Magic Lanthon

               

আবু সাইয়ীদ

প্রকাশিত ১৭ ডিসেম্বর ২০২২ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

‘চলচ্চিত্রের দর্শকপ্রিয়তায় নির্মাতার দায়’

আবু সাইয়ীদ


ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা-২

স্থান                            : ১২৩, রবীন্দ্র কলাভবন

                                   রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সময়                           : ৫ ডিসেম্বর ২০১২

                                   বিকেল চারটা

 

সঞ্চালক-১ : সম্মাননীয় উপস্থিতি, অনুগ্রহ করে আপনাদের ফোনগুলো সাইলেন্ট করুন।

সঞ্চালক-২ :দূরে বহুদূরে/স্বপ্নলোকে উজ্জয়িনীপুরে কবির মতো আমরা স্বপ্নলোকে নয়, যেতে চাই বাস্তবতার পিঠে চড়ে। এ-স্বপ্নটাকেই সঙ্গে করে আমাদের যাত্রার শুরু।

সঞ্চালক-১ : আজ ৫ ডিসেম্বর ২০১২, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪১৯। অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় আমি রায়হানুল রানা।

সঞ্চালক-২ : আমি হালিমা খুশি। সম্মাননীয় উপস্থিতি, আপনারা হয়তো বলবেন-এতো বিষয় থাকতে চলচ্চিত্র বিষয়ক জার্নাল হিসেবে ম্যাজিক লণ্ঠন কেনো? আমাদের লক্ষ্য-চলচ্চিত্রের ভালো দর্শক ও ভালো লেখক তৈরি করা। আর চলচ্চিত্র মানে তো শুধু কিছু মানুষের করে যাওয়া অভিনয় নয়; এর সঙ্গে মিশে আছে পুরো সমাজ ব্যবস্থার চিত্র। তবে, এখানে টেলিভিশন, রেডিও এবং নিউ-মিডিয়ার বিভিন্ন বিষয় নিয়েও আলোচনা করা হয়। জার্নালটি ষাণ্মাসিকভাবে প্রকাশ হয়।

সঞ্চালক-১ : জার্নালটিকে আমার বা আমাদের করে না রেখে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি আগ্রহী শিক্ষক ও সাবেক শিক্ষার্থীরাও রয়েছেন।

সঞ্চালক-২ : জার্নালটিকে মধ্যমণি করে আমরা করে থাকি নানা কর্মকাণ্ড। যার অংশ হিসেবে রয়েছে পাঠচক্র, সেমিনার এবং নিয়মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। আমরা স্বপ্ন দেখি স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা নির্মাণের; এরই অংশ হিসেবে স্বপ্নযাত্রার এ-পথে আমাদের ইচ্ছে ছিলো চলচ্চিত্র সম্পর্কিত কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির অভিজ্ঞতাপূর্ণ কথা শোনার। আর সে-থেকেই আজকের এই আয়োজন।

সঞ্চালক-১ : সম্মাননীয় উপস্থিতি। ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা-২ এর কথা-উপস্থাপনার বিষয়-চলচ্চিত্রের দর্শকপ্রিয়তায় নির্মাতার দায়। কথা উপস্থাপন করবেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা আবু সাইয়ীদ।

সঞ্চালক-২ : এবারে আমি সম্মাননীয় অতিথিকে মঞ্চে আসন গ্রহণ করবার জন্য অনুরোধ করছি। (অতিথির আসন গ্রহণ এবং দর্শকদের হাততালি) ধন্যবাদ সম্মাননীয় অতিথি। সম্মাননীয় অতিথিকে ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা-২ শুভেচ্ছা-স্মারক দিয়ে বরণ করে নেবেন ম্যাজিক লণ্ঠন-এর সম্পাদক কাজী মামুন হায়দার রানা। জনাব কাজী মামুন হায়দার রানাকে শুভেচ্ছা-স্মারকটি দিয়ে সম্মাননীয় অতিথিকে বরণ করে নেবার জন্য অনুরোধ করছি (স্মারক দিয়ে বরণ এবং দর্শকদের হাততালি)। ধন্যবাদ সম্মাননীয় অতিথি এবং সম্পাদককে।


আবু সাইয়ীদের হাতে শুভেচ্ছা স্মারক তুলে দিচ্ছেন সম্পাদক


সঞ্চালক-১ : এবার ম্যাজিক লণ্ঠন পরিবারের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা বক্তব্য দিবেন ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা-২ আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক এম জিয়াউল হক সরকার। জনাব এম জিয়াউল হক সরকারকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করছি।

এম জিয়াউল হক সরকার : সম্মাননীয় উপস্থিতি। সবাইকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। গতবার আমরা ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালার আয়োজন করেছিলাম। আমাদের ইচ্ছে ছিলো ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা-১, ২, ৩ এ-রকম করে ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে। ঠিক এরই ধারাবাহিকতায় আজকে ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা-২ এর আয়োজন। বিশেষ ব্যস্ততার মধ্যেও সম্মাননীয় অতিথি প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা আবু সাইয়ীদ আমাদের মাঝে এসেছেন। এ-জন্য বিশেষ করে তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। ম্যাজিক লণ্ঠন শুধু আমাদের একটি জার্নাল নয়; এখানে আমরা সেমিনার, পাঠচক্র, সিনেমা দেখা, আর সিনেমা নিয়ে অনেক কথা বলাসহ নানা লেনদেন করে থাকি। সেখান থেকে চলচ্চিত্র সম্পর্কে আমাদের যে-বোঝাপড়া; সেখান থেকে আমরা যদি একটু চিন্তা করি-সেটা হলো এ-দেশের চলচ্চিত্রের অবস্থা খুব বেশি ভালো নয়। এটা মূলধারার চলচ্চিত্রে বর্তমান অবস্থা কিংবা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মন কিংবা চলচ্চিত্রের সেন্সর বোর্ড কিংবা আমাদের দর্শক-শ্রোতার রুচির মান; সবকিছু মিলেই এ-দেশের চলচ্চিত্র সিনেমার অনুকূলে নয়। এর আগেও ছিলো না। কিন্তু, গত ২০ বছর ধরে এ-দেশে মূলধারার সিনেমার পাশাপাশি শর্টফিল্ম কিংবা ইন্ডিপেন্ডন্ট ফিল্ম কিংবা আরও অনেক ধারার বেশকিছু সিনেমার কাজ দেখতে পাই। সেগুলো যে এ-দেশের সিনেমাকে বিশেষ কোনো জায়গায় নিয়ে গেছে কিংবা সিনেমাকে সবার জন্য গড়ে তুলেছে; তেমনটি বলা যাচ্ছে না।

আসলে এক সময় সিনেমাটা এ-রকম ছিলো যে-আমরা মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই মিলে সিনেমা হলে যেতাম। সিনেমাটা ছিলো আমাদের জন্য একটা প্রার্থনালয়ের মতো, একটা দেবালয়ের মতো। কিন্তু হঠাৎ করে সিনেমা আস্তে আস্তে এমন একটা সঙ্কটের মধ্যে ঢুকে পড়লো যে, আজ সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সিনেমা হলগুলো উচ্ছেদ হচ্ছে, সেখানে শপিং কমপ্লেক্স হচ্ছে। সিনেমাটা আর আগের জায়গায় নেই। তাহলে কি আমাদের সিনেমা পথ হারিয়েছে? সারা বিশ্বের যে-পরিবর্তন; সারা বিশ্বের সিনেমার ক্ষেত্রে যেমন : ইরানে, কিউবাতে, লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও সিনেমার পরিবর্তনগুলো দেখতে পাচ্ছি-তারা আন্তর্জাতিকমানের সিনেমা তৈরি করছে। সেখানে তাদের সবকিছুই, বলতে গেলে দর্শকদের চাহিদা-রুচির যে-রকম পরিবর্তন ঘটেছে ঠিক তেমনিভাবে একটা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু আমাদের দেশের সিনেমায় আমরা তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ করতে পারছি না। এখন এই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আমরা শুধু আমাদের দেশের এক শ্রেণির মানুষদের দায়ী করতে পারি না। সেখানে যেমন দর্শকদের কথা আছে, সে-রকম নির্মাতার কথা আছে, প্রযোজকের কথা আছে এবং পরিবেশকেরও কথা আছে।

একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা তারও কিন্তু কিছুটা দায় থেকে যায়, সিনেমাটাকে সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বা এর বিকাশের একটা জায়গায় নিয়ে যেতে কিংবা আন্তর্জাতিকমানের করতে তারও নিজস্ব কিছু একটা দায়বদ্ধতা থাকে। সেখান থেকেই আসলে আমরা সিনেমাতে কী চাই? কেনো চাই? কীভাবে চাই? বা দর্শকদেরকে একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য, তাদের রুচির মানটা পরিবর্তনের জন্য কী ধরনের ভূমিকা থাকতে পারে; কোন্ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা যেতে পারি। সেখানে একজন নির্মাতা; সচেতনভাবে তার কিছু ভূমিকার অবশ্যই একটা জায়গা থাকে। সেখান থেকে একজন নির্মাতা; কীভাবে তিনি একটা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে, একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাবেন; সেটা যেমন একটা জায়গা থেকে তিনি করবেন ঠিক তেমনিভাবে একজন শ্রোতা কিংবা একজন দর্শক তিনি বুঝতেই পারবেন না যে-সিনেমার পরিবর্তনটা কীভাবে হচ্ছে। এবং তিনি ভাববেন যে, আসলে সিনেমাতে আমরা যা চাচ্ছি তাই পাচ্ছি, সিনেমাটা আমাদের মতো করে হচ্ছে।

আমাদের যে-আশা, আমাদের যে-আকাঙ্ক্ষা সেগুলোও প্রতিফলিত হচ্ছে সিনেমায়। এটা শুধু যদি এ-রকম হয় যে, সিনেমার যে-কোনো একটি অংশ হিসেবে কিংবা একটি ধারা নিয়ে যেমন-আমাদের দেশে যেটা হলো বিকল্প ধারা। একটা ধারার মধ্য দিয়ে আমরা সিনেমার পরিবর্তন করবো, তাহলে এটা অনেক কষ্টকর হবে। কারণ, আমরা দেখেছি যে-সিনেমাটাকে যদি আমরা সেই জায়গাতে দেখতে চাই; যেমন দেবালয়ের মতো ছিলো, প্রার্থনালয়ের মতো ছিলো। সেখানে কিন্তু সবার জন্য সিনেমা ছিলো। সেটা যেমন আমরা দেখতে পেতাম, আমাদের ছোটরাও দেখতে পেতো। সেটা আমাদের দেশে জহির রায়হানও সে-রকম অনেক সিনেমা করেছিলো। তাহলে সেই জায়গায় যদি আমরা ফিরে যেতে চাই; তাহলে আমাদের যারা নির্মাতা তাদেরকে সুচারুভাবে, একটা পরিকল্পিতভাবে, নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে আমাদের সিনেমাটাকে সেখানে নিয়ে যেতে হবে। নিশ্চয় আমাদের দেশে যারা চলচ্চিত্রনির্মাতা আছেন, এগুলো ভাবছেন এবং তারা সেভাবে আমাদের সিনেমাকে আন্তর্জাতিকমানের করার জন্য কিংবা সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য কিংবা সবার জন্য সিনেমা করার জন্য তারা চিন্তা-ভাবনা করছেন। আমরা আজকে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা আবু সাইয়ীদের কাছ থেকে আসলে আমাদের যে-আকাঙ্ক্ষার জায়গাগুলো কিংবা সিনেমার যে-জায়গাটা আমাদের দরকার কিংবা আমরা যেটা চাচ্ছি অবশ্যই আমরা তা বুঝতে পারবো এবং জানতে পারবো। আমাদের কথা হবে...ধন্যবাদ সবাইকে। (দর্শকদের হাততালি)।

সঞ্চালক-২ : ধন্যবাদ জিয়াউল হক। সম্মাননীয় উপস্থিতি, আমাদের আজকের এই আয়োজনকে আমরা দুটো পর্বে ভাগ করেছি। প্রথম পর্বে থাকছে সম্মাননীয় অতিথির কথামালা এবং দ্বিতীয় পর্বে থাকছে প্রশ্নোত্তর। আমরা লিখিত আকারে প্রশ্ন নেবো। আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যরা আপনাদের কাছে যাবেন এবং লিখিত প্রশ্নটি সংগ্রহ করবেন।

সঞ্চালক-১ : তাহলে আর দেরি নয়; এখন আমরা সরাসরি চলে যাচ্ছি আবু সাইয়ীদের কাছে। এবারে জনাব আবু সাইয়ীদ আমাদের সামনে উপস্থাপন করবেন তার কথামালা।

আবু সাইয়ীদ : উপস্থিত সুধীমণ্ডলী। আমার খুবই ভালো লাগছে যে, এ-রকম একটি অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত হতে পেরেছি। ম্যাজিক লণ্ঠন পত্রিকাটি সম্বন্ধে আমার তেমন কোনো ধারণা ছিলো না। কিন্তু গত দুই-তিন মাস আগে যখন আমি এই পত্রিকাটি পেলাম; পুরোপুরি পড়তে পারিনি, কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে পড়ে আমি সত্যিই অভিভূত হয়েছি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ-রকম একটি কর্মকাণ্ড বিশেষ করে এই পত্রিকা এবং এই পত্রিকার লেখা, লেখার যে-দৃষ্টিভঙ্গি, লেখার যে-মান সেটা সত্যিই আমাকে অনেক আপ্লুত করেছে। হয়তো সংযোগের বা যে-কারণেই হোক না কেনো আমি এই পত্রিকাটি নিয়ে কিছু জানতাম না। যেমন গত পরশুদিন মফিদুল হক; উনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিলো, উনাকে বললাম উনিও জানেন না যে এ-রকম একটি পত্রিকা আছে।  আমি উনাকে বলছিলাম যে, বেশ ভালো একটি পত্রিকা রাজশাহী থেকে বের হয়। এই মুহূর্তে হয়তো আমি বিস্তারিত বলতে পারবো না নির্দিষ্ট কোনো লেখা সম্পর্কে। তবে যা বলতে পারবো, তা হলো-কোনো একটি লেখা আমি পড়ছি, সে-লেখার ধরন বিশেষ করে, যেভাবে বিশ্লেষণ করার একটা প্রবণতা লেখাগুলোর মধ্যে আছে; আমি ধরেই নিয়েছিলাম কোনো একজন শিক্ষক বা একজন ভালো গবেষক লেখাটা লিখেছেন। কিন্তু পড়া শেষে যখন আমি লেখকের পরিচিতিটা পাচ্ছি, তখন দেখছি লেখক একজন ছাত্র, তখন সেটা আমাকে আরও বেশি বিস্মিত করেছে (দর্শকদের হাততালি)। আমার কাছে মনে হয় দ্বিতীয় বর্ষ কিংবা তৃতীয় বর্ষের যে ছাত্র ওরা যা করছে, ওই-বয়সে আমিই বোধহয় চলচ্চিত্র; বিশেষ করে একটি চলচ্চিত্রকে বা একজন নির্মাতার সামগ্রিক কর্মকাণ্ডকে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং দার্শনিকভাবে ব্যাখ্যা করার যে-একটা চেষ্টা; সেটা আমার মধ্যে ছিলো না। সে-কারণেই আমি খুবই একটা অস্বস্তির মধ্যে ছিলাম, এমন শ্রোতার মাঝে আমাকে কিছু বলতে হবে এই ভেবে। ব্যক্তিগতভাবে আমার বেড়ে ওঠা একেবারেই মফস্বল জেলায়-বগুড়াতে। এই ব্যর্থতা স্বীকার করতে আমার কোনো অসুবিধা নেই যে, আমি এইভাবে একটি পরিমণ্ডলের মধ্য দিয়ে বড়ো হইনি; যেখানে একটা মানুষের অনেক বিষয়ে জানা বোঝাপড়ার ব্যাপার থাকে। বিশেষ করে এমন আমার ধারণার মধ্যেই ছিলো না যে, একজনকে অনেক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে বড়ো হতে হয়। যখন জানলাম, তখন আসলে সময়টা এতোটাই পেরিয়ে গেছে যে, তখন আর নিজেকে সংশোধনের সুযোগ নাই। সে-কারণেই আমার যেটুকু কর্মকাণ্ড; ভালো-মন্দ যাই হোক, তার যে-সীমাবদ্ধতা, তার যে-শৈল্পিক প্রকাশে অদক্ষতা, সেটা হয়তো আমার আন্ডার্স্ট্যান্ডিংয়েরই দুর্বলতা। কিন্তু একটা বোধ বা অনুভূতি, ভিতরে একটা কিছু করার আবেগ বা প্রবণতা আমার মধ্যে ছিলো বলেই হয়তো কিছুটা ধারাবাহিকভাবে কয়েকটা কাজ করতে পেরেছি।


কথা উপস্থাপনায় আবু সাইয়ীদ


যাই হোক, খুবই ভালো লাগছে যে, আপনারা আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এবং সেই সঙ্গে একবারেই অচেনা একটি গ্রুপ এবং মামুন ভাইয়ের সঙ্গে আমার জানাশোনা ছিলো না। নিউটন ভাইয়ের কিছু লেখার সঙ্গে হয়তো জড়িত ছিলাম এটুকুই, আর অন্যরা তো একেবারেই আমার অপরিচিত।

তো এবার আজকের এই কথামালার যে-বিষয়টা সেটা নিয়ে একটু আলোচনা করি; যদিও আমি বলেই নিচ্ছি যে, আমি কখনই খুব ভালো বলতে পারতাম না এবং এখনও পারি না। তো যেহেতু এই কথামালায় একটা সুবিধাজনক দিক আছে যে, প্রশ্নপর্ব এবং সবাই এখানে অংশ নেবে; সুতরাং সেটাই একটু ভরসা। সবাই মিলেমিশে এই কথামালাটা কোথাও দাঁড় করানো যায় কি না। আমি এই বিষয়টা নির্ধারণ করার একটা মূল কারণ; প্রথম দিকে যখন আমি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করি, বিশেষ করে ৮০র দশক বা ৯০র দশকেও আমাদেরকে খুব বেশি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো না যে, আমাদের ছবির দর্শক এতো কম কেনো বা যে-ছবির দর্শক এতো কম, সে-ছবি নির্মাণ করাটা কতোটুকু যৌক্তিক। কিন্তু ইদানিংকালে প্রায়ই এ-প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এটা হয়তো আজকের বাস্তবতা, বিশেষ করে সমস্ত কিছুকে পণ্য করে দেখার একটা প্রবণতা থেকেই হয়তো এমনটা হয়ে আসছে। আমাকে জার্নালিস্টরা প্রায়ই একই প্রশ্ন করেন, কেনো হলে আমার বা এ-ধরনের ছবি চলছে না বা ছবি প্রদর্শনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না? এমনকি আমার ছবিগুলোকে এখন পর্যন্ত, যে-ছবিটি হয়তো শ্রেষ্ঠ পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে, কোনো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে শ্রেষ্ঠ ফিল্মের অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছে-যা একটা ফিচার ফিল্মের অ্যাওয়ার্ড, তারপরও এই ছবিকে অনেকে মনে করছে শর্টফিল্ম। তো বিভিন্ন সময় এই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমার এই দর্শক এবং একজন নির্মাতার দায় বিষয়ে আমার কিছু ভাবনা আজকের কথামালায় উপস্থাপন করতে চাই। কেনো এই ছবিগুলোর দর্শক খুবই কমতি; বিশেষ করে আমাদের ধারার। বিশেষ করে সেখানে আমার বা অন্য একজন নির্মাতার দায় কতোটুকু? বা আমাদের সামগ্রিক যা পরিস্থিতি যেমন-ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম, এমনকি দর্শকেরও দায় কতোটুকু? যদিও চলচ্চিত্রের, এটা সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যাই বলি না কেনো; যতোগুলি শিল্পমাধ্যম এখন পৃথিবীতে আছে চলচ্চিত্রের দর্শকের কাছে যাওয়ার যে-ক্ষমতার বিষয়টা এটি আর কোনো শিল্পমাধ্যমের নেই। আমি এটাকে সৌভাগ্যও মনে করবো এবং একই সঙ্গে দুর্ভাগ্যও মনে করবো।

যদি আমরা এখানে একটা উদাহরণ দিই আমাদের বাচ্চু ভাই, মানে নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু উনি দুটি চলচ্চিত্র বানিয়েছেন। এর আগে একাত্তরের যীশু এবং সম্প্রতি গেরিলা। আমার ধারণা তার দুটি ছবির যে-কোনো একটি যতো দর্শক দেখেছে তার নির্দেশিত থিয়েটার তার সবগুলো যোগ করলেও হয়তো অতো দর্শক দেখেনি। এটা চলচ্চিত্র, এ-কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া অন্য শিল্পমাধ্যমও তা পেইন্টিংস, কিছু পপুলার গ্রন্থ বাদ দিলে অধিকাংশ সাহিত্যের ক্ষেত্রেই একই কথা প্রযোজ্য। সেটি ছোটগল্পেই হোক বা উপন্যাসেই হোক, বিপুল সংখ্যক দর্শক-পাঠকের কাছে যেতে পারে না; যেটা পারে চলচ্চিত্র। এটাকে আমি সৌভাগ্য বলবো যে, একটি শিল্পমাধ্যম অনেকের কাছে যাচ্ছে। কিন্তু এটা একইভাবে দুর্ভাগ্য যে, দর্শকের কাছে যাওয়ার প্রবণতা থেকেই এই শিল্পটা যতোটা না শিল্প, যতোটা আর্টের জায়গায় থাকছে, তার থেকে অনেক বেশি ইন্ডাস্ট্রি বা একটা প্রোডাক্টে রূপান্তরিত হচ্ছে। যেটা আমাদের চলচ্চিত্রের শিল্পমানকে রক্ষা এবং শিল্প হিসেবে এই নিজস্বতা বজায়ে ব্যর্থ হচ্ছে।

সর্বত্রই আমাদের বোধহয় একটা লক্ষ্য থাকে যে, চলচ্চিত্র আমাদের দর্শক-শ্রোতার কাছে যাক, এটা সবারই কাম্য থাকবে। কিন্তু তার অঙ্গহানি ঘটিয়ে অর্থাৎ শিল্পমানের কোনো কম্প্রোমাইজ বা যে-কোনো ভাবে যেনোতেনো প্রকারে দর্শককে টানতে হবে! দর্শক খাবে এই অজুহাতে চলচ্চিত্রের নির্মাণ বা এর প্রদর্শনের জন্য যে যে উপকরণ দরকার যা মোটেও দৃষ্টিনন্দন নয়, সেটা যদি ইম্পোজ করা হয়, তাহলে কিন্তু স্বাভাবিক একজন শিল্পীর যে-কমিটমেন্ট থাকে বা তার যদি শৈল্পিক বা সামাজিক বা অন্য কোনো দায়বদ্ধতার কাছে পৌঁছতে হবে। একটি শিল্পকর্ম দর্শকের কাছে পৌঁছুক, পাঠকের কাছে যাক বা শ্রোতার কাছে যাক-এটা সবারই কাম্য থাকবে। কিন্তু সে তার অঙ্গহানি ঘটিয়ে অর্থাৎ শিল্পমানের কোনো কম্প্রোমাইজ বা কোনো প্রকারে দর্শককে টানতে হবে! এই জন্য সেইভাবে এটির নির্মাণ বা এর প্রদর্শনের জন্য যে যে উপকরণ দরকার, সেটা যদি ইম্পোজ করা হয়, তাহলে কিন্তু তার স্বাভাবিক যে-একজন শিল্পীর যদি কমিটমেন্ট থাকে তার যদি শৈল্পিক বা সামাজিক বা অন্য কোনো দায়বদ্ধতা থাকে সেটা অবশ্যই ব্যাহত হয়; সেটা আমি মনে করি। হয়তো অনেকেই একমত হবেন না; হয়তো আবার অনেকেই রক্ষণশীল মনে করবেন, আমি এই এতো ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তার পক্ষে নই, কারণ এই দর্শকপ্রিয়তার দোহাই দিয়ে চলচ্চিত্রকে পণ্য করে তোলা হচ্ছে, এর বাইরে আর কিছু নয়।

আমরা যদি বিভাজন করি যে, ৭০র দশকে বা তারও আগের ৫০ দশকের, ৬০ দশকের যে-চলচ্চিত্রগুলো; পরবর্তী পর্যায়ে ৭০র, ৮০, ৯০ এভাবে আপনি একটা জিনিস লক্ষ করেন, আগের সময় নিয়ে বলা হয়-আমরা সবাই স্বর্ণালি যুগে ছিলাম, আমরা সবাই পারিবারিকভাবে ছবি দেখতাম; সবাই মিলে। ফিল্ম আমাদের কালচারের মধ্যে ছিলো। এটা যেমন সত্যই ধরে নেয়া যায় কিন্তু তারপরও আমরা সেই ছবির ভাবনাগুলো, গল্পগুলোকে, সেই উপস্থাপনগুলোকে বিবেচনায় আনি তবে কিছু চলচ্চিত্র বাদ দিলে, যেমন জহির রায়হানের দুই-তিনটা ছবি যেমন কখনো আসেনি, কাঁচের দেয়াল, কিংবা সূর্যস্নান বা নদী ও নারী, ওইসব চলচ্চিত্রের মান আসলে কোথায় ছিলো! সেটা যদি আমি সাহিত্যের সঙ্গে তুলনা করি সেটা তো নীহাররঞ্জন, নিমাই ওইরকমই একটা উপসন্যাসেরই বা ওইসব চলচ্চিত্র ওই মানেরই একটি প্রেমের গল্প। গৎবাঁধা কাহিনী বিন্যাস বা মানে, শুধুমাত্র একটি ঘটনা ঘটলে গল্প শেষ হয়। যেমন হয়তো নায়ক একটা সিঁড়ি দিয়ে নামছে, আবার নায়িকা হয়তো পাশের সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছে-শুধু এইটুকুই; এই মিলনটুকুই না ঘটিয়ে অন্য এক নাটকীয়তা তৈরি করে অযৌক্তিকভাবে একটা দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা; আমাদের চলচ্চিত্র বরাবর এই সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়েই বা এই গণ্ডিবদ্ধতার মধ্য দিয়েই এগিয়ে গেছে।

পরবর্তী পর্যায়ে এই একঘেঁয়েমিতা কাটানোর জন্য। তারপরে পর্যায়ক্রমে কোনো ভাবনা, বিষয়বস্তু বা অন্য কোনো দিক থেকে এটার কোনো উত্তরণের চেষ্টা না করে কিছু-কিছু নির্মাতা অশ্লীলতা বা বিশেষ করে ভায়োলেন্স-এর আশ্রয় নেয়; চলচ্চিত্রটাকে একটু ভয়াবহভাবে প্রকাশ বা নির্মাণ করতে থাকে। যারই ফলে ৯০র পরবর্তীতে বিশেষ করে বাণিজ্যিক ছবির ক্ষেত্রে সঙ্কট খুবই প্রকট হয়েছে। এইসব ছবি একটা নতুন শ্রেণির দর্শক পেলেও, যারা আদৌ চলচ্চিত্রের দর্শক কি না সন্দেহ আছে; মূল দর্শক-শ্রেণি আস্তে আস্তে ছবি বিমুখ হয়েছে।

যদিও আমার চলচ্চিত্র নির্মাণের জায়গাটা এইসব ছবির বাইরে। তবে আমি মনে করি, বাণিজ্যিক ধারার যে-চলচ্চিত্রটা, এটা এন্টারটেইনমেন্ট-এর জন্য হতেই পারে-যা সাহিত্যেও হতে পারে; হোক তা বটতলার সাহিত্য। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে চলচ্চিত্রটাকে প্রথমত একটি অ্যা...আর্ট-ফর্ম হিসেবেই দেখতে চাই। যদিও নিজের নির্মাণ কাজে সেই প্রমাণ রাখতে পারিনি। যখন একটি শিল্প একটি আর্ট-ফর্ম, তখন কিন্তু এই শিল্পটা দর্শকের কাছে যাবার জন্য শুধুমাত্র যে-নির্মাতার দায় থাকে তা আমি মনে করি না; আমার কাছে দর্শকের দায়টাও খুবই জরুরি। আমরা যদি বিবেচনা করি-ক্লাসিক্যাল মিউজিকের কথা, আমরা যদি ভাবি কোনো চিত্রকলার কথা, এর অন্তর্নিহিত মেসেজটা প্রকাশের, এটা অনুভবের জন্য অবশ্যই শ্রোতা বা দর্শকের নিজস্ব শিল্পবোধ বা শিল্পভাবনার প্রয়োজন হয়। আবার কবিতায়-ও একই ব্যাপার। এখন যদি আমরা রবীন্দ্রনাথের কোনো কবিতা চিন্তা করি, ধরেন এক গাঁয়।


আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি

সেই আমাদের একটি মাত্র সুখ

তাদের গাঁয়ে গায় যে দোয়েল পাখিটা

তাহার গানে আমার নাচে বুক।

এটা যতো শ্রেণির পাঠককে কমিউনিকেট করতে পারবে। পাশাপাশি আমি যদি,

রূপ নারানের কুলে জেগে উঠিলাম;

জানিলাম এ-জগৎ

স্বপ্ন নয় রক্তের অক্ষরে দেখিলাম আপনারও রূপ;

চিনিলাম অপরের আঘাতে আঘাতে বেদনায় বেদনায়

সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম

সে কখনও করে না বঞ্চনা।


এ-ক্ষেত্রে কবিমনের যে-ভাবনা, সেই যে-তার অন্তর্নিহিত শিল্পবোধের প্রকাশ; তখনই একজন পাঠককে আন্দোলিত করবে যখন সেই পাঠকের মধ্যে সমতুল্য বা কখনও কখনও তারও অধিক ভাবনা বা চেতনা তার মধ্যে বিদ্যমান থাকবে। তাছাড়া কিন্তু কবি, কবিতা এবং পাঠকের মধ্যে সংযোগ ঘটানো কখনই সম্ভব হবে না। বিশেষ করে শিল্পের যেহেতু বিভিন্ন রকম আঙ্গিকগত এবং যেহেতু শিল্পের একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা বা চেতনা বা দার্শনিক দায়বদ্ধতার ব্যাপার বিচার-বিশ্লেষণ থাকে, সেহেতু এই চিন্তা-চেতনা, ভাবনা, অনুভূতির ঐক্যটা খুবই জরুরি। এখানে একটা কবিতা পড়া হলো দূরে বহুদূরে/স্বপ্নলোকে উজ্জিয়নীপুরে। এখন এই যে, এই মিথিক্যাল বিষয়গুলো নিয়ে যদি কোনো পাঠকের মধ্যে একটা ন্যূনতম ধারণা না থাকে, তাহলে কিন্তু কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে একটা বড়ো অন্তরায় তৈরি হবে। হয়তো মনে হতে পারে, একজন দর্শক বা পাঠককেও কি তাহলে অতোটা শিল্পবোধসম্পন্ন মানুষ হতে হবে কি না? আসলে আমি মনে করি, দুজন দুজনের পরস্পর, পারস্পরিক একটা যোগাযোগ স্থাপিত হতে হবে। কবি, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার সৃষ্টি করতে পারেন, কিন্তু পাঠক বা দর্শক তা পারেন না; কিন্তু বোধ ও অনুভূতির জায়গায় দুইজন সমতুল্য। যেমন আমার একটা ছবি রূপান্তর, ছবিটি হয়তো সুনির্মিত নয়, অনেক দুর্বলতা আছে তারপরেও বাংলাদেশে এই ছবির প্রতিক্রিয়া তারও অধিক কিছু ছিলো। এই ফিল্ম যখন বাংলাদেশে রিলিজ হয়, তখন অধিকাংশ দর্শক ঠিক নিতে পারেনি। অনেকে আমাকে ফোন করে অন্য ধরনের মন্তব্য করেছে, যা কখনই আমার ক্ষেত্রে হয়নি। যেটা নিরন্তর দেখেই হোক, শঙ্খনাদ দেখেই হোক বা কীত্তনখোলা দেখে হোক বা তার আগের শর্টফিল্ম দেখে হোক। এক বাক্যে অধিকাংশ দর্শকের এই ছবিটি ভালো লাগেনি। অথচ এই ছবিটি যখন ভারতে প্রদর্শিত হয়, ভারতের প্রত্যেকটি শহরে যতোগুলো উল্লেখযোগ্য ফেস্টিভ্যাল আছে সবগুলোতেই প্রদর্শিত হয়। কখনও কখনও বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। যেমন : পন্ডিচেরি; ওখানে কোনো ফেস্টিভ্যাল নাই, সেখানকার কিছু দর্শক গোয়াতে ছবিটি দেখে তারা আমাকে বললো তারা তাদের সোসাইটির জন্য একটা স্পেশাল স্ক্রিনিং করতে চায়। এমনকি পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে আমি তার পরের বছর গেলাম, ওখানে নিরন্তর ছবির স্ক্রিনিং-এ। সেখানে একটা ছেলে বললো, সে-ছবিটা দেখে গোয়াতে সারারাত ঘুমাতে পারেনি। আমি রূপান্তর ছবির পরিচালক জেনে আমাকে বিশেষ সম্মান দিলো।  

তো যাই হোক, এটার মূল কারণটা হচ্ছে যে-মিথ নিয়ে কাজ করা হয়েছে, সেই মিথ ভারতিয় দর্শকদের জানা আছে কিন্তু আমাদের দর্শকদের নাই। তো এখন যদি আমরা আমাদের চলচ্চিত্র ভাবনায় মান্ধাতা আমলের ভাবনাকেই আগলে রাখতে চাই-আমাদের চলচ্চিত্র মানেই একটা প্রেমের গল্প, এখানে চার-পাঁচটা গান থাকবে, একটা ভিলেন থাকবে, সেটা কখনওবা নায়কের বাবা হোক বা কখনও নায়িকার বাবা হোক-বা নায়িকার বন্ধু, যেভাবেই হোক না কেনো, তার একটা নাটকীয় উত্থান-পতন থাকবে। পাশে একজন পার্শ্ব নায়ক-নায়িকা থাকবে বা কিছু মারামারি বা কিছু এ-রকম দৃশ্য থাকবে। যদি অতি পুরাতন একটা ফর্মুলার মধ্যে আমাদের চলচ্চিত্র থেকে যায় এবং এটা যদি নির্মাতা এবং দর্শক দুজনের মানসিকতার মধ্যেই থেকে যায়, তাহলে আমার ধারণা যে, আমরা আমাদের চলচ্চিত্র একটি শৈল্পিক মান বা আলাদা একটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে  দাঁড়াতে পারবো না। আমাদের নির্মাতাদের, আমাদের ভাবনা জগতে একটা ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে, পাশাপাশি দর্শকের মধ্যে এবং আপনারা যারা পৃষ্ঠপোষক আছেন, তাদের মধ্যেও এই পরিবর্তনটা খুবই জরুরি বলে আমি মনে করি। দুটি পরিবর্তনই সমান্তরাল ভাবে জরুরি।

যে-কারণে তাইওয়ানের চলচ্চিত্রের বিরাট পরিবর্তন হয়, সেটা আজ থেকে বোধহয় ২০-২৫ বছর আগে, ওখানকার গভর্নমেন্ট ১০ জন তরুণকে বেছে নিয়েছিলো। বেছে নিয়ে তারা তাদেরকে বিভিন্নভাবে চলচ্চিত্রবিষয়ক প্রশিক্ষণ এবং সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতার মধ্য দিয়ে এবং দর্শকের কাছে যেনো চলচ্চিত্রগুলো ভালোভাবে প্রদর্শিত হয়, দর্শকের মধ্যে যেনো নতুন চলচ্চিত্র ধারণা দেওয়া যায় সেখান থেকেই একটি উদ্যোগের পদ্ধতি, একটি পঞ্চ বা বেশ কয়েক বছরের পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে তারা এগিয়ে যায়। তারই ফলে আমরা এখন ওখানে হোসিয়েন এবং আরও কয়েকজন চলচ্চিত্রনির্মাতাকে পাই। তাইওয়ানি চলচ্চিত্র বর্তমান বিশ্ব-চলচ্চিত্রে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পর্যায়ক্রমে কিন্তু এখন কোরিয়া, মালয়েশিয়া; মালয়েশিয়ার চলচ্চিত্র সংস্থা কিন্তু আমাদের চাইতেও নবীন। কারণ ওদের কিন্তু ৩৫ মিমি ল্যাবও আছে বলে আমার জানা নাই। যেহেতু ওরা সাম্প্রতিককালে ছবি শুরু করেছে, তো এই সময় শুরু করার কারণে ওরা সরাসরি ডিজিটাল মাধ্যমেই চলে গেছে। কারণ ওরা হয়তো এটা দেখেছে যে, ৩৫ মিমি আল্টিমেটলি হয়তো থাকবে না। তাই এইভাবে তাদের ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপড করানোর চিন্তাও করে নাই।

তো সার্বিকভাবে আমি যেটা মনে করি যে-আমাদের চলচ্চিত্রের নতুন ধ্যান-ধারণা এবং নতুন দর্শক, নতুন চলচ্চিত্র একটি গোষ্ঠী আমাদের দরকার। বিশেষ করে এখন খুবই আশার ব্যাপার যে, এর মধ্যেই নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে একটি শর্টফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হয়ে গেলো। গতবছরও হলো। এবার অবশ্য আমি আমার ব্যস্ততার জন্য জুরিতে থাকতে পারিনি। কিন্তু ওদের সেমিনারে ছিলাম, গতবারও ছিলাম। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি নিয়ে আমার খুব অন্যরকম ধারণা ছিলো। এখানে সব ধনাঢ্য ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বা তারা একটু অন্যভাবে নিজেদের ডেভেলপ করছে। কিন্তু তাদের মধ্যেও যে-একটা ভাবনা চিন্তা এগিয়ে যাচ্ছে এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে-আমি খুবই আশাবাদী যে, হয়তো নতুন চলচ্চিত্র আমরা পাবো।

আমাদের নতুন চলচ্চিত্রকে সন্ধান করার যে-আপ্রাণ চেষ্টা সেটা হয়তো খুব দ্রুতই সফল হবে না, কিন্তু একদিন হবে। তো আমাদের সবসময় আশার কথা বলতে হয়, এইটি খুবই স্বাভাবিক। যদিও সার্বিক পরিস্থিতি অতোটা আশার না, পথ এতোটা সহজও না। সামগ্রিক ভাবনাটাকে পরিবর্তন ঘটিয়ে সামগ্রিক এতোদিনের যে-চলচ্চিত্রভাবনা তার মধ্যে একটা আমূল পরিবর্তন ঘটানো, এটা মোটেও সহজ ব্যাপার না। যেমনটা সহজ হচ্ছে না আমাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও। আজকে ফেইসবুকে দেখা যায়, পলিটিক্যাল ভিউ অপশনে ম্যাক্সিমাম ছেলেমেয়েরই কথা হচ্ছে-আই হেইট পলিটিক্স বা এ-রকম একটা কিছু। যেটা খুবই দুঃখজনক। তা এ-রকম হবার কথা ছিলো না। একটা দেশের রাজনীতি, সামাজ, সংস্কৃতি খুবই পাশাপাশি চলে। একটার সঙ্গে আরেকটা খুবই ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

কেউ দর্শকের কাছ থেকে চলচ্চিত্রকে দূরে রাখতে চায় না; আমি অবশ্যই দর্শকের কাছে যেতে চাই। তবে আমার ভাবনাটা হচ্ছে, আমি দর্শকের কাছে, ঠিক দর্শকের কাছে না-আমার চলচ্চিত্রের কাছে দর্শককে আনতে চাই। আমি যদি আমার চলচ্চিত্রের কাছে দর্শককে আনতে পারি, আমি মনে করি সেটিই আমার সাফল্য।

কিন্তু আমি যদি আমার চলচ্চিত্রকে পুঁজি ফেরতের নামে, তথাকথিত এন্টারটেইনমেন্টের নামে যেনোতেনোভাবে শর্টকাটে, বাঁকা বা ভুল পথে দর্শকের কাছে যাই, তাহলে আমি মনে করি-এটা আমার এক ধরনের পরাজয়। আমার তো মাঝে মাঝে কিছু হিন্দি ছবির নাচ-গান দেখলে মনে হয়, এটা মোটেও একটি সুস্থ চলচ্চিত্রের উপকরণ না। অথচ এমন সব অঙ্গভঙ্গির মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রটাকে উপস্থাপন করা হয়, এই সমস্ত চিত্রনায়িকাকে আমার কখনও কখনও পতিতার মতোই একটি ভূমিকা পালন করছে বলে মনে হয়। পর্দায় তাদের মুখের আচরণ, অভিব্যক্তি, দর্শকের উদ্দেশে যেভাবে তাদের টিপ্পনি, তাতে এবং শুধুমাত্র মানুষের ভিতরে যে-নারীর শারীরিক ইয়ের ব্যাপারে যে-আগ্রহটা; সেটাকে পুঁজি করে। অর্থাৎ ভায়োলেন্সকে বা মানুষের ভিতরে যে-একটা পশুত্বকে লালন করে, সেটাকে পুঁজি করে আমি দর্শকের কাছে আমার চলচ্চিত্রটাকে নিয়ে যাবো, এই প্রবণতা সামাজিক এবং শৈল্পিক, দুই দিক থেকেই এটাকে ক্রাইম বলে আমি মনে করি।

তো যাই হোক, এইটুকুই হচ্ছে আমার ক্ষুদ্রতম পরিসরের চিন্তা। এখন আমি আশা করছি, আপনাদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে হয়তো আমরা আরেকটু সামনে যেতে পারবো আর কি। আমার ভাবনার সঙ্গে অনেকেই খুব দ্বিমত পোষণ করবেন। এবং সেটাই অবশ্য খুব স্বাভাবিক।

সঞ্চালক-২ : আমরা ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা-২ এর প্রশ্নোত্তর পর্বে চলে যাচ্ছি। আমি দায়িত্বরতদের প্রশ্নকর্তার কাছে গিয়ে প্রশ্নটি সংগ্রহ করার জন্য অনুরোধ করছি। তবে, এখানে একটি কথা বলে নিই-প্রশ্নকর্তা অবশ্যই তার পরিচয়টি দেবেন। 

(প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু। আবু সাইয়ীদ নিজেই দর্শকদের কাছ থেকে আসা বিভিন্ন প্রশ্ন-সম্বলিত চিরকুটগুলো পড়ে তার উত্তর দিতে শুরু করেন।)

সাইয়ীদ : একজন প্রশ্ন করেছেন, আপনার পথ চলতে কি কখনও হতাশায় ভুগতে হয়নি? আসলে আমি চাচ্ছিলাম যে, মানে-আজকের বিষয়টি নিয়ে যদি কারো কোনো ধরনের জিজ্ঞাসা থেকে থাকে; বিশেষ করে এই যে-আজকের যে-বিষয় চলচ্চিত্রের দর্শকপ্রিয়তায় নির্মাতার দায়। যেটা হয়তো মনে হতে পারে-একজন নির্মাতা হিসেবে আমার দায়টা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা এখানে আছে। কিন্তু আমি কিন্তু সেই জায়গা থেকে না, অন্যভাবে আলোচনাটা করতে চেয়েছিলাম। যাই হোক, তো এখানে উত্তরটা হচ্ছে যে, কখনও হতাশায় ভুগতে হয়নি...মানে (দর্শকদের উদ্দেশে) যিনি এটি লিখেছেন তাকে বলছি। নামটা বলবেন কি? কে লিখেছেন? মানে এই হতাশার দিকটি ঠিক কোন্ দিক থেকে? মানে কর্মের দিক থেকে নাকি সবদিক থেকে? (সবদিক থেকে, প্রশ্নকারীর উত্তর) দেখুন, সবদিক থেকে হয়তো এই হতাশাটা থাকবেই। না থাকবার কোনো কারণও নেই। সেটা হচ্ছে যে-দুই দিক থেকেই হয়। একটা হচ্ছে যে-আমার নির্মাণের দিক থেকে যদি বলি, যেমন-আমার চলচ্চিত্র অপেক্ষাকৃত কম দর্শকের কাছে গেছে। এটার অন্যতম একটা কারণ, আমি যখন কোনো ছবি তৈরি করি তখন আমি যে-স্বপ্ন নিয়ে, চিন্তা নিয়ে, ভাবনা নিয়ে ছবিটা তৈরির উদ্যোগটা নিই-এটা আমার একটা সাইকোলজিক্যাল প্রবলেমই হয়তো বলতে পারেন আপনারা। নির্মাণের পর আমি খুব একটা সন্তুষ্ট থাকতে পারি না। সন্তুষ্ট থাকতে পারি না বলে, তখন দেখানোর জন্য যে-উদ্দামটা সেটা অনেকটা কমে যায়। যে-কারণে আমি খুব স্ব-উদ্যোগে আমার ছবিগুলো কখনও দেখানো বা কাউকে দেখাতে বলা-এটা আমি পারি না। এটা আমার একটু সমস্যা হয়, আবার অনেকেরই এই সমস্যাটা হয়তো নাই। আমার সমস্যাটা না থাকলেই ভালো হতো।

আর যদি হতাশার কথা বলেন, ব্যক্তিপর্যায়ে সেটা আসলে সার্বিকভাবে একটা হতাশা আমার আছে, সেটা রাজনৈতিক, সামাজিক। কিন্তু আমি একজন চলচ্চিত্রনির্মাতার দায়টা শুধু চলচ্চিত্রনির্মাতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না। আমি মনে করি, আমি কেনো চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে আসলাম; তার প্রথম কারণটা হয়তো চলচ্চিত্রই। কারণ ওই সময়ে আমার মধ্যে সাহিত্য বা অন্য মাধ্যমের প্রতি একটা আগ্রহ ছিলো। কিন্তু আমার কাছে মনে হলো-চলচ্চিত্র খুবই একটা নাজুক অবস্থায় আছে। আমি বরং চলচ্চিত্রে যদি একটা ভালো কিছু করতে পারি, সেটা হয়তো চলচ্চিত্রের জন্য কিছু করা হবে। সেটাও কিন্তু ঠিক। কিন্তু তারপরেও একটা কমিটমেন্ট, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং শিল্পের প্রতি কমিটমেন্টের জায়গাটা কিন্তু আমার মধ্যে কাজ করে। সেটা যেমন আমি পালন করতে পারি না, আমার পারিপার্শিক অবস্থা সেটার অনেক বেশি প্রতিকূলে; সেই কারণে হয়তো একটা হতাশা সবসময় কাজ করে। কিন্তু হতাশা কাজ করার ফলেও আমি থেমে যাওয়ার মধ্যে নেই। খুব স্লো, কিন্তু আমি এগিয়ে যাওয়ার পক্ষে। আমাকে কিন্তু এখনও অনেক বেশি সংগ্রাম করে যেতে হচ্ছে এবং এটা আমি যেতেও চাই।

সাইয়ীদ (প্রশ্ন হাতে নিয়ে) : আচ্ছা একজন প্রশ্ন করেছেন মি. সোহরাব হোসেন, আহ্বায়ক, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট। একজন নির্মাতা যেমন দর্শককে বিকশিত করে তেমনি দর্শকও একজন নির্মাতাকে বিকশিত করে অর্থাৎ দর্শকের ফিডব্যাক থেকে নির্মাতা আরও সামনে এগিয়ে যায়। দর্শকের মানকে বিকশিত করার জন্য একজন নির্মাতার দায় কতোটুকু? এ-ক্ষেত্রে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবকাঠামোগত আয়োজনে কী কী থাকা দরকার?

মানে আমি আসলে এই কথাটিই বলতে চাচ্ছিলাম যে, দুইজন দুইজনের সঙ্গে খুবই জড়িত। একজন নির্মাতার যেমন একটা দায় আছে দর্শককে বিকশিত করার, তেমনি দর্শকেরও দায় আছে নির্মাতাকে বিকশিত করার। আর অবকাঠামোগত আয়োজন কী কী থাকা দরকার? সে-ক্ষেত্রে আসলে অনেক কিছুই দরকার হয়, যেমন রাষ্ট্রীয়ভাবে একটা পৃষ্ঠপোষকতার দরকার হয়, সেটা আমি এর আগে তাইওয়ানের কথা বললাম, যেমনটা ইরানে ঘটছে, যেমনটা মালয়েশিয়ায় ঘটছে। আমি ঠিক কোরিয়ার কথাটা বলতে পারবো না, ওদের ডেভলপমেন্টটা। ভারতেও চলচ্চিত্রের বিকাশের ক্ষেত্রে ওদের সরকারের একটা বড়ো ভূমিকা আছে। এছাড়া প্রদর্শনের ক্ষেত্রে যদি ভালো প্রদর্শনের ব্যবস্থা যেখানে আমরা ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ছি; সেখানে আমাদের খুবই নাজুক অবস্থা।

এছাড়া কারিগরি মান, এটা খুবই লজ্জার ব্যাপার যে-আমাদের সবগুলো চলচ্চিত্র, বিকল্প ধারা বলুন বা স্বনির্ভর ধারায় বলুন, সবই কিন্তু মাদ্রাজ বা অন্য কোথাও থেকে পরিস্ফুটিত হচ্ছে বা মুদ্রিত হচ্ছে। টেকনিক্যাল কাজটার আমরা ওখান থেকে সাপোর্ট নিচ্ছি। এটা আমাদের দেশে করতে পারলে আমরা খুবই খুশি হতাম। তো আমরা সেই রকম অবকাঠামো বা সেই রকম কারিগরি সুবিধাটা আমাদের দেশে বিকশিত করতে পারিনি; যা আমাদের একটা বড়ো দুর্বল দিক। তারপরও এখন যে-ডিজিটাল ফরম্যাটটা আসছে, তাতে হয়তো এই সঙ্কটটা একটু দূর হতে পারে অদূর ভবিষ্যতে। কারণ এটি খুব বড়ো আয়োজনের ব্যাপার না।

এরপরও আমার কাছে মনে হয় কী যে, টেকনিক্যাল ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ, আর্থিক ব্যাপারটাও গুরুত্বপূর্ণ, প্রদর্শনীর ব্যাপারটাও গুরুত্বপূর্ণ। তার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমাদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা, আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ভাবনা। এটি কিন্তু ব্যক্তি পর্যায় এবং সাংগঠনিক পর্যায়। দুটো দায়ই সমান। মানে সমাজ পরিবর্তিত হলে আমি পরিবর্তিত হবো এ-রকম ভাবারও কোনো কারণ নাই। আবার আমি একা পরিবর্তন হলেই সমাজ পরিবর্তন হবে তা না। দুটো পারস্পরিকভাবে, মানে পাশাপাশি সমান্তরালভাবে এগিয়ে যাবে, এটাই আমি মনে করি।

সাইয়ীদ : আতিক। শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা। প্রশ্ন করেছেন, চলচ্চিত্র-শিল্পমান বলতে আপনি কোন্ কোন্ বিষয়গুলো উল্লেখ করতে চান বিস্তারিত বলবেন?

এখন এই বিষয়টা, শিল্পমান বলতে কোন্ বিষয়গুলোকে উল্লেখ করতে চান-এটা একটু গুরুতর প্রশ্ন। এটা একটু গুরুতর প্রশ্ন এই কারণে যে, এটা অনেক ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির বিরোধ থাকতে পারে। তো আমার ভাবনাটা যদি আমি বলি, আমি মনে করি চলচ্চিত্র হচ্ছে একটি শিল্পমাধ্যম, এর প্রথম দায়টা থাকবে শিল্পের কাছে। চলচ্চিত্র শিল্প হতে হবে। এই শিল্প মানে আপনি যদি চলচ্চিত্রের ধারাবাহিকতাটা, ইতিহাসটা দেখেন সেই চলচ্চিত্র সৃষ্টির পর থেকে; তার মানে যে-আপনি তিনটা-চারটা জোন ভাগ করে নিতে পারেন। সোভিয়েত ইউনিয়নে একটি, ইতালি বা এর আশেপাশে, আমেরিকা এবং ভারতবর্ষ, বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন শিল্প ভাষার জন্ম নেয়। তো শিল্পের ক্ষেত্রে আমরা যদি চলচ্চিত্রকে একটি যৌগিক শিল্পমাধ্যম মনে করি, এখানে ফটোগ্রাফি আছে, শব্দ আছে, অভিনয় আছে, রূপসজ্জা ইত্যাদি। চলচ্চিত্রটি অবশ্যই আমি মনে করবো বিষয়বস্তুগত দিক থেকে এটি যতোটা সম্ভব, যে-দেশে তৈরি হচ্ছে, সেই দেশের মাটি এবং মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত হবে। আপনারা একটা জিনিস লক্ষ করবেন-বাণিজ্যিক, অধিকাংশ বাণিজ্যিক ছবির সঙ্গে মানুষ এবং মাটির সম্পর্ক চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকে না, একটা ফ্যান্টাসির মধ্য দিয়ে তৈরি হয়।    

আমার মতামত হচ্ছে, মানুষ এবং মাটির সঙ্গে একটা সম্পর্ক থাকা উচিত; সেইভাবেই সিনেমার গল্প কাঠামো এবং বিষয়বস্তু নির্ধারণ করা। আর ফটোগ্রাফি বা এর চলনের দিক থেকে, সাদৃশ্যের দিক থেকে, আমি মনে করি এর একটি রিদম তৈরি হবে। এটি আসলে অনেক বেশি অনুভূতি নির্ভর। আপনি গান শুনছেন, ধরুন ক্লাসিক্যাল মিউজিক; ক্লাসিক্যাল মিউজিকের মধ্যে যদি ধ্রুপদ, তারপরে হচ্ছে ঠুমরি, খেয়াল, টপ্পা এর মধ্যে একটা খুব চলনের পার্থক্য আছে। আবার এই ক্লাসিক্যাল মিউজিকের পরে যদি গজল বা এর মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। তারপর এই আধুনিক গান এখনকার হিন্দি গান, ব্যান্ড সঙ্গীত, হ্যাঁ এর মধ্যেই কিন্তু। তো সে-ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের চলনটা আমি মনে করি একটু, আমার অনুভূতিতে, আমার সঙ্গীত, আমার দেশিয় সংস্কৃতি বা ক্লাসিক্যাল মিউজিকের সঙ্গে তুলনা করলে সেটা পাশ্চাত্য এবং ভারতবর্ষীয় সেই চলনের সঙ্গে একটা মিল থাকুক সেটা আমি ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করি। তার বাইরেও হতে পারে।

অভিনয়ের ক্ষেত্রে আমি মনে করি চলচ্চিত্রে অভিনয়টি অনেক বেশি বাস্তবতার কাছাকাছি। অভিনয় তো অভিনয়ই। একদম তো মানুষের মতো করে কথা বলবে না। একটু তো পার্থক্য থাকবেই। কিন্তু অনেক বেশি ও যতোবেশি ওই চরিত্রের কাছাকাছি যেতে পারে। আমাদের দেশের চলচ্চিত্র অভিনয়টা দেখলে আপনি খুব সহজেই বুঝবেন যে-এটি কোনো চলচ্চিত্র অভিনয় না। এর বিপরীত এক চিন্তা করুন, তাহলে সেটা আমার মনে হয় স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আবহসঙ্গীতের ক্ষেত্রেও তার পরিমিতি ব্যবহার এবং তার মধ্যে কোনো আধিক্য না-থাকুক-আমি মনে করি একটি চলচ্চিত্রের শিল্পমান রক্ষা করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। শিল্প নির্দেশনার ক্ষেত্রে আমি ঘটনার স্থান, পারিপার্শ্বিকতা সেটা যতোদূর সম্ভব তার কাছাকাছি বা হুবহু হোক, সেটি আমি মনে করি। এই সার্বিকভাবে বিবেচনা করে, একটি চলচ্চিত্র কল্পনা করে, যে-শিল্পমান বোঝায় সেটি হচ্ছে আমার ভাবনার জায়গা। তবে আমি আবারও বলছি যে, আমার কাছে বিষয়বস্তু এবং চূড়ান্তপর্যায়ে চলচ্চিত্রটি দেখার পরে আমার কাছে কোন্ ম্যাসেজ বা কোন্ অ্যাসেন্সটা আমার কাছে ধরা পড়লো সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সাইয়ীদ : আচ্ছা, আরেকজন প্রশ্ন করেছেন, রুবেল পারভেজ। দর্শকপ্রিয়তা দিতে পারলেই কি নির্মাতার দায়মুক্তি ঘটে?

না, সেটা তো ঘটে না, আমি মনে করি। সেটাই তো আমি বলার চেষ্টা করলাম। দর্শকপ্রিয়তা দিতে পারলেই দায়মুক্তি ঘটার কোনো কারণ নাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের এখানে অধিকাংশ মানে আমি বলি ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলোর ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র যে-একটি শিল্পমাধ্যম, চলচ্চিত্রের যে-নিজস্ব একটি ভাষা আছে তার পরিপন্থি। সে-কারণেই আমার বক্তব্য হচ্ছে, চলচ্চিত্র নিয়ে দর্শকের কাছে যাওয়াটা যতোটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রটির চলচ্চিত্র হয়ে ওঠা, ভালো চলচ্চিত্র হওয়া। দর্শক পছন্দ করছে, দর্শক মাদকদ্রব্যও পছন্দ করে, কিছু জনসাধারণ দুর্নীতিও পছন্দ করে; জনসাধারণ অনেক কিছু পছন্দ করে, ইভটিজিং পছন্দ করে, একটু মাস্তান হওয়া পছন্দ করে বা নিজের আধিপত্য বিস্তার পছন্দ করে; তো সেই ধরনের কিছু চলচ্চিত্র তারা পছন্দ করবে। আমার মনে হয়, অনেক চলচ্চিত্র এই সমস্ত পরিবেশ বা এই সমস্ত বাজে অনুষঙ্গগুলোকে উৎসাহিত করে। আমাদের সামাজিক যে-অবক্ষয় দর্শক অনুযায়ী যেভাবে ঘটছে চলচ্চিত্রের অবক্ষয়টা ঠিক সেভাবে ঘটছে। হয়তো আমাদের সামাজিক অবক্ষয়টা আমাদের চলচ্চিত্রের অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করছে অথবা আমাদের চলচ্চিত্রের অবক্ষয়টা আমাদের সামাজিক অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করছে। যদিও চলচ্চিত্র অতো শক্তিশালী মাধ্যম না, যে-সমাজে প্যারালালি অবস্থান করবে বা অনেক বেশি প্রভাবিত করবে। কিন্তু অনেক অনুষঙ্গের মধ্যে চলচ্চিত্র একটি অনুষঙ্গ হতে পারে বা টেলিভিশন একটি অনুষঙ্গ হতে পারে; যেটা সমাজকে ক্রমাবনতির দিকে কিংবা ক্রমান্নোতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।

সাইয়ীদ : আচ্ছা ইনি লিখেছেন ফারুক ইমন। আপনি কি মনে করছেন, আপনার চিন্তায়, আপনি দর্শককে নিয়ে আসবেন? আপনার রূপান্তর চলচ্চিত্রটি আমি দেখেছি। আমার সঙ্গে এক প্রকার যোগাযোগ হয়েছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, সিনেমা বিষয়ে আগ্রহ আছে। তাই হয়তো হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে-দেশের ৬০ ভাগ মানুষ প্রায় নিরক্ষর, সেখানে চলচ্চিত্র থেকে কেনো আপনি তাদের বঞ্চিত করবেন। তাদের জন্য সিনেমাটা কীরূপ হবে, আপনার মানে চলচ্চিত্রকারের দায়টা কী?

একটি চলচ্চিত্র কিন্তু কখনই ১০০ ভাগ লোকের কাছে যেতে পারবে না। এটা সম্ভব না। হ্যাঁ, উৎকৃষ্টমানের চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যেও কিন্তু অনেক ডিবেট থাকবে। তা না হলে আপনি একবার ঋত্বিক কুমার ঘটক একবার বার্গম্যানকে জোচ্চর বলেছিলেন বা অমুক দার্শনিক অমুক দার্শনিককে নাকচ করে দিলো। তাই না? দুই জনেই কিন্তু অনেক মেধাবী। অ্যাঁ, অনেক শিল্পী অমুক শিল্পীকে নাকচ করে দিলো। সুতরাং খুব উৎকৃষ্টকর্মও কিন্তু সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। এখন আপামর জনসাধারণের ক্ষেত্রে যে-কথাটা বলা হচ্ছে, সে-ক্ষেত্রে আপামর জনসাধারণ যদি অনেক বেশি চলচ্চিত্রের কাছে যেতো বা অনেক বেশি রসটা আস্বাদন করতে পারতো, এটাতো খুবই ভালো খবর হতো। কিন্তু একটা বিষয় কী যে, তাদের পক্ষে তো পিকাসোর ছবিগুলো দেখা সম্ভব হচ্ছে না বা অনেকের বই পড়া সম্ভব হচ্ছে না, অনেক মিউজিকের কাছে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। চলচ্চিত্রকেই কেনো সবার কাছে যেতে হবে?

তবে যেহেতু চলচ্চিত্রের এটা বড়ো ক্ষমতা, এটি সবার কাছে যেতে পারে। তবে সে-ক্ষেত্রে আমি মনে করি, শৈল্পিক বিবেচনায় উচ্চমার্গীয় কর্মই শুধুমাত্র হতে থাকবে, সেটাই হতে পারলে খুবই ভালো হতো, দর্শকরা সেখানে চলে আসতো। কিন্তু পাশাপাশি এ-রকম কিছু হতেই পারে, যা নির্ভেজাল বিনোদনের কাজ। কিন্তু আমার আপত্তিটা হচ্ছে নির্ভেজাল বিনোদনের নামে আস্তে আস্তে যদি এটার অবনতি ঘটতে থাকে; অর্থাৎ আপনি দেখবেন এক সময় নায়ক-নায়িকা গান গাইতো, নাচতো; ঠিক ওটা নাচ ছিলো না, হাতটা উঁচু করতো এ-রকম ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপরে হয়তো দেখা গেলো যে, হঠাৎ করে ক্যাবারে একটি ড্যান্স শুরু হয়ে গেলো। এরপর নায়ক-নায়িকারাই নাচানাচি শুরু করলো। তারপর পোশাকটা ছোট হতে থাকলো। মানে অন্য সময় ঠিক আছে, কিন্তু এই যে, দর্শক-সাধারণ মানুষের কাছে যেতে হবে। সুতরাং আমাকে এইভাবে সাজাতে হবে। এই কারণে আমাকে গল্পটার মধ্যে একটা বীভৎসতা আনতে হবে, রক্তের বন্যা বয়ে দিতে হবে।

অ্যাঁ, মানুষের-মানে তার মধ্যে এই যে-খুনোখুনি, এটাকে সহনীয় করে তুলতে হবে। এইভাবে আমি সাধারণের কাছে যেতে চাই না। এটা আল্টিমেটলি আমাদের টোটাল সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য বিরাট ক্ষতিকর। আমি তো আবারও মনে করি, আমাদের মানবিক গুণাবলির ই টা কমে যাচ্ছে। তার পিছনে এই সমস্ত মিডিয়া একটা বড়ো রকম ভূমিকা বলবো না, সবাই যে-খুব উদ্দেশ্যমূলকভাবে করে তাও না। এরা অতোটা মেধাবীও না বা কোনো নীল নকশা, তাও না। অবচেতন মনেও অনেক সময় করে বা কিছু পুঁজি বা কিছু ইনকামের জন্যও করে। কিন্তু এর একটা প্রভাব আছে। সুতরাং দর্শকের কাছে থাকতে হবে। এটা সত্য কিন্তু কীভাবে থাকতে হবে, সেটা একটা চমৎকার একটা গ্রহণযোগ্য আঙ্গিক বা গ্রহণযোগ্য বিষয়বস্তু, কনটেন্ট। এটাকে আমি সেন্সর বলবো না, কিন্তু সেলফ সেন্সর বলবো, যিনি করবেন তার মধ্যেই থাকা উচিত বলে আমি মনে করি।

সাইয়ীদ : আরেকজন প্রশ্ন করেছেন, নাম যারিফ অয়ন। চলচ্চিত্র মাধ্যমটিতো ব্যয়বহুল। সে-ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ছবির ধারা ভেঙে নতুন ধারা নির্মাণের জন্য আর্থিক দিকটা কী হতে পারে?

দেখুন, ইরানের সব ছবি আমরা দেখিনি, হ্যাঁ। কিন্তু আমরা যতোগুলো ছবি দেখলাম তাতে কিন্তু এই সমস্ত বিষয়গুলো দরকার হয়নি। যা আমরা যদি এইরকম আবহ তৈরি করতে পারতাম, চলচ্চিত্রটা হচ্ছে এইরকম। আমি যখন বা আপনি যখন সূর্যদীঘল বাড়ী দেখছেন বা আপনি যখন পথের পাঁচালী দেখছেন বা আপনি যখন ইয়ের, তারকোভস্কির কোনো ছবি আপনিতো সেটাতে আনন্দই পাচ্ছেন। সেটাতো আপনার মধ্যে বিনোদনই দিচ্ছে। সেইখান থেকেতো আপনি রস আস্বাদন করতে পারছেন। তা আরেকজন হয়তো পাচ্ছে না, তো অতোটা না যেটা এর আগে বললাম।

হ্যাঁ, মোটামুটিভাবে যদি একটু যে-গ্রহণযোগ্যতার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রটাকে সবার মধ্যে গ্রহণযোগ্য করে বলা যায় এটিই আমাদের চলচ্চিত্র। তাহলে বাণিজ্যের কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্তু বাণিজ্যের নাম দিয়ে এই যে-দর্শককে খাওয়াতে হবে সেই কারণে যেভাবে যা করছে তা কিন্তু টিকলো না, শেষ পর্যন্ত কিন্তু বিপর্যয়ই হলো। কিন্তু এটা যদি বুদ্ধিদীপ্তভাবে, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এগিয়ে চলতো, তাহলে বাণিজ্যটাও রক্ষা হতো এবং চলচ্চিত্র শিল্পটাও রক্ষা হতো। পাশাপাশি আমাদেরকে এই যে-উদ্যোগটা ফিল্ম সোসাইটির উদ্যোগ, এই যে-আপনাদের উদ্যোগ ভিন্নভাবে, সেখান থেকে দর্শকদের মধ্যে চলচ্চিত্র বোধটাকে আরও বিকশিত করা যেতো।

সাইয়ীদ : এটা হচ্ছে সাইফ, নাট্যকলা বিভাগ। আচ্ছা, জগতের দশ দিকে মন ছুটতেই পারে। সবার মনকে বাঁধবার দায়িত্ব না নিয়ে মনকে অনুপ্রাণিত করার মতো সিনেমা নির্মাণ করতে চাই। নিজেকে কীভাবে তৈরি করা উচিত?

মানে মনকে? অ্যাঁ, আমি একটু, আরেকটু বিশ্লেষণ চাচ্ছি।

সাইফ (দাঁড়িয়ে) : বলতে চাচ্ছি যে, ভালো খারাপ সবকিছুই হবে। কিন্তু আমার ভালোটা এতো ভালো করবো যে, ওরা আমার থেকে  শিখবে, ওরা খারাপ করছে।

সাইয়ীদ : না, এখন আপনি শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেই যে-হবে তা না। আপনার মধ্যে যদি আপনার একটা ধারা থাকে, আপনার মধ্যে যদি নিজস্ব চলচ্চিত্র ভাবনা-সেটা আঙ্গিকগত, বিষয়বস্তুগত উভয়দিক থেকেই থাকে, সেটা হতেই পারে। কিন্তু সবাই আপনার দিকে ছুটবে, আপনি কি দর্শকের কথা বলছেন, না আরও অন্য নির্মাতাদের কথা বলছেন?

সাইফ : দর্শক বা আরও যারা আছে।

সাইয়ীদ : মানে আরও যারা ইয়ে আছেন। আসলে হয় কী, এটা আপনি যে-কথাটা বলছেন এটা অনেক বড়ো কথা তো। আমি আল্টিমেটলি, একজন দিকনির্দেশক বা আমি একজন আদর্শ হিসেবে নিজেকে ঠিক করবো। আমার মনে হয়, এখানে নিজের দায়টা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখানে আমি যে-কথাটা বলবো বা আপনার শিক্ষকরা যে-কথাটা বলবেন বা বই থেকে আপনি সেটা পড়বেন, সেটা থেকে কিন্তু আপনি একটা ধারণা নেবেন মাত্র। সেখান থেকে কিন্তু সিদ্ধান্তটা আপনাকেই নিতে হবে। আপনি যদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাটা অর্জন করেন, আমি যা বললাম আপনি শুনে রাখলেন, আপনার টিচার যা বললো আপনি শুনে রাখলেন, কিন্তু এখান থেকে বাছাই করার দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। এবং সেটার মধ্য দিয়েই আপনি নিজেকে তৈরি করতে পারেন। তাহলেই আমার মনে হয় সম্ভব।

আপনি একটা ধারা তৈরি করতে পারেন। কিন্তু আমার কথা এটা আপনার খুব একটা কাজে আসবে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে যেটা মনে করি, আমি অতোটা ই-না যে, আমার অনুসারী হবে অনেকেই। এই ক্ষমতাটা আমার নাই বা সেই চমকটাও আমার মধ্যে নাই। আপনি দেখবেন যারা খুব মহৎ, ধর্মীয় দিক থেকেই বলেন, কবিতার দিক থেকেই বলেন, তারা কিন্তু খুব বেশি প্রভাবিত ছিলেন তা না। তাদের নিজেকে নিজের সৃষ্টি করতে হয়েছে। আপনি নিজেকে নিয়েই ভাবেন কীভাবে এটা হতে পারে।

সাইয়ীদ : আচ্ছা, এখানে মোহাম্মদ আলী মানিক বলছেন, তাহলে একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা কোন্ ধরনের দর্শকের ওপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন?

এখানে আমার একটু বক্তব্যটা হচ্ছে কী, আমি মনে করি, একজন কবির যেমন উচিত না কোন্ শ্রেণির পাঠকের জন্য উনি কবিতা লিখবেন এটা ভাবা। হতে পারে, কখনও হতে পারে না-তা নয়। একটা রাজনৈতিক আন্দোলন হচ্ছে, উনি ওই আন্দোলনকে উদ্দীপ্ত করতে একটা কবিতা লিখতেই পারেন। কিন্তু কবিতা লেখা হচ্ছে তার অনুভূতি দিয়ে। চলচ্চিত্রের একজন স্বাধীন ভাবনার স্বাধীন শিল্পী নিজের মতো করে কাজ করবেন, দর্শকের কথা যখনই ভাবতে হবে তখনই আমার মনে হয় বা অন্যকিছু যখন ভাবতে হবে, তখনই কম্প্রোমাইজটা চলে আসে। আমি টাকার কথা ভাবতে গেলে তখন কম্প্রোমাইজটা চলে আসবে। আমার সামাজিকতার কথা ভাবলে যেমন কম্প্রোমাইজটা চলে আসবে। এটা নির্ভর করবে একান্তই ওই নির্মাতার ওপরে।

কেউ যদি মনে করেন, আমি একজন পপুলার নির্মাতা হবো। সেটা আসলে তার ক্যারিয়ারের বিষয়। আমি আমাকে কীভাবে দেখতে চাই। আমার সামাজিক অবস্থানটা বা চলচ্চিত্রে আমার অবস্থানটা কী! কিন্তু আমি একজন নির্মাতা, তখন আমার মনে হয়, উনি সমস্ত কিছুরই বাহিরে। কারণ, এখানে অনেকেই আছেন যারা লেখালেখি করেন। যখন একজন লেখেন তখন তো উনি বোধ হয় সমস্ত পৃথিবীকে নিয়েই লিখছেন না। তার মধ্যে তো অন্য একটা কোনো কিছু ক্রিয়া করে। এখন এটা মেটাফিজিক্যাল কোনো একটা বিষয় কি না জানি না। যদি সত্যিই ওই রকম কিছু বিষয় থেকে থাকে তাহলে একটা লেখকের সঙ্গেই আসলে এটার যোগাযোগটা বেশি। কারণ, ওই মুহূর্তের অনুভূতিটাতো পারিপার্শ্বিকতা না।

মোট কথা, আমি নিজেকে কোথায় দেখতে চাই, নিজের সাফল্য কীভাবে পেতে চাই। আমাকে অনেকে দেখলে আমার অটোগ্রাফ নেবে বা নিজের জনপ্রিয়তা বা আমি অমুক ফেস্টিভ্যালে যাবো, তখন বোঝাপড়ার বিষয়টা মনে হয় তৈরি হবে। আর কোন্ ধরনের দর্শকের জন্য কাজ করবেন এটা একান্তই আপনার। আপনি কোন্ ধরনের দর্শক নির্মাণ করতে চান।

সাইয়ীদ : (আরেকটি প্রশ্ন হাতে নিয়ে) দর্শক চলচ্চিত্র না দেখলে বা হল বিমুখ বলে হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, নির্মাতারা তখন বাধ্য হয়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সিনেমার ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার করছে। এতে করে কি চলচ্চিত্র তার শিল্পের জায়গায় থাকতে পারবে?

এটা অবশ্য ঠিক যে, চলচ্চিত্র বা অমুক হল বন্ধ হয়ে যাওয়া; তবে এই শিল্পের ক্ষেত্রে, এই শিল্পকে যদি আর্ট বলি তবে এর সঙ্গে কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে খুব একটা সম্পর্ক নাই। কারণটা হচ্ছে যে, আমরা যদি আগের ছবিগুলো দেখি-জহির রায়হানের কখনও আসেনি ছবিটা কিন্তু তেমন একটা চলেনি। তার সবচেয়ে ভালো ছবির মধ্যে একটা বলা চলে এটি। সূর্যদীঘল বাড়ী চলেনি, হলে যায়নি ওই অর্থে, নাটোরে রিলিজ পেতো। তারপরে পরবর্তী পর্যায়ে অনেক ছবির ক্ষেত্রে এ-রকম ঘটনা ঘটেছে। সুতরাং শিল্পের ক্ষেত্রে খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

শুধু মানে বাংলাদেশে না, ওই ওটা, কী বলে কর্ণটকের একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা আছেন আপনারা তার নাম জানতে পারেন গ্রিস কাসালা, কেরালার একজন খুব বড়ো ডিরেক্টর উনিও এর আগে কথা হলো উনার একটা ছবির মাত্র দুটো প্রিন্ট। একটা সাবটাইটেল করা দেশের বাইরের জন্য। আরেকটা প্রিন্ট করে রিলিজ করার চেষ্টা করছেন, তাও সুবিধা করতে পারছেন না। তো সুতরাং সেদিক থেকে মানে দুর্ভাগ্য যে-দর্শক হলের কাছে বা দর্শকের কাছে এক ধরনের শক্ড বা যাই বলেন না কেনো আর্ট ফিল্মগুলো যেতে পারছে না। আর কমার্শিয়াল শিল্পের ক্ষেত্রে বললে তখন অবশ্যই এটা অন্যভাবে চিন্তা করতে হবে। তো সেই ধারাটা থাকলে ভালো কি না-থাকলে ভালো-সেটা একটা বড়ো আলোচনার বিষয়। আর একটা হচ্ছে, যেভাবে আছে সেভাবে থাকার পক্ষে আমি না, তাতে যদি হল বন্ধ হয়ে যায় যাক। পৃথিবীতে অনেক মাধ্যম হয়তো আসতে পারতো, আসেনি। টমাস আলভা এডিসন বা লুমিয়ার ব্রাদার্স এরা যদি কোনোভাবে জন্ম না নিতো হয়তো ফিল্মই আসতো না। হয়তো এমনও হতে পারে যে, হিংটিংছট নামে একটা মাধ্যম আসার কথা ছিলো পৃথিবীতে; কিন্তু ঘটনাক্রমে আসেনি। সুতরাং এটা হতেই পারে। এখন আসেনি, আবার আসবে।

পারভেজ : (প্রশ্নকারী দাঁড়িয়ে) স্যার! প্রশ্ন আমি করেছিলাম। আমি আরেকটু বলতে চাই।

সাইয়ীদ : হ্যাঁ বলো।

পারভেজ : আপনি শিল্পের বিষয়টা তাগিদ দিচ্ছেন, সে-ক্ষেত্রে যদি ওই রকম হল বন্ধ হয়ে যায় সেটা যদি ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার করে, আপনাকে হয়তোবা তাদের সঙ্গে একটা নিগোসিয়েশনে যেতে হতে পারে। ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার নামে সেটাতো পণ্য হয়ে যাচ্ছে। আপনি এই বাণিজ্যিক ধারার সিনেমাকে পণ্য বলছেন, তাহলে সেটাও তো পণ্য হয়ে যাচ্ছে। ওই জায়গায় শিল্পের চেয়ে...

সাইয়ীদ : আমি বুঝতে পারছি, আমি একটু বলি, আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে। আমার প্রযোজিত তিনটে ছবির কথা বলি বাঁশি, রূপান্তর এবং অপেক্ষা; হলে চলেই না, দুই সপ্তাহ তিন সপ্তাহ চালানোই খুব দায়।  রাজশাহীতেও এসেছিলো অপেক্ষা। হলের থেকে তো টাকা পাওয়া দূরের কথা, পরে হল মালিককে আমার দেওয়া উচিত ছিলো। যাই হোক উনি নেননি। এই অবস্থা। কিন্তু কোনো ছবিই আমার ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার করিনি। আমি ওদের বিশ্বাস করি না। আমি আমার মতো করে দর্শককে হয়তো প্রজেক্টর এনে দেখাতেও পারবো না। কিন্তু তেমন একটা কম্প্রোমাইজ করি না। আরও পাঁচ বছর, দুবছর যাবে, আমাকে যেনো কম্প্রোমাইজ না করতে হয়। এখন এই বয়সে এসেতো বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে গেছি; টেলিভিশন প্রোডাকশন করতে হবে জীবিকার জন্য অথবা বিজ্ঞাপনে যেতে হবে অথবা অনেক কিছু শর্ত মেনে সিনেমা করতে হবে। সেটা যেনো না করতে হয়।

আমি সাম্প্রতিককালে মার্চ থেকে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন করতে ব্যবসায় নিজেকে নিয়োজিত রাখছি। সেটা ফুড প্রোডাকশন। যেটা বগুড়াতে ফ্যাক্টরি, আমি প্রেসারে আছি। ১৬ তারিখ থেকে প্রোডাকশনে যাবো। কারণ, আমার কাছে চলচ্চিত্র পবিত্র জায়গা। ফিল্ম হচ্ছে আমার স্বপ্নের, আমার পবিত্র জায়গা। আমি এইখানে ভালো ছবি হয়তো করতে পারছি না। সেই কোয়ালিটি হয়তো আমার নাই। তবে এটাকে আমি কোনোক্রমেই সচেতনভাবে কলুষিত করতে চাই না। তাতে আমি না খেয়ে থাকলেও। প্রয়োজনে আমি অন্যদিকে চলে যাবো। আমি যদি ওই তিনটা ছবির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার করতাম অ্যাট লিস্ট পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা বেশি পেতাম। কিন্তু আমি যেটা চাই না, আমি সেটাতে যাই না। এটা আসলে সবার নিজের জায়গা থেকে খুব দৃঢ় হতে হয়।

পারভেজ : অনেকে তো যাচ্ছে।

সাইয়ীদ : এখন অনেকে যাচ্ছে ঠিক আছে। এখন সেটাকে ভাবতে হবে অনেকে যাচ্ছেন বলেই তো এ-অবস্থা আমাদের। আমার অনেক কিছুই, মানে ঘটনা ঘটছে বলেই ধরেন আমার তো খুব যে-সাকসেস আছে, তা না। কিন্তু তারপরেও আমার কম নাই। ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার ক্ষেত্রে, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার ক্ষেত্রে। তারপরও আমি কন্টিনিউ করতে পারছি না। আবার আমার চাইতে অনেক কম সাফল্যেও অনেক কিছু করতে পারছে অনেকেই। তাদের ঢাকায় ফ্ল্যাট আছে, অনেক কিছু আছে। আমার কিন্তু কিচ্ছু নাই ঢাকায়। একটা গাড়ি থাকা ছাড়া। গাড়িটা রাখতেও হয় একটাই কারণে যে-ঢাকাতে খুব প্রবলেম হয়, এটা ছাড়া। আমি গ্রামে আমার কিছু সঞ্চয় দিয়ে একটা কালচারাল সেন্টার করবো। ঠিক আছে, এটা আসলে একটা মানুষের মাইন্ডসেট আমি কী করবো?

কোনো অধ্যাপক চাইলে লাখ লাখ টাকা ইনকাম করতে পারেন। কোনো অধ্যাপক এখনও রিকশায় চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এটা তার ওপর নির্ভর করবে। সেক্রিফাইস, এখন বলতে পারেন এতো লোক সেক্রিফাইস করলো, এখন তো সেক্রিফাইস করার প্রবণতা কম, বর্তমানে তো আরও কম। ভবিষ্যতে কী হবে? কিন্তু এর মধ্য দিয়েই যেতে হবে, যার যার জায়গা থেকে। আমি এখনও ব্যক্তি সেক্রিফাইসের পক্ষে। রাষ্ট্রীয়ভাবে বা সামাজিকভাবে পরিবর্তন হবে তারপরে আমি সেই পরিবর্তনে অংশ নেবো, সেটা আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক। যারা কমার্শিয়াল ছবি বানায় তাদের গুণগত পরিবর্তনটা করাতে হবে। তাদের ছবিগুলোর কী অবস্থা, সেই মান্ধাতা আমলের। তাদের অভিনয়গুলো এখনও দেখেন, তাদের টার্মগুলো দেখেন, চিত্রায়ণ দেখেন। সেটা তো আমার জায়গা না।

শরৎচন্দ্র, এখানে হুমায়ূন আহমেদও উপন্যাস লিখতেন একরকম; তারপরে হাসান আজিজুল হক, উনি ছোট গল্প লিখতেন। যার যার মতো করে লিখতেন। শরৎচন্দ্রের ক্ষেত্রে এক ধরনের ছিলো, রবীন্দ্রনাথের লেখার ধরন একরকম ছিলো। তাই আমারটা আমার। আমার ছবি সবাই দেখছে, সেটা আমার চেয়ে বেশি কেউ খুশি হবে না। আমি পরিচালক হিসেবে বেশি খুশি হবো, প্রযোজক হিসেবেও। কিন্তু আমার অসুবিধাটা হচ্ছে, যে-শর্তগুলো মানলে ছবি দর্শকরা দেখবে সেই শর্তটা মানা আমার পক্ষে সম্ভব না। ওই শর্ত আমি অনেক জায়গায় মানতে পারি না। মানলে হয়তো আমি আরও দু-চারটা ছবি করতে পারতাম। কিন্তু আমি সেটা চাই না।

সাইয়ীদ : প্রশ্নটি করেছেন ব্যবস্থাপনা বিভাগের হৃদয়। বেদের মেয়ে জোছনা এতো জনপ্রিয় হলো কেনো? কীভাবে এতো দর্শকপ্রিয়তা পেলো?

না, এটা আসলে পুরনো ব্যাপার, সে-জন্যেই তো অনেক দর্শকপ্রিয় হয়েছে। এ-কিন্তু হঠাৎ ঘটনাও বলা চলে। কারণ, এই ছবির প্রযোজক এবং পরিচালক পরে আরও অনেক অনেক ছবি তৈরি করেছে। কিন্তু এই দর্শকপ্রিয়তাটা পায়নি। কোথায় যে-একটা মিলে যাওয়ার ব্যাপারটা ঘটে গেছে। এই ছবির মধ্যে এমন কোনো জিনিসও ছিলো না বা এমন কোনো নতুন টেকনোলজি বা স্টোরি ঘটনা বা অন্য কোনো দিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বা খুবই পরিকল্পনা করে, তা কিন্তু হয়নি। প্রথমে এই ছবি দেখানোর জন্য খুব কম টাকার অফার করা হয়েছিলো। বগুড়াতে ৬০ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলো, পরে তারাই তিন লাখ না চার লাখ টাকায় নিয়েছে। এটা ঘটে গেছে। এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এটার সঙ্গে আর কোনো ঘটনার তুলনা চলবে কি না সন্দেহ। এখনও দুই একটা চলচ্চিত্র এমন হয়। এই তো আর কোনো।

কাজী মামুন হায়দার : স্যার (সেলিম রেজা নিউটনকে দেখিয়ে) কথা বলবেন একটু।

সেলিম রেজা নিউটন : প্রশ্ন না, আমি কিছু পর্যবেক্ষণের কথা বলবো। যে-গুলো আপনার কথার সূত্র ধরে এসেছে। আজ যে-কথা হলো আমাদের চলচ্চিত্র আলোচনায় তো বটেই, অন্যান্য এলাকাতেও ঘুরে ফিরেই আসে। আমি ঠিক প্রশ্ন না করলাম, ঠিক উত্তর চাচ্ছি, তাও না। আপনি যা বলবেন, সেটা আমাদের সবাইকে আলোকিত করবে। আমি একটু এলোমেলো করে মোবাইলে লিখেছিলাম। মোবাইল থেকে মুছে গেলো। আমি শুধু ছোট ছোট করে কমেন্ট করবো। একটু এলোমেলোভাবে। ঘুরে ফিরে শিল্প আর অ-শিল্প এ-রকম মুখোমুখি দুইটা বাইনারি ক্যাটাগরি আমাদের সামনে এসে হাজির হয়। একদিকে শিল্প আরেক দিকে অ-শিল্প। মানুষ কি শিল্পবোধহীন হয়? শিল্পবোধহীন মানুষ। এ-রকম যদি হয়-কিছু লোক শিল্পসম্পন্ন থাকে আর কিছু  লোক শিল্পবোধহীন হয়, তাহলে তো কিছু লোক উন্নত, কিছু লোক অনুন্নত। তাহলে তো ফ্যাসিবাদ জায়েজ হয়। অনুন্নত লোকদের এতো বেশি থাকার দরকার কী? মানুষের কোনো কাজে আসে না। শিল্প তাহলে কী? আসলে এই প্রশ্নটাও ঘুরেফিরে আসতে চায়। মানে আমরা সারাক্ষণই শিল্পের কথা বলছি, সাইয়ীদ ভাইয়ের কথা বলছি না শুধু।

আমার কাছে রবীন্দ্রনাথের পরে, মানে এ-ক্ষেত্রে কিন্তু উনি কাজ এবং আনন্দ এই বইটা দিয়ে সাহিত্যকে বোঝাচ্ছেন। তো উনি বলছিলেন যে, যেটা আনন্দ, ভালো, যেটা ভালো লাগে সেগুলোই হচ্ছে শিল্প-সাহিত্য। আর যেটা করতে হবে, কর্তব্য; যেটা না করলে অন্যদের সমস্যা হবে, সেটা হচ্ছে কাজ।

সেটা আনন্দ, গল্পও না, সাহিত্যও না। আমি নিজে যখন নিজের ওপরে কাজ চাপাই তা আনন্দই লাগে। না, কিন্তু ওইখানে যে-অর্থেই থাকুক, কাজের কথা বলছিলেন, আমি সেটাকে মেলাই ইন্ডাস্ট্রিয়াল। কাজ নামক ধারণাটাই একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ধারণা। এটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রুপের ধারণা। এই অর্থে কাজের ধারণা আগে ছিলো না। শিল্প তাহলে যেটা অকারণ। অকারণ কৌতূহলের কাজ জড়িত কোনো তাৎপর্য। কৌতূহল তাৎপর্য কোনো বিশেষ কারণসিদ্ধতা, প্রশ্নসন্ধিৎসা, অনুসন্ধিৎসা, কৌতূহল এগুলো হুদাই মানুষের মনের মধ্যে আসে। এগুলো দিয়েই আমার ধারণা শিল্পের যোগাযোগ। তার মানে যেটা সাইয়ীদ ভাইয়ের আলোচনার আগাগোড়ায় ছিলো। খুব ভালো লাগলো আমার তার আলোচনার মূল সুরটা; মূল সুরটা খুব পরিষ্কার, খুবই স্পষ্ট। আমার কাছে খুবই স্পষ্ট এবং সেটা আমার জন্য খুবই আনন্দদায়ক ছিলো। সেটা আমি এভাবে বুঝলাম যে, এ-ভাষায় সাইয়ীদ ভাই একা কথা বলেননি। কিন্তু আমি এভাবেই বুঝলাম জিনিসটা যে, শিল্পের জন্যই আসলে শিল্প। পুরনো একটি স্লোগান আছে। তা এটা আমাদের মাঝখানে ১৯২০, ৩০, ৪০, ৫০, ৬০, ৭০, ৮০র দশক ধরে ৮০ পর্যন্ত, অ্যাট লিস্ট শিল্পকে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। এটা সমাজের জন্য হতে হবে এটা এর পিছে কিছু কোচকাছা থাকতে হবে। তা-তাছাড়া বুর্জোয়া-টুর্জোয়া হেনতেন, কিন্তু অ্যাকচ্যুয়ালি শিল্প শিল্পের জন্যই। শিল্প শিল্পের জন্যই এই স্লোগানটা আবার আমাদের ভয় পাওয়ায়ে দেয় অনেককে। এটা এ-জন্য যে, এটাকে অনেকে লিবারাল একটা অ্যাপ্রোচ মনে করে।