Magic Lanthon

               

সুশান্ত  সিনহা

প্রকাশিত ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

প্রসঙ্গ সম্প্রচার সাংবাদিকতা লাইভ-এর ভিতর বাহির

সুশান্ত  সিনহা

এই ছবিটি এআই প্রোম্পট দ্বারা  নির্মিত

লাইভ কী?

সাধারণত চলমান কোনো অনুষ্ঠান, আয়োজন, ঘটনা বা দুর্ঘটনাসহ যেকোনো পরিস্থিতির সেই মুহূর্তের ছবি ও তথ্য তুলে ধরা হয় টেলিভিশনের সরাসরি সম্প্রচারে। কাটছাঁট বা সম্পাদনা ছাড়াই যা ঘটনা তা-ই টেলিভিশনে সম্প্রচারের এই প্রক্রিয়ার নাম লাইভ বা সরাসরি সম্প্রচার। লাইভ যেমন পূর্ব নির্ধারিত হয়, তেমনই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তৎক্ষণাৎও হতে পারে। অগ্নিকাণ্ড, সড়ক দুর্ঘটনা, দুর্যোগের মতো ঘটনার ক্ষেত্রে সাধারণত অনির্ধারিত লাইভ করার উদ্যোগ নেয় বার্তাকক্ষ। বিষয়ের পার্থক্যের মতো লাইভ উপস্থাপনেরও ভিন্নতা রয়েছে। যেমন : টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে নির্ধারিত সময়ে সম্প্রচারিত কোনো সংবাদ-অনুষ্ঠানের মধ্যে সেই সময়ে কোথাও চলা প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা দেখানোর প্রয়োজন হলে তা সংবাদের মধ্যে দু-এক মিনিট সরাসরি দেখানো হয়। যেখানে প্রতিবেদকের নিজের অংশগ্রহণের প্রয়োজন পড়ে না। সংবাদ উপস্থাপক ঘটনা সম্পর্কে দর্শককে বলার পর শুরু হয় লাইভ। আবার কোথাও ঘটনাস্থল থেকে পরিস্থিতি বা অগ্রগতি সম্পর্কে জানাতে প্রতিবেদক ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে লাইভ করেন। এখানে প্রতিবেদককে প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে; সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রতিবেদক তার মুন্সিয়ানা দেখিয়ে চ্যানেলকে এগিয়ে নিতে পারেন। একইভাবে অসতর্ক কথাবার্তা ও উপস্থাপনায় লাইভের মান প্রশ্নবিদ্ধও হতে পারে। ফলে প্রতিবেদকের লাইভ বা সরাসরি সম্প্রচারের নানা দিক নিয়ে আলোচনা অত্যন্ত জরুরি। সম্প্রচার সাংবাদিকতার নানা দিক নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনায় এবার থাকছে সেই লাইভ বা সরাসরি সম্প্রচার।

লাইভ কেনো?

সম্প্রচার সাংবাদিকতায় লাইভ বা সরাসরি সম্প্রচার অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষ করে ২৪ ঘণ্টার সংবাদভিত্তিক চ্যানেলগুলোর জন্য তো বটেই। সংবাদমূল্য আছে এমন যেকোনো ঘটনা, ইভেন্ট, দুর্যোগ, দুর্ঘটনা দর্শক দ্রুত দেখতে চান টেলিভিশনের পর্দায়। এ কারণে সবার আগে তা সম্প্রচার করতে টেলিভিশনগুলোর মধ্যে চলে প্রতিযোগিতা। ঘটনাস্থলের ছবি দেখাতে পারলেই এ প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকা সম্ভব। আধুনিক প্রযুক্তি ও নতুন নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজনের কারণে লাইভ করা এখন ডাল-ভাতে পরিণত হয়েছে। কবছর আগেও টেলিভিশনে সপ্তাহে দু-তিনটির বেশি লাইভ সম্প্রচার দেখা যেতো না। বর্তমানে বাংলাদেশের ছয়টি সংবাদভিত্তিক চ্যানেলসহ অন্যান্য চ্যানেলের মধ্যে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লাইভের সংখ্যা।

একেকটি চ্যানেল দৈনিক গড়ে তিন-চারটি ইভেন্ট লাইভ করছে। পরিস্থিতি এতোটাই প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে, লাইভ করার মতো সংবাদমূল্য নেই এমন অনেক অনুষ্ঠানও লাইভ করা হচ্ছে। আজকের যুগে তাই টেলিভিশন সাংবাদিকতায় সরাসরি সম্প্রচারের বিকল্প নেই। নগরজীবনসহ সব ধরনের মানুষের সময় কমেছে, বেড়েছে অস্থিরতা, ফলে তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনা জানতেই তারা উদগ্রীব থাকে। অগ্রগতি বা সবশেষ অবস্থা জানতে চোখ রাখে লাইভে। তাই দর্শককে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে টিভির পর্দায় আটকে রাখতে লাইভের জুড়ি নেই।

প্রতিযোগিতার পাশাপাশি দুর্ঘটনা ও নানাধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ায় লাইভের চাহিদা বেড়েছে; সাংবাদিকরাও আগের চেয়ে অনেক বেশি লাইভ করার সুযোগ পাচ্ছে। অভিজ্ঞরা তো বটেই, অপেক্ষাকৃত নবীন প্রতিবেদকরাও এ সুযোগ পাওয়ায় নিজেদের শানিয়ে নিতে পারছে। মূলত সংবাদ-অনুষ্ঠানের মধ্যে দু-এক মিনিটের লাইভে গুছিয়ে মূল তথ্য তুলে ধরতে পারার মধ্য দিয়ে প্রতিবেদকের দক্ষতা বাড়তে থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দীর্ঘ সময় ধরে লাইভ হওয়ার মতো নানা ঘটনা ঘটছে। যা সম্প্রচার সাংবাদিকতায় যোগ করেছে নতুন মাত্রা। বিশেষ করে অগ্নিকাণ্ড, দুর্ঘটনা, পুলিশের বড়ো ধরনের অভিযান এবং যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকরের মতো ঘটনাগুলোতে এ ধরনের ম্যারাথন লাইভ করছে চ্যানেলগুলো। এক কথায় প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সম্প্রচার সাংবাদিকতায় লাইভ নতুনত্ব, বৈচিত্র্য এনেছে, সঙ্গে দর্শকপ্রিয়তাও বাড়িয়েছে। তবে প্রদীপের নীচে অন্ধকারের মতো এর পাশাপাশি কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংবাদকর্মীদের অতি উচ্ছ্বাসী ও অসতর্ক কথাবার্তা, বাচনভঙ্গি ও উচ্চারণগত ভুলত্রুটি নতুন ধরনের কিছু সমস্যারও জন্ম দিয়েছে। যা শুধু লাইভের সৌন্দর্যহানিই করে না, সাংবাদিকদের মন্তব্যধর্মী কথাবার্তায় চ্যানেলের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতে পারে।

সংবাদ উপস্থাপকের প্রশ্ন এবং ...

সরাসরি সম্প্রচারের ক্ষেত্রে সংবাদ উপস্থাপকদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু হরেদরে প্রায় সব সংবাদ উপস্থাপক মুখস্থ বুলি দিয়ে প্রতিবেদককে প্রশ্ন করেন। গৎবাঁধা সেই প্রশ্ন—‘সেখানকার সবশেষ অবস্থা কী আমাদের জানান। এমন অনেক ঘটনা থাকে যেগুলোর সঙ্গে সবশেষ অবস্থা কথাটা একেবারে বেমানান। বিশেষ করে, দিনভর চলমান ঘটনাকে একটি নির্দিষ্ট সময় দিয়ে বিচার করা যায় না। যেমন : রাজধানীর গুলশান-বারিধারা এলাকায় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে দুর্ভোগ বেড়েছে নগরবাসীর। এটা সাময়িক হলেও একদিনের সমস্যা নয়। রোদ-বৃষ্টিসহ অনেকগুলো বিষয়ের ওপরে নির্ভর করে দুর্ভোগের মাত্রা। ফলে সেখানকার পরিস্থিতি সবশেষ হতে পারে না। কিন্তু গতানুগতিকের বাইরে যেতে পারেন না উপস্থাপক।

মনে রাখতে হবে সুন্দর উচ্চারণে, সুন্দরভাবে কোনো কিছু বলতে পারাই উপস্থাপকের কাজ নয়। যা বলছেন তা যৌক্তিক কি না সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া কিছুদিন হয়তো তা দর্শক দেখবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তাতে আগ্রহ হারাবে। রাস্তার দুর্ভোগের বিষয়ে জানার জন্য সবশেষ পরিস্থিতি না বলে হয়তো সকালের বৃষ্টির পর রাস্তায় দুর্ভোগ কি বেড়েছে বা বাতাসের কারণে কী দুর্ভোগ আরো বেড়েছেএমন প্রশ্ন করা যেতে পারে। একইভাবে কোনো হত্যাকাণ্ডের পর সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তা নানা দিকে মোড় নেয়, নতুন নতুন তথ্য পাওয়া যায় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রেও সেই পুরনো কথা‘সবশেষ পরিস্থিতি কী জানান-ই জিজ্ঞাসা করেন উপস্থাপক। অথচ একটু মাথা খাটিয়ে একই কথা ঘুরিয়ে বলা যায়এই মুহূর্তে নতুন কী তথ্য আছে আপনার কাছে?’ অথবা ‘এই মুহূর্তে ঘটনার অগ্রগতির কী খবর আছে আপনার কাছে? এতে দর্শকের কানে  ‘অগ্রগতি বা নতুন শব্দটা আটকে যায়, ফলে ঘটনার অগ্রগতি জানতে তারা প্রতিবেদকের বক্তব্য শুনতে আগ্রহী হয়। যদিও সংবাদের এই পরিস্থিতিতে সবশেষ আর অগ্রগতির অর্থ একই দাঁড়ায়। কিন্তু প্রয়োগস্থল আলাদা হওয়ায় একটার ব্যবহার যথার্থ, অন্যটা বেমানান হয়।

সংবাদ উপস্থাপকরা বলতে পারেনপ্রশ্ন লিখে দেন বার্তাকক্ষের ডেস্ক নিউজ এডিটর, সেখানে যা লেখা থাকে সেটাই তাদের পড়তে হয়। এ যুক্তি আংশিক সত্য, কারণ আগেই বলেছি উপস্থাপনা মানে শুধু পরিপাটিভাবে সেজেগুজে ক্যামেরার সামনে গড় গড় করে সংবাদ পাঠ করা নয়। বিশেষ করে, সংবাদভিত্তিক চ্যানেলের উপস্থাপকের ক্ষেত্রে তো নয়ই। মনে রাখতে হবে, সংবাদ উপস্থাপনা কিন্তু বিশেষ ধরনের গুণ ও দক্ষতা। যা কাজের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। সংবাদ-অনুষ্ঠানে যাওয়ার কিছু সময় আগে থেকে উপস্থাপকের এ নিয়ে প্রস্তুতি থাকা দরকার, বার্তাকক্ষে বসে তিনি পুরো সংবাদ স্ক্রিপ্টটি পড়ে নিতে পারেন। সেখানে কোনো শব্দ বা বাক্যের অর্থ না বুঝলে বা ঠিক না থাকলে সেটা সংশোধন করে নেওয়া তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সংবাদ-অনুষ্ঠানে ঢোকার আগে বার্তাকক্ষে বসে সংবাদগুলো বারকয়েক পড়লে ঘটনার সঙ্গেও নিজেকে একধরনের যুক্ত করা যায়। এতে সরাসরি সম্প্রচারের কী প্রশ্ন দেওয়া হচ্ছে সেটা যেমন তিনি দেখতে-জানতে পারেন; একই সঙ্গে সম্পাদককে জানিয়ে প্রয়োজনে ভুল থাকলে শুধরেও নিতে পারেন।

কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংবাদ উপস্থাপকরা সংবাদ-অনুষ্ঠানের ঠিক আগে আগে এসে স্ক্রিপ্ট নিয়ে উপস্থাপনা করতে চলে যান স্টুডিওতে। এতে যেটা হয় পুরো সংবাদ-অনুষ্ঠানের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত থাকতে পারেন না। এর ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনও মার খেয়ে যেতে পারে কেবল উপস্থাপনগত দুর্বলতার কারণে।

সিম্পল বাট স্মার্ট

আকারে সংক্ষিপ্ত কিন্তু ভিতরের বক্তব্য জোরালোলাইভ নিয়ে এ কথা খুব সচরাচর। একই সঙ্গে বলা হয়, গুণে মানে সমৃদ্ধ হলে অল্পতেই তুষ্ট হবে দর্শক। কিন্তু সংক্ষেপে বলতে গিয়ে কখনো কখনো মূল কথাই বলা হয় না। আবার কথার খেই হারিয়ে ফেললে সহজ কথা যায় না বলা সহজে। লাইভে কোনটা ছেড়ে কোন কথাটা বলবো, তা ঠিক গুছিয়ে উঠতে না পারায় প্রতিবেদক জড়িয়ে যায়। এমনকি হ-য-ব-র-ল অবস্থারও সৃষ্টি হতে পারে। যেমন :

ঢাকা মেডিকেল কলেজের পরিচালক মিজানুর রহমান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, আমরা তার সঙ্গে কথা বলেছি, তিনি আমাদেরকে যেটি বলেছেন যে, যারা আহত অবস্থায় এখানে এসেছিলেন তাদের ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে শুধুমাত্র একজন জাকির হোসেন নামে, উনি শাহ আলী থানা ছাত্রলীগের সভাপতি, ওনাকে শুধু আহত অবস্থায় এখানে ভর্তি করা হয়েছে। কারণ ওনার অবস্থা অন্যান্য যারা আহত ছিলেন, তাদের থেকে কিছুটা গুরুতর বিধায় ওনাকে হাসপাতালে আরো চিকিৎসার জন্য এখানে রাখা হয়েছে। এবং উনি যেটা বলেছেন, অন্যান্য যারা ছিলেন তাদের অবস্থা অতোটা গুরুতর ছিলো না বলেই তারা প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাদেরকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছেন। এবং আমরা যেটি বলেছিলাম এর আগে যে, এখানে কিন্তু ঘটনার পরপরই তাদেরকে নিয়ে এসেছিলেন তাদেরই সহযোদ্ধা অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মীরা এবং তারা এতোক্ষণ পর্যন্ত এখানে আমরা তাদের অবস্থান করতে দেখেছি। তো বাকি যে ১৩ জন ছিলেন, সেই ১৩ জনকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়ার পরেই আসলে তারা তাদেরসহ এখান থেকে সরে গিয়েছেন। এবং আমরা যেটা দেখেছি যে, এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র একজনই আছেন এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে বলেছেন যে তার অবস্থা অতোটা গুরুতর নয়, তবে তার পরও উন্নত চিকিৎসার জন্য তারা এখানে রেখেছেন, তো এই ছিলো আহতদের সবশেষ অবস্থা।

একশো ৮০ শব্দের উপরের এই লাইভের সারকথা ছিলোএকজন ছাড়া আহতের অবস্থা গুরুতর কিছু নয়। থানা ছাত্রলীগের সভাপতিকেই শুধু চিকিৎসার জন্য রাখা হয়েছে, বাকি ১৩ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই কথা বারবার বলেছেন প্রতিবেদক। ব্যবহার করেছেন একশো ৮০টির বেশি শব্দ। যা দর্শক-শ্রোতাদের জন্য অনেক ক্ষেত্রে বিরক্তির কারণ হতে পারে। যদিও এই ধরনের লাইভের সংখ্যা ভূরি ভূরি। তাই দর্শকের দেখার আগ্রহ যেনো নষ্ট না হয়, সে বিষয়টি লাইভের সময় মাথায় রাখতে হবে।

অতি উচ্ছ্বাস : শব্দের বাঁধ ভাঙার জোয়ার

দ্বিরুক্তির মতোই অতি উচ্ছ্বাস লাইভের জন্য সমান ক্ষতিকর। আবেগাপ্লুত হলে বাক্য গঠন ও শব্দ চয়নে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ মে মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের দিন একটি লাইভের কথাবার্তা শোনা যাক

... এখানে যে অস্থায়ী মঞ্চ, সেই মঞ্চে কিন্তু শিক্ষার্থীরা রয়েছে, অভিভাবকরা রয়েছে, এমনকি কয়েকজন শিক্ষকও এখানে চলে এসেছেন। অর্থাৎ আত্মীয়স্বজন আজকের দিনটাকে তাদের কাছে স্মরণীয় করে রাখতে, তারা কিন্তু এই উৎসবটা পালন করছেন। তারা উৎসবটা পালন করছেন এই জন্য, এটা রাষ্ট্রীয় কোনো উৎসব নয়, পরিকল্পিত কোনো উৎসব নয়। তাদের যে মনের আবেগ, মনের উচ্ছ্বাস, দীর্ঘদিনের চাওয়া, সেই চাওয়ার, অর্থাৎ যে প্রত্যাশা ছিলো, সেই প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির যখন সমন্বয় ঘটেছে; মেধা, মননে, প্রজ্ঞায়, বুদ্ধিমত্তায় বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেই বিস্ফোরণের কারণেই কিন্তু যার যার মতো আনন্দ করছে।

এই লাইভে প্রতিবেদকের ব্যবহৃত শব্দের সমাহার ও বাক্যের গাঁথুনিতে কোনো কিছুর কমতি নেই। যদিও অনুলিখন পড়তে গিয়ে দেখা গেলো দাঁত ভাঙার অবস্থা। তাহলে লাইভ দেখে ও শুনে দর্শক-শ্রোতাদের কানের কী অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। আবেগ ভালো, কিন্তু বেশি হলে কতোটা বিড়ম্বনার জন্ম দিতে পারে তা বুঝতে উপরের লাইভটি যথেষ্ট। রুটিনমাফিক প্রতিবছরই একদল শিক্ষার্থী মাধ্যমিক, একইভাবে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করছে। আর ফল প্রকাশের ঘটনাও পূর্ব নির্ধারিত। কিন্তু প্রতিবেদকের কথা শুনে মনে হবে হুট করে ফল ঘোষণা করা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে মিশে যেতে গিয়ে অতি উচ্ছ্বাসের বন্যায় কখন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন তা টেরই পাননি তিনি। নিশ্চয় লাইভে প্রতিবেদকের কণ্ঠে ফলাফল নিয়ে আনন্দ-আয়োজনের রেশ, খুশির আমেজ থাকবে; কিন্তু থাকবে না উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। এটা বোঝা জরুরি যে, সাফল্যের এই আনন্দ-উৎসব সবকিছু শিক্ষার্থী, শিক্ষক-অভিভাবকদের, কোনো মতেই সংবাদকর্মীর নয়। এটা মাথায় রাখতে না পারলে লাইভের কথাবার্তায় তালগোল পাকিয়ে ফেলার আশঙ্কা থাকে।

এছাড়া নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে লাইভের সময় অনেক জানা তথ্যও গুলিয়ে যেতে পারে। দর্শকরা বিভ্রান্ত হতে পারেন। উদাহরণ হিসেবে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ২ মার্চ এশিয়া কাপ টি২০’তে বাংলাদেশ ফাইনাল নিশ্চিত করার পর চট্টগ্রামের দর্শকদের উল্লাসের খবর জানাতে সেখান থেকে লাইভে প্রতিবেদক বলেন—‘...এশিয়া কাপ টি২০’র ফাইনালে যে দলই উঠুক না কেনো তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ ভাল খেলবে।প্রতিবেদকের বক্তব্য অনুযায়ী তখনো আরেকটি সেমিফাইনাল খেলা বাকি রয়েছে। ফলে এখনো নিশ্চিত নয়, ফাইনালে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ কে? অথচ এর আগেই গ্রুপ পর্বের পয়েন্টের ভিত্তিতে আরেকটি দল ফাইনাল নিশ্চিত করে ফেলেছেক্রীড়া প্রতিবেদকের কাছে এ তথ্য অজানা থাকার কথা নয়। তার পরও কেনো তিনি এ ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছেন দর্শকদের!

এখানেও স্কুলের শিক্ষার্থীদের মতো কিশোর-যুবাদের আনন্দ মিছিলে প্রতিবেদক আমজনতায় পরিণত হয়েছেন ক্ষণিকের জন্য। খেলার বিজয় আনন্দে গা ভাসিয়ে আর পাঁচ জন সাধারণের মতো কথা বলার সুযোগ নেই প্রতিবেদকের। কোথায় কতোটা আবেগ দেখানো যায় বা যায় না সে সম্পর্কে প্রতিবেদককে সচেতন থাকতে হবে। অনেক সময় এ ধরনের লাইভ দেখে দর্শক ও প্রতিবেদকের কথার মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না।

একই বিষয়ে লাইভে ঢাকায় আরেক প্রতিবেদক বলছেন, ... স্টেডিয়ামের গেটের বাইরে প্রায় হাজার হাজার দর্শক। এখানেও খেলার মাঠের মতো বাঁধভাঙা উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশের ফলাফল এই সংখ্যাতাত্ত্বিক ভুল। ভুলটা ছোটো কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। কারণ হাজার হাজার মানে কয়েক হাজার, নির্দিষ্ট নয়। তাই এখানে প্রা বলার সুযোগ নেই। এক হাজার বা ১০ হাজার বলতে গিয়ে ‘প্রায় শব্দটি ব্যবহার করা যায়। অথচ প্রতিবেদক তা অবলীলায় বলে গেলেন অতি উল্লাসে। এটাকে স্লিপ অব টাঙ হিসেবে বলতে পারেন কেউ কেউ। বলতে পারেন, কথার পর কথা বলতে গেলে এমন দু-একটা ভুল হতেই পারে। কিন্তু শুধু স্লিপ অব টাঙ হিসেবে দেখলে তা ওপর থেকে দেখা হবে। সমস্যার গভীরে গিয়ে তা দূর করা সম্ভব হবে না। প্রতিবেদকের অসর্তকতা ও উদাসীনতার কারণে এ ভুলত্রুটিগুলো থেকেই যায়। ছোটো ছোটো এসব ভুল হয়তো নজর এড়িয়ে যায় বার্তাকক্ষেরও। কিন্তু সচেতন দর্শক-শ্রোতার কাছে তা ধরা পড়বেই। ফলে ত্রুটি ছোটো-বড়ো যেমনই হোক না কেনো, তা থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

লাইভে ভালো করতে হলে অবশ্যই শব্দ চয়নে আরো বিচক্ষণ হতে হবে। কোন শব্দটি বেশি ব্যবহারযোগ্য আর কোনটা নয় কিংবা বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিলে কোনটি সহজে দর্শককে আকৃষ্ট করতে পারে তা নিয়ে ভাবতে হবে। এক কথায় সাধ আর সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ সমন্বয় করতে হবে প্রতিবেদককে। ‘... বৈরী আবহাওয়ার কারণে মেয়র প্রার্থীরা আজ গণসংযোগে বের হবেন না বলে জানিয়েছেন। ... বৈরী আবহাওয়া কেটে গেলে প্রার্থীরা বের হবে বলে জানিয়েছেন।’ চট্টগ্রাম পৌরসভা নির্বাচনের আগে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ২৫ এপ্রিল লাইভের সময় বৃষ্টি ছিলো। প্রতিবেদক ছাতার নীচে দাঁড়িয়ে বারবার বৈরী আবহাওয়ার কথা বলছেন। বৈরী শব্দটি পরিচিত হলেও সবার কাছে তা বোধগম্য নাও হতে পারে। তাই কথোপকথনের মতো করে বললেই হয়, ‘বৃষ্টির কারণে গণসংযোগে বের হবেন না মেয়র প্রার্থীরা।’ এটা অন্তত ‘বৈরী’ শব্দের চেয়ে অনেক বেশি কমিউনিকেটিভ হয় দর্শকের কাছে। যদি নিম্নচাপের কারণে বৃষ্টি হয় তাহলে পরের লাইনে তা উল্লেখ করলেই হয়।

কারওয়ান বাজারের আড়তে আগুন : অর্থনীতির ওপর প্রভাব

ঘটনাবহুল বাংলাদেশে ঘটন-অঘটনের শেষ নেই। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগের মধ্যে অগ্নিকাণ্ড একটি। দুর্ঘটনা ছাড়াও মানুষের হাতেও পরিকল্পিতভাবে এই ঘটনা ঘটে। আগুনে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির বিবেচনায় কমবেশি এ নিয়ে লাইভ করে চ্যানেলগুলো। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের চেষ্টার পরও অনেক সময় আগুন নিভাতে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগে যায়। ফলে দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিবেদককে লাইভে থাকতে হয়। এ সময় একদিকে মানুষের আহাজারি, অন্যদিকে প্রচুর গুজব ছড়ায়; সর্তক না থাকলে এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রতিবেদকের কথাবার্তা গুলিয়ে যাওয়া ও ভুল তথ্য দেওয়ার আশঙ্কা থাকে। যেমন :

... বারবারই একটি কথা মনে করিয়ে দিতে চাই যে, এই কারওয়ান বাজারের আজকের যে আগুন, এটা নিছক একটা কাঁচা বাজারের আগুন নয়। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির মধ্যে একটা ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। অনেকেই বলছেন যে, সারা বাংলাদেশ থেকে যে সবজি-ফলমূল, যেগুলো ট্রাকের পর ট্রাক আসবে, সেগুলো কোথায় যাবে? আজকে কোথায় যাবে এবং এটার প্রভাব নিশ্চয় আমাদের ওপর পড়বে। আমরা যারা সাধারণ মানুষ, আমরা যারা ভোক্তা তাদের ওপর পড়বে।

২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ১ মে অগ্নিকাণ্ডের এ ঘটনায় প্রায় ১০ মিনিটের লাইভের বক্তব্য শুনে যে কেউ আঁতকে উঠবে। এতে একদিকে যেমন দর্শক ব্যথিত হবে, তেমনই জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির শঙ্কা তৈরি হতে পারে। কারণ কারওয়ান বাজারের আগুনের ঘটনায় দেশের অর্থনীতির মধ্যে বড়ো ধরনের প্রভাব ফেলার কথা এসেছে লাইভে। আগুনে কিন্তু পুরো বাজার নয়, একটি মার্কেটের একশো ৮৪টির মতো আড়তের দোকানঘর পুড়েছে মাত্র। সংখ্যা ও আকারে তা কারওয়ান বাজারের কাঁচা বাজারের পাঁচ ভাগের এক ভাগ হতে পারে। আর দোকানে যেমন বিভিন্ন ধরনের পণ্যসামগ্রী থাকে, আড়তে কিন্তু তা থাকে না। সারাদিন এসব আড়ত সাধারণত খালি থাকে, আর সবজি ও ফলমূল কেনা-বেচা হয় সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। সুতরাং এ আগুনের ঘটনায় বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর প্রভাব পড়ার শঙ্কা একেবারেই অমূলক। অর্থনীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা যে কেউ তা বুঝতে পারবেন। আগুন লাগলে অবশ্যই ক্ষতি হয়; কিন্তু তা নির্ভর করে স্থান-কাল-পাত্রের ওপর। যদি ওই আগুন কাঁচা বাজারের ভিতরে লাগতো, তাহলে হয়তো ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বহুগুণে বাড়তো। কারণ সেখানে রয়েছে কয়েকশো স্থায়ী দোকান। প্রতিবেদকের তাই এমন আংশিক ও বিভ্রান্তিকর মন্তব্য থেকে বিরত থাকতে হবে।

... সুতরাং ক্যাশ টাকাও কী পরিমাণ পুড়ে গেছে এ আগুনে সেটা কিন্তু নেহাত কম হবে না। যদি কেউ চিৎকার করে, কান্নাকাটি করে বলার চেষ্টা করে, তাহলে সেটাও নেহায়েৎ কম হবে না। ... তাদের কোটি কোটি টাকা এখানে ইনভেস্ট করেছেন, চারিদিকে তাদের নিরাপত্তার জায়গাটি তারা খেয়াল করেননি। কারণ কোনো জায়গায়, আশেপাশে কোথাও একটু জলাধার নেই।

আড়ত ও দোকানের মধ্যকার পার্থক্যের কথা আগেই বলা হয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিংসহ ব্যাংক লেনদেন এখন অনেক সহজ হয়েছে। তাই নিরাপত্তার স্বার্থে নিত্যনৈমিত্তিক খরচ ছাড়া নগদ টাকা ছোটো-বড়ো কোনো ব্যবসায়ীই আর এখন খুব একটা কাছে রাখে না। তাই আগুনে নগদ টাকা পুড়ে যাওয়া সংক্রান্ত বক্তব্য এখানে বাহুল্য। আর যদি পুড়ে থাকেও সেটা জানার পরই কেবল বলা উচিত। একইভাবে আড়তে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগের সুযোগ নেই। আর শুধু কারওয়ান বাজার কেনো, ঢাকা শহরে হাতে-গোনা কয়েকটি জায়গা ছাড়া কোথাও জলাশয় নেই। পুরো ঢাকার চিত্রই এমন নাজুক। ফলে কারওয়ান বাজারে জলাশয় থাকা না থাকার সঙ্গে ব্যবসা করার সম্পর্ক কোথায় তা স্পষ্ট নয়!   

লাইভের জন্য লাইভ

লাইভের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় চ্যানেলগুলোর সংবাদ পরিবেশন ঢঙে বেশ গুণগত পরিবর্তন এসেছে। সংবাদ-অনুষ্ঠানও যে সমৃদ্ধ হয়েছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে কিছু কিছু লাইভ নিয়ে প্রশ্নের উদ্রেক হয়। দেখে মনে হয়, অন্যরা করছে বলে আমরাও নামকাওয়াস্তে একটু লাইভ করলাম আর কি। এসব ক্ষেত্রে হুট করেই কোনো অনুষ্ঠানের লাইভে গিয়ে হুট করেই শেষ করা হয়। হয়তো তখনো সম্ভাষণ পর্বে চলছে অতিথি বন্দনা। সেখানে হঠাৎই লাইভে ঢুকে যায়। এ ধরনের লাইভ দর্শকের কাছে বেশ বিরক্তিকর হয়, কারণ তারা বুঝে উঠতেই পারে না লাইভের বিষয়বস্তু কী। তাই এমন সময় লাইভে যাওয়া উচিত, যাতে দর্শক মোটামুটি পরিপূর্ণ বার্তা পায়। কিংবা অনুষ্ঠানে বক্তার বক্তব্যের মূল সুরটা যেনো জানা যায়। এতে যদি ওই লাইভ সংবাদ-অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় অংশেও চলে যায় তাতেও ক্ষতি নেই। আবার অনেক সময় দীর্ঘ সংবাদ-অনুষ্ঠানের জায়গা ভরানোর জন্যও লাইভ করার প্রবণতা দেখা যায়। ফলে বাড়তি তথ্য না থাকায় একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে দেখা যায় প্রতিবেদককে।

সরাসরি সম্প্রচারের বিষয়বস্তু ও সময় নির্ধারণের দিকগুলো বার্তাকক্ষের হাতে থাকে। সেখানে প্রতিবেদকের বেশি কিছু করার থাকে না। কিন্তু সিদ্ধান্ত হওয়ার পর প্রতিবেদককে যাত্রাপথেই প্রস্তুতি নিতে হয়। তখন বিষয় সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নিতে, ঘটনাস্থল সম্পর্কে সাধারণ কিছু তথ্য জানতে ফোনে কথা বলা যায় সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে। এই এতোটুকু প্রস্তুতি নিলেও লাইভের মান অনেকাংশে উন্নত করা সম্ভব; যা অন্যদের চেয়ে নিজেকে ও চ্যানেলকে কিছুটা পৃথক করবে।

ক্ষেত্র বিশেষে লাইভে অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা বিরক্তি উৎপাদন করে। এছাড়া দর্শককে আকৃষ্ট করতে হলে লাইভের সময় প্রতিবেদকের চেহারা দেখানোর চেয়ে ঘটনাস্থলের ছবি দেখানো বেশি প্রয়োজন। কিন্তু মাঝে মাঝে দেখা যায়, ফ্রেমজুড়ে কেবল প্রতিবেদকের চেহারাই দেখা যায়, তিনি কথা বলেই চলেছেন। অন্যান্য প্রয়োজনীয় ছবি দেখানো হয় না। এটা বড্ড একঘেয়ে পরিস্থিতির সৃষ্টি করে দর্শকদের জন্য। এসব বিষয়ে প্রতিবেদক এবং প্রোডাকশন কন্ট্রোল রুম-এর (পি সি আর) সদস্যদের সচেতন থাকতে হয়।

উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম, লাইভে দাঁড়াবো কোথায়?

রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় টানা ১৭-১৮ দিন চলে উদ্ধার তৎপরতা। মানবসৃষ্ট সেই দুর্ঘটনা সবগুলো চ্যানেল লাইভ করেছে দিনের পর দিন। অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক সেই ঘটনায় দু-একজন প্রতিবেদকের লাইভ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেসময় প্রশ্ন উঠেছিলো। তবে তা প্রতিবেদকের বক্তব্য নয়, লাইভে দাঁড়ানোর জায়গা নিয়ে। কারণ তারা যে স্থানে দাঁড়িয়ে লাইভ করছেন, সেখানেই চলছিলো উদ্ধার অভিযান। ছোটো গর্ত করে আহতদের উদ্ধারে প্রাণপণ চেষ্টারত কর্মীদের চলাচলের পথে দাঁড়ানো ও তাদের প্রশ্ন করা কিছুটা হলেও ছেদ ফেলে কাজে। এমনকি কাউকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার সময়ও কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন কেউ কেউ। লাইভ জরুরি, কিন্তু তার চেয়ে জরুরি মানুষের জীবন। তাই পথ ছেড়ে দিয়ে উদ্ধার কাজে যতোটা সম্ভব সহযোগিতা করতে পারলেই ভালো।

আর এ ধরনের দুর্ঘটনাস্থলের ভিতরে, উপরে বা নীচে দাঁড়িয়ে লাইভ করতে গিয়ে মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারেন প্রতিবেদক। তথাকথিত সাহসী সাংবাদিকতা করতে গিয়ে প্রতিবেদক ও ক্যামেরা পারসন নিজেরাও বিপদে পড়তে পারেন। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে মিরপুরের বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এমনই এক দুর্ঘটনা চেয়ে চেয়ে দেখতে হয়েছিলো সংবাদকর্মীদের। ফায়ার সার্ভিসের দাঁড়িয়ে থাকা একটি গাড়ির ছাদে উঠে ফ্রেম ঠিক করছিলেন কয়েকজন ক্যামেরা পারসন। পানি নিয়ে আসা পিছনের আরেকটি গাড়ির জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে গাড়িটিকে খানিকটা সামনে এগিয়ে নিতে হয়। থামা গাড়ি হুট করে চলতে শুরু করায় ছাদের শেষ দিকে দাঁড়ানো একজন ক্যামেরা পারসন ছিটকে নীচে পড়ে যান। ওই দুর্ঘটনায় তিনি গুরুতর চোট পান মাথা ও কোমরে; ক্যামেরাটাও ভেঙে যায়। দুর্ঘটনার সংবাদ কাভার করতে গিয়ে নিজেই দুর্ঘটনায় পড়লেন সতর্কতার অভাবে। ক্যামেরা পারসনের নিরাপত্তা দেখার দায়িত্ব কিন্তু প্রতিবেদকেরও ছিলো। থেমে থাকা গাড়িটির চালক তো জানতেন না তার গাড়ির ছাদে উঠে কাজ করছে সংবাদকর্মীরা। ফলে এই দুর্ঘটনার দায় মোটেও চালকের নয়।

দুনিয়ার কোথাও একেবারে দুর্ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে লাইভ দিতে দেখা যায় না। মিশরের তাহরির স্কয়ারের সমাবেশে সংঘর্ষের ঘটনায় দূর থেকে ছাদে দাঁড়িয়ে লাইভ করতো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদকরা। পরিস্থিতি যখন শান্ত হয়েছে, তখন তারাই আবার কাছ থেকে লাইভ করেছে। ফলে লাইভের স্থান নির্ধারণে প্রতিবেদককে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে, যাতে নিরাপদে কাজ শেষ করা যায়। তাতে ফ্রেম বা ছবি যদি একটু খারাপও হয় তাতে সমস্যা নেই। তাহরির স্কয়ারের একই ফ্রেম ধরে টানা লাইভ করেছিলো বিবিসি ও সিএনএন। এ নিয়ে কেউ কিন্তু প্রশ্ন তোলেনি।  

রানা প্লাজা ধসে ১১শোর বেশি শ্রমিক নিহত হয়েছিলো। যাদের মধ্যে তিন শতাধিকের পরিচয় উদ্ধার সম্ভব হয়নি প্রাথমিকভাবে। পরিচয়হীন এসব মরদেহ কবর দেওয়া হয় জুরাইন কবরস্থানে। সে ঘটনায় একটি লাইভ দেখে সবার চক্ষু চড়কগাছ, খনিকের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ়ও হতে হয়েছিলো। কারণ প্রতিবেদক লাইভ করছেন পাশাপাশি খোঁড়া কবরের একটিতে নেমে। তথাকথিত ভালো ফ্রেমের চিন্তায় প্রতিবেদক ও ক্যামেরা পারসন দু’জনেই বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন তাদের কাজের ক্ষেত্রের সীমানা সম্পর্কে। কবরে নেমে সেই লাইভের ঘটনায় ঝড় উঠেছিলো দেশজুড়ে। আগেই বলেছি, প্রতিবেদকের ভুলের দায় শুধু ব্যক্তির নয়, প্রতিষ্ঠানকে নিতে হয় এবং এক্ষেত্রেও নিতে হয়েছিলো।

লাইভের গেটকিপার

লাইভে গেটকিপিংয়ের উদাহরণ হিসেবে আবারও কবরে নেমে লাইভ করার বিষয়টি আনতে হচ্ছে। এ ভুলের দায় কিন্তু শুধু প্রতিবেদকের একার নয়। এ ভুল ক্যামেরা পারসন, পি সি আর, সর্বোপরি সংবাদ পরিচালনাকারী প্রযোজনা দলের সব সদস্যের। প্রথম গেটকিপার হিসেবে ক্যামেরা পারসনের উচিত ছিলো প্রতিবেদকে কবরে নামতে না দেওয়া। কিন্তু তার মতোই দ্বিতীয় গেটকিপার প্রোডাকশন দলের সদস্যরাও যথাযথ দায়িত্ব পালন করেনি। কারণ তারা লাইভ হওয়ার বেশ আগেই দেখেছিলেন প্রতিবেদকের কবরে নামার বিষয়টি। তৎক্ষণাৎ তাদের দায়িত্ব ছিলো, প্রতিবেদককে নিষেধ করা। কিন্তু তারাও হয়তো সেটি করেননি। অথচ লাইভের ক্ষেত্রে প্রোডাকশন টিমের প্রত্যেক সদস্যের ভূমিকা খুবই গুরুত্ববহ।

অনেক সময় দেখা যায়, লাইভে দাঁড়িয়ে প্রতিবেদক এদিক-ওদিক দেখছেন, কেউ কথা বলছেন আবার কেউ চুল ঠিক করছেন। আর এদিকে উপস্থাপক প্রশ্ন করে যাচ্ছেন তাকে। এতে বোঝা যায়, লাইভ শুরু হওয়ার বিষয়টি তখন পর্যন্ত জানেন না প্রতিবেদক। এসব ক্ষেত্রে পি সি আর-এ বসা প্রযোজনা দলের সদস্যদের যান্ত্রিক ত্রুটি বা যে কারণেই হোক, লাইভে যাওয়া প্রয়োজনে বন্ধ করতে হবে। এ ক্ষমতা অবশ্য প্রযোজনা দলের আছে। লাইভ না হলে হয়তো তেমন কিছু হবে না। কিন্তু এ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ লাইভ হলে তাতে চ্যানেলের সুনামের ক্ষতি হয়। লাইভের ক্ষেত্রে ঘটনাস্থলে নানাধরনের সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। বিশেষ করে ২০-২২টি টেলিভিশন চ্যানেলসহ অসংখ্য সংবাদকর্মীর ভিড়ের কারণেও কিছু বিপত্তিতে পড়তে হয় প্রতিবেদককে। ফলে অনেক কথা গুছিয়ে বলার চেষ্টা থাকলেও পরিস্থিতির কারণে যান্ত্রিক গোলযোগসহ ত্রুটিবিচ্যুতি হয়ে থাকে। সংবাদের সময় ঠিক রাখতে পি সি আর থেকে প্রযোজকরা এক বা দেড় মিনিটে শেষ করার তাগাদা দেন। এতে অনেক সময় গুছিয়ে বলার পরিকল্পনা থাকলেও তাড়াহুড়ো করে শেষ করতে গিয়ে কিছু ভুলভ্রান্তি হয়। অনেক সময় আসল কথাটা বলার আগেই লাইভ শেষ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে টেলিগ্রাফ পাঠানোর মতো সবার আগে মূল তথ্যটি বা নতুন তথ্যটি জানিয়ে দিলে ভালো হয়। তারপর সময় পেলে আগে-পরের ঘটনার বর্ণনা দেওয়া যায়।

ম্যারাথন লাইভ

সংক্ষিপ্ত সময়ের লাইভের চেয়ে মিনিটের পর মিনিট লম্বা লাইভে ভুলভ্রান্তি বেশি চোখে পড়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টেনে লম্বা করতে গিয়ে প্রতিবেদক নতুন কথা খুঁজে পান না। তখন হয় ঘুরেফিরে একই কথা বলতে হয়, আবার কখনো অনেক অসামঞ্জস্যপূর্ণ কথাবার্তাও বলতে শোনা যায়। কখনো কখনো ম্যারাথন লাইভ ধারা বিবরণী শুনে মনে হয় প্রতিবেদক নয়, নির্দিষ্ট কোনো দল বা গোষ্ঠীর হয়ে কেউ কথা বলছেন। মনে রাখতে হবে, একজন সংবাদকর্মীর পক্ষাবলম্বনের সুযোগ নেই।

ম্যারাথন লাইভ করতে গিয়ে নিজের অজান্তেই প্রতিবেদক এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করেন যা তাকে একটা পক্ষে ঠেলে দেয়। এবং বারবার যখন এ ধরনের কথা বলতে থাকেন, তখন দর্শকের বিরক্ত হওয়াটা স্বাভাবিক। ঘটনার নিরপেক্ষতা ধরে রাখতে আগে-পরে সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত বলতে হবে, যেনো দর্শক-শ্রোতাকে মনে করিয়ে দেওয়া যায় কেনো এবং কী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবেদকের আজকের এই অবস্থান। যতোটা সম্ভব নির্মোহভাবে কথা বলতে হবে।

স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ড পাওয়া আসামিদের ফাঁসির দিনগুলোতে কারাগারের প্রধান ফটকের সামনে থেকে কারো কারো লাইভের ভাষ্য শুনে মনে হচ্ছিলো সংবাদকর্মী নয়, কথা বলছেন কোনো রাজনৈতিক কর্মী! ফাঁসির রায় বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অপরাধের বর্ণনা তুলে ধরতে হবে, কিন্তু তা অবশ্যই নিজের গণ্ডির বাইরে গিয়ে নয়। সেখানে রবীন্দ্রনাথের গানের মতোঅনেক কথা যাও গো বলি/ কোনো কথা না বলিসবই বলবো কিন্তু বিচারের ভার থাকবে দর্শক-শ্রোতার ওপর। অন্যান্য রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে লাইভের ক্ষেত্রেও এমন সমস্যা দেখা যায়। তথ্য দেওয়া আর পক্ষাবলম্বন কিন্তু এক জিনিস নয়। সংবাদকর্মী হিসেবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা অন্যান্য সব রাজনৈতিক দলের সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্ব দেয় অফিস। তাদের পক্ষে রাজনীতি করার জন্য নয়। আর দশজনের মতো সংবাদকর্মীর রাজনৈতিক দর্শন-আদর্শ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু একান্ত ব্যক্তিগত সেই বিশ্বাস-অবিশ্বাস যেনো সংবাদের ওপর কোনো প্রভাব না ফেলে। তাতে সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে যায়।

লাইভে জিজ্ঞাসা : বাড়তি বিড়ম্বনা

মহান বিজয় দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধ থেকে অনেক চ্যানেলই লাইভ করে ফি-বছর। সেখানে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে আসা রাজনীতিবিদ ছাড়াও সমাজের নানা শ্রেণি পেশার মানুষকে লাইভে যুক্ত করেন প্রতিবেদক। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের বিজয় দিবসে সংবাদভিত্তিক একটি চ্যানেলের প্রতিবেদক বলছেন‘... ফুটফুটে একটি শিশুকে সঙ্গে নিয়েছেন একজন, তার কাছে জানতে চাইবো, শিশুকে কেনো নিয়ে এসেছেন? মহান বিজয় দিবসের সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দিতেই সঙ্গে এনেছি বলে জানান শিশুটির মা। এমন স্পষ্ট উত্তর পাওয়ার পরও প্রতিবেদক দ্বিতীয় দফায় জিজ্ঞেস করেন—‘এতো ছোটো বাচ্চাকে কেনো এনেছেন স্মৃতিসৌধে? উত্তরে শিশুটির মা আগের মতোই বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে সঙ্গে আনার কথা। এ কথা শোনার পর প্রতিবেদক বলেন, ... (সংবাদ উপস্থাপকের নাম) শুনলেন আপনি, নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে অনেকেই সঙ্গে এনেছেন শিশুদের। একে লাইভ না বলে পুলিশি জেরা বললে খুব বাড়িয়ে বলা হবে না। একই কথা বারবার বলার বিষয়টি ওই ব্যক্তির কাছে যেমন বিরক্তির তেমনই তা দর্শকের ক্ষেত্রেও। এতে প্রতিবেদকের মান প্রশ্নবিদ্ধ হয়। যথাযথ প্রশ্ন করতে না পারা সাংবাদিকদের জন্য বড়ো ধরনের দুর্বলতা। এক কথায় কী জানতে চাই, সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না থাকলে যথাযথ প্রশ্ন করা যায় না। এতে প্রতিবেদক নিজের প্রশ্নে নিজেই আটকে যেতে পারেন। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চ সিলেট হাসপাতাল থেকে এমনই একটি লাইভে বলা হয়

... আপনি দেখতে পাচ্ছেন এই ক্লিনিকের সবগুলো কক্ষ তালা দেওয়া। ... সবচেয়ে বড়ো বিষয় এখানে কোনো ডাক্তার নেই। ... আমাদের সঙ্গে আছেন ইউনিয়ন পরিষদের সচিব জিয়াউল ইসলাম। তার সাথে একটু কথা বলতে চাই, আপনি তো এই ইউনিয়ন পরিষদের সচিব। সেক্ষেত্রে এই ক্লিনিকটা কয় দিন খোলা থাকে?

উত্তরে সচিব বলেন, এটা সপ্তাহে দুই দিন খোলা থাকে, সোমবার ও বৃহস্পতিবার।’ লাইভ হচ্ছে মঙ্গলবার দিন। যে দিন ক্লিনিক খোলা থাকার কথা নয়। বন্ধের দিনে চিকিৎসক থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। ফলে লাইভে প্রশ্ন করার আগে প্রতিবেদকের উচিত ছিলো বিষয়টি জেনে নেওয়া। বিষয়টি জানা থাকলে লাইভের বিষয় ঠিক রেখে ভিন্নভাবে তা উপস্থাপনের সুযোগ ছিলো প্রতিবেদকের। না হলে নিজের প্রশ্নের ফাঁদে নিজেকেই পড়তে হবে। যা এ লাইভের ক্ষেত্রে ঘটেছে।

আবার প্রশ্ন করার ঢঙয়ের কারণেও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে লাইভ। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বরিশালের প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা সংক্রান্ত লাইভে একজন প্রতিবেদক বলছেন, ... আপনি তো আওয়ামী লীগ করতেন, এখন বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। প্রচার চালাতে গিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না? নির্বাচনের খবর সংগ্রহ এবং এ বিষয়ে লাইভ করতে গেলে অবশ্যই প্রার্থীদের বক্তব্য নিতে হবে। তবে বিশেষ কোনো প্রার্থী যেনো সুবিধা না পায় সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। একজন সাংবাদিকের কাছে সব প্রার্থীই সমান। প্রার্থীর নাম, প্রতীক ও দলের নাম না বলেও লাইভ করা সম্ভব। এজন্য প্রতিবেদক বলতে পারতেন, ‘ভোটের প্রচার নিয়ে আমরা এখন কথা বলবো একজন প্রার্থীর সঙ্গে।’ এরপর তাকে বলা যায়, ‘প্রচার-প্রচারণায় কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না?’ সবকিছু উহ্য রেখে চমৎকার লাইভ করা সম্ভব। কিন্তু উপরের লাইভে প্রতিবেদক যেভাবে প্রশ্ন করেছেন তাতে তার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকে। ওই প্রার্থীকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে বাড়তি সুবিধার অভিযোগ উঠতে পারে প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে।

পোশাক-পরিচ্ছদ

ইদানীং কারণে-অকারণে নীচের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে লাইভ করছেন কেউ কেউ। হয়তো তারা মনে করেন, এতে লাইভের গুরুত্ব বাড়ছে। আসলে ঘটে তার উল্টোটা। কারণ সাধারণ মানুষ জানে খেলার মাঠে, রাস্তা কিংবা ক্লিনিকের সামনে হাঁটা চলার জন্য নীচে তাকানোর প্রয়োজন নেই। দু-একটি ক্ষেত্রে জায়গা কম থাকলে অথবা খানাখন্দ থাকলে সেখানে তাকানো যেতে পারে। গড়ে সব লাইভে নীচে তাকানোয় লাইভের সৌন্দর্যহানি ঘটে। দর্শকরা যেমন প্রতিবেদকের পোশাক ও উপস্থাপনের ঢঙ আমলে নেয়, তেমনই অনুষ্ঠান বা ঘটনাস্থলের লোকজনও তা গুরুত্ব সহকারে খেয়াল করে। সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর হিসেবে তারা প্রতিবেদককে দেখতে চান। ফলে দর্শকের ভিতরে ঢুকতে হলে মার্জিত পোশাক জরুরি। তা না হলে দেখা যাবে লাইভের বিষয়বস্তু ভালো হলেও টেলিভিশন চ্যানেলের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর প্রতিবেদকের রঙচঙে হাফহাতা জামা, টিশার্ট ইত্যাদির কারণে দর্শককে আকৃষ্ট করতে পারছে না।

সম্প্রচার সাংবাদিকতায় শার্টের হাত গুটিয়ে লাইভ দেওয়ার ‘রোগ’ বেশ কঠিন ও পুরনো। একটু খেয়াল করলেই হাত গুটানোর সমস্যা দূর করা যায়, এতে যেমন প্রতিবেদকের স্মার্টনেস বৃদ্ধি পায়, গ্রহণযোগ্যতাও বাড়ে।

ত্রুটি মুক্তির উপায় : চার-ছক্কার হই হই

সংবাদের লাইভ আর লাইভ ক্রিকেট খেলার মধ্যে দারুণ সাযুজ্য রয়েছে। ধরন ভিন্ন হলেও মাঠে ক্রিকেটার ও সংবাদকর্মীকে তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই দল ও চ্যানেলকে এগিয়ে নিতে হয়। প্রতিপক্ষের বোলারের বলের গতি অত্যধিক হওয়ায় খেলতে পারিনি বলার সুযোগ নেই ব্যাটসম্যানের। তেমনই দায় খণ্ডনের সুযোগ নেই প্রতিবেদকেরও, তা যতোই জনাকীর্ণ, হট্টগোল, লম্বা সময় ধরে লাইভ করায় ক্লান্ত বা অন্য কোনো সমস্যা থাকুক না কেনো। ভুল বা অসঙ্গতিপূর্ণ কথা তীরের মতো, একবার ছুড়লে আর ফেরানোর উপায় থাকে না। ভুল বা অসঙ্গতিপূর্ণ কথাবার্তার পিছনের কারণ খুঁজতে যায় না দর্শক। তারা কেবল ভুলটাই দেখে।

ক্রিকেটের কোচ মাঠে বসে খেলা দেখলেও খেলা শেষে রেকর্ড নিয়ে পর্যালোচনা করেন। একইভাবে ক্রিকেটাররাও নিজের ভুলত্রুটি দূর করতে খেলার রেকর্ড দেখে। একইভাবে লাইভের সমস্যাগুলো এড়াতে প্রাথমিকভাবে ক্যামেরা পারসনকে বেছে নিতে পারে প্রতিবেদক। তার কাছ থেকে ক্যামেরায় ধারণ করা লাইভের রেকর্ড নিয়ে তা শুনে উচ্চারণসহ ভুলত্রুটিগুলো নিজেই চিহ্নিত করতে পারেন। এতে ভুলগুলো কমে আসবে পরের লাইভে। অনেকটা থিওরি ও প্র্যাকটিসের মতো। এছাড়া এখন গুরুত্বপূর্ণ অনেক লাইভ ইন্টারনেটে ইউটিউবে পাওয়া যায়। ফলে চাইলেই যে কেউ দিন তারিখ দিয়ে সার্চ দিয়ে নিজের লাইভ দেখে নিয়ে নিজেই বিশ্লেষণ করতে পারেন। যদিও সংবাদকর্মীদের ক্ষেত্রে নিজেকে নিয়ে এ ধরনের মূল্যায়ন করতে খুব একটা দেখা যায় না। অথচ ত্রুটি মুক্ত হওয়ার এটাই সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম।

ভালো হতো আরো ভালো হলে

ব্যাগের মতো পিঠে নেওয়া লাইভ যন্ত্র ‘ব্যাকপ্যাক’-এর আকার ছোটো হওয়ায় এখন লাইভ বেশ সহজ হয়েছে। তাই আগেই বলেছি লাইভ এখন ডাল-ভাত। দর্শক হিসেবে প্রতিদিন বিভিন্ন চ্যানেলের সবগুলো লাইভ দেখাও সম্ভব নয়। প্রশ্নাতীতভাবে বলা যায়, গুণে ও মানে সব দিক দিয়ে উত্তীর্ণ লাইভের সংখ্যা কম নয়। অনেকের লাইভ দেখতে দর্শক আগ্রহী হয়। তবে এই ভালোর শেষ নেই। প্রতিনিয়ত এই ভালোকে আরো উন্নত করতে হলে সংবাদকর্মীদের নিজস্ব উদ্যোগ জরুরি।

রাজধানীর শাহজাহানপুরে পাইপের ভিতর পড়া শিশু জিহাদের উদ্ধার অভিযানের খবর ছিলো সেদিনের চাঞ্চল্যকর ঘটনা। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর রুদ্ধশ্বাস সেই উদ্ধার অভিযানে নজর কেড়েছিলো আতিক বিন মান্নানের লাইভ। ঘণ্টাব্যাপী সেই ম্যারাথন লাইভ দেখে-শুনে মনে হয়েছিলো ক্যামেরার পিছনে ফায়ার সার্ভিস বা উদ্ধারকারীদের কেউ ধারা বিবরণী দিচ্ছেন। কারণ আর পাঁচটা ঘটনার লাইভের মতো অতি উচ্ছ্বাস কিংবা উত্তেজনায় গা না ভাসিয়ে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় উদ্ধার অভিযানের অগ্রগতি বর্ণনা করছিলেন আতিক। যেখানে তিনি প্রতিটি শব্দ অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সঙ্গে বলছিলেন।

একই ঘটনায় অন্য চ্যানেলের দু-একজন সংবাদকর্মীকে আশেপাশের মানুষের কথায় প্রভাবিত হয়ে কথা বলতে শোনা গেছে। যেমন পাইপের মধ্যে লাইটসহ ক্যামেরা নামানোর পরে অনেককেই বলতে দেখা গেছে, ওই যে শিশুর পা দেখা যাচ্ছে ... ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আতিক বিন মান্নান বলছেন,

... আপনারা দেখছেন পাইপের দুইশো ৪০ ফুট নীচে ক্যামেরা নামানো হয়েছে। কিন্তু সেখানে ককশিটসহ আবর্জনা এবং পানি থাকায় আর নীচে ক্যামেরা পাঠানো যাচ্ছে না। যার ফলে তারা আশঙ্কা করছেন, যে শিশুটি পড়ে গিয়েছে, সেই শিশুটি পানির ভিতরে যাওয়ার কারণে তার ছবি হয়তো ক্যামেরা পাঠাতে পারছে না। ... কিন্তু ঠিক আগের রাতে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কাজে নিয়োজিত কর্মীরা গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছিলেন যে, ভিতর থেকে তারা বাচ্চাটির কান্নার শব্দ পেয়েছিলেন এবং বাচ্চাটিকে খাবার পাঠিয়েছিলেন তারা। কিন্তু আজকে ওয়াসা যে ক্যামেরা পাঠিয়েছিলো, সেই ছবি পাওয়ার পর ফায়ার সার্ভিসের ডি জি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং এই স্থান ত্যাগ করার আগে কিন্তু গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছিলেন যে সেখানে তারা প্রাণের অস্তিত্ব পাননি। এবং তারা এটিকে গুজব বলে চলে গেছেন।

প্রতিবেদক দুটো বক্তব্যই তুলে ধরেছেন উদ্ধার অভিযান চলাকালে, কিন্তু কোথাও সিদ্ধান্ত টানেননি। অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে দম নিয়ে থেমে থেমে লাইভে কথা বলছিলেন আতিক, যেখানে বাড়তি কোনো কথা ছিলো না। তার বক্তব্য ছিলো মেদহীন ঝরঝরে কিন্তু প্রয়োজনীয়। সেখানে নিজের মন্তব্য ছিলো না। তিনি উদ্ধার অভিযানের বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করছিলেন। অগ্রগতি বলার পাশাপাশি বিরতি দিয়ে দিয়ে তুলে ধরছিলেন শিশু জিহাদের পাইপের মধ্যে পড়ে যাওয়ার ঘটনার কথা। যাতে দর্শক যখনই টেলিভিশন দেখতে শুরু করুক না কেনো, সে যেনো ঘটনার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পারে। যা টানা লাইভের ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি।

আতিকের বর্ণনায় ছোটো বাক্যে ছবির সঙ্গে ব্যাখ্যা ছিলো। সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার হলো, প্রতিবেদক নিজে থেকে কারো মতামতের আশ্রয় নেননি। তিনি অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গে শিশুটির পরিবারসহ বিপরীতধর্মী নানা কথাবার্তা তুলে ধরেছেন, কিন্তু সিদ্ধান্ত টানেননি। প্রচণ্ড হট্টগোলের ভিতরে নানান মত শোনার পরও প্রতিবেদক অবিচল ছিলেন ম্যারাথন লাইভে। মুগ্ধ করা এই লাইভের সংবাদকর্মী একেবারে নবীন-আনকোরা, কাজের অভিজ্ঞতা এক বছরেরও কম।

একইভাবে মনে রাখার মতো আরেকটি নিখাদ লাইভের কথা না বললেই নয়। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে একই সময়ে প্রচণ্ড কুয়াশা ও হাড়কাঁপানি শীতে উত্তরাঞ্চলসহ সারাদেশে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ওই বছরের ২৬ ডিসেম্বর শীতের সকালে বগুড়া থেকে একটি সংবাদভিত্তিক চ্যানেলের আবহাওয়া সংক্রান্ত লাইভ দেখে চোখ আটকে যায়। সহজভাবে গুছিয়ে শীত, টানা শৈত্যপ্রবাহ, মানুষের দুর্ভোগ-দুর্দশাসহ পুরো পরিস্থিতির বর্ণনা ছিলো সেখানে। সংক্ষিপ্ত কিন্তু প্রয়োজনীয় সব তথ্যে সমৃদ্ধ লাইভের বক্তব্য ছিলো খুবই প্রাঞ্জল। সংশ্লিষ্ট বার্তাকক্ষে যোগাযোগ করে জানা গেলো, তিনি ওই চ্যানেলের বগুড়া জেলা প্রতিনিধি সুমনা হেমব্রম। সুমনা কিংবা আতিকের মতো প্রতিটি চ্যানেলের প্রত্যেক প্রতিবেদকের লাইভকে মানসম্মত করে তোলা জরুরি। কারণ দিন শেষে একটি যথার্থ লাইভ যেমন প্রতিবেদকের অ্যাকাউন্ট সমৃদ্ধ করে, তেমনই এর উল্টোটা ঘটারও আশঙ্কা রয়েছে। একজন প্রতিবেদকের একটা ভুল বা অসতর্কতার কারণে পুরো দিন মাটি হতে পারে সেই চ্যানেলের।

লেখক : সুশান্ত সিনহা, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল যমুনা টেলিভিশন-এর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক।

sinhasmp@yahoo.com

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন