Magic Lanthon

               

জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

নির্বাসিত : গল্পটা দেশ ছাড়ার নয়, ফেরার আকুতির

জাহাঙ্গীর আলম

 

কড়চা-১ : কলকাতা থেকে লেখক হঠাৎই বিতাড়িত। রাজস্থান, দিল্লি হয়ে সুইডেনে আশ্রয় নেওয়া। নির্বাসিত লেখকের অনিশ্চিত জীবন; একাকিত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম; পোষা বিড়ালকে কাছে পাওয়ার তীব্র আকাক্সক্ষা। একই সঙ্গে অপেক্ষার প্রহরগুলো কেবলই দীর্ঘায়িত হওয়া।

কড়চা-২ : যেনোতেনো বিড়াল নয়। ভেরি ইম্পর্টেন্ট ক্যাটভি আই সি। নাম তার বাঘিনি। সে যাবে বিদেশে, লেখক মায়ের কাছে। পাসপোর্টের জন্য ছবি তুলতে হচ্ছে, দিতে হচ্ছে আঙুলের ছাপ। তাকে নিয়ে সভা করছে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা। শেষ পর্যন্ত অসুস্থ হয়ে তার বিদেশ গমন যায় আটকে।


অভিনয়শিল্পী চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায় নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র নির্বাসিত (২০১৪) এক লেখক ও তার বিড়ালকে নিয়ে আবর্তিত হয়েছে। চলচ্চিত্রের শুরুতে নির্মাতার বয়ানে জানা যায়, এর বিষয়বস্তু বিড়াল মিনু ও তার মায়ের মধ্যকার সম্পর্ক। গল্পের শুরুতে দেখা যায়, সন্ত্রস্ত ও সহিংস এক নগরীর চিত্র। শোনা যায়, ধর্মের শত্রু, কলকাতা ছাড়ো স্লোগান। তখন নারীকণ্ঠে সংলাপতোমরা লেখককে লিখতে দিতে চাইছো না, ভাবতে দিতে চাইছো না, বাঁচতে দিতে চাইছো না ...। স্লোগান ও লেখকের কথায় ইঙ্গিত পাওয়া যায় মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ধর্মের মুখোমুখি অবস্থানের।


লেখক ও তার বিড়ালকে নিয়ে গল্প এগোতে থাকে। মিনু চলচ্চিত্রে নাম ধারণ করে বাঘিনি। তবে লেখকের নাম অনুচ্চারিত। চরিত্রটি সম্বোধিত হয়েছে কখনো ম্যাডাম, কখনো আপনি, উনি, ওর বলে। বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিন সম্পর্কে যারা খোঁজখবর রাখেন, তারা হয়তো জানেন তার পোষা বিড়ালের নাম মিনু। এ তথ্য না জানলেও সমস্যা নেই। লেখক চরিত্রে চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়ের গেটআপ, ছোটো চুল, থেমে থেমে কথা বলা তসলিমার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

তসলিমাকে নিয়ে চলচ্চিত্র-নির্মাণ হলেও তার নাম উচ্চারিত হয়নি কেনো? এ বিষয়ে নির্মাতার ব্যাখ্যাকেননা তসলিমাকে নিয়ে আমি বিতর্ক সৃষ্টি করতে চাইনি। তসলিমাকে বিক্রি করা আমার উদ্দেশ্য নয়। এটা তসলিমার জীবনী বা বায়োপিকও নয়। এটা নিছকই এক সম্পর্কের কাহিনী। কিন্তু লেখককে কোন পরিস্থিতিতে, কাদের কারণে নির্বাসিত হতে হলো চলচ্চিত্রে সেটা পরিষ্কার করে দেখানো হয়নি। তবে যেখানে লেখালেখিটাই অপরাধ; যার কারণে লেখককে নির্বাসিত হতে হয়; সেখানে বিতর্ক এড়াতে কোনো কিছু বাদ দিলে নির্মাতাকে নিশ্চয় দোষ দেওয়া যায় না। 

ঠিক কমেডি নয়, স্যাটায়ার ঘরানার সঙ্গে নাটকীয়তার মিশেলে নির্বাসিতর কাহিনি এগিয়েছে। পাসপোর্টের জন্য বিড়ালের ছবি তোলা, দুরন্ত বাঘিনির ছবি তুলতে ব্যর্থ হওয়ায় ফটোগ্রাফারের আয় না বোকাচোদা সংলাপ, পায়ের ছাপ নেওয়া, পুলিশি তদন্তের স্বার্থে গায়ের দাগ দূর করার জন্য গোসলবিদ্রূপাত্মক বিষয়গুলো তুলে ধরেছে। মন্ত্রী-আমলাদের ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো সবদিক ব্যালান্স করে চলার কায়দা; সব দায় অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার বিষয়গুলো হাস্যরসের মাধ্যমে উঠে এসেছে। 

গণমাধ্যমও কম যায় না। তাকে খবর বিক্রি করতে হবে। বিতর্কিত লেখক নেই তো কী হয়েছে, লেখকের পোষা বিড়াল তো আছে! তার ছবি-গল্পই এখন সংবাদের বিষয়। এছাড়া লেখিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও সংশ্লিষ্টরাও আছে। তাদের সাক্ষাৎকারের চাহিদাও আছে। নির্বাসিত লেখকের বন্ধুর বউ শায়ন্তীর কাছে সাংবাদিকের প্রশ্ন—‘যুগ যুগ ধরে পুরুষ নারীকে ধর্ষণ করে এসেছে, আপনার কি মনে হয় না পুরুষ ওর লেখাতেই ধর্ষিত হচ্ছে? তবে জবাবটাও মোক্ষম দেন বন্ধুর বউআপনি হয়তো ওর সব লেখা পড়েননি।

যাদের সহিংসতার কারণে তসলিমা নির্বাসিত, দেশে ফিরতে পারেন না, তারা সবাই কি তার লেখা পড়েছেন? লেখকের বিরোধিতাকারীরা যদি তার একটি করে বইও পড়েন, তাহলে এ ডিজিটাল যুগে অন্তত পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার বাহবা পেতেন তসলিমা! 

নির্বাসিত লেখককে নিয়ে তার বন্ধুর অফিসের সহকর্মীদের কথোপকথন এমন 

জনৈক সহকর্মী ১ : ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বললে আমিও কিন্তু মানতে পারতাম না গুরু।

জনৈক সহকর্মী ২ : তাহলে মানুষ মার, ধর্মের নামে পুড়িয়ে দে পুরো দেশ।

জনৈক সহকর্মী ৩ : ... শুধু ধর্ম নয়, ওর আত্মজীবনী! পড়েছিস? নির্লজ্জ। এভাবে লিখতে পারলে বুঝি নারী জাগরণ হয়? তোমার অন্দরমহলের কীর্তিকলাপ কে জানতে চায়?

জনৈক সহকর্মী ২ : কেনো তুমি? তাইতো পড়েছো। আর পড়ে শুধু কীর্তিকলাপই মনে রেখেছো, স্যাড!

প্রিয় পাঠক, আপনি তসলিমা নাসরিনের কোনো বই পড়েছেন কি? পড়ে থাকলে কি মনে রেখেছেন? একবার মনে করার চেষ্টা করুন। কিংবা চেষ্টা না করেই কী মনে পড়লো? যদি কীর্তিকলাপই মনে পড়ে, তাহলে ভেরি ভেরি স্যাড!

আবার এটা শুধু ওর বিড়াল নয়, ইটস দ্যাট ওম্যানএ সংলাপও শায়ন্তীর। তিনি মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে, উচ্চশিক্ষিত, বিদ্যালয়ের শিক্ষক। সাংবাদিকের প্রশ্নের মুখে তিনি ভীষণ ফরমাল; তবে বাড়িতে অগ্নিশর্মা। নির্বাসিত লেখকের লেখা নিয়ে তার ইতিবাচক মনোভাব থাকলেও স্বামীর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব কোনোভাবেই তিনি মেনে নিতে পারেননি। লেখক কলকাতা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পরও বিড়ালের প্রতি শায়ন্তীর তাই হয়তো এ মারমুখী অবস্থান। এক নারী অন্য নারীর ভালো দেখতে পারে না, মেয়েরা মেয়েদের শত্রুএমন প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গিই যেনো এ চরিত্রের মূলভাব। 

তসলিমা নাসরিন গত শতকের ৯০-এর দশকে বাংলাদেশে বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখে আলোচনায় আসেন। বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়ন নিয়ে উপন্যাস লজ্জা প্রকাশের পর মৌলবাদীদের হুমকি ও ব্যাপক হইচইয়ের মধ্যে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে দেশত্যাগে বাধ্য হন তিনি। ধর্ম সম্পর্কে তার মন্তব্য, লেখালেখি এবং আত্মজীবনী প্রকাশের মাধ্যমে তিনি এর পর নানা সময় বিতর্কের কেন্দ্রে থেকেছেন।


বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তসলিমা জানান, সমাজে নারীর বৈষম্য তুলে ধরতেই তার লেখালেখির শুরু। পুরুষতান্ত্রিকতার দোষসমূহ তার লেখায় বেশ স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছে। সবার চোখে আঙুল দিয়ে তা তিনি দেখিয়েও দিয়েছেন। কিন্তু সেই দোষগুলো কীভাবে সংশোধন হবে, সেটা দেখানোর প্রজ্ঞা তার মধ্যে দেখা যায়নি। মানুষ হিসেবে নারীর পরিপূর্ণ অধিকারের দাবির নাম যদি নারীবাদ হয়, তবে তসলিমার দর্শন হচ্ছে পুরুষ কর্তৃত্বপরায়ণ, তাই নারীদেরও কর্তৃত্বপরায়ণ হতে হবে। নারীর শরীর ভোগ করে পুরুষ, তাই নারীকেও পুরুষের শরীর ভোগ করতে হবে। এটাকে নারীবাদ না বলে প্রতিশোধবাদ বলাই ভালো। নারীবাদ মানে পুরুষকে অনুকরণ নয়, বরঞ্চ পুরুষ আধিপত্য থেকে বেরিয়ে আসা, স্বাধীন-স্বাবলম্বী হওয়া। নারীবাদ নারীদের আন্দোলন নয়, নারীদের জন্য আন্দোলন, নারী-পুরুষ সাম্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলনযেখানে সমাজের সব শ্রেণি-পেশা-লিঙ্গের মানুষ অংশ নেন।

চিন্তার বিষয় হলো, ধর্ম ও পুরুষতন্ত্রের ওপর তসলিমা যতোটা খড়গহস্ত, ব্যক্তি জীবনের পুরুষদের নিয়ে লেখালেখিতে তিনি যতোটা আগ্রহী, ঠিক ততোধিক অনাগ্রহী রাষ্ট্রযন্ত্র, পুঁজিবাদ ও করপোরেট আধিপত্য নিয়ে। ভোগবাদের রাজনীতি, নারীকে পণ্য করে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া, রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মীয় রাজনীতির বিস্তার নিয়ে তার লেখায় প্রতিফলন কম। নির্বাসিতয় এগুলোর কোনোটাই আসেনি, এমনকি তার ইঙ্গিতও পাওয়া যায় না। অবশ্য এগুলো থাকার কথাও হয়তো ছিলো না। কারণ নির্মাতা আগেই কবুল করে নিয়েছেনএটা মিনু ও তার মায়ের সত্য কাহিনি; যেখানে তিনি তুলে ধরেছেন কলকাতা থেকে বিতাড়িত লেখক ও তার পোষা বিড়ালের সাময়িক বিচ্ছেদ; সেই সময়ে তাদের মানসিক অবস্থা, একাকিত্বের যন্ত্রণা।

এদিকে নির্বাসিত লেখকের প্রশ্ন—‘আমি কি কোনো অন্যায় করেছি; আত্মজীবনী লেখাটা কি অপরাধনিশ্চয় নয়। অবসরপ্রাপ্ত আমলা, সামরিক কর্মকর্তা, অধ্যাপক, খেলোয়াড়, চলচ্চিত্র তারকা অনেকেই আত্মজীবনী লিখেছেন, লিখছেন। জীবনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা কি প্রকাশ করা সম্ভব? অনেকে স্বীকার করেন, সেটা হয়তো সম্ভব নয়। তাদের অনেকে অবশ্য স্মৃতিকথা লেখেন। অতীতের কোনো ভুল বা অপরাধের কথা প্রকাশ পেলে নিজের, পরিবারের, বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনের সম্মানহানির আশঙ্কা থাকে। কিংবা সত্য কথা প্রকাশ পেলে হয়রানিরও ভয় থাকে। তবে এমনও দেখা গেছে, অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু বিতর্কিত বিষয় তুলে ধরেন, যাতে আত্মজীবনীর প্রচার ও কাটতি বাড়াতে সহায়ক হয়। কিন্তু বন্ধুর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা, বিশেষত বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কের তথ্য, তার গোপনীয়তা লঙ্ঘন করছে কি না সে সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয়। যৌন হয়রানির মতো গুরুতর অভিযোগ প্রকাশে নিজের দৃঢ় নৈতিক অবস্থানের প্রয়োজন হয়। তসলিমার আত্মজীবনীতে এসব বিষয় বাছবিচার ছাড়াই এসেছে। পরিণামে এক সময়কার বন্ধুরা পরিণত হয়েছে শত্রুতে। তবে চলচ্চিত্রে লেখকের আত্মজীবনী লেখা নিয়ে সামান্য আলোচনা থাকলেও ধর্মের বিরুদ্ধে তিনি কেনো লেখেন তা জানা যায় না!

তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশে ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে কথা বললে পশ্চিম থেকে বেশ বাহবা মেলে। মুসলিম সন্ত্রাসবাদের বিশ্বায়নের কালে পরিস্থিতি আরো রমরমা। ভিন্ন মত প্রকাশ করে, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লিখে, নাস্তিক উপাধি নিয়ে ব্লগাররা যেনো আনন্দ চিত্তে দেশ ত্যাগ করছেন! ধনীরা সম্পদ ও অর্থ পাচার করে অন্য দেশে নিজের ও বংশধরদের নিশ্চিত ভবিষ্যৎ নির্মাণে ব্যস্ত। দেশের যারা ভবিষ্যৎ সেই মেধাবী শিক্ষার্থীদের কেবল অপেক্ষা, কখন দেশ ছাড়বেন! অন্যরাও বিদেশ যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর, যদিও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তারা যেতে পারছেন না।

তাহলে লেখকরূপী তসলিমা কেনো দেশে ফিরে আসতে চান? তিনি তো সহজেই নাগরিকত্ব নিয়ে পশ্চিমের কোনো রাষ্ট্রে থাকতে পারেন। চলচ্চিত্রে এর কিছুটা ব্যাখ্যা আছে। তিনি লেখালেখি করতে চান। তিনি বাংলাদেশে থাকতে চান, বাংলাভাষীদের সঙ্গ চান। ফলে নির্বাসিত কেবল বিড়ালের সঙ্গে লেখকের বিচ্ছেদের রসায়নের মধ্যে আটকে থাকেনি; জন্মভূমি ও মাতৃভাষার সঙ্গে মিলিত হওয়ার সংগ্রাম এটিকে অনন্যতা দিয়েছে।

 

লেখক : জাহাঙ্গীর আলম, প্রথম আলো পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসেবে কর্মরত।

alam_rumc05@yahoo.com

তথ্যসূত্র

১.তসলিমাকে নিয়ে সিনেমা; প্রথম আলো, ৩০ অক্টোবর ২০১৪।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন