Magic Lanthon

               

ফারুক আলম

প্রকাশিত ০৮ অক্টোবর ২০২৫ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

‘রাজকাহিনী’ : ‘বেশ্যাবাড়ি’র আঙিনায় মহাত্মাদের ছেলেখেলা

ফারুক আলম


নির্জন প্রান্তরে নিষিদ্ধ পল্লী। হলদিবাড়ি আর দেবীগঞ্জের মাঝখানে বেগমজানের কোটা। র‌্যাডক্লিফ সাহেব আঙিনার মাঝ দিয়ে বর্ডার লাইন এঁকে দিলেন। ছোটোখাটো শক্তিমানেরা বেগমজানের শক্তিকে ভয় পায়। বোস বাবুরা রাতের অন্ধকারে এ বাড়িতে আসেন বটে, কিন্তু দিনের আলোতে বেশ্যাদের উচ্ছেদ চান। নালিশ করেন হলদিবাড়ি থানায়; বলেন, আমরা দেবীগঞ্জ থানাতেও গেছিলাম হুজুর। ওরা বলল, ওটা ওদের থানার বাইরে। বিরক্ত ওসি শশী বাবু বলেন, ওটা হলদিবাড়ি থানার আওতায় পড়ে না। তার জেরাতে শেষ পর্যন্ত কাবু হন বোস বাবুরা। শশী বাবু বেশ স্পষ্ট করে বলে দেন, নিজে চিনি খাওয়া না কমালে, আর একজনের চিনি খাওয়া বন্ধ করবেন কীভাবে? সবাইকে ক্ষমতাশালীদের মন জুগিয়ে চলতে হয়; সে ওসি হোক কিংবা বেশ্যা। বোস বাবুদের দাবি নিরর্থক।

রংপুর স্টেটের নবাবদের আশীর্বাদের হাত যে মাথায়, সেই বেগমজানের ওপর আইন প্রয়োগ অসম্ভব। বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? তাছাড়া মাস্টার বাবুর মতো এলাকার প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতারাও বেগমজানের বশংবদ। তাই বোস বাবুর মতো গেয়ো ভাঁড় তো দূরের কথা, কোনো কেউকেটা গোছের লোক হলেও তাদের কথা মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না; কৌশলে তাদেরকে নাজেহাল করতে হয় বা ফিরিয়ে দিতে হয়। মেনে চলতে হয় বড়ো কর্তাদের কথা। যে রাষ্ট্রযন্ত্রের পাহারাদার শশী বাবুরা, সে যন্ত্রের মালিক কোনো দিন প্রজারা ছিলো না; আজও হয়নি; আগামীতেও হবে না। শশী বাবু খুব ভালো করে জানেন, রাষ্ট্রের মালিক সব দিনই ছিলেন রাজা বাহাদুরেরা; আজও আছেন। এই কাঠামোর বাইরে যাওয়ার সাধ্য কারো কখনো ছিলো না, এখনো নেই। তারা চিড়িয়াখানার খাঁচায় পোরা প্রাণীদের মতো বন্দি। বানর, হাঁস বা বাঘ-সিংহের বন্দিদশা ও স্বাধীনতার ফারাক এতো নগণ্য যে, তা আমলে না আনলেও চলে।

দুই.

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের দেশ বিভাগের কাহিনি নিয়ে সৃজিত মুখার্জীর রাজকাহিনী (২০১৬) চলচ্চিত্রের নামকরণ। কেন্দ্রীয় চরিত্রে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। চলচ্চিত্রের নাম কেন্দ্রীয় চরিত্র বেগমজান-এর নামে হলেও হতে পারতো, তা হয়নি। তবে চলচ্চিত্রটি অতীত-বর্তমানের ঐতিহাসিক ঘটনাকে মিশিয়ে শৈল্পিক রূপ দিয়ে আকৃষ্ট করেছে সবাইকে। একটি ঘরে বসে কয়েকজন মানুষের ইচ্ছায় একটি দেশের মাঝখানে সীমানা উঠে গেলো। রাতারাতি আপন জন্মস্থান হয়ে গেলো বিদেশ। মুহূর্তের সিদ্ধান্তে উদ্বাস্তু হলো লক্ষ লক্ষ মানুষ। যারা মাটির মায়ায় রয়ে গেলো নিজের ভিটেমাটিতে, তারা হলো নিজ দেশে পরবাসী। মানুষ মাটি কামড়ে পড়ে রইলো বলে শুরু হলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। রক্ত গঙ্গায় ভেসে গেলো হাজার হাজার মানুষের প্রাণ। ধর্ষিতার ক্রন্দনে, সর্বহারার বিলাপে আকাশ-বাতাস স্তম্ভিত হলেও রাজনৈতিক মহাত্মারা অনড়। তাদের দেশপ্রেমের নিদর্শনে গড়ে উঠলো চেক পোস্ট, বর্ডার।

নতুন দেশ, নতুন কাঠামো। মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বন্দি হলো পুরাতন শোষণযন্ত্রে বিনির্মিত নতুন রাষ্ট্র কাঠামোর পিঞ্জিরায়। তবুও মানবিক চিন্তা বিবেকবানের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। সাড়া দিয়েছে আবেগ-অনুভূতিকে। হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জেগে উঠেছে বারবার। রক্তক্ষরণ থামেনি। সাদত হাসান মান্তোর চিতরের রাজপুতদের ইতিহাস সমৃদ্ধ গল্পগ্রন্থ খলদো থেকে নেওয়া রাজকাহিনীর আত্মত্যাগী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে দেবীর মর্যাদা সম্পন্ন সতী রাজকন্যার মতো মৃত্যুবরণ করলো বেগমজান নামক এক বেশ্যা ও তার অনুসারীরা। সমস্ত রাজনৈতিক-কূটনৈতিক খেলা তাদের আত্মত্যাগের কাছে ম্লান হয়ে গেলো।

তিন.

চলচ্চিত্রের নাম হলো রাজকাহিনী। উৎসর্গ হলো পৃথিবীর তাবৎ উদ্বাস্তুদের জন্য। নীরবে লেখা হলো, সব নয়, কিছু চরিত্র কাল্পনিক। কিছু ঘটনা, কিছু স্থান-ও। শরণার্থী শিবিরের ভাঙা দেয়ালের মাথায় ব্রিটিশ সম্রাটের মুণ্ডু আঁকানো মুদ্রা নিয়ে খেলা করে দুটি বাচ্চা ছেলে; শুরু হয় চলচ্চিত্র; শুরু হয় খেলা। এ খেলা করপোরেট পুঁজির। এ খেলা পুঁজিবাদী সমাজের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে শক্তিশালী শোষণের হাতিয়ার বানানোর খেলা। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারের খেলা। আজন্ম লালিত শোষণমুক্ত স্বাধীন স্বদেশের বিপরীতে সাম্রাজ্যবাদী কলোনির চিন্তাধারায় পরিপুষ্ট বিভক্ত ভারতের ধর্মভিত্তিক দুটি আলাদা রাষ্ট্র নামক পুঁজিবাদের শোষণযন্ত্র বানানোর খেলা।

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের এদেশীয় অনুগামীরা স্বাধীনতার নাম করে জনগণকে অ্যানেসথেসিয়া বা চেতনানাশক ওষুধ দিতে সক্ষম হয়েছিলো; যেমনটা চেয়েছিলো ভাইসরয় ও র‌্যাডক্লিফ। তারা স্বাধীনতার জন্য ভারতকে ভাগ করে হিন্দুদের জন্য হিন্দুস্তান এবং মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান তৈরির কথা বললো। ভাইসরয়ের ঘরে বসে সভা হলো। র‌্যাডক্লিফ সাহেব ভারতকে পেন্সিল, স্কেল, কম্পাস ও ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে দ্রুত দুভাগ করে দিলেন। আজন্ম লালিত সংস্কৃতি, আত্মীয়স্বজন তো দূরের কথা পাহাড়, সমুদ্র, নদী, বিল, খাল, হাওড়, বাওড়, বনভূমি, পুকুর, বাগান কোনো কিছুই তার পেন্সিল কম্পাসের শক্তিশালী সুচের গতিকে রোধ করতে পারলো না। দুটি রাষ্ট্র বানাবেন তিনি; শক্তিশালী রাষ্ট্র। সে রাষ্ট্র কার শক্তি জোগাবে? পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তথা করপোরেট পুঁজির। এখানে রংপুরের দেবীগঞ্জ আর হলদিবাড়ির মাঝের কোনো এক বেগমজান নামক বেশ্যার পতিতালয় কোনো বাধা হতে পারে না। বরং গোটা ভারতবর্ষ হয়ে উঠলো বেগমজানের বেশ্যাখানা; তার মতোই অসহায়।

দিল্লিতে সংসদীয় সভা হলো। জায়গাজমি নিয়ে কামড়াকামড়ি বাঁধলো। হাইকোর্টে দুপক্ষের দাবি করা স্থানের ওপর শুনানি এবং অতঃপর রায়নিরাপত্তার জন্যে হিন্দুদের পাকিস্তান ছেড়ে হিন্দুস্তানে এবং মুসলমানদের হিন্দুস্তান ছেড়ে পাকিস্তানে পাড়ি জমাতে হবে। রায় কেউ মানতে চায় না। কেবা চৌদ্দপুরুষের ভিটামাটি, জায়গাজমি ছেড়ে যেতে চায়? যাবে না মানে! কর্তার ইচ্ছাতে কর্ম হবে। চারিদিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলো। হত্যা, খুন, ধর্ষণ, বর্বরতা। পশুকে ছাড়িয়ে মানুষ প্রমাণ করলো তারা পশুর চেয়েও অধম। পাশাপাশি মানুষ বাঁচাতে কতো মানুষ প্রাণ দিলো! লক্ষ লক্ষ মানুষকে ছাড়তে হলো ভিটেমাটি; হতে হলো দেশহীন রিফিউজি। এতো কিছুর পরেও ধর্মগত পরিচয়কে আমলে না এনে যারা দেশ ছাড়লো না, মাতৃভূমির মাটি কামড়ে পড়ে রইলো, তাদের হতে হলো নিজ দেশে পরবাসী।

চার.

১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে অন্যান্য ইউরোপিয়ানদের মতো ভারতে আসে। মুঘল সম্রাটের আনুকূল্যে তারা ব্যবসার দ্রুত বিস্তার ঘটায়। ১৬৯৩ খ্রিস্টাব্দে পত্তনি নেয় বাংলা মুল্লুকে; সমুদ্রপাড়ের তিন গ্রামের একটি জায়গাকলকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুর, যা আজকের কলকাতা। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে এদেশীয় বিত্তবানদের সহযোগিতায় ও কৌশলে তারা নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে কার্যত বাংলার শাসনভার দখলে নেয়। ভারত শাসন করে প্রায় দুশো বছর১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭। অবশ্য শুরু থেকেই স্বাধীনতার সংগ্রাম চলতে থাকে। ইংরেজরাও তা দমন করে সিদ্ধহস্তে। বহু নির্মম নিষ্ঠুরতার ভিতর দিয়ে ব্রিটিশ তাদের শোষণ-শাসন চালিয়ে গেছে। বহুধাবিভক্ত ভারতকে একত্র করে আধুনিক প্রশাসনিক শাসন দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে শোষণের শক্তিশালী রাষ্ট্র।

প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো মারাত্মক দুটি যুদ্ধ পেরিয়ে ভারত শাসনের আর ক্ষমতা ছিলো না ব্রিটিশদের। তাছাড়া নানান রাজ্যে সহিংস-অহিংসসহ নানামুখী আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে ওঠে। প্রথম দিকে ভারতীয় কংগ্রেস আবেদন নিবেদনের সংগঠন হলেও পরবর্তী সময়ে তা গণআন্দোলনের দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং কংগ্রেসের নেতৃত্বে সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে। এর নেতৃত্বে ছিলেন বল্লভ ভাই প্যাটেল, জওহরলাল নেহেরু, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, সুভাষ বসু, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রমুখ। কংগ্রেসের পাশাপাশি হিন্দু মহাসভা শক্তিশালী হয়; গঠন হয় মুসলিম লীগ। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি হিন্দু ও মুসলিম জাতীয়তাবাদ হয়ে ওঠে রমরমা। বিখ্যাত লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে মুসলিম লীগ দাবি জানায়, সব জাতির স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে তৈরি হবে স্ব স্ব স্বাধীন দেশ। যা পরবর্তী সময়ে রূপ নিলো ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের। মুসলিম লীগের নেতা জিন্নাহ স্পষ্ট জানান, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে মুসলমানদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হবে, যার নাম হবে পাকিস্তান।

ঘটনাক্রমে আগস্ট ১৯৪৭ ব্রিটিশ স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়। লন্ডন গোলটেবিল বৈঠকসহ কয়েকবার সভা বসে, কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারলেও তারা দেশ বিভাজনে র‌্যাডক্লিফ কমিশন গঠন করে। অবশেষে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য হিন্দুস্তান এবং একইভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য পাকিস্তান। বিভিন্ন এলাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। সব চাইতে মারাত্মক রূপ নেয় পাঞ্জাব ও বাংলায়।

পাঁচ.

আগেই বলেছি, বানপুর, বাংলা, রিফিউজি ক্যাম্প; ১৯৪৬-এ ভাঙা ঘরবাড়ির দেয়ালের উপর বসে ব্রিটিশ সম্রাটের মুণ্ডু মার্কা মুদ্রার টস দিয়ে দুটো ছেলে তাদের খেলা শুরু করলে চলচ্চিত্রও শুরু হয়। ব্রিটিশের লোভনীয় মুদ্রা করপোরেট পুঁজির নোংরা খেলার ইঙ্গিত দিলেইবা ক্ষতি কী! এ খেলা যে কতো মারাত্মক ও ব্যাপক হতে পারে তা বর্ণনাতীত।

বাবা খুঁজছে মেয়ে ফাতিমাকে। তাকে পাওয়া গেলো হাসপাতালে। গণধর্ষণে শারীরিক ও মানসিকভাবে তিনি অসুস্থ। হয়তো তিনি লাশকাটা ঘরেও পড়ে থাকতে পারতেন। হাসপাতালের বিছানা থেকে মর্গ নাকি বেশ্যালয়? জীবন মৃত্যুর কোনো ফারাক নেই এখানে। জীবনানন্দ দাশ জেনেছিলেন বড়ো গভীরভাবে। যদিও প্রশ্ন করেছেন, কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে? তবু তিনি জানতেন পঞ্চমীর চাঁদ ক্ষণস্থায়ী। তাই রাতের আঁধারে মাতৃভূমির এ বিভক্তিকে তিনি মানতে পারেননি। মহাপৃথিবীবলিল অশ্বত্থ সেই

জীবনের ক্লান্তি ক্ষুধা আকাক্সক্ষার বেদনার শুধেছিলো ঋণ;

দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে সব দেখেছি যেমনে হয় যেন সেই দিন।

এখানে তোমরা তবু থাকিবে না? ...

অথবা রূপসী বাংলাশ্মশানের দেশে তুমি আসিয়াছবহুকাল গেয়ে গেছ গান অথবা তবু তাহা ভুল জানিপ্রান্তরের কুয়াশায় এইখানে বাদুড়ের যাওয়া আর আসা; বরিশালের ধানসিঁড়ি নদী ছিলো যার অনুভূতির গভীরে; তার হৃদয় জগৎ দেশ বিভক্তিতে কতো যে ক্ষতবিক্ষত, তার প্রমাণ কবিতায় রয়ে গেলো চিরকাল। আমরা নতুন করে সে অনুভূতি ফেরত পাই, যখন ঠাম্মা রাজকাহিনি পড়তে থাকেন। তার পঠনে বেদনা, বিস্ময় ঝরে পড়ে। বুচকি প্রশ্ন করে, আমার বাবা কে? আমি কার সন্তান? আমরা কার পূজারি? শিব ঠাকুর আর সূর্য দেবতা কি এক? প্রশ্ন হাজার কিন্তু উত্তর একটাইঠাম্মার চড়, না হলে বিরক্তি।

এসব দৃশ্যে সহজে ভারতে মানব সভ্যতার ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। আর্য-অনার্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব-মিলন শিব ঠাকুর আর সূর্য দেবের পূজাতে উঠে এসেছে। স্পৃশ্য-অস্পৃশ্যতার কথাও এসেছে। এসব ধর্ম, জাতি, বর্ণ ইত্যাদি ভারতবর্ষের কঠিন কঠোর সমস্যা। তবে এর সমাধান হয়েছে বেগমজানের পতিতালয়ে। যৌনকর্মীর কাছে খদ্দের লক্ষ্মী। সে নিজের জাত বা খদ্দেরের জাত বিচার করে না। স্নানে শুদ্ধিনা শত গমনে শুদ্ধি? সেসব বিচার দর্শক করবে। কখনো কখনো মনে হয়, বর্ণাশ্রমের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে এই দেশ বিভাগ বুঝি একটা রাস্তা। তা তো নয়ইবর্ণবাদ যেমন পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের শোষণের হাতিয়ার, তেমনই দেশ বিভাগও নয়া কলোনিয়াল কৌশল। মানুষকে ঘরে পুরে হাত-পা বেঁধে মারতে যতো সুবিধা, মুক্ত প্রান্তরে মুক্ত অবস্থায় মারা ততো সুবিধাজনক হয় না। তবে দেশ বিভক্তির পরিবর্তে যদি সীমানাহীন পৃথিবী শোষণে সুবিধা হয়, পুঁজিবাদীরা তেমন পৃথিবী গড়তে বেশি সময় নিবে না; যেমনটা দেশভাগ করতেও নেয়নি।

ধর্মের জন্য দেশ বিভাগ হলো! হাজার হাজার ধর্ষিতার মধ্যে আমরা অল্পবয়সি ফাতিমাকে পেলাম বেগমজানের বেশ্যালয়ে। ঠাস ঠাস করে চড় মেরে বাস্তবে ফেরানো হলো তাকে। আমার ধর্ষিতা জন্মভূমিকে যেনো সজোরে চাবকাচ্ছে বেগমজান। তার প্রতিটি সশব্দ চড় কথা বলে ওঠেনে এই তোর দেশ; এই তোর স্বাধীনতা; এই তোর মুক্তি।

ছয়.

ভাইসরয় হাউজে সভা (৭ মিনিট ১১ সে.), নয়া দিল্লি, জুলাই ১৯৪৭। ঠাম্মার গল্প পড়া, আর সভা চলতে থাকে। ভাইসরয়প্রশ্ন তোলেন হিমালয় থেকে ভারত সাগর কতো নদী, ব্রিজ, গাছপালাপেন্সিল, কম্পাস আর ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে ভাগ করা গেলো বটে; কিন্তু পাঁচ হাজার বছরের এই সভ্যতার লোকেরা খুব বদমেজাজি, তাদের ভাগ করতে ওই সব জিনিস দিয়ে হবে না। জুলাই ১৭, ১৯৪৭ কলকাতা হাইকোর্ট (১০ মি. ২৭ সে.)। হাইকোর্টের পাশাপাশি বেশ্যাবাড়ির চিত্র। বেগমজান কুকুরকে খাওয়াচ্ছেন। তার খাবার খাওয়ানোটা প্রতীকী হয়ে ওঠে। মানুষের যৌনতার পরিতৃপ্তিতে সদা নিয়োজিত কর্মদক্ষতা বেগমজান নিজেই তুলে ধরলে, তার কর্মকুশলতা নিয়ে কারো কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

আগস্ট ১১, ১৯৪৭; দিল্লির ভাইসরয় হাউজ সুনসান। র‌্যাডক্লিফের বাউন্ডারি লাইন বাস্তবায়নে দাঙ্গা চলছে। ভাইসরয় মন্তব্য করেন, দেশ বিভাগের জন্য প্রয়োজন হবে রক্তাক্ত সার্জারি, তাই মানুষকে দিতে হবে স্বাধীনতার চেতনানাশক ড্রাগ। ঠাম্মা বুচকিকে বলছেন, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার স্মৃতিকথা। বুচকি প্রশ্ন করেবড্ড ছেলেমানুষি প্রশ্ন, কিন্তু মানুষের অন্তরাত্মায় তা অনুরণিত হতে থাকেঠাম্মা, হিন্দু মারা আর মুসলমান মারা কি এক কথা?

আগস্ট ১৪, ১৯৪৭-এর রাত ১২টার আগে মানুষ যখন গভীর ঘুমে নিমগ্ন, বেতারে (আকাশবাণী) তখন পাকিস্তানের স্বাধীনতা এবং রাত ১২টার পরে ভারতের (হিন্দুস্থানের) স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। ততোক্ষণে ক্যালেন্ডারের পাতায় ১৫ আগস্ট ১৯৪৭। কী চমৎকার পরিকল্পনা! বেগমজানের কোটাতেও উৎসবের ধুম লেগে গেলো, বিশেষত যখন কংগ্রেসের সক্রিয় কর্মী মাস্টার বাবু রঙ, মিষ্টি ও আতশবাজি সঙ্গে নিয়ে সেখানে উপস্থিত আছেন। ঠাম্মা শঙ্খ বাজাচ্ছেন, কেউ রঙ, কেউ মিষ্টির হাড়ি হাতে, আবার কেউবা আতশবাজি নিয়ে আনন্দ-উৎসবে ব্যস্ত। কিন্তু বেগমজান বেজার। তার কাছে এসব অর্থহীনই শুধু না, লোকসানের কারণও বটে। এক মেয়েকে তিনি সজোরে চাপট লাগান; মাস্টারকে শাসান, অপমান করেন। অন্যরা আপত্তি জানায়। মাস্টারের মুখে দেশপ্রেমের কথা শুনে তার সন্দেহ জাগে। পোড় খাওয়া মানুষ তিনি। কয়লা আর হীরের খনি চিনতে তার ভুল হয় না। এসব তোফা এনো না মাস্টার; আমরা কারো ঋণ রাখি না। যদি ক্ষমতা থাকে পয়সা খরচ করে একটা যৌনকর্মী ঘরে নিয়ে মহত্ত্বের প্রমাণ দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে স্থান ত্যাগ করেন বেগমজান। তার কথা শুনে অন্যরা মাস্টারের সঙ্গে রঙ্গ-তামাশা করে (২৮ মি. ৩৩ সে.)। তিনি যে অসাধারণ নন, তার মনের পাথরে খোদাই করা চিরকালের বাসনার বিবর্ণ বর্ণমালা পড়তে সময় নেননি বেগমজান। অন্যরাও তা বুঝে ফেলে। তাকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করে।

অনেকে আবার ভুল পথে চলতে ভালোবাসে; দুলি তেমনই। তিনি মাস্টারের প্রেমে পড়েন। মানুষ চিনতে ভুল করেন। দেশ স্বাধীন হলেই যে, ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামীরা অতিমানব বা খাঁটি প্রেমিক হয় না, সে কথা দুলি বোঝেন না। রাজনৈতিক কর্মীরা যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আত্মকেন্দ্রিক বা সুচতুর, স্বার্থপর তা তার জানা ছিলো না। দুলি মন-প্রাণ উজাড় করে মাস্টারকে ভালোবাসেন; বেগমজানের সঙ্গে বিরোধ পর্যন্ত করেন। বেগমজানের সতর্ক সঙ্কেতকে তিনি আমল দেন না। কাচ আর হীরার পার্থক্য বুঝতে পারেন না। আপনজন, বেগমজানকে মনে করেন শত্রু। সশস্ত্র প্রশিক্ষণের সময় মাস্টারকে পাওয়ার জন্যে মনে মনে বন্দুক তাক করে, হত্যা করতে চান আশ্রয়দাতা, প্রাণরক্ষাকারী বেগমজানকে! যখন তার বোঝার সময় আসে তখন রাত অনেক গভীর। মাস্টার তাকে বিক্রি করে খরিদ্দারের গাড়িতে তুলে দিয়েছেন; বুঝিয়ে দিয়েছেন বেশ্যাদের বর হয় না, বাবু হয়।

সাত.

ভাইসরয় হাউজ দিল্লি, আগস্ট ১৭, ১৯৪৭। দেশের কর্ণধারেরা বসেছে। জিন্নাহ, নেহেরুসহ নেতৃবৃন্দ হাজির। সবাই ভাইসরয়ের সঙ্গে একমত। দেশ বিভাগ চূড়ান্ত (২৯ মি. ৪৫ সে.)। বাংলা হবে দুই ভাগ।

হলদিবাড়ি ও দেবীগঞ্জ টাউনের মাঝখানটাতে র‌্যাডক্লিফের লাইন অনুযায়ী কাঁটাতারের বেড়া ও তিন মাইল অন্তর-অন্তর বর্ডার চেকপোস্ট বসানোর দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন দুই কর্মকর্তাহিন্দুস্তানের কংগ্রেস প্রতিনিধি গোকুল এবং পাকিস্তানের মুসলিম লীগ প্রতিনিধি ইলিয়াস। বাল্যকালের বন্ধু দুজন, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় সব হারিয়ে একা। অভিনয় করছেন শত্রু দেশের দুই সৈনিক হিসেবে, যেনো চির শত্রুতার বন্ধনে আবদ্ধ। দুই জনের আলাপ সুখ-দুঃখের কথা, মান-অভিমানের পালা, রাজনৈতিক আবহে আটকে যায়। দুজন স্পষ্ট করে বুঝেছে, ধর্মীয় পরিচয় মানুষকে যে কাঠামোতে আবদ্ধ করে তা খুবই মারাত্মক। চিন্তা, চেতনা, অনুভূতি, বিস্ময়কর রকমের অমানবিক হয়ে পড়ে বলে, এখন আর আমার পক্ষে তোকে ঘৃণা করা কঠিন কিছু নয়। তবুও সব ছাড়িয়ে অন্তরের কথা হৃদয়ের অভিব্যক্তি ব্যক্ত হয়। কাজের পরিকল্পনাও হয়; তিন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে।

প্রতি মুহূর্তে কাজের অগ্রগতির খবর কেন্দ্রীয় সরকারকে জানাতে হবে। দুই থানার দুই দারোগাকে খবর দেওয়া হয়। তারা ভ্যানে করে পুলিশ নিয়ে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। ইলিয়াস বলেন, দেশ ভাগ হয়ে দুটো দেশ হয়েছে। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা হয়েছে হিন্দুস্থান এবং মুসলিম প্রধান এলাকা পাকিস্তান। র‌্যাডক্লিফের লাইন অনুযায়ী দুই দেশের সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া বসবে। চেকপোস্ট বসবে। তারপর পারাপার হতে হলে পাস লাগবে। দেবীগঞ্জ থানার ওসি আকতার মিঞার সোজাসাপ্টা প্রশ্ন—‘এ্যা, কইতেছিলাম দিল্লির, অমৃতসর, লাহোরের মতো দাঙ্গা হইবো নাতো? পাকিস্তানের মুসলিম লীগ প্রতিনিধি ইলিয়াস স্পষ্ট উত্তর দেন—‘হতে পারে। কিন্তু তার দায়িত্ব পাকিস্তান বা মুসলিম লীগ নেবে না। যারা পার হতে চায়, তাদেরকে এখন পার হতে হবে। এরপর পারমিট লাগবে। দাঙ্গা হবে, সংখ্যালঘুদের কচুকাটা করা হবে। মানুষ জন্তু হয়ে যাবে। এটা মোটেও বেগমজানের রেন্ডিখানার দালাল সুজনের অভিনয় করে দেখানোর মতো নয়, জানোয়ারের থেকেও ভয়ঙ্কর। দুই কর্মকর্তা র‌্যাডক্লিফের বর্ডার লাইন সরেজমিন দেখার জন্য মাঠে নামে। অবাক কাণ্ড, বাইনোকুলারে দেখা যায় একটা বাড়ি। বাড়ির পাশেই হবে বর্ডারের চেকপোস্ট। গোকুল শশী বাবুকে জিজ্ঞাসা করেন, ওটা কী শশী বাবু?

কশী বাবু : বাড়ি, শহর বা গ্রামের শেষ প্রান্তে যেমন থাকে ।

ইলিয়াস : দরগা?

আকতার : তওবা-তওবা, ওয়াসতাগফিরুল্লা।

তাহলে, এমন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কোনো বাড়ি থাকলে চলবে না, ভাঙতে হবে। ওসি আকতার প্রশ্ন তোলেন, একটুআধটু বাদ দিলে চলবে কি না? ইলিয়াস রাগ করেনসেতো সেখানে যেয়ে দেখতে হবে। আচ্ছা বলুন তো আপনি এতো ভয় পাচ্ছেন কেনো? উত্তরটা দেন শশী বাবুথামুন আকতার মিঞা, কইতে কইতে কিয়ামত আইয়া পড়বো। আমি কই, বেগমজানের ইতিবৃত্ত যতোটুকু পারেন শোনান। বেগমজান মানে যিনি কোটা চালান, খুব জাঁদরেল মহিলা হুজুর। মুখের কোনো লাগাম নেই, হাতেরও নেই। না, মানে ওনার অনেক বড়ো বড়ো বাঁধা বাবু তো, নবাব-সাহেব-জমিদার। তাই ওসব আইনকানুনেরও কোনো তোয়াক্কা তিনি করেন না। এখানকারই মেয়ে। কচি বয়সে বিধবা। কারা যেনো বেশ্যাখানায় বিক্রি করে দেয়। সেখান থেকে চলে যান লক্ষ্ম্যেই; নাচগান শেখেন; বাঈজি হিসেবে খুব নাম করেন। তারপর এখানে এসে কোটা খুলে বসেছেন। অবশ্য সবাই সন্দেহ করে রংপুর স্টেটের নবাবের হাত আছে তার মাখার ওপর।

ইলিয়াস সাহেবের ভাষ্যখুব খারাপ খবর আছে আকতার মিঞা। র‌্যাডক্লিফের ম্যাপ অনুযায়ী এই বাড়ির মাঝখান দিয়ে কাঁটাতার বসবে।

শশী প্রশ্ন করেন, তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন, এই বাড়িটার উঠোনের একদিক হিন্দুস্তান, অন্যদিক পাকিস্তান? ইংরেজরা কাজ পায়নি, তাই ইঁদুর-বিড়াল খেলেছে। কথা ঘুরিয়ে আবার বলেন, যা করেছে নিশ্চয় ভেবেচিন্তে করেছে।

রাষ্ট্রের কাজ নিয়ে খুব বেশি কথার আর দরকার হচ্ছে না। সীমানার মধ্যে মানুষকে আটকে ফেলার জন্য যা যা দরকার শুরু হয়ে যায়। এখানে মানবিকতার কোনো স্থান নেই। কাঠামো চাই কাঠামোতা হতে হবে শাসকদের ইচ্ছানুযায়ী।

দুই কর্মকর্তা কাগজপত্র প্রস্তুত করে ইরাডিকেশন নোটিশ জারি করতে বেগমজানের কোটায় হাজির হন। সঙ্গে সেই আইনের দুই রক্ষক তাদের সঙ্গী। বেগমজান ও শশী বাবুর কথোপকথনে বোঝা যায়, তারা পূর্বপরিচিত এবং সম্পর্কটা আদৌ মধুর নয়।

শশী : সেলাম আলেকুম বেগমজান, সব ঠিক আছে তো?

বেগমজান : ওয়ালাইকুম আসসেলাম। ঠিক ছিলো, তোমার মুখটা দেখার আগে অবধি।

শশী : না, বেগমজান, আমার থেকে দুটো জরুরি মুখ কিন্তু এখানে উপস্থিত আছে।

বেগমজান : দেখো, আগের মতো যদি মুফতি-টুফতি করতে এসে থাকো, তবে আগের বারের ইয়াদটা মনে রেখো।

শশী : না, না।

বেগমজান : এসব সরকারি লোকজন বহুত অত্যাচার করে।

সরকারি লোকজন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে অত্যাচার যে করে, তা বেশ্যাখানার লোকজন এতো ভালো করে জানে বলে বেগমজান তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন। বেশ্যাদেরকে লড়াই করে বাঁচতে হয়; বাঁচতে হয় নানান কৌশলে। অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে কোনো ছাড় দিলে টেকা যাবে না, তা তারা ভালো করে জানে। বাড়ির উঠোনের মাঝ দিয়ে হিন্দুস্তান-পাকিস্তানের বর্ডার লাইন শুনে বেগমজান হাসতে থাকেনএ কেমন কসাই যে দেশটাকেও ভালো করে কাটতে পারলো না; এর থেকে তো বাজারের কসাই অনেক ভালো; কলিজা চাইলে কলিজা আর মাংস চাইলে মাংস দেয়। এরপর এক মাসের মধ্যে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিলে বেগমজান ঘোষণা করেন, কোনো দেশ বিভাগ তিনি মানেন না (৫৬ মি. ২১ সে. থেকে এক ঘণ্টা সাত মি. ৪৪ সে.)। বাড়ি খালি করা তো দূরের কথা, পার্টিশনের কথা ফের বলতে এলে, তার ধড় থেকে মুণ্ডুটার পার্টিশন করে দেওয়া হবে; পুতে রাখা হবে এই উঠোনে। সেলিম, রুবিনা, দুলি, ফুলি সবাই অস্ত্র, লাঠি, দা, বটি ইত্যাদি নিয়ে আক্রমণে উদ্যত। বেগমজান পরিস্থিতি সামাল দেন। এরা মেহমান; না হলে সেলিম সবাইকে শেষ করতে পারতেন। বিশেষত দেশ যখন অস্থির, পার্টিশন নিয়ে নিত্য দাঙ্গা লেগেই আছে; মানুষের জীবনের মূল্য যখন কানা কড়িও নেই। লড়াইয়ে যখন জীবন বাজি রাখতেই হবে, আজই তারা শুরু করতে পারতো; করেনি। বাড়ির মেহমানকে তারা হত্যা করেনি। মানবিক কারণে, চিরাচরিত সভ্য জগতের আচরণ মেনে চলেছে।

অথচ সভ্যতা সুযোগ পেয়েই তাদের ওপর বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে। ভোগবাদী সমাজের পণ্য ব্যবস্থাপনার শিকার হয়ে সমাজ বিবর্জিত জীবন যাপন করতে হয় তাদের। তাদের অশ্রুর দাম এ সমাজ দেয় না। তারা জানে এসব দেশ বিভাজন, দেশপ্রেম, স্বাধীনতা সব অর্থহীন শব্দ সম্ভার। ইংরেজ, মুসলমান, আর্য, হিন্দু শোষণের বেলায় সবাই এক। রাষ্ট্র এক শোষণযন্ত্রএকটা ফর্ম। এই কাঠামো দিয়ে শোষণ করা যায়। শোষণকে আরো তীব্রতর করা যায়শোষণ মুক্ত করা যায় না। বেশ্যাতন্ত্র উচ্ছেদ করা যায় না। রংপুর স্টেটের নবাবের শরণাপন্ন হয়ে বেগমজান নিরাশ হন, মাস্টারের পুনর্বাসন ব্যবস্থাকে তিনি অন্যের জন্যে যৌনদাসী হওয়ার নামান্তর মনে করেন। বেগমজান জানেন, এ সমাজ তাদেরকে এই দাসত্ব থেকে মুক্তি দিবে না। বাঁচতে হলে নিজের মতো করে বাঁচতে হবে। অপমানের জীবন থেকে মৃত্যুই শ্রেয়। তাই তিনি সেলিমের সঙ্গীদের অস্ত্র নিয়ে, সবার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। সবাইকে নিয়ে শেষ লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেন।

আট.

দুই বন্ধু উচ্ছেদ অভিযানের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করলে সত্যটা সামনে চলে আসে। চৌদ্দপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে কেনো মানুষ অচেনা-অজানা জায়গার অনিশ্চিত জীবন মেনে নিবে? গোকুল তাকে নিশ্চয়তা দেনসহজে মানুষ না মানতে চাইলে দাঙ্গা বাধালে তারা যেতে বাধ্য হবে। অবশ্য তখন তাদের অনেক মূল্য দিতে হবে (এক ঘণ্টা ১৭ মিনিট ২৯ সে.)।

মানুষ ভিটেমাটি ছাড়তে শুরু করে (এক ঘণ্টা ১৯ মি. ১৪ সে.)। নতুন ভিটের সন্ধানে বাস্তুচ্যুত উদ্বাস্তু হয়ে যায় লক্ষ লক্ষ মানুষ। জীবনানন্দের কথা মনে পড়ে, যে জীবন ফড়িংয়ের, দোয়েলেরমানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা। বেগমজান দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তিনি বাড়ি ছাড়বেন না। নবাব তাকে বলেন, বেগমজান তুমি বাড়ি ছেড়ে দাও। বেগমজান তাকে অবজ্ঞা করে এড়িয়ে যান। মাস্টার তাকে ভালোবাসার কথা বলেন; নতুন করে বেঁচে থাকার কথা বলেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, পাশে দাঁড়ানো মানে পাশে শোওয়া না মাস্টার। মাস্টারকে বেগমজান তাড়িয়ে দেন। ফের তার বাড়িতে পা রাখতে নিষেধ করেন। এই সমস্ত ক্ষমতাবান পুরুষ, রাজনৈতিক নেতাদেরকে বেগমজান চিনতেন। এরা বেশ্যাদের মতোই সবার সঙ্গে শুতে অভ্যস্ত; পুঁজিতন্ত্রের দালাল; পরিস্থিতি সামলাতে নিজেকে বদলাতে সময় নেয় না। প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এরা দাঁড়াবে তো না-ই, প্রয়োজনে স্ত্রী, মা, মেয়ে সবাইকে এমনকি নিজেকেও বিক্রি করে দেয়।

এখানে মধ্যবিত্ত রাজনৈতিক নেতা মাস্টার, নিজের চরিত্র একটু পরেই উন্মোচন করে ফেলেন। মিথ্যা ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে কব্জা করেন এক যৌনকর্মীকে। তাকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে বিক্রি করে দেন। কবিরের সঙ্গে চুক্তি করেন। এক গাড়িতে করে এগিয়ে যান। বেগমজানের কোঠার দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন, সন্ত্রাসীদের আক্রমণে বেগমজান কখন পরাজিত হয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাবে তার জন্যে।

গোকুল ও ইলিয়াস বেগমজানের কাছে লোক পাঠান। ফিরে এসে তারা বলেন, হুজুর পাঠানটা (সেলিম) আমাদেরকে বড্ড মেরেছে। আপনাদেরকে পেলে মেরে পুতে রাখবে বলেছে। তারা পরিস্থিতি বোঝে, বাড়ি উচ্ছেদে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাহায্য পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। তাই চটজলদি কাজ সারার জন্য তারা অমানবিক বাঁকা পথ বেছে নেয়। বেগমজানের সঙ্গে শশী বাবু আলাপ করতে গিয়ে আক্রান্ত হন। সেলিম তার গলায় ছুরি ধরে বেগমজানের কাছে নিয়ে যান। বাকবিতণ্ডা জমে ওঠে

শশী : আমি তোমাদের ভালোর জন্যে বলতে এসেছি, এ বাড়ি তোমরা ছেড়ে দেও বেগমজান।

বেগমজান : ক্যানরে এটা তোর বাবার বাড়ি, নাকি তোর মা এখানে কাজ করে?

শশী : এই খানকি ...!

বেগমজান : ... ডাক্তারকে ডাক্তার, মোক্তারকে মোক্তার আর খানকিকে খানকি বললে বুঝি গাল দেয়া হয়! 

বেগমজান তার পেশা পরিচয় এবং সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে সচেতন। বেশ্যাবৃত্তি’কে তিনি পেশা হিসেবে নিয়েছেন। তিনি জানেন, এ সমাজে যৌনদাসীদের কতো অমর্যাদা। তাই তিনি তার বাড়ি ছেড়ে কোনো প্রকার অনুকম্পার আশ্রয় নিবেন না।

নয়.

গোকুল ও ইলিয়াস যান মিঠিগঞ্জ। আলাপ করেন কবিরের সঙ্গে। কবির নিজের পরিচয় এভাবে দেয়গুণ্ডা-মাস্তানদের কোম্পানি চালাই হুজুর, নাম কবির। আমি হিন্দুও, মুসলমানও। গায়ে পৈতে, নীচে সুন্নতও দেওয়া আছে হুজুর। ঘরে নামাবলি টুপি দুই-ই আছে। কখন কোনটা লাগে! ধর্মনিরপেক্ষ হুজুর। তারা (গোকুল ও ইলিয়াস) বেগমজানের বেশ্যাবাড়ি উচ্ছেদের জন্য কবিরের দলবলকে ভাড়া করে আনে।

কবিরের কর্মকাণ্ড শুরু হয়। বেগমজানকে তার পোষা কুকুর-শেকুরের মাংস রান্না করে পাঠানো হয়। তারা বুলুকে মেরে টাঙিয়ে রাখে পথের ধারে। খাওয়ার সময় যাতে এসব লেখা চিঠিটা হাতে পায় বেগমজান, তার ব্যবস্থা করে। একটু পরে ক্লাইম্যাক্স আরো স্পষ্ট হতে থাকে। বাজার থেকে ফেরার পথে সুজনকে ধরে চার টুকরা করে ফেলে তারা। বস্তা বন্দি লাশ ফেলে যায় বাড়ির পাশে। সুজনকে দাহ করে ফিরে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন বেগমজান। সশস্ত্র লড়াইয়ের পাশাপাশি তিনি আইনি লড়াইয়ের জন্য বিপিন বাবুর মাধ্যমে উকিল নিয়োগের চিঠি লিখেন। সময় বড়ো কম। আক্রমণ আসন্ন। সেলিম শুধু তার প্রহরী নয়, ঘনিষ্ঠ জনও বটে। সেলিম ইংরেজ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামী। তার সঙ্গীদের রেখে যাওয়া হাতিয়ার সুরক্ষার ব্যবস্থা করছেন তিনি। সেই অস্ত্র দিয়ে বেগমজানের মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। আত্মরক্ষার লড়াই আসন্ন। সবাইকে ডেকে তিনি তৈরি হতে বলেন। 

মাঝরাতে যুদ্ধ শুরু হয়। বেশ্যার হাতে বেআইনি অস্ত্র। তাদের উচ্ছেদে কবিরের ভয়ঙ্কর দলবল। তাদের হাতে পুলিশের আইনি হাতিয়ার। পুলিশ পাহারায়, ওসি আকরাম সময় মতো এসে যাবেন। যেনো কেউ পালিয়ে বাঁচতে না পারে তার জন্য শশী বাবু বাড়ির পিছনে। তিনি ধরে ফেলেন বুচকি, তার মা ও ফাতেমা ওরফে শবনমকে। কাপড় খুলে ফেলে বাচ্চা মেয়ে বুচকি। নগ্ন বুচকির দেহ দেখে ওসি শশী বাবু বমি করতে থাকেন। ওদেরকে ছেড়ে দেন।

বন্দুকযুদ্ধে টিকতে না পেরে চারিদিক থেকে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে ছুটতে থাকে কবিরের লোকেরা। বেগমজানেরা গুলি করে মারতে থাকে ওদেরকে। কিন্তু অতো লোককে এক সঙ্গে মারার মতো হাতিয়ার তাদের ছিলো না। চারিদিক থেকে অসংখ্য জ্বলন্ত মশাল বাড়িতে পড়তে থাকে; আগুন লেগে যায়। শেষে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যুদ্ধ করতে থাকে তারা। সেলিম শত্রুকে তাড়িয়ে নিয়ে যান। কিন্তু শত্রুরা ঘিরে ধরে তার গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। প্রিয় সহচরকে আগুনে জ্বলতে দেখে বেগমজান ও তার মেয়েরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। বেগমজান সেলিমের কষ্ট কমিয়ে দেন। গুলি করে মৃত্যু ত্বরান্বিত করেন। আর নিজেরা জ্বলন্ত বাড়িতে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেন।

অবাক কবির। অবাক ইলিয়াস ও গোকুল। অবাক দর্শক। ঠাম্মা তার রাজকাহিনি পড়তে থাকেন। চিতরের সেই বীরত্বগাথা। সতীত্বের সেই লড়াইয়ের গল্প বেগমজানকে আরো মহিমান্বিত করেন। বেশ্যা হয়ে ওঠে সতী। মহাত্মাদের পাপ পতিতালয়ের আঙিনায় জ্বলতে থাকে। জ্বলছে মানুষের বাসস্থান। জ্বলছে স্বদেশ। বিভাজনের রাজনীতিতে বিভক্ত উপমহাদেশ। সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবৃক্ষ রোপিত হয়েছে, তার বিনাশ এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নেই। বিকশিত পুঁজি যে বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনার জন্ম দেওয়ার কথা ছিলো, তা আটকে গিয়েছে সঙ্কীর্ণতার চোরাবালিতে।

দশ.

সৃজিত মুখার্জীর রাজকাহিনী ভারত বিভাজনের রাজনীতির কাহিনি হলেও মূলত অতি সাধারণের বেদনার কাহিনি। সর্বস্ব হারানোর কাহিনি। উদ্বান্তুদের হৃদয় নিংড়ানো নির্যাস। বেশ্যারা এখানে সত্যিকারের মানুষ। ঘটনা প্রবাহে অমানুষদের মুখোশ খুলে গেছে অবলীলায়। প্রশ্নভারত বিভাজন ছাড়া আর কি কোনো উপায় ছিলো; না, ছিলো নাইতিহাসের উত্তর। কিন্তু সত্যি হলোএই পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিলো। ভারতীয় উপমহাদেশে বর্ণবাদ তথা ব্রাহ্মণ্য সমাজব্যবস্থা প্রতিটা অঞ্চলের যে বিশেষ বাস্তবতা তৈরি করেছিলো, তা মেনে নিয়ে কনফেডারেশন তৈরি আবশ্যক ছিলো। গণতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্র সে যাই হোক না কেনো, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুঁজিবাদের হাতেই থাকবে। ব্রিটিশদের কমনওয়েলথ দেশের সংখ্যা বাড়িয়ে তাদের লাভালাভ তারা হিসেব কষেই এগিয়েছিলো। অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর মাজাভাঙা সাবেক ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের স্থলে নয়া সাম্রাজ্যবাদী শাসনকে পোষ মানানোর এটাও একটা কৌশল।

আর কি হে হবে দেখা? কপোতাক্ষ নদ শুকিয়ে গেছে। তার সঙ্গে মাইকেল মধুসূদনের দেখা হয়নি। আর কারো সঙ্গে দেখা মিলবেও না। তবে যশোরের সাগরদাঁড়িতে এসে শুকনো নদ যে কেউ দেখতে পারে। পুঁজিবাদের প্রয়োজনে, বাজারব্যবস্থার কারণে, যেকোনো সময় র‌্যাডক্লিফের বাউন্ডারি লাইন খসে পড়লে তা কোনো বিস্ময়কর কাণ্ড হবে না। এবং তা হতেই পারে। এসব হলে কারো তেমন একটা লাভ-ক্ষতি হবে না। শ্রমবাজারের বিকাশ এখন করপোরেট পুঁজির অন্তরায় নয়। বরং বড়ো বাজারে মুক্ত প্রবেশাধিকার বড়ো প্রয়োজন। বাণিজ্য ঘাটতি পুষিয়ে নিতে এখন নানারকম জোট হচ্ছে। জোটের জোর বাড়লে, সাধারণের জোর বাড়–ক আর নাই বাড়ুক, বিশ্ব পুঁজিবাজারে তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক বিপরীত ব্যবস্থার কারণে মানবসমাজ থেকে শোষণের খেলা বন্ধ হতে পারে। মানুষ যদি শোষণ মুক্ত হতে চায়, তবে তাকে কাঠামোর বন্ধন মুক্ত হতে হবে। রাষ্ট্র কাঠামোর বিপরীতে সারাবিশ্ব হবে তার নিজস্ব আবাস। তা সে গড়ে তুলবে-ই। তখন এসব পাকিস্তান-হিন্দুস্তানের ছেলেখেলা হবে পাগলামির কারণ ও ফলাফল গবেষণার বিষয়বস্তু।

লেখক : ফারুক আলম, সাহিত্যিক ও ছড়াকার। তিনি একটি বেসরকারি কলেজে ইংরেজি সাহিত্য পড়ান। তার প্রকাশিত ছড়ার বই গোলাপ-কাঁটা

falamsmc@gmail.com

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন