সবাই আসছেন; আমি সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি ম্যাজিকলণ্ঠন-এর পক্ষ থেকে। আর আতিক ভাই ঢাকা থেকে সেই কালকে রাতে প্রচণ্ড গরম... আমি আশা করছি তার আসা অব্যাহত থাকবে এবং তিনি আর কাউকে আসায় সহায়তা করবেন। সবাইকে ধন্যবাদ। ম্যাজিকলণ্ঠন কথামালা শেষ করছি। (দর্শকদের হাততালি)
নূরুল আলম আতিক : কিন্তু আমি আরও এক মিনিট কথা বলতে চাই (কাজী মামুন হায়দারকে উদ্দেশ করে) এই লোক আমাকে উত্যক্ত করলো। কথা দিয়ে নয়; ম্যাজিকলণ্ঠনদিয়ে। কোথাও একটু বাতি দেখা গেলো; ওরে এতো অন্ধকারের মধ্যে কোথা একটু বাতি জ্বললো, আচ্ছা কী বলতে চায়; তাই বাতি দিয়ে কী ইশারা? একদিন কথা হলো তার সঙ্গে... তার কয়েকদিন বাদে এ-রকম একটা প্রোগ্রাম নিয়ে। অনেকদিন কোনো খোঁজখবর নাই বরং মামুন ভাইয়ের (আ. আল মামুন) সঙ্গে আমার যোগাযোগ এর মধ্যে দু-একবার হয়ে থাকবে। শেষ পর্যন্ত আরেক মামুন ভাই ... যাই হোক। উনি এখানে হাজিরার জন্য আয়োজন করেছেন ঠিক আছে। আমি, স্যার আছেন, নিউটন ভাই মানে নিউটন স্যারই বলবো; এরা আছেন-আপনারা আছেন। আমি সিনেমা নিয়ে কথা বলবার এখতিয়ার রাখি না। অ্যাকাডেমিক্যালি যেমন আমি তাকে বারবার বলছিলাম-আমার, আমার নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু আপনাদের সঙ্গে শেয়ারিংয়ের জায়গা ছাড়া আমার এর বাইরে আর কিছুই নেই। আর এই ডাইনে বামে, হ্যাঁ আপনাদের কৃতজ্ঞতা; আপনারা আসছেন প্রথমেই আমি ঘাবড়ে গেলাম এই লাল টেবিল দেখে। তারপর তা থেকে রেহাই পাবার জন্য মাইক্রোফোনটা নিলাম না। আমি কিন্তু আস্তে কথা বলি। কিন্তু মাইক্রোফোন থাকলে আমার সঙ্কট হয়; মনে হয় আমি কথা বলছি না, বলছে অন্য কেউ। এই আমিত্বের আকাঙ্খা এই কাণ্ডটুকু করা; জানি না আপনাদেরকে কতোটা বিরক্ত করলাম। সেলাম। (দর্শকদের হাততালি)
nurulalamatique@yahoo.com
দায় স্বীকার : বিশাল এই কথামালাটি রেকর্ডিং থেকে প্রতিলিপি করতে সহায়তা করেছেন ইমরান হোসেন মিলন, রুবেল পারভেজ, তৈয়ব তরুণ,মাজিদ মিঠু ও রুম্পা রানী রায়। আর পুরো লেখা তৈরিতে সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেছেন রোকন রাকিব।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন