Magic Lanthon

               

আব্দুর রউফ

প্রকাশিত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

ডক লিপজিগ উৎসব পশ্চিমাকাশে ‘সূর্যের’ উদয়

আব্দুর রউফ

 

ভূমিকা

ক্ষমতার লড়াই, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ ও ঘৃণার ওপর ভিত্তি করে পৃথিবীতে সংঘটিত হয় দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধ। দুটি যুদ্ধেই জার্মানি অক্ষশক্তির ভূমিকা পালন করলেও কোনোটিতে জয়লাভ করতে পারেনি তারা। বরং তাদের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে যুদ্ধ পরবর্তী ঝড়। সেই সূত্র ধরেই জার্মানিকে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে বার্লিন প্রাচীর দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি নামে দুই ভূখণ্ডে বিভক্ত করা হয়। এক কথায় বললে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি হেরে গেলে পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশটিকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। যার পূর্ব পাশ সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পশ্চিম পাশ যায় পশ্চিমা দেশগুলোর দখলে। পূর্ব জার্মানিতে সমাজতন্ত্র এবং পশ্চিম জার্মানিতে ধনতন্ত্র বিস্তার করতে থাকে; সঙ্গে পরাশক্তি দেশগুলোর প্রভাবেই চলতে থাকে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ।

একই সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও ভাষাভাষীর হওয়া সত্ত্বেও ভূখণ্ড আলাদা হওয়ায় দুই জার্মানির মানুষদের নিজেদের মধ্যে বিভাজন বাড়তে থাকে। তবে এটা যে তৃতীয় পক্ষের ষড়যন্ত্র তা বুঝতে বেশিদিন সময় লাগেনি তাদের। তারা স্বপ্ন দেখতে থাকে পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার। পরে অবশ্য তা সম্ভবও হয়। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে ভেঙে ফেলা হয় বিভাজন তৈরি করা বার্লিন প্রাচীর। দুই জার্মানির মানুষ বিশ্ববাসীর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, তারাও পারে। বর্তমানে সারাবিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ এক দেশ জার্মানি। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় অনেক কিছুর পাশাপাশি তাদের চলচ্চিত্রও বেশ এগিয়েছে। এর প্রমাণ হলো, শুধু জার্মানিতেই প্রতিবছর আয়োজন করা হয় কমপক্ষে ২৫টি চলচ্চিত্র উৎসবের। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন উৎসবটির নাম ডক লিপজিগ ফিল্ম ফেস্টিভালউৎসবটি কেবল প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে; তবে অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রও এতে অংশ নিতে পারে। এবারের আলোচনা প্রাচীন এই চলচ্চিত্র উৎসবের নানা দিক নিয়ে।

পথের শুরু যেথায়

ডক লিপজিগ প্রামাণ্যচিত্র উৎসবটির কথা প্রথম চিন্তা করেন তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক লডউইগ টমাস। পশ্চিম জার্মানিতে তখন ম্যানহেইম কালচার অ্যান্ড ডকুমেন্টারি ফিল্ম উইকনামে (বর্তমানে  ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল ম্যানহেইম-হাইডেলবার্গনামে পরিচিত) চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন ছিলো। লডউইগ টমাস চেয়েছিলেন, এই আয়োজনটির মতো, তবে আকারে বড়ো একটি প্রামাণ্যচিত্র উৎসব পূর্ব জার্মানিতে করতে। আর সেটা বাস্তবায়নের জন্য প্রথমেই লডউইগ পূর্ব জার্মানির চলচ্চিত্রনির্মাতাদের ক্লাব Club der Filmschaffenden der DDR’-এর সঙ্গে আলোচনায় বসেন। ক্লাবের সদস্যরাও অবশ্য এ ধরনের উদ্যোগে বেশ আগ্রহ দেখায়। দুই পক্ষের যৌথ প্রচেষ্টায় ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব জার্মানিতে যাত্রা শুরু করে পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রামাণ্যচিত্র উৎসব ডক লিপজিগ। শুরুতে উৎসবের নাম ছিলো ফার্স্ট অল-জার্মান লিপজিগ ফেস্টিভাল অব কালচারাল অ্যান্ড ডকুমেন্টারি ফিল্মস। উৎসবটির প্রথম পরিচালক ছিলেন ওয়াল্টার কারনিক। তারই পরিচালনায় ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে চলে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।

শুরুটা ভালো হলেও পরের বছরই উৎসব খানিকটা গতি হারিয়ে ফেলে। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে উৎসব হয় ঠিকই, কিন্তু কেমন জানি তাতে জৌলুস ছিলো না। রাজনৈতিক প্রভাব ও কিছু নিয়মনীতির কারণে গণমাধ্যমের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে উৎসব কর্তৃপক্ষ। পরে নিয়মনীতিতে বেশকিছু পরিবর্তন আনলেও ১৯৫৭, ১৯৫৮ ও ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে উৎসব আয়োজন বন্ধ থাকে। উৎসব বন্ধ রাখার কারণ হিসেবে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম জার্মানির সার্বিক চলচ্চিত্রের খারাপ অবস্থা; ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে জার্মান কালচারাল অ্যান্ড ডকুমেন্টারি ফিল্ম উইকনামের অনুষ্ঠানে বড়ো ধরনের লোকসান এবং ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর উদ্যোগে একটি কালচারাল অ্যান্ড ডকুমেন্টারি ফিল্ম উইক প্রতিষ্ঠার চেষ্টার কথা জানায় কর্তৃপক্ষ।

টানা তিন বছর বন্ধ থাকার পর ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ইন্টারন্যাশনাল লিপজিগ ডকুমেন্টারি অ্যান্ড শর্ট ফিল্ম উইকনামে উৎসবটি পুনরায় চালু হয়। নাম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে উৎসবেও যুক্ত হয় কিছু নতুন বিষয়। আগের আয়োজিত উৎসবগুলোতে পুরস্কারের ধরন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা না গেলেও, ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দ থেকে উৎসবে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার হিসেবে গোল্ড ডাভসিলভার ডাভ-এর প্রচলন করা হয়। একই সঙ্গে এ বছর প্রথম বারের মতো হোয়াইট ডাভকে উৎসবের লোগো করা হয়; যার নকশা করেছিলেন বিখ্যাত চিত্রকর পাবলো পিকাসো। তিনি মূলত ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের প্যারিস ওয়ার্ল্ড পিস কংগ্রেস-এর জন্য লোগো তৈরি করেন। পরে এই উৎসবের পরিচালনা পর্ষদ ফ্রান্সের লেখক ভ্লাদিমির পোজনার-এর মাধ্যমে তার বন্ধু পাবলো পিকাসোর কাছে ওই লোগোটি চায়। পিকাসো অবশ্য এ নিয়ে কোনো আপত্তি করেননি।

উৎসবের প্রথম পরিচালক ওয়াল্টার কারনিক ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে অবসর নেন। এবার উৎসব পরিচালনার দায়িত্বে আসেন উল্ফগ্যাঙ হারকেনথাল (Wolfgang Harkenthal)। দায়িত্ব গ্রহণের পর হারকেনথাল উৎসবের দার্শনিক চিন্তায় কিছু পরিবর্তন আনেন। তার পরিচালনায় প্রথম উৎসবেই তিনি আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও চলচ্চিত্র উৎসবে ক্রমবর্ধমান রাজনীতিকীকরণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ২০তম বছর পূর্তি উপলক্ষে তিনি উৎসবের শিরোনাম করেন ‘ফিল্মস অ্যাগেইনস্ট ফ্যাসিজম’। সেই উৎসবে আগত পিটার আলব্রিচ, স্ট্যানলি ফরমান ও জরিস আইভেন্স প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতাদের ভিয়েতনামকে সমর্থন এবং তাদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নির্মম আচরণ সম্পর্কে সকল জনসাধারণকে অবহিত করতে অনুরোধ জানায়। উৎসব বুলেটিনে পরিষ্কারভাবে বলা হয়ভিয়েতনামে যা চলছে, কোনো দায়িত্বশীল চলচ্চিত্রনির্মাতা সে প্রসঙ্গে উদাসীন থাকতে পারে না। শুধু তাই নয়, পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের উৎসবে ভিয়েতনাম যুদ্ধে হতাহত মানুষের জন্য রক্তও সংগ্রহ করা হয়।

১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে এসে উৎসবের মোড় ঘুরে যায় চেকোস্লোভাকিয়ার দিকে। দেশটিতে তখন কমিউনিস্ট সরকার উৎখাত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ‘প্রাগ বসন্ত’ বিপ্লব শুরু হয়েছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলো পূর্ব জার্মানিও। ফলে সেই বিপ্লব ত্বরান্বিত করতে চেকোস্লোভাকিয়ায় যেসব প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ হয়েছিলো, তা উৎসবে নিষিদ্ধ করা হয়।

উৎসবের নাম আরো একবার পরিবর্তন করা হয় ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে। নতুন নাম রাখা হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল লিপজিগ ডকুমেন্টারি অ্যান্ড শর্ট ফিল্ম উইক ফর সিনেমা অ্যান্ড টেলিভিশন’। এরপর থেকে ফি-বছর উৎসব চললেও কড়া সেন্সরশিপ চালু ছিলো। পূর্ব জার্মানির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই সময় চেকোস্লোভাকিয়া ও লাতিন আমেরিকায় সমাজতন্ত্র-বিরোধী আন্দোলনের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রগুলো নিষিদ্ধ করা হয়। এই সেন্সরশিপ অবশ্য ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছিলো। এ সময় প্রামাণ্যচিত্রের স্বাধীনতা নিয়েও বিতর্ক চলতে থাকে। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে উৎসবের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন রোনাল্ড ট্রিচ। পরের বছর উৎসবে যুক্তরাষ্ট্রের অভিনয়শিল্পী জেনি ফন্ডা ভিয়েতনাম যুদ্ধের ওপর নির্মিত ইন্ট্রোডাকশন টু এনিমি নিয়ে হাজির হন। তিনি উৎসবে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী নানা প্রচার- প্রচারণাও চালান।

১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে দুই জার্মানির রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে উৎসব কর্তৃপক্ষ আর্থিক সঙ্কটে পড়ে। এই সময় তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে কোনোরকমে সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় উৎসবের নাম পরিবর্তন করে ‘ইন্টারন্যাশনাল লিপজিগ ফিল্ম উইক ফর ডকুমেন্টারি অ্যান্ড অ্যানিমেশন ফিল্ম করা হয়। তখন পরিচালকের দায়িত্বে আসেন ক্রিস্টিয়ান ম্যাককেনবার্জার। এ বছরের উৎসবে অংশগ্রহণকারীদের উপস্থিতি একেবারেই কম ছিলো। উৎসবের প্রেক্ষাগৃহগুলো অর্ধেকই ছিলো দর্শকশূন্য। এই রেশ অবশ্য পরের বেশ কয়েক বছর চলে।

১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে উৎসবের পরিচালক হিসেবে যোগ দেন ফ্রিড ঘেলার। এর পরের বছর তিনি প্রতিযোগিতায় প্রামাণ্যচিত্র থেকে অ্যানিমেশন ফিল্মকে আলাদা করে ফেলেন। তবে তখন এই সিদ্ধান্তকে তিনি বাস্তবায়ন করতে পারেননি। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে উৎসবে চলচ্চিত্রনির্মাতাদের আজীবন সম্মাননার জন্য গোল্ডেন ডাভ’ পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। প্রথমবারের মতো এ সম্মাননা পান সান্টিয়াগো আলভারেজ ও ফারনান্দো বিরি। একই বছরে প্যাসেজ কিনোকে উৎসবের সদর দপ্তর হিসেবেও ঘোষণা করা হয়। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে উৎসবের পর ফ্রিড ঘেলার অবসরে গেলে ক্লাস ডেনিয়েলসন উৎসব পরিচালনার দায়িত্ব নেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর ডেনিয়েলসন ডক ইন্ডাস্ট্রি প্রোগ্রাম’ নামে একটি নতুন প্রকল্প চালু করেন। এর মধ্য দিয়ে উৎসবে চলচ্চিত্রের নানা চিন্তাভাবনা নির্মাতাদের মধ্যে আদান-প্রদানের একটা মঞ্চ তৈরি হয়। এই উদ্যোগ উৎসবকে আরো প্রাণবন্ত করে তোলে। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে উৎসবের সর্বশেষ নাম রাখা হয় ইন্টারন্যাশনাল লিপজিগ ফেস্টিভাল ফর ডকুমেন্টারি অ্যান্ড অ্যানিমেটেড ফিল্ম; এর পাশাপাশি সংক্ষিপ্ত শিরোনামে একে ডক লিপজিগ’ বলা হয়।

চলো ডক লিপজিগ-এ যাই

প্রতিবছর সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসের কোনো একসময় জার্মানির লিপজিগ শহর সজ্জিত হয় নতুন সাজে। চারিদিকে রঙ-বেরঙের আলোর বাহার আর সারাবিশ্বের


প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা, অভিনয়শিল্পীদের পদচারণায় এক মিলনমেলায় পরিণত হয় লিপজিগ। উৎসবে আগত অতিথিদেরকেও ডানা মেলা গোল্ডেন ডাভ-এর মতোই উৎফুল্ল ও প্রাণবন্ত মনে হয়। তবে যারা এখানে নির্মাতা হিসেবে অংশ নিয়ে নিজেদের দক্ষতা যাচাই এবং আনন্দ উপভোগ করতে চান, তাদেরকে প্রতিবছর মে মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে উৎসবের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে তার প্রামাণ্যচিত্রটি আপলোড করতে হবে। এই প্রামাণ্যচিত্রগুলোর বাছাই প্রক্রিয়া জুন মাসের মধ্যেই শেষ করে উৎসব কর্তৃপক্ষ। আপলোডের আগে অবশ্য উৎসবের প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য উৎসবের ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করতে হয়। প্রামাণ্যচিত্রটি আপলোড করার সময় ইংরেজি ভাষায় সেটি সম্পর্কে দুইশো শব্দের একটি সার-সংক্ষেপ লিখতে হয়। এর সঙ্গে নির্মাতার জীবনবৃত্তান্ত ও তার নিজের একটি ছবি দিতে হবে।

উৎসবে জমা দেওয়া প্রামাণ্যচিত্রটিতে অবশ্যই ইংরেজি অথবা জার্মান ভাষার সাবটাইটেল সংযোজন করতে হবে। তবে অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে ইংরেজি সাবটাইটেল দিতে হবে। উৎসবের নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক প্রামাণ্যচিত্রের জন্য নিবন্ধন ফি ৩৫ ইউরো (সাত শতাংশ ভ্যাটসহ)। এই ফি প্রামাণ্যচিত্র জমা দেওয়ার ১০ কার্যদিবসের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। প্রামাণ্যচিত্র জমা দেওয়ার সময় অবশ্যই কোন বিভাগে জমা দিবেন সেটা আবেদন ফরমে উল্লেখ করতে হবে। তবে যেসব নির্মাতা তিনটার বেশি প্রামাণ্যচিত্র বা অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেনি, তাদের চলচ্চিত্র কেবল নেক্সট মাস্টার্স কম্পিটিশন (Next Masters Competition) বিভাগেই দেখানো হয়। নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে সব তথ্য ও প্রামাণ্যচিত্র জমা দেওয়ার পাশাপাশি, আবেদনকারীকে সেটার ডিভিডি, এমপিফোর ও ডিজিটাল ফাইল পোস্ট অফিসের মাধ্যমে পাঠাতে হবে। উৎসবের ঠিকানা :

DOK LEIPZIG,

rKatharinenstraße 17

D-04109 LEIPZIG

GERMANY.

এছাড়া উৎসব শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতিযোগিতার জন্য পাঠানো প্রামাণ্যচিত্রটি টেলিভিশন বা বাণিজ্যিকভাবে কোথাও দেখানো যাবে না। উৎসব চলাকালীন যদি কোনোভাবে তথ্য পাওয়া যায়, প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া কোনো চলচ্চিত্র কোথাও বাণিজ্যিকভাবে প্রদর্শন হয়েছে, তাহলে তাৎক্ষণিক তা প্রতিযোগিতা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হবে। পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র ও অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্রের দৈর্ঘ্য কমপক্ষে ৪১ মিনিট এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র ও অ্যানিমেশন সর্বোচ্চ ৪০ মিনিটের হতে হবে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্মাতাদের পাঠানো চলচ্চিত্র থেকে উৎসব কমিটি প্রতিযোগিতার জন্য বাছাই করবে। প্রামাণ্যচিত্র ও অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্রগুলো মূলত কল্পনাশক্তি, সৃজনশীলতা ও স্বাধীনধারার মতো বৈশিষ্ট্যগুলো মাথায় রেখে নির্বাচন করা হয়। উৎসবের জুরি বোর্ড মোট নয়টি বিভাগে প্রতিযোগিতার জন্য চলচ্চিত্র বাছাই করে থাকে। নয়টি বিভাগে মোট ১৯টি পুরস্কার দেওয়া হয়। প্রত্যেক বিভাগে প্রত্যেক পুরস্কারের জন্য আলাদা আলাদা জুরি বোর্ড রয়েছে।

উৎসবের নয়টি বিভাগ হলো :

১. ইন্টারন্যাশনাল কম্পিটিশন লঙ ডকুমেন্টারি অ্যান্ড অ্যানিমেটেড ফিল্ম 

২. ইন্টারন্যাশনাল কম্পিটিশন শর্ট ডকুমেন্টারি অ্যান্ড অ্যানিমেটেড ফিল্ম 

৩. জার্মান কম্পিটিশন লঙ ডকুমেন্টারি অ্যান্ড অ্যানিমেটেড ফিল্ম 

৪. জার্মান কম্পিটিশন শর্ট ডকুমেন্টারি অ্যান্ড অ্যানিমেটেড ফিল্ম

৫. নেক্সট মাস্টার্স কম্পিটিশন

৬. ইন্টারন্যাশনাল কম্পিটিশন অ্যানিমেটেড ডকুমেন্টারি

৭. ইন্টারন্যাশনাল প্রোগ্রাম ডকুমেন্টারি অ্যান্ড অ্যানিমেটেড ফিল্ম, কিডস ডক অ্যান্ড ইয়ুথ প্রোগ্রাম ইনক্লুডেড

৮. লোকাল ডক

৯. ডক ইন্টারঅ্যাকটিভ।

এর মধ্য থেকে ইন্টারন্যাশনাল কম্পিটিশন লঙ ডকুমেন্টারি অ্যান্ড অ্যানিমেটেড ফিল্ম বিভাগ ও ইন্টারন্যাশনাল কম্পিটিশন শর্র্ট ডকুমেন্টারি অ্যান্ড অ্যানিমেটেড ফিল্ম বিভাগে চারটি এবং ইন্টারন্যাশনাল প্রোগ্রাম ডকুমেন্টারি অ্যান্ড অ্যানিমেটেড ফিল্ম, কিডস ডক অ্যান্ড ইয়ুথ প্রোগ্রাম ইনক্লুডেড বিভাগে ছয়টি পুরস্কার দেওয়া হয়। ডক ইন্টারঅ্যাকটিভ বিভাগে উৎসবে আগত দর্শকের ভোটে নির্বাচিত চলচ্চিত্রকে ‘ডক নিউল্যান্ড অডিয়েন্স অ্যাওয়ার্ড এবং বাকি বিভাগগুলোতে শুধু ‘গোল্ডেন ডাভ’ পুরস্কার দেওয়া হয়। মজার বিষয় হলো, ভিন্ন ভিন্ন বিভাগে ‘গোল্ডেন ডাভ’ পুরস্কারের অর্থমূল্য কিন্তু আলাদা।

ভেনিসের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘গোল্ডেন লায়ন’, কান-এর ‘পাম’, বার্লিনের গোল্ডেন বিয়ার’-এর মতো ডক লিপজিগের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘গোল্ডেন ডাভ’। বিভিন্ন বিভাগে ‘গোল্ডেন ডাভ’ দিলেও এর পাশাপাশি তারা ওই বিভাগের আরেকটি চলচ্চিত্রকে সম্মানসূচক পুরস্কারও দেয়।

৫৮তম আসর

১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে শুরু হওয়া এই উৎসবটি ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে ৬১ বছরে পদার্পণ করলেও এটা ছিলো উৎসবের ৫৮তম আসর। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬ অক্টোবর শুরু হয়ে ১ নভেম্বর পর্যন্ত চলা উৎসবের পরিচালক ছিলেন লিনা প্যাসানেন। তিনি ফিনল্যান্ডের সরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইল টিভি-ওয়ান-এর (YLE TV-1) সাংবাদিক, পরিচালক ও উপস্থাপক ছিলেন। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি থেকে তিনি এ উৎসবের সঙ্গে কাজ করছেন। উৎসবের ৫৯তম আসর শুরু হবে এ বছরের ৩১ অক্টোবর। চলবে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত।

লিপজিগ-এর ৫৮তম উৎসবে একটু ভিন্নতা ছিলো। উৎসবের ৬১ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম অ্যানিমেটেড ফিল্মকে প্রামাণ্যচিত্র থেকে আলাদা করা হয়। যদিও ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন পরিচালক ফ্রিড ঘেলার এই উদ্যোগ নেন। কিন্তু তিনি তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। এবারের উৎসবে সর্বমোট তিনশো ১৬টি ডকুমেন্টারি ও অ্যানিমেটেড ফিল্ম অংশ নেয়। যার মধ্যে একশো ৩১টি অ্যানিমেটেড ফিল্ম ও একশো ৮৫টি ডকুমেন্টারি। পাশাপাশি উৎসবে এক হাজার সাতশো অতিথি এবং ৪৮ হাজার দর্শক উপস্থিত ছিলো। এটা ছিলো এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংখ্যক দর্শকের উপস্থিতি।

৫৮তম আসরে ইন্টারন্যাশনাল কম্পিটিশন লঙ ডকুমেন্টারি অ্যান্ড অ্যানিমেটেড ফিল্ম বিভাগে ‘গোল্ডেন ডাভ’ অর্জন করেছে ব্রাসিয়া (২০১৫) নামের একটি প্রামাণ্যচিত্র। পোল্যান্ডের অজচিচ স্ট্যারন-এর (Wojciech Staron) এ প্রামাণ্যচিত্রটি ‘প্রাইজ অব দ্য ইকোমেনিকাল জুরি পুরস্কারটিও পায়। এ বিভাগের প্রাইজ অব দ্য ইউনাইটেড সার্ভিসেস ট্রেড ইউনিয়ন ভার.ডি(Prize of the United Services Trade Union ver.di) ও সম্মানসূচক পুরস্কার পেয়েছেন গ্রিসের ম্যারিয়ান্না ইকোনোমউ নির্মিত দ্য লঙগেস্ট রান (২০১৫)। আর প্রাইজ অব দ্য ফিপরেসি পুরস্কার পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নির্মাতা ক্রিস্টাল মোসেল্লি, তার দ্য ওলফপ্যাক (২০১৫) প্রামাণ্যচিত্রের জন্য।

ইন্টারন্যাশনাল কম্পিটিশন শর্ট ডকুমেন্টারি অ্যান্ড অ্যানিমেটেড ফিল্ম বিভাগে শর্ট ডকুমেন্টারির জন্য ‘গোল্ডেন ডাভ’ পেয়েছে রাশিয়ার অ্যানাসতাসিয়া নোভিকোভাদ্য কনভারসেশন। আর শর্ট অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্রের জন্য ‘গোল্ডেন ডাভ’ পেয়েছে সুইজারল্যান্ডের জর্জেস সুইজব্যল-এর আর্লকিং (২০১৫)। এ বিভাগে অংশ নেওয়া প্রামাণ্যচিত্রের মধ্যে সবচেয়ে ‘শৈল্পিক’ বলে জুরি বোর্ডের কাছে মনে হয়েছে চায়নার লিই লিই নির্মিত মিসিং ওয়ান প্লেয়ারকে। তাই এ বছর সিলভার ডাভ ফর অ্যান আউটস্ট্যান্ডিং আর্টিস্টিক অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কারটি তার ঘরেই উঠেছে। এছাড়াও এ বিভাগে দর্শকের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্রের জন্য মিফিস্টো ৯৭.৬ অডিয়েন্স অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করে জার্মানির ফ্লরিয়ান গ্লরিগ নির্মিত ইন দ্য ডিসটেন্স (২০১৫)।

জার্মান কম্পিটিশন লঙ ডকুমেন্টারি অ্যান্ড অ্যানিমেটেড ফিল্ম বিভাগে লঙ ডকুমেন্টারিতে ‘গোল্ডেন ডাভ’ পেয়েছেন জার্মানির টম লেমকি। তিনি ল্যান্ড এম ওয়াসার (২০১৫) প্রামাণ্যচিত্রের জন্য এ পুরস্কারটি পান। এ বিভাগে সম্মানসূচক পুরস্কারটি পায় স্টেফেন ইবারলিন ও ম্যানুয়েল ফ্যান-এর যৌথ পরিচালনায় নির্মিত পারছিম ইন্টারন্যাশনাল (২০১৫)। আর জার্মান কম্পিটিশন শর্ট ডকুমেন্টারি অ্যান্ড অ্যানিমেটেড ফিল্ম বিভাগে গোল্ডেন ডাভ’ পেয়েছে জার্মানির বেনজামিন কালমেয়ার-এর আইসেন। আর সম্মানসূচক পুরস্কার পেয়েছে মার্স ক্লোজার প্রামাণ্যচিত্রের জন্য জার্মানির নির্মাতা অ্যানিলাই বোরোস ও ভেরা মারিয়া ব্রাকনার।

ইন্টারন্যাশনাল প্রোগ্রাম ডকুমেন্টারি অ্যান্ড অ্যানিমেটেড ফিল্ম, কিডস ডক অ্যান্ড ইয়ুথ প্রোগ্রাম ইনক্লুডেড বিভাগে মোট ছয়টি পুরস্কার দেওয়া হয়। এর মধ্যে চলচ্চিত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে ‘হেলদি ওয়ার্কপ্লেস ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড নামে যে পুরস্কারটি দেওয়া হয়, তা এবার দুটি অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র পেয়েছে। এগুলো হলো : জার্মানির অ্যালিজান্দ্রা টোমেই ও আ্যালবার্টো কুসেইরো’র অটোমেটিক ফিটনেস এবং রিতা ব্যাকাস-এর ওয়ার্ক ফর ওয়ান ডে। এই বিভাগের ডিইএফএ (ডিফা) স্পন্সরিং প্রাইজ পেয়েছে জার্মানির আরেক নির্মাতা ম্যাথিয়াস কবমেল নির্মিত ক্যাফে ওয়াল্ডলাফট

শুধু পূর্ব জার্মানির নান্দনিক চলচ্চিত্রের জন্য তিন হাজার ইউরো সমমূল্যের যে এম ডি আর ফিল্ম প্রাইজ’ দেওয়া হয়, সেটা এবার পেয়েছে অ্যানকা ডামিয়েন-এর দ্য ম্যাজিক মাউনটেন অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রটি। এছাড়া এ বিভাগে দুই হাজার ইউরো সমমূল্যের লঙ জার্মান ডকুমেন্টারির জন্য ‘গ্যাটে ইন্সটিটিউট ডকুমেন্টারি ফিল্ম প্রাইজ’ পেয়েছে লাটজ ড্যামবেক-এর ওভারগেমস। ইয়ঙ জুরি বোর্ডের মাধ্যমে নির্বাচিত ইয়ঙ আইজ ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ নির্মাতা পেটরিক ওব্রিন, তার ট্রান্সফ্যাটি লাইভস প্রামাণ্যচিত্রের জন্য। তবে এ উৎসবে জুরি বোর্ডের কোনো চলচ্চিত্র মনঃপূত না হওয়ায় ‘ফিল্ম প্রাইজ লিপজিগ রিঙ’ পুরস্কারটি দেওয়া হয়নি। 

ইন্টারন্যাশনাল কম্পিটিশন অ্যানিমেটেড ডকুমেন্টারি বিভাগে ‘গোল্ডেন ডাভ’ পেয়েছে জার্মানির বিটিনা কাউনচ নির্মিত স্পিরিট অ্যাওয়ে। এই বিভাগের সম্মানসূচক পুরস্কারটি পেয়েছে লাস্ট ডে অব ফ্রিডম-এর নির্মাতা আমেরিকান ডি হিব্বার্ট ও নোমি তালিসম্যান।

এছাড়া তরুণ নির্মাতাদের জন্য নির্ধারিত ‘নেক্সট মাস্টার্স কম্পিটিশন’ বিভাগে তাদের পরবর্তী চলচ্চিত্র-নির্মাণের জন্য ১০ হাজার ইউরো সমমূল্যের গোল্ডেন ডাভ পেয়েছেন হাঙ্গেরিয়ান তরুণ নির্মাতা ক্লারা ট্রেনসেনাই তার ট্রেইন টু অ্যাডাল্টহুড-এর জন্য। এই বিভাগে সম্মানসূচক পুরস্কারটি পেয়েছে রাশিয়ার আরেক তরুণ ডেনিশ ক্লিবলেভ নির্মিত স্ট্রেনজ পারটিকেলস

অন্যদিকে ডক ইন্টারঅ্যাকটিভ বিভাগে ডক নিউল্যান্ড অডিয়েন্স অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে নেদারল্যান্ডের ওমেন হ্যারিস ও আয়ারল্যান্ডের নিকি স্মিথ নির্মিত ডিপ। তবে ৫৮তম উৎসবে লোকাল ডক বিভাগে কোনো পুরস্কার দেওয়া হয়নি।

লেখক : আব্দুর রউফ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।

roufa8228@gmail.com

পাঠ সহায়িকা

. http: //ww w. dok- Leipyig. de/en/festival/profil/struktur; retrieved on 22.02.2016

2. http://www.dok-leipyig.de/en/festival/submission; retrieved on 22.02.2016

3. http://www.dok-leipyig.de/en/festival/wettbewerbe/gewinner; retrieved on 22.02.2016

4. http://www.dok-leipyig.de/en/festival/bildung/dokmachtschule; retrieved on 22.02.2016

5. http://www.dok-leipyig.de/en/festival/dokneuland/exhibition; retrieved on 22.02.2016

6. https://www.goethe.de/en/kul/flm/20649652.htlm; retrieved on 17.04.2016

7. https://www.telefilm.ca/en/festivals-and-markets/festivals/58th-dok-leipyig-international-leipyig-festinal-documentary; retrieved on 10.04.2016

8. http:www.awn.com/blog/58th-international-dok-leipyig-festival-26-octeber-1-november-2015-leipyig-germaû; retrieved on 10.04.2016

9. http://www.dok-leipyig.de/en/festival/submission/reglement; retrieved on 10.05.2016

10. https://festagent.com/en/festivals/dokleipyig; retrieved on 10.05.2016

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন