Magic Lanthon

               

সুশান্ত সিনহা

প্রকাশিত ২৬ অক্টোবর ২০২৫ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

প্রসঙ্গ সম্প্রচার সাংবাদিকতা : অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বিশ্লেষণি পাঠ

সুশান্ত সিনহা


ভূমিকা  

প্রতিদিন-প্রতিক্ষণ দেশে ও বিদেশের ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে দর্শকশ্রোতার কাছে তুলে ধরার সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হলো সম্প্রচার মাধ্যম বা টেলিভিশন চ্যানেল। আর স্থান, কাল ও গুরুত্ব ভেদে এসব সংবাদ প্রচার ও উপস্থাপনে রয়েছে আলাদা আলাদা ধরন বা ফরম্যাট। অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বের খবরটির মূল কথাগুলো ২৫৩০ সেকেন্ডের মধ্যে সংবাদ উপস্থাপক জানিয়ে দেন, যা আউট অব ভিশন বা উভ নামে পরিচিত। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সভার বক্তা ও দায়িত্বশীল ব্যক্তির বক্তব্যের চুম্বক অংশটুকু সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়; যাকে উভ শট্ বলা হয়। এ দুই ক্ষেত্রে প্রতিবেদকের খুব বেশি মুন্সিয়ানা দেখানোর সুযোগ থাকে না। প্রতিবেদকের মেধা-মনন আর দক্ষতা ফুটে ওঠে যে প্রতিবেদন বা স্টোরিতে, টেলিভিশনের ভাষায় তা প্যাকেজ নামে পরিচিত।

সচরাচর দৈনন্দিন ঘটনা ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনা-অনুষ্ঠানের সংবাদ গুরুত্ব বুঝে প্যাকেজ বা স্টোরি তৈরি হয়। এ ধরনের প্রতিবেদনে প্রতিবেদককে অনেকাংশে নির্ভর করতে হয় সভা-অনুষ্ঠানের বক্তার ওপর। মোটাদাগে একই ধরনের কথাবার্তা ও তথ্য সমৃদ্ধ প্রতিবেদন কমবেশি সব চ্যানেলে সম্প্রচার হয়। এখানে বেশ খানিকটা দক্ষতা-যোগ্যতার পরীক্ষা থাকলেও বিষয়ের গভীরে যাওয়ার সুযোগ থাকে না প্রতিবেদকের। এর বাইরে কিছু না কিছু বিশেষ প্রতিবেদন বা প্যাকেজ থাকে প্রতিদিনের সংবাদে। পত্রিকার মতো বাই লাইন স্টোরির (প্রতিবেদকের নাম ব্যবহার করে যে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়) আদলে টেলিভিশন সাংবাদিকরা চেষ্টা করে কোনো একটি বিষয়ের খানিকটা গভীরে ঢুকে এ ধরনের বিশেষ প্রতিবেদন তৈরির। আর এই বিশেষ প্যাকেজই বড়ো হাতিয়ার হিসেবে অনেক চ্যানেলের ভিড়ে নিজেদের আলাদাভাবে উপস্থাপন করে।

দিনের ঘটনাকেন্দ্রিক সাধারণ ও বিশেষ প্যাকেজের বাইরেও রয়েছে ইনডেপথ বা ডেপথ রিপোর্টিং। যেখানে বিশেষ প্যাকেজের চেয়ে খানিকটা ঘটনার গভীরে গিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। আর ইনডেফথ রিপোর্টিংয়ের চেয়ে লম্বা সময় দিয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান চালিয়ে করা হয় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। ইনডেপথ ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মধ্যে সাযুজ্য রয়েছে। চ্যানেলে সম্প্রচারিত প্রতিবেদনগুলো পিরামিড আকারে সাজালে চূড়ায় থাকবে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। এরপরের ধাপে ইনডেপথ, তারপরে বিশেষ এবং সব নীচে দৈনন্দিন ঘটনানির্ভর প্যাকেজ। মাঝে মাঝে কোনো কোনো টেলিভিশনে বিশেষ প্রতিবেদনকেঅনুসন্ধানী প্রতিবেদন হিসেবে উল্লেখ করা হয়। যা কাক্সিক্ষত নয়, কারণ বিশেষের সঙ্গে অনুসন্ধানের পার্থক্য মৌলিক এবং দূরত্ব যোজন যোজন। মনে রাখতে হবে, সব অনুসন্ধানী প্রতিবেদনই বিশেষ। কিন্তু বিশেষ প্রতিবেদন কখনো অনুসন্ধানী হয় না। উপস্থাপনের ধরন এক হলেও দুটোর কাজ হয় দুই উপায়ে। সম্প্রচার সাংবাদিকতা বিষয়ক ধারাবাহিক আলোচনায় এবার থাকছে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন।

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন কী?

সাধারণভাবে একজন প্রতিবেদক নিজে সরাসরি কিছু সৃষ্টি করে না। সমাজ-রাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং অন্যদের সৃষ্ট বা তুলে ধরা বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন তথ্য-উপাত্ত সাজিয়ে-গুছিয়ে সাধারণ মানুষের বোধগম্য উপস্থাপন করে একজন প্রতিবেদক। অনেকটা মালা গাঁথার মতো, এ কাজে কে কতোটা মনোযোগ দিচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে প্রতিবেদনের গাঁথুনি কতোটা শক্তিশালী হবে এবং তা কতোটা উজ্জ্বলতা ছড়াবে। এ কারণেই পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা সৃষ্টিশীল। যেখানে সংবাদকর্মীর মন সবসময়ের জন্য অনুসন্ধিৎসু থাকে নতুন কিছু খুঁজে পেতে; সদা আবিষ্কারের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকার মতো ঘুরেফিরে নতুন নতুন সংবাদ তুলে আনতে। অনেকটা সাগর বা স্থলভাগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের মতো, সংবাদকর্মীরা প্রতিনিয়ত অনুসন্ধান করে থাকে। কূপ খননকারীরা যেমন একের পর এক খনন করে অনুসন্ধান চালিয়ে যায়।

একইভাবে একটি সংবাদের গভীরে ঢুকে অন্তর্নিহিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো উদ্ঘাটনের প্রয়োজন পড়ে। প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্য-সূত্র ধরে, ঘটনার নেপথ্যের হোতা বা বিষয়গুলোর আদি-অন্ত তুলে ধরতে যে প্রতিবেদন করা হয় তাই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ধরাবাঁধা কোনো সংজ্ঞা নেই। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হচ্ছে তদন্তের তদন্ত, অর্থাৎ যেদিকে আলো ফেলেনি, খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেনি তদন্ত কর্মকর্তা বা সংশ্লিষ্ট দপ্তর, সেখানে অনুসন্ধান চালিয়ে প্রকৃত সত্য তথ্য সবার কাছে তুলে ধরে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। সহজ কথায়, তথ্যের গভীর থেকে গভীরে খনন করতে করতে লুক্কায়িত সত্যের উদ্ঘাটন করা। যা সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে দর্শকশ্রোতার পাশে দাঁড়ানোর সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র।

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন কম কেনো?

মানুষ, তথা সমাজের প্রতি দায়বোধ ও ন্যায়বিচারের স্বার্থেই সত্যানুসন্ধান জরুরি। আর অপ্রিয় সত্য তুলে ধরার কারণে অনেক সময় রাজনৈতিক ক্ষমতাধর ও পেশিশক্তির মুখোশ উম্মোচন হয়। এতে তাদের রোষের শিকার হতে হয়। এমনকি প্রভাবশালীদের হামলা-নির্যাতনের পাশাপাশি শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সংবাদ সম্প্রচারে বাধা দেওয়ার শঙ্কাও থাকে। থ্যাঙ্কলেস বা ধন্যবাদহীন কাজের আনন্দটা হলো অনেকটা শিল্পীর সৃষ্টির আনন্দের মতো। একটা একটা করে রঙ-তুলির আঁচড়ে যেভাবে একটি ছবি মূর্ত হয়ে ওঠে, ঠিক  তেমনই ছোটো ছোটো প্রতিটি ধাপ খতিয়ে দেখতে দেখতে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি পূর্ণতা পায়। যা সাংবাদিককে প্রেরণা-শক্তি জোগায় আরো বেশি অনুসন্ধানী কাজের।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশকিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন আলোচিত হয়েছে, বিচারও পেয়েছে ভুক্তভোগীরা। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে বিনা বিচারে কারাগারে বছরের পর বছর আটক কয়েকজন জামিনে মুক্তি পাওয়ার প্রতিদেনটি এমনই একটি। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা, প্রতিপক্ষের প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে অপরাধ প্রমাণের আগেই যাদেরকে ১০১২ বছর পর্যন্ত সাজা খাটতে হয়েছে। আইনের দৃষ্টিতে তা সম্পূর্ণভাবে ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। বিষয়টি অনেকের জানা থাকলেও এভাবেই চলছিলো, কিছুই করার ছিলো না ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারগুলোর। এ নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন সম্প্রচারের পর বিষয়টি উচ্চ আদালতের নজরে আসে এবং কারাবন্দি জীবনের অবসানের মাধ্যমে প্রাথমিক ন্যায়বিচার পায় সেই মানুষগুলো। খুঁজতে খুঁজতে ঘটনার গভীরে গিয়ে সত্য উদ্ঘাটনকারী এই প্রতিবেদনটি মুহূর্তে জাতীয় বিষয়ে পরিণত হয় এবং আদালত তার রায়ে ওই অনুসন্ধানী প্রতিবেদকের নাম উল্লেখ করেছে। যা একজন সাংবাদিকের কাছে অনেক বড়ো সম্মানের।

একটি ঘটনার ইতিবৃত্ত তুলে ধরতে অনেক প্রশ্নের উত্তর তুলে আনতে হয়। অনুসন্ধানের ফোকাস বা মূল বিষয় ঠিক রেখে সবগুলো তথ্য-উপাত্তকে গাঁথতে হয় এক সুতোয়। আর বহুমুখী সব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও সত্যতা যাচাই-বাছাই করতে অনেক স্থানে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে। এমনও হতে পারে সংঘটিত ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি বা ঘটনাস্থল দূরের কোনো জেলায়; একইভাবে একটি তথ্য যাচাই করতে গিয়ে দুতিনটি অফিসে পর্যন্ত খোঁজ করতে হয়। সঙ্গত কারণেই এ কাজে দুএকদিন নয়, সপ্তাহ নয়, পুরো মাস কিংবা তার চেয়ে বেশি সময় লাগতে পারে। সাগর মন্থন করে অমৃত তুলে আনার মতো সর্বোচ্চ ভিতরে গিয়ে ঘটনার আদ্যপ্রান্ত সবকিছু তুলে ধরা যায় অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। আর এ ধরনের প্রতিবেদন তৈরির মাধ্যমেই সবচেয়ে সৃষ্টিশীল কাজটি করতে পারে একজন সংবাদকর্মী। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের ব্যবহারের সর্বোত্তম ক্ষেত্রও এটি।

আগের তুলনায় অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের সংখ্যা বহুগুণে বেড়েছে তা বলাই বাহুল্য। শুধু সংখ্যায় নয়, গুণে-মানেও তা বেশ এগিয়েছে। বিশেষ করে প্রচলিত দুআড়াই মিনিটের প্রতিবেদনের বৃত্ত ভেঙে ১০ মিনিটেরও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন সম্প্রচার করছে দুএকটি টেলিভিশন চ্যানেল। যার অনেকগুলো এতোটাই আলোচিত হয়েছে যে, পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো বাধ্য হয়েছে, ওই বিষয় খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে। তবে টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা বৃদ্ধির বিবেচনায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার হার এখনো অনেক কম। আমাদের মতো জনবহুল, ঘটনাবহুল দেশে যেভাবে দুর্নীতি-অনিয়ম ছড়িয়ে আছে, সেই তুলনায় অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের সংখ্যা এখনো নগণ্য। মোটাদাগে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের সংখ্যা কম হওয়ার কারণ তিনটিক. প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা; খ. প্রতিবেদকের আগ্রহের অভাব এবং গ. মাঠের সমস্যা। সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রথম দুটি একে অন্যের সঙ্গে আন্তঃসম্পর্কিত; অনেকটা ভাইস-ভার্সার মতো।

ক. প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা

বর্তমানের বাংলাদেশে বিজ্ঞাপন বাজারের সঙ্গে টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যার ভারসাম্য নেই বললেই চলে। ফলে ভীষণ প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে যথাসম্ভব খরচ কমিয়ে ভালো কিছুর চেষ্টা থাকে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর। উল্টো দিকে, বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ও সিন্ডিকেটের অভিযোগও রয়েছে, সঙ্গে পেশাদারিত্বের অভাব তো রয়েছেই। এসব কারণে ভালো সংবাদ, অনুষ্ঠানসহ দর্শক চাহিদা পূরণে  যোগ্যতা থাকলেও বিজ্ঞাপন পাওয়া যাবে বিষয়টা মোটেও এমন নয়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ভারতীয় চ্যানেলে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনের আগ্রাসন। এই পরিস্থিতির মধ্যে রশি টানাটানিতে সবার উদ্দেশ্য থাকে কম খরচে একটা কিছু করার।

অন্যদিকে সম্প্রচার সাংবাদিকতায় প্রতিবেদকের সঙ্গে ক্যামেরাপার্সন এবং গাড়ি চালকের অংশগ্রহণ ছাড়া চলা সম্ভব হয় না। সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে শুধু প্রতিবেদক অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়লেই হয়। কিন্তু টেলিভিশন যেহেতু ভিজ্যুয়াল মাধ্যম, তাই এখানে ছবির গুরুত্ব অনেক বেশি। অনুসন্ধানে কেবল কোনো নথি পেলেই চলে না, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য সংগ্রহ করতে গেলে ক্যামেরাপার্সনের প্রয়োজন হয়। এসব কারণে কয়েকদিন সময় দিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করার মতো আগ্রহ টেলিভিশন প্রতিষ্ঠানগুলোর কম থাকে। আর শুধু তো সময় নয়, ঘটনার গভীরে অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রতিবেদকসহ তিনজনের খরচের হিসাবটাও মাথায় রাখতে হয় বার্তাকক্ষের কর্তাদের। সঙ্গে প্রতিদিনের বুলেটিন চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রতিবেদনের চাহিদা তো রয়েছেই। এসব কারণে কোনো একজন প্রতিবেদককে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য লম্বা সময় ছেড়ে দিয়ে রাখা সম্ভব হয় না।

এসবের পাশাপাশি এখনো টেলিভিশন প্রতিষ্ঠানগুলো গতানুগতিক চিন্তার বৃত্ত ভেঙে বের হতে পারেনি। ফলে খুব কম টেলিভিশন চ্যানেল আছে যেখানে চারপাঁচ মিনিটের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন সম্প্রচারে আগ্রহ আছে। যেহেতু সংবাদ বুলেটিনে কুল রেখে মান ঠিক রাখার চেষ্টা চলে, তাই সংশ্লিষ্ট সম্পাদকরাও বড়ো প্রতিবেদন সংকুলান করতে চান কম। কখনো কখনো বিকল্প হিসেবে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি ভাগ করে দুতিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এতে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের গুরুত্ব কিছুটা হলেও কমে যায়। কারণ প্রতিবেদকের প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত জেনেশুনে তাকে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে বলা হলে আরো ভালো কিছু করার সুযোগ তৈরি হয়। প্রতিবেদকের যতোটুকু অনুসন্ধানে ঘাটতি ছিলো বা আছে সেটা দূর করে পরিপূর্ণ একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পাওয়া যেতে পারে। ফলে বার্তাকক্ষের লোকজনের এমন অনীহার কারণে অনেক সময় সম্ভাবনা অঙ্কুরে নষ্ট হয়। আবার কোনো একটি বিষয়ে অনুসন্ধান শুরুর পর তাদের বোঝাতে হয় কী আছে আর কী নেই। কেউ কেউ বলেই বসে, কী এমন কাজ করছে এতো দিন ধরে! যেহেতু টেলিভিশন টিম ওয়ার্ক, তাই অনুসন্ধান চলাকালে প্রতিবেদককে প্রয়োজনীয় সবগুলো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সহায়তা করার সুযোগ আছে বার্তাকক্ষের।

খ. প্রতিবেদকের আগ্রহের অভাব

আর পাঁচটা মানুষের মতো সাদা চোখে একজন প্রতিবেদক সবকিছু বিচার করে না। কিছুটা খুঁতখুঁতে স্বভাবে ঘটনার বিশদ জানতে চেষ্টা করাই হলো তার প্রাথমিক কর্তব্য। হয়তো বিষয়টি বড়ো কোনো সংবাদ হবে না, কিন্তু পুরো বিষয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না থাকলে ভালো প্রতিবেদন তৈরি কঠিন হয়। বিশেষত ইনডেপথ বা অনুসন্ধানী যে প্রতিবেদনই হোক না কেনো, ভালোভাবে বিষয়টি বুঝতে হবে প্রতিবেদককে। এমনকি দৈনন্দিন ঘটনার ক্ষেত্রেও তা সমানভাবে প্রযোজ্য। আর জানতে গেলে ওই বিষয়ে পড়াশোনা করতে হবে; নথিপত্র ঘাটতে হবে; কথা বলতে হবে অভিজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে। এজন্য বাড়তি সময়ও দরকার। আর এই বাড়তি সময় তখনই দেওয়া সম্ভব, যখন প্রতিবেদক বিষয়টিতে আগ্রহী হবে; বিষয়টি ধারণ করবে;  ধৈর্য ধরে খুঁজবার মানসিকতা থাকবে। এগুলোই একজন ভালো সংবাদকর্মীর গুণাবলি হওয়ার কথা।

নিশ্চয়, সংবাদপত্র বা ওয়েব পোর্টালের চেয়ে টেলিভিশন সাংবাদিকতায় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করা একটু কঠিন। আগেই বলেছি, এখানে সবকিছুই ভিজ্যুয়ালাইজ করতে হয় এবং তা বেশ জটিল ও চ্যালেঞ্জিং। অনেক তথ্য পেলেই হয় না, তা সম্প্রচার যোগ্য করে তুলতে হয় ছবির মাধ্যমে। বিশেষ করে অভিযুক্তের ছবিসহ বক্তব্য সংগ্রহ করা সহজসাধ্য নয়। ক্যামেরা দেখলে সটকে পড়া, কথা না বলে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা, লাঞ্ছিত হওয়ার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়াএতো বাধাবিপত্তির পরও প্রতিবেদকের হাল ছাড়ার সুযোগ নেই। লেগে থাকতে হবে এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা প্রয়োজনে একদিন, দুদিন বা এক সপ্তাহ।

কয়েক দিনের চেষ্টায় ভালো কিছু তুলে ধরতে পারলে, তা প্রতিবেদকসহ টেলিভিশন চ্যানেলটির জন্য যেমন সুনাম বয়ে আনবে, তেমন জনস্বার্থেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কিন্তু বেশিরভাগ টেলিভিশন সাংবাদিকের ভিতরে এমন আগ্রহ খুব একটা দেখা যায় না। দিনের পর দিন লেগে থেকে একটা গোপন বিষয় হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ নেওয়ার ইচ্ছা ও মনোবলে তাদের ঘাটতি রয়েছে। হ্যাঁ, অফিস হয়তো এতো সময় দেয় না বলে যুক্তি আসতে পারে। সেটাও প্রতিবেদককে মোকাবেলা করেই এগিয়ে যেতে হবে, বোঝাতে হবে প্রতিবেদনের গুরুত্ব, বলতে হবে কেনো এই প্রতিবেদনটির জন্য সময় নিয়ে কাজ করা জরুরি। সম্পাদকসহ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে রীতিমতো দর কষাকষি করতে হবে নিজের প্রতিবেদনের জন্য; নিজের জন্য নয়। বৃহত্তরের স্বার্থে সংবাদকর্মীর সেই মনোবল থাকতে হবে, উচ্চাকাক্ষী হতে হবে এবং তা খুবই জরুরি।

এক্ষেত্রে ফোরাম ফর আফ্রিকান ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার্স-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা অনুসন্ধানী প্রতিবেদক অ্যাভলিন গ্রোয়েনিঙ্ক (Evelyn Groenink) বলেন,

যদি আপনি চ্যালেঞ্জকে উপভোগ করতে পারেন, সত্য ও ন্যায় বিচারে আগ্রহী হন; ভিন্নতর তথ্য-উপাত্ত প্রতিবেদনে দিয়ে দর্শক-শ্রোতাদের সেবা করতে চান; পেশি ও রাজনৈতিক শক্তির রক্তচক্ষুকে ভয় না পান এবং কতো দিন, কতো ঘণ্টা সময় ও শক্তি খরচ করেছেন তা যদি আপনার জন্য মুখ্য বিষয় না হয়, তাহলেই কেবল অনুসন্ধানী প্রতিবেদন আপনার জন্য। নচেৎ নয়।

ছোটো ছোটো ঘাত-প্রতিঘাত ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মাধ্যমে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় চ্যালেঞ্জ গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। আর কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মাধ্যমেই মান বাড়ে প্রতিবেদনের। ঘটনার অন্তরালে থেকে সুবিধা নেওয়া ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সত্য উদ্ঘাটন করার এ কাজে বাড়তি কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হতে পারে প্রতিবেদককে। এর জন্য প্রতিমন্ত্রী-মন্ত্রীসহ ভি আই পিদের অনুষ্ঠানে দাওয়াত হারাতে হতে পারে; বিশেষ দিনে শুভেচ্ছা বা বিদেশ ট্যুরের ডাক নাও আসতে পারে; রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও পেশিশক্তির রোষানলে পড়তে হতে পারে। ব্যক্তিগত এসব পাওয়া না পাওয়ার সবকিছুই সাময়িক-ক্ষণস্থায়ী। দেশ ও দশের উপকারে আসে এমন একটি ভালো অনুসন্ধানী প্রতিবেদনই কেবল স্থায়ীভাবে প্রতিবেদকের অ্যাকাউন্টে জমা থেকে যায়। যার মাধ্যমে পাল্টে যেতে পারে প্রতিবেদকের অবস্থান।

গ. মাঠের সমস্যা  

বাংলাদেশের মতো দেশে সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলো তথ্য-উপাত্তের অভাব। বিশেষ করে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাসহ প্রশাসনে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার বেশ কম। এসব কারণে তথ্যের সত্যতা যাচাই করা সংবাদকর্মীদের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য। আবার অনেক বিষয়ে তথ্য পেলেও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি কথা বলতে চায় না। জবাবদিহিতার অভাবে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের দায়সারা মনোভাবের কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। অনেক সময় তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমেও সময় মতো অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলে না। আর যেহেতু আর্থিক অনিয়ম দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সম্পর্ক থাকে, তাই তারা ঘটনা ধামাচাপা দিতে নানামুখী অপচেষ্টা করে। বিশেষ করে পুলিশসহ প্রশাসনকে ব্যবহার করে ঘটনাস্থলে হুমকি-ধামকি এবং প্রয়োজনে হামলা করতেও ছাড়ে না তারা। এখানেও প্রতিবেদককে কৌশলী হতে হয়। কারণ তার আসল লক্ষ জনসম্মুখে লুক্কায়িত সত্য তুলে ধরা। ফলে বিকল্প উপায় বের করে এসব পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে হবে অনুসন্ধানের স্বার্থে।

আবার যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন তৈরি হচ্ছে, তারা বিষয়টি জেনে গেলে তার বা তাদের বক্তব্য পাওয়া কঠিন হয়। বিশেষ করে ক্যামেরার সামনে। কিন্তু বক্তব্য ছাড়া প্রতিবেদন অনেক ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ ও দুর্বল হয়। তাই বুদ্ধি খাটিয়ে সাধারণ বিষয়ে প্রতিবেদনের কথা বলে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করতে হয়। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, দ্বিতীয় দফায় সেখানে যাওয়ার সুযোগ নেই, আবার সরাসরি তাকে অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্নও করা যাবে না। কিন্তু তার কাছ থেকে কথা বের করতেই হবে। এজন্য সাধারণ কিছু কথাবার্তার পর একটু ঘুরিয়ে ওই প্রসঙ্গে এমনভাবে প্রশ্ন করতে হবে যাতে সে বুঝতে না পারে। সেজন্য গুছিয়ে ও প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন করার বিকল্প নেই।

প্রতিবেদক নয়, প্রতিবেদন মুখ্য

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন মানে প্রতিবেদকের নিজেকে উপস্থাপন নয়, নিজের ঢোল পেটানো নয়। প্রতিবেদক যেনো মুখ্য হয়ে না উঠে সেদিকে নজর রাখতে হবে। প্রতিবেদককে অবশ্যই আইনের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করছি বলেই আইনকানুন লঙ্ঘনের সুযোগ নেই; মনে রাখতে হবে, সাংবাদিকের জন্য আইনে কিন্তু বিশেষ কোনো সুবিধা দেওয়া হয়নি। কিন্তু দু-একটি ক্ষেত্রে অনেকখানি পুলিশি ভূমিকায় দেখা যায় প্রতিবেদককে। কখনো কখনো এমনভাবে প্রশ্ন করতে দেখা যায়, যেনো তিনি আসামির জবানবন্দি আদায় করছেন। সংবাদকর্মী বিচারক নয়; তবে বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার মতো ঘটনার নেপথ্যের বিষয়গুলো তুলে ধরাই তার কাজ।

অসঙ্গতি-অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র এমনভাবে ফুটিয়ে তুলতে হবে, যাতে প্রতিবেদনই মুখ্য হয়ে ওঠে। অনেক সময় প্রতিবেদন সম্প্রচারের সময় পর্দায় গোপনে ধারণকৃত লিখে প্রতিবেদনটির গুরুত্ব বাড়ানোর চেষ্টা থাকে। কিন্তু ডাল-ভাতের মতো গোপন ক্যামেরা ধারণ করা আদৌও কি বাড়তি কিছু যোগ করে? এ বিষয়ে সম্প্রচার মাধ্যমে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় অভিজ্ঞ বদরুদ্দোজা বাবু মনে করেন

 কেবল গোপনে ক্যামেরায় ছবি ধারণ করলেই তা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হয় না। এ ধারণা সঠিক নয়। যেখানে সাধারণভাবে ছবি ধারণ করা সম্ভব, সেখানে গোপনে ছবি তুলে বাড়তি আকর্ষণ তৈরির চেষ্টা, কখনো কখনো প্রতিবেদনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই চেষ্টা করা উচিত যতোটা সম্ভব সম্মুখ ছবি বা বক্তব্য সংগ্রহ করার। আর নিতান্তই যেখানে সম্ভব নয়, সেখানে গোপন ক্যামেরা অবশ্যই ব্যবহার করা উচিত।

বারবার চেষ্টা করেও কোনো বিষয়ে বক্তব্য না পেলে, তা উল্লেখ করে দর্শকশ্রোতাদের জানিয়ে দিতে হবে। সাম্প্রতিক দেশের টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত কয়েকটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পর্যালোচনায় উপরিউক্ত বিষয়গুলো বুঝতে সহায়তা করবে।

কেস স্টাডি-১

গাছের মগ ডাল থেকে পড়ে আহত হন, আর পরিচয় দেন রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত উদ্ধারকারী হিসেবে।  বিনা পয়সায় চিকিৎসা নেন ঢাকা মেডিকেল, অ্যাপোলো হাসপাতাল ও সি আর পিতে। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ১০ লক্ষ টাকার সঞ্চয়পত্রের পাশাপাশি হাতিয়ে নিয়েছেন দেশি-বিদেশি সহায়তার লক্ষ লক্ষ টাকা। সঙ্গে ১৬ কোটি মানুষের সহানুভূতিও। বিস্ময়কর এ প্রতারণার অভিনেতা রাজবাড়ির গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়নের সাবেক মেম্বর ইউনুস আলী ওরফে ইউসুফ। যে কিনা নিজের আখের গোছানোর মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলেন বিশ্বের শতো কোটি মানুষের বিবেক নাড়িয়ে দেওয়া রানা প্লাজা দুর্ঘটনাকে। এক্স-এর  অনুসন্ধানী রিপোর্ট। ছবি তুলেছেন ওয়াই। (প্রতিবেদক, ক্যামেরাপার্সন ও চ্যানেলের নাম ব্যবহার করা হয়নি)

প্যাকেজ

২৪ এপ্রিল ২০১৩। রানা প্লাজা ভবন ধস। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কতো রক্ত, জীবন আর কষ্টের গল্প।

(আপ্স)

ইউনুস আলী ওরফে ইউসুফ। রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় উদ্ধারকারী পরিচয়ে ১৭ মাস চিকিৎসা সেবা নেন পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সাভারের সি আর পিতে। সবাই জানতো এই ব্যক্তি স্বেচ্ছায় উদ্ধারে নেমে প্রাণ বাঁচান অন্তত ১০ জনের। আর তা করতে গিয়ে বরণ করেন পঙ্গুত্ব।

(আপ্স)

সে সময় দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম ইউসুফকে আখ্যা দেয় রানা প্লাজার বীর। বি জি এম ই এতেও ইউসুফের নাম রয়েছে উদ্ধারকারীর তালিকায়।

(আপ্স)

(জি এফ এক্সগ্রাফিক্স)

ইউসুফের পরিবার বলছে, ... ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তাকে দেওয়া হয় ১০ লক্ষ টাকার সঞ্চয়পত্র; বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন থেকে তিনি পেয়েছেন আরো ১০ লক্ষ টাকা। আর বি জি এম ই এ কর্তৃপক্ষ জানায়, তার চিকিৎসা বাবদ আট লক্ষ টাকা খরচ করেছেন তারা।

(আপ্স)

এছাড়া কয়েকটি বিদেশি এন জি ও এবং বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানও ইউসুফকে দিয়েছে মোটা অঙ্কের সহায়তা। তবে, গোপনীয়তার কারণে ব্যক্তি বিশেষের তথ্য জানাতে রাজি হয়নি তারা।

(আপ্স)

এতো সাহায্য যাকে দেওয়া হলো ... সেই ইউসুফ আসলেই কি রানা প্লাজা দুর্ঘটনার উদ্ধারকারী?

(আপ্স)

আর তা জানতেই ... চ্যানেলের (টেলিভিশন চ্যানেলের নামটি ব্যবহার করা হলো না) যাত্রা ইউসুফের গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ি জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার নুরু মন্ডলের পাড়ায়। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর ইউসুফ চার লক্ষ টাকা দিয়ে নতুন বাড়ি করেছেন। গড়ে তুলেছেন একটি গরুর খামারও। রেখেছেন বেতনভুক্ত একজন সেক্রেটারি। যার কাজ তার ব্যাংক ব্যালান্স ও সম্পদের দেখাশোনা করা।

(আপ্স)

স্থানীয়রা জানায়, ইউসুফ ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর। পেশায় গাছ ব্যবসায়ী।

(আপ্স)

রানা প্লাজায় কীভাবে আহত হয়েছিলেন, ইউসুফের কাছে সেই গল্প শুনতে চাইলে তিনি ভান করেন কথা বলতে না পারার।

(আপ্স)

তাহলে ... গল্পটা শোনা যাক তার স্ত্রীর কাছে।

(ভক্সপপ ... ইউসুফের স্ত্রী)

কিন্তু অনুসন্ধান বলছে, যেদিন রানা প্লাজা ধস হয়, সেই একই তারিখে গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়নের বেথুরী গ্রামে, একটি গাছ কাটতে গিয়ে মগ ডাল থেকে পড়ে গুরুতর আহত হন ইউসুফ।

(ভক্সপপ ... ইউসুফের স্ত্রী)

তাহলে দেখা যাক কোনটা সত্য ... স্থানীয় জনপ্রতিনিধি জানান, ইউসুফের গাছ থেকে পড়ার বিস্তারিত।

(ভক্সপপ )

২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ২৪ এপ্রিল গাছ থেকে পড়ে মাথায় জখম নিয়ে ইউনুস আলী ওরফে ইউসুফ সর্বপ্রথম ভর্তি হন গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এখানকার রেকর্ডে তার আঘাতের কারণ বলা হয় ... গাছ থেকে পড়ে যাওয়া। একদিন পর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেওয়া হয়।

(শট্ : থানা মেডিকেল অফিসার)

এবারের যাত্রা ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে। নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায় ... ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ২৫ এপ্রিল থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত এখানকার সার্জারি বিভাগে চিকিৎসা চলে ইউসুফের। এখানেও তার আঘাতের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ফল ফ্রম হাইট। অর্থাৎ উঁচু থেকে পড়ে যাওয়া।

(শট্ : নার্স ইনচার্জ, ফরিদপুর মেডিকেল)

ফরিদপুর মেডিকেল থেকে ইউনুস আলী ওরফে ইউসুফ ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এখানকার রেকর্ড বিভাগের তথ্যে দেখা যায়, ইউসুফ রাজবাড়ির ঠিকানা গোপন করে লিখেন সাভার। মূলত এখান থেকেই শুরু করেন নিজেকে রানা প্লাজা উদ্ধারকারী পরিচয় দেওয়া।

(শট্ : রেকর্ড অফিসার)

ঢাকা মেডিকেলে তিন দিন থাকার পর বি জি এম ই এর তত্ত্বাবধায়নে ইউসুফকে ভর্তি করা হয় রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে। অ্যাপোলো রেকর্ড বলছে, এখানে তার চিকিৎসা হয় টানা ২৫ দিন। আর রোগী হিসেবে ইউসুফের আইডি নম্বর ৪২১৪৭১।

(আপ্স)

এরপর দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার জন্য ইউসুফকে নেওয়া হয় সাভারের সি আর পিতে। আর এখানে বি জি এম ই এর তত্ত্বাবধায়নে তার চিকিৎসা চলে ৪৯১ দিন অর্থাৎ প্রায় ১৭ মাস।

(শট্ : অ্যাডভোকেসি অফিসার, সি আর পি)

বি জি এম ই এ বলছে, পোশাকশিল্পে বিভিন্ন দুর্ঘটনায়, সবসময়েই এমন বেশকিছু চক্র প্রতারণায় সক্রিয় হয়ে ওঠে।

(শট্ : সভাপতি, বি জি এম ই এ)

ইউসুফের পরিবার ২০ লক্ষ টাকা সহায়তা পাওয়ার কথা স্বীকার করলেও, স্থানীয়রা জানান, তিনি দৌলতদিয়ায় আত্মীয়ের নামে চার বিঘা জমি কিনেছেন, যার বাজার মূল্য ১৬ লক্ষ টাকা এবং অগ্রণীসহ কয়েকটি ব্যাংকে তার রয়েছে বিপুল অর্থ।

পর্যালোচনা

শুধু সাম্প্রতিক নয়, গেলো কয়েক বছরের মধ্যে টেলিভিশন মাধ্যমে ইউসুফের এই ঘটনা একটি চমৎকার অনুসন্ধানী কাজ। মানুষের আবেগকে পুঁজি করে এমন অভিনব প্রতারণা সত্যিই চমকপ্রদ, বিস্ময়করও বটে। একটা ছোট্ট তথ্যের সূত্র ধরে খুঁজতে খুঁজতে ফরিদপুরের গোয়ালন্দ সদর উপজেলা হয়ে ঢাকার সাভারসহ বিভিন্ন হাসপাতালে নথিপত্র খুঁজে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে দর্শকের সামনে প্রতারণার বিষয়টি তুলে ধরেছেন প্রতিবেদক। এজন্যে সাত-আট দিনের মাঠের কাজ ছাড়াও সবমিলিয়ে লেগেছে প্রায় ১৫-২০ দিন। এ প্রতিবেদনটি বেশ আলোচিত হওয়ার মাধ্যমে প্রতিবেদকের সেই পরিশ্রম সার্থক হয়েছে, অসংখ্য দর্শকের কাছে তিনি পৌঁছাতে পেরেছেন।

আগেই উল্লেখ করেছি, সম্প্রচার সাংবাদিকতা হলো টিম ওয়ার্ক বা যৌথতার কাজ। মাঠে তথ্যানুসন্ধানে ক্যামেরাপার্সন থেকে শুরু করে প্রতিবেদনের স্ক্রিপ্ট লেখা ও সম্পাদনা, ছবি সম্পাদনা থেকে অন এয়ার হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে কয়েকজনের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। এমনকি গাড়ি চালকের সহযোগিতাও গুরুত্বপূর্ণ। ফলে কোনো একটি স্তরে একজনের খেয়াল না করলে বা অর্পিত দায়িত্বটুকু ঠিকভাবে পালন না করলে তার ছাপ পড়ে প্রতিবেদনে এবং গুণে-মানে তা দুর্বল হতে বাধ্য। ছোটো ছোটো কিছু বিষয়ে সতর্কতার অভাব বা ভুলের কারণে কীভাবে চমৎকার একটি অনুসন্ধানী কাজ প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে তারও উদাহরণ হতে পারে এটি। যেমন : প্রতিবেদনের লিঙ্ক/ইন্ট্রো অহেতুক বড়ো করতে গিয়ে ঝুলে গেছে। এমনকি প্রতিবেদনের মূল ফোকাস আবছা হয়ে গেছে লিঙ্কে সব বলতে গিয়ে। অল্প কথায় মূল বিষয়টা বললেই দর্শকশ্রোতার কাছে আকর্ষণটা ধরে রাখা সম্ভব হতো।

প্রতিবেদনের শুরুতেই বলা হয়েছে, গাছের মগ ডাল থেকে পড়ে আহত হন এ কথাটা বাহুল্য। এখানে গাছ থেকে পড়ে আহত বললেই চলে। ফলে এতো বড়ো ঘটনা হালকা করে দিয়েছে মগ ডাল থেকে পড়ার বিষয়টি লিঙ্কে বলার মাধ্যমে। আবার প্রতারণার অভিনয়ের কথা বলতে গিয়ে তার ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা সবকিছুই বলা হয়েছে। এমনকি সাবেক মেম্বর বলার পাশাপাশি র‌্যাব, পুলিশের মতো ওরফে ব্যবহার করা হয়েছে, যা অপ্রয়োজনীয়। দর্শকের আকর্ষণ ধরে রাখতে, অভিনব সেই প্রতারক ফরিদপুরের ইউসুফ আলী বললেই যথেষ্ট ছিলো। কারণ তার নাম পরিচয় পেশার বিষয়টি লিঙ্কে নয়, পাঠককে জানানোর প্রয়োজন হলে তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা উচিত।

এখানেই শেষ নয়, ৮৫ শব্দের লিঙ্কের শেষে আবার জুড়ে দেওয়া হয়েছে ১৯ শব্দের একটি লাইন। এতে দর্শকের অনুভূতিতে নাড়া দেওয়ার বদলে তা খানিকটা ছেদ ঘটায়। কারণ লিঙ্কের শুরুতে যেভাবে ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তাতে রানা প্লাজার বিষয়টি এসেছে এবং অন্তত প্রতিবেদন দেখতে গভীর মনোযোগ নিয়ে অপেক্ষা করার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছিলো। বাড়তি লাইনটা জুড়ে না দিলে ১০ সেকেন্ড ওজন কমে লিঙ্কটা হতো ঝরঝরে ও আকর্ষণীয়। এখানে প্রতিবেদকের চেয়ে নিউজ এডিটর বা সম্পাদকের দায় বেশি। কারণ স্ক্রিপ্ট দেখা, তা শ্রুতিমধুর ও আকর্ষণীয় করার কাজটি তাদেরই। এমনকি এক্সক্লুসিভ ব্র্যান্ড (এমন কোনো ফুটেজ বা ছবি, যা অন্য কারো কাছে নেই, সেই ফুটেজের তাৎপর্য বোঝাতে চ্যানেলের নামসহ এক্সক্লুসিভ লেখা জলছাপ আকারে প্রতিবেদনে ব্যবহার করা হয়। যেমন : গাইবান্ধার সাঁওতাল পল্লীতে পুলিশের আগুন দেওয়ার ভিডিও ফুটেজটি) ব্যবহার করা প্রতিবেদনটি দিনভর সম্প্রচার হয়েছে। ফলে প্রতিবেদন দেখে অন্তত সন্ধ্যা সাতটার মূল সংবাদের আগে লিঙ্কটা পরিচ্ছন্ন করার সুযোগ ছিলো। কিন্তু বার্তাকক্ষের সেই সক্রিয় অংশগ্রহণ না থাকায় লিঙ্কের দুর্বলতা থেকে গেছে; আখেরে প্রতিবেদনের মান বৃদ্ধির জায়গায় অনেকটা ক্ষুণ্ন হয়েছে।

তবে কীভাবে এবং কাদের সহযোগিতায় ফরিদপুরের একজন সাধারণ আহত ব্যক্তি রানা প্লাজার আহত উদ্ধারকর্মীতে পরিণত হলো সে সম্পর্কে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ন্যূনতম কিছু নেই। যা প্রতিবেদনের সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা, এক অর্থে খানিকটা অসম্পূর্ণ অনুসন্ধানী কাজ। আহত ব্যক্তিটি প্রতারণা করেছে ঠিক, কিন্তু তিনি তো একলা এ কাজ করতে পারার কথা নয়। তিনি যেহেতু রানা প্লাজার মর্মান্তিক দুর্ঘটনার দিনেই আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিলেন ফরিদপুরে, তাই তাকে অবশ্যই কেউ না কেউ কাজে লাগিয়েছে, ব্যবহার করেছে। এবং সহায়তা করেছে রানা প্লাজার আহত উদ্ধারকারী হিসেবে পরিচিত করাতে। এমনকি অনেক আহত উদ্ধারকর্মীসহ নিহত পোশাককর্মীর পরিবারের অনেকেই ক্ষতিপূরণ পায়নি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। কিন্তু প্রতারক ইউসুফ ঠিকই পৌঁছেছে। অথচ সেখানে কিন্তু প্রায় আট মিনিটের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে কোথাও তার ছাপ নেই। হতে পারে পিছনের চক্রটি শক্তিশালী বা বিশেষ কেউ; তাই হয়তো তার বা তাদের সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব হয়নি। সেক্ষেত্রে অবশ্যই ইঙ্গিত দেওয়া যেতো এবং পিস টু ক্যামেরা (পি টি সি) দিয়ে বিষয়টি কোনো না কোনোভাবে তুলে ধরা সম্ভব ছিলো। একজন সাধারণ মানুষ কীভাবে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে সাহায্য নিতে যেতে পারেন? নিশ্চয়, একটি প্রতারক চক্র আছে, যারা তাকে সাজিয়েছেএমন প্রশ্ন তুলে বক্তব্য দিয়েছেন পোশাক মালিকদের সংগঠন বি জি এম ই এর সভাপতি। কিন্তু তারপরও প্রতিবেদক এ সম্পর্কে টু শব্দ করেননি।

অনেক তথ্য বলতে গিয়ে প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ অংশটি হারিয়ে গেছে তা খেয়ালই করেনি প্রতিবেদক। এমনকি সংশ্লিষ্ট নিউজ এডিটরের নজরেও তা ধরা পড়েনি। প্রতিবেদনের একদম শেষে সে আবারও বলেছে, ইউসুফের পরিবার ২০ লক্ষ টাকা সহায়তা পাওয়ার কথা স্বীকার করলেও, স্থানীয়রা জানান, তিনি দৌলতদিয়ায় আত্মীয়ের নামে চার বিঘা জমি কিনেছেন। যার বাজার মূল্য ১৬ লক্ষ টাকা এবং অগ্রণীসহ কয়েকটি ব্যাংকে তার রয়েছে বিপুল অর্থ। অঙ্কের হিসাবে তা মেলে না এবং অভিযুক্ত আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলতেই পারেন জমির মূল্য তো বর্ণিত আর্থিক সহায়তার চেয়ে কম। তিনি কতো টাকা সাহায্য পেয়েছেন সে ফিরিস্তি কিন্তু আগেই দেওয়া হয়েছে। আর এটা তো অনুসন্ধানের কেন্দ্রবিন্দু নয়, কিন্তু পুরো প্রতিবেদনে ঘুরেফিরে বিষয়টি এমনভাবে এসেছে যেনো আহত উদ্ধারকর্মী সেজে কতো টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সেটাই যেনো মুখ্য। উদাহরণস্বরূপ, মোটরসাইকেল চুরি করে উল্টো পথে চালালে দুটি অপরাধের মধ্যে মূল অপরাধ হলো চুরি করা, আর দ্বিতীয় অপরাধ হলো ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করা। ফলে গাড়ি চুরির মতো বড়ো অপরাধের শাস্তি না দিয়ে নিশ্চয় পাঁচশো টাকা জরিমানা করাটা সমীচীন নয়! এখানে ঠিক তাই ঘটেছে। বার্তাকক্ষের দায়িত্বশীলদের নজরদারির অভাবে চমৎকার এ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি অনেকখানি দুর্বল হয়েছে।

কেস স্টাডি-২

লিঙ্ক : এক ঠিকাদারের সব কাজ পাওয়া, ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে দরপত্র দেওয়া, ভেজাল মালামাল গছিয়ে দেওয়া, বাজার মূল্যের চাইতে কয়েকগুণ বেশি দাম নেওয়া এই সব কারসাজি হয়েছে রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসার যন্ত্রপাতি কেনাকাটায়। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এই অনিয়ম আর দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরছেন এক্স; ক্যামেরায় ছিলেন ওয়াই

পর্যালোচনা

সাম্প্রতিক দুর্নীতি সংক্রান্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের লিঙ্ক এটি। কীভাবে পরস্পরের যোগসাজশে দুর্নীতি-অনিয়ম হয় তার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। একইভাবে এতো অভিযোগ থাকার পরও হাসপাতালটির বাজেট বরাদ্দ কেনো বাড়িয়েছে সেই প্রশ্নও করা হয়েছে। আবার অনিয়মের সুযোগ নিতে বা টেন্ডারবাজি করতে কীভাবে পছন্দের ব্যক্তিকে আগে থেকে বদলি করে আনা হয় সেই বিষয়টিও জানানো হয়েছে দর্শককে। আর কীভাবে ভারী যন্ত্রপাতি দাম দ্বিগুণ-তিনগুণ দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে তাও আছে। একই প্রতিবেদনে অনেকগুলো বিষয় তুলে ধরার পরও অনুসন্ধানের মূল ফোকাস হারিয়ে যায়নি। মূল লক্ষ্য ঠিক রেখে পারিপার্শ্বিক সম্পর্কযুক্ত অনেকগুলো ঘটনা কীভাবে তুলে ধরার শিক্ষণীয় এক প্রতিবেদন এটি। আর এই শক্তিশালী গাঁথুনির কারণে ১০ মিনিটের প্রতিবেদন দেখতে দর্শকের একঘেঁয়েমি লাগেনি, বিরক্তও হয়নি।

প্রায় ২০ দিনের পরিশ্রমে করা এই প্রতিবেদনটির ঝুলিতে জমা হয়েছে টি আই বিসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার। তবে প্রতিবেদনটির লিঙ্ক একেবারেই সাদামাটা। এতোটাই সাধারণ যে, এতো বড়ো আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতির অনুসন্ধানের গুরুত্ব ফুটে ওঠেনি প্রতিবেদনে। অভিযুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। যেহেতু লিঙ্ক শুনে পুরো প্রতিবেদন দেখতে দর্শক আগ্রহী হয়, সে কারণে চুম্বক অংশ তুলে ধরার প্রয়োজন ছিলো।

পি টি সি : প্রতিবছর বাজেটে অর্থমন্ত্রী, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য প্রায় শতো কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখেন। উদ্দেশ্য একটাই, যাতে জরুরি প্রয়োজনে হাসপাতালগুলোতে ভারী যন্ত্রপাতি কেনাকাটা সম্ভব হয়। এই জরুরি প্রয়োজনের অজুহাতে, গত কয়েক বছর ধরে হাসপাতালগুলোতে এই টাকা খরচ করে যে যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে তা নিয়ে রয়েছে দুর্নীতির বড়ো অভিযোগ। গেলো অর্থবছরেও এর ব্যতিক্রম হয়নি; যেমন মুগদা জেনারেল হাসপাতাল। 

পর্যালোচনা

মুগদা জেনারেল হাসপাতালের দুর্নীতি সংক্রান্ত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে লিঙ্কের মতোই পি টি সি প্রতিবেদনের মূল সুরকে খানিকটা ঘুরিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে পি টি সির বক্তব্য শুনে বোঝার উপায় নেই কী নিয়ে প্রতিবেদন! পুরো প্রতিবেদনে ঘটনার পর ঘটনা সাজিয়ে যে শক্ত ভিত্তি তৈরি করা হয়েছিলো, তার অনেকটা ধসে পড়েছে পি টি সিতে। কারণ প্রতিবেদনটি স্বাস্থ্য খাতে বাজেট দেওয়া নিয়ে নয়। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় অবশ্যই সরকারি হাসপাতালে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। প্রতিবেদকের কথা শুনে যে কেউ ভাবতে পারে, বাজেট বরাদ্দ দেওয়াটাই যেনো অপরাধ অথবা বরাদ্দ দেওয়ার কারণেই দুর্নীতি হয়েছে। এবং পরোক্ষভাবে তার দায় অর্থমন্ত্রীর। ৩০ সেকেন্ডের পি টি সির শেষ তিন শব্দে হাসপাতালের নাম বলার মাধ্যমে প্রতিবেদনের সঙ্গে এটাকে সম্পর্ক যুক্ত করা হয়েছে। দায়টা যেনো হাসপাতালের। যা অনেকটা তীরে এসে তরী ডোবার মতো, প্রতিবেদনের গাঁথুনি আলগা করেছে; মান বৃদ্ধির বদলে ক্ষুণ্নও করেছে।

কেস স্টাডি-৩

ছোট্ট এই মানবজীবনে যখন প্রতিটি সেকেন্ডই অমূল্য, তখন কারো জীবন থেকে শুধু শুধুই হারিয়ে যায় পাঁচ, ১০ অথবা ২০ বছর। দেশের কারাগারগুলোতে বিনা বিচারে এভাবেই ক্ষয়ে যায় কতো শতো মানুষের জীবন। খোদ কারা কর্তৃপক্ষের হিসাব বলছে, পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচার ছাড়াই বন্দি হাজতির সংখ্যা সাড়ে পাঁচশোর বেশি। মামলা জট আর বিচারের দীর্ঘ সূত্রিতায় কপালপোড়া এমন অনেক নামের একজন হলেন পুরান ঢাকার বাসিন্দা শিপন। ১৭ বছর ধরে যিনি পঁচে মরছেন বন্দিশালার চার দেয়ালে। এক্স এর রিপোর্টে ...।

পর্যালোচনা

সাধারণত আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, জালিয়াতি আর দখল বাণিজ্য ইত্যাদি কড়া কড়া ঘটনা নিয়ে হয়ে থাকে বেশিরভাগ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। কিন্তু একেবারে সাধারণ মানুষের জীবনের দুঃখ-কষ্টের গল্পগুলো যে অনুসন্ধানের খোরাক হতে পারে; বেদনাবিধুর একেকটা গল্প নাড়িয়ে দিতে পারে শতো শতো মানুষের বিবেকএমনই এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বিনা বিচারে ১৭ বছর জেল বন্দিদের নিয়ে উপরের প্রতিবেদনটি।

শুধু সাধারণ মানুষ নয়, সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত প্রতিবেদনটি আদালত পর্যন্ত পৌঁছেছে। প্রতিবেদন সম্প্রচারের পর তা আদালতের নজরে আসায় বিনা বিচারে আটক কারাবন্দিদের জামিনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে জামিনে বেশ কয়েকজন মুক্তিও পেয়েছে এবং সারাদেশে কতো বন্দি এভাবে বিনা বিচারে আটক আছে তা জানতে চেয়েছেন আদালত। সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার হলো, আদালত তার নির্দেশনায় প্রতিবেদকের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেছেন। যা সত্যিই বিরল এবং যেকোনো সংবাদকর্মীর জন্য অনেক বড়ো সম্মানের।

মানবিক অধিকার সংক্রান্ত দারুণ এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি বেশ খানিকটা দুর্বল হয়েছে লিঙ্কের বক্তব্যে। সতর্কতার অভাবে এমন কিছু শব্দ চয়ন করা হয়েছে যা রীতিমতো বেমানান ও প্রশ্নবিদ্ধ। লিঙ্কে বলা হয়েছে ... ১৭ বছর ধরে যিনি পঁচে মরছেন বন্দিশালার চার দেয়ালে।

জেলবন্দি থাকা আর পঁচে মরা দুটো এক জিনিস নয়। হ্যাঁ, ঘটনার গুরুত্ব তুলে ধরতে রূপক অর্থে এমন উপমা ব্যবহার করা দোষের নয়। কিন্তু সেখানে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, উপমার সঙ্গে শাব্দিক অর্থ যেনো অর্থবহ হয়। লিঙ্কের মতো প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, ... ১৭ বছর ধরে জেলে কাটাচ্ছেন;  শিপনরা কেউ জেলে স্বেচ্ছায় আসেনি, তারা বাধ্য হচ্ছে থাকতে। কাটাচ্ছেন শব্দটা কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো কিছু বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। এখানে কাটাতে হচ্ছে বা কাটাতে বাধ্য হচ্ছে শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা যেতো। কাছাকাছি হলেও দুটো শব্দের পার্থক্য অনেক। এখানেও প্রতিবেদকের পাশাপাশি দায় বর্তায় বার্তাকক্ষের ওপর।

এবং দায়স্বীকার

আর পাঁচটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের চেয়ে উপরের তিনটির গুরুত্ব একটু বেশি বলে আলোচনার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। নিছক ব্যক্তি-প্রতিবেদক বা চ্যানেলের সমালোচনার জন্য নয়; খুঁত ধরতে নয়; ঘটনার তাৎপর্য, জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্ব এবং অনুসন্ধান করে বড়ো বড়ো গোমড় ফাঁসের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এ প্রতিবেদন তিনটি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এর বাইরে টেলিভিশনে আরো অনেক অনুসন্ধানী কাজ রয়েছে।

ছোটো ছোটো এসব বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিবেদনগুলোকে ত্রুটিমুক্ত করার চেষ্টা হয়েছে। অন্য একটি কারণেও এভাবে খতিয়ে দেখার কারণ রয়েছেটেলিভিশনগুলোতে প্রতিবেদক ও প্রতিবেদন মান উন্নয়নে ধরে ধরে আলোচনা-সমালোচনা করে ত্রুটিমুক্ত করার আয়োজন নেই বললেই চলে। অপেক্ষাকৃত নতুন সংবাদকর্মীদের বিষয়গুলো তুলে ধরে সচেতন করারও ব্যবস্থা নেই। আর কোটি দশর্কের কাছে ভুল তথ্য বা শব্দ অথবা অসম্পূর্ণ প্রতিবেদন সম্প্রচারের চেয়ে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া বাড়ানোই উত্তম।

সমালোচনার ভয়ে পরস্পর পরস্পরের পিঠ চুলকানোর মতো খুব মিষ্টি কথার চেয়ে সমালোচনা ঢের ভালো। গঠনমূলক সমালোচনায় নিজেরই উপকার হয়। জানি হয়তো সবটা সম্ভব নয়, কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রতিবেদনের স্ক্রিপ্ট নিয়ে মনে হয় পর্যালোচনা করার সময় এসেছে। এ প্রক্রিয়া শুরু হলে প্রতিবেদকের মতো বার্তাকক্ষের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও উপকৃত হবে। প্রতিবেদকের অসম্পূর্ণতা দূর করে গড়েপিটে নিতে বার্তাকক্ষের ত্রুটিবিচ্যুতিগুলো চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। ভালোর কোনো শেষ নেই, ভালো হতো আরও ভালো হলে। এই আকাক্ষা সবার, কিন্তু রয়েছে উদ্যোগের অভাব। আর এ হাতেকলমে শেখানোর প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই টেলিভিশনের পর্দায় যতোটা সম্ভব খাদমুক্ত ঝরঝরে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দেখতে পাবে দর্শক। শেষ বিচারে সাফল্য জমা হবে অন্য কারো নামে নয়, প্রতিবেদকের নিজের অ্যাকাউন্টেই। তাই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে আরো বেশি আগ্রহের পাশাপাশি চোখ কান খোলা রাখার বিকল্প নেই।

 

লেখক : সুশান্ত সিনহা, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল যমুনা টেলিভিশন-এর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক।

sinhasmp@yahoo.com

তথ্যসূত্র

১. http://www.investigative-manual.org/chapters/who-is-that-investigative-journalist/3-how-to-become-a-great-investigative-journalist/?lang=en; retrieved on 20.12.16

২. বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল মাছারাঙার বিশেষ প্রতিবেদক বদরুদ্দোজা বাবুর সঙ্গে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নিয়ে লেখকের সাক্ষাৎকারমূলক আলোচনা থেকে নেওয়া।

৩. সাধারণভাবে প্রতিবেদন তৈরির সময় শুরুর দুই-এক লাইন পরে দুই-তিন সেকেন্ডের একটি বিরতি দেওয়া হয়, ওই বিরতিতে ভিডিও ছবির নিজস্ব শব্দ যেমন : মিছিলের ক্ষেত্রে স্লোগান, বৃষ্টির ক্ষেত্রে বৃষ্টি পড়ার শব্দ, জনসভার ক্ষেত্রে মাইকের হালকা আওয়াজ, যানজটের ক্ষেত্রে গাড়ির হর্ন ব্যবহার করা হয়যাকে আপ্স বা Ambient বলে।

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন