Magic Lanthon

               

তাসনিয়া মিন্নি

প্রকাশিত ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

এক মানুষ-খুনির ‘ত্রাতা’ হওয়ার গল্প সেভিয়র

তাসনিয়া মিন্নি


যে কারণে গল্পের শুরু

দর্শকের অভিগম্যতা কিংবা সামাজিক ভূমিকা বিবেচনায় বেশিরভাগ মৌলিক শিল্পমাধ্যমকে ছাপিয়ে গেছে চলচ্চিত্র। ফলে সালভেদর দালির মতো চিত্রশিল্পীকে চলচ্চিত্রকার হতে দেখা গেছে, সের্গেই আইজেনস্টাইন, ইঙ্গমার বার্গম্যান কিংবা ঋত্বিক ঘটকের মতো থিয়েটারকর্মীরাও চলচ্চিত্রকার বনে গেছেন। এমনকি ব্যাকরণিক দিক থেকে চলচ্চিত্র বুঝতে হলে এদের সৃষ্টি না দেখলে চলচ্চিত্রই বোঝা সম্ভব নয়। অন্যদিকে চলচ্চিত্রের পুঁজিবাদী রূপ দর্শককে বিনোদন-বাজারে অবিরত অক্রিয় ভোক্তায় রূপান্তর করে, ক্ষমতাবানের মতাদর্শিক হাতিয়ার হয়ে দর্শক মনে আধিপত্য কায়েম করে। আর এ কারণেই হয়তো পশ্চিমা বিশ্ব চোখের সামনে বিশাল পর্দায় যুদ্ধের চলচ্চিত্রায়ণ করে তাদের মতো করে। আর দর্শক হিসেবে আমরা এই চলচ্চিত্র দেখি আর ভাবি, পশ্চিমের সাদা চামড়ার সৈন্যরা সমস্যাপীড়িত অঞ্চলের মানুষ ও মানবতাকে রক্ষায় কতোই না কষ্ট করছে!

কিন্তু একটু গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায় ঘটনা একেবারেই অন্য রকম। এতোদিনে এটা বুঝতে কষ্ট হয় না যে, সন্ত্রাস দমন পশ্চিমাদের কাছে একটা অজুহাত মাত্র; আসল উদ্দেশ্য ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন, অস্ত্র বিক্রি, প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠনসহ সামগ্রিক আধিপত্য বিস্তার। তাদের এই তৎপরতায় সারাবিশ্ব এখন একদিকে নির্যাতিত, অন্যদিকে নিপীড়নকারীদুই ভাগে বিভক্ত। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান, চিন ও ইউরোপের কিছু দেশ নিজেদের প্রতিনিয়ত জাহির করছে নিপীড়িত দেশগুলোর ত্রাতা হিসেবে। এমনই এক ত্রাতার গল্প পর্দায় হাজির করেছেন মার্কিন নির্মাতা পিটার আন্তোনিজেভিচ (Peter Antonijevic)। গল্পের সেই ত্রাতা এই পর্বে গেছেন বসনিয়া যুদ্ধের নিপীড়িত মানুষদের রক্ষায়। চলচ্চিত্র সেভিয়র-এর (১৯৯৮) সেই মানুষের ত্রাতা হয়ে ওঠার গল্পই এই প্রবন্ধের বিষয়।

নথি থেকে সেলুলয়েডে বসনিয়ার গৃহযুদ্ধ

১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ, স্নায়ুযুদ্ধ কেবল শেষ হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নও ভেঙে গেছে ততোদিনে। ঠিক এমনই একসময় ইউরোপের বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় শুরু হয় গৃহযুদ্ধ, যা বসনিয়া যুদ্ধ নামে পরিচিত। যার সূত্রপাত মূলত ক্রোয়েশিয়া ও স্লোভেনিয়া বিভাজনের মাধ্যমে। অবিভক্ত যুগোস্লাভিয়ার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় মোট জনগোষ্ঠীর ৪৪ শতাংশ বসনিয় মুসলিম, ৩১ শতাংশ অর্থোডক্স সার্ব এবং ১৭ শতাংশ ক্রোয়েশিয় ক্যাথলিকের বসবাস। স্বাধীনতা লাভের পর যুগোস্লাভিয়ার এ অংশ শাসন করতে থাকে সার্বরা। ফলে সার্বদের একচ্ছত্র কর্তৃত্বকে মেনে নিতে পারেনি বসনিয় মুসলমান ও ক্রোটরা। তাই মুসলিম ও ক্রোটরা সংসদে স্বাধীনতার দাবি জানায়। কিন্তু এই দাবির বৈধতা অর্জনে ইউরোপিয় ইউনিয়ন ও মার্কিন সরকার গণভোটের শর্ত জুড়ে দেয়। সার্বরা অবশ্য এ গণভোট বর্জন করে। তার পরও ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক নীতি অনুযায়ী এবং বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নজরদারিতে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়; যাতে ভোট দেয় ৬৪ শতাংশ নাগরিক। এই ভোটারদের ৯৯ শতাংশ অবিভক্ত ও স্বাধীন বসনিয়া গড়ার পক্ষে রায় দেয়। পরে দ্বন্দ্ব নিরসনে ত্রিজাতির সমন্বয়ে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা প্রজাতন্ত্র নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণাও পাস হয়। কিন্তু বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার এই স্বাধীনতা ঘোষণা মেনে নেয় না বসনিয়-সার্ব রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা।

একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পরদিনই বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা আবার সার্বদের আগ্রাসনের শিকার হয়। সার্বরা মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য শুদ্ধি অভিযানে নামে। শুরু হয় বসনিয়া যুদ্ধ, যা ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ৭ এপ্রিল থেকে ১৯৯৫-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে। এই যুদ্ধে সার্বদের মদদ দেয় সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও মন্টিনিগ্রো। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘ বসনিয়া সংঘাতে হস্তক্ষেপের দায়ে সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রোর ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। অন্যদিকে যুগোস্লাভিয়ার ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকায় আত্মরক্ষার সুযোগ পায় না বসনিয়া সরকার। বসনিয় মুসলমানরা এ নীতির প্রতিবাদ জানালে জাতিসংঘ সাফ জানিয়ে দেয়, তারা মুসলমানদের পক্ষ নিয়ে সেখানকার কোনো কিছুতে হস্তক্ষেপ করবে না। তবে তারা মুসলমানদের রক্ষার জন্য ছয়টি অঞ্চলকে নিরাপদ এলাকা ঘোষণা করে। এরপর ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২২ জানুয়ারি শান্তি প্রস্তাব করে জাতিসংঘ। ৩০ জুলাই বিবাদমান তিনটি পক্ষ ওয়েন স্টোলটেনবার্গ চুক্তি মেনে নেয়। চুক্তিতে রিপাবলিক অব বসনিয়ান ইউনিয়ন নামের একটি রাষ্ট্রের জন্মের কথা বলা হয়; যেখানে ৫২ শতাংশ ভূমি বসনিয়ান সার্বদের, ১৭ শতাংশ ক্রোটদের, ৩০ শতাংশ মুসলমানদের এবং রাজধানী সারায়েভোর জন্য থাকে এক শতাংশ ভূমি। নতুন প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রটি দুই বছর জাতিসংঘের অধীনে থাকারও সিদ্ধান্ত হয়।

তিন পক্ষই এই শান্তি প্রস্তাব মেনে নেওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধ অব্যাহত থাকে! জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর নাকের ডগায় বসে সার্বরা একে একে জাতিসংঘ ঘোষিত নিরাপদ অঞ্চলগুলোতে আক্রমণ চালিয়ে হাজার হাজার বেসামরিক মুসলমান নারী-পুরুষ-শিশুকে নির্যাতন ও হত্যা করে। কখনো কখনো শান্তিরক্ষী বাহিনীকে অসহায় বানিয়ে তাদের কাছ থেকে বসনিয় মুসলমানদের নিয়েও হত্যা করে তারা। একসময় জাতিসংঘ ও ন্যাটোর হস্তক্ষেপে অবসান হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সবচেয়ে বড়ো এ গণহত্যার। এই ছিলো মূলত নথিপত্র অনুযায়ী বসনিয়া যুদ্ধ। এবারে চলচ্চিত্রে এই যুদ্ধের যে উপস্থাপন তা সংক্ষেপে জেনে নিই।

বসনিয়া যুদ্ধের ছায়া অবলম্বনে ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে পিটার আন্তোনিজেভিচ নির্মাণ করেন সেভিয়র। কাহিনির শুরু ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের প্যারিসে জোসুয়া রোজ (Joshua Rose) নামে এক সৈনিককে ঘিরে। মার্কিন নাগরিক রোজ, কাজ করেন ফ্রান্সের মার্কিন দূতাবাসে। সেভিয়র-এর শুরুতে মুসলমান জঙ্গিদের বোমা হামলায় নিহত হয় রোজের স্ত্রী ও সন্তান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে রোজ পাশের এক মসজিদে নামাজরত কয়েকজন মুসলিমকে গুলি করে হত্যা করেন। এই ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একজন আহত মুসলমান রোজের দিকে পিস্তল তাক করলে, তাকেও হত্যা করেন রোজের বন্ধু পিটার। পরে গ্রেফতার এড়াতে দুই বন্ধু ফ্রান্সের বিশেষ বাহিনী ‘ফ্রান্স ফরেন লিজন’-এ (French Foreign Legion, বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের নিয়ে গঠিত ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ ইউনিট। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এই ইউনিটটি ফ্রান্সের হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধে অংশ নেয়।) যোগ দেন। যেখানে নাম-পরিচয় হারিয়ে ছদ্মনামে শুরু হয় রোজের নতুন জীবন। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে বসনিয়ায় মুসলিম, অর্থোডক্স সার্ব ও ক্রোয়েশিয় ক্যাথলিকদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে রোজ ও পিটার এই যুদ্ধে যোগ দেন সার্বদের পক্ষে। দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় পিটার এক মুসলিম কিশোরীর বোমা হামলায় নিহত হন।

রোজ ও সার্ব সেনা গোরান দুই মুসলমান বন্দিকে ধরে নিয়ে যান বসনিয় মুসলিমদের সঙ্গে বন্দি বিনিময়ের জন্য। বিনিময় কেন্দ্রে গোরান তার প্রতিবেশী ভেরা’কে মুসলিম সৈন্যদের হাতে নির্যাতিত ও অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় দেখতে পান। সার্বিয় নারীর শরীরে একজন মুসলমানের বেড়ে ওঠাকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন না গোরান। তাই তিনি হত্যা করতে চান ভেরাকে। ঘটনাক্রমে গোরানকে হত্যা করে ভেরাকে বাঁচান রোজ। এমন সময় সন্তান প্রসব করেন ভেরা। এরপর মা ও সন্তানকে ভেরার বাড়িতে নিয়ে যান রোজ। কিন্তু ভেরাকে তার পরিবারের লোকজনও মেনে নেয় না। তারপর থেকেই শুরু হয় মা ও সন্তানকে বাঁচানোর জন্য রোজের লড়াই।

নামকরণ ও নাম বদলের খেলা  

সেভিয়র-এর চার মিনিট ৩৮ সেকেন্ডে রোজের স্ত্রী ও সন্তান মুসলিম জঙ্গিদের বোমা হামলায় নিহত হয়। পরে রোজ মুসলিমদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে কাছের একটি মসজিদে গিয়ে নামাজরত কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করেন। মনে হতে পারে, রোজ কেনো নির্বিচারে এতো মানুষকে হত্যা করলেন? কিন্তু সে প্রশ্ন তোলার সুযোগই নির্মাতা দর্শককে দেন না। তিনি পরের দৃশ্যেই বুঝিয়ে দেন, নামাজরত মুসলিমের কাছেও অস্ত্র থাকে। তারা নিশ্চয় কোনো জঙ্গি সংগঠনের সদস্য; কিংবা মুসলমান মানেই সন্ত্রাসী, বোমা হামলাকারী! তাছাড়া মসজিদে অস্ত্র আসবে কোথা থেকে? একই সঙ্গে এও জায়েজ করেন, এই মুসলিমদের ধ্বংস করা ছাড়া উপায় নেই। ফলে রোজের বন্ধু পিটার আহত মুসল্লির ওপর গুলি চালাতে দ্বিধা করেন না। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বাস্তবেও এই চিন্তার প্রয়োগ দেখা যায়। আর সেজন্যই হয়তো যুক্তরাষ্ট্রে ১৪ বছর বয়সি মুসলিম আহমদের বানানো ঘড়ি দেখে তার শিক্ষকদের এটাকে বোমা মনে হয়। ‘আহমদ’ নামটি যেহেতু মুসলমানের, ফলে তাকে জঙ্গি প্রমাণ করা আহামরি কিছু নয়। একই ঘটনা নামের সঙ্গে চার্লস, জন কিংবা মাইকেল সংযুক্ত কেউ ঘটালে হয়তো অন্য রকম হতো।

এক ঘণ্টা তিন মিনিট ১১ সেকেন্ডে মুসলিমরা ভেরা ও তাদের আশেপাশের গ্রামে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালায়। তারা আরো অনেকের সঙ্গে ভেরার মা-বাবা ও ভাইকেও বন্দি করে নিয়ে যায়। যারা যেতে চায় না, তাদেরকে পথেই হত্যা করে মুসলিমরা। আবার ওই মুসলিমরাই একসময় ভেরাকে ধরে নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন করে। যাদের কারণে ভেরা আজ পরিবার-পরিজন থেকে আলাদা। এতো সব ‘খারাপ’ কাজ যে মুসলিম করে, তারা আর যাই হোক ‘ভালো’ হতে পারে না। তাই রোজের মতো চৌকস সেনাদের এ যুদ্ধে যোগদানের প্রয়োজন পড়ে। উল্টোভাবে রোজের হাতে বারবার যেসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, জঙ্গিবাদের ধুয়া তুলে তা বৈধতা দেওয়া হয়। একবারও প্রশ্ন তোলা হয় না, মসজিদে নামাজরত সবাই কি জঙ্গি ছিলো? আর যদি তারা জঙ্গি হয়েও থাকে, বিনা বিচারে এভাবে তাদের হত্যা করা যায় কি না? অবশ্য প্রতিপক্ষ যখন মুসলমান, সেখানে কোনো কিছুর আইনি বৈধতার প্রশ্ন তোলাই ‘নির্বুদ্ধিতা’র শামিল। হয়তো সেভিয়র-এ সেজন্যই এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠে না। যেমন প্রশ্ন ওঠে না সারাবিশ্বে নানা হত্যাকাণ্ডের হোতা যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার কিংবা ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়েও।

মুসলমানদের হাতে ধর্ষিত ও অন্তঃস্বত্ত্বা ভেরা সন্তান প্রসবের পরে আত্মহত্যায় উদ্যত হন সেভিয়র-এর ৩১ মিনিট ৫০ সেকেন্ডে। এতে তিনি সফল হন না। রোজের হস্তক্ষেপে জীবন ফিরে পেলেও ভেরা নিজের সন্তানকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন না। কারণ এ শিশুর শরীরে মুসলমানের রক্ত প্রবাহিত। ফলে নিরন্তর সন্তান কেঁদে চললেও বুকের দুধ খাওয়ানো থেকে তিনি বিরত থাকেন। এদিকে মুসলিম সেনাদের হাতে নির্যাতিত ভেরা ও তার সন্তানের দায়িত্ব নিতে অপারগতা জানায় ভেরার পরিবার। বাধ্য হয়েই এসব দায়িত্ব বর্তায় ‘ত্রাতা’ রোজের ওপর। ভেরাকে গাড়িতে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বের হন রোজ। ভেরার বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় তার মা একটা ঝুড়িতে কিছু ফল, দুধের পাত্র, ফিডার দিলেও নিপল দিতে ভুলে যান। ভেরা ও তার সন্তান নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে রোজের গাড়ি ছুটে চলে। পথিমধ্যে ক্ষুধায় শিশুটি কাঁদতে থাকে, কিন্তু এবারেও শিশুটিকে স্তন দানে অস্বীকৃতি জানান ভেরা। নিরুপায় রোজ তাই ফিডারের নিপল না পেয়ে নিজের পকেটে থাকা কনডমকে নিপল হিসেবে ব্যবহার করেন। উপস্থিত বুদ্ধিতে কনডমের সাহায্যে দুধ খাওয়ানোটা ভালোভাবেই সম্পন্ন করেন রোজ।

রোজের এই উপস্থিত বুদ্ধিতে দর্শক তৃপ্ত হলেও, বিপরীতে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন ঢাকা পড়ে যায়। পুরো বিষয় এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যে, রোজের পকেটে কনডম কেনোদর্শক মনে এই প্রশ্ন আসার কোনো সুযোগই থাকে না! এতো সাবলীলভাবে রোজ পকেট থেকে কনডম বের করেন, যেনো এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। তিনি মনে হয় জানতেন (!) এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে এবং এই মহৎ কার্য সম্পাদনের জন্যই পকেটে কনডম রাখতে হবে। কিন্তু ঘটনা কি আদতে তাই? রোজের পকেটে কনডম রেখে নির্মাতা পিটার যুদ্ধে নারী নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের বৈধতা দেন। একই সঙ্গে বসনিয়া যুদ্ধে সার্বিয় সৈন্যরাও যে বসনিয় নারীদের ধর্ষণ করেছে এবং রোজও যে তার বাইরের কেউ নন, এ কনডম সেটাই স্পষ্ট করে। বিষয়টি হয়তো এমন যেধর্ষণ করুন, তবে অবশ্যই মার্কিন নাগরিকদের মতো কনডম ব্যবহার করবেন। তাতে আর যাই হোক ধর্ষণকারীর পরিচয় সংক্রান্ত কোনো ঝামেলায় অন্তত পড়তে হবে না! অন্যদিকে যৌনবাহিত রোগ থেকে নিরাপদ তো রইলেনই!

‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ

আমি আজ চোর বটে’ 

সেভিয়র-এর ১৫ মিনিট ৫৫ সেকেন্ডে শহরের মধ্যে এক অভিযানে গোরান ও রোজ এক মুসলিম বাড়িতে প্রবেশ করেন। রোজ আগে প্রবেশ করেই দেখতে পান, ওই বাড়ির একটি ঘরের ধ্বংসস্তুপের মধ্যে একজন অন্ধ বৃদ্ধ নারী খাটের উপর বসে আছেন এবং মেঝেতে নারী ও পুরুষের মৃতদেহ পড়ে আছে। রোজ ঘরের আলমারির ভিতর থেকে হালকা কান্নার আওয়াজ শুনতে পান। তিনি আলমারির দরজা খুলে একটা শিশুকে দেখতে পান। শিশুটিকে হয়তো তার মা প্রাণ রক্ষার আশায় এখানে লুকিয়ে রেখেছিলেন। গোরান ঘরে ঢোকার আগেই রোজ শিশুটির মুখে নিপল দিয়ে তার কান্না বন্ধ করেন। রোজের আশঙ্কা, গোরান শিশুটিকে দেখলে হয়তো মেরে ফেলবেন। গোরান মৃত নারীর পায়ের দিকে কামুক দৃষ্টিতে তাকান এবং তারা আসার আগে কেউ নারীটিকে ধর্ষণের পর খুন করেছে, এ ভেবে তিনি আফসোসও করেন। গোরান এ সময় রোজকে জড়িয়ে বৃদ্ধ নারী সম্পর্কেও নানাধরনের অশ্লীল মন্তব্য করতে থাকেন। আবার ২৩ মিনিট সাত সেকেন্ডে গোরান ও রোজ দুই জন মুসলিম পুরুষ ও নারীকে বন্দি বিনিময়ের জন্য নিয়ে যান; যাদেরকে সার্ব সৈন্যরা কারাগারে আটকে রেখেছিলো। মুসলিম ওই নারীকে আটক অবস্থায় একাধিকবার ধর্ষণ করার কথা রোজের কাছে দম্ভ নিয়ে বলেন গোরান। কারণ হিসেবে গোরান এও বলেনওই নারীর বাবার অধীনে তার (গোরানের) বাবা কাজ করতো; কঠোর পরিশ্রম করলেও তার বাবাকে ন্যায্য পারিশ্রমিক দেননি ওই নারীর বাবা। এর প্রতিশোধ হিসেবে ওই নারীকে তিনি একাধিকবার ধর্ষণ করেছেন! এটা শুনে গোরানের উদ্দেশে রোজ বলেন, ‘তার মানে মুসলমানরাও নিশ্চয় তোমাদের নারীদের সঙ্গে এমন আচরণ করছে।’ গোরান জবাবে বলেন, ‘আমাদের মেয়েরা খুবই ভালো, তাদেরকে স্পর্শ করার আগেই তারা নিজেদেরকে শেষ করে দেবে!’

গৃহযুদ্ধ কিংবা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ঘটে যাওয়া এক ‘সাধারণ’ ঘটনার নাম ধর্ষণ। ভারতীয় উপমহাদেশে ৪৭-এ দেশভাগের সময় যখন দাঙ্গা হয়, তখনো এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। হিন্দু ও মুসলমান উভয়ই তাদের দীর্ঘদিনের আবাসভূমি ছেড়ে অন্য দেশে উদ্বাস্তু হয়। যারা কোনোভাবেই স্বজাতির ডাকে সাড়া দিয়ে আপন ধর্ম অধ্যুষিত দেশে যেতে পারেনি, তাদেরকে ভোগ করতে হয়েছে চরম দুর্ভোগ। এই সময় বিধর্মীদের বাড়িতে লুট, আগুন দেওয়া ও ধর্ষণ করা হয়ে উঠেছিলো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। মনজিত নামে পাকিস্তানের এক নারী দেশভাগের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘তার দাদা সকালে বেরোবার সময় তার হাতে একটা ছোটো বিষের পুরিয়া ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, সঙ্গে রাখ। গুণ্ডারা এলে সঙ্গে সঙ্গে খেয়ে ফেলবি। খবরদার, ওদের হাতে পড়িস না।’২ তারপর থেকে মনজিত সেটা সবসময় সঙ্গে রাখতেন। আর ভাবতেন বিপদের সময় সাহস করে এটা খেতে পারবেন তো।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় দাদা ঘরে থেকে বোনকে রক্ষা করার দায়িত্ব নেননি; বাইরে গিয়ে লুটপাট, আগুন দেওয়া, ধর্ষণ করাকে অনেক বেশি পুরুষোচিত মনে করেছে! মনজিতের দাদা যেমন ঘরে থেকে বোনকে রক্ষার দায়িত্ব নেননি, তেমনই ভেরার বাবা কিংবা ভাইও সেটা করেননি। তারাও হয়তো মনজিতের ভাইয়ের মতো অন্য কোথাও লুট, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদিতে ব্যস্ত ছিলেন। আর এ কারণেই তারা ভেরাকে রক্ষা করতে পারেনি। আবার মনজিতের দাদার মতো গোরানও চান তাদের মেয়েদের শরীর অন্য পুরুষ স্পর্শ করার আগে তারা যেনো নিজেদের শেষ করে দেয়। মনজিত যেমন ভাবতেন, তিনি সময় মতো বিষ খেতে পারবেন কি না; ঠিক তেমনই ধর্ষণের আগে ও পরে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ভেরাও সফল হননিসে কথা স্বীকারও করেন ভেরা।

যখন ভেরা তার পরিবারের কাছে ফিরে যান, তখন ভেরার বাবা বলেন, ‘এ ঘটনার আগে তোমার নিজেকে শেষ করে দেওয়া উচিত ছিলো।’ ভেরার উত্তর‘অনেকবার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি।’ আসলে এই না পারার কারণেই ভেরাদের মেনে নিতে পারে না পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রও। খেয়াল করলে দেখা যায়, বসনিয়া যুদ্ধ কিংবা উপমহাদেশের দেশভাগ উভয় ক্ষেত্রেই পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি ধর্মীয় সম্মানও নির্ভর করেছিলো নারী শরীরের ওপর। পুরুষেরা ধর্ষণ, লুট, খুন করলেও সম্মান নষ্ট হয়নি! পুরুষত্বের এতো অবাধ ক্ষমতা হাতে পেয়েও নির্মাতা পিটার সেটা ব্যবহার করবেন না, সেটা হয়!

২২ মিনিট চার সেকেন্ডে রোজের বন্ধু পিটার এক কিশোরীর ছোড়া বোমায় নিহত হন। মুসলিম এই মেয়েটি যখন তাদের জন্য নির্ধারিত সীমানা পার হচ্ছিলো, তখন তাকে গুলি করবে কি নাপিটারের কাছে জানতে চান রোজ। পিটার তাকে গুলি করতে নিষেধ করেন। কারণ তার দিকে এগিয়ে আসা আগন্তুক একজন নারী! সে নারীশিশু হলেও তাকে দেখে কামুক হওয়ার মতো যথেষ্ট শারীরিক বৈশিষ্ট্য তার ছিলো! আসলে নারী মানেই পুরুষের চোখে ভোগ কিংবা লালসার বস্তু। তাই তাদের হাতে অস্ত্র বা বোমা থাকতে পারেএটা হয়তো পিটার ভাবতেই পারেননি।

সেভিয়র জুড়ে যেখানেই নারীকে দেখানো হয়েছে, সেখানেই কোনো না কোনোভাবে তাকে হেয় বা নিচু করা হয়েছে। অথচ এই চলচ্চিত্রটির পরিচালক-প্রযোজকের রাষ্ট্র সারা পৃথিবীতে গলা উঁচু করে বলে বেড়ান নারীর সমঅধিকার ও বৈষম্যহীনতার কথা। কিন্তু চলচ্চিত্র জুড়ে কোথাও তার লেশমাত্র দেখা যায় না!

ঘৃণা ও কুসংস্কারে পূর্ণ দেশপ্রেম

কীভাবে মুসলমানরা সার্বদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, হত্যা করছে, সেভিয়র-এর এক ঘণ্টা চার মিনিটে তা দেখানো হয়। এর আগে ধর্ষিত সার্বিয় নারী ভেরার বিনিময়ে মুসলিম বন্দি বিনিময়ের ঘটনা দেখানো হয়। অন্যদিকে এক ঘণ্টা ২০ মিনিটে দেখা যায়, ক্রোটদের ক্ষমতার জন্য সার্ব ও মুসলমানদের নির্মমভাবে হত্যার দৃশ্য। সার্ব ও মুসলমান নারী-পুরুষকে যখন ক্রোট সৈন্যরা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে, তখন তাদের কমান্ডার পরম স্বস্তির সঙ্গে মুখে ক্ষুর-কাঁচি চালান। বসনিয়ায় মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ১৭ শতাংশ ক্রোট। কিন্তু সীমান্তবর্তী শহরের রাস্তাঘাট, নদী সবই তাদের দখলে। সার্বদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে অংশ নেওয়া রোজ যখন শিশুটিকে নিয়ে স্প্লিট (বসনিয়ার সীমান্তবর্তী ক্রোয়েশিয়ার একটি শহর) যাওয়ার জন্য বাসে ওঠেন, তখন তার কাছে টাকা না থাকায় বাসচালককে তার ছেলের একমাত্র স্মৃতি সোনার চেইনটা পর্যন্ত দিয়ে দিতে হয়। বাসচালক যেহেতু একজন ক্রোট সেহেতু এই যুদ্ধের বাজারেও তার কাছে মানুষের জীবনের চেয়ে সোনার চেইন গুরুত্বপূর্ণ। এদেরও হয়তো দেশপ্রেম আছে, কিন্তু সেই দেশপ্রেম ঘৃণায় পরিপূর্ণ। তারা দেশের মাটির চেয়ে মানুষকে ভালোবাসতে পারেনি। তাই সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশের ভূখণ্ডকে কতোটা নিজেদের দখলে আনা যায়, তাই নিয়েই তারা একে অন্যকে নিশ্চিহ্ন করার অভিযানে নামে।

সেভিয়র দেখলে মনে হতে পারে, বসনিয়া যুদ্ধে মুসলমানরা সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বসনিয়াতে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকলেও তাদেরকে উৎখাত করার জন্য সার্বরা মরিয়া হয়ে ওঠে। সার্বরা ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রোর সহায়তায় হাজার হাজার মুসলমান নারী-পুরুষকে হত্যা ও ধর্ষণ করে। মুসলমানরা শুধু নিজেদের আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছিলো। কারণ তাদের তেমন কোনো অস্ত্রই ছিলো না।  জাতিসংঘ কর্তৃক যুগোস্লাভিয়ার ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা থাকায় বসনিয় মুসলমানদের আত্মরক্ষারও সুযোগ ছিলো না। অন্যদিকে জাতিসংঘের পাঠানো শান্তিরক্ষী বাহিনীর ডাচ সৈন্যরাও তাদের রক্ষা করতে পারেনি। বরং তাদেরকেই জিম্মি কিংবা অসহায় বানিয়ে বসনিয় শরণার্থী শিবির থেকে মুসলমানদের নিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

আবার চলচ্চিত্রে সংখ্যালঘু ক্রোটদের যে নৃশংসতা ও হিংস্রতা দেখানো হয়, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। একটা সংখ্যালঘু জাতি কী করে প্রতিনিধিত্বশীল দুই জাতির মানুষকে হত্যা করে! এমনকি দেশের রাস্তাঘাট, নদী সবই তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে, কোনো বিদেশি শক্তির সাহায্য ছাড়াই! পুরো চলচ্চিত্রে পদে পদে দেখানো ও বোঝানো হয়েছে গৃহযুদ্ধে অংশ নেওয়া তিন জাতি-ই খারাপ, কিন্তু এর মধ্যে সার্বরা তুলনামূলক কম খারাপ!  সার্ব যেহেতু কম খারাপ, সে কারণে সব সাহায্য সহযোগিতা পায় সার্বরা। তবে সার্ব সৈন্যদের মধ্যে গোরানকে একটু বেশি খারাপভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। মজার বিষয় হলো, সার্ব সৈন্য গোরান সেখানেই খারাপ, যেখানে রোজকে ভালো দেখানো প্রয়োজন। আসলে যুদ্ধের ওই পরিস্থিতিতে গোরান যদি খারাপ না হয়, রোজ ত্রাতা হবেন কী করে?

উত্তরের চেয়ে প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ

সেভিয়র-এর নয় মিনিট ৫০ সেকেন্ডে একটি ঘরে আটক একদল কালো চামড়ার মানুষকে (সম্ভবত আফ্রিকার কোনো দেশে) পাহারা দিতে দেখা যায় রোজ ও পিটারকে। বন্দিদের সঙ্গে থাকা কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের ডেকে তারা চুইংগাম দেন। কিন্তু পিটার ও রোজের কথোপকথন ও অভিব্যক্তিতে বোঝা যায়, ওই কৃষ্ণাঙ্গদের অনেক বেশি ভয়ঙ্কর ও বিপজ্জনক হিসেবে দেখেন তারা। তাদের কথায় বোঝা যায়, সাদা চামড়ার মানুষ হয়েও তারা দীর্ঘ ছয় বছর ধরে কালো চামড়ার ওই মানুষদের দেখভাল করছে, আর কতো? তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে থাকেন, এই কাজ তারা কখনোই করতেন না, যদি এখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর তাদের নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা থাকতো। এই বিশেষ দল (ফ্রান্স ফরেন লিজন) ছেড়ে গেলে হত্যার দায়ে তাদের জেলে যেতে হবে। এখান থেকে বের হওয়ার জন্য তাই রোজ ও পিটার একটা যুদ্ধ প্রত্যাশা করতে থাকেন, অন্তত সেখানে গিয়ে তারা এই একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পাবেন।

অবশেষে তাদের সেই সুযোগ আসে বসনিয়া যুদ্ধে। এই যুদ্ধে রোজ মুসলমানদের হত্যা করতে পারবে ভেবে আনন্দিত হলেও পিটার ফিরে যেতে চান সাধারণ জীবনে, যেখানে তিনি অন্তত মুদি দোকান করে জীবন ধারণ করবেন। স্ত্রী-পুত্রের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে রোজ যুদ্ধে থেকে যেতে চান মুসলমানদের নিঃশেষ করতে। তিনি এদেরকে শেষ না করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবেন না। অথচ গোরান ও রোজ যখন মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায়  অভিযানে যান, তখন রোজের আচরণে তাকে সহিংস মনে হয় না; বরং মাঝে মাঝে তিনি গোরানকে সহিংস আচরণ থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে তো রোজ সবকিছুর ঊর্ধ্বে মানুষকে রক্ষার ব্রত নেন। আমেরিকান সেনা, ফ্রান্সের বিশেষ দলের সদস্য রোজের তো তা-ই করার কথা, মুসলমানদের হামলায় তার পরিবারের সবাই নিহত হলেও! কারণ সাদা চামড়ার এই মানুষগুলো তো কখনোই মানুষের অমঙ্গল কামনা করতে পারে না। তারা শেষ পর্যন্ত ‘ত্রাতা’ হয়েই হাজির থাকেন। উপরিতলে তারা যদি এই আচরণ না করেন, তাহলে ভিতরে ভিতরে সারা পৃথিবীর নানা প্রান্তে যুদ্ধের দামামা বাজাবে কীভাবে?

‘বৃথাই ওগো কেঁদে আমার

কাটলো যামিনী’

সেভিয়র-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র রোজ মসজিদে নামাজরত মুসলিম কিংবা বসনিয়া যুদ্ধে একজন নিরস্ত্র কিশোরকে হত্যা করলেও শেষ পর্যন্ত তাকে হত্যাকারী মনে হয় না! কারণ ভেরার জীবন রক্ষার চেষ্টা এবং তার সন্তানকে রক্ষা করে রোজকে নির্মাতা পিটার পর্দায় এমন উচ্চতায় নিয়ে যান, তাকে হত্যাকারী হিসেবে মনে করার কোনো অবকাশ-ই থাকে না। এ কারণে তাকে ধরেই চলচ্চিত্রের নাম হয় ঝধারড়ৎ, ‘রক্ষাকারী’; হন্তারক নয়। রোজ একজনকে রক্ষার বিপরীতে যেসব মানুষকে হত্যা করেছে তা বেমালুম ভুলে গেছে দর্শক। পশ্চিমাদের চেহারা কিন্তু এমনইএক ৯/১১’তে তিন হাজার মানুষ নিহতের খেসারত দিতে হচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষকে জীবন দিয়ে।

কিন্তু প্রশ্ন সেখানে নয়। প্রশ্ন হলো, বসনিয়া যুদ্ধের যেসব ইতিহাস পাওয়া যায়, তার সঙ্গে এই চলচ্চিত্রের এতো অমিল কেনো? যুক্তরাষ্ট্র কিছুদিন আগে জাতিসংঘে বসনিয়ার যুদ্ধকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব তোলে। যদিও সেই প্রস্তাব রাশিয়ার ভেটোতে বাতিলও হয়ে যায়। আবার ইতিহাস এটাও সাক্ষ্য দেয় যে, বসনিয়ার যুদ্ধের বিষয়টি প্রথমে ন্যাটো অবহেলা করলেও একসময় তাদের হস্তক্ষেপেই এ যুদ্ধ বন্ধ হয়। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপও ছিলো। কিন্তু সেই দেশেরই একজন পরিচালক কেনো বসনিয়ার এ গণহত্যাকে এভাবে উপস্থাপন করলেন? বাতাসে ভাসমান পাতা যদি কখনো পথ পরিবর্তন করে, তাহলে সেটা আকস্মিক মানা যায়। কিন্তু কোনো উড়ন্ত পক্ষী যদি তার পথ পরিবর্তন করে, তবে তাকে পরিকল্পনাই বলা হয়। ঠিক তেমনই মার্কিনিরা প্রকাশ্যে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাকে সাহায্যের উদারতা দেখালেও, গোপনে মার্কিন নাগরিকের সার্বদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করার মতো সত্য লুকিয়ে রাখা যায় না।

ফুল যদি কখনো ঈশ্বরের চরণে সমর্পিত না হয়ে নর্তকীর কবরীতে স্থান পায়, তাতে ঈশ্বরের অপমান হয় না; তা ফুলেরই দুর্ভাগ্য বটে। মনে পড়ে সক্রেটিসের কথা, যিনি বলেছিলেন, কোনো মানুষের যদি সাধন করার মতো মহৎ কার্য থাকে, তাহলে তার সম্মুখে প্রশ্ন, জীবন কিংবা মৃত্যু নয়। তার বিবেচনার একমাত্র বিষয় হওয়া আবশ্যক, আপন কার্য সাধনে সে কোথাও অন্যায় কিংবা অবিচারের আশ্রয় গ্রহণ করলো কি না।

লেখক : তাসনিয়া মিন্নি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী

tasniyaminniru@gmail.com

তথ্যসূত্র

১. https://tinyurl.com/4b3vnjhn; retrieved on 12.04.2016

২. দাস, বীণা (১৯৯৮ : ১৮৩-১৮৪); ‘হিংসা, দেশান্তর ও ব্যক্তিগত কণ্ঠস্বর’; নিম্নবর্গের ইতিহাস; সম্পাদনা : গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়; আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।

৩. এই তথ্যগুলো Srebrenica: A Cry from the Grave নামের প্রামাণ্যচিত্র থেকে নেওয়া। প্রামাণ্যচিত্রটি দেখতে এই লিঙ্কে যেতে পারেন : https://www.youtube.com/watch?v=Fliw801iX84; retrieved on 07.06.2016

৪. https://tinyurl.com/5yu2c3xr; retrieved on 19.03.2016


এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন