Magic Lanthon

               

তাওছিয়া তাজমিম

প্রকাশিত ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

একটি ‘কিরণমালা গ্রাম’-এর গল্প

তাওছিয়া তাজমিম


ভূমিকা

শেষ পর্যন্ত কি বিয়ে হবে ঝিল-সঞ্জুর, নাকি ঘটবে অন্য ঘটনা? ঝিল-সঞ্জুর নীরব প্রেমের মহাপর্ব দেখতে শুক্রবার রাত ৮:৩০-এ চোখ রাখুন জি বাংলায়। এক সপ্তাহ ধরে দেখানো হচ্ছে এ প্রোমো। প্রোমোর কথাগুলো শুনে হালিমা বেগমের মনে কাজ করছে চাপা অস্বস্তি। সত্যি কি বিয়েটা হবে নাকি ঘটনা মোড় নিবে অন্যদিকে? অপেক্ষা আর অস্বস্তির মধ্যে কেটে যায় একটি সপ্তাহ। তার পর আসে কাক্সিক্ষত সেই রাত, সেই পর্ব। যে পর্বে অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে বিয়ে হয় ঝিল-সঞ্জুর। স্বস্তি পায় নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের বসুনিয়াপাড়ার ৪৫ ঊর্ধ্ব হালিমা।

প্রোমো দেখানোর সময় হালিমা কথা দিয়েছিলেন সত্যি যদি বিয়েটা হয়, তাহলে তিনি যে প্রতিবেশীর বাড়িতে সোপ অপেরা দেখেন তাদেরকে পিঁয়াজি কিনে খাওয়াবেন। কথা রাখেন হালিমা, প্রতিবেশীদের পিঁয়াজি খাইয়ে উদ্যাপন করেন ঝিল-সঞ্জুর বিয়ে। তুমি রবে নীরবে সোপ অপেরায় ঝিল-সঞ্জুর বিয়েতে হালিমা যেমন খুশি হয়েছেন, তেমনই তিনি প্রচণ্ড কষ্টও পেয়েছেন ঠিক যেন লাভ স্টোরির নায়িকা ঈশার মৃত্যুতে। ঝিল-সঞ্জু, ঈশা-আদি কিংবা পাখি-অরণ্য তো আজ হালিমার কাছে তার পরিবারের সদস্যের মতোই আপন। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬:৩০ থেকে রাত ১১:৩০ পর্যন্ত তিনি সময় কাটান সোপ অপেরার এই চরিত্রগুলোর সঙ্গে। তাইতো তাদের আনন্দে-কষ্টে তিনি সমানুভূতি পান।

রণচণ্ডীর কথা : কী সন্ধানে যাই সেখানে

বাংলাদেশের উত্তরের জেলা নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার রণচণ্ডী গ্রামের বসুনিয়াপাড়ায় হালিমা বেগমের বাড়ি। উপজেলা শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরের এই গ্রামটিতে ১৫ বছর আগেও বিদ্যুৎ ছিলো না। গ্রামের নারীরা সন্ধ্যা হলেই সংসারের কাজ শেষ করে একে অন্যের বাড়িতে গিয়ে গল্প করে সময় কাটাতো। আর তাদের স্বামীরা হাটবাজার শেষে বাড়ি ফিরলে তারাও বাড়ি ফিরতো এবং সবাই মিলে একসঙ্গে খেয়ে রাত বাড়ার আগেই ঘুমিয়ে পড়তো। দিন শুরু হতো ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে। তখন তাদের জীবনে প্রতিবেশীর উঠোনে জমিয়ে গল্প করার বাইরে বিনোদন ছিলো কারো বাড়িতে ব্যাটারিচালিত টেলিভিশনে শুক্রবার বাংলা চলচ্চিত্র আর রাতে আলিফ লায়লা কিংবা সিন্দাবাদ দেখা। যদিও মাঝে মাঝে তারা সপ্তাহান্তে সম্প্রচারিত নাটক দেখতো, তবে সেটা ছিলো অনেকটাই বিলাসিতার শামিল। উপজেলা সদরের প্রেক্ষাগৃহে কালেভদ্রে গ্রামের নারীরা দলবেঁধে কোনো চলচ্চিত্র দেখতে গেলেও তা খুব একটা ভালোভাবে নেওয়া হতো না।

রণচণ্ডীর চেহারা এখন অনেকখানি বদলে গেছে। গ্রাম থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে এখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ, ব্র্যাক স্কুল, কমিউনিটি ক্লিনিক, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। গ্রামের বিভিন্ন পাড়ায় বিদ্যুৎ ও ডিশ সংযোগও রয়েছে। বদলে যাচ্ছে সেই গ্রামীণ নারীদের জীবনাচরণও। যে নারীরা সপ্তাহে একদিন টেলিভিশন দেখার সুযোগ পেতো বা পেতো নাসেই নারীরা আজ ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেলিভিশন দেখে সময় কাটায়। সেই নারীরা এখন প্রতিবেশীর উঠোনে আড্ডা দেওয়ার চেয়ে সোপ অপেরা দেখাকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এখন ভিন্নতর ও স্বপ্নময় দূরদেশি জীবন, জাতীয় স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা-রাজনীতি এবং লোভনীয় পণ্যের মদির আহ্বানে তারা মশগুল হয়। গিন্নী-বউরা সিনেমা আর সিরিয়াল নাটক দেখে পরিবার ও সমাজে তাদের ভূমিকাটি রপ্ত করে নেয়। গ্রামের সামর্থ্যবান সবার হাতেই আছে মোবাইল ফোন, এমনকি বাড়ির গিন্নিদের হাতেও। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সি প্রতি চার জন নারীর মধ্যে তিন জনই মুঠোফোন ব্যবহার করে। রণচণ্ডীর নারীরাও এর বাইরে নয়।

রণচণ্ডীর সব পাড়ায় এখনো বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছায়নি। কিন্তু সেসব পাড়ায়ও পৌঁছে গেছে সোপ অপেরা। সেখানেও রয়েছে সোপ অপেরায় মত্ত দর্শক (Heavy Viwer)। বিদ্যুৎ না থাকলেও গ্রামের মানুষের মোবাইল ফোনসেট আছে। সেই ফোনসেটে নৈমিত্তিক প্রয়োজন ও সামাজিক যোগাযোগের চাহিদা পূরণের বাইরেও ছবি তোলা, ভিডিও করা-দেখা, গান শোনা, নাটক-চলচ্চিত্র দেখা সম্ভব। আর সেই ফোনসেটের মেমোরি কার্ডে বাজার থেকে সোপ অপেরা ধারণ করে দেখে গ্রামের নারীরা। বিদ্যুৎ না থাকলেও সোপ অপেরা দেখার সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত নয়।

বাস্তব ও নির্মিত বাস্তবের মধ্যে বসবাস

মানুষ হাজারো কোড ও ইমেজের মধ্যে বাস করে। প্রতিনিয়ত নানা ইমেজে পরিপূর্ণ থাকে মানুষের মস্তিষ্ক। আনন্দ, কষ্ট, স্বপ্ন সর্বত্রই ইমেজের বিচরণ। প্রত্যেক মানুষ তার মতো কল্পনা করে, ইমেজ তৈরি করে। দৈনন্দিন জীবনের নানা ঘটনার পাশাপাশি সঙ্গীত, কবিতা, চিত্রকলাসহ বিভিন্ন শিল্পকর্ম থেকে আসে এই ইমেজ। এই ইমেজ তৈরিতে ভূমিকা রাখে গণমাধ্যমও। গণমাধ্যম বিশেষত দৃশ্যমাধ্যম যেহেতু সমাজ-বাস্তবতার কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে, সেহেতু ইমেজ তৈরিতেও ভূমিকা রাখে। বেতার শ্রুতিমাধ্যম হওয়ায় আগে মানুষ বেতারে শব্দ শুনে তার সঙ্গে সেই বিষয় সম্পর্কিত ধারণা মিলিয়ে নিজের মতো করে ইমেজ তৈরি করতো। বেতারের সেই দৃশ্যমানতার অভাব দূর করে টেলিভিশন। শব্দ ও ইমেজের যথাযথ উপস্থাপন হয়ে ওঠে টেলিভিশনের মূল আকর্ষণ। একই সঙ্গে দেখা ও শোনার কাজ হয় বলে দর্শকদের কাছে অন্যান্য মাধ্যমের চেয়ে টেলিভিশন অনেক বেশি কাছের ও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।

টেলিভিশন বাস্তবজীবনকে নাটক, সংঘাত এবং ঘটনা প্রবাহ ইত্যাদির আঙ্গিকে দর্শক-শ্রোতার সামনে হাজির করে। এক্ষেত্রে তারা প্রদর্শিত বাস্তব এবং কাল্পনিক বিষয়গুলোর সঙ্গে কথোপকথন, বর্ণনা কিংবা সক্রিয় না থেকেও অংশগ্রহণ বা টেলিভিশন দর্শক-শ্রোতাকে আন্দোলিত ও উত্তেজিত করে। গণমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশনের ক্ষমতা প্রশ্নাতীত।

সেই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে টেলিভিশন জীবনধর্মী অভিজ্ঞতার সমন্বয় ঘটানোর মাধ্যমে দর্শক-শ্রোতার সামনে একধরনের বাস্তবতা নির্মাণ করে। টেলিভিশনের সঙ্গে প্রতিদিন অনেকটা সময় কাটানোর ফলে কখনো কখনো টেলিভিশনের সেই নির্মিত বাস্তবতা অনেকের কাছে ‘প্রকৃত’ বাস্তবতা হয়ে ধরা দেয়। বিষয়টি এমন হয় যে, টেলিভিশন বিরাজ করতে থাকে দর্শকের চেতন এবং অবচেতন [অচেতন] মনে। ফলে তারা কেবল টেলিভিশন দেখে না, টেলিভিশনের সঙ্গে ঘর করে।

তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে বর্তমানে টেলিভিশনের চেয়ে আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সাইবার জগৎ। নতুন মাধ্যম হিসেবে সাইবার জগতে এক শ্রেণির মানুষের সম্পৃক্ততাও বাড়ছে। গণমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশনের ইতিবাচক দিক দেখা ও শোনার বিষয়টি থাকলেও, এর ফলাবর্তনের যে দিক সেটি অনেকখানি ধীর গতিসম্পন্ন। অন্যদিকে গণমাধ্যম হিসেবে সাইবার জগতে দেখা ও শোনার পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রেই ফলাবর্তন পাওয়া যায় দ্রুত। ফলে টেলিভিশনের চেয়ে সাইবার জগৎ নিয়ে মানুষ অনেক বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সাইবার জগতের ক্ষমতা এমনই ব্যাপক যে, তা মানুষে মানুষে সম্পর্কের ধরন পর্যন্ত বদলে দিচ্ছে।

সাইবার জগতে দেখা ও শোনার বাইরে ফলাবর্তন প্রক্রিয়া কখনো কখনো এতো দ্রুত হয় যে, ব্যবহারকারী বুঝতেই পারেন না তিনি বাস্তবে আছেন নাকি সাইবার জগতে। ফলে মানুষ যতো বেশি সাইবার জগতে যুক্ত থাকে, তার কাছে বাস্তব ও সাইবার জগতের পার্থক্য ততো বেশি কমতে থাকে। ব্যাপারটা অনেকটা এ রকম যে, ফেইসবুকে কেউ একটা ছবি বা স্ট্যাটাস দিলে তাতে দ্রুত লাইক, কমেন্ট পড়তে শুরু করে। ব্যবহারকারীও প্রত্যুত্তর দিতে থাকে। ফেইসবুকের এই ফলাবর্তন সেটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক যাই হোক না কেনো, তা ব্যবহারকারীকে বারবার এই মাধ্যমের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে। সে যতো বেশি এই মাধ্যমে সম্পৃক্ত হয়, তার সঙ্গে বাস্তবের দূরত্ব ততোই বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে সে সাইবার নির্মিত বাস্তবতার মধ্যে বাস করতে থাকে। যুক্তরাজ্যের একটি জরিপে দেখা গেছে, ভার্চুয়াল সম্পর্কের কারণে ৪০ শতাংশ দম্পতি নিজেদের স্বাভাবিক সম্পর্ক উপেক্ষা করছেন। ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই জরিপে এক নারী বলেছেন, আমার এবং আমার স্বামীর মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তির কাজ করছে স্মার্টফোন।

আমাদের দেশে সাইবার জগতে এখনো সব শ্রেণির মানুষের প্রবেশের সামর্থ্য নেই। কারণ সাইবার জগতে প্রবেশের জন্য অর্থ, প্রযুক্তি জ্ঞান ও ন্যূনতম শিক্ষার প্রয়োজন। তবে এর গতি যেভাবে বাড়ছে, তাতে হয়তো অল্প সময়ের মধ্যে এটিও গণমানুষের মাধ্যমে পরিণত হবে।

টেলিভিশনের ঠিকানাতেই আছি

সম্প্রতি দেশের বেশিরভাগ প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হওয়া, সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বিনোদন কমে যাওয়ায় মানুষের বিনোদনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে টেলিভিশন। এই সুযোগে টেলিভিশন নানাধরনের অনুষ্ঠানের পসরা সাজিয়ে হাজির হয় দর্শকের সামনে। টেলিভিশনের এসব অনুষ্ঠানের আধেয়ের মতো দর্শকও ভিন্ন ভিন্ন। চ্যানেলগুলো তাদের উদ্দিষ্ট দর্শক হিসেবে সাধারণত বয়স্ক বা পুরুষদের জন্য সংবাদ, টক শো, শিশুদের জন্য কার্টুন, তরুণদের জন্য ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, গানের অনুষ্ঠান ও খেলা সম্প্রচার করে। আর নারী দর্শকের জন্য সম্প্রচার করে নাটক, সোপ অপেরা। পারিবারিক টানাপড়েন, দাম্পত্য কলহ, পরকীয়া, প্রেমএ ধরনের উপাদাননির্ভর সোপ অপেরা সব শ্রেণির দর্শক, বিশেষ করে নারীদের একটু বেশি আগ্রহী করে।

সোপ অপেরার দর্শকের সামনে এমন একধরনের বাস্তবতা নির্মাণ করা হয়, তারা অনেক ক্ষেত্রেই এর বাস্তবতা ও বাস্তবের বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। কখনো কখনো দর্শকরা সোপ অপেরার বাস্তবতাকেই সত্যি হিসেবে ভাবতে শুরু করে। ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল দূরদর্শন-এ যখন রামায়ণ দেখানো হয়, সেই সময় ভারতের এক বিশাল অঙ্কের মানুষ এই সোপ অপেরার বাস্তবতা এবং বাস্তবের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেনি। সেই সময় ভারতীয় রামায়ণ দেখেছেন এমন একজন দর্শক, কলেজ শিক্ষার্থী পুনম শর্মার মতে বিষয়টি এ রকমটা বিস্ময়কর যে রামায়ণ সিরিয়ালের রাম ও সীতার চেহারা আমি যেমন কল্পনা করেছিলাম ঠিক তেমনই। রাম-সীতার শান্ত, লক্ষণের রাগী, রাবণের ভয়ঙ্কর আচরণ একদম সেরকম যা আমি সবসময় কল্পনা করেছিলাম। কীভাবে অভিনেতারা এমন করলো? পুনমের কল্পনায় ‘রামায়ণ’-এর চরিত্রদের নিয়ে যে ইমেজ ছিলো, তার সঙ্গে যখন নির্মিত চরিত্রের ইমেজ মিলে যায়, তখন তিনি সোপ অপেরার বাস্তবতাকেই বাস্তব বলে মনে করেন। সেই সময় এমনও ঘটনা ঘটেছে যে, ‘রামায়ণ যখন সম্প্রচার হতো, তখন ভারতের অনেক হিন্দু দর্শক স্নান করে পবিত্র হয়ে টেলিভিশনের সামনে বসতো। অনেকে ধুপ জ্বালিয়ে প্রণাম করে ভক্তি সহকারে টেলিভিশন দেখতো।

এখনো অনেক ক্ষেত্রে দর্শকদের কাছে সোপ অপেরার বাস্তবতাই সত্যি হয়ে ধরা দেয়। সে কারণেই প্রয়াত অভিনেতা পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায় অভিনীত চরিত্র অমর্ত্যর (জল নূপুর সোপ অপেরায় অমর্ত্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন পীযূষ) যখন জল নূপুর-এ মৃত্যু হয়, তখন দর্শকেরা কষ্ট পায়। জল নূপুর-এ অমর্ত্যর মৃত্যুর পর পারি’র (জল নূপুর-এ অমর্ত্যর স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন পারি) সাদা শাড়ি পরা দেখে তারা কাঁদেন। তারা পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাস্তবের মৃত্যুর জন্য কষ্ট পায় সোপ অপেরায় পারি’র সাদা শাড়ি পরা দেখে। যেখানে পারির সাদা শাড়ি পরার সঙ্গে পীযূষের মৃত্যুর সত্যি কোনো সম্পর্ক নেই। সোপ অপেরার নির্মিত বাস্তবতার সঙ্গে তারা সত্যিকারের বাস্তবতার পার্থক্য করতে পারে না।

সোপ অপেরার নির্মিত বাস্তবতাকে গ্রামের মানুষেরা, বিশেষ করে গ্রামীণ নারীরা কীভাবে দেখছে এবং তার সঙ্গে তারা কীভাবে সম্পৃক্ত হচ্ছেতা জানার জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার রণচণ্ডী ইউনিয়নের রণচণ্ডী গ্রামকে বেছে নেওয়া হয়। এ গ্রামটি বেছে নেওয়ার কারণ হলো, গ্রামের একটি পাড়ার দর্শকেরা টেলিভিশনে সোপ অপেরা দেখে, আর অন্য একটি পাড়ায় বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় তারা দোকান থেকে মোবাইল ফোনসেটের মেমোরি কার্ডে তা ধারণ করে এনে দেখে। অর্থাৎ সোপ অপেরার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দর্শক রয়েছে এই গ্রামে। এই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দর্শকেরা সোপ অপেরার নির্মিত বাস্তবতাকে কীভাবে দেখছে এবং কীভাবে এর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করছে তা দেখার উদ্দেশ্যে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ২৩ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১০ দিন রণচণ্ডী গ্রামের নারী দর্শকের সঙ্গে কথা বলে তাদের সম্পৃক্ততার গল্প তুলে ধরা হয়েছে।

সোপ অপেরার বাস্তবতায় বাঁচা

সেদিন (২৮ নভেম্বর ২০১৫) বসুনিয়াপাড়ার দুই-একটি বাড়ি ঘুরে যখন নার্গিস বেগমের বাড়িতে পৌঁছালাম, তখন দুপুর। নার্গিস বেগম উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছিলেন। আমাকে দেখে কাজ বাদ দিয়ে হাসিমুখে এগিয়ে আসেন তিনি। সোপ অপেরা নিয়ে কথা বলবো শুনে বেশ আগ্রহ দেখান নার্গিস। টুলে বসতে দিয়ে হাতের কাজ সেরে এসে তিনি নানা বিষয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। শুরুতেই কথা হলো তার প্রিয় সোপ অপেরা ইচ্ছেনদী নিয়ে। ‘ইচ্ছেনদী নিয়ে তার ভালো-মন্দ লাগার কথা তিনি জানালেন। অন্যান্য সোপ অপেরার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলার পর হঠাৎই কেঁদে ফেললেন তিনি। নার্গিসকে কাঁদতে দেখে যদিও খুব একটা অবাক হইনি, কেননা এর আগে যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের অনেকের মধ্যেই সোপ অপেরার বিভিন্ন ঘটনা বা বিষয় নিয়ে মন খারাপ বা বিমর্ষতা দেখেছি। তাই ভাবলাম, তিনি হয়তো সোপ অপেরার কারো মৃত্যুতে অথবা কোনো ঘটনায় কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু নার্গিস বললেন একেবারে অন্য কথা। তার স্বামী কিছুই করেন না, জমি যা ছিলো তার অনেকটাই বিক্রি করা শেষ। আর এখন যতোটুকু আছে তা দিয়ে সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়। সংসারের এমন অবস্থায় নীলফামারীতে স্নাতক পড়ুয়া একমাত্র মেয়েকে প্রতি মাসে তিন হাজার টাকা দিতে হয়। সেই টাকার চিন্তায় তার ঘুম আসে না। ৪০ ঊর্ধ্ব নার্গিসের এই বয়সে তেমন কিছু করার উপায়ও নেই। এসব কষ্ট ভুলতেই তিনি নিয়মিত সোপ অপেরা দেখেন। সন্ধ্যা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত প্রতিবেশীর বাড়িতে সোপ অপেরা দেখে যখন তিনি ঘুমাতে যান, তখন সেই গল্পই মাথায় ঘুরপাক খায়, সংসারের ঝামেলার কথা মনে আসে না।

নার্গিসের উঠোনে বসে যখন কথা বলছিলাম, তখন পাশেই তার জা শাহনাজ বেগম একজনকে নিয়ে চাল থেকে আটা করছিলেন। নার্গিসের সঙ্গে কথা বলার সময় অবশ্য শাহনাজের সঙ্গে কয়েকবার চোখাচোখি হয়। মুখাবয়ব দেখে বুঝতে কষ্ট হচ্ছিলো না, তিনি আমাদের কথা শুনছেন। কথা বলার মাঝখানে হঠাৎই কানে আসে শাহনাজ তার সঙ্গে থাকা নারীকে বলছেন, ‘অসীমার জন্যে খুব চিন্তা হয়ছে। কায় যে ওক মারি ফেলাইল বুঝির পাংছো না। আইজ সকালে ভাত খাইতে খাইতে বাবুর আব্বুক কনু, তোমার কী মনে হয়, কায় মাইবার পায় অসীমাক? শাহনাজের এই কথা শুনে এবার মুখ ঘুরিয়ে একটু আগ্রহ নিয়ে তার কাছে জানতে চাই, অসীমা কে, আর কী-ইবা হয়েছে তার? আমার প্রশ্ন শুনে শাহনাজ খানিকটা উৎসাহ নিয়েই বলতে শুরু করেন, ভারতের ন্যাশনাল চ্যানেলে সম্প্রচারিত সোপ অপেরা পবিত্র বন্ধন-এর নায়িকা অসীমার কথা। অসীমার সঙ্গে নাকি তার জীবনের অনেক মিল। অসীমা যেমন সংসারের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেন, তাকে কেউ বোঝে না; তেমনই তাকেও তার সংসারের কেউ বুঝতে চায় না।

কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম শাহনাজের বিদেশ ফেরত স্বামী বর্তমানে কিছুই করেন না। জমানো যা টাকা ছিলো তাও শেষ হয়ে গেছে। কয়েকটি গরু-ছাগল পালন আর অল্পকিছু জমি থেকে যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চালাতে তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়। সংসারের বিভিন্ন প্রয়োজনে কিংবা সন্তানদের পড়াশোনার খরচ জোগাতে অনেক সময় তাকে ভাই-বোনের কাছ থেকে সাহায্য নিতে হয়। এমনকি বাড়িতে যে টেলিভিশনটি আছে, সেটিও শাহনাজের বোনের টাকায় কেনা; যদিও সেটি তার স্বামীও দেখেন, কিন্তু নষ্ট হলে তা শাহনাজকেই ঠিক করতে হয়।

সংসারের জন্য এতো কষ্ট করার পরও যেহেতু কেউ তাকে বুঝতে চায় না, তাই হয়তো শাহনাজের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সোপ অপেরার অসীমা। অসীমার জীবনের কষ্ট, হতাশা কিংবা আশায় তিনি হয়তো তার জীবনের প্রতিচ্ছবি খুঁজে ফেরেন। অসীমা ও শাহনাজ মানসিকভাবে এতো কাছাকাছি যে, গত তিন বছরে নাটকটির একটি পর্বও না দেখে থাকেননি তিনি। এমনকি যে দুই দিন পবিত্র বন্ধন সম্প্রচারিত হয় না, সে দুই দিন তিনি টিভি পর্যন্ত দেখেন না। সারাদিন সংসারের কাজ করে ক্লান্ত শাহনাজ রাত ১১টা পর্যন্ত জেগে থাকেন সোপ অপেরাটি দেখার জন্য। আগে অবশ্য সকালে সোপ অপেরাটি পুনঃপ্রচার হতো, তাই রাতে না দেখলেও সকালে দেখা যেতো, কিন্তু এখন আর তা হয় না। তাই যতো কষ্টই হোক, রাতে সোপ অপেরাটি দেখেই তিনি ঘুমাতে যান।

যেদিন নার্গিস ও শাহনাজ বেগমের সঙ্গে কথা হলো সেদিন রাতে আমাদের বাড়িতে সোপ অপেরা দেখছিলেন পাশের বাড়ির সেই হালিমা বেগম। বিজ্ঞাপন বিরতিতে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সোপ অপেরার কী সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। তিনি জানালেন, কিরণমালার জাদু দেখতে বেশি ভালো লাগে। কিরণমালার মতো যদি জাদু দিয়া রাইতা-রাইত বড়োলোক হওয়া যাইতো, তাইলে সংসারে ঝগড়া-কাজিয়া কিছুই হইলো না হয়, সবাই সুখে শান্তিতে থাকনো হয়।

নার্গিস, শাহনাজ কিংবা হালিমা কোনো না কোনোভাবে প্রশান্তি খুঁজে পান সোপ অপেরার মধ্যে। কেউ নিজের কষ্ট ভুলতে, কেউ নিজেকে খুঁজে পেতে, আবার কেউবা স্বপ্ন দেখেন সোপ অপেরার মতো জীবনের। তিন জনকেই প্রশান্তি দেয় টেলিভিশন। এটাই আসলে টেলিভিশনের শক্তি। গার্বনার যেমনটি বলেন, টেলিভিশনের শক্তি আসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, সপ্তাহের পর সপ্তাহ বাস্তব জীবনের প্রতীকি আধেয় থেকে। নার্গিস, শাহনাজ কিংবা হালিমা যখন টেলিভিশনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পারিবারিক গল্পনির্ভর সোপ অপেরা দেখেন, তখন তারা সেটাকেই বাস্তব ভাবতে থাকেন। তারা বিদ্যমান বাস্তবতাকে অস্বীকার করে টিভির বাস্তবতার সঙ্গে নিজেকে মেলানোর চেষ্টা করেন। বাস্তব জীবনের ঝামেলা, অর্থকষ্ট, সন্তানের পড়াশোনার দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচতে তারা যেনো সোপ অপেরার মধ্যেই জীবনের সান্ত্বনা খুঁজে পান।

কিরণমালার ছবি থাকলেই বিক্রি ভালো হয়

১ ডিসেম্বর ২০১৫, বিকেলে বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে পাড়ার মধ্যে হাঁটছিলাম। একটু দূরে একটা জটলা দেখে এগিয়ে যাই, একজন ফেরিওয়ালা সাইকেলে করে প্রসাধন সামগ্রী বিক্রি করছেন। ক্রেতাদের বেশিরভাগই নারী। তারা বেশ আগ্রহ নিয়ে নানা জিনিস দেখছে, কথা বলছে। আমি খানিকটা সঙ্গোপনে তাদের সঙ্গে শরিক হই এবং নানা কথা শুনতে থাকি। ফেরিওয়ালার সাইকেলের পিছনের প্লাস্টিকের ঝুড়ির মধ্যে হঠাৎই চোখে পড়ে কিরণমালার ছবিওয়ালা একটি প্যাকেট। ফেরিওয়ালার কাছ থেকে প্যাকেটটি নিয়ে দেখলাম, সেটি রঙ ফর্সাকারী স্নো‘কিরণমালা ফেয়ারনেস স্কীন ক্রিম পার্ল স্নো! স্নোটি দেখে একটু আগ্রহ নিয়েই ফেরিওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, এসব কেনে মানুষ? প্রশ্ন শুনে ফেরিওয়ালা রাজ্জাকুর ইসলাম খানিকটা উৎফুল্ল হয়ে বললেন, কেনে না মানে, কী বলেন! সৈয়দপুর থেকে সাত দিনের জন্য ১৫টা করি স্নো নিয়া আসি, তিন-চার দিনের মধ্যেই সব স্নো বিক্রি হয়া যায়। নারী আর অল্পবয়সী মেয়েরাই এই স্নো বেশি কেনে। স্নোর গায়ে কেবল কিরণমালার ছবি থাকায় এর বিক্রি বেশি হয় বলে রাজ্জাকুর মনে করেন।

ফেরিওয়ালার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই লুৎফর রহমান নামে একজনকে সেই স্নো কিনতে দেখলাম। আগ্রহ হলো লুৎফরের সঙ্গে কথা বলার। লুৎফর তার বউয়ের জন্য স্নোটি কিনেছেন। একটু সঙ্কোচ নিয়েই তার কাছে স্নো কেনার কারণ জানতে চাইলাম; তিনি অবশ্য নিঃসঙ্কোচেই বলে গেলেনকিরণমালাকে তার খুব ভালো লাগে, তাই বউয়ের জন্য এই কিরণমালা স্নো। লুৎফরের স্ত্রী অবশ্য পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। দেখলাম তিনি যথেষ্ট ফর্সা। তাহলে তার রঙ ফর্সাকারী স্নোর দরকার হলো কেনো? লুৎফর কী তাহলে কিরণমালার মতো নারী শরীর কামনা করেন? বাস্তবে তো তা পাওয়া সম্ভবও নয়। কারণ এই ছবিগুলিতে থাকে ক্যালেন্ডারের সৌন্দর্য যা আমাদের চকচকে, মসৃণ, স্বার্থপর জীবনের আকাক্সক্ষায় কামুক করে তুলতে ... পারে ঠিকই, তবে সামনে এসে দাঁড়ায় না কখনো ‘বাস্তব হয়ে। তাই হয়তো ‘কিরণমালার নির্মিত শরীর’ লুৎফরেরা খুঁজে ফেরেন স্ত্রী কিংবা পরিচিত কোনো নারীর মধ্যে।

কিরণমালা স্নো দেখে অন্য বিষয়ে একটু আগ্রহী হলাম, কারণ এর আগে সিরিয়ালের পাখি‘কিরণমালা এবার লেখাপড়ার খাতায় শিরোনামে একটি সংবাদ পড়েছিলাম। তাই মনে হলো স্থানীয় দোকানগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা যেতে পারে, এ রকমের অন্য কোনো পণ্য পাওয়া যায় কি না। সেই পণ্য খোঁজার উদ্দেশ্যে লুৎফরের সঙ্গে কথা শেষ করে হাঁটতে থাকি পাশের খদ্দপাড়ার মুদি দোকানের দিকে। খদ্দপাড়ার শেষে রাস্তার পাশে অবস্থিত দোকানটি। দোকানে গিয়ে দেখলাম নিলুফা বেগম নামে একজন বসে আছেন। স্বামী দিনের বেলা মাঠে কাজ করেন, তাই দিনে নিলুফা আর রাতে স্বামী দোকানে বসেন। দোকানে টেলিভিশন দেখে জানতে চাইলাম, তিনি সোপ অপেরা দেখেন কি না। নিলুফা জানালেন, রোজ তিনিসহ প্রায় ৩০-৪০ জন সোপ অপেরা দেখেন। আর সোপ অপেরা দেখার সময় তার দোকানে ভালো বিক্রি হয়। অবশ্য ওই দোকানে পরে বিভিন্ন পণ্যের পাশাপাশি কিরণমালা, জল নূপুর, বোঝেনা সে বোঝেনার ছবিযুক্ত খাতা, কলম, চিপস, আচার, চকলেট, বেলুন দেখতে পাই। কথা প্রসঙ্গে নিলুফা জানালেন, শিশুদের কাছে সোপ অপেরার ছবিযুক্ত এসব পণ্যের চাহিদা খুব বেশি।

নিলুফার দোকান থেকে ফেরার পথে দেখা হয় বসুনিয়াপাড়ার দর্জি বিউটি বেগমের সঙ্গে। ক্লাস ওয়ানে পড়া মেয়ের আবদার মেটাতে তিনি কিরণমালা চিপস কিনতে নিলুর দোকানে গিয়েছিলেন। মেয়ে যেমন কিরণমালা চকলেট, চিপসের আবদার করে, তেমনই তারও কিরণমালার মতো শাড়ি-জামার ইচ্ছে হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘টিভির মতন শাড়ি-জামার ইচ্ছা তো হয়, কিন্তু সামর্থ্যরে কারণে কিনির পাই না। তবে টাকা হইলে কিনমো।’ বিউটি বেগমের মতো গ্রামের অনেক নারীরই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সোপ অপেরার চরিত্রের মতো শাড়ি-জামা কিনতে না পারলেও তারা তাদের সন্তানদের আবদার মেটাতে সেরকম জামা-জুতা কিনে দিচ্ছেন। ‘পাখি জামা না পেয়ে এবার গাইবান্ধায় আত্মহত্যা১০, ঈদে পাখি জামা না পেয়ে আত্মহত্যা১১ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদ থেকে পাখি জামার প্রতি মেয়েদের আগ্রহ বোঝা যায়। তাই মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহিনি নার্গিস নিজে না পারলেও গত ঈদে মেয়েকে দুই হাজার টাকা দিয়ে পাখি জামা কিনে দিয়েছেন। অন্যদিকে ছদ্মপ্রাতিস্বিকীকরণের১২ কারণে নিম্নবিত্ত পরিবারেও পৌঁছে গেছে পাখি, কিরণমালা জামা। তারা দুই হাজার টাকা দিয়ে পাখি জামা কিনতে না পারলেও কিন্তু তিনশো টাকা দিয়ে ঠিকই কিনতে পারছেন। তাইতো বসুনিয়াপাড়ার হালিমার মেয়ে আরাফাতেরও আছে তিনশো টাকার কিরণমালা জামা। ‘মনে রাখতে হবে, সব শ্রেণির মানুষের ভোগ ও ভোগের ইচ্ছাই পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখে। সাম্প্রতিক সম্প্রচারিত এসব সোপ অপেরা প্রতিনিয়ত পুঁজি ও ভোগকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। কারণ সংস্কৃতির সংকট অর্থনীতির সাথে জড়িত।১৩

সোপ অপেরা গ্রামের মানুষের মধ্যে যে ভোগের ইচ্ছা জাগ্রত করছে তা পূরণে নিম্নবিত্ত মানুষদের শহরে কাজে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে কথা হয়েছিলো চৌধুরীপাড়ার গৃহবধূ মিশু আক্তারের সঙ্গে, যিনি মোবাইল ফোনসেটে সোপ অপেরা দেখেন। এবার গ্রামে গিয়ে তার খোঁজ করতেই জানতে পারলাম মিশু, তার স্বামী, দেবর ও জা সবাই ঢাকায় চলে গেছে গার্মেন্টে কাজ করতে। শুনলাম, মিশুর স্বামী ও দেবররা গরু-ছাগল বিক্রি করে এবং চড়া সুদে ঋণ নিয়ে বাজারের কাছে একটি জমি কিনেছে। তাই ঋণের টাকা পরিশোধ করে ভালো বাড়ি বানানোর টাকা জোগাড় করতেই পুরো পরিবার শহরে কাজে গেছে।

শুধু মিশু নয়, গ্রামের আরো অনেকেই গার্মেন্টে দিনরাত ওভার-টাইম করে ভালো বাড়ি বানানোর চেষ্টা করছে, টিভি, ফ্রিজ কিনছে; আবার কেউ কেউ মা, বউ বা বোনকে নতুন শাড়ি, জামা কিনে দিচ্ছে। আর যারা নানা কারণে গার্মেন্টে যেতে পারছে না, তাদের অধিকাংশই এসব ইচ্ছা পূরণে বেছে নিচ্ছে সুদের ব্যবসা। গত তিন-চার বছরে রণচণ্ডী গ্রামে সুদের ব্যবসা এবং গার্মেন্টে যাওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। গ্রামের অর্থনৈতিক অবস্থা কিন্তু আগের মতোই আছে, শুধু বেড়ে গেছে মানুষের ভোগের ইচ্ছা।

তাদের কোনো সীমানা নেই

বসুনিয়াপাড়া থেকে পায়ে হেঁটে ১০ মিনিটের রাস্তা চৌধুরীপাড়া। ২০-২৫টি মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবার নিয়ে গঠিত এ পাড়ার অধিকাংশ মানুষ কৃষি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আশেপাশের সব এলাকায় বিদ্যুৎ থাকলেও চৌধুরীপাড়ায় এখনো বিদ্যুতের সংযোগ নেই। বিদ্যুৎ না থাকলেও সেখানকার মানুষজন সোপ অপেরার দর্শক। তাদের হাতে চিনে তৈরি অল্প দামের যে মাল্টিমিডিয়া মোবাইল ফোনসেট আছে, তার মেমোরি কার্ডে সোপ অপেরা ধারণ করে এনে তারা দেখে।

৩০ নভেম্বর সকালে চৌধুরীপাড়ায় কথা হয় মোবাইল ফোনসেটে সোপ অপেরা দেখা মরিয়মের সঙ্গে। তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, এই এলাকার নারীদেরকে স্বামী বা সন্তানরা মেমোরি কার্ডে সোপ অপেরা ধারণ করে এনে দেয়। একটি মেমোরি কার্ডে সোপ অপেরার ২০-২৫টি পর্ব ১০ টাকা দিয়ে এনে তারা তিন-চার দিন ধরে সেগুলো দেখেন। যেহেতু পাশের পাড়া থেকে মোবাইল ফোনসেট চার্জ করতে হয়, তাই একদিনে তারা তিন-চারটির বেশি পর্ব দেখেন না।

চৌধুরীপাড়ায় এরপর কথা হয় গৃহবধূ লাকী বেগমের সঙ্গে। দুই সন্তানের মা লাকীর বয়স ৪০-এর কাছাকাছি। স্বামী শহরে চাকরি করেন, সন্তানদের নিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে তিনি গ্রামেই থাকেন। প্রায় দুই বছর ধরে তিনি মোবাইল ফোনসেটে কিরণমালা‘বোঝেনা সে বোঝেনা দেখেন। সোপ অপেরার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে বলতে তার মুখে ভিন্ন ধরনের কথা শোনা গেলো। লাকী বেগমের ভাষায়, ‘আচ্ছা, হামরা যে নাটকগুল্যা দেখি সেগুলাত খালি হিন্দু ধর্মের সব দেখায় ক্যা, ইসলাম ধর্মের ক্যামা কিছুই নাই।’ যদিও তিনি এই সোপ অপেরাগুলো দেখেন, বিষয়টি তার ভালো লাগে না। তিনি জানান, হিন্দুদের হলেও সোপ অপেরার ভাষা ও জীবনাচরণের সঙ্গে তার প্রাত্যহিক জীবনের মিল আছে, তাই তিনি ভালো না লাগলেও দেখেন।

লাকীর সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ কথা বলার পর বুঝতে পারলাম, তিনি আসলে রোজ যে সোপ অপেরাগুলো দেখেন, সেগুলো কোন দেশের তা জানেন না। তার কথায় বোঝা যায়, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যে সংস্কৃতিগত পার্থক্য আছে, সোপ অপেরা দেখে তা তিনি বুঝতে পারেন না। অবশ্য এটা ঠিক, বিশ্বায়নের এই যুগে ভৌগোলিক সীমারেখাগুলো আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যে মানুষ জানেই না রাষ্ট্রীয় সীমারেখা কী, তার কাছে ভৌগোলিক এই রাষ্ট্রের চেয়ে তার কল্পনার রাষ্ট্র বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

লাকী বেগমের সঙ্গে কথা বলার দুই দিন পর গিয়েছিলাম রণচণ্ডীর খদ্দপাড়ায়। সেখানে কথা হয় ৬০ ঊর্ধ্ব জাহেনুর বানুর সঙ্গে। তিনি ‘কিরণমালার নিয়মিত দর্শক। পাড়ার মুদি দোকানে তিনি সোপ অপেরা দেখেন। তিনিও বুঝতে পারেন না সেগুলো ভারতীয় নাকি বাংলাদেশি। তার মতে, ‘টিপির মোতন ঘটনা তো হামার ইত্তিও হয়ছে, তা উলা ফির এন্ডিয়ান হয় ক্যামন করি। লাকী বেগম কিংবা জাহেনুর বানুর মনে সোপ অপেরা দেখতে দেখতে দেশ-জাতি সম্পর্কে যে ধারণা তৈরি হয়েছে, তার সঙ্গে বাস্তবের ভৌগোলিক সীমারেখার কোনো সম্পর্ক নাই। দেশ-জাতি বলতে নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলের সামাজিক, সাংস্কৃতিক যে সম্প্রদায়কে বোঝায়, তার সঙ্গে যোজন যোজন দূর সম্পর্ক লাকী, জাহেনুরের ভাবনার।

‘মেয়েদের সব সহ্য করতেই হবে

৩০ নভেম্বর দুপুরে চৌধুরীপাড়ায় গিয়েছিলাম দিনমজুর জালালের বাড়িতে। সেখানে কথা হলো সেই বাড়ির পুত্রবধূ কাজলীর সঙ্গে। সালোয়ার-কামিজ পরা অল্পবয়সী কাজলীকে দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম তিনি হয়তো এই বাড়ির মেয়ে। কিন্তু কিছুক্ষণ কথা বলার পর জানতে পারলাম কাজলী এই বাড়ির পুত্রবধূ। ১৯ বছর বয়সি কাজলীর দুই বছরের একটি সন্তানও আছে। ভ্যানচালক স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, দুই ভাসুর-জা, দেবর নিয়ে কাজলীর সংসার। তিনি সোপ অপেরার নিয়মিত দর্শক। কাজলীদের বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকলেও ভিডিও দেখা যায় এমন মোবাইল ফোনসেট আছে। সেই ফোনসেটের মেমোরি কার্ডে বাজার থেকে সোপ অপেরা ধারণ করে এনে দেন তার স্বামী। কাজলী প্রায় তিন বছর ধরে এভাবেই বোঝেনা সে বোঝেনা, কিরণমালা, তুমি আসবে বলেতোমায় আমায় মিলে দেখেন।

কাজলীর বাড়ির উঠোনে পিঁড়িতে বসে সোপ অপের নিয়ে কথা হচ্ছিলো তার সঙ্গে। কথা বলতে বলতে তিনি সংসারের কাজও করছিলেন। কাজলীর বয়স কম হলেও তার চেহারায় কেনো জানি কোনো উচ্ছলতা চোখে পড়ছিলো না। বরং বয়সের তুলনায় তাকে বেশখানিকটা গম্ভীরই মনে হলো। কথার একপর্যায়ে কাজলী নিজে থেকেই বলতে শুরু করেন, যেসব মেয়েরা সবকিছু মেনে নিয়ে শান্তিতে সংসার করে তাদের তার বেশি ভালো লাগে। তার ভাষায়, মেয়ে মানষোক সগ (সব) সহ্য করা নাগে। সেই জন্যি পুতিবাদ (প্রতিবাদ) না করি সগ মানি নিয়া সংসার করাই ভালো। সোপ অপেরার মতো তার সংসারেও ঝগড়া-বিদ্বেষ প্রায়ই হয়। সেসব বিষয় খুব স্বাভাবিকভাবে মেনে নেন তিনি।

চৌধুরীপাড়ার কাজলীর মতো বসুনিয়াপাড়ার গৃহবধূ মোতাহারাও মনে করেন বাড়ির বউ হওয়া উচিত গোয়েন্দা গিন্নির পরমার মতো। পরমা যেমন বাইরের কাজে দক্ষ, আবার সংসারেও সবার মন রক্ষা করে চলেঠিক তেমন। দুই সন্তানের মা মোতাহারা সারাদিন সংসারের কাজ করে সন্ধ্যা থেকে সন্তানদের পড়াশোনা করান। এরপর রাত আটটা থেকে ১১টা পর্যন্ত টেলিভিশনে সোপ অপেরা দেখেন। এই তিন ঘণ্টায় তিনি স্টার জলসাজি বাংলায় সবমিলিয়ে প্রায় আটটি সোপ অপেরা দেখেন। পরমা মিত্রের ঘরে-বাইরে সফলতার জন্য গোয়েন্দা গিন্নি তার বেশি প্রিয়।

কাজলী ও মোতাহারার কথা শুনে বোঝা যায়, নারীর সামাজিক ভূমিকা নির্মাণের রাজনীতিতে সোপ অপেরা অনেকাংশে সফলনারী সর্বংসহা। যে নারী শ্বশুরবাড়ির কিংবা স্বামীর সব অবহেলা-অত্যাচার সহ্য করেও সংসারের সবার মঙ্গলের জন্য কাজ করে, সে-ই আদর্শ নারী। সোপ অপেরায় যেসব নায়িকাদের দেখানো হয়, তাদের অধিকাংশই অল্পবয়সী, সুন্দর, শিক্ষিত ও নানা গুণের অধিকারী, কিন্তু তারা প্রতিবাদী নয়। তারা সংসারের সবার ভালোর জন্য কাজ করে, কিন্তু নিজেদের বিরুদ্ধে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না। সোপ অপেরার নারীরা পুলিশ কর্মকর্তা, চিকিৎসক, গোয়েন্দা, ভালো ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় কিংবা গায়িকা যাই হোক না কেনো সংসারে তারা ঠিকই লক্ষ্মী বউ। সংসারের সব অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করাকে তারা নিয়তি হিসেবে ধরে নেয়। নায়িকাদের পাশাপাশি সোপ অপেরায় আর একধরনের নারীকে উপস্থাপন করা হয়, যে নারী হিংসুটে, সংসারে কুটনামি করে, নয়তো রাক্ষসী। সোপ অপেরাগুলো দেখে মনে হয়, নারীদের কাজই যেনো কুটনামি করা। এর বাইরে তাদের আর কোনো কাজ নেই।

একবিংশ শতাব্দীতে এসে নারী যখন তার যোগ্যতায় এগিয়ে যাচ্ছে, তখনো সোপ অপেরা নারীকে বন্দি করে রাখছে সংসারের বন্দিশালায়। যদিও কিছু কিছু সোপ অপেরায় পুলিশ-গোয়েন্দার মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারীকে দেখানো হচ্ছে, কিন্তু তারাও সংসারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত নয়। বরং তাদের নির্মাণ করা হচ্ছে আরো ভিন্নভাবে। চাকরিজীবী সেসব নারীদের দেখানো হচ্ছে, তারা সারাদিন বাইরে কাজ করে এসে রাতভর সংসারের কাজ করে শ্বশুরবাড়ির সবাইকে শান্তিতে রাখছে। ঘর-বাহির সব সামলিয়ে তারা হয়ে উঠছে আদর্শ নারী! সোপ অপেরা আদর্শ নারীর যে চিত্রায়ণ করে সেগুলো দেখতে দেখতে হয়তো নিজের মধ্যেও তা ধারণ করতে থাকে কাজলী, মোতাহারা কিংবা অন্য কোনো নারী। তারা ভাবে তাদের প্রিয় চরিত্র পাখি, কিরণমালা, উষসী কিংবা পরমা যদি এতো কষ্ট করে সংসারে শান্তি বজায় রাখতে পারে, তবে তারা পারবে না কেনো? তারাও তো নিজেদেরকে একেকজন পাখি কিংবা পরমাই ভাবে।

পীযূষের মৃত্যু ও গণমাধ্যমের দায়

সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ভারতের অভিনেতা পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়। দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পাঁচ দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। পীযূষের মৃত্যুতে বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রিন্ট ও অনলাইন পোর্টাল গুরুত্ব দিয়ে সেই সংবাদ প্রকাশ করে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতেলকাতার অভিনেতা পীযূষ আর নেই১৪, চলে গেলেন অভিনেতা পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়১৫, পরলোকে টালিউডের পীযূষ১৬,পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়ের অকালমৃত্যু১৭ শিরোনামের সংবাদে পীযূষের অভিনীত চলচ্চিত্র, সোপ অপেরার নাম, আবার কোনো কোনো সংবাদে পীযূষের জন্ম যে বাংলাদেশে তাও গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। পীযূষের সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার খবরও বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এসেছে। এখন প্রশ্ন হলো, কলকাতার অভিনেতা পীযূষের মৃত্যু সংবাদ বাংলাদেশের গণমাধ্যমের কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ কেনো? তার অন্যতম কারণ হয়তো তিনি ভারতীয় সোপ অপেরার জনপ্রিয় চরিত্র; তার অভিনীত জল নূপুর কিছুদিন হলো শেষ হয়েছে এবং চোখের তারা তুই (চোখের তারা তুই-এ পীযূষ অভিনয় করেছেন অংশু চরিত্রে) এখনো (জুন ২০১৬) সম্প্রচার হচ্ছে।

গণমাধ্যমের কাছে অভিনেতা পীযূষের মৃত্যু যতোটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সোপ অপেরার জনপ্রিয় চরিত্র অমর্ত্য বা অংশুর মৃত্যু। তাইতো পীযূষের স্মরণে ২৭ অক্টোবর প্রথম আলোতে অপরাজিতা আঢ্যের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ হয়। সেই সাক্ষাৎকারের শিরোনাম ছিলো আমার স্যার নেই। যেহেতু  পীযূষ অভিনীত জল নূপুর-এ অপরাজিতা আঢ্য (পারি) পীযূষকে (অমর্ত্য) স্যার বলে ডাকতো, তাই ‘প্রথম আলো ব্যক্তি পীযূষ বা অপরাজিতার চেয়ে সোপ অপেরার চরিত্র অমর্ত্য ও পারিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। তাইতো সাক্ষাৎকারে অপরাজিতাকে বলতে শোনা যায়, অমর্ত্য (পীযূষ) ছাড়া পারি হতে পারে না, জল নূপুরও হতে পারে না অমর্ত্য ছাড়া। আমি মনের মাধুরী মিশিয়ে আর একবার ডাকতে পারবো না আমার স্যারকে?১৮

শুধু পীযূষের মৃত্যু সংবাদ নয়, স্টার জলসার জনপ্রিয় সোপ অপেরা জল নূপুর-এর অভিনেতা রনি চক্রবর্তী (জল নূপুর-এ লাল চরিত্রে অভিনয়কারী) ও দিশা গাঙ্গুলির (তুমি আসবে বলেতে দিশা চরিত্রে অভিনয়কারী) মৃত্যু সংবাদও বাংলাদেশের গণমাধ্যমে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, স্টার জলসায় সম্প্রচারিত বোঝেনা সে বোঝেনাতে অরণ্য চরিত্রে অভিনয় করেন অভিনেতা যশ দাশগুপ্ত। এই সোপ অপেরায় কাহিনির প্রয়োজনে নায়ক অরণ্যর মৃত্যু হয়। অথচ সোপ অপেরায় নায়কের মৃত্যুর সেই সংবাদও বোঝেনা সে বোঝেনা থেকে অরণ্যর বিদায়১৯, বোঝেনা সে বোঝেনা সিরিয়ালের অরণ্যের মৃত্যু২০ শিরোনামে বাংলাদেশের কিছু অনলাইন পোর্টালে উঠে এসেছে।

সম্প্রতি কলকাতার অভিনেত্রী মধুমিতার বিয়ের সংবাদ গণমাধ্যমে এসেছে জোরেশোরে। মধুমিতা স্টার জলসায় সম্প্রচারিত ‘বোঝেনা সে বোঝেনাতে পাখি চরিত্রে অভিনয় করেন। সোপ অপেরার নায়িকা পাখি অর্থাৎ মধুমিতার বিয়ের সংবাদ বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন২১ এবং ট্যাবলয়েড মানবজমিন২২-এ ‘পাখির বিয়ে শিরোনামে প্রকাশ হয়। অভিনেত্রী মধুমিতার ব্যক্তি ইমেজকে ছাপিয়ে তার অভিনীত চরিত্রের ইমেজকে গুরুত্ব দিয়ে গণমাধ্যম সোপ অপেরার বাস্তবতা নির্মাণ করে। ফলে দর্শক বাস্তব এবং গণমাধ্যম নির্মিত বাস্তবের পার্থক্য করতে বিভ্রান্ত হয়।

পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে যে, দর্শকের কাছে বাস্তবের চেয়ে সোপ অপেরার জগৎ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাই যারা নিয়মিতভাবে সোপ অপেরা দেখে, তাদের কাছে প্রকাশক দীপনের মৃত্যুর চেয়ে ভারতীয় সোপ অপেরার অমর্ত্যরে (পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়ের) সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বেশি অস্বাভাবিক ও কষ্টের। তাইতো অমর্ত্যরে মৃত্যুতে হালিমা বেগম কষ্ট পেয়েছেন, কিন্তু তিনি জানেনই না দীপনের মৃত্যুর কথা। কেননা তিনি বা তার পরিচিত কেউই বাংলাদেশি কোনো টেলিভিশন চ্যানেল দেখেন না। তাই দীপনের মৃত্যুর বিষয়ে তিনি অবগত নন। তাইতো হালিমাকে অমর্ত্যরে মৃত্যু প্রসঙ্গে বলতেই তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে বললেন, অমর্ত্য খুইব ভালা মানুষ আছিলো। তাই মরি যায়া খুব খারাপ নাগছি। হালিমার কাছেই জানতে পারলাম, জল নূপুর-এর বড়ো বৌদির বাড়ির কাছেই অমর্ত্যরে বাড়ি। বড়ো বৌদিকে বাস্তবে অমর্ত্য চাচি বলে ডাকতেন। পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর স্টার জলসায় তার স্মরণে সম্প্রচারিত অমর্ত্য নামক অনুষ্ঠান থেকে তিনি এসব তথ্য জেনেছেন। হালিমার কথা শুনে বুঝতে কষ্ট হয় না, সোপ অপেরার চরিত্রগুলোর সঙ্গে তিনি কতোখানি সম্পৃক্ত।

হালিমার মতো গ্রামের আরো অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম তারা অমর্ত্যর মৃত্যু, পাখির বিয়েসহ সোপ অপেরা সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে জানেন। গ্রামের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তারা সোপ অপেরা বিষয়ে এসব তথ্য পান। গ্রামের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা সংবাদপত্র বা ফেইসবুক থেকে সোপ অপেরা সম্পর্কিত কোনো তথ্য পেলে তা গ্রামের নারীদের জানায়। এক্ষেত্রে তারা গ্রামের নারীদের সোপ অপেরাবিষয়ক তথ্য জানাতে মতমোড়লের২৩ ভূমিকা পালন করে। এই বিষয়ে কলেজ পড়ুয়া লাকী আক্তারের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, সোপ অপেরা বিষয়ে তথ্য জানতেই তিনি ও তার বন্ধুরা ফেইসবুক ব্যবহার করেন। ফেইসবুক থেকে সোপ অপেরাবিষয়ক নতুন কোনো তথ্য পেলেই তারা গ্রামের নারীদের তা জানিয়ে দেন।

যে গল্পের শেষ হয় না

রণচণ্ডী গ্রামের নারীদের সোপ অপেরা দেখার ধরনে ভিন্নতা রয়েছে। তারা কেউ টেলিভিশনে নিজের বাড়িতে, কেউ প্রতিবেশীর বাড়িতে, কেউ পাড়ার মুদি দোকানে আবার কেউবা মোবাইল ফোনসেটে সোপ অপেরা দেখে। ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে সোপ অপেরা দেখা এই নারীদের জীবনে এখন নৈমিত্তিক অভ্যাস। সংসার, সন্তান পালনসহ আর দশটা কাজের মতোই তারা প্রতিদিন নিয়ম করে সোপ অপেরা দেখেন। তাদের প্রতিদিনের চর্চিত জীবনের অপরিহার্য অংশ সোপ অপেরা।

আর এই অপরিহার্যতাই হয়তো তাদের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে একটা ভিন্ন জগতে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন চাহিদা ও মূল্যবোধ। সোপ অপেরা গ্রামীণ নারীদের গতানুগতিক মূল্যবোধকে আরো শক্তিশালী করছে, আবার অনেক ক্ষেত্রে নতুন মূল্যবোধ তৈরি করছে। ফলে তাদের নিজেদের জীবন ও সোপ অপেরা অনেক ক্ষেত্রে হয়ে যাচ্ছে একাকার।

 

লেখক : তাওছিয়া তাজমিম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে সম্প্রতি স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি বণিক বার্তায় শিক্ষানবিশ সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করছেন।

tawsia.tasu@gmail.com

তথ্যসূত্র

১. আল মামুন; বাংলাদেশে প্রসারমাণ মিডিয়া-সংস্কৃতি; সাপ্তাহিক ২০০০; সম্পাদনা : মঈনুল আহসান সাবের; বর্ষ ১৫, সংখ্যা ১, ২০১২, ঢাকা।

২. ৮৭ শতাংশ পরিবারেই মুঠোফোন আছে; প্রথম আলো, ১১ জানুয়ারি ২০১৬।

৩. Unnikrishnan, Namita and Shailaja Bajpai (1996); The Impact of Telivision Advertising on Children; Sage Publication Inc, Nwe Delhi.

৪. জর্জ গার্বনার, উদ্ধৃত; রেবা (১৯৯৮ : ১৭); টেলিপ্রজন্মে সংস্কৃতি; দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।

৫. সঙ্গী বনাম ছায়াসঙ্গী; প্রথম আলোর বুধবারের ক্রোড়পত্র অধুনা, ১৮ নভেম্বর ২০১৫।

৬. Mankekar,  Purnima (2002 : 137);`Epic Contests: Television and Religious Identity in India'; Media Worlds : anthropology on nwe terrain; Edited by: Faye d. Ginsburg, Lila Abu-Lughod, Brian Larkin.

৭. হায়দার, শাওন্তী ও সাইফুল সামিন (২০১৫ : ১৫৩); গণযোগাযোগ তত্ত্ব ও প্রয়োগ; বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট, ঢাকা।

৮. হোসেন, মাহমুদুল (২০১০ : ৯২); সিনেমা; ফ্ল্যাট ১/বি, বাড়ি ২৮, সড়ক ১৫, ধানমণ্ডি, ঢাকা। 

৯. সিরিয়ালের পাখিকিরণমালা এবার লেখাপড়ার খাতায়; প্রথম আলো, ২৩ মে ২০১৫।

১০. পাখি না পেয়ে এবার গাইবান্ধায় আত্মহত্যা; প্রথম আলো, ২৭ জুলাই ২০১৪।

১১. ঈদে পাখি জামা না পেয়ে আত্মহত্যা; দৈনিক ইত্তেফাক, ২২ জুলাই ২০১৪।

১২. ছদ্মপ্রাতিস্বিকীকরণ মূলত একই সাংস্কৃতিক পণ্যকে সমাজের উঁচু-নিচু নানা স্তরের লোকদের জন্য সামান্য এদিক-ওদিক করে বাজারে ছাড়ার প্রক্রিয়া।

১৩. চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম; ‘সংস্কৃতির সংকট অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত; সমকাল-এর শুক্রবারের সাময়িকী কালের খেয়া, ১৯ জুন ২০১৫।

১৪. কলকাতার অভিনেতা পীযূষ আর নেই; প্রথম আলো, ২৬ অক্টোবর ২০১৫।

১৫. চলে গেলেন অভিনেতা পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়; দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৬ অক্টোবর ২০১৫।

১৬. পরলোকে টালিউডের পীযূষ; যুগান্তর, ২৬ অক্টোবর ২০১৫।

১৭. http://www.ntvbd.com/entertainment/25309/%E0%A6%AA%E0%A7%80%E0%A6%AF%E0%A7%82%E0%A6%B7; retrieved on 25.12.2015

১৮. আমার স্যার নেই; প্রথম আলো, ২৭ অক্টোবর ২০১৫।

১৯. http://bangla.bdnews24.com/glity/article1023199.bdnews; retrieved on 25.12.2015

২০. http:/ww/w.shampratikdeshkal.com/entertainment/2015/09/07/3438; retrieved on 25.12.2015

২১. পাখির বিয়ে; বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৩ জুলাই ২০১৫।

২২. পাখির বিয়ে; মানবজমিন, ৩ জুলাই ২০১৫।

২৩. গণমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত বার্তা দর্শক-শ্রোতা সরাসরি গ্রহণ না করে, সমাজের বিশ্বস্ত ও তাদের নির্ভরযোগ্য মানুষের কাছ থেকে এর সত্যতা যাচাই করে নেয়; তার পর তারা সে বার্তা গ্রহণ কিংবা বর্জন করে।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন