মাহামুদ সেতু
প্রকাশিত ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
সতীর্থের চোখে আব্বাস
মাহামুদ সেতু

সতীর্থের চোখে আব্বাস
ইরানি চলচ্চিত্রের অন্যতম পুরোধা আব্বাস কিয়ারোস্তামি ৪ জুলাই ২০১৬ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আব্বাস স্মরণে নিউইয়র্কের স্কুল অব ভিজ্যুয়াল আর্টস-এর থিয়েটার হলে এক শোকসভার আয়োজন করে তার দীর্ঘদিনের বন্ধু ও সহকর্মী পিটার স্কারলেট ও নাজি বেগলারি। এতে আব্বাসের বন্ধুবান্ধব ও গুণগ্রাহীরা তাকে স্মরণ করেন এবং কথা বলেন তার সৃষ্টি নিয়ে। শোকসভায় আব্বাসের স্মরণে শ্রদ্ধা জানিয়ে কথা বলেন তার বন্ধু মার্টিন স্করসিস, জিম জারমুচসহ অনেকেই। অবশ্য এতে বিখ্যাত অভিনেতা, প্রযোজক রবার্ট ডি নিরো’র উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে নিউইয়র্কে না থাকায় তিনি উপস্থিত হতে পারেননি। শোকসভায় দেওয়া বক্তব্যগুলো সংক্ষিপ্তাকারে ম্যাজিক লণ্ঠন-এর জন্য বাংলায় ভাষান্তর করেছেন মাহামুদ সেতু।
‘আব্বাসের চলচ্চিত্র নতুন করে
চলচ্চিত্রকে সংজ্ঞায়ন করেছে’
মার্টিন স্করসিস
আসলে বুঝতে পারছি না, ঠিক কীভাবে শুরু করবো। আব্বাসের সঙ্গে আমার চেনাজানা ১৪ বছর ধরে। উনার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ছিলো ২০১৭-তে, সেমিনার বা এই ধরনের কোনো একটি প্রকল্পে একত্রে কাজ করার জন্য। বললামই তো, গত ১৪ বছর ধরে উনার সঙ্গে পরিচয়; এ সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তেই আব্বাসের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। নিউইয়র্কের মতো বড়ো শহরে চলচ্চিত্র শিক্ষার্থীদের জমায়েতে বা সেমিনারে আমরা কথা বলেছি, নিদেনপক্ষে চোখের ইশারা বিনিময় হয়েছে। আমি আগামী বছর সাক্ষাতের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আসলে আপনি যখন জানেন আপনার জন্য কেউ অপেক্ষায় রয়েছে, অথচ সে নেই, সত্যিই তখন বড়ো আঘাত লাগে। তার অনুপস্থিতি, তাকে আর কখনোই পাবো না, এই অনুভূতিগুলো খুবই কষ্ট দেয়। তার স্মৃতিগুলো বারবার ফিরে আসে, সেগুলোই মনে পড়ে।
১২-১৩ বছর আগে আমি তার ‘অলিভ ট্রি’ ট্রিলজিসহ চার-পাঁচটি চলচ্চিত্র দেখেছিলাম। ক্লোজ আপটা তখনো দেখা হয়নি। সেসময় আমার মনে পড়ে, ছোটোবেলায় যখন আমার বয়স পাঁচ-ছয়, তখন ইতালিতে ১৯৪৭-৪৮-এর দিকে নব্য-বাস্তববাদ ধারা শুরু হয়। পরে যখন আমি সেই নব্য-বাস্তববাদ ধারার চলচ্চিত্রগুলো দেখি, সেগুলোর ভিন্ন রকমের বিশুদ্ধতা (other purity), সেগুলোর সত্যতা আমাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। রোম ওপেন সিটি, শুশাইন, দ্য বাইসাইকেল থিভস চলচ্চিত্রগুলো আমাকে চমৎকৃত করে। এবং আমি যখন আব্বাসের চার-পাঁচটি চলচ্চিত্র দেখলাম, আমার সেই একই অনুভূতি হচ্ছিলো; ৬৫ বছর আগের কথাই মনে হচ্ছিলো। আসলে তার চলচ্চিত্রে এমন কিছু ছিলো, যা আমার দৃষ্টিভঙ্গিটাই পাল্টে দেয়। এখনো তার চলচ্চিত্রের প্রভাব আমার ওপর রয়েছে।
আব্বাসের সঙ্গে আমার যখন প্রথম দেখা, তখন আমি কিছুটা সতর্ক ছিলাম। উনার সেই সানগ্লাস, বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা, আভিজাত্য, ব্যক্তিত্ব—এক কথায় অসাধারণ। মনে হয়, তিনি যেনো সবসময় চোখ দিয়ে চারপাশের সবকিছু পড়ছেন! তার মতো করে জগতটাকে দেখতে পারা দরকার ছিলো আমার, সেটা শুধু চলচ্চিত্রেই নয়, বরং বাস্তব জীবনেও।
চলচ্চিত্রের প্রতি তার ভালোবাসা, কাজের ধরন, ক্যামেরা মুভমেন্ট, সম্পাদনা সবমিলিয়ে আমার মনে হয়েছে তিনি কিছু বলতে চেয়েছেন। তিনি আসলে চলচ্চিত্রের প্রযুক্তিটাকে ব্যবহার করে সরাসরি সম্পর্ক তৈরি করতে চেয়েছেন দর্শকের সঙ্গে। দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস-এ আমি সেই পুরনো বিশুদ্ধতা ফিরে পেয়েছি। আমি অনুভব করলাম, এই চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলোর সঙ্গে সময় কাটাতে চাই। এটা আসলে আমাকে নতুন করে জগৎ-সংসার, মানুষকে এক সতেজ ও আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে শেখায়। কিন্তু সবসময় এই বিশুদ্ধতাকে ধরতে পারা সহজ হয় না। যেমন টেস্ট অব চেরির কথাই ধরুন। এটা খুবই জটিল একটি গল্প। চলচ্চিত্রটি অবশ্যই সুন্দর, কিন্তু এর ভিতরে প্রবেশ করাটা একটু জটিল। আর তার ক্লোজ আপ দেখার পর থেকে আমি আরো ঘনিষ্ঠভাবে তাকে বুঝতে চেয়েছি। তিনি যেনো আসলে ফিল্ম ছাড়াই শুধু ক্যামেরা দিয়ে চলচ্চিত্র বানাতে চেয়েছেন! তার অস্তিত্ব চিরন্তন। তার চলচ্চিত্র শুধুই ব্যবসা নয়, পারস্পরিক সম্মানবোধ, মানবতাবোধ জাগিয়ে তোলে। আসলে আব্বাসের চলচ্চিত্র নতুন করে চলচ্চিত্রকে সংজ্ঞায়ন করেছে।
সব চলচ্চিত্রনির্মাতাই চায়, তার অস্তিত্বকে জিঁইয়ে রাখতে। আমিও চেয়েছি। জগতটাকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটাই পাল্টে ফেলেছি আমি। তার কথা ভেবেছি সবসময়। এরই মাঝে সেই দুঃসংবাদটা শুনলাম। একজন মহান শিল্পী আমাদের ছেড়ে গেছেন। তার চলচ্চিত্রই আজ আমাদেরকে এখানে একত্রিত করেছে; করে রাখবেও অনন্তকাল। তার চলচ্চিত্র আমার কাছে আশীর্বাদের মতো। এটাই আমার বিশ্বাস। উনি ভালো থাকুক।
মার্টিন স্করসিস, আমেরিকান চলচ্চিত্রনির্মাতা; যিনি অর্ধশতাধিক বছর ধরে চলচ্চিত্রের সঙ্গে আছেন। নির্মাণের পাশাপাশি তিনি প্রযোজনা, চিত্রনাট্য রচনা ও অভিনয় করেন।
‘তার মতো মহান মানুষের সঙ্গে আমি
কিছু সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছি’
জিম জারমুচ
আব্বাসের মতো অবিশ্বাস্য রকমের মেধাবী একজন শিল্পীকে হারানো সত্যিই কষ্টের। অন্য কাউকে হারিয়ে আমি এতো কষ্ট পাইনি। আসলে মানুষের অভিব্যক্তি ও চিন্তা-চেতনা যে অর্থ, ক্ষমতা, বন্দুক কিংবা জেলখানার চেয়েও শক্তিশালী—এই সত্যটা আব্বাসই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। তাই তাকে হারানোটা আরো বেশি কষ্টের। আমি যদি পিছন ফিরে দেখি, তিনি আমাদেরকে কী কী দিয়ে গেছেন; দেখা যাবে, সেগুলো সত্যিই অবিস্মরণীয়। আর এজন্যই নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি—তার মতো মহান মানুষের সঙ্গে আমি কিছু সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছি।
তার সঙ্গে আমার প্যারিসে, মরক্কোতে কথা হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে, মরক্কোতে আব্বাস, জেফ অ্যান্ড্রু, ক্রিস্টোফার ওয়াকেন, মরক্কোর যুবরাজ ও আমার মধ্যে হওয়া সেই আলোচনার একটি ট্রান্সক্রিপ্ট যদি থাকতো! অবশ্য ট্রান্সক্রিপ্ট না থাকলেও তার কথাগুলো আমাদের অন্তরে তো রয়েই গেছে, এটাইবা কম কি! সম্প্রতি পিটার স্কারলেটের কাছে শুনলাম আব্বাসের ছয়টি হাইকু’র (জাপানি ছোটো কবিতা) বই প্রকাশ হয়েছে। আমি জানতামই না, তার এতোগুলো কবিতা রয়েছে। তার কিন্তু ফটোগ্রাফিরও পাঁচটি ভলিউম বের হয়েছে। চলচ্চিত্রের কথা না হয় বাদই দিলাম।
যাহোক, আমি আব্বাসের রচিত ১০টি হাইকু আপনাদের আবৃত্তি করে শোনাবো। এগুলোও কিন্তু তার চলচ্চিত্রের শটের মতো নিজস্ব পর্যবেক্ষণ—বিভিন্ন ঋতুতে প্রকৃতির বিভিন্ন রূপ কেমন সেটা। আমি অবশ্য মূল ফার্সি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে আপনাদের শোনাবো।
The sea breeye steals the hat off the Scarecrow's head first day of spring
The Scarecrwo getting irrigated in the middle of the field at summer noon
The Scarecrwo sweats under its woman hat among hundreds of rocks small and large
dawdles a single turtle spring noon.
The worker bees slwo down autumn afternoon a sycamore leaf falls softly
and rests on its own shadwo
A little nameless flower blossoming alone in the crack of a huge mountain in a snow-covered field
The black hooded crwo looks at itself dayed
The dream of a thousand little birds slaughtered on a dowû pillwo
The beating of drums frightens the roadside poppies
Will they shwo themselves again
জিম জারমুচ, আমেরিকান স্বাধীন চলচ্চিত্রনির্মাতা। পাশাপাশি তিনি চিত্রনাট্য রচনা, প্রযোজনা, সঙ্গীত পরিচালনা ও অভিনয় করেন।
‘আব্বাস থামতে জানতেন না’
আমেনেইজাহ
আব্বাস কিয়ারোস্তামি আমাদের জীবনে পাওয়া সবচেয়ে বড়ো চমক। তিনি এমন সময়ে জন্মেছিলেন, যখন আমরা আসলে তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। অল্প কয়েকটি চলচ্চিত্র দিয়ে তিনি গোটা ইরানের চিত্রই পাল্টে দিয়েছেন। আব্বাস একা একা নিজের মতো কাজ করতেই পছন্দ করতেন। তার প্রেরণা ছিলো প্রাচীন সংস্কৃতি, যেগুলোর মৃত্যু নেই। তিনি সেগুলোকে ছাড়তে চাইতেন না।
শিল্প যে ধ্বংস হয় না, বদল হয় না কিংবা থেমে যায় না—এটার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আব্বাস নিজে। আমাদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী ছিলেন তিনি। আমরা তো অনেক সময় বাধা দেখলে না বুঝেই নিজেদেরকে গুটিয়ে নিই, কিন্তু
আব্বাস থামতে জানতেন না। আসলে মানুষ যে চাইলে সব বাধা অতিক্রম করতে পারে, এটা তিনি করে দেখিয়েছেন। তার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।
আমেনেইজাহ, এথনোমিউজিকোলজিস্ট। উত্তর-পশ্চিম ইরানের খোরাসান অঞ্চলের সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ। বর্তমানে তিনি নিউইয়র্ক সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান।
সূত্র:https:/ww/w.youtube.com/watch?v=3o-BSPJyVS&ts=98s; retrieved on 26.07.16 https:/ww/w.youtube.com/watch?v=_D4O7G6gZqw; retrieved on 26.07.16
https:/ww/w.youtube.com/watch?v=3WGF4lgyhVM; retrieved on 26.07.16
মাহামুদ সেতু, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্বের শিক্ষার্থী।
msetu.mcj@gmail.com
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন