Magic Lanthon

               

কবীর সুমন ও সুমন

প্রকাশিত ১৫ অক্টোবর ২০২৫ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

সিস্টেমেরও আমাকে দরকার নাই আমারও সিস্টেমকে দরকার নাই

কবীর সুমন ও সুমন


বাংলা গানের জীবন্ত এক কিংবদন্তি কবীর সুমনের জন্ম ১৬ মার্চ ১৯৪৯। তিনি একাধারে গায়ক, গীতিকার, অভিনেতা, বেতার সাংবাদিক, গদ্যকার ও সংসদ সদস্য। তার পূর্বনাম সুমন চট্টোপাধ্যায়। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে তিনি পুরনো নাম পরিত্যাগ করেন। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে তোমাকে চাই অ্যালবামের মাধ্যমে বাংলা গানে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেন তিনি। সুমনের গান নিজেই তার পরিচয়। তার সমসাময়িক খুব কম শিল্পীই আছে, যারা সময়কে সুমনের মতো এতো অসাধারণভাবে তাদের গানে ধরতে পেরেছে। শিকড়ের টানে শিকড়ের জন্য গান করে চলেছেন তিনি। তার স্বরচিত গানের অ্যালবামের সংখ্যা ২০টির উপরে। সম্প্রতি তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের জাতিস্মর-এর সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে। কবীর সুমনের সঙ্গে এ নিয়ে আড্ডায় মেতেছিলেন ভারতের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল স্টার আনন্দ-এর জনপ্রিয় উপস্থাপক সুমন। কবীর সুমন ও সুমনের সেই আলোচনার ভিডিওটি ইউটিউব থেকে ডাউনলোড করে ম্যাজিক লণ্ঠন-এর পাঠকদের জন্য অনুলিখন করা হয়েছে। যে কেউ চাইলে অবশ্য এই লিঙ্কটিতে https://www.youtube.com/watch?v=ibZJo2d-32Y; retrieved on : 31.10.2016 ঢু মেরে আসতে পারেন মূল ভিডিওটি দেখার জন্য। আড্ডার প্রথম পর্ব এবার প্রকাশ করা হলো।

সুমন : ৬১তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে; এতে যিনি শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হয়েছেন, আমার সঙ্গে এই মুহূর্তে স্টুডিওতে আছেন সেই কবীর সুমন। কবীর দা অভিনন্দন। জাতিস্মর চারটে পুরস্কার এবং সেরা মেল প্লেব্যাকের পুরস্কার পেয়েছে রূপঙ্কর, তোমারই কথা ও সুরেএ তুমি, কেমন তুমি। আমি যদি একেবারে অন্যভাবে শুরু করি, আসলে আমার সামনে যিনি বসে আছেন, তিনি কোনো পুরস্কারই পাননি; পুরস্কার পেয়েছেন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, পুরস্কার পেয়েছেন ভোলা ময়রা, যোগেশ্বরী, রাম বসু, গোরক্ষানাথ, ঠাকুরসিংহ, হরু ঠাকুর। তোমার কাজটা আসলে ছিলো প্রত্নতাত্ত্বিক, যে সময়টার আসলে কোনো রেফারেন্স নেই, সেসময় সুর-তাল, যন্ত্রসঙ্গীতে কী ব্যবহার হয়েছে তার কোনোকিছুই ছিলো না; সেখান থেকে পুরোটা তুমি রিক্রিয়েট করলে। এটা তুমি মানবে?

কবীর সুমন : প্রত্নতাত্ত্বিক ঠিক নয়, এটাকে তুমি রিক্রিয়েট-ই বলতে পারো। আসলে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের জিনিয়াসটা হলো, তিনি ১৩টি টেক্সট বেছে নিয়েছেন। মাত্র দুটি জায়গায় আমাদের স্পর্শ করতে হয়েছে, এর আগে প্রণব রায় করেছিলেনসেখানে ছোটো করে নেওয়া হয়েছিলো গানগুলোকে। এখানে কিন্তু পুরো গান নেওয়া হয়েছে। এবং এই ১৩টি গানের সুর কী ছিলো তা নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন সৃজিত; আমাকেও বই পড়তে দিয়েছিলেন। আমি আবার নিজে থেকে কিছু জায়গায় খোঁজ করি, যেমন : আমার এক নবীন বন্ধু আছেন ইতিহাসের লোক, আমি তাকে বললাম তুমি একটু খোঁজখবর করো তো, সেসময় ঠিক কী বাজনা বাজতো। তার পরবর্তী যুগের মানুষেরা, যেমন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তারা কিন্তু খুব অদ্ভুতভাবে সেই যুগটাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেনঢাকঢোল পিটিয়ে লোকে চেঁচাতো বলে। তাই যদি হয় ...

সুমন : যেমন বটতলার সাহিত্যকে কোথায় যেনো একটা অবহেলার চোখে দেখা হয়, ওটা অন্ত্যজ শ্রেণির, কবিগানও তেমনই ক্লাসিক্যাল নয়।

কবীর : এই অন্ত্যজ বলে যে কথাটা বললে না, ঠিক সেটাই; কৌম মানুষের গান। কিন্তু এটা সকলে ভুলে গেছে, মানে ইতিহাসটা; একজন কবিয়াল হতে গেলে কেবল লড়াইটাই আসল না, কবিয়াল হতে গেলে তাদের শাস্ত্র পড়তে হতো। তাদেরকে হিন্দু ও ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখতে হতো। এজন্য তাদের ভাষা শিখতে হতোবাংলা, সংস্কৃত, ফার্সি। পণ্ডিত রেখে, মৌলবি রেখে এরা কিন্তু সেটা শিখতেন।

সুমন : এটা কিন্তু কবীর দা প্রেজেন্স অব মাইন্ড, মানে এখানে কোনো রেকর্ডিংয়ের সুবিধা নেই; তোমার গান শুনে আমি সরাসরি তার প্রত্যুত্তর দিচ্ছিএতো অসাধারণ!

কবীর : এবং এর মধ্যে একটা টিমওয়ার্ক ছিলো। যেমন : এদের মধ্যে বাঁধনদার বলে একজন ছিলেন; তিনি কিন্তু গানটা বাঁধতেন। অনেক সময় যিনি ঠিক গানটা পরিবেশন করতেন, তিনি বাঁধতেন না। তাকে কিন্তু ভিতরে ভিতরে জিনিস আনতে হতো। ধরো, সৃজিত আমায় একটা টেক্সট দিচ্ছেনএখন বুঝলি তো/ এই হরু না সেই হরি/ সেই হরি সারাৎস্বার/ পুরানো ইন্দু সেই হরি/ এ হরু প্রচণ্ড অসার।' এটা রাম বসু গাইছেন। রাম বসু ছিলেন আনডিসপিউটেড মাস্টার। যোগেশ্বরী তার প্রেমিকা ছিলেন বলে শোনা যায়।

এই যে গানটাএখন বুঝলি তো/ এই হরু না সেই হরি; এটা হরি ঠাকুরকে উদ্দেশ্য করে সেই হরি সারাৎস্বার। এবার বলো তো দেখি, এই সুরটা কী হবে? তুমি বিশ্বাস করো, কী করে যে এটা সম্ভব হলো (!); এই গানগুলোর সুর করতে আমার সবচেয়ে কম সময় লেগেছে। আমি একেক দিনে দু-তিনটি করে গানের সুর করেছি এবং সেটা সৃজিতকে পাঠিয়ে দিয়েছি। সৃজিত এসেছেন পেনড্রাইভ নিয়ে, তারপর তারা শুনেছেন। ধরো, এখন বুঝলি তো/ এই হরু না সেই হরি/ সেই হরি সারাৎস্বার (সুর করে গাইলেন)এই স্ক্যানিংটা করে তৈরি করা। এখন এটা আমি রিক্রিয়েট করছি; গিটার, পিয়ানো নয়, হারমোনিয়াম বাজিয়ে বাজিয়ে।

সুমন : কবীর দা, এখানে আমার একটা প্রশ্ন থাকবে, কবীর সুমনকে সবাই গিটারসহ মানে গিটার এবং সুমন  দেখে অভ্যস্ত। এর বাইরে যে যন্ত্রগুলোর সঙ্গে দেখেছেসিনথেসাইজার, পিয়ানোকিন্তু কোনোটাই খোল, করতাল কিংবা সেই সময়ে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র নয়। তাহলে ওই রিদম, ছন্দটা তুমি ফিল্মে কী করে রিক্রিয়েট করলে?

কবীর : তোমার জীবনে প্রথম যেদিন তুমি আমায় গিটার নিয়ে দেখলে, আমি তো তার আগের দিন জন্মাইনি (উচ্চ শব্দে সুমনের হাসি)। আমি তো অনেক কালের লোক, সেই ৪৯ সালে জন্মেছি। দেখো আমার আর কোনো ক্ষমতা নেই; আমি কেবল একটা বিশাল অ্যাবজরভার, স্পঞ্জ; আমি খালি টেনে নিচ্ছি ব্লোটিং পেপারের মতো, যে শুষে নিচ্ছে। আমি আরেকটি কাজ করেছিশুনেছি, প্রচুর শুনেছি। আমাকে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, উনি যখন ওস্তাদ বড়ো গোলাম আলি খাঁ সাহেবের কাছে নাড়া বেঁধে গান শিখতে গেলেন, তখন সঙ্গীতাচার্য সন্ধ্যাজিকে বলেছিলেন, `ব্যাটা সঙ্গীত শিক্ষা যদি একশো ইউনিট হয়, তার ৮০ ইউনিট হলো তুই কী শুনেছিস, কী শুনছিস, কী শুনবি। আর মাত্র কুড়ি ইউনিট হলো গুরুর কাছে নেওয়া তালিম।'

মনে রেখো, আমি যদি ৪৯-এ না জন্মাই, তাহলে এই গানের সুর করতে পারি না। যাদের জন্ম ছয়ের দশকের পর সাতের দশকে, তারা আর পারবে না। এই যে রেডিওতে, পুরনো রেকর্ডে গান শোনা কিংবা পঞ্চানন ঘোষাল মশাই আসছেন, আমার মাকে গান শেখাচ্ছেন। আমরা ছোট্ট ১০ ফুট বাই ১০ ফুটে থাকি, আড়াল থেকে আমি তা শুনছি। শোনা, শোনা, শুধু শোনা। এর পর আমি কিছু তালিম নিয়েছি, খেয়াল শিখেছি; না, ঠিক শিখতে চেষ্টা করেছি ১৪ বছর। আর ঠুমরি, কাওয়ালি কেবল শুনছি, শুনছি। যেমন এই গানটার না একটা কাওয়ালি তাল হয়ে যাচ্ছেএখন বুঝলি তো/ এই হরু না সেই হরি/ সেই হরি সারাৎস্বার (হাতে তাল বাজিয়ে গাইলেন)। এটার সঙ্গে কাওয়ালি বাজতে পারে, আবার বাংলা ঢোলও বাজতে পারে। এই যে কোরাস গাচ্ছে, এ হরু প্রকাণ্ড অসার’এই যে ছোটো ছোটো জিনিসগুলো, রবীন্দ্রনাথের কথায় বলতে গেলেসে যে প্রাণ পেয়েছে পান করে যুগ-যুগান্তরের স্তন্য’; আমার তো জন্মের ঠিক নেই, বাপের ঠিক নেই, মায়ের ঠিক নেই। কতোজনের স্তন্য যে আমি পান করেছি, সেটাই একটা বিশেষ মুহূর্তে বেরিয়ে এলো। এটা নিতান্তই আমার গুরুদের আশীর্বাদ।

সুমন : কবীর দা, এটাকে তুমি একটা কালের সময়সীমায় বাঁধছো এবং প্রায় একটা গোটা শতাব্দীর গান আত্মস্থ করার কথা বলছো। আমি যদি কালের সময়সীমার পাশাপাশি ভৌগোলিক সীমাটাকেও ধরি, আজকে এই জাতীয় পুরস্কার, জাতীয় প্ল্যাটফর্ম সেই সিনেমাটাকে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতের মর্যাদা দিলো, যে সিনেমাটা খুব টিপিকালি বাঙালি, যার শিকড়টা একেবারে বঙ্গদেশের গভীরে আছে। তার মানে বাংলার সেই সময়ের কবিগান যেগুলো তুমি রিক্রিয়েট করেছো, তার আবেদনটা কি সর্বজনীন?

কবীর : এর মধ্যে কতোগুলো কথা আছে। আমার মনে হয়, প্রধানত এই গানগুলো তাদের হৃদয় ছুঁয়েছে এবং এ রকম জিনিস ভূ-ভারতে হয় না আজকাল। এর এক একটা গানের মধ্যে তুমি যা যা পাচ্ছো, তা তামাম হিন্দুস্তানের খুব নিজস্ব এবং সেটা শুধু এক জায়গাতে নেই। এই যে বললাম না, এর মধ্যে কাওয়ালি রয়েছেশোন রে বলি মূঢ়/ তোর ভেবে পাই না কুঢ়ো’ (হাতে তাল দিয়ে সুর করে গাইলেন); এর মধ্যে তুমি একটা ভোজপুরি গানের স্ট্রেইন পাচ্ছো। এ সবকিছু ছড়িয়ে পড়েছে তো।

সুমন : কিন্তু যেখানে বাঙালিই জানে নালহর আর খেউড়ের বাইরে কবিগান হয়সেখানে নিশ্চয় যারা জাজ করেছেন তাদের ...

কবীর : আমার মনে হয়, সুর-ছন্দ-তাল এবং তার প্যাশন; সোজা কথায় সঙ্গীত মানে দ্য মিউজিক অব ইট; আর কিচ্ছু না। যাক একটা উদাহরণ দিই, ধরো আমাদের সবার প্রিয় রূপঙ্কর যে গানটি গেয়ে সেরা প্লেব্যাক গায়কের শিরোপা পেলেন, সেই গানটা কীএ তুমি কেমন তুমি/ চোখের তারায় আয়না ধরো/ এ কেমন কান্না তুমি/ আমায় যখন আদর করো।’ এই গানটা হবার কথা একটা একতারার সঙ্গে, আর কিচ্ছু দরকার নেই। অর্থাৎ এই গানের মধ্যে কীর্তন ওতপ্রোতভাবে ঢুকে আছে।

আমি জানি না, এইভাবে দেশজ গানের চর্চা হিন্দি ছবিতে গত ৩০ বছরে হয়েছে কি না! তার আগে এটা হতো কিন্তু। আমি দক্ষিণ ভারতের সিনেমা সম্পর্কে খুব একটা জানি না, তবে ওরা অনেক বেশি রাগ-রাগিনীর চর্চা করে। তুমি অবাক হয়ে যাবে, হঠাৎ শুনলাম সিমেন্দ্রা মধ্যম রাগে একটা গান; তুমি যদি ইউটিউবে যাও, ওখানে নো ইউর রাগ আচ’ বলে একটা জায়গা আছে; ওমা, ওখানে গিয়ে তুমি দেখবেধরো, ত্রিলোককামদ রাগ লিখলে, এর তলায় লেখা থাকবে কোন হিন্দি বা দক্ষিণ ভারতের ফিল্ম সঙে এই রাগটা আছে। অথচ তুমি বাংলায় এটার উল্লেখ পাচ্ছো না।

আমার রাজ্যের বেশকিছু লোকের মস্তিষ্কে গোলযোগ দেখা দিয়েছে; সেটা আমরা বুঝতে পারছি, তবে পুরো দেশটা কিন্তু জাহান্নামে যায়নি; এটা সম্ভব হয়নি এখনো। আমার মনে হয়, যারা এই জায়গাগুলো দেখছেন, তাদের এসব গান শুনে কান খাড়া হয়ে যায় এটা ভেবে যে, এগুলো আমার।

সুমন : তোমার মনে হচ্ছে না যে, তোমার ডাবল প্রমোশন বা ট্রিপল প্রমোশন হয়েছে। তুমি বঙ্গরত্ন, বঙ্গবিভূষণ, বঙ্গ অমুক, বঙ্গ তমুক হলে না; তুমি সটান জাতীয় পুরস্কার পেলে এবং শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হলে।

কবীর : না না; আমি কী বলবো দেখো ... (হাসি)

সুমন : তুমি তো ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেয়ে নিলে।

কবীর : আমাকে ঘোড়া ডিঙোতে হয়নি, ঘোড়াই আমাকে ডিঙোচ্ছে। ব্যাপারটা এই রকম, ধরো আমাকে লোকে খুব পছন্দ করে না; পছন্দ করা হয়তো উচিতও না। আমার মতো লোক, যে এখানে জি হুজুর, ওখানে জি হুজুর করে না। সোজাসুজি বললে, এ ধরনের লোককে আসলে কেউ পছন্দ করে না। আমাদের বর্তমান সরকার বাহাদুর, তারাও যেমন সযত্নে এড়িয়ে গেছেন আমাকে। সবাই ধরে এনে অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজে খুঁজে দেখেতারা হয়তো জানে না, আমি কী চাইআপনি রত্ন, আপনি পরমেশ্বর ইত্যাদি পুরস্কার দিয়ে, দাঁত বের করে ছবি তুলে খবরের কাগজে ছাপে। সেখানে বলো, আমি কী করে ঢুকি! কারণ এতো না বলা লোক; আমি তো হ্যাঁ, হ্যাঁ বলা সঙ নই।

যেমন ধরো আমি গানবাজনা করি, আমার চেয়েও কম গানবাজনা করা লোক, কিংবা আদৌ গানবাজনা করেই না, লেখালেখি করে নাএমন লোক পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সঙ্গীত একাডেমিতে সি পি এম আমলে স্থান পেয়েছে। দেখো দুই আমলেই রাজ্য সঙ্গীত একাডেমিতে আমি ব্রাত্য। এর কারণটা কী; আমার ধারণা, নিশ্চয় আমার মধ্যে কিছু একটা আছে, যা ভাইব্রেশন দেয়; যাতে মনে হয়, লোকটা বেসিকালি খারাপ; আমার ভালো লাগছে না লোকটাকে।

সুমন : এখন প্রফেশনের জায়গায়, এই ভালো লাগাটা এবার বাড়বে।

কবীর : আমার মনে হয় না, সেটা খুব একটা হবে। একটু আগে যেমন সৃজিত আমায় ফোন করেছিলেন, উনি মায়ামিতে আছেন এই মুহূর্তে; উনি আমায় বললেন, খবরটা পেয়ে সুমন দা আমি সারাদিন কাঁদছি। আমি বললাম, কেনো? ও বললো, আমার মনে পড়ে যাচ্ছে সেই প্রোডিউসারদের মুখ, যারা আমায় বলেছিলো, কবীর সুমন যদি সঙ্গীত করে আমরা সিনেমা প্রযোজনা করবো না, টাকা দেবো না! আমার মনে পড়ে যাচ্ছে, খবরের কাগজে ছাপা তোমার সেই সব ব্যঙ্গচিত্রগুলো, তোমার নামে ছড়ানো কুৎসাগুলো, ষড়যন্ত্রগুলোসবকিছু আমার মনে পড়ে যাচ্ছে। আমার মনে পড়ছে, সেই সব লোকগুলোকে যারা গম্ভীর মুখে বলেছে, কবীর সুমন হলে আমি নেই, দেখবে তোমার বারোটা বাজবে।

কোথাও নিশ্চয় ব্যাপার একটা আছে, যারা ওইটা করছেন তারা হয়তো বাঙালি নন বা তাদের মধ্যে বেশিরভাগ লোক হয়তো বাঙালি নন। আমি হয়তো তাদের মাথায় নেই, তারা হয়তো সঙ্গীতটা শুনেছেন; বা রূপঙ্করের গলার যে প্রিস্টিন ব্যাপারটা, টিম্বারটা এবং যে অদ্ভুতভাবে গানটা গাইছেউইদ নো প্যাশন। আমি বারে বারে মনোমায়াকেও সেটাই বলেছিলাম ...।

সুমন : একেবারে আবেগ বর্জিত; আবেগটা বাড়ি রেখে এসে।

কবীর : ওকে বলেছিলাম, কিশোর কুমার যেভাবে গাইতেন সেইভাবে গাও, স্ট্রেইট। সোজা গলাটাকে ফেলো, সোজাজন্মের আগেও জন্ম/ পরেও জন্ম তুমিএমন স্ট্রেইট গাও। তুমি কি জানো, স্ট্রেইট গাওয়া কী শক্ত কাজ; খুব ছোটো ছোটো প্রিয় জিনিস বেরিয়ে পড়তে চায়; ওগুলোকে কাট করতে হয়।

সুমন :  যেমন সহজ কথাটা সহজে বলা যায় না, ঠিক সে রকমই।

কবীর : ঠিক ডাইরেক্ট টেস্টটা রূপঙ্কর আনতে পেরেছিলো ফাইনালি। আমার তো মনে হয়, সহসা এলে কী’ গানটার জন্যও ওর পুরস্কার পাওয়া উচিত, অসামান্য গেয়েছেন। এখন সঙ্গীতের উপাদানটাই হলো আসল কথা। আরো অনেক গান ছিলো, কিন্তু আমার মনে হয় না, সেগুলো নিয়ে আমাদের আলোচনা করার খুব একটা প্রয়োজন আছে, সেটার জায়গাও অন্য। মূল জায়গা কবিয়ালদের গান ...।

সুমন : কবীর দা তুমি ফ্ল্যাশব্যাকের কথা বলছিলে, প্রাথমিকভাবে তুমি তো এই প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিয়েছিলে। এমনকি প্রযোজক যাতে রাজি না হন, সেজন্য তুমি সম্মানী হিসেবে পাঁচ লক্ষ টাকা চেয়ে বসলে! তুমি বলছো, সিস্টেম তোমায় রিজেক্ট করে, তুমিও তো এই প্রস্তাবটাকে পর পর রিজেক্ট করেছো।

কবীর : আমি সিস্টেমকে রিজেক্ট করিনি, আমি সৃজিতকে রিজেক্ট করেছিলাম। সিস্টেমকে আমি রিজেক্ট করেছি অনেক কাল আগেআমার কাঁচকলা এসে যায়, সিস্টেমেরও কাঁচকলা আসে যায়। সিস্টেমেরও আমাকে দরকার নাই, আমারও সিস্টেমকে দরকার নাইসোজা কথা। খোলাখুলি বলছি, এমনিতে আমাকে কেউ মনে করে না, হঠাৎ এটার সময় কেনো মনে করছে! আমি বুড়ো হয়েছি, আমারও তো একটা জায়গা আছে, আত্মমর্যাদাবোধ আছে, বুঝতে পেরেছো? এমন তো না, আমি কালকের খোকা। ধরো, আমি এর আগে প্রভাত রায়ের সেদিন চৈত্র মাসএটা একটা পুরস্কৃত ছবিসেখানে শ্রেষ্ঠ গীতিকারের পুরস্কার পেয়েছিলাম, সেরা সঙ্গীত পরিচালকেরও। তারপর ধরো, মাধবী মুখোপাধ্যায়ের আত্মজা সিনেমায় কাজ করেছি; বীরেশ চট্টোপাধ্যায়ের ছবিতে কাজ করেছি; পান্না একটা ছবি করেছিলো, তাতেও আমি কাজ করেছি। বেশি কাজের আমি সুযোগ পাইনি, তবে যেটুকু করেছি, ডেলিভার তো করতে পেরেছি। এমন তো নয়, আমি ডেলিভার করতে পারিনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাকে পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে কিন্তু সবকিছু হচ্ছে!

একটা উদাহরণ দিই, তন্ময় বোস সুশিল্পী; চমৎকার তবলা বাজান; গানেও সুর করেন। এবং মোটেও সেটা খারাপ হয় না। শ্রীজাতের লেখা, ওর সুর করা একটা গান নিয়ে এসে উনি আমাকে বললেন, দাদা একটু চারটে লাইন গেয়ে দিতে পারবে? আমি বললাম, চারটে লাইন কেনো গাইবো? তারপর আমি বললাম, তুমি একটা কাজ করো না, পুরো গানটাই নাও, চার লাইন নিয়ো না। ওই ছবির প্রযোজক আবার আমার চেনা, তিনি সেই প্রযোজক সমেত এলেন। তাহলে আমি পুরো গানটা গেয়ে দেবো। প্রথমে ওরা গানটার অ্যারেঞ্জ ডি-তে (স্কেল) করেছিলো; আমি বললাম অতো চড়ায় আমি পারবো না, আমি তলায় গাই। তারপর গানটা প্রথমে আমি গিটার নিয়ে গাইলাম, শ্রীজাতের ভালো লেখা, তন্ময় চমৎকার সুর দিয়েছেন। ওরা সেটা শুনে বললো, হলো না, মিলছে না। পরে ওরা পুরো অ্যারেঞ্জমেন্ট পাল্টে দিলো। এবার এ-তে অ্যারেঞ্জ হলো, গান গেয়ে দিলাম, সবাই খুশি; কিন্তু গানটা সিনেমা থেকে বাদ গেলো। কেনো? তার কারণ তৃণমূলের [তৃণমূল কংগ্রেস] কার সঙ্গে যেনো পরিচালকের ভালো সম্পর্ক; তারা বলেছে আমার গান রাখা চলবে না। তাহলে হয়তো তারা ছবি রিলিজ করতে পারবে না, বা হয়তো ল্যাঙ মেরে ফেলে দেবে। আমি ঠিক জানি না আর কী কী করবে; হয়তো অ্যারোপ্লেন বানিয়ে ছুড়বে!

সুমন : তার মানে রাজনৈতিক কারণে তোমাকে ভিকটিমাইজ করা হয়েছে?

কবীর : হ্যাঁ, সে তো বটেই।

সুমন : তাহলে এখনো তো বলা হতে পারে, জাতীয় পুরস্কার কমিটি কংগ্রেস, পি সি এম, বি জে পি-কে নিয়ে চক্রান্ত করেছে!

কবীর : এই গানগুলোর সুর করতে কিন্তু শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটবে। রাজ্যসরকারের শরীর নামক এই চমৎকার জিনিসটির বিভিন্ন জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটতে থাকবে, বুঝতে পেরেছো? ওরা সেটা বলতে পারবে না। কিন্তু এর মধ্যে ওরা ছোটো করে বলবে, ইস্, মালটাকে ইয়ে করে ধরি, ইলেকশনের পর দেখা যাবে, সময় তো আছে।’

টাকায় চলে না কে কে? কতো চাই, সাহেব কতো খায়? কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়, বেরসিকে ভরে গেছে এই জায়গাটা। পুরো জিনিসটার মূলে একটা বেরসিকপনা এবং তুমি কেনো আমার নও? এ তুমি কেমন তুমি, আমার হলে না। তুমি অন্য জায়গায় যাচ্ছো কেনো, তোমার তো আমার ঘরে থাকা দরকার। এই হচ্ছে আমাদের জায়গাবাম আমলেও তাই, অবাম আমলেও তাই; ঘাম আমলেও তাই, কাম আমলেও তাইসব আমলেই তাই। রাজ্য এ রকম হয়ে গেছে; কিন্তু সুখের বিষয় যারা এই সিনেমাটার জুরি ছিলেন, আমার মনে হয় তারা এভাবে দেখেননি; তারা সঙ্গীতকে সঙ্গীত হিসেবেই দেখেছেন। কোন ব্যক্তি এটা করেছেন, তিনি কি কৃষাণজিকে চিনতেন? তিনি কি কোনোদিন ঝাড়খণ্ডে ঢুকে পড়েছিলেন? তিনি কি একটু বেশি মহিলা সঙ্গ করেনএইসব চিন্তা তারা করেননি। বিষয়টা বুঝতে পেরেছো? কিংবা তিনি কি আমার কথা মানবেন নাকি মানবেন নাএসব চিন্তাও তারা করেননি। তারা সঙ্গীতটা শুনেছেন।

সুমন : না, আমার একটা জিনিস ইন্টারেস্টিং লাগছে, সেটা হলো, যে কবীর সুমনকে ধারাবাহিকভাবে নানা দল, নানা মুখ, নানা অভিধানে এক সুরে মাওবাদী বলেছে; সেই কবীর সুমন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং স্বয়ং রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন!   

কবীর : এভাবে বলো না, এখনো পাইনি। দেখো, এই পুরস্কারটা আমার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো কাদের জন্য, জানো তো? আমার মনে হচ্ছে সেই ছেলেমেয়েদের কথা, আমি যখন প্রথম বুড়ো বয়সে গান গাইতে এলাম, তখন ৪৩ বছর বয়সওই বয়সে তো কেউ নতুন করে শুরু করে না; লেনার্ড কোহেন করেছিলেন এই বয়সে, কিশোর কুমারও একটু বেশি বয়সে নাম করেনতখন যে নবীনরা ছিলো তাদের কথা। বারেবারে আমি অপমানিত হয়েছি কারণে-অকারণে; আমাকে এই সিস্টেম অপমান করেছে। তারা কী-না করেছে! আমার মুখ ম্লান হয়েছে যখন, আমার গানের মুখ ম্লান করার চেষ্টা করেছে এই রাজ্যবিহার করেনি, উড়িষ্যা করেনি, কর্ণাটক করেনিবাঙালি করেছে। তখন এই নবীনদের মুখগুলো করুণ হতো, তারা কাঁদতো। আজ আমি বুড়ো হয়েছি, তারা বড়ো হয়েছে, আজ তারা হাসছে। এটাতে আমার বড়ো আনন্দ হচ্ছে! বড়ো সুখ পাচ্ছি, সেই করুণ হয়ে যাওয়া মুখগুলো হাসছে। সেসময় তাদের সেই মুখগুলো বারবার করুণ হয়ে যেতো, কারণ তাদের প্রিয় একজন সঙ্গীতকারকে সবাই মিলে ইট মারছে, মানে গণধর্ষণ।

দেখেন এখন সৃজিত যেটা বলছেন বিভিন্ন চ্যানেলে, প্রত্যেকে আমায় বাধা দিয়েছে কবীর সুমনকে দিয়ে এই কাজ না করানোর জন্য। এই নবীনরা এখন হয়তো অনেকে অনেক দূরে বসে আছেন, কেউ হয়তো আফ্রিকাতে, কেউ হয়তো চিনে, কেউ হয়তো ইংল্যান্ডে, আমেরিকায়তারা হাসছে আজকে। এটা হলো এক নম্বর বিষয়। আর দ্বিতীয়টি হলো, আজ আমার গুরুরা কেউ বেঁচে নেই। গতকাল আমার বাবার শতবর্ষ ছিলো, বুঝলে। আজ আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ বেঁচে নেই, আজকে আমার গুরু কালীপদ দাস বেঁচে নেই, মণি চক্রবর্তী মহোদয় বেঁচে নেই। আজকে অনিল বাগচী বেঁচে নেই। আজকে এরা কেউ বেঁচে নেই। এই গানগুলো তারা যদি শুনতেন না, তারা যে কী আনন্দ পেতেন! এগুলো তারা শুনতে পেলেন না। এবং যেটা চিন্তার সেটা হচ্ছে, জাতিস্মর চমৎকারভাবে নির্মিত একটা সিনেমা। সৃজিত প্রাণ ঢেলে দিয়েছেন, প্রযোজকরা কার্পণ্য করেননি। সবাই মিলে বাঘের বাচ্চার মতো লড়েছেন। ইন্দ্রজিৎ দাশগুপ্ত আমার সহকারী এবং ব্যাকগ্রাউন্ড যিনি করেছেন, ফাটিয়ে কাজ করেছেন। সবাই জান দিয়ে লড়েছে। কিন্তু রিভিউ যখন হয়েছে, কবিয়ালদের গানগুলো যথেষ্টভাবে আলোচিত হয়নি। এইখানটাতে একটা খামতি।

এটার একটা কারণ হতে পারে, আমাদের যারা রিভিউগুলো করছেন, তারা এক্সপোজ নন, তাদের হয়ে ওঠার পথে এ সঙ্গীতগুলো ছিলো না।

(চলবে)  

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন