ফারুক আলম
প্রকাশিত ১৫ নভেম্বর ২০২৫ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
বহির্গমন ও দেহব্যবসার চালচিত্রে ‘অজ্ঞাতনামা’দের অনিশ্চয়তা
ফারুক আলম

অবৈধ বহির্গমনের ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা চলচ্চিত্র অজ্ঞাতনামা (২০১৬)। তৌকির আহমেদ পরিচালিত ফরিদুর রেজা সাগরের প্রযোজনায় রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার বার্তাবাহী প্রতিবেদন ও সংবাদ পরিবেশনাধর্মী এই চিত্রনাট্য গণসচেতনতা সৃষ্টিতে সচেষ্ট। কিন্তু এই সচেতনতা সৃষ্টি করতে গিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের দুর্বলতা ও দুর্দশা প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে এতে। রাষ্ট্র যেভাবেই চলুক না কেনো, তার দ্বিচারিতার স্বভাব সর্বত্র। মূল কাহিনির সারসংক্ষেপে হতচ্ছাড়া রাষ্ট্রের অসহায় মানুষের হাহাকার নিদারুণ প্রকট।
‘বিউটি সব বোঝে। সে আর কারো ধার ধারবো না। সে নিজের পায়ে দাঁড়াইয়া মানুষের মতো বাঁচবো। সে আর কারো কাছে বাঁন্দা থাকবো না। ... একবার যাইতে পারলে আর কোনো সমস্যা নাই, তোমাগোও না, আমারও না।’ বিউটির এসব কথায় বোঝা যায়, তিনি নিশ্চিত, বিদেশ গেলেই তার সব সমস্যার সমাধান। কিন্তু তার বিদেশ যাওয়ার ব্যবস্থাটা সুনিশ্চিত নয়। তিনি রমজান দালালকে রাজি করিয়েছেন। রমজান বিদেশে লোক পাঠান। অত্র এলাকায় যারা বিদেশ গেছে, তারা প্রায় সবাই রমজান দালালের হাত ধরেই গিয়েছে। তবুও লোকে তাকে দালাল বলে গাল দেয়। তিনি নিজেও সেটা জানেন। জেনেশুনেই তিনি এ কাজ করেন এবং বিউটিকেও বিদেশে পাঠাবেন। লোকজন তাকে টাকাপয়সা দেয়, এটাই তার আয়-রোজগার। বিউটির টাকা নেই, তাই টাকার বদলে বিউটি নিজেকেই তার হাতে তুলে দিয়েছেন। রমজান আয়-রোজগার ভালোই করেছে, তার একটু আমোদ-ফুর্তিও দরকার। বিউটির ঘরে রাতে-দিনে তাই তার অবাধ যাতায়াত।
দুই
বিউটিকে বিদেশে পাঠানোর জন্য রমজান শুভগাছা গ্রামের কিফায়াত উদ্দিন পরামানিকের ছেলে আছির উদ্দিন পরামানিককে বেছে নেন। আছির উদ্দিন পরামানিক নিজের নাম নিয়ে বিদেশ যেতে পারেননি। তিনি গলাকাটা পাসপোর্ট নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আজমান শহরে চাকরি করেন। শেখ আ. হাকিমের ছেলে শেখ আ. ওহাব পৃথিবীর অন্যতম আয়-রোজগারের মহাদেশ, স্বপ্নের জায়গা ইউরোপের ইতালিতে যাওয়ার সময় নতুন পাসপোর্ট করে যান। কিন্তু পুরাতন পাসপোর্টটা রেখে দেন রমজান দালাল। দালাল চক্র পাসপোর্টের মুখমণ্ডল পরিবর্তন করে ওহাবের নামেই ৩০ হাজার টাকায় মধ্যপ্রাচ্যে পাঠিয়ে দেয় আছিরকে। রমজান দালালের প্রতি কৃতজ্ঞ আছির। সম্ভবত সেই কারণে রমজানের কথায় বিউটিকে তিনি সেই গলাকাটা পাসপোর্টে বউ করতে রাজি হয়েছিলেন। বিউটির ভিসা আটকে আছে পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের কারণে। বিউটি পুলিশ কর্মকর্তা ফরহাদকে পেয়ে যান হাতের নাগালে। তাকে দিয়ে তিনি পুলিশ ক্লিয়ারেন্স আনাবেন। ফরহাদ গোপনে তার ঘরে যাতায়াত শুরু করেন। তবে বিউটির ঘরে এসে সেই সম্পর্কের ব্যাপারটা জেনে ফেলেন রমজান। বিউটির খাটের তলায় তিনি ফরহাদকে পেয়েও যান। সুযোগ বুঝে পুলিশ ফরহাদ দৌড় দেন; তাড়া করেন রমজান। তবে ফরহাদকে ধরতে পারেন না। তাই বিউটির ওপর রাগ করে বাড়ি চলে যান রমজান।
হঠাৎ এক দুর্ঘটনায় আরব আমিরাতে আছিরসহ বিভিন্ন দেশের ছয়জন লোক মারা যায়। আছির যেহেতু আ. ওহাবের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ থাকতেন, তাই রাজবাড়ি জেলার কালুখালি থানার ওসি কুদ্দুসের কাছে বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব টেলিফোনে জানান-শুভগাছা গ্রামের শেখ আ. হাকিমের ছেলে আ. ওহাব তিন দিন আগে আরব আমিরাতের আজমান শহরে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। যেভাবেই হোক রাতের মধ্যে ওহাবের পরিবারকে মৃত্যু সংবাদ দিতে হবে; কারণ বিমানবন্দর থেকে তার লাশ গ্রহণ করতে হবে পরদিন বিকালে। ঝড়বৃষ্টির মধ্যে নদী পার হয়ে প্রায় শেষরাতে গ্রামের জালাল মেম্বারকে সঙ্গে নিয়ে ওহাবের বাবা শেখ আ. হাকিমের কাছে পৌঁছায় কালুখালি থানার ওসিসহ চার পুলিশ। বহু বাদানুবাদের পর পুলিশ মোবাইল ফোনসেটে ওহাবের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়, তিনি বহাল তবিয়তে ইতালির রোমে অবস্থান করছেন। ফোনে কথা বলেই মৃত ব্যক্তি কে হতে পারে তা জেনে নেয় পুলিশ। তারা এটাও নিশ্চিত হয়, সব ঘটনার নাটের গুরু রমজান দালাল। রমজানকে বাড়ি থেকে ডেকে আনেন ফরহাদ। পুলিশ তার কাছ থেকে জানতে পারে, গলাকাটা পাসপোর্টে শেখ কিফায়াত উদ্দিন পরামানিকের ছেলে আছির উদ্দিন পরামানিককে মধ্যপ্রাচ্যের আরব আমিরাতের আজমান শহরে পাঠিয়েছিলো দালাল চক্র। সেখানে আ. ওহাব নামের পাসপোর্ট নিয়ে আছির কাজ করতেন। দুর্ঘটনায় আ. ওহাব মরেননি, মরেছেন গলাকাটা পাসপোর্টধারী আছির। এখন আছিরের লাশ দেশে আসছে। সেই লাশ গ্রহণ করবে তার পরিবার।
তিন
পুলিশ রমজান দালালকে গ্রেপ্তারের পরিবর্তে তাকে দিয়ে বিমানবন্দর থেকে লাশ গ্রহণের কাজ করায়। যেহেতু আছিরের কাছে আ. ওহাবের পাসপোর্ট, তাই এখন আছিরের বাবাকে শেখ আ. ওহাবের বাবা শেখ আ. হাকিম সেজে ছেলের লাশ নিয়ে সৎকার করতে হবে। কিফায়াত উদ্দিন মহাজনের কাছে বাড়ির ভিটা বন্ধক রেখে টাকা নিতে চান। এদিকে মেম্বার ও গ্রামবাসীরা মিলে টাকা দিয়ে ঢাকা থেকে লাশ আনার ব্যবস্থা করতে চায়। গ্রামবাসীদের দেওয়া সামান্য অর্থে অনর্থ হবে জেনেও, রমজান টাকাপয়সা জোগাড় করে আছিরের বাবা কিফায়াত ও চাচাতো ভাই রহমানকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় রওনা দেন। রমজানকেই অবশ্য এর সব ব্যবস্থা করতে হয়। গ্রাম্য সাদামাটা মানুষ কিফায়াত মিথ্যা বলতে অভ্যস্ত নন। বরং চুপ থাকার পরিবর্তে তিনি সত্য কথাটা কাস্টমস কর্মকর্তার সামনে বলে ফেলেন। রমজানের টাকা খরচ হতে থাকে পানির মতো। বহু কষ্টে লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন তারা। মুর্দার গোসলের সময় দেখা যায়, লাশ আছিরের নয়। এমনকি মৃত ব্যক্তি বাঙালি-ই না, অন্য কোনো দেশের কালো মানুষ-শ্রীলঙ্কান, তামিল কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার নিগ্রো জাতির কেউ।
এদিকে বিউটির দখল নিয়ে নিয়েছেন ফরহাদ। কথা ছিলো পুলিশ ক্লিয়ারেন্স দিলে তিনি বিউটিকে পাবেন। ফরহাদ তা-ই করেছেন। নিজে বিউটির ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে রমজানকে ফেরত পাঠিয়েছেন। অন্যদিকে গ্রামবাসী লাশ নিয়ে থানায় আসে। কালুখালি থানার করিৎকর্মা ওসি দ্রুত লাশ ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। লাশ নিয়ে আবারও রমজান, কিফায়াত ও রহমান রওনা দেয়। তবে এবার লাশের সঙ্গে সাধারণ পোশাকে যান পুলিশ ফরহাদও। দীর্ঘযাত্রায় রমজান-ফরহাদ দ্বন্দ্ব মিটমাট হয়ে যায়। তারা দুজনেই মনে মনে বুঝে যায়, বিউটিকে তারা কেউ বিয়ে করবে না। দুজন এক বোতলের মদ ভাগাভাগি করে খায়।
লাশ নিয়ে তারা প্রথমে যায় প্রবাসী কল্যাণ ভবনে, তারপর একে একে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, মেডিকেলের মর্গে এবং অবশেষে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। রাষ্ট্রের এসব দায়িত্বশীল সংস্থা তাদের দপ্তরে লাশ নিয়ে পৌঁছানোর মতো বোকামির জন্য প্রথমত ভর্ৎসনা এবং অন্য দপ্তরের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বিদায় করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লাশে পচন ধরা শুরু হয়। সিন্দাবাদের ভূতের মতো লাশ তাদের কাঁধে চেপে বসে থাকে। তারা না পারে লাশ ফেলে দিতে, না পারে বহন করতে। নিরুপায় হয়ে বিমানবন্দরে লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড ডিপার্টমেন্টে তথ্য তালাশের জন্য অপেক্ষা করে তারা। ঠিক এ সময় ওসি সাহেবের ফোন পান ফরহাদ। অবশেষে জানা যায়, লাশটা বিদেশির কিন্তু যে দুর্ঘটনায় লোকটা মারা গেছে, সেই একই দুর্ঘটনায় ওহাবের পাসপোর্টধারী আছিরেরও মৃত্যু হয়েছে। কারো লাশ চেনা যাচ্ছে না। কাজেই কোনোক্রমেই আছিরের লাশ শনাক্ত করে বাংলাদেশে পাঠানো সম্ভব না। এ কথা শুনে সবাই হতাশ হয়।
বিদেশির লাশ ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে যখন বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ সংস্থা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিমানবন্দরের কাস্টমস কেউ দায়দায়িত্ব নেয় না বা নিতে পারে না; তখন আছিরের বাবা কথা বলেন, সব মানুষেরই সৎকার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। মৃত লোকটি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা মুসলমান যাই হোক না কেনো, তিনি নিজের হাতে তাকে সৎকার করবেন। গলাকাটা পাসপোর্টে আছির যেদিন বিদেশে গিয়েছেন, সেদিনই তার নাম মুছে গেছে, তিনি মারা গেছেন। কাজেই রাষ্ট্র বা তার অঙ্গসমূহ যখন একজন মরা মানুষের দায়ভার নিতে পারে না, তখন সহায় সম্বলহীন সাধারণ মানুষ কিফায়াত উদ্দিন পরামানিক শেষ সম্বল ভিটামাটি বন্ধক রেখে লাশ সৎকারের সিদ্ধান্ত নেন।
চার
অজ্ঞাতনামার শিল্পনির্দেশনায় কাজী রাকিব, রূপসজ্জায় মো. ফারুখ, চিত্রগ্রহণে এনামুল হক সোহেল, সম্পাদনায় অমিত দেবনাথ, কালারিস্ট মানস ভট্টাচার্য্য, সঙ্গীত পরিচালনায় পিন্টু ঘোষ, শব্দ পরিকল্পনায় রিপন নাথ ও নির্বাহী প্রযোজক ইবনে হাসান খান। চিত্রনাট্য লিখেছেন নির্মাতা তৌকির আহমেদ স্বয়ং। সংলাপ ও চিত্র পরিকল্পনা যেভাবে এক ঘণ্টা ৪৮ মিনিট নয় সেকেন্ডের এই চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নিয়েছে, তা সাবলীল ও চমৎকার।
ব্যান্ডের গান দিয়ে কাহিনির শুরু। পর্দায় বিমানবন্দরের দৃশ্যের পাশাপাশি কুশীলব ও কলাকুশলীদের নাম দেখা যায়; থাকে তিন ছত্রের ইংরেজি বাক্য। যার সারকথা হলো-বেআইনি অভিবাসন ও বহির্গমন সমস্যায় জর্জরিত মানুষের সংখ্যা নিছক কম না। সঙ্গে থাকে ওয়েল্ডিং, ভবন-নির্মাণ ও লেদ মেশিন ইত্যাদি। পাঁচ মিনিট ২০ সেকেন্ডে প্রথম শোনা যায় দাদা’র কথা-এই সবুজ, আস্তে যা। সবুজ বলে-দাদা, পাখি। মরা পাখি নিয়ে এরপর দাদা-পৌত্র কথা বলে। তারা পাখির কবর দেয়। দর্শক বুঝতে পারে মৃত্যুতে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে এবং লাশ মাটিতে পুঁতে ফেলতে হয়। এখানে নদীর পাড়, সবুজ ক্ষেত, পাখির পালক, ঘূর্ণি, শিশুর দৌড় জীবনের সৃষ্টি, গতি ও পরিণতির ইঙ্গিতবহ। পরের দৃশ্যে আছিরের বউ শেফালির সামনে এসে দাঁড়ান বিউটি। তিনি আছিরের বউ হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যেতে বদ্ধ পরিকর। আলাপের মধ্য দিয়ে শেফালির মনোভাব এবং আছিরের খোঁজখবর নিয়ে তিনি নদী পাড়ি দেন।
আট মিনিট ৪৯ সেকেন্ডে দেখা যায়, বিউটি ও ফরহাদের রসরঙ্গ। ১২ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডে থানার দৃশ্যে ওসি ও পুলিশ কনস্টেবল হাজির হয়ে কাহিনির মোড় ঘুরিয়ে দেয়। টেলিফোন বাজে। বিদেশ থেকে ওসির কাছে মৃত্যুর খবর আসে। এদিকে ১৪ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডে বিউটির ঘরে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা ফরহাদের মোবাইল ফোনসেট বেজে ওঠে। রমজানের সামনে বিউটি তা সামলানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু খাটের তলায় লুকিয়ে থাকা ফরহাদের এক হাঁচিতে সব ফাঁস হয়ে যায়। ফরহাদের কলার ধরে তাকে বের করে আনেন রমজান। সেখানে পুলিশের চোর সাজা, আর দালালের পুলিশ সাজা চলে বেশ কিছুক্ষণ।
এরপর ১৯ মিনিট ছয় সেকেন্ডে পুলিশ চলে নদীপথে। দুর্যোগের রাত; তবু যেতে হয়। ২১ মিনিটে ডাঙ্গায় উঠে তারা প্রথমে জালাল মেম্বারের বাড়ি, পরে মৃত আ. ওহাবের বাবা শেখ আ. হাকিমের বাড়ি যায়। মৃত ব্যক্তির সন্ধান করতে গিয়ে পুলিশ রমজান দালালের নাম জানতে পারে। পরে রমজানকে আনতে যান পুলিশ কর্মকর্তা ফরহাদ। এবার পুলিশ এসেছে আসামি ধরতে। রমজান এবার ফরহাদের হাতে। ২৯ মিনিটে রমজান দালালকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন ওসি। রমজান নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন।
রমজান : ... কার পাসপোর্ট কার কাছে এইটাতো আমার পক্ষে জানা সম্ভব না। আমি তো শুধু স্যার লোক পাঠাই।
ওসি : ... এই বাইনচোদ কথা ক।
বেরিয়ে আসে গলাকাটা পাসপোর্টের কাহিনি। আ. ওহাবের পাসপোর্টে আছির চাকরি করতেন আরব আমিরাতের আজমানে। এক দুর্ঘটনায় তিনি মারা গেছেন। তার লাশ দেশে আসছে। বিমানবন্দর থেকে সেই লাশ তার পরিবারকে সংগ্রহ করতে হবে। মূল রহস্য উদঘাটন হলে কাহিনি মোড় নেয় নতুন দিকে। এবার লাশ আনার পালা। ৩৪ মিনিটে আছিরের বাড়ি গিয়ে পুলিশ কীভাবে তার পরিবারকে দ্রুত অথচ সহানুভূতির সঙ্গে মৃত্যু সংবাদ দেয়, তা দর্শকসহ বাংলাদেশ পুলিশকে শিখে নিতে হবে। ৪২ মিনিট ৪০ সেকেন্ডে চারটে ডাল-ভাতের (মাংস আবশ্যক) আয়োজনে পুলিশ অংশ না নিয়ে পারে না। ৪৮ মিনিট ১৫ সেকেন্ডে বিউটির ঘর থেকে ফেরত যান রমজান দালাল। আকাশের বজ্রধ্বনি শুনে মনে হয়, যেনো তার মাথাতেই মুহুর্মুহু বজ্রপাত হচ্ছে। চারিদিকে তার সমস্যা। ৫১ মিনিট ২১ সেকেন্ডে কিফায়াতকে মিথ্যা কথা বলার প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন রমজান দালাল। কিন্তু কিছুতেই বুড়ো লোকটাকে দিয়ে মিথ্যা বলানো যায় না। ৫১ মিনিট ৫৪ সেকেন্ডে সকালের নাস্তা খাওয়ার দৃশ্য। বেঁচে থাকলে মানুষের জৈবিক চাহিদা, ক্ষুধা, তৃষ্ণাকে অস্বীকার করলে চলে না। ৫৪ মিনিট ছয় সেকেন্ডে গাড়ি মেরামতের দৃশ্য। এরপর পুলিশ চেকপোস্টে গাড়ি থামে। লাশ আনতে বিমানবন্দরে যাচ্ছে বলে ছাড়া পায়। বিমানবন্দরের কাস্টমস কর্মকর্তা লাশ হস্তান্তর করে।
কিফায়াত চিৎকার করে সত্যি কথাটাই বলেন-‘ওরে আমার আছির রে, মরার সময় নিজের পিতৃ পরিচয় নিয়ে মরতে পারলি না বাজান। আমারে মাফ কইরা দিস বাজান। তোর কব্বরে আমি বড়ো বড়ো কইরা লিইখা দিমু ...।’ লাশ নিয়ে বাড়ি এসে সৎকারের আয়োজন করে গোসল দেওয়ার সময় জানা যায়, এ লাশ আছিরের না। এটা বিদেশের অমুসলিম কোনো লোক। কিফায়াত উদ্দিন পরামানিক আশার আলো দেখতে পান। তিনি বলেন, ‘এটা তো আমার ছেলের লাশ না। তাইলে তো এমনও হতে পারে আমার আছির বেঁচে আছে!’ লাশ নিয়ে তাই পুনরায় ঢাকা গমন। পথে রমজান দালাল ও পুলিশ ফরহাদের কথোপকথনে মনে হয়, দুই জনের যেনো সমঝোতা হয়ে গেছে। একটু বাদে দেখা যায়, একই মদের বোতলে দুই জন পালাক্রমে মদ খাচ্ছে। নিছক মেয়ে মানুষের জন্যে কতক্ষণ আর শত্রুতা চলে! মিটমাট করে ভাগে-যোগে ভোগ করার ভোগবাদী সংস্কৃতি শক্তিমানদের মধ্যে গড়ে ওঠে। তারা লাশ নিয়ে প্রথম পৌঁছায় প্রবাসী কল্যাণ ভবনে। তারপর বিভিন্ন দপ্তর ঘুরে হয়রানি শেষে পৌঁছায় বিমানবন্দর।
এক ঘণ্টা ৩৮ মিনিট ২৬ সেকেন্ডে ফরহাদের কাছে ওসি ফোন করে বলেন, যে লাশ তারা নিয়ে গেছে তা বিদেশির। তবে ওহাবের পাসপোর্টধারী আছির সত্যিই মারা গেছে। দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কারণে লাশ শনাক্তেরও কোনো উপায় নেই। এক ঘণ্টা ৩৯ মিনিট ৪০ সেকেন্ড কিফায়াতের বক্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ-‘আমার ছেলের নাম যে দিন হারাইয়া গেছিলো গলাকাটা পাসপোর্টে, সেদিনই তো তারে মারা হইছিলো। নামই যদি না থাকলো, তাইলে থাকলো কী মানুষটার?’ চলচ্চিত্রের একেবারে শেষে দাদা ও পৌত্রের কথা হয় এভাবে-
দাদা : ও সবুজ আস্তে যা।
সবুজ : তাড়াতাড়ি আসো দাদু, দেরি হইয়া যাইতাছে তো।
দাদা : কই যাস তুই?
সবুজ : বিদেশে।
আবহে গান বাজতে থাকে-আমার সোনা জাদুর মুখ জগতের সবচেয়ে সুন্দর ...। এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় অজ্ঞাতনামা।
পাঁচ
নিছক সাধারণ উদ্দেশ্য অভিমুখী চলচ্চিত্র না হলেও এটি নির্মাণের আগেই কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান যে এর আনুষঙ্গিক ব্যয়ভার বহন করেছে, তা দর্শক শুরুতেই বুঝে ফেলে। কাজেই নির্মাতাকে শুধু কর্তাব্যক্তিদের মুখের দিকে তাকালেই চলে, দর্শককুলের কুল রাখার প্রশ্ন এখানে অবান্তর; তাই বিজ্ঞাপনই এখানে সারবস্তু হয়ে ওঠে। চলচ্চিত্র শেষ হওয়ার পর শিল্পের যে ক্রিয়াকলাপ মানুষের ভিতরে ক্রিয়াশীল থাকে, অনুরণন সৃষ্টি করে, তাড়িত করে, তেমন তাড়না না থাকলেও কিছু বিষয়ে সাধারণ ভাবনা ভিড় করে।
Bangladesh is one of the largest manpower exporters in the world. More than 10 million Bangladeshis are working abroad.
The process of migration and overseas employment is full of loopholes, allowing unchecked human trafficking and faking identity.
Intending migrant workers have to pay the highest amount of money but get lowest wages. Living is poor and insecure in abroad. The workers are denied the basic human rights and protection.
চলচ্চিত্রের শুরুতে প্রোলঙের এই তিন লাইন দেখে বহির্গমন, বিদেশে কর্মসংস্থান বা অভিবাসন সমস্যা নিয়ে চিন্তিত হতে হয়। একটু তলিয়ে দেখলে জানা যায়, জাতিসংঘের হিসাবে, প্রতিবছর গড়ে প্রায় দুই মিলিয়ন বিদেশগামী দেশ হারানোর কাফেলায় যোগ দিতে দিতে প্রতি ১০ বছরে দ্বিগুণ হয়। আন্তর্জাতিক অভিবাসনকারীদের অর্ধেক বাস করে মাত্র ১০টি দেশে বা অঞ্চলে। দেশগুলো হলো-যুক্তরাষ্ট্র (৪৫.৮ মিলিয়ন, যা সারা পৃথিবীর ২০ শতাংশ), রাশিয়া (১১ মিলিয়ন), জার্মানি (৯.৮ মিলিয়ন), সৌদি আরব (৯.১ মিলিয়ন), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৭.৮ মিলিয়ন), যুক্তরাজ্য (৭.৮ মিলিয়ন), ফ্রান্স (৭.৫ মিলিয়ন), কানাডা (৭.৩ মিলিয়ন), অস্ট্রেলিয়া (৬.৫ মিলিয়ন) ও স্পেন (৬.৫ মিলিয়ন)। লক্ষণীয় তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোতে এবং মধ্যপ্রাচ্যে নারী অভিবাসীদের চাহিদা বেশ চড়া।
অভিবাসন বা বহির্গমন সমস্যা মানব সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই আছে-প্রতিকূল পরিবেশ থেকে অনুকূল পরিবেশের জন্য। আবহাওয়া, খাদ্য, নিরাপত্তা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মানুষ বা বন্য জন্তুর আক্রমণ থেকে প্রাণরক্ষা ইত্যাদি যৌক্তিক কারণে মানুষকে এক আবাসভূমি বদলে নতুন আবাসভূমি খুঁজে নিতে হয়েছে। এই খোঁজাখুঁজির প্রক্রিয়া খুব যে আরামদায়ক ছিলো, তা কিন্তু নয়। ইসরাইলের ইহুদি, মধ্য ইউরোপ বা এশিয়া মাইনরের আর্যদের স্থানান্তর; রেড ইন্ডিয়ান বা আফ্রিকানদের আবাসস্থল ত্যাগ থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে ফিলিস্তিনিদের পিতৃভূমি সঙ্কট, রোহিঙ্গা সমস্যা; জনসংখ্যার আধিক্যের চাপে ভাগ্যান্বেষণে বাংলাদেশিদের বিদেশে ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করতে যাওয়ার ঘটনা মোটেও সুখকর ছিলো না।
সংশ্লিষ্ট দেশের সদিচ্ছা ও প্রয়োজনের ওপর নির্ভর করে কর্মসংস্থান বা অভিবাসন। অতীতে আক্রমণকারী শক্তিকে সামরিক শক্তিতে বা কৌশলে অন্য দেশের মানুষকে বা রাজশক্তিকে কব্জা করতে হতো। আজ শক্তি প্রয়োগ ও কূটনৈতিক সম্পর্কের চেহারা বদলে গেছে। ব্যক্তি যেমন ব্যক্তি তোষণের ফর্মুলায় মুনাফা অর্জন করে, তেমনই রাষ্ট্র নামক জনকল্যাণকামী প্রতিষ্ঠানের অন্তরালে দুটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান করপোরেট পুঁজি খাটিয়ে কৌশল অবলম্বনে বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নয়নের নামে ব্যবসায়ী স্বার্থ হাসিল করে এবং বাণিজ্য ঘাটতির ভারসাম্য রক্ষা করে। তাই বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশের মানব সম্পদ ব্যবহারের নামে মানুষকে কৃতদাস হতে উৎসাহী করে বিদেশে পাঠানো ছাড়া কী-ইবা করার আছে? সুষ্ঠু নিয়োগবিধি মেনে লোক পাঠানোর ব্যবস্থা কোনোদিন কি হবে?
অন্তরের ক্ষত ক্রন্দন অপ্রকাশ রেখে আধুনিক রাষ্ট্রের মানুষ চলে। ‘আছির! আমার আছির রে। তুই কই’-গলাকাটা পাসপোর্টে বিদেশ গিয়ে আছিররা হারিয়ে যায়। এই ক্রন্দন সারা বাংলায় ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়। সন্তানহারা বাবা-মা, স্বামীহারা নারী, বাবাহারা অবুঝ সন্তানের হৃদয় বিদীর্ণ করা হাহাকার নিবারিত হওয়ার নয়। আরব আমিরাতের আজমান শহর কেমন, কোথায় তাদের আছির থাকতো, তা তার পরিবার জানে না। ভাগ্যের সন্ধানে যারা সেসব জায়গায় যায়, তাদের খোঁজ রাখা অতো সোজা নয়; ভাগ্যের সন্ধানে যাওয়াও অতো সহজ না। বিউটিকে রমজান দালাল ঠিকই বলেছেন, ‘অতো সোজা না!’
ছয়
অজ্ঞাতনামার চিত্রনাট্যে যদি প্রধান পাত্র-পাত্রী খোঁজার চেষ্টা করি, তাহলে বলতে হয় যাকে নিয়ে কাহিনি তিনি মৃত আছির উদ্দিন পরামানিক-নায়ক। পাত্রী, আছিরের বেনামী গলাকাটা পাসপোর্টের (আ. ওহাব) স্ত্রী হয়ে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক বিউটি।
চলচ্চিত্রে বিউটিসহ বিদেশগামী দেহ সম্বল মানুষেরা বৈধ-অবৈধ বোঝে না। পাসপোর্ট তাদের কাছে শুধু শ্রমবাজারে প্রবেশের একটি কাগজ মাত্র, তা সে আস্ত ছবি সম্বলিত বা গলাকাটা যেরকমই হোক না কেনো। দেহ যেখানে পুঁজি; ব্যবসার রকমফের, অবস্থা, অবস্থান, স্থানান্তর ইত্যাদি প্রশ্ন সেখানে অবান্তর। তাই বিদেশ যাত্রা-ই বিউটির ধ্যানজ্ঞান। এই দেহ তিনি এখন বিদেশে খাটাতে চান। একবার বিদেশ গেলেই তার সব সমস্যার সমাধান। বিদেশ তার কাছে সোনালি স্বপ্নের দেশ। সেখানকার বাস্তবতা তার জানা নেই। তাই সবাই যেখানে গিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছে, তিনিও সেখানেই যাবেন। চলচ্চিত্রে বিউটির ভূমিকায় নিপুণ আক্তার ও পুলিশ কর্মকর্তা ফরহাদ চরিত্রে মোশারফ করিমের কথোপকথনে বিদেশ যাত্রার প্রকট অভিলাষের চিত্র স্পষ্ট হয়।
বিউটি গঞ্জে থাকেন, রোজগার করেন। সে টাকায় তার অভাব পূরণ হয় না। তিনি বিশ্বাস করেন, দেহ দিয়েই যখন রোজগার করতে হবে, তখন দেশে পড়ে থাকা কেনো? মিডলইস্টে গিয়ে বেশি বেশি টাকা রোজগার করাই ভালো। বিউটি তাকে বিদেশে পাঠানোর জন্য একজনকে বলেছিলেন। তিনি বিউটিকে জানিয়েছেন, মিডলইস্টে যেতে তিন লক্ষ টাকা লাগে। বিউটির পক্ষে অতো টাকা জোগাড় করা অসম্ভব। তার মাধ্যমেই রমজান দালালের সঙ্গে আলাপ হয় বিউটির। রমজান তাকে বিদেশ পাঠানোর আশ্বাস দিয়েছেন।
রমজান দালাল বিভিন্ন কলাকৌশলে বিদেশে লোক পাঠান, টাকা রোজগার করেন। তিনি আদম ব্যাপারী। টাকার বদলে তার যা আছে, সেই দেহ, রূপ, যৌবন দিয়ে রমজানের সঙ্গে লেনদেনে নেমেছেন বিউটি। বিউটির ঘর এখন রমজান ব্যাপারীর গঞ্জের অস্থায়ী ঠিকানা। তার বউও ব্যাপারটা জেনেছেন। তিনি অভিযোগ করে আসছেন, গঞ্জে রমজানের একটা পরিবার আছে। বিয়ে না করেও বিউটিকে তিনি বউয়ের মতো ব্যবহার করেনথাকেন, ঘুমান, খান; এমনকি টাকাও রাখেন। বিউটির কপাট বদ্ধ ঘরের দরজায় কড়া নাড়েন রমজান। দরজাটা যে কারো স্থায়ী না এবং তা যে তার জন্য বন্ধ হতে চলেছে, রমজান না বুঝলেও দর্শক তা বেশ আগেই জেনে যায়।
কারণ ঘরে তখন পুলিশের ছোটোবাবু ফরহাদ। সহকর্মীদেরকে না জানিয়ে, কাজে ফাঁকি দিয়ে, লোকচক্ষুর অন্তরালে বিউটির বাড়িতে ফরহাদ রসরঙ্গে মেতে উঠতে চান। বিউটি এ ব্যবসা বোঝেন। দেহ দিয়ে কাজ হাসিল করতে হয় কীভাবে, তা তাকে রপ্ত করতে হয়েছে। শিশুকাল থেকেই বিউটি পিতৃহারা। বিয়ের একবছরের মাথায় স্বামী মারা যায় তার। এক বাচ্চার জন্ম হতে না হতেই বিধবার জীবন শুরু হয় বিউটির। তার পোড়াকপাল। এখন সংসার-বাচ্চা সবই তার টাকায় চলে। বিউটি চাকরি করে দেখেছেন। কিন্তু স্বল্প বেতনে সংসার চলে না। তাই তিনি দেহ পুঁজির পসরা নিয়ে গঞ্জে নামেন। বড্ড সেয়ানা বিউটি নিজেকে ছুঁতে দেন কিন্তু ধরতে দেন না ফরহাদকে। ছুঁয়াছুঁয়ির নেশায় ফরহাদের রক্তে একটু একটু করে আগুন লাগতে থাকে।
বিউটি : আমার পুলিশ ক্লিয়ারেন্স কবে পামু?
ফরহাদ : রিপোর্ট তো তৈরি করেই রাখিছি, এখন ওসি সাহেব একটু সাইন করে দিলেই হয়।
বিউটি : সেইড্যা কবে? এই পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের জন্য তো রমজান ভাই আমার ভিসাডা আনতে পারতেছে না।
ফরহাদ : ওরে বাবারে, যেদিন ওসি সাহেবের মাথাডা ঠাণ্ডা থাকবে, সেদিন সাইন করাইয়া নেবো। তুমি চিন্তা কইরো নাতো।
বিউটি : এদেশ থেকে মনডাই উইড্যা গেছে। মিডলইস্টে যামু সেই চিন্তায় কোনো কাজকামই করতে পারতেছি না।
ফরহাদ : আরে মিডলইস্টে যাওয়ার দরকার কী? তুমি এহানে থাইক্যা যাও। একটা বিয়েশাদি করো, ঘরসংসার করো।
বিউটি : কে বিয়া করবো এই বিউটিরে? তুমি করবা? কেউ বিয়া করবো না এই বিউটিরে। সবাই আইবো ফুর্তি করতে।
ফরহাদ হাত ধরে বিউটির; দেহের টানে এতো টানাটানি, বিউটি নারী, তার বুঝতে কষ্ট হয় না। তবুও পুরুষের এই আলগা পিরিতকে তিনি কাজে লাগাতে চান।
ফরহাদ : আমি তোমারে ভালোবাসি।
বিউটি : বিউটি সব বোঝে। সে আর কারো ধার ধারবো না। সে নিজের পায়ে দাঁড়াইয়া মানুষের মতো বাঁচবো। সে আর কারো কাছে বাঁন্দা থাকবো না।
ফরহাদ : আমি সত্যি ভালোবাসি তোমারে।
বিউটি : ভালো যদি বাসো, বিউটির কাগজটা তাড়াতাড়ি রেডি কইরা দেও।
ভালোবাসার বাড়াবাড়ি দেখে ফরহাদকে ঘর থেকে বের করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন বিউটি। বলেন, ‘তোমার আজকে ডিউটি নাই?’ এমন সময় দরজায় কড়া নাড়েন রমজান দালাল (শহীদুজ্জামান সেলিম)। তিনি দৃশ্যপটে হাজির হন। বিউটির কারো বিরুদ্ধে কিছু বলার নেই। পরিস্থিতি সামাল দিয়ে নিজের কাজ হাসিল করতে চান। দুজন পুরুষের লড়াইয়ে তার কিছু যায় আসে না। তিনি অবলীলায় সত্যি-মিথ্যা মিশিয়ে গল্প বলেন। রেগেমেগে রমজান যখন চলে যেতে চান, তখন বলেন, ‘ভাত চড়াইছি, খাইয়া যাও।’ উত্তরে রমজান বলেন, ‘তুই খা।’
রাগ দেখান ঠিকই, কিন্তু সম্পর্কের ছেদ হয় না। বিনি সুতার বাঁধনে পুরুষ বাঁধার ফাঁদ পাতা বিউটির সহজাত। তার যে দেহ সম্বল। প্রেম-পিরিতের আদিম কৌশল শিখতে কোনো পিঠস্থান বা বিদ্যাপীঠে তার যাওয়া লাগেনি। মধ্যযুগে সামন্ত সমাজব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রাধান্যে নারী দেহকে যৌন ব্যবসায় ব্যবহার আজ পুঁজিবাদী সমাজে মুনাফা লাভের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। বিধবা বিউটিকে জীবনযুদ্ধ শিখতে হয়েছে। সেন আমলের প্রতিষ্ঠিত মন্দিরভিত্তিক সেবাদাসী নামের দেহব্যবসা, অথবা মুঘল, ব্রিটিশ ভারতে বাইজিখানা নয়; নিজ গৃহে কুঠির শিল্পের পাশাপাশি সামাজিক সম্পর্কের অন্তরালে রূপ যৌবন সৌন্দর্যের ব্যবহার করেন বিউটি। সবাই যে তার কাছে ফুর্তি করতে আসে, তিনি তা ভালো করেই জানেন। আর জানেন বলেই যাকে দিয়ে তার স্বার্থসিদ্ধি হবে কৌশলে তাকে দিয়ে তিনি সেই কাজ করিয়ে নেন।
বিউটির পরিবার থাক বা না থাক, চার জন মানুষের ভরণপোষণের দায়দায়িত্ব তাকে পালন করতে হয়। তিনি তার নানাকে টাকা পাঠান; আশ্বস্ত করেন তিনি বিদেশে যেতে পারলে তাদের আর কোনো সমস্যা থাকবে না। ছেলেটাকে আদর করার সময় তার মাতৃস্নেহের অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ তাকে ব্যবহার করবে কিন্তু নিরাপদ পেশা বা আশ্রয় দিবে না; এটা বিউটি মানতে নারাজ। দর্শকের মনে পড়ে ‘মনু সংহিতা’র (নবম অধ্যায় শ্লোক-৩) বিখ্যাত সেই শ্লোক-
পিতা রক্ষতি কৌমারে, ভর্ত্তা রক্ষতি যৌবনে।
রক্ষতি স্থবিরে পুত্রা স্ত্রী স্বাতন্ত্র মর্হতি।
শুধু ভারতীয় উপমহাদেশ কেনো, সারা পৃথিবীর পিতৃতান্ত্রিক তথা সুসংঘবদ্ধ রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে উপহাস করেছে প্রধান নারীচরিত্র। তবু কোনো এক সীমাবদ্ধতা শেষ পর্যন্ত তাকে সীমানার বেড়াজালে আটকে রাখে; কারো স্ত্রী বা মা হতে চাওয়ার বাসনা তাকে তাড়িত করে। বিধিলিপির অনিবার্যতা মেনে নিয়ে চলতে হয় তাকে। যে মুখে তিনি অন্ন জোগান, সে মুখের দুর্ব্যবহার তাকে সহ্য করতে হয়।
নানা : ছেলেটা খালি উৎপাত করে মা মা বইল্ল্যা।
বিউটি : রঞ্জু স্কুলে যায়?
নানা : যায়, তয় ঘুমনের সময় মা মা বলে বইল্ল্যা রোজই কাঁন্দে।
বিউটি : ঠিক হইয়্যা যাবো।
নানা : জামাইটা মইরা গিয়াই যতো ঝামেলা বাঁধাইলো। ওই রকম একটা তরতাজা পোলা ...
বিউটি : বাদ দেও তো নানা।
নানা : আমি বাদ দিলে কী অইবো? তোর জন্মের পর দিনই তোর বাপটা মইরা গ্যালো। বিয়া দিলাম, বছর না ঘুরতেই স্বামীটা গ্যালো। এর পরেও তুই কইতে চাস, তুই পোড়াকপাইল্ল্যা না!
এই রাষ্ট্রের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাকে কীভাবে বেঁধেছে তা স্পষ্ট হয়। তাকে ভাত দেওয়ার কেউ নেই। অথচ বিধিলিপির ভবিতব্য নিয়ে ‘মেয়ে মানুষ’ হয়ে জন্মানোর খোটা দিচ্ছে সবাই। হায়রে বিধাতা! আধুনিক রাষ্ট্রযন্ত্রের অসাড় মানবিকতার মতো বিউটিও বড়ো অসহায়, ক্ষণে ক্ষণে ‘আত্মহত্যা’ করে বসেন। ভালোর জন্য সবাই তার কাছে মিনতি করলেও কারো ভালো তিনি করেন কি না, বোঝা দায়। তাই বিউটি বলেন, ‘হইছে অহন যাও।’ ছেলেসহ নানাকে একপ্রকার তাড়িয়েই দেন তিনি।
বিউটি ও নানার কথোপকথনের পর ফরহাদের সঙ্গের কিছুসময় বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এখানে খানিকটা ফ্রয়েড এসে থমকে দাঁড়ায়। নারীর দখল নিয়ে দুই পুরুষের দ্বন্দ্ব। রমজান দালালের বর্তমান দুর্দশার কথা সবিস্তার সরস বর্ণনা করছেন ফরহাদ। কারণ তিনি তার প্রেমাঙ্গনে প্রতিদ্বন্দ্বী।
ফরহাদ : আরে বেটা টাউট, লোক পাঠায়েছে বিদেশে গলাকাটা পাসপোর্টে। সে লোক গেছে আবার মইরে। দালাল শালা নিজেই ধরা খায়েছে। তার চেহারা যদি তুমি দ্যাখতা। সে তো আমারে দেখে নাই, মনে হয় ভূত দেখিছে।
বিউটি : তুমি আবার তার সাথে খারাপ ব্যবহার করো নাই তো?
ফরহাদ : সে আমারে শুয়োরের বাচ্চা বলে গালি দিলো। ভরা বাজারে আমারে দাবড়াইলো। আর আমি তারে ধইর্যা আদর করবো, না?
বিউটি : গায়ে হাত দিছো?
ফরহাদ : তার জন্যি এতো দরদ তোমার?
বিউটি : দরদ না, স্বার্থ। সে আমারে কইছে বিদেশ পাঠায় দিবো। একবার বিদেশ যাইতে পারলেই কপাল খুইল্যা যাইবো। দেশে আইস্যা তখন সুখে শান্তিতে জীবন কাটাইমু।
ফরহাদ : আরে ধুর এই বিদেশ-ফিদেশ বাদ দাও তো।
বিউটি : বিদেশ বাদ দেওয়ন যাইবো না। চার-চারটা প্যাট আমারে পালতে অয়।
ফরহাদ অবশেষে বিউটির পুলিশ ক্লিয়ারেন্স নিয়ে হাজির হন। আছির উদ্দিনের মৃত্যুর খবর বিউটিকে ইতোমধ্যে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। কিন্তু এখন তিনি আর বিদেশ যাবেন না। ফরহাদের সামনেই পুলিশ ক্লিয়ারেন্স ছিঁড়ে ফেলেন তিনি। তাকে বলে দেন, তার ভাগ্য খারাপ তাই স্বামী ও আছির উদ্দিনের এই মৃত্যু। তিনি আর কারো মৃত্যুর কারণ হবেন না। তাই কেউ তাকে বিয়ে করুক, তা যেমন তিনি চান না, তেমনই তিনি কারো বউ হয়ে বিদেশ যেতেও চান না।
সাত
আমাদের সমাজ বাস্তবতায় পুলিশ দেখে আমরা অভ্যস্ত। সেখানে পুলিশ ও মানুষের পার্থক্য সর্বজনবিদিত। পুলিশকে সাধারণ মানুষ যেভাবে দেখে বা পুলিশ নিজেদেরকে যেভাবে দেখে, তার ভিন্নমাত্রার জীবন্ত চিত্র ফুটে উঠেছে অজ্ঞাতনামায়। রাজবাড়ী জেলার কালুখালি থানার ওসি প্রমাণ করেছেন, পুলিশ ও মানুষ আয়নায় নিজের ছবি দেখে ভয় পায় না। টাকাপয়সার কথা বাদ দিয়েও বলা যায়, পান-বিড়ি-চা-সিগারেট আদায় করা, কোনো বাড়ি গিয়ে ভরপেট খেয়ে আসা-পূর্বপুরুষ ব্রিটিশ পুলিশের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে তাদের এগুলো পাওয়া। ওসি তার নিজের কথা নিজেই বলে ফেলেন, ‘পুলিশে চাকরি করি, মাস গেলে বেতন পাই। যা পাই তাতে চলে না, তাই একটু এদিক-সেদিক করি।’ ওসি কুদ্দুস রাগ হলেই তার সহকর্মীদেরকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘এই তোদেরকে পুলিশে নিছে কে?’ ফরহাদ উত্তর করেন, ‘ঘুষ-টুস দিয়ে ঢুকেছে ...।’ এদিকে রমজান দালাল নিজেকে ভালো মানুষ দাবি করেন। ওসি কুদ্দুস বা ফরহাদের মতো পুলিশ বাস্তবে আমরা পাবো কি না জানি না, হয়তো সেই কারণেই পুলিশকে এই কাহিনির পার্শ্বনায়ক আর রমজান দালালকে খলনায়ক মনে হয়। এ দুইয়ের বিরোধ ও ঐক্য ক্ষমতার রাজনীতির মিলন ও দ্বন্দ্বকে সামনে এনে আমাদেরকে শক্তিমানদের আঁতাতের চরিত্র স্মরণ করিয়ে দেয়।
প্রায় দেড়শো বছর আগে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়ে (১৮৬৩-৬৫) যখন দেশপ্রেমের পাঠ গ্রহণ করলেন, তখন বুঝলেন, ‘হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে’; সত্যিকারের ধনদৌলত লুকিয়ে আছে মাতৃকোলে মাতৃভূমির মায়ায়। ‘মাতৃকোষে রতনের রাজি।’ আজকের বাংলাদেশ কবির এই অনুভূতিকে ধারণ করে বলেই আজকের এই অজ্ঞাতনামা। মধু কবির কবিতা মনে পড়ে যায়-
হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন
তা সবে (অবোধ আমি) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
লেখক : ফারুক আলম, সাহিত্যিক ও ছড়াকার। তিনি খুলনার একটি কলেজে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য পড়ান। তার প্রকাশিত ছড়ার বই ‘গোলাপ-কাঁটা’।
falamsmc@gmail.com
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন