যুবরাজ শামীম
প্রকাশিত ০৮ জুলাই ২০২৫ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
প্রথম পর্ব.
'এমন একটা সিনেমা বানাতে চাইছি যেটাতে কোনো খরচ হবে না’
যুবরাজ শামীম

নির্মাতা যুবরাজ শামীম-এর প্রথম চলচ্চিত্র আদিম। ২০২২ খ্রিস্টাব্দে ৪৪তম মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সিলভার সেন্ট জর্জ অ্যাওয়ার্ড এবং নেটপ্যাক জুরি অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয় চলচ্চিত্রটি। এর বাইরে বিশ্বের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসবেও এটা প্রদর্শন হয়। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই থেকে আদিম নির্মাণের প্রস্তুতি শুরু করেন যুবরাজ। এর পর গণঅর্থায়নের জন্য তিনি ফেইসবুকে শেয়ার বিক্রি করেন। সেখান থেকে কিছু অর্থ জোগাড় হলে ২০১৮-তে চলচ্চিত্রটির শুটিং শুরু হয়। গাজীপুরের টঙ্গী রেলস্টেশনের পাশে ব্যাংকের মাঠ বস্তির মানুষের গল্প অবলম্বনে নির্মাণ হয় আদিম। অভিনয়শিল্পীদের কেউ-ই পেশাদার নন, বেশিরভাগই ওই বস্তির বাসিন্দা। খানিকটা ভিন্ন চিন্তায়, ভিন্নভাবে চলচ্চিত্র ও তার নির্মাণ প্রক্রিয়াকে দেখেন যুবরাজ। তার বেড়ে ওঠা গাজীপুরেই। জন্ম ১৫ অগ্রহায়ণ। তড়িৎ প্রকৌশলে পড়ালেখা করা যুবরাজ বর্তমানে নতুন এক চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ করছেন। সে উদ্দেশে গাজীপুরে এক বিলের পাড়ে ঘর বেঁধেছেন তিনি। জায়গাটির নাম তিনি দিয়েছেন ‘যুবরাজের দরবার শরীফ’।
গত ৯ নভেম্বর ২০২৪ ‘যুবরাজের দরবার শরীফ’-এ তার চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রযাপন নিয়ে ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’-এর পক্ষে দীর্ঘ আলাপ করেন মইনুল ইসলাম। আলাপের প্রথম পর্ব ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’-এর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আমি তো আপনাকে ফিল্মমেকার হিসেবেই চিনি। কিন্তু বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে আপনি যেটা বলেন, আপনি ফিল্মমেকার না! আপনার এটা কেনো মনে হয়?
যুবরাজ শামীম : আমি মোটেও ফিল্মমেকার না। ধরেন, মির্জা গালিব’কে আপনি কী বলবেন? কবি বলবেন? তিনি শুধু শের লিখে গেছেন? কিংবা তিনি শের লিখেছেন বলেই আমরা তাকে কবি বলবো? তাহলে আপনি লালনকে কী বলবেন, গীতিকার? লালনের ভাব প্রকাশ পেয়েছে তার গানের মধ্য দিয়ে। মির্জা গালিবের ভাব প্রকাশ পেয়েছে তার কবিতার মধ্য দিয়ে। জালাল উদ্দিন রুমি’র ভাব প্রকাশ পেয়েছে তার কবিতার মধ্য দিয়ে। আমি কবিতা ভালো লিখতে পারি না। আমার কবিতা হয় না। কিন্তু আমার সিনেমা হয়। তারা যেমন নিজেদের ইনকোয়ারি করেছে, খোদাকে ইনকোয়ারি করেছে বা যাইহোক, কিছু একটা ইনকোয়ারি করছে। তারা ইনকোয়ারার। আমিও তা-ই। এর বাইরে কিছু না। এই যে আমার লাইফস্টাইল দেখছেন আপনি। এখানে এসেছেন, দেখছেন এই লাইফস্টাইলটা। আমি কেনো সবকিছু বাদ দিয়ে [এভাবে জীবনযাপন করছি]। আমার বাসা তো এখান থেকে খুব বেশি দূরে না। টঙ্গীতে আমার নিজের বাড়ি, থাকার জায়গা বাবার সূত্রে পেয়েছি। খাওয়ার সমস্যা নেই। সবকিছু ঠিকঠাক। কিন্তু আমি এখানে যখন থাকি, তখন আমার পেটে ২৪ ঘণ্টাই ক্ষুধা থাকে। আমি এই ক্ষুধা নিয়ে ঘুরি। আমার ভালো লাগে। ক্ষুধা বলতে কী? খাবার। পুরোটা খাবার খেতে পারি না। মানে পুরো খাবার খাওয়ার টাকা নাই। আমি সেই টাকাটা ম্যানেজ করছি না। মানে ইচ্ছা করেই ম্যানেজ করি না। বাসায় গেলেই পেট ভরে খেতে পারি। কিন্তু বাসায় তো যাচ্ছি না। যখন আমি এখানে থাকি, তখন ধরেন আমি চিড়া খাচ্ছি, এটা সেটা খাচ্ছি, পেটে ক্ষুধা নিয়ে ঘুরছি। ক্ষুধা নিয়ে ঘুরতে আমার ভালো লাগে। আমি চয়েজ করেছি এই লাইফ। কিন্তু আমি অভাবী না। আমার কাছে টাকা নাই, কিন্তু আমি পুওর না। আমি রিচম্যান। আমার কাছে টাকা নাই; কিন্তু রিয়েলি আমি রিচম্যান। মানে আমার লাইফস্টাইল—এমনই আমার চয়েজ। সেই জায়গা থেকে আমি ফিল্মমেকার হিসেবে নিজেকে কনসিডার করি না। আপনারা আমাকে আদিম দিয়ে বিচার করতে পারেন। আদিম দেখেছেন বা হাজত? আদিম-এর সঙ্গে এটার অনেকটা মিল আছে। কিন্তু আমাকে লোকজন বুঝতে পারবে—অবশ্য বোঝারও দরকার নাই। তবে আমি নিজেকে অনেকটা খুঁজে পেয়েছি অতল থেকে। এবং আমার জার্নি শুরু হয়েছে অতল থেকে। সামনে হাজত আসবে; আবার নাও আসতে পারে।
যাইহোক, আদিম নিয়েই কথা বলি। আদিম বড়োজোর একটা স্টুডেন্ট ফিল্ম হয়েছে বলতে পারেন। একটা মানুষ, সে জাস্ট বানানো শিখছে। এর আগে আমি শর্টফিল্ম বানিয়েছি। তবে আদিম একটা প্রসেস। যেটা বানাতে গিয়ে আমি বুঝেছি, আমি ফিচার ফিল্ম বানাতে পারি। এর আগে আমি বুঝতাম না। এবং জাস্ট শিখছি। কিন্তু আদিম তো আমি না। কিংবা আদিম আমি ওই সময়টায়, যখন আমি শুরু করেছি ২০১৮ সালে। কিন্তু এই সময়ে আমি তো আর আদিম না। আমি তো চেঞ্জ হচ্ছি। এবং আদিম বা হাজত থেকে আমি অনেক আগেই বের হয়ে গেছি। আমি অলওয়েজ কিংবা আদিম করার সময়ও গল্প খুঁজছি—আশপাশে কী ঘটছে। ধরেন, আদিম করার সময় আমি রেললাইনে বসে আছি। মানুষ দেখছি। তখন মনে হলো ওদের নিয়েও গল্প বলা যায়। বস্তিতে থাকা শুরু করেছি। এখন আমার পরের সিনেমা বিলে। তার মানে এই নয় যে, বিলের গল্পের জন্য আমি এইখানে থাকছি। আমি গ্রামে থাকছি এই গল্প চয়েজ করার আগে থেকেই। আমার ভালো লাগে। তবে এখানে থাকার কারণে মাথায় বিলের গল্পটা এসেছে। আমি গল্পটা লিখছি।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আচ্ছা, তাহলে আদিম নিয়ে আরেকটু কথা বলি। আদিম-এর গল্পে বেশিরভাগ সময় দেখা যায় মাদক, অপরাধ। এই প্রসঙ্গেই অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। আপনি কি মনে করেন মানুষের প্রবৃত্তিতে প্রধানত এই দুটোই কাজ করে?
যুবরাজ : দেখেন, আদিম-এর বেসিকটা কেমন ছিলো সেটা আপনাকে তাহলে বলি। আদিম-এর এডিটিং হয়েছে উপন্যাসের মতো। একটা উপন্যাস শুরু হলো এভাবে যে, এমন একটা এলাকা, এলাকার বর্ণনা দিচ্ছি এই এই এই ... । এলাকার মধ্যে এই এই ঘটছে। নায়ক এসে হাজির। আপনি খেয়াল করে দেখবেন, আদিম-এর এডিটিং প্যাটার্নটা অন্যান্য ফিল্মের মতো না। আমি আসলে ওভাবে ভাবিও নাই। আমি আসলে উপন্যাসের মতো করে ভেবেছি। একটা বর্ণনা দেখাচ্ছি। এলাকার বর্ণনা শেষ। তার পর মূল গল্প শুরু করেছি। আমি এইভাবে ভেবেছি। সেই জায়গা থেকে দেখিয়েছি, এই জায়গার অবস্থা কী। তার পর আমি ক্যারেক্টারগুলো ঢুকিয়েছি। কিন্তু আদিম-এর মূল ফোকাস হলো মানুষের গল্প বলা; বস্তির গল্প বলা নয়, আবার ক্রাইমের গল্প বলাও না।
আদিম চলচ্চিত্রের পোস্টার, ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনার চোখে মানুষের প্রবৃত্তি কি এটাই?
যুবরাজ : মানুষের বেসিক প্রবৃত্তি কী? আমি মানে আমিত্বের যে ব্যাপারটা। আমি’র জায়গা আমাকে বা নিজেকে প্রাধান্য দেওয়া নয় কি? নিজেকে প্রাধান্য দিতে যা যা করা লাগে মানুষ তো তা-ই করে। আমি’র মধ্যে তো আপনি নাই।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনি এর আগে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’-এর কথা উল্লেখ করেছেন। আমি জানতে চাচ্ছিলাম, ‘প্রাগৈতিহাসিক’-এর কোন চরিত্র কীভাবে, কতোটা আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছে?
যুবরাজ : দেখেন, আমি বলেছি সেটা ঠিক। কিন্তু সিনেমাটা দেখার পরে আপনার কী মনে হয়েছে? ব্যাপারটা হয়েছে কী—আমি ‘প্রাগৈতিহাসিক’-এর কথা বলেছি—‘প্রাগৈতিহাসিক’ পড়ার পর ভিখু চরিত্রটা আমার মধ্যে একটা প্রভাব ফেলে, সে একটা জায়গা তৈরি করেছিলো। আমি একবার নারায়ণগঞ্জ গিয়েছি—আমি প্রায়ই নারায়ণগঞ্জ যেতাম আর কি—স্টেশনে তখন আমি একটা ক্যারেক্টার দেখি। গল্পের শুরুটা হয় এভাবে। আমি ট্রেনে বসে ওই লোকটাকে দেখছিলাম। লোকটার সঙ্গে সেকেন্ড টাইম আমার আর কখনো দেখা হয় নাই। বা দেখা হলেও আমি কখনো খেয়াল করি নাই। কিন্তু তাকে দেখে আমার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভিখুর মতো মনে হয়েছে। ধরেন, লোকটা কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কাউন্টারের সামনে সাধারণত মানুষ টিকিট কাটতে এলে দুই-পাঁচ টাকা থাকলে ভিক্ষুককে দেয়। কিন্তু ওইখানে ভিক্ষুকটা একা ছিলো। আশপাশে আর কোনো ভিক্ষুক ছিলো না। আমি বুঝতে পারছি ও আসলে আশপাশে কাউকে দাঁড়াতে দেয় নাই। কারণ আমি টঙ্গীতে এ রকম দেখেছি—ভিক্ষুকদের একে অন্যের মধ্যে অনেক দ্বন্দ্ব আছে। এবং আমরা যতোটা নির্মোহভাবে, অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাদের দেখি, ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়। তাদের লাইফের স্ট্রাগল অন্যরকম। এবং সেটাই আদিম-এ এসেছে।
ওই ভিক্ষুককে দেখার পর আমার মনে প্রশ্ন এলো, লোকটা কোন শক্তিবলে এখানে কাউকে দাঁড়াতে দেয় না। কিছুক্ষণ পর যখন আমাদের ট্রেনের হুইসেল বাজলো, দেখলাম কাউন্টারের সামনে যে প্লেট লাগানো থাকে—পরবর্তী ট্রেন ৯টা ২০; এর পরবর্তী ট্রেন ১০টা ২০—ওই লোকটা ওই প্লেটটা ঘুরিয়ে দিচ্ছে। বুঝতে পারছেন বিষয়টা। ট্রেন ছাড়া মাত্রই ও লাফ দিয়ে ট্রেনের শিডিউলটা চেঞ্জ করে দিলো। ট্রেন ছাড়ার শিডিউল চেঞ্জ করার দায়িত্ব কার? কাউন্টারের কারো। এটা তো ওর কাজ না। তারপরও ও সেটা করে। তার মানে ও ফুটফরমায়েশ খেটে দেয়। এবং এর মধ্যে দিয়ে ও একটা ক্ষমতা পেয়েছে। যে শক্তিতে ও কাউকে আশপাশে দাঁড়াতে দেয় নাই। এগুলো আদিম-এর প্রথম স্ক্রিপ্টে ছিলো। আমি শ্যুট করার আগে বাদ দিয়েছি। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় নাই। তাই ঝামেলা কমিয়েছি। আমার কাছে মনে হয়েছে এতো কিছুর দরকার নাই।
এর কয়েকদিন পর আমি আবারও নারায়ণগঞ্জ বা অন্য কোথাও যাচ্ছি। এক শীতের সকালে এয়ারপোর্ট স্টেশনে আমি দেখি এক লোক খালি গায়ে কুয়াশার মধ্যে বাচ্চা কোলে দাঁড়িয়ে আছে। তখন সাতটা কি সাড়ে সাতটা বাজে। লোকটাকে দেখে ভাবলাম, তার ওয়াইফ কি চলে গেছে? লোকটা খুব মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একদম নির্বিকার। তখন আমার মনে হলো, নারায়ণগঞ্জে যে লোকটাকে দেখেছি, তার সঙ্গে কি এর কোনো মিল আছে? মানুষের মধ্যে তো ইমাজিনেশন কাজ করে। সেই জায়গা থেকে আমি কানেকশন খোঁজার চেষ্টা করলাম। এভাবে ভাবতে ভাবতে একটা গল্প দাঁড়িয়ে গেছে। যে গল্প লিখেছিলাম সেটার মধ্যে এসব ছিলো। এবং এই গল্পে ভালো প্রভাব ছিলো ‘প্রাগৈতিহাসিক’-এর। কিন্তু আমি যখন বস্তিতে থাকা শুরু করলাম; দেখলাম, আমার ইমাজিনেশন ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন নেই। দেখলাম, বস্তিতে থাকা মানুষের জীবনের লেয়ার অনেকগুলো। আমি যে চোখে তাদের দেখি বা যে গল্প-উপন্যাসের চোখে দেখি, এর ফলে তাদের জীবনের লেয়ারগুলো আমার কাছে ধরা দিতে থাকলো। এমনকি বস্তিতে থাকার পর আমার স্ক্রিপ্টে আমূল পরিবর্তন এসেছে। অনেকবার আমাকে চেঞ্জ করতে হয়েছে।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনি যে ট্রেনের বিষয়টা বলছিলেন। আপনার সিনেমায় অনেকবার ট্রেনের দৃশ্য দেখা গেছে। আমি যদি ভুল না করে থাকি, সাধারণত এমন শট্ ঘটনা-সময়-কাল বোঝাতে সাহায্য করে। আর যদি ট্রেনের দৃশ্যের আধিক্য নিয়ে ভাবি, তাহলে পুনরাবৃত্তি কেনো করেছেন?
যুবরাজ : ট্রেন এবং সিগারেট। সিনেমা এডিট করতে গিয়ে আমার কাছে রিলিফের জায়গা মনে হয়েছে ট্রেন। এটা আমার স্বাচ্ছন্দ্য বলতে পারেন। মন খারাপ থাকলে আমি রেললাইনে বসে থাকতাম। ট্রেন দেখতাম। এই যে ট্রেনের চলে যাওয়া, এটা আমাকে রিলিফ দিতো। চলন্ত ট্রেন আমাকে বরাবরই রিলিফ দেয়। আদিম-এ এমন দৃশ্য ব্যবহার করেছি আমার রিলিফের জন্যই। ধরেন, অনেক জটিলতা যাচ্ছে, এর মধ্য থেকে রিলিফ পেলাম। এটা একটা কারণ। আবার একটা ক্যাওয়াজ যাচ্ছে, ঝামেলা চলছে, সেখানে ট্রেনের চলে যাওয়া দেখিয়ে আমি রিলিফ দিলাম। কিংবা একটা সময় পার করছি, তখনো দেখিয়েছি। তবে একটা মূল কারণ হলো, এই মানুষগুলোর সঙ্গে ট্রেন, ট্রেনের সাউন্ড তো অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। তবে তারা জানেও না যে ট্রেন চলছে। আপনার আমার কানে শব্দ এলেই বলে উঠি, এই ট্রেন যায় নাকি! অথচ ওনাদের বাড়ির পাশ দিয়ে সারাদিন ট্রেন গেলেও ওরা জানেই না। সারাক্ষণ ট্রেন গেলেও বিষয়টা তাদের মাথায় নাই। মূলত আমার রিলিফ এবং ওনাদের জীবনে ট্রেনের সম্পর্কের কারণেই ট্রেনের ব্যবহার।
আর সিগারেটের ব্যাপারটা নিয়ে আপনি প্রশ্ন করেছেন কিনা জানি না। তবে সিগারেটের ক্ষেত্রেও আমি একই বিষয় দেখেছি। একেকজনের রিলিফের জায়গা তো একেক রকম। কেউ গান শোনে, কেউ মসজিদে যায় আবার কেউ নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকে। কেউ সিগারেট ধরায়। আমার যে ক্যারেক্টার পছন্দ হয়েছে, আমি তাকে দেখেছি, ঝগড়ার পর সিগারেট ধরায়; সুখে আছে সিগারেট ধরায়; ভালো লাগছে না সিগারেট ধরায়; ঝগড়া-তর্ক শুরু হয়েছে, মাঝে বলেন আর শেষে সিগারেট ধরাবেই। সেই জায়গা থেকেই সিগারেটের ব্যবহার বলতে পারেন।
ম্যাজিক লণ্ঠন : তাহলে আপনি কি শুধুই রিলিফের জন্য এসব সিম্বল ব্যবহার করেন?
যুবরাজ : রিলিফ তো আছেই। এছাড়াও আনকনসাসলি আমার মধ্যে ট্রেনের প্রতি এক ধরনের প্রেম তৈরি হয়েছে। আরেকটা কারণ হলো, ওদের জীবনের সঙ্গে তো ট্রেন জড়িয়ে আছে।
ম্যাজিক লণ্ঠন : সিনেমার বিষয়বস্তু দর্শকের কাছে গভীরভাবে তুলে ধরতে আবহসঙ্গীতের গুরুত্ব রয়েছে। অথচ আমরা আদিম-এ দেখি, আপনি খালি গলায় কিছু গান ছাড়া তেমন কিছুই ব্যবহার করেননি। বরং অ্যাম্বিয়েন্স সাউন্ড প্রধান করে তুলেছেন। কোন চিন্তা থেকে আপনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?
যুবরাজ : আপনি যখন কথা বলছিলেন, একটা মুরগি ডেকেছে। আপনি কি শুনেছেন?
ম্যাজিক লণ্ঠন : হ্যাঁ।
যুবরাজ : আবার ডাকছে শোনেন। কতো সুন্দর শোনাচ্ছে! এর চেয়ে সুন্দর আবহসঙ্গীত আর কী হতে পারে? প্রকৃতির যে সাউন্ড আমার ইমোশনের জন্য সেটাই যথেষ্ট। যখন একটা মেয়ে মনে করে সে যথেষ্ট সুন্দর না, তখন সে মেকআপ নেয়। সে মনে করে তার গায়ের রঙ কালো এবং তার একটু ফরসা হওয়া উচিত। কিন্তু সে যদি মনে করে, আমি এতেই সুন্দর, ইটস ফাইন। আপনি তো ন্যাচারালি সুন্দর। তারপরও কোনো সন্দেহ থেকে আপনি যদি মেকআপ নেন, সেটা আপনার ঘাটতি প্রকাশ করবে। মেকআপ অবশ্যই সুন্দর, যদি অতিরিক্ত না হয়।
সিনেমার ক্ষেত্রে সঙ্গীতের ব্যবহার নিয়ে যদি বলি। আমার কাছে মনে হয়েছে, ওদের সঙ্গে যা ঘটছে, আর ওদের চারপাশে যা ঘটছে, ওদের ইমোশন ক্যারি করার জন্য সেটাই যথেষ্ট। এখানে আলাদাভাবে মেকআপের দরকার নাই। [সিনেমার ক্ষেত্রে] সঙ্গীতটা আমার কাছে ঠিক মেকআপ মনে হয়। যখন আমার ইমোশন বুঝতে পারছেন না, একটা বাঁশির সুর দিয়ে দিলেন। কিন্তু আমার ইমোশন বোঝানোর জন্য বাঁশির সুর প্রয়োজন মনে হয় নাই, তাহলে কেনো দিবো? আমি অবশ্যই সঙ্গীতের পক্ষে। কিন্তু এই ছবির ক্ষেত্রে আমার কাছে মনে হয়েছে, চারপাশের সাউন্ড-ই যথেষ্ট। আমি কখনোই অযাচিত, অহেতুক সঙ্গীতের পক্ষে না।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আরেকটি বিষয়ে একটু জানতে চাচ্ছিলাম। আপনি সিনেমা নির্মাণ করেছেন সাদাকালো। আবার কিছু জায়গায় পোশাকের রঙ দেখিয়েছেন। এই বৈপরীত্য ঠিক কেনো?
যুবরাজ : সিনেমাটা মেইনলি কালারে ছিলো। আমি এটা কালার করেছিও। কালার করার পরে আমি এটা কয়েকটা ফেস্টিভালে পাঠিয়েছি। কিন্তু কালারটা আমার পছন্দ হচ্ছিলো না। আমার কাছে মনে হচ্ছিলো, এই ছবির সঙ্গে কালারটা যাচ্ছে না। এবং ছবিটার কী কালার হওয়া উচিত আমি সেটাও বুঝতে পারছিলাম না। সেই সময়ে জামান [মোহাম্মদ নুরুজ্জামান] ভাইয়ের একটা ছবির এডিট চলছিলো—আম কাঁঠালের ছুটি। দেখলাম উনি সিনেমাটা সাদাকালো করছেন। মানে কালার স্যাচুরেশন কমিয়ে দিয়েছেন। ১০ পারসেন্ট বা ১৫ পারসেন্ট করেছেন। সেটা দেখে আমার মনে হয় আদিম-এ এমনটা হতে পারে। হালকা কালার থাকুক। যখন আমি নির্দিষ্ট কালার খুঁজে পাচ্ছিলাম না, তখন এটা করি। সেকেন্ডলি, আপনি যে কালার ব্যবহারের কথা বলছেন। সেটা আসলে স্বপ্নের দৃশ্য। এমন কালারফুল দৃশ্য মাত্র একটা আছে। সাধারণত মানুষ সাদাকালো স্বপ্ন দেখে। কিন্তু ওই ক্যারেক্টারটার স্বপ্ন আমার কাছে রঙিন মনে হয়েছে। সে কারণে আমি রঙিন করেছি।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আচ্ছা, আপনি সিনেমায় কীভাবে সিম্বল ব্যবহার করেন? সিম্বল নিয়ে চিন্তার জায়গাটা যদি আরেকটু বলতেন।
যুবরাজ : দেখেন আমি যাই করি, সেটা আমার ব্যক্তিজীবনের অবজারভেশন থেকে নেওয়া। একটা ঘটনা বলি আপনাকে; তখন একটা মেয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। একদিন আমি স্কুটি চালাচ্ছি, মেয়েটা পেছনে বসা। সেই সময় ওর সঙ্গে আমি একটা ঘটনা শেয়ার করতে চাচ্ছিলাম। যেটা শোনার পর মেয়েটা হয়তোবা আমার সঙ্গে সম্পর্ক নাও রাখতে পারে। কিন্তু আমার বলাও দরকার। সেকেন্ডলি, আমি যেহেতু ধরে রাখার মানুষ না, আমার ধরে রাখতে ভালোও লাগে না, তাই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম যে চলেও যেতে পারে। তবুও শেয়ার করা উচিত। বাইক চলতেছে। আমি ওকে ঘটনাটা বলছি। যেই মুহূর্তে আমি ঘটনার চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেলাম, তখন হুট করে আমার সামনে একটা কুকুর চলে আসলো। আমি ঠাস করে ব্রেক চাপলাম। পেছন থেকে ও আমার উপর গিয়ে পড়লো। সবকিছু স্তব্ধ। তখন ওর ইমোশন, ওর রিয়্যাকশন, এটা আসলে আলাদা করে আর দেখানোর দরকার পড়ে না! তারপর আমি আবারও স্কুটি স্টার্ট দিয়ে চলতে শুরু করলাম। এবং অনেকটা সময় আমরা কেউ কোনো কথা বলিনি। শুধু চলছিলাম। এটাই বোধহয় সিনেমা। ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন? আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা বলছি, সেটা বলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সামনে একটা কুকুর পড়ে, আমি ব্রেক করি এবং আমরা দুজন স্তব্ধ হয়ে যাই। একটা অ্যাক্সিডেন্ট হতে যাচ্ছিলো। তারপর আবার গাড়ি চলছিলো এবং আমরা কোনো কথা না বলে একসঙ্গে চলতে থাকি।
এখন যদি আমার কোনো সিনেমায় প্রেমিক-প্রেমিকার কোনো দৃশ্য শ্যুট করতে চাই, আমি এই জিনিসটা আনবো; ঠিক এইভাবে পোর্ট্রেট করবো। এর জন্য আলাদাভাবে কোনো রিয়্যাকশন, ইমোশন ব্যবহার করবো না। আর আপনি সিম্বলের যে ব্যাপারটা বললেন, আপনি কোন অর্থে আদিম-এর কথা বলছেন বুঝতে পারছি না। তবে আপনি বলার পর একটা সিম্বল মনে পড়েছে। একটা দৃশ্যে দেখবেন, একজন কুকুরকে খাওয়াচ্ছিলো। আরেকজন এসে লাথি মারে। এই দৃশ্যে, ও আসলে কেনো লাথি মারে? কারণ ও তো এক জায়গা থেকে মাইর খেয়ে এসেছে, ওর দলনেতা ওরে মাইর দিয়েছে; মাইর খাওয়ার কারণে ও ভালোবাসা দেখে বিরক্ত হচ্ছে। কুকুরকে খাওয়ানোর ভালোবাসা ও নিতে পারছে না। আসলে ও ওর লাইফে ভালোবাসাটা পায় নাই, যে কারণে ও কুকুরকে লাথি মারে। ব্যাপারটাকে আমি এভাবে চিন্তা করেছিলাম।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আমি যখন আদিম নিয়ে নিউজ করতাম, আমার কাছে বিষয়গুলো খুব সাদামাটা মনে হয়েছিলো। প্রথমে ভাবতাম হামযা [আমির হামযা, আদিম-এর সিনেমাটোগ্রাফার] কি এটা নিয়ে কথা বলতে পারবে? এরপর আপনার সঙ্গে কথা হওয়ার পর মনে হয়েছে হামযা তো এই ছবির খুব গুরুত্বপূর্ণ পারসন। তখন ভাবলাম, না হয় হামযা থাকুক, আপনার সঙ্গে সরাসরি কথা বলি।
যুবরাজ : আদিম-এর টেকনিকাল বিষয়গুলো কীভাবে মোকাবিলা করা হয়েছে হামযা সেটা নিয়ে ভালো বলতে পারবে। আরেকটি বিষয় আপনাকে ক্লিয়ার করি। আদিম থেকে আমি বের হয়ে গেছি। আদিম-এর ব্যাপারটা আমার মাথায় নাই। এখন তো আমি অন্য জার্নিতে আছি। যার কারণে আপনি যখন আদিম নিয়ে প্রশ্ন করছেন, আমার রিকল করতে হচ্ছে। যদিও আমার স্মৃতিশক্তি অতোটা ভালো না। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমি কি আদিম বানিয়েছি?
ম্যাজিক লণ্ঠন : আদিম-এর বেশিরভাগ চরিত্রই স্থানীয়। তাদের পক্ষে ক্যামেরার সামনে অভিনয় করাটা নিশ্চয় কঠিন ছিলো। ফিচার ফিল্ম হওয়ার পরও দর্শক হিসেবে কখনো কখনো মনে হয়েছে, এটা একটা ডকুমেন্টারি। দর্শকের এই অনুভূতিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
যুবরাজ : সিনেমাটা বানানোর সময় আমি চিন্তা করেছি, মানুষকে একটা এক্সপেরিয়েন্স দিই। আর আর্ট নিজেও এক্সপেরিয়েন্স। একটা পেইন্টিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আপনার একরকম অনুভূতি হবে, আরেকজনের আরেক ধরনের। ধরেন ভ্যান গঘ-এর একটা পেইন্টিংয়ের সামনে তিনজন দাঁড়ালাম। দেখবেন, আমাদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি হবে। আমি আদতে যে এক্সপেরিয়েন্সের মধ্য দিয়ে গিয়েছি, তার সঙ্গে মানুষকে কানেক্ট করতে চেয়েছি।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আদিম-এর অভিনয়শিল্পীরা তো একেবারে অপেশাদার। তাদের বাছাইয়ে কি কোনো ধরনের কর্মশালা, ব্রিফিং বা অন্য কোনো উপায়ের মধ্য দিয়ে গেছেন? মানে আদিম বানানোর প্রক্রিয়া কেমন ছিলো? আপনার গল্পটা ওদের বোঝালেন কীভাবে? অনেকে তো স্ক্রিপ্ট পড়তেও জানে না।
যুবরাজ : আদিম-এর স্ক্রিপ্ট তো আমি লিখি নাই। এর স্ক্রিপ্ট তারাই লিখে দিয়েছে। রাইটার হিসেবে আমার নাম যাচ্ছে। কিন্তু স্ক্রিপ্ট মূলত তারাই লিখেছে। কারণ তাদের সঙ্গে প্রত্যেকটা সিন নিয়ে আমি গল্প করেছি। দুলাল ভাই, বাদশা ভাই, সোহাগী আপা; ওদের সবার সঙ্গে আমি বসেছি। যার সঙ্গে যে সিন, আমরা তাকে সঙ্গে নিয়ে বসে গল্প করেছি। এই রকম একটা অবস্থা, তো এখানে আপনি কী করবেন বা কী বলবেন? আমরা এভাবে কথাবার্তা বলে একেকটা সিন সাজিয়েছি।
ম্যাজিক লণ্ঠন : তাহলে কি স্ক্রিপ্ট ছিলো না?
যুবরাজ : অবশ্যই স্ক্রিপ্ট ছিলো। কিন্তু আমি স্ক্রিপ্টের ডায়ালগগুলো ওনাদের ওপর ইমপোজ করিনি। আমি সিনগুলো করার আগে তাদের বলেছি, এই হলো সিন, কী করা যায়, কী করবেন, কী ডায়ালগ দেবেন, দেখেন আপনি। আমরা ওদের সঙ্গে নিয়ে হ্যান্ডিক্যাম দিয়ে ছবিটার অনেক অংশ আগে ডামি শ্যুট করেছি। আপনি যে ক্যারেক্টার দেখছেন, শুরুতে তো এই ক্যারেক্টার ছিলো না। অনেক ক্যারেক্টার চেঞ্জ হয়েছে। ডামি শ্যুট করার আগে ওদের সঙ্গে কথা বলেছি। এই যে দৃশ্য, এখানে কী কী ডায়ালগ হতে পারে। আপনি এরে কী বলবেন? ও বলে, আমি এটা বলবো। এভাবে বলে নিয়ে আমরা শ্যুট করেছি। ফলে ডায়ালগগুলো ওনাদের মধ্য থেকে এসেছে। আমি শুধু খেয়াল করেছি, আমি যে ভাবটা প্রকাশ করতে চাই, ওদের ডায়ালগে সেই ভাবটা বের হয়ে যাচ্ছে কিনা। না হলে, তখন আমি বোঝাতাম। ভাই কথাটা এভাবে না বলে কী একটু এভাবে বলবেন। মানে তারা যেনো আমার ভাবের মধ্যে থাকে, আমার গল্পের ফ্লো’র মধ্যে থাকে। পয়েন্টটা বুঝতে পেরেছেন? ওরা ওদের মতো কথাবার্তা বলে ডায়ালগ সাজাতো। যখন দেখতাম ওরা গল্পের ভাব থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, তখন বলতাম, না না এভাবে না, একটু এইভাবে বলেন। গল্পের ভাবটা যেনো চেঞ্জ না হয়।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনি বলছিলেন, বস্তিতে বসবাস করলে স্বাভাবিকের চেয়ে নেতিবাচক দিকগুলো বেশি চোখে পড়ে। বস্তি নিয়ে গবেষণার স্বার্থে আপনি প্রায় সাত মাস বস্তিতেই থেকেছেন; সিনেমা বানানোর জন্য। সেই সময়টাতে আপনার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ নিয়ে যদি আরেকটু বলতেন।
যুবরাজ : আসলে আমি যখন বস্তিতে থাকা শুরু করি, প্রথম কয়েকদিন আমি ঘরে বোতল নিয়ে ঘুমাতাম। কারণ আমার বাইরে বের হতে ভয় লাগতো। এতো পরিমাণে মারামারি, ঝগড়া, ছিনতাইয়ের ঘটনা শুনতাম; আমার পাশে শাকিল নামে একটা ছেলে ছিলো, ও চার-পাঁচজন নিয়ে থাকতো, ও ছিনতাই করতো এবং প্রতিরাতে ওর ঘরে ঝগড়া হতো। প্রতিরাতেই ওদের ঘরে পুলিশ আসতো, ওদের মারধর করতো, ওরা চিল্লাচিল্লি করতো। আমি বোতল নিয়ে ঘুমাতাম কারণ আমার বাইরে গিয়ে প্রস্রাব করতে ভয় করতো। তাই বোতলেই করতাম। এতো কঠিন সিচুয়েশন ছিলো। প্রথম কয়েকদিন খুব ঝামেলা হয় মানুষজনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে। ওরাও সন্দেহ করতে থাকে। কিন্তু কিছু বলতে পারছিলো না।
ধরেন, আমি চায়ের দোকানে বসে আছি। ওরা ভাবছে, ওদের ওখান থেকে কিছু নিয়ে যাবো কিনা; গল্পটল্প লিখবো, ওদের জানাবো কিনা। ওদের কোনো তথ্য হয়তো ফাঁস করে দেবো। ধীরে ধীরে মিশতে মিশতে দেখলাম, ওখানে সাধারণ মানুষই বেশি। একটা সময় আমি ওদের কাছাকাছি মিশে দেখেছি, বস্তিতে সাধারণ মানুষের সংখ্যাই বেশি। যারা এসব ব্যবসার সঙ্গে জড়িত না। এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্ক এমন হয়ে গেলো যে, ওদের অনেকেই আমাকে উদ্ধারকর্তা ভাবতে শুরু করে। একটা কথা আছে না, ডুবতে যাওয়া মানুষ খড়কুটা ধরে বাঁচতে চায়। ওদের তো আর ডরভয় নাই। ওরা সহজেই আমার সঙ্গে মিশতে থাকে। আবার যারা অবৈধ ব্যবসা করে, তারাও এসে মিশেছে। তবে তারা ঝামেলাও করেছে। এবং আমি ওখানে থাকতে শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই পুলিশের এক ইনফরমার আমাকে ধরিয়ে দেয়, আমি নাকি নেশাটেশা করি। তবে পুলিশ আমাকে ধরার পর ঘরে সার্চ করে কিছু পায়নি। সঙ্গের একটা ছেলের কাছে অবশ্য গাঁজা খাওয়ার সরঞ্জাম পেয়েছিলো। সেটা অবশ্য অন্য সময়ের ঘটনা। কিন্তু আমাকে যখন ধরে তখন কিছুই পায় নাই। আর পাওয়ার কথাও না। তার পরও কিছু না বলেই আমাকে ধরেছে। পরে আমি বুঝি যে ওই ইনফরমার ধরিয়ে দিয়েছে।
এই যে ওরা আমাকে ধরিয়ে দিলো, আবার ওরাই কিন্তু বাঁচিয়েছে। খালেক চাচা নামে একজন ছিলেন—পরে মারা গেছেন—ওনাকে আমি এক কাপ চা খাইয়েছিলাম বোধহয়। অনেক মানুষ আছে যাদের অনেক কিছু লাগে না, এক কাপ চা খাওয়ালে খুশি। আমি তার সঙ্গে বসে চা খেয়েছি, সেটা ওনার কাছে অনেক কিছু। কারণ ওরা তো আমাদের অন্য চোখে দেখে। আমরা ওনাদের ভালো চোখে দেখি না, গরিব চোখে দেখি, এটা ওনারাও জানে। ওই খালেক চাচা প্রথম সাক্ষী দিয়েছেন। পুলিশ যখন আমাকে গাড়িতে তুলবে, তখন উনি গিয়ে বলেন, এই লোক কখনো সিগারেটও খায় না। আমরা কখনো কিছু খেতে দেখিনি। ইনি ভালো লোক। তখন আরো কয়েকজন সায় দিয়েছে। আমাকে যখন পুলিশ গাড়িতে তুলতে যাচ্ছে, আমার তখন আক্ষরিক অর্থেই ভয় লাগছিলো, কান্না পাচ্ছিলো। কারণ এই ধরনের সিচুয়েশন তো আমার জন্য নতুন। আমি সিক্স কি সেভেনে পড়ার সময় আমার ভাই একটা ছেলের সঙ্গে মারামারি করেছিলো। সেই লোক ভাইয়ের সঙ্গে আমার নামেও মামলা করেছিলো। ওই সময়ে পুলিশ আমাকে গাড়িতে করে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। আমি খুব কান্নাকাটি করেছিলাম। সেটা ছোটোবেলার কথা। তবে বড়োবেলার সিচুয়েশনটা আরো খারাপ ছিলো। আমি বার বার ভাবছিলাম, এখানে আর আমার শ্যুট করা হবে না, কারণ মা আমাকে বস্তিতে থাকতে দেবেন না। এমনি আমার পরিবারের সবাই এসব করতে দিতে চাচ্ছিলো না। পরে খালেক চাচাসহ আরো কয়েকজন একরকম পুলিশের কাছ থেকে আমাকে ছিনতাই করেছে। জোর করে বলেছে, না এই লোককে নিতে পারবেন না। এগুলো বস্তির ঘটনা। আপনারা যেমন নেগেটিভলি দেখেন, আমি দেখেছি এভাবে। নেগেটিভ ঘটনা অনেক আছে। অহরহ ঘটছে। কিন্তু সাধারণ মানুষও আছে।
সেন্সরবোর্ড কিন্তু আমাদের এই সিনেমাটা আটকে দিয়েছিলো, কারণ তাদের কথা ছিলো, এই যে এখানে এতো মাদক, অপরাধ, বার বার সিগারেট খাওয়া দেখাচ্ছি অথচ পুলিশ নাই কেনো! আমি তখন তাদের বলেছিলাম, দেখেন আমি নিজে দেখেছি যারা অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাদের কাছ থেকে পুলিশ সপ্তাহে সপ্তাহে ২,০০০ টাকা করে খায়। আমি নিজের চোখে দেখেছি। তাহলে আমি কি এই সিনটা দেখাতে পারবো সিনেমার মধ্যে? আপনারা যদি পুলিশ আনতেই বলেন, তাহলে এই অংশটাও আমি দেখাতে চাই। সেক্ষেত্রে তো আপনারা সেন্সর দেবেন না। আমি তাদেরকে আরো একটা কথা বলেছিলাম, রাশিয়ার লোকজন আদিম-এর যে ভার্সনটা দেখেছে, আমি বাংলাদেশের মানুষকে সেটাই দেখাতে চাই। এ রকম নানা কথাবার্তা তাদের সঙ্গে আমার হয়েছিলো। তবে শেষ পর্যন্ত সেন্সর পেয়েছি।
একটা দৃশ্য মনে আছে কিনা, ওরা দুইজন ঘরে বসে গাঁজা বানাচ্ছিলো—বাদশা নামে যে ল্যাংড়া ও বলছিলো, আমার অতো লাভের দরকার নাই। দুই-চারটা বেচলাম, আমার খরচের টাকাটা হইলেই হইলো আরকি। মানে ও যে গাঁজা খায়, সেই খরচের টাকা। তখন কালা বলে, তুমি তো ভালোই আছো। আমার তো সপ্তাহে সপ্তাহে ২,০০০ টাকা করে দিতে হয়। না দিলে পরের সপ্তাহে এসে ধরে নিয়ে যায়। এই যে সপ্তাহে সপ্তাহে ২,০০০ টাকা দিতে হয়, কাকে দিতে হয়? পুলিশকে দিতে হয়। এটা আমার লাইফে দেখা। এই সিনগুলো আমরা খুব সতর্কতার সঙ্গে শ্যুট করেছি। সেই সময় পুলিশ এসে আমাদের হাজতে ভরতে পারতো।
আমরা এতোগুলো গাঁজার পোটলা নিয়ে শ্যুট করেছি, যা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো। পুলিশের তো সেই সময় তুমুল দাপট, পুরো আওয়ামী লীগের পুলিশ। এতো ঝুঁকি নিয়ে শ্যুট করেছি! এই আলোচনাগুলো আপনি রাখবেন। এই আলোচনাগুলো উঠে আসুক। এই আলোচনাগুলো কোথাও নাই, শুটিং কতোটা কঠিন ছিলো! গাঁজার সিনের শ্যুট করার সময় আমি বাইরে একটা লোক পাহারায় রেখেছি, যাতে কেউ না দেখতে পায়। দুলাল ভাইয়ের প্রতি আমি সবসময় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, যিনি কালা চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তিনি আমার ওপর আস্থা রেখেছিলেন। কারণ বস্তির সবাই বলাবলি করেছিলো, ওদের ফাঁসিয়ে দেবো, প্রচুর নেগেটিভ কথাবার্তা। এখন এমন অবস্থা যে, আমি ওদের ওখানে নির্বাচন করলেও পাশ করে যাবো! ওরা আমাকে এতো পছন্দ করে! আবার অনেকে অপছন্দও করে। তারা বলছে, আমি বস্তির লোক। এটা অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পরে তারা বলেছে, বস্তির লোকজন দিয়ে আমি টাকা ইনকাম করেছি। এছাড়া ইয়াবার দৃশ্যগুলো শ্যুট করতেও খুব সতর্ক থাকতে হয়েছে। তার পরও এগুলো দেখানো প্রয়োজন মনে হয়েছে আমার কাছে।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনি গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইনডিপেনডেন্ট সিনেমার বিজয় হিসেবে ঘোষণা করেছেন আদিমকে। একজন তরুণ নির্মাতা হিসেবে ইনডিপেনডেন্ট সিনেমা নিয়ে আপনার মতামত কী?
যুবরাজ : দেখেন, এই সময়ে এসে আর্টিস্ট শব্দটা ব্যবহার করতে ভালো লাগে না। কেনো জানেন? একটা সময় মনে হতো, আমি ফিল্মমেকার না, আমি আর্টিস্ট। পরে একটা সময় মনে হলো, আদৌ কি আর্টিস্ট বলে কিছু আছে? এখন বোঝার স্বার্থে আমরা আর্টিস্ট শব্দটা ব্যবহার করছি। জানেন, পৃথিবীর প্রত্যেকটা পিওর আর্টিস্ট-ই স্বাধীন। আর সাক্ষাৎকারে আমি আদিম-এর বিজয় বলে ঘোষণা করেছি, এমনটা মনে পড়ছে না। কারণ আদিমকে এতো হাইলি উদ্যাপন করার কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না।
এখন আমাকে যারা বিচার করে, তাদের অনেকেই আদিম যেহেতু রিলিজ হয়েছে, সেটা দিয়েই বিচার করে। কিন্তু আমি আপনাকে বলছি, আমি আর আদিম-এর মধ্যে নাই। আমি আদিম থেকে বের হয়ে গেছি। কিন্তু আপনি যখন এতো দূর থেকে এসেছেন, যেই কথাগুলো আমি সবার সঙ্গে বলেছি, সেই একই কথা তো আমি আপনার সঙ্গে বলতে চাই না। আমি যেসব সাক্ষাৎকার দিয়েছি সেই সাক্ষাৎকারগুলো ঘাটলে আপনি অনেক প্রশ্নেরই উত্তর পেয়ে যাবেন। যদি একই কথাই আমি বলি, তাহলে আপনি কেনো আমার সাক্ষাৎকার নিবেন? আমি এমন কথাই বলতে চাই, যেই কথাগুলো কোথাও বলা হয় নাই। আমি এখন ফিল্ম দর্শন নিয়ে কথা বলতে চাই, আমি আমার জীবন নিয়ে কথা বলতে চাই। আমি চাই কীভাবে সহজভাবে সিনেমা বানানো যায়, সেটা নিয়ে কথা বলতে। এই জায়গাটার [নির্মাতা যুবরাজ বর্তমানে যেই জায়গায় থাকছেন] আমি নাম দিয়েছি দরবার শরীফ। কেনো এই নাম দিলাম আসলে? দরবার শরীফ কাদের হয়? পিরদের হয় দরবার শরীফ। আমি চাই আমি পির হবো। আমার কাছে মুরিদরা আসবে; আমার প্রতি তাদের প্রেম থাকবে। এখানে তারা আসবে সিনেমা বানিয়ে চলে যাবে। আমি চাই এখানে ক্যামেরা থাকবে, এডিটিং প্যানেল তো আছেই—সবকিছু থাকবে। যে প্রসেসে আমি সিনেমা বানিয়েছি, সেভাবেই এখন আমি অতল-এর গল্প নিয়ে সিনেমা বানাচ্ছি। অতল কী আসলে? কেনো এমন গল্প বেছে নেওয়া হলো? সেভাবে গল্পও না বলতে গেলে। আমি এমন একটা সিনেমা বানাতে চাইছি যেটাতে কোনো খরচ হবে না; খাতা-কলমের মতো। আমার কবিতা লেখার ভাব আসছে, একটা কলম আছে খাতা আছে, আমি সেটা লিখে ফেলবো। আমি এভাবেই সিনেমা বানাতে সবসময় চাইছি এবং সামনেও চাই।
(চলবে)
যুবরাজ শামীম
মইনুল ইসলাম, জাগোনিউজটুয়েন্টিফোরডটকম-এ প্রতিবেদক হিসেবে কর্মরত।
Moynulislam2071@gmail.com
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন