মাজিদ মিঠু
প্রকাশিত ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
সাম্প্রতিক ঢাকাই চলচ্চিত্রের কোষ্ঠী উদ্ধার
খেই হারিয়ে খুঁজে চলি তোমার দেখা নাই
মাজিদ মিঠু
প্রেক্ষাগৃহ চিত্র—১
রাজশাহীর ‘উপহার সিনেমা’য়১ রাজত্ব মুক্তি পায় ৭ মার্চ। ১১ মার্চ ২০১৪ রাত ৯—১২টার শো দেখতে প্রেক্ষাগৃহে পৌঁছাই একটু আগেই। ছয়—নয়টার শো শেষে দর্শক বেরুচ্ছেন। এই শো-এ দর্শক বেশ ভালোই ছিলো; বেশ কয়েকজন বিভিন্ন বয়সের নারীকেও দেখা গেলো। তবে তরুণদের উপস্থিতি একটু বেশি।
থ্রি কোয়ার্টার, হাতে ব্যান্ড পরা সুইট; তিন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে বের হন প্রেক্ষাগৃহ থেকে। ছয়—নয়টার শো দেখেছেন রাজশাহী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের এই চার শিক্ষার্থী। কেমন লাগলো প্রশ্নের উত্তরে চট করে বললেন,‘ভালো লাগেনি।’ কিন্তু কেনো ভালো লাগেনি—তা জোরাজুরিতেও বললেন না। তাহলে আসলেন কেনো—এমন প্রশ্নের জবাবে বললেন,‘এই বন্ধুদের সঙ্গে মজা করলাম কিছুক্ষণ।’
টিকিট কালোবাজারিদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম,‘শাকিবের ছবিতে দর্শক ভালোই হয়।’ কিন্তু চলতি শো-এ তার প্রমাণ পাওয়া গেলো না। ড্রেস সার্কেলে (ডি সি) হাতেগোনা কয়েকজন আর নীচের শোভন ও সুলভ-এ পাওয়া গেলো গোটা তিরিশেক। পর্দায় শাকিবের প্রথম উপস্থিতিতে কয়েকজন উল্লাস করলেও পুরো চলচ্চিত্রে তাদের কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না; যেনো দায়ে পড়ে টিকিটের টাকা উসুল করছেন।
প্রেক্ষাগৃহ চিত্র—২
৪ এপ্রিল মুক্তি পায় জাকির হোসেন রাজুর দবির সাহেবের সংসার। শরীর দেখানো রগরগে নাচ, হলিউড স্টাইলে ফাইটিং, আর নায়কের অতিমানবীয় উপস্থাপন ছাড়া অনেকদিন পর বাংলাদেশে কমেডি ধাঁচের কোনো চলচ্চিত্র পাওয়া গেলো। ৭ এপ্রিল ছয়টার শো দেখতে একটু আগে আগেই পৌঁছাই প্রেক্ষাগৃহে। তিনটার শো (তিন—ছয়টা) শেষে দর্শক বেরোতে দেখে খানিকটা আশাহত হলাম। সবমিলিয়ে ৪০—৪৫ জনের মতো দর্শক ছিলো। কিছু দর্শকের মুখে হাসির ছটা, আর নিজেদের মধ্যে চলচ্চিত্রটি নিয়ে গল্প দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না, তাদের মনোরঞ্জনে চলচ্চিত্রটি কিছুটা হলেও সফল।
কোনো প্রকার ঠেলাঠেলি ছাড়াই টিকিট পেলাম। নিজের আসনে বসতেই শুরু হলো জাতীয় সঙ্গীত, দু-একজন ছাড়া কেউ দাঁড়ালো না। কেউ কেউ হাত নেড়ে সম্মান জানালো মাত্র। চলচ্চিত্র শুরু হলো, আগের শো-এর তুলনায় শোভন ও সুলভে দর্শক বৃদ্ধি হলেও আসন সংখ্যার চার ভাগের তিন ভাগই তখনো খালি।
চলচ্চিত্র চলতে চলতে প্রায় শূন্য ফার্স্ট ক্লাসের এক কোণে বসে চিৎকার করে গান শুরু করলো এক নারী। দর্শকদের কেউ কেউ গালি দিয়ে তাকে থামাতে ব্যস্ত, কিন্তু তার থামার কোনো নাম নেই। চলচ্চিত্র চলছিলো, মাঝে মাঝেই হাসির দমক ধাক্কা খাচ্ছিলো বদ্ধ প্রেক্ষাগৃহের দেয়ালে। শো শেষে বের হলাম, পরবর্তী শো শুরু হতে মিনিট দশেকের মতো বাকি, কিন্তু প্রেক্ষাগৃহের সামনে দু-একজন ছাড়া কাউকে পাওয়া গেলো না।
ফেরার পথে কথা হলো চলচ্চিত্রটি দেখে বেরোনো কয়েকজনের সঙ্গে। তিন জনের দুই জন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থী, একজন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশল বিষয়ে পড়েন। প্রশ্ন করলাম, নিয়মিত আসেন? একজন বললো, ‘এই রকম সিনেমা দেখতে আসি; তবে পরেরটা দেখতে আসবো না।’ বললাম, কেমন লাগলো? তিন জন প্রায় একসঙ্গেই বললেন, মোটামুটি ভালোই। পরিচালক হাসানোর চেষ্টা করেছেন। তবে নায়কদের অতিনাটকীয় অভিনয়ে মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়েছি।
প্রেক্ষাগৃহ চিত্র—৩
ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র আমি শুধু চেয়েছি তোমায়। অঙ্কুশ, শুভশ্রী, মিশা সওদাগর অভিনীত চলচ্চিত্রে ভারতীয় শিল্পীদের প্রাধান্যই বেশি। দেশের প্রেক্ষাগৃহে টালিগঞ্জের চলচ্চিত্র দেখা আর কি! ভিড়টা একটু বেশি। হলের সামনে যেতেই দেখি দর্শক সমাগম আগের কয়েক সপ্তাহের চেয়ে অনেক বেশি। টিকিট সংগ্রহ করতে হলো কালোবাজারিদের ধরে। আগের (ছয়—নয়টা) শো ভাঙতেই অনেক দিন পর সারিতে দাঁড়িয়ে প্রেক্ষাগৃহে ঢুকতে হলো। একটু কষ্ট হলেও ভালোই লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো হারানো সেই দিনে ফিরে গেছি।
দর্শকদের মধ্যে সব শ্রেণির উপস্থিতিই পাওয়া গেলো। বেশ কয়েকটি জুটি ভিড় এড়াতে প্রেক্ষাগৃহ ত্যাগ করলো একটু আগেই। রাত নয়টার শো-এ চোখে পড়ার মতো নারী দর্শকের উপস্থিতি কিছুটা অবাকই করলো। তরুণ দর্শক সংখ্যাও অনেক বেশি। নায়িকার এন্ট্রি দৃশ্যে উল্লাসে ফেটে পড়লো দর্শকরা। অনেক দিন পর মনে হচ্ছিলো প্রেক্ষাগৃহ তার পুরনো ঐতিহ্য ফিরে পেয়েছে।
১৬ মে ভারত-বাংলাদেশে একযোগে মুক্তি পায় চলচ্চিত্রটি। মুক্তির দ্বিতীয় সপ্তাহে রাজশাহীর ‘উপহার সিনেমা’য় এটি মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তির দ্বিতীয় সপ্তাহের তৃতীয় দিনেও রাত নয়টার শো-এ এমন দর্শক ঢালিউডের চলচ্চিত্রে দেখা যায়নি অনেক দিন। প্রেক্ষাগৃহ কর্তৃপক্ষের একজনের সঙ্গে কথা বলেও এর সমর্থন পাওয়া গেলো। তার মতে, ‘গত দুই দিন হল প্রায় হাউজফুল ছিলো, এমন চলচ্চিত্র মাসে দু-একটি হলে ব্যবসা ভালোই হতো।’
ভূমিকার পরে : পথের দেখা নাই
‘অশ্লীল যুগ’, ‘ক্রান্তিকাল’ শেষে দীর্ঘ স্থবিরতার পর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার অবস্থা এই। পথ খুঁজে পেয়েছে; ধীরে ধীরে চলচ্চিত্র ফিরে পাচ্ছে হারানো গৌরব; চলছে ‘সুস্থ’ চলচ্চিত্র-নির্মাণের প্রতিযোগিতা; চলচ্চিত্র দাঁড়াচ্ছে নতুন আঙ্গিকে—বর্তমানের এমন সব কথার বিপরীতে কিছু প্রশ্ন তো ওঠেই—এই ‘সুস্থ’ চলচ্চিত্র দেখতে কেমন, প্রতিযোগিতার ধরন আর নতুন আঙ্গিকটাইবা কী? আদতেও তা কি নতুন কিছু? এই ভূখণ্ডে চলচ্চিত্র যাত্রার ইতিহাস রূপভেদে একশো ১০ বা ৫৮ বছর। কিন্তু ‘সেই দীর্ঘ ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে যদি ভাবি, যে-স্বাপ্নিক অভিলাষ থেকে এদেশের চলচ্চিত্রের সূচনা সেই অভিলাষের কেন্দ্রাভিমুখে কতটা পৌঁছুতে পেরেছি তবে আমাদের হতাশা বহুগুণে বেড়ে যায়।’২
৫০ দশকের শেষভাগ এবং ৬০ দশকের পুরোটা ধরে যখন এদেশে চলেছিলো বাঙালি মধ্যবিত্তের বিকাশের সময়, প্রেক্ষাগৃহগুলোতে ছিলো তখন উপচে পড়া মধ্যবিত্ত দর্শক।
একদিকে বাংলা ছবিকে প্যাট্রোনাইজ করবার মতো জাতীয়তাবোধ অন্যদিকে সেসময়কার বাংলা ছবি ও ছবির প্রদর্শনী সংলগ্ন সমস্ত অবস্থা জুড়ে এমন একটি শ্লথগতি, স্যাঁতসেঁতে দোদুল্যমান এবং নিরাপদ পরিবেশ বজায় ছিল যা বাঙালি মধ্যবিত্তকে দারুণভাবে টানতে পেরেছিল।৩
কিন্তু এ অবস্থা খুব বেশিদিন বাংলা চলচ্চিত্রের ময়দানে বজায় ছিলো না। হঠাৎ করেই চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে বীভৎস, ন্যাক্কারজনক এবং মধ্যবিত্ত মানসের জন্যে পীড়াদায়ক ও ভীতিকর। নাগরিক মধ্যবিত্ত পিছিয়ে আসে ছবিঘরগুলো থেকে। চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে নিম্নবিত্ত, অশিক্ষিত মানুষের ‘বিনোদন’-এর উপকরণ।
চলচ্চিত্র পণ্য হিসেবে হোক আর সুকুমার শিল্প হিসেবেই হোক—শেষ বিচারে এর ভোক্তা হচ্ছে দেশের জনসাধারণ। কিন্তু সেই জনসাধারণের চরিত্র ও রুচি বিচার না করে ‘... আমাদের চলচ্চিত্র কারখানায় উৎকট বিনোদন সামগ্রী হিসেবে নির্মিত ছবিগুলো জনসাধারণের পাতে তুলে দেয়া হচ্ছে।’৪ এমতাবস্থায় বাংলাদেশের মূলধারার চলচ্চিত্র আজ কোথায় দাঁড়িয়ে—তা দেখাই এ লেখার উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা চলচ্চিত্রগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে। লেখার পরিসর ও সময় বিবেচনা করে ২০১৪ সালের প্রথম ছয় মাসের প্রত্যেক মাস থেকে একটি করে চলচ্চিত্র উদ্দেশ্যমূলকভাবে নির্বাচন করা হয়েছে। এ নির্বাচনের ক্ষেত্রে মারদাঙ্গা, প্রেম, হাস্যরস, সামাজিক ঘরানার চলচ্চিত্রগুলো প্রাধান্য পেয়েছে। এ লেখায় দাবাং (১৭ জানুয়ারি), অগ্নি (১৪ ফেব্রুয়ারি), রাজত্ব (৭ মার্চ), দবির সাহেবের সংসার (৪ এপ্রিল), আমি শুধু চেয়েছি তোমায় (১৬ মে) ও তারকাঁটার (১৪ জুন) পোস্টমর্টেম করে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের বর্তমান প্রবণতা দেখার চেষ্টা থাকবে।
চলচ্চিত্র—১ : দাবাং
শহরের ডন হিটলার খান। সে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ, গরিবের ওপর অত্যাচার—এমন কোনো কাজ নেই, যা সে করে না। হিটলার খানের ভাই ওসমান খানের হাত থেকে রেহাই পায় না পুলিশ কর্মকর্তা পর্যন্ত। এদের সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় আজাদ মানে আজাদ দ্য গ্রেট। হিটলারের হাতে যারা নির্যাতিত তাদের বাঁচিয়ে গড়ে তোলে একটি বস্তি, যেখানে সবাই আজাদের ছায়ায় নিরাপদ। আজাদের প্রাণের বন্ধু রাজ, হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আজাদের সবচেয়ে বড়ো শক্তি। একসময় আজাদের প্রেমিকাকে বাঁচাতে গিয়ে হিটলারের লোকের হাতে নিহত হয় সে। এরপর আজাদ দ্য গ্রেট হিটলারের সাম্রাজ্য ধ্বংস করে আবার শান্তি ফিরিয়ে আনে। প্রেম, মারপিট আর নায়কের অতিমানবীয় শক্তি প্রদর্শনের গল্প দাবাং।
চলচ্চিত্র—২ : অগ্নি
চোখের সামনে বাবা-মাকে খুন হতে দেখে ছোট্ট তানিশা। কৌশলে পালিয়ে সে পৌঁছায় মামার কাছে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের প্রভাবশালী সন্ত্রাসী মামার কাছে বেড়ে উঠতে থাকে তানিশা। মামার সহায়তায় নিজেকে গড়ে তোলে একজন প্রশিক্ষিত খুনি হিসেবে। এবার প্রতিশোধের পালা; একে একে খুন করতে থাকে তার পরিবারের হত্যাকারীদের। এর মধ্যে সে জানতে পারে বাবা-মার খুনের মূল হোতা দেশ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে থাইল্যান্ডে। তানিশাও তাকে শেষ করতে পাড়ি জমায় বিদেশ। কৌশলে আশ্রয় নেয় মূল শত্রুর দেহরক্ষী ড্রাগনের বাড়িতে। ড্রাগনের চোখে ধুলো দিয়ে একে একে শেষ করতে থাকে টার্গেট করা সন্ত্রাসীদের। কিন্তু ঘটনাচক্রে ড্রাগন তানিশার প্রেমে পড়ে। একদিকে ড্রাগনের প্রেম, অন্যদিকে প্রতিশোধ-এ দ্বিধায় তানিশা প্রতিশোধকেই প্রাধান্য দেয়। শেষে ড্রাগন তানিশা মিলে শেষ করে শত্রুদের।
চলচ্চিত্র—৩ : রাজত্ব
শহরের শীর্ষ সন্ত্রাসী সম্রাট। শহরের অন্য চাঁদাবাজদের যেকোনো আয়ের ‘টেন পার্সেন্ট’ পাঠাতে হয় সম্রাটের কাছে। তবে সম্রাটের রাজত্ব বিস্তারের যুদ্ধে প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় আরেক সন্ত্রাসী কিবরিয়া জুহালা। এক রাতে মোটরবাইক নষ্ট হলে রাস্তার পাশের এক বাসায় রাখতে যায় সম্রাট। সেখানে দেখা হয় সেই পরিবারের বড়ো মেয়ে রিয়ানার সঙ্গে, প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে সম্রাট। রাতে বৃষ্টি আসলে মোটরবাইক ঢাকতে বাইরে আসে রিয়ানার বোন তুলনা, তখন শহরের আরেক সন্ত্রাসী জুলহাসের ছোটো ছেলে তাকে ধর্ষণ করে মোটরবাইকটি নিয়ে যায়। পরের দিন সম্রাট মোটরবাইক আনতে গেলে তাকে ওই বাড়ির সবাই না চেনার ভান করে। মূলত তারা ধর্ষণের বিষয়টি গোপন করতে চায়। অবশেষে জানা যায়, সম্রাট পুলিশ কর্মকর্তা, সে বিষয়টি জেনে ফেলে ধর্ষণকারীকে শাস্তি দেয়।
চলচ্চিত্র—৪ : দবির সাহেবের সংসার
অবসরপ্রাপ্ত জজ দবির সাহেব। তার বাড়িতে কোনো কাজের লোক টিকতে পারে না, অতিরিক্ত রাগের কারণে। একসময় কাজ খুঁজতে দবির সাহেবের বাড়িতে আসে আক্কাস ও কুদ্দুস। তাদের দক্ষতা যাচাইয়ে পরীক্ষামূলকভাবে দুজনকেই রেখে দেন দবির সাহেব। দুজনের কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। তাই সবসময় চলতে থাকে খুনসুটি। একসময় দেখা হয় পাশের বাড়ির কাজের মেয়ে চুমকির সঙ্গে। যাকে আপন করে পাওয়ার যুদ্ধে লিপ্ত হয় আক্কাস ও কুদ্দুস। কিন্তু চুমকি আসলে কাজের মেয়ে নয়। শেষে দেখা যায়, দবির সাহেবের হারিয়ে যাওয়া ছোটো মেয়েই চুমকি।
চলচ্চিত্র—৫ : আমি শুধু চেয়েছি তোমায়
অভি ছোটোবেলা থেকেই একটু জেদি স্বভাবের। কাছের মানুষ বলতে তার কেউ ছিলো না। স্কুলে পড়তে গিয়ে লটারির মাধ্যমে বন্ধু নির্বাচন করে সে। কিন্তু যাকে বন্ধু নির্বাচন করে, সেই ভূমি তাকে পছন্দ করে না। একসময় ভূমির পরিবার কলকাতায় চলে যায়। এরপর বড়ো হয়ে অভি কলকাতায় ভূমির কলেজেই পড়তে যায় এবং তাকে ভালোবাসার কথা জানায়, সঙ্গে এও জানায়—সে-ই তার ছোটোবেলার বন্ধু অভি। কিন্তু ভূমি তাকে পছন্দ করে না। অভির ওপর রাগ করে জয়কে ভালোবাসার কথা বলে ভূমি। এদিকে অভি কথা দেয়-ভূমি যদি সত্যিই জয়কে ভালোবাসে, তবে যেকোনো মূল্যে সে তাদের মিলন ঘটাবে। হঠাৎ করেই ভূমির বাবা তাকে বাড়িতে নিয়ে আসে বিয়ে দেওয়ার জন্য। জয়কে দেওয়া কথা রাখতে ভূমির বিয়ে ভাঙতে বাংলাদেশে আসে অভি। এমন ত্রিভুজ প্রেমের গল্প নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ চলচ্চিত্র আমি শুধু চেয়েছি তোমায়।
চলচ্চিত্র—৬ : তারকাঁটা
বাবা-মা হারা ইব্রাহীম অতি আদরে বেড়ে ওঠে বড়ো বোনের কাছে। প্রেমিকার বাবার সাজানো খুনের মামলায় জেল হয় তার। মিথ্যা মামলায় জেল হলে মুখ ফিরিয়ে নেয় বড়ো বোন। এ সময় তার পাশে দাঁড়ায় অন্ধকার জগতের এক ডন। যে তাকে জেল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। ধীরে ধীরে ইব্রাহীম হয়ে ওঠে ঢাকার সবচেয়ে বড়ো সন্ত্রাসী। কিন্তু সে তার বোনকে ভুলতে পারে না; বার বার তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেও ব্যর্থ হয়। তাই ভালো পথে আর ফেরা হয় না ইব্রাহীমের। ঘটনাক্রমে ইব্রাহীম নিজের জীবনের বিনিময়ে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বোনকে রক্ষা করে। সন্ত্রাসী জীবনের গোলকধাঁধা নির্ভর এ কাহিনি ঘিরেই তারকাঁটা।
নির্দিষ্ট বৃত্তে বন্দি কাহিনি
চলচ্চিত্রে বিষয় হিসেবে বেছে নেওয়া হয় জীবনেরই খণ্ডচিত্র। সেই জীবনে যেমন ব্যক্তিমানুষের যাপিত কর্মধারা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, রাগ-অনুরাগ, বিরহ-মিলন থাকে; তেমনই থাকে সামাজিক জীবনের একক হিসেবে পারিবারিক সমস্যা-সঙ্কটের কথা। কেবল ব্যক্তিক ও পারিবারিক জীবন নয়, সামাজিক, রাষ্ট্রিক, ঐতিহাসিক, পৌরাণিক জীবনও হয় চলচ্চিত্রের বিষয়। এমনকি কল্পকাহিনি, লোককাহিনি, ভৌতিক কাহিনি নিয়েও নির্মাণ হতে পারে সার্থক চলচ্চিত্র। বিষয়-বিবেচনা থেকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে ‘সামাজিক, লোককাহিনি ভিত্তিক, রূপকথা ভিত্তিক, বিনোদনধর্মী জমকালো পোষাকি ও ফ্যান্টাসি নির্ভর, নাটকীয়তায় ভরা মডার্ন অ্যাকশন নির্ভর, মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর সমাজ বিষয়ক, মিশ্র চলচ্চিত্র,’৫ কমেডি, শিশুতোষ—এতসব শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা হলেও প্রকৃত অর্থে প্রথম দুটি ছাড়া আর কোনো ধরনই স্বমহিমায় দাঁড়াতে পারেনি।
১৯৫৬ সালে আব্দুল জব্বার খানের মুখ ও মুখোশ দিয়ে পূর্ববঙ্গের পূর্ণদৈর্ঘ্য সামাজিক আখ্যাননির্ভর চলচ্চিত্রের শুরু। তার পরের দশকের মাঝ পর্যায়ে রূপবান (১৯৬৫) দিয়ে যাত্রা শুরু হয় মানুষের কল্পনা-বিশ্বাস ও লোককাহিনি ভিত্তিক চলচ্চিত্রের। যা তখনকার দর্শক শ্রেণিকে প্রেক্ষাগৃহমুখী করতে পেরেছিলো আশাতীতভাবে। তারপর ৮০’র দশকে এসে চলচ্চিত্র কাহিনিতে যোগ হয় অ্যাকশন, চটুল প্রেম, জমকালো পোশাক, ‘‘অশ্লীল’ অঙ্গভঙ্গির চর্চা। বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে এসে লোককাহিনি ভিত্তিক চলচ্চিত্র-নির্মাণ প্রায় বন্ধ হয়ে গেলে চলচ্চিত্রের কাহিনি উদ্ভট এক রূপ নেয়—‘ছয়টা গান + দশটা মারপিট + একটা প্রেম = বাংলা ছবি।’৬ আখ্যানহীন এ চলচ্চিত্রগুলোতে দর্শক টানার জন্য চটুল গান আর অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির নৃত্যের সঙ্গে যোগ হয় পর্নোগ্রাফি। যা চলচ্চিত্রের ধারাবাহিকতার বাইরে একটু শরীর গরম করা গান বা ধর্ষণ দৃশ্যের আদলে পর্দায় হাজির হতো হুটহাট। এই ‘কাটপিস’ নির্ভর চলচ্চিত্রের সমাপ্তি ঘটে ২০০৭-এ সরকারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে। কিন্তু ততোদিনে চলচ্চিত্র হয়ে পড়েছে গল্পহীন; চলছে নির্দিষ্ট ধাঁচের গল্পের পুনরুৎপাদন।
লোককাহিনি আর হাতেগোনা কয়েকটি চলচ্চিত্র বাদ দিলে অতিমানবীয় বৈশিষ্ট্যের নায়ক, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিপদগ্রস্ত অতি সুন্দরী নায়িকা আর তথাকথিত খলনায়ক নির্ভর হয়ে পড়েছে কাহিনি। কয়েকটি বৈশিষ্ট্যে সীমাবদ্ধ বাংলাদেশের এ চলচ্চিত্র কাহিনি :
ক. প্রেম : ধনী-গরিবের প্রেম, ত্রিভুজ প্রেম, অসহায়-বিপদগ্রস্ত নায়িকার ত্রাতা নায়ক, ভালোবাসার অদৃশ্য শক্তিতে অর্ধমৃত নায়কের শক্তিমান রূপে আবির্ভাব।
খ. সামাজিক সমস্যা সমাধানে অতিমানবীয় নায়ক : মৃতপ্রায় কারো কাছে নায়কের শপথ, দুর্নীতিবাজ পুলিশ-চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে গরিবের বন্ধু মাস্তান নায়কের পরিত্রাতা হিসেবে আগমন।
গ. পিতৃহত্যার প্রতিশোধ : ছোটোবেলায় চোখের সামনে বাবা-মা খুন, হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে লকেট চিনে বা গান শুনে ফেরত পাওয়া, খলনায়ককে ধবল ধোলাই।
ঘ. আধিপত্য বিস্তার : অপরাধ জগতে প্রভাব বিস্তার, খলনায়কের হাতে প্রেমিকা-বাবা-মা জিম্মি, খুনের পর খুন করে এক—দু’বছর জেল খেটে কারাগার থেকে ‘নিষ্পাপ’ নায়কের মুক্তি—দু’ফোঁটা চোখের জল আর ফুলের মালা দিয়ে বরণ।
ঘুরেফিরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কাহিনি ছিলো এ বৃত্তেই বন্দি। ‘অশ্লীল সময়’ থেকে অর্ধযুগ পরে এসে চলচ্চিত্র সেই ‘ক্রান্তিকাল’ অতিক্রমের কথা বলছে; আদতেও কি তা হচ্ছে? এখনো কি চলচ্চিত্র কাহিনির সেই বৃত্ত থেকে মুক্ত?
আজাদ খানের দাবাং; কাহিনি গড়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠিত খলনায়কের বিরুদ্ধে নায়কের বিরুদ্ধাচরণকে কেন্দ্র করে। চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী খলনায়কের বিরুদ্ধে গরিবের বন্ধু নায়ক পরিত্রাতা। আপনজনের খুন, অবশেষে নায়কের হাতে খলনায়কের মৃত্যু, আর বিপদগ্রস্ত নায়িকাকে উদ্ধার।
পিতৃহত্যার প্রতিশোধ আর একটু প্রেম; বহুল আলোচিত ইফতেখার চৌধুরীর অগ্নি। নতুন বলতে নায়ক কেন্দ্রিক না হয়ে চলচ্চিত্রটি নায়িকা কেন্দ্রিক। শাকিব খান অভিনীত রাজত্বর কাহিনিতেও নেই কোনো নতুনত্ব বা ভিন্নতার ছোঁয়া। অপরাধ জগতে প্রভাব বিস্তার আর অসহায়-বিপদগ্রস্ত নায়িকার ত্রাতা নায়ক-কাহিনির সারসত্তা এটাই। এছাড়া ‘‘গরিব বা বড়োলোকের ছেলে শাকিব, ভালোবাসে একটি মেয়েকে, বাধা হয়ে দাঁড়ায় মেয়েটির অভিভাবক’—এমন গল্পের চলচ্চিত্র শুধু শাকিবেরই রয়েছে অর্ধশতাধিক।৭ দর্শক গাঁটের পয়সা খরচ করে আর কতো দেখবে একই মুখ, একই গল্প!
দবির সাহেবের সংসার বাংলাদেশে সংখ্যায় খুব কম অথচ চাহিদা সম্পন্ন চলচ্চিত্রের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু তথাকথিত খলনায়ককে ছাড়া এটিও অচল, তাই কমেডি হলেও এর কাহিনি মুক্তি পায়নি সিরিয়াস খলনায়ক চরিত্র থেকে। আর শেষে সেই হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে লকেট চিনে ফিরে পাওয়া! নায়কের সর্বশক্তি দিয়ে নায়িকাকে রক্ষা করা।
ভারত-বাংলাদেশ যৌথ চলচ্চিত্র আমি শুধু চেয়েছি তোমায়-এর কাহিনি গড়ে উঠেছে প্রেমকে কেন্দ্র করে। ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনিতে টুইস্ট আনতে দেওয়া হয়েছে বন্ধুত্বের আবরণ। বিপরীতে প্রথাগত খলনায়ক, নায়কের তথাকথিত ত্যাগ ও শেষে ভালোবাসার জাদুতে নায়ক-নায়িকার মিলন। এ কাহিনিতে নতুন কিছু কি খুঁজে পেলেন পাঠক?
নায়কের অতিমানবীয় বৈশিষ্ট্য আর হলিউডি কায়দার মারপিট এড়িয়ে একজন সাধারণ যুবকের অপরাধ জগতে জড়িয়ে যাওয়ার গল্প তারকাঁটা। কিন্তু বাংলাদেশি বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্র বিগত ৫৮ বছরে যে বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে তা থেকে বের হতে পারেননি গল্পকার। ধনী বাবার একমাত্র মেয়ের প্রেমিককে কৌশলে জেলে পাঠানো, সেখানে ‘সৎ গডফাদার’-এর সহায়তায় নায়ককে ফাঁসির হাত থেকে রক্ষা, নায়কের পরিবারের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি, অবশেষে পরিবারের সদস্যকে বাঁচাতে নায়কের আত্মত্যাগ। এ গল্পে নতুন কিছু খুঁজে পাওয়া তো ডুমুরের ফুল দেখার মতোই অসাধ্য।
রিমেকের যুগে ভিরমি : নকল নেবে নকল
বর্তমান সময়ে এক ইন্ডাস্ট্রি থেকে আরেক ইন্ডাস্ট্রি, এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় চলচ্চিত্র রিমেকের জোয়ার চলছে। হলিউড নকল করছে ফরাসি, নাইজেরিয় চলচ্চিত্র; বলিউডের সাম্প্রতিক ব্লকবাস্টার চলচ্চিত্রের বেশিরভাগই তামিল থেকে রিমেক। আবার তামিলরা করছে হলিউড থেকে। এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায়-সংস্কৃতিতে একই কাহিনির ভিন্ন চিত্রায়ণের এই ধারা স্বীকৃতি পেয়েছে অনেক আগেই। সেই ১৯৩৫ সালে রিমেক চলচ্চিত্র Mutiny on the Bounty জয় করে অস্কার। ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবসায়িক সাফল্যও নিয়ে এসেছে এই রিমেক-বলিউডে তেরে নাম (২০০৩), গজনি (২০০৮), ওয়ান্টেড (২০০৯), রেডি (২০১১), রাউডি রাঠোর (২০১২), বডিগার্ড (২০১১), কিক (২০১৪), ব্যাং ব্যাং (২০১৪); টালিগঞ্জে গল্প হলেও সত্যি (২০১৪), ওয়ান্টেড (২০১০); ঢালিউডের কেয়ামত থেকে কেয়ামত (১৯৯৩), অগ্নির (২০১৪) মতো জনপ্রিয় ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রগুলো তা প্রমাণ করে।
১৯৭০ সালে ঢাকায় নির্মিত চলচ্চিত্রের ৮০ ভাগই ছিলো হিন্দি, উর্দু ও ইংরেজি চলচ্চিত্রের নকল। ৮০’র দশকে তা মহামারিতে রূপ নেয়।৮ শুধু মুনাফার লোভে মৌলিকত্ব বিসর্জন দিয়ে ভিনদেশি চলচ্চিত্রের নির্লজ্জ নকলের সেই ঘেরাটোপ থেকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র মুক্তি পায়নি আজও। ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, চেতনার কথা পাশ কাটিয়ে ইন্ডাস্ট্রির ভবিষ্যতের কথা ভাবলেও তা শঙ্কার উদয় ছাড়া কিছুই করে না। বিদেশি চলচ্চিত্রের কপিরাইট ক্রয়, কাহিনি চুরি, দৃশ্যসজ্জার অনুকরণ, গানের সুর, কথা ও মিউজিক নকল, মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের পুরো দৃশ্য, অংশবিশেষ বা কাট টু কাট নকল করে সাম্প্রতিক ঢালিউড হামাগুড়ি দিয়ে চলছে তা বললে খুব একটা অবিচার করা হবে না। এমনকি কপিরাইট কিনে হুবহু রিমেক করে বলিউড বা টালিগঞ্জ যে ব্যবসায়িক সাফল্যের মুখ দেখছে-সে পথেও হাঁটছে না ঢালিউড।
আজাদ খানের দাবাং-এর নামটিই নেওয়া হয়েছে বলিউডের শতকোটি পেরোনো একটি চলচ্চিত্র অনুকরণে। যার সিক্যুয়াল দাবাং টু মুক্তির আগেই আয় করে ৮০ কোটি রুপি। নামের সার্থকতা (হিন্দি দাবাং-এ অপ্রতিরোধ্য পুলিশ কর্মকর্তা সালমান খানও একই ধরনের কাজে ব্যস্ত থাকে) রক্ষায় চলচ্চিত্র শুরুর ১০ মিনিটের মাথায় সৎ-সাহসী পুলিশ কর্মকর্তা খলনায়কের অবৈধ মদের দোকান বন্ধে তাদের ধবল ধোলাইয়ে ব্যস্ত, দেয়ালে হিন্দি দাবাং-এর পোস্টার, পাশে সালমান খানের অর্ধনগ্ন ছবি দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। নায়িকার বাবার চরিত্রটিও সরাসরি হিন্দি দাবাং-এর নায়িকার মাতাল বাবার অনুকরণে করা, যে মেয়ের সুখের জন্য আত্মহত্যা করে।
প্রথম ছয় মাসে অন্যতম ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র অগ্নি। এর কাহিনি হলিউডের কলম্বিয়ানার সঙ্গে বেশিরভাগ মিলে গেলেও অগ্নির ‘‘কাহিনি, সংলাপ ও চিত্রনাট্য’ টাইটেলে ভেসে ওঠে আব্দুল্লাহ্ জহির বাবু নামটি। কলম্বিয়ানার গল্পের সঙ্গে বক্সার দেহরক্ষী নায়ক ড্রাগন, নায়কের মামা-মামি, গান আর ছোটো ছোটো কিছু ঘটনা জুড়ে আব্দুল্লাহ্ জহির বাবু দাবি করলেন এটা মৌলিক গল্প। অগ্নির চার মিনিটের মাথায় অ্যাকশন দৃশ্য—নায়িকা চেয়ারে বাঁধা, তার কাছ থেকে কথা আদায়ের চেষ্টা করছে খলনায়ক, হঠাৎ সে মুক্ত হয়ে সবাইকে হত্যা করে। এ অ্যাকশন দৃশ্যটি হলিউডের বিগ বাজেটের চলচ্চিত্র অ্যাভেঞ্জারস থেকে নকল করা। এছাড়া নায়কের ইন্ট্রোডিউসিং দৃশ্যে একজন গুপ্তচরকে ধরার দৃশ্যটি তামিলের ‘‘স্টাইলিশ হিরো’ আল্লু অর্জুন অভিনীত রোমিও জুলিয়েট-এ নায়কের এন্ট্রি দৃশ্যের সঙ্গে মিলে যায়। অগ্নির ৩৭ থেকে ৪৩ মিনিট এবং এক ঘণ্টা ৪৯ মিনিট থেকে দুই ঘণ্টা ৪৫ সেকেন্ড পর্যন্ত ফ্ল্যাশব্যাক দৃশ্য দুটি হুবহু নকল করা হয়েছে কলম্বিয়ানা থেকে। এটাকে চুরি না বলে কোনো উপায় আছে!
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় নির্মাণ করা হয়েছে তামিলের আরিয়া : মি. পারফেক্ট-এর কাহিনির অনেকাংশই নকল করে। এটি সম্পূর্ণ রিমেক নয়, আবার মৌলিকও নয়। এছাড়া তারকাঁটার কাহিনিতে নতুনত্ব আনতে গিয়ে নির্মাতা মোহাম্মাদ মুস্তাফা কামাল রাজ জড়িয়েছেন চুরিতে। চলচ্চিত্রের এক ঘণ্টা ছয় মিনিট থেকে ১০ মিনিট ৩০ সেকেন্ড, এক ঘণ্টা ১১ মিনিট থেকে ১১ মিনিট ৩০ সেকেন্ড এবং শেষের দুই ঘণ্টা ২৬ মিনিট ৩০ সেকেন্ড থেকে ৩০ মিনিট ২৭ সেকেন্ড পর্যন্ত দৃশ্যগুলো বলিউডের আশিকি টুর বিভিন্ন দৃশ্যের সঙ্গে মিলে যায়। তাছাড়া নায়িকার গল্পটিও একই চলচ্চিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নেওয়া হয়েছে বলে মনে হয়।
এভাবে বেশিরভাগ চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে মৌলিক কোনো গল্প ছাড়াই। ছন্দহীন গল্পের মাঝে মাঝে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে হিন্দি বা জনপ্রিয় তামিল চলচ্চিত্রের অংশ। অবস্থা কিছু ক্ষেত্রে আরো দুশ্চিন্তার। কখনো কখনো সরাসরি কোনো ইংরেজি-হিন্দি-তামিল চলচ্চিত্রের দু-একটি দৃশ্য জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। যেমনটি দেখা গেছে, অনন্ত জলিলের মোস্ট ওয়েলকাম টুতে কুকুর দিয়ে ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্যে। এছাড়া ২০১৪ সালের ঈদুল আজহায় মুক্তি পাওয়া বদিউল আলম খোকনের হিরো দ্যা সুপার স্টার-এর কাহিনি তামিলের রেবেল ও নায়ক-এর কাহিনি থেকে তৈরি। যদিও কাহিনিকার হিসেবে আবারও নাম জাহির করেছেন আব্দুল্লাহ্ জহির বাবু। আর মোহাম্মদ হোসেনের আই ডোন্ট কেয়ার-এর কাহিনি ভিন্ন হলেও এর কিছু অ্যাকশন দৃশ্য নকল করা হয়েছে ওই রেবেল থেকেই। সবচেয়ে শঙ্কার কথা হলো, হিরো দ্যা সুপার স্টার ও আই ডোন্ট কেয়ার-এর শেষের মারপিটের দৃশ্যটি একই চলচ্চিত্র থেকে নকল করা! পরিচালকরা হয়তো মুক্তির আগে বুঝতেই পারেননি, তারা একই দৃশ্য নকল করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন!
সেই সুর আর এই সুরে নেই
সারা পৃথিবীর চলচ্চিত্র থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্রকে যে একটি বৈশিষ্ট্যে পৃথক করা যায় সেটা হলো গান। ভালোবাসা, রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ প্রকাশে স্বপ্নে, ধ্যানে-জ্ঞানে, গল্পের পট পরিবর্তনে, গল্প এগিয়ে নিতে নায়ক-নায়িকার ঠোঁটে গান এই উপমহাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো দেশের চলচ্চিত্রেই নেই। এর অন্যতম কারণ যতোদূর সম্ভব এই উপমহাদেশের আরেক জনপ্রিয় লোকমাধ্যম যাত্রাপালা। লোকসংস্কৃতির এই উপাদানে অভিনয়ের মাঝে মাঝে গান দিয়ে গল্প বলার যে ধারা তা এখানকার দর্শকের মজ্জায় মিশে আছে। প্রযুক্তির বিকাশে এক শিল্পমাধ্যম তার খুব কাছাকাছি ফর্মের শিল্পমাধ্যমে রূপান্তর হয়। যাত্রাপালার ক্ষেত্রেও হয়েছে তা-ই। কখনো কখনো এই যান্ত্রিক রূপান্তর যেমন আবশ্যক, তেমনই স্পষ্ট। শিল্পমাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের বৈশিষ্ট্যই হয়তো যাত্রার সঙ্গে মিলে গেছে-সরাসরি দেখা, শোনা আর একই সঙ্গে বিপুল সংখ্যক দর্শকের সমাগম ঘটে এ উভয় মাধ্যমেই। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যেমন বদলেছে, মাধ্যম হিসেবে এখানকার চলচ্চিত্রও ধারণ করেছে যাত্রাপালাকে। যাত্রার রস, শৈল্পিক ব্যঞ্জনা, গান এখানকার চলচ্চিত্রে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা। চলচ্চিত্রের এই বৈশিষ্ট্যের সূচনা হয়েছিলো ১৯৩১ সালে আরদেশির এ এম ইরানি’র (Ardeshir A M Irani) হাত ধরে, এ উপমহাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র আলম আরার মাধ্যমে।
এর পোস্টারে ইরানি লিখেছিলেন ‘অল আর টকিং, সিঙয়িং অ্যান্ড ড্যান্সিং’। আলম আরায় প্রায় এক ডজন গান ব্যবহার করেছিলেন তিনি।৯ আলম আরার সেই গান, যাত্রা দেখা দর্শককে চলচ্চিত্রে আকৃষ্ট করেছিলো আশাতীতভাবে। সেই ৩০-এর দশকেই ভাগ্যচক্র চলচ্চিত্রে প্রথম প্লেব্যাক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে শব্দ সংলাপের পাশাপাশি শুরু হয়েছিলো সঙ্গীতের পাকাপোক্ত ব্যবহার।১০ যাত্রাপালার ‘বিবেক’, নায়িকা-নায়কের চরিত্রে পাট করা সেই মানুষগুলো নিজ গলায় যে গান গেয়ে কাহিনি এগিয়ে নিতেন, তা চলচ্চিত্রে স্থানান্তর হয়েছে মাত্র। যাত্রাপালার বিবেককে এখানকার চলচ্চিত্রে পাওয়া যায় মন্দির, মাজার, দরগা শরিফের খাদেম, গেরুয়া বসনের বাউল, ফকির, দরবেশদের লিপে চিত্রায়িত গানে। তাই গান এখানকার চলচ্চিত্রে এমন গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পরিণত হয়েছে যে, তা চলচ্চিত্র হয়ে ওঠার জন্য যেমন জরুরি, তেমনই জরুরি ব্যবসার জন্যও।
দীর্ঘদিনের চর্চায় এই উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের যে ডিসকোর্স তাতে পাঁচ থেকে সাতটি গান না থাকলে তা যেনো চলচ্চিত্রই হয়ে ওঠে না। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রেও কাহিনির প্রয়োজনেই ব্যবহার হতো গান। রূপবান-এর ‘শোনো তাজেল গো’, ‘প্রাণ পতি গো’; পিচ ঢালা পথ-এর রাজ্জাকের লিপে পথে হাঁটতে হাঁটতে চিত্রায়িত সেই বিখ্যাত ‘পিচ ঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি’; নায়িকা ববিতার লিপে ‘এই উতলা রাতে কেনো যে শুধু জেগে থাকে মন’; আলোর মিছিল-এর সেই ‘এই পৃথিবীর পরে, কতো ফুল ফোটে আর ঝরে’; বেইমান-এর আব্দুল জব্বারের কণ্ঠে নায়ক রাজ্জাকের লিপে ‘আমি তো বন্ধু মাতাল নই’; আঁখি মিলন-এর ‘আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে’; ময়নামতিতে যখন নায়িকা পালকি করে অন্যের ঘরনি হতে চলেছে, গাছে হেলান দিয়ে অশ্রু ভেজা চোখে নায়কের লিপে ‘অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায়’—গানগুলো যেমন গল্পের প্রেক্ষাপটে সুষম মাত্রায় কাহিনি এগিয়ে নিয়েছে, তেমনই দর্শক হৃদয়েও তুলেছে আলোড়ন। কিন্তু সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রে গল্পের প্রয়োজনে গানের যে ব্যবহার তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থাকছে না। বেশিরভাগ চলচ্চিত্রেই এমনভাবে গান আরোপ করা হচ্ছে যা কাহিনির সঙ্গে কার্যকারণ-সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হচ্ছে।
দাবাং-এ ৪৮ মিনিটের মাথায় নায়ককে হত্যা করার সিদ্ধান্ত শেষে খলনায়কের ছোটো ভাই গাড়ি নিয়ে একটি বাড়িতে ঢোকে, পরের দৃশ্যেই ‘পরি বলে কতো জনে ডাকে আমাকে’ গান নিয়ে হাজির হয় এক নর্তকী। গান শেষেই নায়কের বস্তিতে হামলা চালায় গুণ্ডারা। কিন্তু মাঝখানের এই গানটি কাহিনির ঠিক কোন্ প্রয়োজনে বোঝা যায় না।
আবার আমি শুধু চেয়েছি তোমায়-এ ৫৭ মিনিটে নায়িকা নায়কের ভদ্রবেশধারী মুখোশ খুলে সবাইকে তার কুকীর্তি জানান, এমন ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যের মাঝখানে হঠাৎই নায়ক-নায়িকা উদয় হয় ‘পাগলামি তোর চোখে/হাতছানি কে রোখে/বেব্বি তুই যে হেব্বি ইনোসেন্ট/ডিসিশন ইজ ওকে/চাইছি শুধু তোকে/ ... চলো দুজন মিলে করি এগ্রিমেন্ট’ এ গানটি নিয়ে। গান শেষে নায়িকা যেখানে নায়ককে ঘৃণা করে অন্য একজনকে ভালোবাসার প্রস্তাব দেয়, তখন এই মিষ্টি প্রেমের গানের কারণ বোঝা যায় না। এমন উদাহরণ আরো রয়েছে যা শুধু প্রবন্ধের দৈর্ঘ্যই বাড়াবে।
তবে কাহিনির সঙ্গে সম্পৃক্ততাহীন এই গানগুলোর বাইরে বলিউড থেকে টালিগঞ্জ হয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে আর একধরনের গান যোগ হয়েছে—‘আইটেম সঙ’। চটকদার কথা, চটুল নাচ, উত্তাল সঙ্গীতের সমন্বয়ে এ আইটেম সঙ চলচ্চিত্রের জন্য না হলেও ব্যবসার জন্য অপরিহার্য অংশ। এ গানগুলো মূলত মুক্তির আগে চলচ্চিত্র সম্পর্কে দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণে এবং মুক্তির পর বাড়তি বিনোদন দেয়। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক প্রায় সব চলচ্চিত্রেই আইটেম সঙ উপস্থিত। যদিও গানের কথা, সুর, মিউজিক, চিত্রায়ণ, নৃত্য—এমনকি নৃত্যশিল্পীরাও বলিউডি চাকচিক্য মাখা মশলাদার গানের স্বাদ চাখা চোখ ও মনকে সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হয়।
নমুনা চলচ্চিত্র দাবাং-এর পাঁচটি গানের দুইটি, তারকাঁটার পাঁচটির একটি, দবির সাহেবের সংসার-এ তিনটি গানের একটি, অগ্নির চারটি গানের একটি আর রাজত্বর ছয়টি গানের মধ্যে একটি এবং আমি শুধু চেয়েছি তোমায়-এর সাতটি গানের একটি আইটেম সঙ। কাহিনির ধারাবাহিকতা এড়িয়ে খলনায়কের আড্ডা বা বারে চিত্রায়িত এসব গানে বলিউডের হিট আইটেম গানগুলোর অনুকরণ স্পষ্ট। দাবাং-এর ‘তুমি একটা দিলে টোক্কা’, অগ্নির ‘নেশায় নেশায় এ মন তোকে চায়’ এবং রাজত্বর ‘আজ এই রাতে দিশেহারা আমি’ ও ‘চাই না ভালোবাসা’ গানের চিত্রায়ণ করা হয়েছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অদক্ষ নৃত্যশিল্পী দিয়ে অপরিকল্পিত সেটে কোনো না কোনো হিন্দি গানের আদলে।
দাবাং শুধু নামই নকল করেনি। গান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে—সুর-সঙ্গীত-কথা ও চিত্রায়ণে হিন্দি বিভিন্ন চলচ্চিত্রের গানের ছাপ রয়েছে। ‘পরি বলে কতো জনে ডাকে আমাকে’ গানটিতে হিন্দি রাউডি রাঠোর-এর ‘চিকনি কোমর পে তেরা, মেরা দিল ফিসাল গায়া’ গানের মিউজিক নকল করা। ‘ও প্রিয় তুমি দাও না গো ভালোবাসা প্রেম ষোল আনা’ গানটি ডার্টি পিকচার-এর ‘উলালা উলালা’ গানের সুর ও সঙ্গীত নকল করে করা, আর ‘প্রেমেরই বর্ষায় ভিজে যাবো দুজনায়’ গানটি তামিল চলচ্চিত্রের একটি গানের চিত্রায়ণের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। এছাড়া ‘ও আমার বন্ধুরে, রয়েছো অন্তরে’ গানটি টালিগঞ্জের পাগলু টুর ‘থোড়া সা কারলে রোম্যান্স’ গানের সুর, মিউজিক নকল করে শুধু কথা বসানো হয়েছে।
অগ্নির ‘ছোঁয়ায় ছোঁয়ায় এ মন শুধু চায়’ গানটিতে নায়িকাসহ সহনৃত্যশিল্পীদের পোশাক বিশেষ করে নায়িকার সাদা শার্ট, কালো টাই, হ্যাট হিন্দি তিসমার খান-এর ‘শিলা কি জাওয়ানি’ গান থেকে নকল করা হয়েছে।
আমি শুধু চেয়েছি তোমায়-এর ‘পাক্কা ঘুঘু মাল এ বান্দা’ গানটি নকল করা হয়েছে আরিয়া থেকেই; আর ‘তুমি যদি আমাকে/কাছে এসে ভালোবাসো’ গানটির কিছু অংশের চিত্রায়ণ নকল করা হয়েছে বলিউডের জ্যাকপট-এর ‘কাভি জো বাদাল বারসে’ গান থেকে। সেখানে নায়িকা সানি লিওনের পোশাকের রঙ ছিলো সাদা তা বদলে কেবল লাল রঙের পোশাকে সাজানো হয়েছে শুভশ্রীকে। তারকাঁটার ‘কী যে শূন্য শূন্য লাগে তুমি হীনা’ গানটির চিত্রায়ণের সঙ্গে আশিকি টুর ‘তুহি এ মুঝকো বাতা দে/চাহু মে ইয়া না’ গানের কয়েকটি দৃশ্য মিলে যায়।
জ্যাকপট আমি শুধু চেয়েছি তোমায়
তবে গানের শুটিং লোকেশন ও নায়ক-নায়িকার কস্টিউম নির্বাচনের ক্ষেত্রে নতুন প্রবণতা হলো টালিগঞ্জকে নকল করা। টালিগঞ্জের বেশিরভাগ চলচ্চিত্রে যেমন নায়ক-নায়িকাকে দেশের বাইরের কোনো লোকেশনে নিয়ে নৃত্যে অদক্ষ কয়েকজন বিদেশি নারীর উপস্থিতিতে নাচানো হয়, আমাদের পরিচালকরাও এখন তা-ই করছেন। কাহিনি-গানের সঙ্গে কোনো মিল না রেখে শুধু বিদেশি লোকেশন, কয়েকটি দামি গাড়ি দেখিয়ে তারা দর্শকের মন জয় করতে চান! এতকিছুর পরও তারকাঁটার ‘রূপে আমার আগুন জলে’, দবির সাহেবের সংসার-এর ‘লজ্জাবতীরে ছুঁইলে যেমন লজ্জা পায়/আমারও তেমন হইয়া যায়’ গান দুটির চিত্রায়ণ ভালো লেগেছে।
নির্দেশকের শিল্প ভঙ্গ, সাজসজ্জা অপাঙ্ক্তেয়
একটি চলচ্চিত্রের জন্য শৈল্পিকতা, নিপুণতা, মেধা, মনন দিয়ে নান্দনিকভাবে গল্পের স্থান, কাল, পাত্র অনুযায়ী ইনডোর-আউটডোর উভয় স্থানেরই সেট, ডেকর, মডেল, পোশাক-পরিচ্ছদ, সাজসজ্জা, কেশবিন্যাস থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় বিষয় ও দ্রব্যাদির সঠিক সমন্বয় যিনি করেন তিনিই শিল্পনির্দেশক। চলচ্চিত্রের দৃশ্যগুণ, চরিত্রের সঙ্গে পরিবেশের সামঞ্জস্য নির্ভর করে এই নির্দেশকের ওপরই। সেলুলয়েডে পরিচালকের যে বিদ্যমান ও অলীক বাস্তবতা, যে স্বপ্নকে ছুঁতে চাওয়া তা নির্মাণের দায়িত্ব শিল্পনির্দেশকের। যদি চলচ্চিত্রের নির্মিত বাস্তবতার মাঝে দর্শক যাপিত ‘বাস্তবতার’ মিল খুঁজে না পান, তবে ব্যর্থ হয় চলচ্চিত্র; যদিও এই ‘বাস্তবতা’ কী—তা নিয়ে দার্শনিক দ্বন্দ্ব রয়েছে।
‘বাস্তবতা’কে সেলুলয়েডে যথাযথ ফুটিয়ে তোলাই যদি শিল্পনির্দেশকের দায়িত্ব হয় তবে বলতে দ্বিধা নেই, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে শিল্পনির্দেশনা বিষয়টিই দাঁড়ায়নি। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ, দাবাং-এর টাইটেল কার্ডে শিল্পনির্দেশক ক্যাটাগরিটি পর্যন্ত নেই। তাছাড়া নমুনায়িত ছয়টি চলচ্চিত্রের তিনটির শিল্পনির্দেশকই একজন। নমুনা চলচ্চিত্রগুলো বিশ্লেষণ করে মোটামুটি সাতটি সূত্রে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রের শিল্পনির্দেশনাকে ব্যাখ্যা করা যায়।
সূত্র ১ : চরিত্রের অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে সামাজিক অবস্থার মিল নেই।
সূত্র ২ : চরিত্রের সঙ্গে পোশাক, থাকা, খাওয়া, রুচি, আচরণ ও আনুষঙ্গিক বিষয়ের অসামঞ্জস্য।
সূত্র ৩ : সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে বাসস্থানের অমিল।
সূত্র ৪ : খলনায়ক, গুণ্ডা হলেই লম্বা চুল, বিশেষ ধাঁচের অদ্ভুত পোশাক।
সূত্র ৫ : খলনায়কের আস্তানা মানেই গুদামঘর বা নির্মাণাধীন ভবন।
সূত্র ৬ : উচ্চবিত্ত মানেই ডুপ্লেক্স বাড়ি, বড়ো বড়ো সোফা, বিস্তৃত খাবার জায়গা এবং বিশাল পরিসরে বসার ব্যবস্থা, আর বসার ঘর থেকে উপরে ওঠার জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুটি, কখনো একটি সিঁড়ি। আর নিম্নবিত্তের জন্য বস্তি। গ্রামের বাড়ি হলে টিন দিয়ে তৈরি প্রশস্ত বাংলো বাড়ি।
সূত্র ৭ : নায়িকা হলেই তার গ্ল্যামার, পোশাক-পরিচ্ছদ ও অন্যান্য বিষয় অত্যাধুনিক—তা সে গ্রামের, বস্তির বা যে পরিবেশেই থাকুক না কেনো।
প্রযুক্তি, সময় আর মানুষের চরিত্রের পাশাপাশি রুচিও বদলে যায়। সেই ১৯৭০ দশকের মানুষের রুচি আর এখনকার মানুষের রুচি এক নয়। বর্তমানে মধ্যবিত্তও তার বাথরুমের টাইলস্ ফিটিং করার সময় ১০ বার ভাবেন, আর উচ্চবিত্তরা তো ঘর সাজান অভিজ্ঞ ইন্টেরিয়র ডিজাইনার দিয়ে। সেখানে আমাদের পরিচালকরাই কেবল এখনো সেই ৭০—৮০ দশকের গতানুগতিক সেট নিয়েই কাজ করে যাচ্ছেন। তাই তারা সেলুলয়েডে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সময়কে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ফলে চলচ্চিত্রের প্রধান যে বৈশিষ্ট্য—বিভ্রম সৃষ্টি করা, তা আর হচ্ছে না। ‘‘বাস্তব’ গল্প নিয়ে হলেও কখনো পুরো চলচ্চিত্রই মনে হয় ফ্যান্টাসি।
দাবাং-এর নায়ক ও তার বন্ধু ছোটোবেলায় যেখানে খুব কষ্টের মধ্যে সময় পার করেন। সেই তারাই পরে কোনো ধরনের কার্যকারণ ছাড়াই খুব দামি মোটরবাইকে ঘুরে বেড়ান, গরিব-অসহায়দের পুনর্বাসনে বস্তি তৈরি করেন, নিজেরাও থাকেন বিশাল এক বাড়িতে; অথচ তাদের আয়ের কোনো উৎস দেখানো হয় না। এছাড়া নায়িকা অত্যন্ত গরিব ঘরের হলেও তার পোশাক ও ব্যবহৃত প্রসাধনী দেখে তা বোঝার কোনো উপায় নেই। চলচ্চিত্রের ৫৮ মিনিটের মাথায় জ্যোতিষীকে হাত দেখানোর দৃশ্যে নায়িকার পোশাক ও প্রসাধনীর ব্যবহার তার অর্থনৈতিক-সামাজিক অবস্থানের একেবারেই উল্টো। এছাড়া নায়িকার বাড়ির সেটটি নিয়েও শঙ্কায় পড়তে হয়—৫৭ মিনিট থেকে ৫৮ মিনিট আট সেকেন্ড এবং ৫৯ মিনিট ৩০ সেকেন্ড থেকে এক ঘণ্টা এক মিনিট নয় সেকেন্ড পর্যন্ত নায়িকা ও তার বাবার কথোপকথনের দৃশ্যটি দেখানো হয় সবুজ রঙের পাকা বৃহৎ একটি ঘরের ভিতরে। পরের দৃশ্যে নায়ক যখন নায়িকার বাড়িতে পানি পান করতে যান, তখন দেখানো হয় বস্তির একটি কুঁড়ে ঘর।
পারলে দুই ঘরের ছবি
চলচ্চিত্রে একটু অবস্থাসম্পন্ন বাড়ির চিত্রায়ণে অধিকাংশ সময়ই ব্যবহার করা হয় ডুপ্লেক্স বাড়ি, সুবিশাল বসার জায়গা ও বড়ো বড়ো সোফা। আর দরজা-জানালার ভারি পর্দা দেখে মনে হয় দম আটকে মেরেই ফেলবে দর্শককে। চরিত্রের পেশার সঙ্গে মিল না রেখেই তাদের ওপর আভিজাত্য আরোপ করা হয়। তারকাঁটায় নায়কের বোন এক মেয়েকে নিয়ে খুব কষ্ট করে সংসার চালান। অথচ তার বাড়ির সেটটি যেভাবে সাজানো হয়েছে তা কেবল উচ্চবিত্ত পরিবারকেই রিপ্রেজেন্ট করে। আবার নায়িকা ক্লাবের একজন সাধারণ গায়িকা হলেও ভাড়া বাসায় থাকা সোফা, দামি পর্দা ও অন্যান্য ডেকোরেশন তার সামাজিক অবস্থান তুলে ধরে না। আবার রাজত্ব-এ নায়কের বসার কক্ষে দেখা যায় তিনটি বৃহদাকার উদ্ভট রঙের সোফা, দেয়ালের পেইন্টিং আর দরজা-জানালার ভারি পর্দাও নায়কের অবস্থান তুলে ধরে না।
খলনায়কের আস্তানা, রাস্তার পাশের মদের দোকান বা অভিজাত শ্রেণির মদপানের চিত্রায়ণেও তেমন ভিন্নতা নেই। দাবাং-এর নয় মিনিট ৪৭ সেকেন্ডের মাথায় পুলিশ কর্মকর্তা যে অবৈধ মদের দোকান উচ্ছেদ করে, তার সঙ্গে এক ঘণ্টা ২৭ মিনিট থেকে ৩০ মিনিট পর্যন্ত দৃশ্যে খলনায়কের ছোটো ভাই যে অভিজাত বারে বসে নেশা করে তার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। দুই দৃশ্যেই ঘরের দেয়ালে একই চলচ্চিত্রের পোস্টার আর কয়েকজনকে নতুন টেবিল-বেঞ্চে বসে থাকতে দেখা যায়।
তাছাড়া খলনায়ক হলেই বড়ো চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, গলায় মালা, হাতে ব্রেসলেট আর উদ্ভট আলখাল্লা ধরনের পোশাক যেনো প্রথা হয়ে গেছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে। রাজত্ব, দাবাং, দবির সাহেবের সংসার, তারকাঁটার খলনায়ক চরিত্রের এ ধরনের বৈশিষ্ট্য যেমন দৃষ্টিকটু তেমনই উদ্ভট।
ঢাকাই চলচ্চিত্রের খলনায়কেরা
নায়ক-নায়িকার পোশাকের নকশা, রঙ, ধরন নির্ধারণেও শিল্পনির্দেশকের অপরিপক্বতার পরিচয় পাওয়া যায়। দবির সাহেবের সংসার-এ কাজের মেয়ে চরিত্রে নায়িকার রঙিন পোশাক দেখে মনে হয়, বাংলাদেশের কাজের মেয়েরা বুঝি সবসময় নতুন পোশাক পরেই ঘুরে বেড়ায়। আর ঠোঁটের লাল লিপস্টিক, বেণি করা চুলে নতুন লাল-নীল ফিতা, পায়ের নতুন হাওয়াই চপ্পল শিল্পনির্দেশকের অপরিপক্বতাই শুধু নয়, অজ্ঞতারও পরিচয় দেয়। সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রে শিল্পনির্দেশনার এই অসঙ্গতি-ই এখন সঙ্গতি!
মিটলো না মনের আশ, ভাল্লাগে না মাইরি!
প্রাত্যহিক জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে মানুষের মনে যে ক্রোধ-ঘৃণা-প্রতিশোধ জন্ম নেয় তা ফ্রয়েডের চিন্তা অনুযায়ী বাসা বাঁধে মানবমনের অবচেতনে। তাই প্রকৃতিগতভাবেই সংঘাত-সংঘর্ষ-‘‘ভালো-মন্দের’ দ্বন্দ্ব দেখতে-করতে মানুষ ভালোবাসে। বিভিন্ন রঙে-ঢঙে-আকারে-কৌশলে মানুষের অবচেতনের এই দ্বন্দ্ব ক্ষুধার বহিঃপ্রকাশে শিল্প মাধ্যমের ভূমিকা পরিত্রাতার। আধুনিক শিল্প মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্র মানুষের এই অপরিহার্য শারীরিক-মানসিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত বহিঃপ্রকাশে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা-সংঘর্ষের অতিবাস্তব-মায়াময়-আকর্ষণীয়-শৈল্পিক-ঘোর লাগা উপস্থাপনে দর্শক নায়কের সঙ্গে একাত্ম হয়ে খলনায়ককে ক্ষতবিক্ষত করে মন অবচেতনের সেই ক্ষুধা মেটায় অনায়াসে।
কাহিনির সঙ্গে মানানসই, পরিশীলিত ও শৈল্পিক করে তুলতে মূল পরিচালকের পাশাপাশি একজন মারপিট পরিচালকও কাজ করে চলচ্চিত্রে। মুখ ও মুখোশ থেকে সাম্প্রতিক প্রায় প্রতিটি চলচ্চিত্রেই এই মারপিট, গোলাগুলির দৃশ্য ছিলো, আছে এবং থাকবে। ব্যবসায়িক দিক বিবেচনা করলে চলচ্চিত্রে সংঘাত-সংঘর্ষের চিত্রায়ণ এখন প্রায় অপরিহার্য। বিশ্বের বড়ো বড়ো চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিগুলোর প্রধান নিয়ামক এখন এই অ্যাকশন ঘরানার চলচ্চিত্র। যেখানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, অস্ত্র, মারপিট কৌশল, সাউন্ড ইফেক্ট আর আনুষঙ্গিক পরিবেশের কারণে দর্শক এক অতিবাস্তব সংঘর্ষের স্বাদ পায়। এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রে মারপিট বা সংঘর্ষ চিত্রায়ণের অবস্থা কেমন?
মারপিটের দৃশ্যগুলো সাধারণত দুইভাবে চিত্রায়ণ করা হয়-কোনো প্রকার অস্ত্রের ব্যবহার ছাড়াই মারপিট, এ ধরনের মারপিটে শৈল্পিক কৌশল প্রদর্শন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আরেক ধরন হলো—অস্ত্র সহযোগে মারপিট, এক্ষেত্রে কখনো আগ্নেয়াস্ত্র, কখনো দেশীয় অস্ত্র, আবার কখনো উভয় অস্ত্রেরই ব্যবহার করা হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বিস্ফোরক, যানবাহন ভাঙচুর ও আধুনিক প্রযুক্তির নানা ভেলকি। এখানে ব্যক্তি কখনো কখনো আসীন হন অতিমানবীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে—যেমন উড়ে, মাটির নীচ দিয়ে বা হঠাৎ পানির মধ্য থেকে উঠে আসেন; একা অনেকের সঙ্গে মারপিট করেন বা অনেক মার খাওয়ার পরও বেঁচে ওঠেন। কাহিনির ধারাবাহিকতা আর আবেগের ঘোরে সেগুলোও দর্শক মেনে নেন বা পর্দায় তেমনটাই দেখতে চান; কেননা চলচ্চিত্রের মূল কাজই হলো বিভ্রম-ঘোর সৃষ্টি করে দর্শককে বিনোদন দেওয়া। এখন প্রশ্ন, এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক চলচ্চিত্রের অবস্থান কোথায়?
প্রথমত, অস্ত্র ছাড়া বা দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করে যে মারপিট তাতে নায়ককে ১০—১৫ জন একসঙ্গে আক্রমণ করলেও নায়ক একাই সবাইকে ছিটকে ফেলে দেয় এক অদ্ভুত ক্ষমতায়। তারপর কেনো জানি একজন একজন করে ক্রমান্বয়ে এসে নায়কের সঙ্গে মারপিট করে। আবার অনেক দৃশ্যে দেখা যায়, নায়কের সঙ্গে গুণ্ডা মারপিট করছে আর তার অন্য সঙ্গীরা দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে। দাবাং-এ ১১ মিনিট, ৫৫ মিনিট, এক ঘণ্টা ১১ মিনিট, রাজত্বর ছয় মিনিট; আমি শুধু চেয়েছি তোমায়-এর ১২ মিনিট ও এক ঘণ্টা ৩৬ মিনিটের মারপিটের দৃশ্যগুলোতে এই প্রবণতা স্পষ্ট।
দ্বিতীয়ত, চলচ্চিত্রে যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয় দর্শক প্রথম দেখাতেই বুঝে ফেলেন সেগুলো নকল। ওগুলোর ওজন, রঙ ও আকার আসল অস্ত্রের মতো নয়। দাবাং-এর ৩১ মিনিট, দুই ঘণ্টা ১২ মিনিট থেকে ২৫ মিনিট পর্যন্ত অ্যাকশন দৃশ্যে যে আগ্নেয়াস্ত্র দেখানো হয় তা দেখেই বোঝা যায় নকল। এছাড়া রাজত্ব, দবির সাহেবের সংসার, তারকাঁটায় যে অস্ত্রের ব্যবহার সেগুলো দেখলেও বোঝা যায় খেলনা। আর সেগুলোও সময়োপযোগী নয়; পুরনো ডিজাইনের, বিশেষ করে পিস্তল, রিভলবার, শটগানগুলোর চেহারায় ৭০ বা ৮০ দশকের ছাপ স্পষ্ট।
অস্ত্রের ব্যবহারেও অভিনেতাদের আনাড়িপনা ধরা পড়ে। যেমন, গুলি করার সময় হাত অতিরিক্ত সামনে-পিছনে করা, গুলি বের হওয়া আর হাতের ঝাঁকুনির মধ্যে অসামঞ্জস্য, অস্ত্র যে পজিশনে রেখে গুলি করতে হয় তা না জানাসহ বিভিন্ন অসঙ্গতি দর্শকের মোহ ভঙ্গ করে। গুলি করার সময় আগ্নেয়াস্ত্রের মুখ এবং যেখানে গুলি লাগছে সেখান থেকে ধোঁয়া বের হওয়াও সঠিক মাত্রায় হয় না। অগ্নির এক ঘণ্টা ৫১ মিনিট থেকে ৫৭ মিনিট পর্যন্ত গোলাগুলির দৃশ্যে, রাজত্বর দুই ঘণ্টা এক মিনিট থেকে দুই মিনিট এবং দাবাং-এর খলনায়কের বাড়িতে ও কবরস্থানের গোলাগুলিসহ প্রায় সব গোলাগুলির দৃশ্যেই তা দেখা যায়।
অস্ত্রগুলো দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না যে এগুলো কাঠের তৈরি
তৃতীয়ত, রামদা, চাপাতি, ছোরা, হাসুয়াসহ যে দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করা হয়, তা দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, কাঠের ওপর কালো রঙ দিয়ে তা লোহা বানানো হয়েছে। অস্ত্রের ধারালো অংশ বোঝাতে দেওয়া হয় সিলভার রঙ। তাছাড়া যারা এ অস্ত্রগুলো ব্যবহার করেন, তাদের অস্ত্র ধরা ও ব্যবহার দেখে বোঝা যায় এর ওজন আছে কি নেই। আর সেগুলো কখনো পড়ে গেলে তার শব্দ, ভার ও কম্পনের যে চিত্রায়ণ তা-ও সঠিক হয় না। দাবাং-এ ১৯ মিনিটের মাথায় মারপিটের দৃশ্যে ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো যেভাবে তারা হাতে ঘষতে থাকে তাতে হাত কেটে যাবার কথা, হাত কিন্তু কাটে না। চলচ্চিত্রে একেবারে আসল আগ্নেয়াস্ত্র বা দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করতেই হবে এমনটি নয়। কিন্তু সেই বানানো অস্ত্রগুলোর আকার, ওজন, দৃশ্যমানতা দেখা শিল্পনির্দেশকের আর ব্যবহার দেখা মারপিট পরিচালকের কাজ।
চতুর্থত, মারপিটের দৃশ্যে শব্দ ও সঙ্গীতের ব্যবহারও যথাযথ হয় না। এখনো সেই ৪০ বছর আগের মতোই ঘুষি বা লাথির সময় ড্রামের ঢিসুম-ঢিসুম শব্দ ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া কোন্ হাতিয়ারের ব্যবহার এবং পড়ে যাওয়ার শব্দ কেমন তা না ভেবেই সাউন্ড ইফেক্ট ব্যবহার করা হয়। সেই ৭০ দশকের পটকা ফুটিয়ে বানানো গুলির শব্দ একবিংশ শতকেও ব্যবহার হচ্ছে। আর গুলি কাঠে, শরীরে, ধাতব জিনিসে, মাটিতে যেখানেই লাগুক একই শব্দ। অগ্নির এক ঘণ্টা ২৩ মিনিটের অ্যাকশন দৃশ্যে নায়কের পিস্তলের গুলি দেয়ালে লাগার শব্দ আর নায়িকার পিস্তলের গুলি খলনায়কের মাথায় লাগার শব্দ একই হয়।
পঞ্চমত, রক্ত ও কস্টিউমের ব্যবহারেও সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট বোঝা যায়। রক্ত আর রঙের যে পার্থক্য তা বোঝা যায়, আর গুলি বা ধারালো অস্ত্রের কোপ লাগার পর কাপড় না কাটলেও রক্ত ঠিকই বের হয়। তাছাড়া খলনায়কের সহযোগীদের বুকে বা পিঠে গুলি লাগলে যে রক্ত বের হয়, তা যে শরীরের কাপড়ের নীচে বাঁধা থাকে তা বুঝতে কষ্ট হয় না।
ষষ্ঠত, বেশিরভাগ চলচ্চিত্রে মারপিটের শৈলী এখনো সেই মান্ধাতা আমলের। প্রথমে নায়ক মার খায়, তারপর খলনায়ক; ধারাবাহিকভাবে এ মারপিট চলতে চলতে শেষে গিয়ে নায়ক জিতে যায়—এ ফর্মুলাতেই চলছে গত ৪০ বছর। তাছাড়া কিছু ক্ষেত্রে হলিউড, বলিউড বা কলিউডের মারপিটের দৃশ্য নকল করা হলেও তা যথাযথভাবে ফুটে ওঠে না।
সপ্তমত, বিভিন্ন স্পেশাল ইফেক্ট, যেমন মানুষকে ওড়ানোর ক্ষেত্রে ক্রেনের সাহায্যে পিঠে দড়ি বেঁধে তা চিত্রায়ণ করা হয়। এটাই হয়তো কৌশল, কিন্তু সমস্যা হয় তখন, যখন পিঠে বাঁধা সেই দড়ি আর পিঠের কাপড় উঁচু হয়ে থাকাটা স্পষ্ট দেখা যায়। দাবাং-এর দুই ঘণ্টা ২২ মিনিট ২৮ সেকেন্ডের একটি শটে নায়কের গুলিতে খলনায়কের দুই সহযোগীকে যেভাবে পিঠে দড়ি বেঁধে ওড়ানো হয় বা খলনায়ক যেভাবে উড়ে এসে লাথি মারে কিংবা খলনায়ককে লাথি মারার সময় নায়কের যে ওড়ার দৃশ্য তাতে পিঠে বাঁধা দড়ি স্পষ্ট দেখা যায়। দবির সাহেবের সংসার-এ দুই ঘণ্টা ১৫ মিনিটে খলনায়কের গায়ে নায়কের লাথি না লাগলেও তার যে উড়ে যাওয়া দেখানো হয় তা দর্শককে মারপিটের মজা থেকে বঞ্চিত করে।
অসমাপ্ত : সরষের ভূত তাড়াই কীভাবে!
মৃত ভেবে বাড়ির চাকরকে দিয়ে শিশু সন্তানকে জঙ্গলে কবর দিতে পাঠান বাবা। এক ডাকাত সর্দার চাকরকে খুন করে বাঁচায় ছেলেটিকে, বড়ো হয়ে সেই ছেলেটিও হয় ডাকাত। আরেক সন্তান বাবা-মার ছায়াতলে হয় পুলিশ কর্মকর্তা। সেই ডাকাত-পুলিশের যুদ্ধ এবং ২০ বছর পর হারানো সন্তানকে ফিরে পাওয়ার কাহিনি নিয়ে নির্মাণ হয় এ ভূখণ্ডের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা চলচ্চিত্র।
তার প্রায় ৬১ বছর পর, বাড়ির চাকর ও চাকরানি অর্থের লোভে মালিকের ছোটো মেয়েকে চুরি করে পালায়। সেই জঙ্গলেই পুলিশের গুলিতে নিহত হন তারা। মেয়েটিকে খুঁজে পায় একজন ক্যাবারে ড্যান্সার। মেয়েটি হয়ে ওঠে নৃত্যশিল্পী। তার প্রতি লোলুপ দৃষ্টি পড়ে এক মাফিয়ার। ঘটনাচক্রে হারানো বাবার পাশের ফ্ল্যাটে কাজের মেয়ে হিসেবে আত্মগোপন করে মেয়েটি। একপর্যায়ে আবারো ধরা পড়ে খলনায়কের হাতে। অবশেষে পুলিশ-মাফিয়ার যুদ্ধ এবং ২০ বছর পর বাবা ফিরে পায় হারানো সন্তানকে। ২০১৪ সালের এপ্রিলে মুক্তি পাওয়া দবির সাহেবের সংসার নির্মাণ হয় এ কাহিনি অবলম্বনে।
প্রাযুক্তিক সীমাবদ্ধতা আর বৈরী পরিবেশে নির্মিত মুখ ও মুখোশ না হয় ৫০ বছর আগে নানা সমস্যায় নিমজ্জিত ছিলো। কিন্তু আজকের বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে কি? এমন তো নয়, বাংলাদেশের মানুষ চলচ্চিত্র ভালোবাসে না! তা-ই যদি সত্যি হতো তবে অগ্নি ১২ কোটি টাকা আয় করতো না, হিরো দ্যা সুপার স্টার ছাড়িয়ে যেতো না ১০ কোটি। মোস্ট ওয়েলকাম সাত কোটির ঘর ছাড়িয়েছে, তা অনন্ত জলিল বলতে পারতেন না।
তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা দর্শকে নয়, সমস্যা প্রেক্ষাগৃহেও নয়; সমস্যা আমাদের সরষেতে। একজন পরিচালক যদি বছরে পাঁচ—সাতটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, একজন অভিনেতা যদি বছরে ছয়—সাতটি চলচ্চিত্রে মুখ দেখান; তাহলে তাদের চিন্তা, চেহারায় দর্শক আলাদা কী আশা করতে পারেন। একইভাবে একজন কাহিনিকার যদি বছরে আট—দশটি গল্প ফাঁদেন তবে তা ‘‘টুকলিফাই’ না হয়ে কী হবে? তাই আগে ছাড়াতে হবে সেই ভূত তাড়ানো সরষের ভূত। আর এর বাইরে আরো অসংখ্য সমস্যা তো রয়েছেই।
লেখক : মাজিদ মিঠু, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্বের শিক্ষার্থী।
mazid.mithu@gmail.com
তথ্যসূত্র
১. রাজশাহী সিটি করপোরেশনে প্রেক্ষাগৃহ ছিলো পাঁচটি—স্মৃতি, বর্ণালী, উৎসব, লিলি ও উপহার সিনেমা। শহরের সবচেয়ে পুরনো প্রেক্ষাগৃহ ‘স্মৃতি’ এখন শুধুই স্মৃতি; ২০০৭ সালে বন্ধ হওয়ার পর সেখানে গড়ে উঠেছে বহুতল বিপণি ভবন। ২০০৯ সালে এম এল এম কোম্পানি ডেসটিনি কিনে নেয় ‘বর্ণালী’র জমি; ২০১০ সালের শুরুতেই ভেঙে ফেলা হয় প্রেক্ষাগৃহটি। একই বছর পর পর ভাঙা হয় শহরের আলুপট্টির মোড়ের ‘উৎসব’ ও শহরতলীর বাইপাস এলাকার ‘লিলি’ প্রেক্ষাগৃহ। এর একটির জমিতে গড়ে উঠছে বহুতল ভবন ও বিপণিবিতান, অন্যটি হয়েছে বাসাবাড়ি। বর্তমানে রাজশাহী শহরের একমাত্র প্রেক্ষাগৃহ ‘উপহার সিনেমা’। ১৯৮৫ সালে নির্মিত প্রেক্ষাগৃহটিও রয়েছে হুমকির মুখে। যেকোনো সময় মালিকানা পরিবর্তন হয়ে গড়ে উঠতে পারে বিপণিবিতান।
২. ইসলাম, আহমেদ আমিনুল (২০১৪ : ৩২৮); বাংলাদেশের চলচ্চিত্র : চলচ্চিত্রে বাংলাদেশ; ভাষাচিত্র, ঢাকা।
৩. হোসেন, মাহমুদুল (২০১৪ : ১০৪); ‘‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র-বাস্তবতা ও সংসদ আন্দোলন’; সুবর্ণজয়ন্তী স্মারকগ্রন্থ : বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ইতিবৃত্ত [১৯৬৩—২০১৩]; সম্পাদনা : সাজেদুল আউয়াল; সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন পরিষদ, ঢাকা।
৪. প্রাগুক্ত; হোসেন, মাহমুদুল (২০১৪ : ১০৪)।
৫. কাদের, মির্জা তারেকুল (১৯৯৩ : ১৬৮—১৬৯); বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প; বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
৬. চৌধুরী, ইকবাল হোসাইন; ‘ছয়টা গান + দশটা মারপিট + একটা প্রেম = বাংলা ছবি!’; প্রথম আলো, ২৭ আগস্ট ২০০৯।
৭. হোসেন, আমজাদ; ‘তবুও আলোর হাতছানি’; সমকাল, ২২ জুন ২০১১।
৮. প্রাগুক্ত; কাদের, মির্জা তারেকুল (১৯৯৩ : ১৬৯)।
৯. সেতু, মাহামুদ ও মাহমুদ বাবু; ‘‘বলিউডের পাগলাঘোড়া ছুটছে তবে জায়গায় দাঁড়িয়ে’; ম্যাজিক লণ্ঠন; সম্পাদনা : কাজী মামুন হায়দার; বর্ষ ৩, সংখ্যা ১, জুলাই ২০১৩, পৃ. ৮৬, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী।
১০. প্রাগুক্ত; কাদের, মির্জা তারেকুল (১৯৯৩ : ৬৫)।
বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জানুয়ারির ম্যাজিক লণ্ঠনের অষ্টম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন