Magic Lanthon

               

মফিজ ইমাম মিলন

প্রকাশিত ০৯ নভেম্বর ২০২৫ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

ধারাবাহিক পাঠ : সিনেমা দেখার গল্প

মফিজ ইমাম মিলন


কিস্তি ১


সিনেমা দেখার স্মৃতি নিয়ে লিখতে বলা হয়েছে। যে স্মৃতি একান্তই আমার। যদিও কোনো কিছুই একান্ত নিজের বলে থাকে না; সেখানে নানা জন, নানা সময়ে উঁকি মারে। তার পরও না চাইলেও তাকে আমি আগলে রেখেছি, আপন করে কিংবা রাখতে হয়েছে। দৃশ্যত জন্মের আগের কোনো স্মৃতি আমার নেই। মৃত্যুর পরে কী হবে, সে ব্যাপারেও নিশ্চিত কোনো তথ্য অন্তত আমার জানা নেই। আছে শুধু বিশ্বাস, ভরসা আর পরম তৃপ্তি লাভের প্রবল আকাক্সক্ষা। সেই আকাক্সক্ষা নিয়েই স্মৃতি আগলে বেঁচে থাকা।


সিনেমা দেখার সঙ্গে আমার মায়ের মধুর স্মৃতি জড়িয়ে থাকায় এ ব্যাপারে কলম চালানো কষ্টের। তবে সুখ ও আনন্দ স্মৃতি হচ্ছে, মায়ের বদৌলতে আমি সম্পূর্ণ বিনা খাই-খরচে হারানো সুর, হাসপাতাল, পথে হলো দেরি, শিল্পী, মায়া মৃগ-এমন অনেক ভারতীয় বাংলা সিনেমা দেখার সুযোগ পেয়েছি! কোলে চড়ে যাওয়ার স্মৃতি মনে নেই, তবে রিকশার পাদানিতে হাঁটু গেড়ে বসে যাওয়া, মা’র সঙ্গে দোতলায় নারীদের নির্দিষ্ট জায়গায় বসে সিনেমা দেখার কিছু কিছু স্মৃতি মনে আছে। চেকার বা সুপারভাইজার ডান হাতে টর্চ খাড়া করে কাছে এসে যখন জিজ্ঞেস করতেন- ‘টিকেট ... এই ছেলে কার সঙ্গে?’ মা তখন তেড়ে উঠতেন-‘ওর টিকেট লাগবে না, ও ছোটো।’ মা তাকে অপছন্দ করলেও আমার কিন্তু খুব ভালো লাগতো। কী ক্ষমতা, কী তার দাপট! টর্চ কয়েকবার নাড়াচাড়া করে আলো ফেলে ধমকে উঠতেন-‘টিকেট, টিকেট দেখাও।’


সেই থেকে মনে আশা ছিলো বড়ো হয়ে সিনেমাহলের টিকেট চেকার হবো। সব সিনেমা বিনা পয়সায় দেখবো, আর দাপট দেখিয়ে টিকেট চেক করবো। তা অবশ্য হওয়া হয়ে ওঠেনি। পরদিন অঙ্ক ক্লাসে দু’হাত পাত একসঙ্গে, এমন হুঙ্কার শুনবার সঙ্গে সঙ্গে সিনেমা দেখার, চেকার হওয়ার সব সাধ-আহ্লাদ উবে যেতো।


সেই ছোটো মানুষ আজ কতো বয়সের স্মৃতি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বর্তমান সমাজে সেই মানুষ অচল, সমস্যা সমাধানে অপারগ। যার বল নেই, দল নেই, হোন্ডা-গুণ্ডা নেই, এককথায় যাকে বলা হয় বাতিল মাল। তাদেরকেই তো প্রবীণ বয়সে স্মৃতিচারণ করতে বলা হয়।


ফরিদপুর শহরের যে সিনেমাহলে আমরা সিনেমা দেখতাম, তার আদি নাম ‘ফরিদপুর টাউন থিয়েটার’। এর বর্তমান বয়স একশো ৪৩ বছর। তৎকালীন হিন্দু জমিদার আর উচ্চবংশীয় মুসলমানরা এটি তৈরি করেছিলো। মঞ্চটি অনেক বড়ো হওয়ায় সেখানে নাটক-থিয়েটার হতো, আবার সিনেমা প্রদর্শনের আয়োজনও ছিলো। মহেন্দ্র গুপ্ত, সলিল চৌধুরী, আব্দুল কাসেম, রহিম উদ্দিনরা এ মঞ্চে অভিনয়-সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। ফরিদপুরে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে কিরণবালা বোস-এর নামটি জড়িয়ে রয়েছে। তিনি ছিলেন বিখ্যাত রায় বাহাদুর সতীশ মজুমদারের মেয়ে। খুব অল্পবয়সে বিধবা হয়ে রাজেন্দ্র কলেজের কাছে তার বাবার বাড়িতে থাকতেন। এবং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। এমনকি বাবার জমিদারির দেখভালের দায়িত্বও ছিলো তার ওপর।


‘অরোরা টকিজ’ নামে ৫০-এর দশকে আরেকটি সিনেমাহল চালু হয়। সেই কালে সিনেমাহলকে ‘টকিঘর’ আবার ‘বায়োস্কোপ’ দেখানোর ঘরও বলতো অনেকে। পরে আরেক জমিদার পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ময়েজ মঞ্জিলের লাল মিয়া সাহেবের প্রয়াত মেয়ের স্মৃতি রক্ষায় সিনেমাহলটির নামকরণ করা হয় ‘মায়া’। এর পর হাতবদল হয়ে দীর্ঘদিন ‘ছায়াবাণী’ সিনেমাহল নামে এটিই ছিলো ফরিদপুর শহরের মানুষের চিত্তবিনোদনের একমাত্র ভরসাস্থল। ‘বনলতা’ নামে পরবর্তী সময়ে আরো একটি সিনেমাহল চালু হয়। বৃষ্টি নামলে পৌর সুপার মার্কেটের কচুরি ডোবার পানি উপচে সেই সিনেমাহলের মধ্যে ঢুকতো। সামনের সারির দর্শকের অনেকেই সিনেমাহলের মধ্যে  প্রস্রাব করতো সেখানে দাঁড়িয়ে-ই। সেই আওয়াজ পিছনের রিয়ার স্টল থেকে শোনা যেতো। কেউ কেউ আমাদের অঞ্চলের স্থানীয় ভাষায় চিৎকার দিতো-‘ওই শালারা, পানির মধ্যে মুতশ ক্যা।’ ওপারের টিন চুঁইয়ে দেয়ালের গা বেয়ে নিচে চলে আসতো পানি। দর্শকের সব রাগ-ক্ষোভ-কষ্ট অশ্লীল গালি হয়ে বের হতো ম্যানেজারের উদ্দেশে। ম্যানেজার ভুলু বাবু ছিলেন অত্যন্ত স্মার্ট ও সুবেশধারী ভদ্রলোক। কিন্তু তাকে গালি শুনতেই হতো। ট্রেনে বিদ্যুৎ চলে গেলেও যাত্রীরা আচমকা তাকেই গালি দিতো- ‘ওই ভুলু কারেন্ট দে।’ শহরের বিদ্যুৎ চলে গেছে, সে দোষেরও অংশীদার তাকেই করা হতো প্রায়ই!


আমার প্রথম দেখা সিনেমা কোনটি, তার নাম স্পষ্ট মনে নেই। তবে কয়েকটি স্মৃতি আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় ছোটোবেলায় সিনেমা দেখার গল্প। একদিন রিকশা থেকে নামবার সঙ্গেই হলের সামনে দেখতে পেলাম কটকটি, বাদাম আর খেজুরের রস বিক্রি হচ্ছে। ই-রে আমি রস খাবো! দুই পা ঝাড়া দিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়ালাম। ছোটোকালে কথা বলার শুরুতেই নাকি আমি ‘ই-রে’ শব্দটা ব্যবহার করতাম। ই-রে খাবো না। ই-রে নিবো না। ই-রে ওড়না নিবো। ই-রে কোলে চড়বো। ই-রে আমি সিনেমা দেখবো-এমন আর কি।


সিনেমাহলে পৌঁছতে দেরি হয়ে গেছে; বাইরের গান বন্ধ হয়ে ভিতরে গান শুরু হয়েছে। সেকালে সিনেমা শো শুরুর আগে মাইকে বাংলা-উর্দু-হিন্দি গান বাজানো হতো। কখনো কখনো যে সিনেমা চলছে, সেই সিনেমার গানও বাজানো হতো। মাইকের এই গানের আওয়াজের সঙ্গে শহরের অনেক লোক সময় নির্ণয় করতো। বিশেষ করে রিকশাওয়ালারা ভাড়ার আশায় কান খাড়া রাখতো; কখন শো ভাঙবে। হোটেল কর্মচারীরাও নাইট-শো শুরুর পর ঝাপ বন্ধ করতো। সেসময় পুলিশ লাইন, জেলখানা, ফায়ার সার্ভিস, ট্রেজারিতে এক ঘণ্টা পর পর ঘণ্টা বাজানো হতো। তখন এমন দালানকোঠায় ঠাসা শহর না হওয়ায়, ঘণ্টার আওয়াজ বহু দূর থেকে মানুষ শুনতে পেতো। রেল স্টেশনের ট্রেন ছাড়ার ঘণ্টাও অনেক দূর যেতো।


যাহোক সেদিন সিনেমাহলে ঢোকার মুখে রস না খেতে পেয়ে সারাক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছি। পাশের সিটের এক খালামণি বোধ করি বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুমি কাঁদো কেনো, কী চাও?’ আমি তখন উচ্চস্বরে কেঁদে উঠেছিলাম- ই-রে আমি রস খাবো। মা ততোক্ষণে আমার হাতে-মুখে খামচি বসিয়ে এমন একটা বকা দিয়েছিলেন, যা শুনলে আব্বা খুবই কষ্ট পেতেন। আমার সেদিনের সে চিৎকারে সিনেমাহলের নিচতলা, থার্ড ক্লাসের দর্শকের কেউ কেউ উচ্চস্বরে বলে উঠেছিলো-‘কার পোলাপান কাঁন্দে, ওরে দুধ দেও, থামাও।’ হঠাৎ বিরতির সঙ্কেত বেজে আলো জ্বলে উঠায় মুহূর্তে বদলে গেলো সম্পূর্ণ পরিস্থিতি। বাদাম, চানাচুর, সোডা ফান্টার বোতলের শব্দে সিনেমাহলে ভিন্ন এক আমেজ সৃষ্টি হলো। আমার রস খাওয়ার সাধ তখনো মেটেনি। যে মাসি সিনেমাহলে ঢুকবার সময় টিকেট অর্ধেক ছিঁড়ে রেখে দিয়েছিলেন, মা তার হাতে আমাকে সোপর্দ করলেন-‘যাও রস খেয়ে আসো।’


রস খাওয়ার আনন্দে মাসির আগে আগে চিকন সিঁড়ির কার্নিশ ধরে দ্রুত নেমে এসেছিলাম। দুর্ভাগ্য আমার রসওয়ালাকে পাওয়া গেলো না; রস খাওয়াও আর হলো না। রস না খাওয়ার যে অতৃপ্তি, তার জন্য এখনো মাঝেমধ্যে মন আনচান করে ওঠে। সেই থেকেই হয়তো অনেক ক্ষেত্রে আমার রসবোধের অভাব। সেদিন রস খেলে বোধ করি এ বয়সে এমন নীরস জীবন কাটাতে হতো না।


সিনেমা দেখার আরেকটি গল্প মনে আছে। সেটি খুবই কষ্ট ও ধিক্কারের। পর্দায় ‘সমাপ্ত’ লেখা ভেসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পুরুষ দর্শকের চিৎকার, চিল্লাচিল্লি; কেউ কেউ বেঞ্চি-চেয়ার উপরে তুলে ছুড়ে মারতে লাগলো। নারী দর্শকেরও চোখে জল। অতো কিছু বুঝবার বয়স তখনো আমার হয়নি। সবার মুখে একই কথা ‘হ্যাষে (শেষে) মিল নাই।’ পরে যেটুকু বুঝেছিলাম তা হচ্ছে, এ সিনেমায় নায়ক-নায়িকার মিল হয়নি। নায়িকার সঙ্গে মিলন না হওয়ার সম্পূর্ণ খেসারত দিতে হলো সিনেমাহলের ম্যানেজার থেকে শুরু করে অপারেটর-চেকার-গেটম্যানকেও। শো শেষে রাস্তার ওপরে গিয়েও দর্শকের প্রশ্ন, কী সিনেমা বানাইলো যে হ্যাষে নায়ক-নায়িকার মিল দিলো না!


১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে পাক-ভারত যুদ্ধ বাঁধে। আমরা পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী। যুদ্ধ শুরুর ১৭ দিন পরেই তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধবাজি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ক্ষতি হয় সিনেমা দর্শকের। পাকিস্তান সরকার এ দেশে ভারতীয় সিনেমা আসা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে এখানকার চলচ্চিত্রনির্মাতারা সিনেমা নির্মাণে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।


(চলবে)


লেখক : মফিজ ইমাম মিলন, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক। তিনি ফরিদপুর থেকে উঠোন নামে একটি সৃজনশীল সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেন।


uthon.faridpur@gmail.com

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন