Magic Lanthon

               

স্পাইক লি ভাব-ভাষান্তর : কাওসার বকুল

প্রকাশিত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

আমরা এক বিশৃঙ্খলার মধ্যে আছি 

স্পাইক লি ভাব-ভাষান্তর : কাওসার বকুল


বছরের পর বছর আফ্রিকান-আমেরিকানরা কেবল গায়ের রঙ কৃষ্ণ হওয়ার অপরাধেনা-মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে শ্বেতাঙ্গদের কাছে। বিষয়টি কোনোভাবেই মানতে পারেননি স্পাইক লি। তাই আফ্রিকান-আমেরিকানদের দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরতে চেয়েছেন বিশ্ব দরবারে; মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন চলচ্চিত্রকে। একে একে নির্মাণ করেছেন শিজ গট্টা হ্যাভ ইট (১৯৮৬), স্কুল ডেজ (১৯৮৮), ডু দ্য রাইট থিঙ (১৯৮৯), ম্যালকম এক্স (১৯৯২), হি গট গেইম (১৯৯৮), টোয়েন্টি ফাইভ আওয়ার-এর (২০০০) মতো সাড়া জাগানো সব চলচ্চিত্র। এসব চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে রাষ্ট্রের পরিস্থিতি, বর্ণবাদসহ সমসাময়িক নানা ইস্যু। চলচ্চিত্রের পিছনের কারিগর স্পাইক লি কিন্তু একই সঙ্গে অভিনেতা, চিত্রনাট্যকার ও প্রযোজক। নিজের প্রতিষ্ঠান ফোরটি অ্যার্কস অ্যান্ড অ্যা মিউল ফিল্মওয়ার্কসথেকে প্রযোজনা করেছেন ৩৫টি চলচ্চিত্র।

প্রতিভাবান এই নির্মাতা ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ মার্চ আমেরিকার জর্জিয়া শহরের আটলান্টায় জন্মগ্রহণ করেন। সেখানকার মোরহাউজ কলেজ থেকে স্নাতক শেষে চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনার জন্য ভর্তি হন নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে; ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে সেখান থেকেই চলচ্চিত্র-নির্মাণে তিনি স্নাতকোত্তর করেন। অভিনয় ও পরিচালনার পাশাপাশি গত ১৫ বছর পড়িয়েছেন নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের টিস স্কুল অব আর্টস-এ। ছাত্রাবস্থায় লাস্ট হাসল ইন ব্রুকলিন (১৯৭৯) নামক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে লির যাত্রা শুরু। জোস বেড-স্টু বারবারশপ : উই কাট হেডস-এর (১৯৮০) জন্য পান স্টুডেন্ট অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড। এরপর ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে এসে নির্মাণ করেন তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র শিজ গট্টা হ্যাভ ইট। মূলত এই সময়েই তিনি নিজের আসল নাম শেলটন জ্যাকসন লি থেকে স্পাইক লি করে নেন। কালো মানুষের অধিকার নিয়ে সোচ্চার লি ৮৮তম অস্কার (২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত) অনুষ্ঠান বর্জন করেন। লির অভিযোগ, ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের মতো এবারও অস্কারে শ্রেষ্ঠ পুরুষ ও নারী চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে শ্বেতাঙ্গ নির্বাচন করা হয়েছে। 

ক্রাউড ফান্ডিং-এর মাধ্যমে নির্মিত লিদ্য সুইট ব্লাড অব জিসাস মুক্তি পায় ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে। দ্য সুইট ব্লাড অব জিসাস, লির ব্যক্তি জীবন, হলিউডে কৃষ্ণাঙ্গ নির্মাতাদের পরিস্থিতি, ক্রাউড ফান্ডিংসহ নানা বিষয় নিয়ে স্পাইক লির সঙ্গে কথা বলেছেন আমেরিকান লেখক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্র সমালোচক স্যাম ফ্রাগোসো। অনলাইন ম্যাগাজিন দ্য আটলান্টিক ডট কম-এ ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ হয়।  

 

স্যাম ফ্রাগোসো : একই ঘরানায় আটকে থেকে আপনাকে কখনোই চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে দেখা যায়নি। সবসময় আপনি প্রচলিত কাঠামোর বাইরে গিয়ে নানা বিষয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চেয়েছেন। সেক্ষেত্রে দ্য সুইট ব্লাড অব জিসাস ঠিক কী ধরনের চিন্তা থেকে এসেছে?

স্পাইক লি : চিন্তা তো অনেক। তাছাড়া একই বিষয়ে চলচ্চিত্র-নির্মাণ আমার কাছে বিরক্তিকরও। স্কুল ডেজ-এর (১৯৮৮) সিক্যুয়াল নির্মাণের জন্য চিত্রনাট্য লেখার কাজ চলছিলো। কিন্তু সেখানে কোনোভাবেই আমরা স্বতন্ত্র কোনো কাহিনি তৈরি করতে পারছিলাম না। বরং হি গট গেম-এ (১৯৯৮) রে অ্যাল্যান (Ray Allen; আমেরিকার বিখ্যাত বাস্কেটবল খেলোয়াড়, যিনি হি গট গেম-এ অভিনয় করেন) যে চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সেটাই বারবার চলে আসছিলো বলে মনে হচ্ছিলো। হতে পারে এটা সিক্যুয়াল, তাই বলে তো আর একই রকম করা যায় না। আমি সবসময়ই আকর্ষণীয় কাহিনি ভালোবাসি এবং সে ধরনের চলচ্চিত্রই নির্মাণ করি।

ফ্রাগোসো : এমনকি আপনি যদি সিক্যুয়ালও নির্মাণ করতেন, সেখানেও সম্ভবত আগের বিষয়গুলো ঘুরেফিরে আসতো না। তাছাড়া আপনি নিজেই বলেছেন, আগে যে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছি, বর্তমান পরিস্থিতিতে এমন কিছু করাটা কঠিন।

লি : আমি একান্তভাবেই তেমন কিছু করতে চাইতাম না। আর স্টুডিও হিসেবে হলিউডের বর্তমান সিস্টেম নিয়ে বলতে পারিএকজন কৃষ্ণাঙ্গ নির্মাতা হিসেবে নয়, চলচ্চিত্রকার হিসেবেই বলছিবর্তমান পরিস্থিতিতে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সত্যিই আগের চেয়ে অনেক কঠিন। তবে আমি এখনো মনে করি, এ ধরনের চলচ্চিত্রেরও কিছু দর্শক আছে। কিন্তু পৃথিবীটা পাল্টে গেছে এবং আমাদের এখানে টেন্টপোল (tentpole হলো বিশেষ ধরনের চলচ্চিত্র, মুক্তির আগেই নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ধরে নেয় এটি বড়ো ধরনের ব্যবসা করবে এবং চলচ্চিত্র ব্যবসায় যে ঝুঁকি এসব চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে তা একেবারে সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকে) চলচ্চিত্রের একটা ঐতিহ্য আছে। আমাদের ছোটোবেলায় বিশেষ দিন ও শ্রমিক দিবস উপলক্ষে এ ধরনের চলচ্চিত্র মুক্তি পেতো। কিন্তু এখন বছরের ১২ মাসেই এগুলো মুক্তি পাচ্ছে। আমি বলছি না যে, এ ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যাবে না। আমি শুধু ভারসাম্য রক্ষার কথা বলছি। বাস্তবতা হলোদর্শকরা এসব চলচ্চিত্রের পিছনে কোটি কোটি ডলার খরচ বন্ধ না করা পর্যন্ত তারা (প্রযোজকরা) এগুলো নির্মাণ করেই যাবে। ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস-এর সিক্যুয়াল যেনো কতো পর্যন্ত হলো? আট?

ফ্রাগোসো : তারা তো এসব চলচ্চিত্রের ভিন্ন ভিন্ন নাম দিচ্ছে। এমনকি কিছু চলচ্চিত্রের সিক্যুয়াল সংখ্যাও উল্লেখ করছে না। 

লি : হ্যাঁ, তা ঠিক আছে। তবে ওই সব চলচ্চিত্রের দর্শক কিন্তু ঠিকই জানে সেটা কতো নম্বর। তাছাড়া দেখুন, ওই সব চলচ্চিত্রের একটা আলাদা ঘরানা আছে, সেইভাবেই তারা একের পর এক চলচ্চিত্র নির্মাণ করে যাচ্ছে। আমার মতে, প্রযোজকদের মনমানসিকতার ওপর নির্ভর করে কী ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ হবে, আর কোনটা হবে না।

ফ্রাগোসো : আপনি প্রায়ই বলেন, আপনার মতো স্বাধীনধারার শিল্পী-নির্মাতাদের জন্য কিকস্টার্টার (Kickstarter, জনগণের অর্থায়নে চলচ্চিত্র নির্মাণের একটি প্রক্রিয়া; যা ক্রাউড ফান্ডিং নামে সমধিক পরিচিত) গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। কারণ স্টুডিওগুলো এ ধরনের চলচ্চিত্রের পিছনে সাধারণত লগ্নি করার সাহস দেখায় না। আর আপনি তো শি’জ গট্টা হ্যাভ ইট চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে এ রকম কিকস্টার্টার শুরু করে দিয়েছেন।

লি : এটা খুবই সাধারণ একটা ব্যাপার। তাছাড়া কিকস্টার্টার নতুন কিছু নয়। এখন নতুন বলতে এই ক্ষেত্রে  প্রযুক্তির ব্যবহারটা বলা যেতে পারে। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে আমি যখন আমার প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করার জন্য এক লক্ষ ৭৫ হাজার ডলার তুলেছিলাম সেটাও তো কিকস্টার্টার-ই ছিলো। আসলে মূলনীতিটা একই।

ফ্রাগোসো : তাহলে স্বাধীনধারার নির্মাতাদের ভবিষ্যতে চলচ্চিত্র-নির্মাণের পথ কি ক্রাউড ফান্ডিং?

লি : হ্যাঁ, তবে শুধু কিকস্টার্টার দিয়েই সারাজীবন চলবে না। আমিও পারবো না জানি। এটা আপনাকে একটা সুযোগ করে দিতে পারে মাত্র। আমি কিন্তু হলিউডের যে সিস্টেম তার মধ্যেই কাজ করবো। এটা পুরোই বাজেটের ওপর নির্ভর করে। আমি পাগল নই। আমি জানতাম, কোনো স্টুডিও এই চলচ্চিত্রে লগ্নি করবে না। তাই সে চেষ্টাই করিনি। আসলে এটা শুরু থেকেই কিকস্টার্টার প্রজেক্ট ছিলো। তাই আমাদের লক্ষ্য ছিলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তহবিল জোগাড় করা এবং আমরা তা করেছিলামও।

তবে অনেক প্রজেক্টই প্রয়োজনীয় তহবিল জোগাড় করতে পারেনি, সে নজিরও আছে। শুধু আমার বেলায়ই নয়, অনেক ভালো স্ক্রিপ্টই প্রয়োজনীয় অর্থের অপেক্ষায় আছে। হলিউড সিস্টেমের সমস্যাটাই এখানে। অবশ্য আপনার স্ক্রিপ্ট যদি উচ্চাভিলাষী হয়, সেক্ষেত্রে কিকস্টার্টার দিয়েও ১০ মিলিয়ন ডলার জোগাড় করতে পারবেন না। এটা অসম্ভব।

ফ্রাগোসো : এক্ষেত্রে স্পাইক লির উপস্থিতি’কে কীভাবে আলাদা করবেন?

লি : আমার পক্ষে এটা ব্যাখ্যা করা খুবই কঠিন। আমি মনে করি, আমার চলচ্চিত্রে আমি যা যা রাখতে চাই, তার সবই থাকে; সেটা যে চলচ্চিত্রই হোক, যে বিষয় নিয়েই হোক না কেনো। এটা প্রামাণ্যচিত্র, আখ্যানধর্মী যে চলচ্চিত্রই হোক না কেনো; এগুলোর মধ্যে মিল একটাইএগুলো আমার হাতে জন্মেছে। তার পরও চলচ্চিত্রগুলোর প্রত্যেকটিই কিন্তু আলাদা আলাদা। সেগুলো একটি অন্যটির সঙ্গে যুক্ত কিন্তু পরস্পর থেকে ভিন্নও। অনেকটা হাতের পাঁচ আঙুলের মতো।

ফ্রাগোসো : হ্যাঁ, আপনার অনেকগুলো আঙুল আছে বটে!

লি : আমি আকিরা কুরোশাওয়ার মতো কাজ করে যেতে চাই। তিনিই আমার আদর্শ। ৮০ বছর বয়সেও তিনি কাজ করে গেছেন; আর আমার তো সবে ৫৭ [বর্তমানে ৫৯]। আমার এখনো প্রচুর কাজ করার আছে।

ফ্রাগোসো : আপনার সব গল্পেই কমবেশি কিছু রাজনৈতিক বক্তব্য থাকে। কখনো কখনো সেটা অনেক বেশি মাত্রায় দেখা যায়। ডু দ্য রাইট থিঙ-এ লস অ্যাঞ্জেলসের দাঙ্গা উঠে এসেছে। আবার ম্যালকম এক্স আর টোয়েন্টি ফিফথ আওয়ার-এ তো ভালোভাবে উঠে এসেছে ৯/১১ পরবর্তী নিউইয়র্কের মানুষের জীবনযাত্রা।

লি : এটা নিয়ে অবশ্য কথা বলার জায়গা আছে। লস অ্যাঞ্জেলসের দাঙ্গা, ৯/১১’র হামলা নিয়ে আমাদের একটা স্বচ্ছ ধারণা আছে; বিশ্বের জলবায়ু পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা ধারণা আছে; একইভাবে নগর বিকাশের ওপরও ধারণা আছে। যেমন : ডু দ্য রাইট থিঙ-এর সবুজ ল্যারি বার্ড সেলটিকস টি-শার্ট পরা জন স্যাভেজ চরিত্রটা এমন নাগরিক বিকাশকে ফুটিয়ে তোলে, যে আদিম।

ফ্রাগোসো : যখন ফার্গুসন (নিউইয়র্কের ফার্গুসন এলাকায় ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ৯ আগস্ট মাইকেল ব্রাউন নামের এক কৃষ্ণাঙ্গকে গুলি করে হত্যা করে আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ পুলিশ। এই হত্যাকাণ্ড তখন সারাবিশ্বে ব্যাপক আলোচিত হয়) কিংবা এরিক গার্নার (শুল্ক ফাঁকি দিয়ে সিগারেট বিক্রির ‘অপরাধে’ ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুলাই এই আফ্রিকান-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ এরিক গার্নারকে নিউইয়র্কের পুলিশ গুলি করে হত্যা করে) ট্রাজেডির মতো কোনো ঘটনা হয়; সেই বিষয়গুলো কি আপনার চলচ্চিত্রে তুলে ধরার তাড়না অনুভব করেন?

লি : আমি এমন কিছু করতে চাই, যেখানে রাষ্ট্র হিসেবে আজকের আমেরিকায় আমরা তার অংশ হয়ে উঠবো।  এটা সত্যিই একটি বড়ো ধরনের প্রাপ্তি হতে পারে।

ফ্রাগোসো : তাহলে আপনি কী চিন্তা করছেন, আমরা এখন কোন পরিস্থিতির মধ্যে আছি?

লি : আমরা এক বিশৃঙ্খলার মধ্যে আছি।

ফ্রাগোসো : সবসময় কি এই পরিস্থিতিই বিরাজ করে?

লি : অবশ্যই। কিন্তু যেটা হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা হালকা চাপা পড়ে থাকে। আর যখনই কোনো ঘটনা ঘটে, তখন গোটা পরিস্থিতিটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

ফ্রাগোসো : অনেক আমেরিকানই বর্তমান সময়ের বর্ণবাদ দেখে বিস্মিত হচ্ছে। ভাবটা এমন যে আগে সবকিছু অনেক ভালো ছিলো!

লি : আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওবামা যখন আব্রাহাম লিঙ্কনের বাইবেলে হাত রেখে শপথ নিচ্ছিলো, তখন কিছু লোক ভাবলো বর্ণবাদের অবসান হয়ে গেছেএটা পাগলামি ছাড়া আর কিছু না। এটা আমি গিলতে পারিনি। অথচ মানুষজন একজন আফ্রিকান-আমেরিকান প্রেসিডেন্ট পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলো।

ফ্রাগোসো : আর এখন?

লি : এখন আবার আমরা সেই বাস্তবতায় ফিরে এসেছি।

ফ্রাগোসো : ডু দ্য রাইট থিঙ শুরুই হয় রোজি পেরেজ-এর নাচ দিয়ে, সেখানে তাকে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ভঙ্গিতে নাচতে দেখা যায়। এর ২৬ বছর পর দ্য সুইট ব্লাড অব জিসাসও আবার আপনি শুরু করলেন ফেডোরা ব্রেক ড্যান্সের মধ্য দিয়ে।

লি : নাচিয়ে লিল বাক; ও তো মেমফিস, টেনেসির (আমেরিকান শহর) বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী। এটাকে তারা ‘জাকিন’ (Juckin, বিশেষ ধরনের ব্রেক ড্যান্স) বলে। তাছাড়া ব্রুস হর্নবাই-এর (আমেরিকান পিয়ানোবাদক, গায়ক ও গীতিকার। ইনি মূলত পপ, জ্যাজ ধারার গান করেন।) পিয়ানোতে বাজানো সুরটা তো শুনেছেন। চলচ্চিত্রের শুরুর সময়টার (ওপেনিং ক্রেডিট সিকোয়েন্স) ব্যাপারে আমি কিন্তু খুবই সচেতন থাকি। কারণ এর মধ্য দিয়েই পরের দুই-আড়াই ঘণ্টায় যা দেখানো হবে তার প্রতি দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করা যায়। দর্শককে দেখাতে হবে বলে কিছু দেখাবোবিষয়টি আমার কাছে মোটেও এমন নয়, এর চেয়ে বেশি কিছু। চলচ্চিত্রের শুরুটাকে আপনি চাইলেই আকর্ষণীয় ও সৃজনশীল করে তুলতে পারেন।

ফ্রাগোসো : সত্যিই। দুটি চলচ্চিত্রের শুরুর দুই নাচের দৃশ্য নিয়ে আমি কথা বললাম, কারণ ২৬ বছরের ব্যবধানে সেগুলোর মধ্যে ভিন্ন একটা টোন ছিলো। লিল বাক-এর চেয়ে পেরেজকে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক মনে হয়েছে। তাছাড়া আগে তো লোকজন আপনাকে রগচটা বলতো, যদিও সেটা বলা ঠিক নয়। আর আপনিও তো বলেন, ‘কাউকে রগচটা আখ্যা দেওয়া হলে বুঝতে হবে সে আফ্রিকান-আমেরিকান। আমরা (কৃষ্ণাঙ্গ) আরো বেশি রাগান্বিত হতে পারি।

লি : আচ্ছা, বিষয়টা হলোএকটা ঘটনা আছে যেখানে একজন আফ্রিকান-আমেরিকান তার তীব্র রাগ-ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সম্প্রতি দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’ শোনডা রাইমস’কে (কৃষ্ণাঙ্গ লেখক ও টেলিভিশন প্রযোজক) নিয়ে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেটা পড়ে কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। আর এটাই বোধ হয় প্রথম ঘটনা, যার জন্য নিউইয়র্ক টাইমস’ ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়। ওই নারীরা ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর ভবন পর্যন্ত পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলো। শোনডাকে ‘রগচটা নারী’ বলাটাই ছিলো তাদের ক্ষোভের কারণ। তাদের প্রশ্ন ছিলো, ‘শোনডা রাইমস কেনো রগচটা?’ এই রাগী বলাটা একটা লেবেল বা মানদণ্ড! এটা তো নতুন না। কেউ যতো গুরুত্বপূর্ণ কথাই বলুক তা এড়িয়ে যাওয়ার এটা একটা পুরনো চাল। সে যা-ই বলুক, আপনি শুধু ‘ওহ, ওরা ওই রকমই রগচটা’ বলে সব উড়িয়ে দিবেন। তারপর আপনি যখন এটা সম্পর্কে ভাববেন, তখন কাউকে যদি রগচটা আখ্যা দেওয়া হয়, তবে ধরেই নিবেন সে নিশ্চয় আফ্রিকান-আমেরিকান! আমরা কিন্তু আরো অনেক বেশি রগচটা হতে পারি!

ফ্রাগোসো : গান এবং টোনের মধ্যে পার্থক্যের কথা তো আগেই বলেছি। সত্যিই আমার জানার আগ্রহ, এই ২৬ বছরে আপনার পরিবর্তনটা কতোখানি? বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কি সেখানেও হেরফের হয়েছে?

লি : বিয়ে করেছি; দুটো বাচ্চা হয়েছে। আমার মেয়ে এখন নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্রের ওপর পড়াশোনা করে; আর ছেলেটা উচ্চ বিদ্যালয়ে। সবমিলিয়ে পরিবর্তন তো অনেক। ... সব বিষয়েই আপনি যদি রেগে যান, তাহলে তো নিজেকে ক্যান্সারের কাছে সমর্পণ করার মতো হবে। সে কারণে সবকিছু যত্ন সহকারে বেছে নিতে হবে। সত্যি কথা বলতে কী, রাগ দিয়ে তো আর জীবন চলে না। রাগ দিয়ে জীবনে কিছু হয় না। অন্যদের কথা বলতে পারি না, তবে রাগ থেকে এক জীবনে আমি কিছুই পাইনি।

ফ্রাগোসো : তাহলে কীভাবে আপনি বাছাই কিংবা পছন্দ করেন?

লি : এটা নির্ভর করে, কী বিষয়ে আমি কথা বলছি তার ওপর। একবার ফার্গুসন এবং স্টেটেন আইল্যান্ড চলচ্চিত্র উৎসবে গ্র্যান্ড জুরি ফলাফল দেখে আমার খুবই রাগ হয়েছিলো। তারপর ট্রাভন মার্টিনের (২০১২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার স্যানফোর্ড-এ ১৭ বছরের আফ্রিকান-আমেরিকান ট্রাভন মার্টিনকে সামান্য ঘটনায় পুলিশ গুলি করে হত্যা করে) বিষয়টাও আমাকে উত্তেজিত করেছিলো। এ ধরনের বিষয়ের তালিকা অনেক দীর্ঘ-ই। কিন্তু আগেই বলেছি, রাগ দিয়ে তো আর জীবন চলে না। এটা কারো জন্যই ভালো নয়।

ফ্রাগোসো : কিন্তু আপনার কাজে, বিশেষ করে প্রথম দিককার কাজগুলোতে অনেক বেশি ক্রোধ, হতাশা দেখা যায়।

লি : আমার তো মনে হয়, সেটা পরের কাজগুলোতেও আছে। হয়তো আরো বেশি সূক্ষ্মভাবে আছে। তবে এমন তো নয় যে, ময়লা ফেলতে হবে বলে সাল্স-এর পিৎজার (Sal's Famous Pizyeria হলো আমেরিকান পিৎজার খুব প্রসিদ্ধ ব্র্যান্ড) মধ্যেই ফেলতে হবে।

ফ্রাগোসো : অতীতে তো আপনি হলিউডের আফ্রিকান-আমেরিকান শিল্পীদের ক্ষেত্রে ফিস্ট-টু-ফেমিন(feast-to-famine হলো এমন একধরনের অবস্থা, যেখানে আফ্রিকান-আমেরিকান শিল্পীরা কখনো অনেক কাজ পায়, আবার কখনো দিনের পর দিন কোনো কাজই পায় না) সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন। আপনার কি মনে হয়, এ সমস্যা, বৈষম্য দিনে দিনে মিটে যাবে?

লি : আমি তখনই আশান্বিত হবো, যখন হলিউডের এই স্টুডিও সিস্টেমে আফ্রিকান-আমেরিকানদের গ্রিন লাইট ভোটের (প্রথমবার যেসব নির্মাতা তথ্যচিত্র বানানোর জন্য সুযোগ পান, সেটাকে গ্রিন লাইট আখ্যা দেওয়া হয়) পরিমাণ বাড়বে। আমি কিন্তু হলিউডের স্টুডিও সিস্টেমের ক্ষেত্রে এ কথা বলছি এবং এটা তখনই শুরু হবে, যখন মানুষের কথা আর কাজ এক হবে। তারা মুখে বলে, তারা বৈচিত্র্যে বিশ্বাস করে; কিন্তু চলচ্চিত্রের সংখ্যা অন্যকিছু বলে।

ফ্রাগোসো : আপনি বললেন, আপনার মেয়ে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্রে পড়ে, আপনিও ১৫ বছর ধরে  ফিল্ম স্কুলে পড়াচ্ছেন। আপনার সময়ে আপনি নতুন নির্মাতাদের যেসব উপদেশ দিতেন, এখনো কি একই উপদেশ দেন?

লি : হ্যাঁ, ১৫ বছর হলো; গত গ্রীষ্মে আমার মেয়াদ শেষ হয়েছে। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের টিস স্কুল অব আর্টস-এর আমি একজন শিল্পনির্দেশকও ছিলাম। এই ১৫ বছরে নতুনদের দেওয়া পরামর্শ, উপদেশগুলো মোটেও বদলায়নি। আমি সবসময় বলি, কিছু করতে হলে কঠোর পরিশ্রম করা দরকার। রাতারাতি কিছুই হয় না। এজন্য আপনাকে গাধার মতো খাটতে হবে। তাহলেই আপনি কিছু করতে পারবেন।

ফ্রাগোসো : কিন্তু ইন্ডাস্ট্রি তো বদলে গেছে?

লি : ঠিকই বলেছেন, ইন্ডাস্ট্রির পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু আমি যা বলেছি, সেগুলো পাল্টে যায়নি। এটা একটা ফর্মুলা; রাতারাতি কিছু হওয়ার কোনো উপায় নেই। কঠোর পরিশ্রম করুন, তাহলে কখনোই ব্যর্থ হবেন না। আমি শুধু তাদের একটা রাস্তা বাতলে দেওয়ার চেষ্টা করছি; কারণ তারা তো এখনো শিখছে আর আমি সে পথটা পার করে এসেছি।

সূত্র : http://www.theatlantic.com/entertainment/archive/2015/02/spike-lee-interview/385495/; retrieved on 24.01.2016

কাওসার বকুল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্বের শিক্ষার্থী।

bokulmcj71@gmail.com

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন