এম এ মোমিন রাঙ্গা
প্রকাশিত ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
ফিল্মপাড়ায় যারা একসময় লেবার ছিলো তারা আজ প্রযোজক, তারা কী সিনেমা বানাবে!
এম এ মোমিন রাঙ্গা

চলচ্চিত্র প্রতিনিধি পেশাটির সঙ্গে খুব বেশি পরিচিত নন দর্শক। অবশ্য এর কারণও আছে; চলচ্চিত্র ও প্রেক্ষাগৃহের সঙ্গে এই পেশার মানুষের সরাসরি সম্পর্ক থাকলেও দর্শকের সঙ্গে নেই বললেই চলে। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে মেহের আফরোজ শাওন পরিচালিত কৃষ্ণপক্ষ-এর সঙ্গে প্রতিনিধি হিসেবে রাজশাহীর ‘উপহার সিনেমা লি.’-এ এসেছিলেন এম এ মোমিন রাঙ্গা। চলচ্চিত্রের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা সেই ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে। সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার মোমিন রাঙ্গা পড়াশোনা করেছেন উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত। দূর সম্পর্কের এক চাচাতো ভাই চলচ্চিত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তার কাছেই ঢাকায় গিয়েছিলেন চাকরির জন্য। ভাইয়ের সুপারিশে পেশা জীবনের শুরু ঢাকার পোস্তগোলায় ‘ডায়না’ নামের প্রেক্ষাগৃহে টিকিট বুকিং ক্লার্ক হিসেবে। পোস্তগোলায় তখন সোবহান নামে জনৈক ব্যক্তির ‘ডায়না’, ‘মেঘনা’ ও ‘যমুনা’ নামে তিনটি প্রেক্ষাগৃহ ছিলো। শুরুতে বেতন পেতেন মাসে ৭০ টাকা।
প্রেক্ষাগৃহ শ্রমিকদের নিয়ে একপর্যায়ে ইউনিয়ন করেন মোমিন রাঙ্গা। মালিকপক্ষ বিষয়টি ভালোভাবে নেননি, তাই নানা সঙ্কটের আশঙ্কায় একপর্যায়ে তিনটি প্রেক্ষাগৃহই তারা বন্ধ করে দেন। দ্বন্দ্বের চরমে মালিকপক্ষ মামলাও করেন শ্রমিকদের বিরুদ্ধে। ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে মোমিন রাঙ্গা সেসময় পলাতক ছিলেন। মালিক-শ্রমিক দ্বন্দ্বের একপর্যায়ে মোমিন রাঙ্গা চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। পরে ঢাকার কাকরাইলের চলচ্চিত্রপাড়ায় ঘুরে ঘুরে চলচ্চিত্র প্রতিনিধি সমিতির সদস্য হিসেবে নাম তালিকাভুক্ত করেন। এরপর থেকে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এখনো এই পেশাতেই আছেন। ৪ এপ্রিল ২০১৬, বেলা ১১টায় ‘উপহার’ প্রেক্ষাগৃহে কথা হয় তার সঙ্গে। চলচ্চিত্রের নানা বিষয় নিয়ে ম্যাজিক লণ্ঠন-এর পক্ষ থেকে তার সঙ্গে কথা বলেন কাজী মামুন হায়দার।
ম্যাজিক লণ্ঠন : সেদিন (২ এপ্রিল কৃষ্ণপক্ষ দেখার জন্য ‘উপহার’-এ গিয়ে মোমিন রাঙ্গার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়) কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন প্রেক্ষাগৃহের ব্যবসা আপনাদের অনেক পুরনো ব্যবসা—এটা ঠিক বুঝলাম না।
এম এ মোমিন রাঙ্গা : ‘উৎসব’ নামে রাজশাহীর যে সিনেমাহলটি ভাঙা হয়েছে, সেটাও কিন্তু আমাদেরই ছিলো। তখন ওর নাম ছিলো ‘কল্পনা’। তখন ব্যবসাও বেশ ভালো ছিলো। কিন্তু কল্পনার শ্রমিকরা যখন ইউনিয়ন করলো, তখন আমার চাচাতো ভাই ওই সিনেমাহলটি বিক্রি করে দিলো। তার বক্তব্য—‘শ্রমিকের কাছে আমি মাথানত করবো না।’ তখন ওই সিনেমাহলটা কিনলেন রহমান সাহেব। তিনি নাম বদলে রাখলেন ‘উৎসব সিনেমাহল’। উনিও ভালো ব্যবসা করেছেন সেসময়। কিন্তু এখন তো সিনেমাহলে সেই ব্যবসা নাই। যেমন ধরেন কখনো ভুলে যেও না (২০১৪) টাইপের সিনেমা যদি পরিচালকরা বানায়, তাহলে সিনেমাহলে দর্শক কীভাবে আসবে? এখন শাকিব আর শুভ ছাড়া কোনো নায়কের সিনেমা চলতেছে না দেশে। এদের নিয়ে দুই টাকা দিয়ে সিনেমা করলেও টাকাটা ঘরে আনা যায়। কিন্তু অন্য নায়কের সিনেমা দিয়ে সেটা পারবেন না।
ম্যাজিক লণ্ঠন : কিন্তু কেউ কেউ তো বলছে যে, শাকিব খানকে একটানা দেখতে দেখতে তারা হাঁপিয়ে উঠেছে।
মোমিন রাঙ্গা : এটা একেবারেই বাজে কথা। আমি এর প্রমাণ দিতে পারবো। শাকিবের নাম থাকলেই সিনেমাহল মালিকরাও আগ্রহী হয়। আমি দেখছি শাকিবের সিনেমায় টেবিল ক্যাশই আসে এক—দেড় কোটি টাকার মতো। অন্য হিরোর সিনেমায় হলমালিক টাকা দিতে এতোটা আগ্রহ দেখান না।
ম্যাজিক লণ্ঠন : টেবিল ক্যাশ বলতে আপনি ঠিক কোনটা বোঝাচ্ছেন?
মোমিন রাঙ্গা : সিনেমাহলের মালিক যখন কোনো সিনেমার জন্য প্রযোজকের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করেন, তখন এম জি মানি (মিনিমাম গ্যারান্টি) দিতে হয়। এই ভাবে বিভিন্ন সিনেমাহলের মালিকরা টাকা দিয়ে প্রযোজকের কাছ থেকে সিনেমা নিয়ে আসেন। এ থেকে অফিসে যে টাকা জমা হয়—সেটাই টেবিল ক্যাশ। এই ধরেন আপনি দেড় লক্ষ টাকা দিয়ে একটা সিনেমা নিয়ে আসলেন। এই সিনেমায় আপনাকে কমপক্ষে তিন লক্ষ টাকার টিকিট বিক্রি করতে হবে। কারণ আপনি তো অফিসে দেড় লক্ষ টাকা দিয়েই আসছেন, ফলে ওই দেড় লক্ষ তোলার পর না আপনার কিছু থাকবে। তার ওপর আপনার সিনেমাহলের খরচ, স্টাফ বেতন, বিদ্যুৎ বিল তো আছেই।
এই বছর শাকিবের লাভ ম্যারেজ কিছুটা ব্যবসা করেছে। এখনো শাকিবের সিনেমা কোনো মতে ব্যবসা করে। কিন্তু অন্য হিরোর সিনেমা হলে আপনি টাকাই ফেরত পাবেন না। আপনি তো মানুষের কাছ থেকে টাকা ধার করে সিনেমা মুক্তি দিয়েছেন। ভালো ব্যবসা না হলে তো আপনি সেই টাকা ফেরত দিতে পারবেন না। তখন আপনার কী হবে?
ম্যাজিক লণ্ঠন : এ রকম কেনো হচ্ছে?
মোমিন রাঙ্গা : কারণ নতুন হিরো-হিরোইনকে কেউ খাচ্ছে না; তারা যতো ভালো অভিনয়ই করুক। আর একটা বিষয় দেখেন, আমাদের দেশের অনেক সিনেমায় নায়ক-নায়িকা মেরে ফেলা হয়। নায়ক-নায়িকা মেরে ফেললে এদেশে ছবি ভালো চলে না। কিন্তু গল্পের খাতিরে অনেক সময় তাদের মেরে ফেলতে হয়।
এই কিছুদিন আগে পদ্ম পাতার জল নামে একটা সিনেমার নাম নিশ্চয় শুনেছেন? সিনেমাটার খুব প্রচার চলে সারাদেশে। ঈদে সিনেমাটা মুক্তিও পায়। আমি ঢাকা থেকে চাঁপাই নবাবগঞ্জের এক সিনেমাহলে ফোন করি, ভাই কী অবস্থা আপনাদের ওখানে? সিনেমাহলের ম্যানেজার জানায়, ‘ভাই প্রথম শো-এ সাড়ে তিনশো টাকার টিকিট বিক্রি করেছি। সিনেমাটা ভালো ছিলো, কিন্তু চললো না।’ এই যে আমার সিনেমা কৃষ্ণপক্ষ, এর খরচ কিন্তু কম। এই ধরেন এক জায়গায় শুটিং করেই শেষ হয়েছে। এই সিনেমা ব্যবসা করবে। কারণ খুব বেশি হলে এর ব্যয় ৫০ লক্ষ টাকা। প্রযোজক বিজ্ঞাপন দিয়েই অনেক টাকা তুলে নিয়েছে। এই ধরনের কম টাকায় সিনেমা বানালে ব্যবসা হয়তো হবে।
ম্যাজিক লণ্ঠন : তাহলে আমরা এ ধরনের অল্প বাজেটের সিনেমা নির্মাণ করছি না কেনো?
মোমিন রাঙ্গা : বানানো তো যায়-ই। এ ধরনের সিনেমা বানালে বিজ্ঞাপন দিয়ে কিছু টাকা উঠে আসে। আর সিনেমাহল থেকে তো কিছু আসবেই। তবে এর বাইরে সিনেমা বানালে সেটাতে সবকিছু থাকতে হবে। যেমন : ভালো হিরো-হিরোইন লাগবে, ডিরেক্টর ভালো লাগবে, গল্প লাগবে এবং দু-একটা কমার্শিয়াল গান যদি ঢুকানো যায়, তাহলে সে সিনেমা ব্যবসা করবে।
ম্যাজিক লণ্ঠন : এই যে এখানে কৃষ্ণপক্ষ চালাচ্ছেন, ব্যবসার পদ্ধতিটা কী, মানে হলমালিকের সঙ্গে টাকার হিসাবটা একটু বলবেন?
মোমিন রাঙ্গা : এখানে যা টিকিট বিক্রি হবে তার থেকে সরকারি ট্যাক্স বাদ যাবে ২০ শতাংশ। ধরেন এক লক্ষ টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছে, সেখান থেকে ২০ হাজার টাকার ট্যাক্স বাদ যাবে। বাকি ৮০ হাজারের অর্ধেক পাবে হলমালিক, বাকি টাকা সিনেমার মালিক। তবে সব সিনেমাহলে কিন্তু এই ট্যাক্স সমান নয়, যেমন যশোরের ‘মণিহার’’-এ ৩০ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হয়।
আপনাকে একটা বিষয় পরিষ্কার করি, উপহারে বক্সে একটা টিকিট বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা। ওরা আমাকে এর থেকে হিসাব দিচ্ছে ১০৫ টাকার। ওই যে পাঁচ টাকা বাদ দেওয়া হলো, এর মধ্যে থেকে তিন টাকা পাবে জাজ মাল্টিমিডিয়া, যারা এখানকার প্রজেক্টর মেশিন দিয়েছে। এরা প্রতি টিকিটে তিন টাকা করে পায়। বাকি দুই টাকা হলমালিক পায়। তাকে আবার এখান থেকে নানা জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। তবে এই টাকার ২৫ শতাংশ আমাকে মানে প্রতিনিধিকে দেওয়া হয়।
ম্যাজিক লণ্ঠন : তাহলে ড্রেস সার্কেল-এর (ডি সি) ক্ষেত্রে কী হয়?
মোমিন রাঙ্গা : এই ধরেন এখানে টিকিট বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকা। আমাকে দেওয়া হচ্ছে ৫৯ টাকা। ওই ছয় টাকার তিন টাকা জাজ পায়। বাকি তিন টাকার মধ্যে হলমালিক, আমি, অন্ধকল্যাণ সমিতি, ডায়াবেটিক সমিতিকে চাঁদা দিতে হয়।
ম্যাজিক লণ্ঠন : এই যে আপনি চলচ্চিত্র প্রতিনিধি হিসেবে এখানে এসেছেন, আপনারা চলচ্চিত্রের সঙ্গে ঠিক কীভাবে কাজ করেন?
মোমিন রাঙ্গা : সিনেমার মালিক হলো প্রযোজক। মনে করেন, কোনো সিনেমা যখন একশো ২০টি সিনেমাহলে মুক্তি দেওয়া হবে, তখন একশো ২০ জন প্রতিনিধি লাগবে।
ম্যাজিক লণ্ঠন : ধরেন, আমি একটা সিনেমা করছি। শুটিংয়ের পর সিনেমার এডিটিং, ডাবিংও শেষ, মানে মুক্তির জন্য এটি প্রস্তুত, ঠিক এই সময় আমি কী করবো? একই সঙ্গে এই সময় প্রযোজক পরিবেশকের সঙ্গে আপনাদের কী সম্পর্ক?
মোমিন রাঙ্গা : মনে করেন সিনেমা মুক্তির জন্য পুরো রেডি হওয়ার পর আপনি সেটা সেন্সর বোর্ডের কাছে পাঠাবেন। সেন্সর বোর্ড তাদের সনদ দিলে আপনি প্রযোজক সমিতিতে একটা চিঠি পাঠাবেন। সেই চিঠিতে আপনি সিনেমা মুক্তির একটা তারিখ চাইবেন। তখন প্রযোজক সমিতি আপনাকে একটা তারিখ বলবে। আপনি নিজের ইচ্ছেমতো তারিখে সিনেমা মুক্তি দিতে পারবেন না। আপনার যদি সেই তারিখ পছন্দ হয় তাহলে সেই মোতাবেক প্রচার-প্রচারণা ইত্যাদি চালাতে থাকবেন। আর যদি না হয়, তাহলে একটু সময় নিয়ে পছন্দের তারিখ চাইতে পারেন। সবকিছু মিললে প্রযোজক সমিতি হয়তো সেই তারিখই আপনার জন্য নির্ধারণ করে দিলো।
ম্যাজিক লণ্ঠন : এই সময়ে আপনাদের ভূমিকা কী?
মোমিন রাঙ্গা : যখন ঠিক হয়ে গেলো ওই তারিখে এই সিনেমাটি সারাদেশে মুক্তি পাবে, তখন আপনার দরকার পড়বে প্রতিনিধির। এই যে ধরেন, একশো ২০টি সিনেমাহলে ওই সিনেমাটি চলবে; আমরা এসব সিনেমাহলে প্রযোজকের পক্ষ থেকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবো। এর ব্যবসা নিয়ে আমরা যে রিপোর্ট দেবো সেটাই ঠিক হবে। প্রত্যেকটা সিনেমাহলে প্রতি শো’তে প্রতিনিধি ভিতরে যাবে, লাইট মেরে দর্শক গুনবে এবং হিসাব রাখবে কোন শো’তে কতোজন দর্শক দেখলো। তিনি দেখবেন টিকিট বিক্রি হলো কয়টা, আর কয়জন সিনেমা দেখছে।
ম্যাজিক লণ্ঠন : প্রযোজকের সঙ্গে প্রতিনিধির সম্পর্কটা ঠিক গড়ে ওঠে কীভাবে? আপনাকে বাছাই করা হয় কীভাবে বা কার মাধ্যমে?
মোমিন রাঙ্গা : যখন আপনি মুক্তির তারিখ নির্ধারণ করে ফেললেন, তখন প্রতিনিধিদের যে সমিতি আছে সেখানে আপনাকে চিঠি দিতে হবে। আমাদের সমিতিতে বর্তমানে ধরেন দুইশো ৫০ জন সদস্য আছে। আগে আরো অনেক বেশি ছিলো। প্রযোজক আমাদের সভাপতি বরাবর চিঠি দিবেন যে, আমার সিনেমা ওই তারিখে মুক্তি পাবে, এতোটা সিনেমাহলে চলবে, আমার এতোজন প্রতিনিধি দরকার। তখন আমাদের সমিতি থেকে প্রযোজকের কাছে একটা তালিকা পাঠানো হবে।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনাদের সমিতির পুরো নাম?
মোমিন রাঙ্গা : ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রতিনিধি সমিতি’। সমিতিতে আমাদের যে বায়োডাটাগুলো আছে সেগুলো প্রযোজকের কাছে পাঠানো হয়। প্রযোজক সেই বায়োডাটাগুলো দেখে দেখে তার প্রয়োজন মতো প্রতিনিধি বাছাই করেন। ধরেন আপনার দরকার একশো জন প্রতিনিধি, সমিতি থেকে পাঠানো হবে দুইশো জনের বায়োডাটা। সেখান থেকে আপনি একশো জন বাছাই করে নিয়ে তাদের নিয়োগপত্র দেবেন। এরপর সেই নিয়োগপত্র দিয়ে আপনি তাদের সিনেমাহলে পাঠাবেন।
বর্তমানে যে নিয়ম তাতে একজন প্রতিনিধির প্রতিদিনের ভাতা একশো ৫০ টাকা। যেমন : আমি এখানে (উপহার) প্রতিদিন একশো ৫০ টাকা করে পাচ্ছি। এখন বলেন, এই একশো ৫০ টাকায় আমার চলবে? চলবে না। তাই সিনেমাহল মালিক আমাকে প্রতিদিন খাওয়া বাবদ দিচ্ছে তিনশো টাকা করে। তাহলে কতো হলো—চারশো ৫০ টাকা; আর ওই যে বললাম প্রত্যেক টিকিট থেকে হলমালিক বিভিন্ন খাতে দুই টাকা করে পায়, সেখান থেকে আমি আরো ২৫ শতাংশ পাই। এইসব দিয়ে সিনেমাহল থেকে আমি যে বিলটা পাই সেটা আর খরচ হয় না। তবে সিনেমাহল থেকে যে তিনশো টাকা খাওয়া বাবদ দেওয়া হয়, সেটা কিন্তু পুরোটাই সিনেমাহল মালিক দেয় না। এর অর্ধেক প্রযোজক, অর্ধেক হলমালিক দেয়।
ম্যাজিক লণ্ঠন : ধরেন কোনো সিনেমা যদি না চলে, সেক্ষেত্রে কী হয়?
মোমিন রাঙ্গা : দেখেন, সিনেমা চলুক আর না চলুক তাতে প্রতিনিধির কিছু আসে যায় না। তার খরচা আপনাকে দিতেই হবে। আবার যখন ভালো চলবে, আপনি হয়তো এক লক্ষ টাকা এম জি দিয়ে কোনো সিনেমা নিয়ে আসছেন, ব্যবসা করছেন তিন লক্ষ টাকা, তখন তো আপনি আমাকে বেশি টাকা দিবেন না। তখনো আপনি আমাকে ওই একশো ৫০ টাকাই দিবেন। তাই আমাদেরকে কিছু সুযোগ-সুবিধা প্রত্যেক প্রযোজকই দেয়, এটা জোরের কিছু নয়।
ম্যাজিক লণ্ঠন : তার মানে প্রত্যেক সিনেমার সঙ্গেই প্রতিনিধি আসে?
মোমিন রাঙ্গা : আসে, তবে কিছু ক্ষেত্রে অন্যরকমও আছে। এই ধরেন, কিছু সিনেমাহলে কিছু সিনেমা ফিক্সডে যায়। ফিক্সড মানে হলো, একটা নির্দিষ্ট টাকা একবারে দিয়ে তারা সিনেমাটা সিনেমাহলে চালানোর জন্য নিয়ে যায়। এটাকে রেন্টাল-এ আনাও বলে। এসব ক্ষেত্রে সিনেমাহলে প্রতিনিধি লাগে না। তখন লাভ-ক্ষতি সবই হলমালিকের, প্রযোজকের কিছু নাই।
আর একটা হলো অ্যাডভান্স সিস্টেম। যেসব সিনেমা একটু কম চলে সেগুলোতে প্রযোজকরা সাধারণত এম জি’তে দেয় না। তখন এই ধরেন ১০ কিংবা ২০ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে সিনেমা আনতে হয়। আবার কোনো সিনেমায় যদি ভালো নায়ক, যেমন : শাকিব খান থাকে, তখন আপনাকে এম জি দিয়েই সিনেমা আনতে হয়। আপনি হয়তো শাকিবের কোনো সিনেমা দেড় লক্ষ টাকা এম জি দিয়ে নিয়ে আসছেন, সে টাকা কিন্তু আপনি আর ফেরত পাবেন না। আপনার টাকা উঠলে উঠলো, না হলে নাই।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আচ্ছা মোমিন ভাই, আপনার এই পেশা কতোদিন হলো?
মোমিন রাঙ্গা : অনেক দিন। এই সিনেমাহলের (উপহার) যারা মালিক মানে মোশারফ হোসেন চৌধুরী ও তার ভাই সাইফুল ইসলাম চৌধুরী, তারাই পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সিনেমা মুখ ও মুখোশ-এর পরিবেশক। তারা আমার দূর সম্পর্কের ভাই।
আমি প্রথমের দিকে এই কাজ করতাম না। ভাইদের প্রতিষ্ঠান ছিলো ‘পূর্ব পাকিস্তান ফিল্ম ট্রাস্ট’; আমি সেই অফিসে বসতাম, টুকটাক কাজকর্ম করতাম। স্বাধীনতার পর এই প্রতিষ্ঠানের নাম হয় ‘‘বাংলাদেশ ফিল্ম ট্রাস্ট’। তারও কিছু পরে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় খালি ‘‘ফিল্ম ট্রাস্ট’। এই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সর্বশেষ সিনেমা হলো সারেন্ডার, জসিম আর শাবানা ছিলো। এই সিনেমাটা সেসময় খুব ব্যবসা করেছিলো। একটা গান খুবই জনপ্রিয় হয়, ‘‘সবাই তো ভালোবাসা চায়/ কেউ পায় কেউবা হারায়/ তাতে প্রেমিকের কী আসে যায়’। এরপর নানা কারণে আমার ভাইয়েরা ব্যবসা গুটিয়ে নেয়।
ম্যাজিক লণ্ঠন : মোশারফ হোসেন চৌধুরীর সিনেমাহল কয়টা ছিলো?
মোমিন রাঙ্গা : এই যে এখানে ‘উপহার’ ও ‘‘কল্পনা’। সরিষাবাড়ির ‘‘চম্পাকলি’’, কুমিল্লার চান্দিনায় ‘‘পালকি’’, বগুড়ার শেরপুরে ‘‘মুক্তি’’সহ মোট পাঁচটি সিনেমাহল ছিলো।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে এমন কিছু সিনেমা নিয়ে একটু কথা বলেন তো মোমিন ভাই।
মোমিন রাঙ্গা : আজ থেকে ১৫—২০ বছর পিছনে যান যখন জসিম, শাবানা, আলমগীর অভিনয় করতো; তখন সিনেমার মান, অভিনেতাদের মান, গল্পের মান ভালো ছিলো; সঙ্গে ডিরেক্টররাও। বিশেষ করে সিনেমার গল্পটা আপনি যদি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত টাইট রাখতে পারেন, সেই সিনেমা ব্যবসা করবেই। মনে করেন সিনেমা শুরু করে মাঝখানে গিয়ে যদি স্লো হয়ে যায়, তাহলে সে সিনেমা আর চলবে না। আমাদের দেশে স্লো সিনেমা চলতে চায় না। সিনেমা সবসময় ফাস্ট রাখতে হবে, যাতে কোনো দর্শক সিনেমা দেখা বাদ দিয়ে প্রস্রাব করার জন্যও বাইরে না যায়। এই ধরেন এরপর কী, এরপর কী একটা আকর্ষণ।
এখন যে সিনেমা হচ্ছে, আপনি-আমি চাইলেই তো এর সিকোয়েন্স বলে দিতে পারি, এরপর কী হবে। ওই ধরনের সিনেমা হলে তো চলবে না। মানুষকে একটা টেনশনের মধ্যে রাখতে হবে। যেমন : সত্য মিথ্যা, এ জে মিন্টুর লালু মাস্তান, জসিমের সারেন্ডার—এই সিনেমাগুলোতে যে ব্যবসা তখন হয়েছে; এখনো ওই ধরনের সিনেমা বানালে ব্যবসা হবে।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আজকে চলচ্চিত্রের এই অবস্থার জন্য আমরা কাকে দায়ী করবো কিংবা এই অবস্থাটা কেনো হলো?
মোমিন রাঙ্গা : এই যে ‘চ্যানেল আই’ সিনেমা বানাচ্ছে। এরা নাটক বানিয়ে তার মধ্যে একটা কমার্শিয়াল গান ঢুকিয়ে দিয়ে বলতেছে, সিনেমাহলে মুক্তি দেওয়া হবে। এইসব নাটক-ফাটক জাতীয় সিনেমা বানিয়ে আজ ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস হয়ে গেছে। শোনেন, নাটক দিয়ে সিনেমাহল চলে না। সিনেমাহল চালাতে হলে সিনেমাই লাগবে।
আর এখন সিনেমায় বিশাল একটা সিন্ডিকেট কাজ করছে। কেউ আর সিনেমা বানানোর জন্য ইন্ডাস্ট্রিতে আসে না। বেশিরভাগ লোক আসে দুই নম্বর টাকা নিয়ে। তারা সিনেমা বানাবে বলে প্রযোজক-পরিচালক সমিতি থেকে অনুমতি নিয়ে দুই নম্বর ব্যবসা করছে। এই ধরেন, আগে কোনো প্রযোজক সিনেমা বানালে প্রথমে নায়িকাদের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট হতো, তারপর মহরত হতো। এখন আর সেই মহরত হয় না। এখন নায়িকাকে সিনেমার প্রযোজক-পরিচালক বলে, তুমি আগে আমার সঙ্গে তিন-চার রাত থাকো, আনন্দ-ফুর্তি করি; মহরত পরে হবে। এই চিন্তাভাবনা নিয়ে এখন শতকরা ৭৫ ভাগ পরিচালক-প্রযোজক আসতেছে।
আর একটা কথা বলি শোনেন, ফিল্মপাড়ায় যারা একসময় লেবার ছিলো তারা আজ প্রযোজক, তারা কী সিনেমা বানাবে বলেন! আমজাদ হোসেন কি আর দ্বিতীয় কেউ হবে? হবে না। এ জে মিন্টু কি আর হবে এদেশে? হবে না। ইবনে মিজানও হবে না। সেই ডিরেক্টর আর এদেশে নাই, তাই সিনেমাও ভালো হবে না।
আর একটা লোকের কথা বলি, এই যে ডিপজল সাহেব; উনি কিন্তু একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক। উনি বাংলাদেশের ফিল্মের নতুন জীবন দিয়েছেন। কিন্তু একটা চক্র আছে যারা তার বিরোধী। তারা ডিপজলের এসব কার্যক্রম মেনে নেয় নাই, তারা গুলি পর্যন্ত করছিলো ডিপজলকে মারার জন্য। এই ঘটনার পর ডিপজল চলে গেলেন। উনি ইন্ডাস্ট্রিতে থাকার সময় প্রতি মাসে নতুন নতুন গল্প নিয়ে সিনেমা রিলিজ দেওয়ার চেষ্টা করতেন।
সিনেমায় আরেকজন ভদ্রলোক আছেন, তিনি হলেন ‘টি ও টি ফিল্মস’-এর কর্ণধার খোরশেদ আলম খসরু। উনি খুব চেষ্টা করছিলেন সিনেমা জগতটাকে আবার নতুন করে ঘুরে দাঁড় করানোর। এই যে ভিডিও পাইরেসি যা হতো, উনি সংগ্রাম করে বন্ধ করান। কিন্তু আর একটা চক্র আছে, ভিডিও পাইরেসি যারা করে তাদের সঙ্গে হাত মেলায়। তারা বলে, আমরা কিছু বলবো না, তোমরা যতো পারো করো, মাস শেষে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিলেই হবে। এই হলো অবস্থা।
ম্যাজিক লণ্ঠন : তার মানে অনেকে যে বলে ডিশ অ্যান্টেনা, মেমোরি কার্ড এসবের জন্য বাংলাদেশের চলচ্চিত্র চলছে না—এটা তাহলে ঠিক না?
মোমিন রাঙ্গা : এ ধরনের কথারও কিছুটা সত্যতা আছে। তবে ডিশ, মেমোরি কার্ড চললেও সেটা সিনেমার খুব বড়ো ধরনের ক্ষতি করতে পারে নাই। হ্যাঁ ডিশ, মেমোরির কারণে হয়তো সাময়িক কিছু ক্ষতি হয়, কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, সিনেমা ভালো হলে এগুলো তো বেশি ক্ষতি করতে পারে না।
ম্যাজিক লণ্ঠন : ভাই, এই যে আপনি একটা কথা বললেন যে, আগে যারা ফিল্মপাড়ায় লেবার ছিলো তারা এখন প্রযোজক হয়ে গেছে—এটা কীভাবে হলো?
মোমিন রাঙ্গা : এরা করে কী জানেন, পাঁচ-সাতজন মিলে ১০টা পুরনো সিনেমা কেনে। মানে আপনি প্রযোজক; আপনার ব্যবসা শেষ, আমি সেই সিনেমাটা কম দামে কিনে নিলাম। বেশিরভাগ সময় এরা শাকিবের এ ধরনের সিনেমা কিনে থাকে। সিনেমা কেনার পর এগুলোর মধ্যে এক্সট্রাভাবে চার-পাঁচটা করে কাটপিস গান ঢুকাইয়া দেয়। তারপর এসব সিনেমা এরা আট-নয় হাজার টাকায় মফস্বলে যেসব সিনেমাহল আছে সেগুলোতে চালানোর ব্যবস্থা করে। দীর্ঘদিন ধরে এরা এভাবে ব্যবসা করে লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক হয়ে গেছে। এখন তাদেরকে আমরা সালাম দেই, তাদের সিনেমার কাজও আমরা করি। এরাই একসময় কাকরাইলে সিনেমা রিলের বাক্স উঠানামার কাজ করতো। প্রথমে একটা বাক্স উঠালে দেওয়া হতো ১০ টাকা, পরে দেওয়া হলো ৫০ টাকা করে। এখন এই লেবার যদি প্রযোজক হয়, সে কী সিনেমা বানাবে!
ম্যাজিক লণ্ঠন : মোমিন ভাই, আপনি যে সিনেমাগুলোর কথা বললেন, এগুলোর একটা মারাত্মক খারাপ প্রভাব আছে পুরো ইন্ডাস্ট্রিতে। মফস্বলে এইসব সিনেমা চালানোর ফলে সেখানকার জনগণের কাছে কিন্তু সিনেমাহলটাই একটা খারাপ জায়গা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছে।
মোমিন রাঙ্গা : শুধু এটাই না। আমাদের ফিল্মপাড়া হলো কাকরাইল; এই কাকরাইল দিয়ে একসময় ভালো ছেলে-মেয়েরা, ভদ্র লোকজন রিকশা নিয়ে যেতে চাইতো না। কারণ নোংরা সব পোস্টার তখন এসব অফিসের সামনে লাগানো থাকতো। একপর্যায়ে মানুষ সিনেমা জগতটাকেই ঘৃণা করা শুরু করলো। একটা উদাহরণ দেই, এই যে এই সিনেমাহলের মালিক তার একটাই মেয়ে। বিয়ে ঠিক হওয়ার সময় ছেলের বাবা বলছিলো, সিনেমার লোকজনের সঙ্গে আত্মীয়তা করবো! তাহলে চিন্তা করেন, এই জগতটাকে কতো ঘৃণা করে মানুষ।
ম্যাজিক লণ্ঠন : কিন্তু এই জায়গাটা তো ঘৃণা করার মতো ছিলো না।
মোমিন রাঙ্গা : ওই যে বললাম দুশ্চরিত্র কিছু প্রযোজক আসছে, তারা দিনের পর দিন এগুলো করছে।
ম্যাজিক লণ্ঠন : এই যে আপনি এতোদিন ধরে চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত আছেন, আপনি কি কখনো এজন্য সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছেন?
মোমিন রাঙ্গা : হ্যাঁ, হ্যাঁ হয়েছি। আমি সেই প্রযোজকের নাম বলবো না, তার এমন কিছু সিনেমাতে আমাকে প্রতিনিধি হয়ে যেতে হয়েছিলো, যেগুলো পুরোপুরি পর্নোগ্রাফি। এইসব সিনেমা যখন সিনেমাহলে চলতো, আমি ভয়ে সেখান থেকে খানিকটা ফাঁকে থাকতাম। ভয়ে ভয়ে থাকতাম, কখন র্যাব, পুলিশ আসে আর কখন রেইড দেয়। তার পরও আমি দুইবার ধরা খাইছি। এইসব সিনেমা দেখার জন্য সিনেমাহলে সে কী ভিড়; খালি মানুষ আর মানুষ।
ম্যাজিক লণ্ঠন : তাহলে ইন্ডাস্ট্রির কী হবে এখন?
মোমিন রাঙ্গা : ইন্ডাস্ট্রি শেষ। আমরা যতোই আশা করি, এই ইন্ডাস্ট্রি আর কোনো দিনও ফিরবে না। এ নিয়ে শেষ চেষ্টা করা হয়েছিলো ভারতীয় সিনেমা আমদানি করে, কিন্তু সে চেষ্টাও সফল হয়নি। তবে ভারতে মুক্তির দিনেই যদি আমাদের এখানেও মুক্তি দেওয়া যায়সে হিন্দি, বাংলা যাই হোক—তাহলে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হতে পারে।
ম্যাজিক লণ্ঠন : ধরেন, একই দিনে ভারত-বাংলাদেশে সিনেমা মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো, তাহলে বাংলাদেশের সিনেমার কী হবে? আমাদের সিনেমা বলে কি আদৌ কিছু থাকবে?
মোমিন রাঙ্গা : আমাদের সিনেমা বলে হয়তো কিছুই থাকবে না। ওই যে কয়েকদিন আগে প্রধানমন্ত্রী সিনেমার লোকদের উদ্দেশ্য করে বললো, তোমাদের সিনেমা বিশ্বে চলে না, কেনো চলে না? ভারতের সিনেমা কেনো এখন সারাবিশ্বে চলছে। তোমরা তাদের দেখে তাদের মতো করে সিনেমা বানাও। এ কথা পরিচালকদের ডেকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছে। কিন্তু তারা তো সেই সিনেমা বানাচ্ছে না। বানাতে পারলেও অতো টাকা নাই।
এই ধরেন আমজাদ হোসেন, এ জে রানার মতো ডিরেক্টর ঘরে বসে আছে। এখন আবার নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে এফ ডি সি’তে, সেটা হলো চাঁদাবাজি। আপনি নতুন প্রযোজক, সিনেমা বানিয়েছেন, আপনাকে মোটাদাগের চাঁদা দিতে হবে। তাছাড়া আপনি সিনেমা মুক্তি দিতে পারবেন না। এরা অত্যন্ত শক্তিশালী। এভাবে চারিদিকেই করুণ অবস্থা। এই যে আমাদের এই সিনেমাহল হয়তো আমার ভাই আর রাখবে না। যেকোনো দিন এই সিনেমাহল বিক্রি হয়ে যেতে পারে। শুনছি দর কষাকষি চলছে, ১৫ কোটি টাকা দাম করছে ক্রেতা, আর মালিক বলছে ২০ কোটি টাকার কথা। এখন ১০টা সিনেমা লাগানো হলে একটায় ব্যবসা হয়, নয়টায় লোকসান। মালিক কী করে ব্যবসা করবে?
তবে যাদের অনেক টাকা আছে কিংবা কালো টাকা আছে, যেমন ধরেন অনন্ত জলিল সাহেব; তাদের দুই-চার কোটি টাকা লোকসান হলেও কিছু হবে না; এরাই এখন মোটামুটিভাবে টিকে আছে। তার পরও সেটা খালি সিনেমার ব্যবসা দিয়ে নয়, অন্য ব্যবসাও আছে। তার পরও দেখেন এখন ডিপজল সাহেব নাই, অনন্ত জলিল নাই, খসরু ভাই নাই। এখন আছে কিছু দুই নম্বর লোকজন। তাদের কাজ হলো ফিল্মের আড়ালে নায়িকাদের দিয়ে কিছু মক্কেল জোগাড় করে বাইরের ব্যবসা করানো। আসলে এখন সিনেমার নামে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুই নম্বরের ব্যবসা চলছে।
এখন সিনেমা বানানোর মন-মানসিকতা কারো নাই। তাই ব্যবসা আর হবে না। আমি সেই ৭৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে দেখতেছি, এই ব্যবসা খালি নীচের দিকে নামছে বছরের পর বছর। এইভাবে এটা এখন শেষ সীমানায় চলে আসছে।
আমরা তো ভারতের নতুন সিনেমা আনছিলাম বেপরোয়া; কলকাতা ও বাংলাদেশে একসঙ্গে রিলিজ। মোটামুটি টাকা উঠে আসছে। তবে এখন একটাই পথ আছে সিনেমাহল বাঁচানোর, সেটা হলো হিন্দি সিনেমা। ভারত-বাংলাদেশে একসঙ্গে হিন্দি সিনেমা রিলিজ দিলে, আবার সিনেমাহল চাঙা হবে। তবে এটাও ঠিক, তখন আমাদের সিনেমা বলে আর কিছু থাকবে না। এই যে দেখেন শাকিব চলে গেছে ভারতে, ওখানে শিকারি নামে সিনেমা করছে। মাহি সিনেমা করছে দেবের সঙ্গে আজকের সংবাদপত্রেই আছে (৪ এপ্রিল ২০১৬’র ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ দেখিয়ে)। কারণ খালি দেশের নায়ক-নায়িকা দিয়ে আর সিনেমা চলবে না। যৌথভাবে সিনেমা বানাতে হবে, একই সঙ্গে মুক্তি দিতে হবে।
এই যে আগামী শুক্রবারে পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনি ২ আসতেছে, এর প্রথম পার্টটা বেশ ভালো ব্যবসা করছে। এই সিনেমার বেশ চাহিদা আছে। সিনেমাহল মালিকরা দুই—আড়াই লক্ষ টাকা পর্যন্ত এম জি দিচ্ছে। তারা আশাবাদী যে শাকিবের সিনেমা যেহেতু, কিছু ব্যবসা হবে। এর বাইরে কোনো নায়ক-নায়িকা দিয়ে সিনেমা বানান, হলমালিকরা এই ঝুঁকিতে আর যাবে না। তখন তারা প্রযোজককে বলে, এই ২০ হাজার টাকা দিলাম দেন, না হয় সিনেমা চালাবো না।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনাদের সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী দেশে এখন মোট সিনেমাহল কতোগুলো আছে?
মোমিন রাঙ্গা : আমাদের হিসাব মতে, নিয়মিত চলছে এ রকম সিনেমাহলের সংখ্যা দুইশো ৩৫টি। মোট সিনেমাহল ছিলো এক হাজার চারশোটি।
ম্যাজিক লণ্ঠন : এগুলোর বেশিরভাগই কি জেলা শহরে?
মোমিন রাঙ্গা : না। কিছু সিনেমাহল উপজেলাতেও আছে। যেমন : সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার কথাই ধরেন, ওখানে সিনেমাহল ছিলো ১১টা। সেই সময় ব্যবসাও হয়েছে এসব সিনেমাহলে। একটা সিনেমা বেলকুচিতে তখন তিন—চারটা সিনেমাহলে একসঙ্গে চলেছে প্রতিযোগিতা করে। তখন সিনেমা চালানোর জন্য মালিকরা কাড়াকাড়ি করতো।
ম্যাজিক লণ্ঠন : এখন বেলকুচিতে কয়টা সিনেমাহল আছে?
মোমিন রাঙ্গা : এখন আছে মাত্র দুইটা। এ দুইটাও এখন ধুক ধুক করে চলছে। কয়েক মাস আগে এই দুইটা সিনেমাহলও কিছুদিন বন্ধ ছিলো। এখন আবার চালু করছে। তবে ব্যবসা নাই বললেই চলে। এই হলো আমাদের চলচ্চিত্রের সার্বিক অবস্থা। মানুষের নৈতিক চরিত্র ভালো হতে হবে; ব্যবসায়িক মন নিয়ে চলচ্চিত্রে আসতে হবে; ভালো গল্প, ভালো নায়ক-নায়িকা দিয়ে সিনেমা নির্মাণ করেন তাহলে সেটা চলবে, ব্যবসা হবে।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আচ্ছা, এই যে সিনেপ্লেক্সের ব্যবসা নিয়ে আপনার মতামত কী?
মোমিন রাঙ্গা : ওই সব সিনেমাহলে ব্যবসা আছে। ওখানে কিন্তু কোনো শো’তে কোনো সিট খালি থাকে না। যেমন ধরেন বসুন্ধরা সিটি সিনেপ্লেক্সে এতো টাকা টিকিটের দাম, তার পরও কোনো সিট ফাঁকা থাকে না। সিনেপ্লেক্সে চলার মতো সিনেমা তৈরি করতে পারলে আর পরিবেশ দিতে পারলে সিনেমা চলবে। ওখানে কিন্তু পদ্ম পাতার জল, কৃষ্ণপক্ষ হাউসফুল থাকে; কিন্তু এই যে মিয়া বিবি রাজি ওখানে চলবে না। ওরা এ ধরনের সিনেমা চালাবেও না।
এই যে কৃষ্ণপক্ষ ওখানে মুক্তির দিন থেকে চলছে বেশ ভালোই। আপনি যদি মনে করেন পুরস্কার আনবেন, তখন এই ধরনের সিনেমা বানাবেন। ধরেন যমুনা ও বসুন্ধরা থেকে এসব সিনেমার টাকা আসবে লাখ বিশেক; আর এইসব সিনেমাহলের ৫০টা চালালেও ১০ লক্ষ টাকা আসে কি না সন্দেহ। ওই সব সিনেমাহলে তো রিকশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা যায় না; সব শিল্পপতির ছেলে-মেয়েরা গাড়ি নিয়ে আসে। তারা টাকাকে টাকা মনে করে না। তারা চায় ভালো পরিবেশ, ভালো সিনেমা।
আপনি ‘বলাকা’ সিনেমাহলে যান, সেখানকার দর্শক কিন্তু আলাদা। ওখানে ডি সি’র টিকিট দুইশো টাকা, তার পরও জায়গা দেওয়া যায় না। ওখানকার বাথরুমে যাবেন, সেখানে বসে আপনি নির্দ্বিধায় পোলাও-কোরমা-বিরিয়ানি খেতে পারবেন। আর এই সিনেমাহলের বাথরুমে যান, আপনি একবার ঢুকলে আর দ্বিতীয়বার ঢুকবেন না। হলমালিকদেরও দোষ আছে। দেশের বেশিরভাগ সিনেমাহলের পরিবেশ ভালো না। তাই খালি সিনেমার দোষ দিলেই হবে না। অবশ্য এর কারণও আছে, লোকসান দিতে দিতে তাদের মন নষ্ট হয়ে গেছে।
কাজী মামুন হায়দার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ান।
kmhaiderru@yahoo.com
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন