Magic Lanthon

               

মৃণাল সেন

প্রকাশিত ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

একশো বছরেও সিনেমা মরেনি, মরবেও না

মৃণাল সেন


যন্ত্রের অগ্রগতির সঙ্গে-সঙ্গে সিনেমার রঙ ঢঙ বদলেছে। সিনেমার বিচরণক্ষেত্রের পরিধি বিস্তৃত হয়েছে। নিত্য নতুন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে এগিয়ে এসেছে সিনেমা। আমি এখানে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের প্রেক্ষিতেই সিনেমা-কে দেখতে চাইছি। একশো বছর ধরে সিনেমায় কত কী না ঘটে গেল। কোথাও শিল্পগত নিরিখে সিনেমার উত্তরণ ঘটেছে, কোথাও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কেরামতিতে সিনেমা হয়ে উঠেছে দর্শনীয়। সেটা বড় কথা নয়। আরও বড় কথা হল, যেটা দেখা গেছে, দেখে চলেছিএকটা ফ্রন্টিয়ার অতিক্রম করার নেশা যেন এখনও পেয়ে বসে আছে সিনেমা-করিয়েদের। পৃথিবীর সর্বত্র এক চিত্র নয়, সব জায়গায় একই ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু এটা ঠিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চমকদারির মোকাবিলা করতে হচ্ছে আজ সৎ সিনেমাকে। টিভি এবং ভিডিও এখন ঢুকে পড়েছে ঘরে ঘরে। সিনেমা হলে যাওয়ার ইচ্ছেটা কমিয়ে দিয়েছে, দিচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উদ্ভাবনী শক্তি একদিকে যেমন সিনেমাকে কোণঠাসা করে দিচ্ছে, অন্য দিকে সিনেমাকেও সুযোগ দিচ্ছে নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার। তাতে কী হচ্ছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কেরামতির দৌলতে এক শ্রেণীর চিত্র পরিচালক পর্দায় চমকদারি দেখিয়ে বাজিমাৎ করার জন্য উৎসাহী হয়ে উঠেছেন, যেখানে সিনেমা তার শিল্পগুণ নিয়ে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ফলে সৎ সিনেমা, শিল্পসম্মত সিনেমা এখন ভয়ঙ্কর এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।

কয়েকদিন আগেই একটা হিসাব পড়লাম, পাঁচ-এর দশকে জার্মানিতে বছরে ৯০০ মিলিয়ন দর্শক সিনেমা দেখেছেন। নয়-এর দশকে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে বছরে ১০৬ মিলিয়ন-এ। এর থেকেই বোঝা যায় সিনেমা কী ভয়ঙ্কর একটা অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। দর্শক ভিডিওতে সিনেমা দেখে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছেন, তবু সিনেমা দর্শককে টেনে নিয়ে যেতে পারছে না প্রেক্ষাগৃহে। সত্যিকারের একজন সিনেমা-করিয়ে কি তাঁর ছবি ছোট পর্দায় দেখে বা দেখিয়ে তৃপ্তিবোধ করবেন? আমি তো কখনওই তা পারি না। আমার নিজের ছবি ছোট পর্দায় মিনিট পাঁচেক দেখতে পারি বড়জোর। দেখাতে চাই না, কিন্তু দেখাতে হয়-ই। অথচ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কেরামতিকে সিনেমা যদি শিল্পসম্মতভাবে কাজে লাগাতে পারে, লাগাতে পারেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিনেমা-করিয়েরা, তাহলে সিনেমাকে নিশ্চয়ই এরকম সঙ্কটের মোকাবিলা করতে হ না।

বিজ্ঞানের অগ্রগতির পথরোধ করা যায় না, যায়নি কখনও। কিন্তু সেই অগ্রগতিকে শুধুমাত্র ব্যবসায়িক স্বার্থে কাজে  লাগালে একশো বছরে শিল্প হয়ে ওঠা সিনেমা কোথায় নেমে দাঁড়াতে পারে! জনমনোরঞ্জনের জন্য ছবি তৈরি হয়েছে, হচ্ছে, হবেও। সেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কেরামতিকে চিত্র পরিচালকরা নিশ্চয় কাজে লাগাবেন। সেখানে  শিল্পের শর্তগুলো পুরোপুরি বর্জন করে কেউ যদি সিনেমাকে ম্যাজিকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করেন এবং তথাকথিত সেই ‘সিনেমা’ যখন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, তখনই সর্বনাশ ঘটে যায়। আন্তর্জাতিক সিনেমার ক্ষেত্রে সর্বনাশ ঘটেছে এভাবেই। ঘটিয়েছে ‘জুরাসিক পার্ক’-এর মতো ছবিগুলো। এর পরিপ্রেক্ষিতে একথাও ঠিক, এ ধরনের চমকদারি তৈরির কখনও চিরন্তন আবেদন থাকে না, থাকতে পারে না। অর্থাৎ এসব সময়ের ধোপে শেষ পর্যন্ত টেকে না। টেকে ভাল যা কিছু।

জনপ্রিয়তা শিল্পবিচারের মাপকাঠি নয়। তাই সিনেমা মরে যায়নি, মরবেও না। এখানে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা কথা বলি। কথায় কথায় তিনি কোথাও বলেছিলেন, ‘সাহিত্যের তো একটা আভিজাত্য থাকবে।’ হ্যাঁ, সেই আভিজাত্য সৎ সিনেমারও থাকা দরকার। বটতলার সাহিত্য যেমন চলে, তেমনি বটতলার সিনেমাও। তার অর্থ এই নয়, সেগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করব। আলোচনা হয়, আলোচনা হবেও, অভিজাততথা শিল্পসম্মত সিনেমা নিয়েই। সারা পৃথিবীতে, ভারতবর্ষেও এটা দেখছি, সঙ্কট মোকাবিলা করার জন্য কৃতী চিত্র পরিচালকরাও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চমকদারিকে অত্যন্ত কদর্যভাবে ব্যবহার ক’রে, মূল বিষয়বস্তুকে একবারে উপর থেকে দেখার কাজটি করে যাচ্ছেন। ফলে সেইসব ছবি হয়ে উঠছে অন্তঃসার শূন্য।

১৯২৯-এ মস্ত বড় যে ঘটনাটি ঘটেছিল, সেটা হ’ল সিনেমায় শব্দের আগমন। যে কোনও ক্ষেত্রে নতুন কোনও ব্যাপার এলে সেটা প্রতিরোধ করার প্রবণতা দেখা যায়। শব্দ যখন আসে, তখনও এরকম ঘটেছিল। এমনকি চ্যাপলিনের মতো চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বও শব্দকে সাদরে গ্রহণ করেননি। তখন সেই প্রতিরোধ ঠেকাতে আরও একটা বড় ঘটনা ঘটেছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃতি দিয়ে আইজেনস্টাইন বা পুডভ্কিনের মতো সিনেমার পুরোধারা বিজ্ঞানের নব উদ্ভাবনকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। একই সঙ্গে একথাও বলেছিলেন, শব্দের যেন ভালগার ব্যবহার না হয়। এই উদ্ভাবনকে ব্যবহার করতে হবে শিল্পসম্মতভাবে। সেদিনের পুরোধাদের বিবৃতি আজকের দিনে আরও বেশি প্রযোজ্য। সঙ্গে সঙ্গে একথাটাও বলা দরকার, ভূত সরষের মধ্যেও রয়েছে। সিনেমাকে জনপ্রিয় ক’রে তোলার তাগিদে কেবল যে প্রযুক্তির চটকদারি বা ভালগারিটি সিনেমার সর্বনাশ ঘটাচ্ছে, তা নয়। আমি বলব, সিনেমা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সৎ সিনেমার নামে কিছু অসৎ ছবি-করিয়ের জন্য। এ ব্যাপারে সচেতন থাকা দরকার।

শিয়রে সংক্রান্তি হলেও সিনেমা বেঁচে আছে, বেঁচে থাকবেও। সারা পৃথিবীতে চালিয়াতি যেমন আছে, তেমনই ভাল কিছু করার চেষ্টাও আছে। আর আমি মনে করি, এই পরিস্থিতিতে সিনেমাকে আরও শত শত বছর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সাহসী, সৎ মানুষেরসাহস এবং সততা নিয়ে যাঁরা ছবি করবেন, ছবি দেখাবেন এবং ছবি দেখবেন!

দায়স্বীকার : এই লেখাটি অপর্ণা সেন সম্পাদিত ‘সানন্দা’ ৯ম বর্ষ, ১৫শ সংখ্যা, ১৭ এপ্রিল ১৯৯৫ থেকে নেওয়া। এই সংখ্যায় সানন্দা ‘সিনেমার একশো বছর’ শিরোনামে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করে।

লেখক : মৃণাল সেন, ভারতের বিখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা।  

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন