যুবরাজ শামীম
প্রকাশিত ২৫ জুন ২০২৫ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
‘আমি কোনো প্রকার জটিলতা ও চাপ নিয়ে সিনেমা বানাতে চাই না’
যুবরাজ শামীম

নির্মাতা যুবরাজ শামীম-এর প্রথম চলচ্চিত্র আদিম। ২০২২ খ্রিস্টাব্দে ৪৪তম মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সিলভার সেন্ট জর্জ অ্যাওয়ার্ড এবং নেটপ্যাক জুরি অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয় চলচ্চিত্রটি। এছাড়া আদিম ১০ম নেপাল হিউম্যান রাইটস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘বেস্ট ইন্টারন্যাশনাল ফিকশন’ ও নিউ ইয়র্কের ১২তম কুইন্স ওয়ার্ল্ড ফিল্ম ফেস্টিভালে ‘বেস্ট অব দ্য ফেস্ট’ অ্যাওয়ার্ড জিতেছে। এর বাইরে বিশ্বের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসবেও এটা প্রদর্শন হয়। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই থেকে আদিম নির্মাণের প্রস্তুতি শুরু করেন যুবরাজ। এর পর গণঅর্থায়নের জন্য তিনি ফেইসবুকে শেয়ার বিক্রি করেন। সেখান থেকে কিছু অর্থ জোগাড় হলে ২০১৮-তে চলচ্চিত্রটির শুটিং শুরু হয়। গাজীপুরের টঙ্গী রেলস্টেশনের পাশে ব্যাংকের মাঠ বস্তির মানুষের গল্প অবলম্বনে নির্মাণ হয় আদিম। অভিনয়শিল্পীদের কেউ-ই পেশাদার নন, বেশিরভাগই ওই বস্তির বাসিন্দা। খানিকটা ভিন্ন চিন্তায়, ভিন্নভাবে চলচ্চিত্র ও তার নির্মাণ প্রক্রিয়াকে দেখেন যুবরাজ। তার বেড়ে ওঠা গাজীপুরেই। জন্ম ১৫ অগ্রহায়ণ। তড়িৎ প্রকৌশলে পড়ালেখা করা যুবরাজ বর্তমানে নতুন এক চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ করছেন। সে উদ্দেশে গাজীপুরে এক বিলের পাড়ে ঘর বেঁধেছেন তিনি। জায়গাটির নাম তিনি দিয়েছেন ‘যুবরাজের দরবার শরীফ’।
গত ৯ নভেম্বর ২০২৪ ‘যুবরাজের দরবার শরীফ’-এ তার চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রযাপন নিয়ে ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’-এর পক্ষে দীর্ঘ আলাপ করেন মইনুল ইসলাম। আলাপের শেষ পর্ব ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’-এর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনি সিনেমার দর্শন নিয়ে কথা বলছিলেন। আচ্ছা, আপনার সিনেমা দর্শনের এই চর্চা অন্যদের জন্য কতোটা আরামদায়ক?
যুবরাজ শামীম : আমি সেই ওয়ে-তেই সিনেমা বানাই, যা আমার কাছে আরামদায়ক। আমি কোনো প্রকার জটিলতা ও চাপ নিয়ে সিনেমা বানাতে চাই না। এখন এটা কার জন্য আরামদায়ক, কার জন্য আরামদায়ক না, এসব আমার চিন্তার মধ্যেই নাই। আপনি তখন বলছিলেন না, দর্শক এভাবে নিচ্ছে আপনার সিনেমা—আপনি কীভাবে দেখেন বিষয়টাকে? দেখেন, দর্শক নিয়ে আমার কোনো চাপ নাই। তাহলে আমি সিনেমা কেনো বানাই? কারণ লাইফ ইজ সো বোরিং। এটা সাফারিং আর বিরক্তিকর! আজকে যে শিশুটা জন্ম নিয়েছে, সে জ¦র আর কাশি নিয়েই জন্মায়। পরে নিউমোনিয়ায় ভোগে, মানে জন্মের পর থেকেই সাফারিং শুরু। সিনেমাটা বানাই মূলত সাফারিং থেকে নিজেকে রেহাই দেওয়ার জন্য। যতোক্ষণ আমি সিনেমার সঙ্গে থাকি, ততোক্ষণ আমার মনে হয় আমি ঠিকঠাক আছি। এডিটিং প্যানেলে যে সময়টা থাকি, আমার মনে হয় সময়টা ভালো যাচ্ছে।
ফলে সিনেমা বিক্রি হবে কি হবে না, সেটা নিয়ে ভাবতে চাই না। তবে আমাদের এই অঞ্চলে সিনেমা বানাতে গেলে ভাবতে হয়। কারণ সিনেমা বানানো থেকে শুরু করে সবই নিজের করতে হয়, সেই অর্থে এখানে ডিস্ট্রিবিউশন বা পি আর টিম নাই। আর ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকারদের জন্য তো ডিস্ট্রিবিউশন রাস্তা আরো কঠিন। তার উপর সিনেমা নির্মাণের সঙ্গে টাকাপয়সার ব্যাপার আছে, সারভাইভাল ইস্যু আছে। তাই ভাবতেই হয়। কী আর করা! তবে আমি খুশি হতাম, সিনেমা বিক্রি নিয়ে যদি আমাকে ভাবতে না হতো।
এখন আমার কাছে যা মনে হয়েছে এবং এটাই সত্য, আমি যে সিনেমা বানাতে চাই; আমার যে সিনেমা সফর; তার জন্য তো প্রোডিউসার টাকা নিয়ে বসে নাই। কারণ দর্শক তা দেখবে না। এখানে কারো কোনো দায় নাই, কাউকে দোষারোপ করছি না। কারণ তারা বিজনেস বোঝে, দর্শক বোঝে। আমাকে তো চেনে না লোকজন, এটা স্বাভাবিক ব্যাপার, তাই না? যারা কমার্শিয়ালি ফিল্ম বানায় তাদেরকে সবাই জানবে, চিনবে। আমাকে সেভাবে কেউ চিনবে না, জানবেও না। এটা আমি জানি। কারণ আমার সিনেমা সেই পরিমাণ দর্শক দেখবে না। ফলে টাকাও আসবে না। তাই আমাকে অর্থনৈতিক টানাপড়েনের মধ্য দিয়েই যেতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। আর এ কারণে আমার বেঁচে থাকার পথটাও নিজের মতো করে সহজ করে নিয়েছি। আবার ভিন্নভাবে বলতে গেলে এটাই আমার জার্নি, আমি আর্টের জার্নির মধ্যেই আছি। আর ভেতরে যে আর্টের জন্ম হয় কিংবা যা আমি ফিল করি তাই সিনেমার মধ্য দিয়ে প্রকাশ ঘটে, সিনেমা আমার কাছে জাস্ট একটা টুলস্, নিজেকে এক্সপ্লোর করার টুলস্, এটা নিয়ে আলাদা কোনো ফেসিনেশন নাই। বরং ফিল্মমেকার পরিচয়ের জন্য নিজের ওপর মাঝে মাঝে মেজাজ খারাপ হয়।
অতল নিয়ে যেটা বলছিলাম, আমার কাছে মনে হয়েছে, একটা সিনেমা বানানো উচিত, কিন্তু সেটার খরচ কীভাবে মিনিমাম করা যায়। এমন একজন লোককে ক্যামেরা পারসন হিসেবে নিবো তিনি অভিনয়ও করবেন। আমি তাই করছি। আমার থেকে যদি ভালো কারো ফ্রেমিং সেন্স থাকে, আমি তো তার কাছেই যাবো। যে এক্সপোজার বোঝে, ফোকাস বোঝে, লাইট বোঝে— আমার এমন লোক দরকার। আমি তো ক্যামেরা অপারেট করতে পারি।
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, তুষার ভাই (নাঈম তুষার), অতল-এ যিনি সিনেমাটোগ্রাফি এবং অভিনয় দুটোই করেছেন, তিনিও একই মেন্টাল জার্নির মধ্যে ছিলেন। যে কারণে আমার কাজটা আরো সহজ হয়েছে। তিনি ক্যামেরার ফ্রেম ঠিক করে দিয়েছেন আর আমি কেবল অন-অফ করেছি। তিনি অভিনয় করেছেন। আমাদের প্রোডাকশন কস্ট বলতে শুধু স্কুটারের তেল আর চা-বিস্কুটের খরচ! কিন্তু আমার তো এমন বেশ কয়েকটা স্ক্রিপ্ট তৈরি আছে, যেগুলো বানাতে তুলনামূলক বেশি টাকা লাগবে, যা আমার কাছে নাই কিংবা ইনভেস্ট করার মতোও কেউ নাই। তাই বলে কী আমি বসে থাকবো! আমার হাতের কাছে যা আছে সেটা দিয়েই সিনেমা বানাতে শুরু করবো। হয়তো সামনে দেখবেন নিজের মোবাইল ফোনে নিজেই অভিনয় করে সিনেমা বানাচ্ছি! এটা হতেই পারে, যেহেতু সবকিছুই আমার, এডিটটাও নিজে করছি —এটাই তো বড়ো সুবিধা।
আদিম চলচ্চিত্রের পোস্টার, ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
একজন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকারের অবশ্যই এডিটিং শেখাটা অত্যন্ত জরুরি। আমি এডিটিংয়ের মতো সুখ আর কোথাও পাই না। যখন আমি এডিট করতে বসি আমার মনে হয় আমি কবিতা লিখতে বসেছি। অবশ্য আমি অন্যদের সিনেমা এডিট করতে চাই না। এডিটিংয়ে আমি ট্রু ক্রিয়েশনের মজা, আর্টের যে মজা, সেটা পাই। যে আমার কাছে সিনেমা করতে আসে, তাকে আমি বলি, এডিট করতে শেখো। এখন ইন্ডিপেন্ডেন্ট না হয়ে তো উপায় নাই। কারণ আপনি তো প্রোডিউসারের জন্য অপেক্ষা করছেন না, কিংবা কারো দারস্থ হলে তো আপনি ঠিকঠাক কাজটা করতে পারবেন না। আমার সঙ্গে তো কয়েকজনের কথা হয়েছিলো তারা গল্প সাজেস্ট করে, আর্টিস্ট সাজেস্ট করে। এটা তারা করবেই। কারণ তারা আপনাকে টাকা লগ্নি করছে। এখন আমার ফিল্মমেকিং জার্নি তো নিজেকে এক্সপ্লোর করার, নিজেকে খুঁজে পাওয়ার। তাই আমার পথটা আমার মতো করে ইজি করে নিয়েছি, সেটা ফিল্মমেকিং প্রসেস হোক কিংবা জীবন কাটানো হোক।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনি বলছিলেন, দর্শকের জন্য চলচ্চিত্র করেন না; পুরস্কারের চিন্তাও মাথায় রাখেন না। এখন যে প্রক্রিয়ায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন সেভাবেই নির্মাণ করতে চান। আপনার কাছে এখন যে বিষয়টা জানতে চাই, নির্মাতা হিসেবে ভালো চলচ্চিত্র বলতে আপনি কী বোঝেন?
যুবরাজ : যেই মুহূর্তে আমার মন খারাপ থাকে, সেই মুহূর্তে যদি আমি একটা কবিতা লিখতে পারি, সেটা আমার কাছে ভালো লাগা। যেদিন আমি একটা ভালো বই পড়ি, সে দিনটা আমার মনে হয় ভালো কাটলো। যেদিন ভালো সিনেমা দেখি, মনে হয় দিনটা আজকে ভালো কাটলো। এখন ভালো সিনেমা কী, সেই প্রসঙ্গে আসা যাক। আমি অনেক লোক দেখেছি, যারা এমনটা বলে এই সিনেমা দারুণ হয়েছে! পরে সেটা দেখতে বসে আমি আর দেখতে পারি না। তার পারসপেক্টিভে কিন্তু সেটা দুর্দান্ত। আমার পারসপেক্টিভ হলো আমাকে যেটা শান্তি দেয়, ভালো লাগে, সেটাই ভালো সিনেমা।
এক ছেলে আমাকে বলেছিলো, কাজী হায়াৎ পৃথিবীর সেরা অভিনেতা। আমি তাকে বলেছিলাম, উনি তো পরিচালক! পরে সে আমাকে বললো, না ভাই, সে তো দুর্দান্ত অভিনয় করে! তখন আমি আর ওকে কী বলবো! ও যদি অস্কারের আয়োজন করতো,মানে অনন্ত জলিলের মতো টাকাপয়সা থাকতো,ও তো কাজী হায়াৎকে ফার্স্ট প্রাইজটা দিতো!
ভালোমন্দের ব্যাপারটা না খুবই আপেক্ষিক। আমি যেভাবে রিলেট করি— সিনেমাতে অতিরিক্ত কাট, অপ্রয়োজনীয় শট্ আমার ভালো লাগে না। এগুলো আমার পারসপেক্টিভ থেকে বলা।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনার কাছে কোনো চলচ্চিত্রের সফলতা কীসের ওপর নির্ভর করে?
যুবরাজ : আমি ঠিক জানি না এখনো, এটা কীসের ওপর নির্ভর করে! তবে আমি সিনেমা বানানোর জার্নিটা উপভোগ করি। এখানে সফলতা, ব্যর্থতার কিছুই নাই। সিনেমাটা যদি কখনো নির্মাণ করা শেষও না হয়, আই ডোন্ট কেয়ার।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আমরা অনেকক্ষণ নানা বিষয় নিয়ে কথা বললাম। ধরেন, একজন দর্শক যিনি এসব বিষয়ের কোনো কিছু সম্পর্কে ধারণা রাখে না। এই প্রেক্ষাপটে কোনো দর্শক আপনার নির্মিত আদিম থেকে কী বার্তা পাবে?
যুবরাজ : আদিম নিয়ে আমি না কোনো বার্তা দেইনি। আমি কোথাও কোনো বার্তা দেইনি। বার্তার ব্যাপারটা দর্শক জানে। কী বার্তা পাবে সেটা তারা দেখবে। আমি একটু বেশিই করে ফেলছি তখন। একবার বলেছিলাম না, ‘আদিম : দিনশেষে আমরা মানুষ’। লেখা দেখছেন না এই রকম একটা? আমার কাছে এখন মনে হয়, দিনশেষে আমরা প্রাণ, মানুষ না। এটা হতে পারে আদিম-এর বার্তা—আমরা সবাই প্রাণ।
ম্যাজিক লণ্ঠন : শিল্পের এতো এতো মাধ্যম থাকতে আপনি কেনো সিনেমাকেই বেছে নিলেন? আপনার কথায় তো বার বার কবিতার প্রসঙ্গ আসছে।
যুবরাজ : এটা তো আসলে বেছে নেওয়ার ব্যাপার না; এটা ভেতরে ঢুকে গেছে আস্তে আস্তে।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনার সেই জার্নিটা কীভাবে শুরু হয়েছে সেটাই জানতে চাচ্ছি?
যুবরাজ : আমি তো ছোটোবেলা থেকেই লিখতাম। সিনেমা বানানোর ব্যাপারটা কেমনে জানি আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকে গেলো। নানা ধরনের সিনেমা দেখেছি। এটা আসলে অনেক দিনের জার্নি। সিনেমাটাকে আমি আসলে সেভাবে বেছে নেইনি। সিনেমার আরেকটা জার্নির ব্যাপারে আপনাকে বলি—আমি তো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছি। পড়ালেখা বাদ দিয়ে চাকরি না করে আমি তখন সিনেমা বানাচ্ছি। আব্বার সঙ্গে এটা নিয়ে খুব ঝামেলা হতো। মা-ও এসব পছন্দ করতেন না। আব্বা ছিলেন ঘোর বিরোধী। মা পছন্দ না করলেও সাপোর্ট করতেন। কারণ মা দেখছিলেন, আমি কোনো কিছুই মানছি না। এভাবেই আরকি সিনেমায় আসা। আমি চাই বার বার আমার প্রিয়তম আব্বার নামটা আসুক, তাই আমি তার কথা বলছি।
আমার আব্বা কী করলেন, আমাকে সিনেমা বানাতে দিবেন না। তিনি বলতেন, কী সব যাত্রা-ফাত্রা করে, এটা সেটা! তখন আদিম-এর শুটিং করছি। আমার সঙ্গে তার কথা হয় না ঠিকঠাক মতো। আব্বাকে কোনো টাকাপয়সা দিতে পারি না। তিনি তখন কোনো চাকরিও করেন না। বয়স হয়ে গেছে। আমার ভাই রেগুলার পকেট খরচ দিতেন আব্বাকে। এর মধ্যে আব্বা স্ট্রোক করলেন, যা আমরা পরে টের পেয়েছি। সেটা আমরা কেউ বুঝি-ই নাই তখন; মাইনর স্ট্রোক। বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলেন। আব্বাকে তুলে নিয়ে গিয়ে মা সেবাযত্ন করছেন, পরে ঠিক হয়ে গেছে। তারপর থেকে আব্বার হাতে-পায়ে সমস্যা হতো। ডান দিকে। চলতে ফিরতে সমস্যা হতো। আস্তে আস্তে দেখি আব্বা আমাদেরকে চিনছে না। কম চিনছে। চেনে আবার ভুলে যায়। অদ্ভুত সব আচরণ করতে থাকেন আব্বা! তিনি তখন শিশুর মতো হয়ে গেছেন। আব্বাকে গোসল করিয়ে দিতাম, চুমু খেতাম—প্রতিদিন চুমু না খেলে আমার ভালো লাগতো না। আব্বাকে আদর করলে আমার ভালো লাগতো। যে আব্বার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিলো; আমাকে সিনেমা বানাতে দিতে চাইতো না; সেই আব্বাই আমার কাছে ধরা দিলেন শিশুর মতো!
প্রথম শৈশবে আব্বার মুখ থেকেই আমি সমাজতন্ত্র এবং মহাপুরুষ শব্দ দু’টি শুনি। আব্বা মহাপুরুষদের কথা বলতেন। তিনি লেখকদের পছন্দ করতেন না, বিজ্ঞানীদের পছন্দ করতেন, গ্রেট যোদ্ধাদের পছন্দ করতেন। আমি যে লেখালেখি করতাম, সেটাও আব্বা পছন্দ করতেন না। আমি একবার আব্বাকে কবিতা শুনিয়েছিলাম। পরে তিনি বলেছিলেন, এগুলো আর লিখবি না। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। যাইহোক, সেই আব্বাই পরে অদ্ভুতভাবে ধরা দিলো আমার কাছে! রাতের পর রাত তার সঙ্গে বসে থাকতাম। তিনি একেবারে বাচ্চাদের মতো বসে থাকতেন, বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতেন আয়নার দিকে। আমি আব্বাকে প্রায়ই খাইয়ে দিতাম, গোসল করাতাম। আব্বার সঙ্গে আমার এই যে সময়টা, এই যে জার্নি, এর মধ্যে কোনো সিনেমা দেখা হয় নাই।
ইতোমধ্যে আদিম-এর শুটিং শেষ হয়েছে। কিন্তু পোস্টের কাজ করতে পারছি না; টাকাপয়সা নাই। তো হঠাৎ একদিন আমি সিনেমা দেখতে গিয়ে দেখি, সিনেমা আমার কাছে অন্যভাবে ধরা দিচ্ছে। বুঝছেন? মানে সিনেমার ম্যাজিকটা আমি ধরতে পেরেছি। আমার নিজের সঙ্গে কানেক্ট করতে পেরেছি। তখন আমার আর আদিম-এর ব্যাপার-স্যাপার ভালো লাগছিলো না। এটা আদিম-এর এডিটিংয়ে প্রভাব ফেলেছে। এডিট তো কেউ আমাকে শেখায় নাই। এডিট তো মাথায় হয়ে যায়। কোন শটের পর কোন শট্ কীভাবে ওয়ার্ক করে, এডিটিং এর এই বোধ জন্ম নিলো। তাই এডিটিং আমার কাছে কোন টেকনিক্যাল বিষয় না, আমি তো ভালো টেকনিশিয়ানও না। এবং আমি দেখলাম আগে আমি যেভাবে ভাবতাম সেভাবে আর ভাবতে পারছি না। মানে আব্বার সঙ্গ আমাকে যে প্রশান্তি দিতো, আমি যেকোন ভাবনার সঙ্গেই সেই অনুভূতিটা খুঁজতে শুরু করি, আপনি বুঝতে পারছেন? মানে আমার গল্পবলার ওয়ে, শট্ ডিজাইন, এডিটিং সেন্স সবই চেঞ্জ হতে শুরু করলো এই জার্নির মধ্য দিয়ে। দেখেন, আমার আব্বা যিনি ফিল্ম বানানোর জন্য আমাকে সবচেয়ে অপছন্দ করতেন, সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করেছেন, সেই মানুষটার সঙ্গই আমাকে অন্য এক জার্নিতে নিয়ে গেলো!
আমি এখন সিনেমা বানানোর সময়, শ্যুট করার সময় ওই আনন্দটাই বার বার খুঁজি। সেটা হতে পারে অদৃশ্যের কোনো স্পর্শ, স্পিরিচুয়াল কোনো কানেকশন। যে স্পর্শ এখন আমি যে সিনেমার কথাই ভাবি, গল্পই ভাবি, সেখানেই পেতে চাই। যে কাজই করি না কেনো, সেখানে আমি এই স্পর্শ বা কানেকশনটা পেতে চাই।
এখন আমি আশ্চর্যের একটা গল্প নিয়ে কাজ করছি। দুইটা সিনেমাই আশ্চর্যের গল্প। দুনিয়ার সিনেমা না এগুলো; পরের দুনিয়ার সিনেমা। পরের দুনিয়ার ফিল্ম মানে আপনারা যেই সিনেমা দেখেন, সেই সিনেমা না। অতল আমার ট্রানজেশন ফিল্ম। অতল-এর ভিজ্যুয়াল নিয়ে আমি নানা রকম কাজ করছি। অনেকবার এডিটিং করেছি; এক বছর ধরে এডিটিং করছি। আমার ভালো লাগে! ইদানীং আমার মনে হচ্ছে আমি ভেতরে ভেতরে অন্য এক জার্নির জন্য রেডি হচ্ছি। এই কারণে বার বার বলি আমি ফিল্মমেকার না। গন্দম (যার ওয়ার্কিং টাইটেল হাজত ছিলো) সামনে আসবে। অতল, আদিম এগুলো আমি আমার স্টুডেন্ট ফিল্ম হিসেবে বিবেচনা করি।
এই যে ফিল্ম পাওয়ার ব্যাপারটা—এটা পুরোপুরি অন্যভাবে পাওয়া। এই জার্নির মধ্য দিয়ে আপনাকে যেতে হবে। আপনি যদি জার্নির মধ্য দিয়ে না যান, তাহলে তো পৌঁছাতে পারবেন না জায়গা মতো। আপনি শুধু ফিল্ম স্কুলে গেলেন, তার মানেই আপনি ফিল্মমেকার না। এটা তো কবিতা লেখার মতো না। আপনি ছন্দ শিখলেন আর কবিতা লিখে ফেললেন! আপনি কষ্ট করে না হয় সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-এর মতো কবিতা লিখতে পারবেন, কিন্তু জীবনানন্দের মতো কবিতা লিখতে পারবেন না!
আমি ফিল্ম স্কুলে কোনো দিন যাই নাই। আমি আসলে জীবনের জার্নির মধ্য দিয়ে গেছি। আমি জাস্ট অবজার্ভ করেছি আমার ভেতরে যা যা ঘটছে। আমি অবজার্ভ করেছি, তার মানে এই না আমি সিনেমা বানানোর জন্য অবজার্ভ করেছি। আমার অবজার্ভ করতে ভালো লাগে তাই অবজার্ভ করি। আমি এখনো অবজার্ভ করি। আপনি কীভাবে বসেছেন, কোন ছাগলটা কীভাবে ডাকছে, কোন পাখিটা কীভাবে ডাকছে, এসব অবর্জাভেশনে আমার ভেতরে কী অনুভূতি হচ্ছে,এগুলো আমার খেয়াল করতে ভালো লাগে।
আজকের দিনটা কেমন যাচ্ছে, আকাশটা কেমন আজকের—এই অবজার্ভ করাটাই আমাকে ফিল্মমেকার হিসেবে তৈরি করছে। আমার তো আসলে সেই অর্থে অনেক জানাশোনা নাই বা জ্ঞানী মানুষও না, জ্ঞানের জার্নিতে আছি বলতে পারেন। কিন্তু আমি অনুভব করতে পারি কোনো মানুষ একটা কথা কেনো বলছেন, এর পারপাস কি! আমার কাছে মানুষ ফুলের মতো, মানুষ গোবরের মতো—মানুষের থেকে সুবাস পাওয়া যায়। আপনি যখন আসছেন না সেই মুহূর্তে আমি সুবাস পেয়েছি।
অতল চলচ্চিত্রের পোস্টার, ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
এখন এই যে আমার ভেতরে নানান রকম অনুভূতি বা আর্ট জন্মায়, যাই বলি তা আমি ফিল্মের সঙ্গে কানেক্ট করতে পারি। হুটহাট কিছু কবিতা সুন্দর হয়ে যায়। কিন্তু ম্যাক্সিমাম সময় ভালো কবিতা লিখতে পারি না। আর উপন্যাস তো আমার লেখার ক্ষমতাই নাই! উপন্যাস লিখতে যে ধৈর্য লাগে! আমি অনেকবার ট্রাই করেছি কিন্তু হচ্ছে না। ফিল্মে আমি অনেক বেশি আনন্দ পাই, এজন্যই আমি আছি ফিল্মে। ফিল্মটা আমার কাছে নিজেকে প্রকাশের একটা মাধ্যম মাত্র।
ম্যাজিক লণ্ঠন : কোনো নির্মাতার প্রভাব কী আপনার চলচ্চিত্র কিংবা জীবনে আছে?
যুবরাজ : আমি ঠিক জানি না; থাকতেও পারে। এতো এতো নির্মাতার সিনেমা দেখেছি সেটা আলাদাভাবে বলার কিছু নাই, একেক সময় একেক নির্মাতার কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। এখন যদি আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, সিনেমা কীভাবে দেখেন—একটার পর একটা শট্ যায়, এভাবেই তো দেখেন, তাই না? কিন্তু আমার দেখাটা ভিন্ন। ফিল্মমেকার যেভাবে দেখায় আমি সেভাবে দেখি না। আমি দেখি, আমি যেভাবে দেখতে চাই সেভাবে। আমি বইয়ের পাতার মতো ফিল্মটাকে দেখি। হয় এখান থেকে দেখছি, না হয় ওখান থেকে দেখছি। আইনস্টাইন, স্টিফেন হকিংস, ওরা আলো যেভাবে দেখতে পারছে—ফিল্মে দেখেন নাই কোনো একটা বিষয় সমাধান করতে গিয়ে বোর্ড থেকে লেখাগুলো বের হয়ে আসছে—আমি যখন সিনেমা দেখতে বসি সিনেমা আমার কাছে এভাবেই ধরা দেয়। অবশ্যই সেটা তারকোভস্কির ফিল্ম না। গ্রেট ফিল্মমেকারদের ফিল্ম ওরা যেভাবে দেখায় সেভাবেই দেখি। আমি অন্যভাবে দেখতে পারি না। কারণ ওদের এতোই ক্ষমতা! তবে মাঝেমধ্যে সেখানেও ভিন্নতা ঘটে। কিন্তু মিডিওকার কিংবা উঠতি ফিল্মমেকার যারা, তাদের ফিল্ম দেখতে বসলে আমার মতো করে দেখি। তাদের সিনেমা দেখতে বসলে মনে হয়, কিছু জায়গা এলোমেলোভাবে আছে, অন্যভাবে হলে ভালো হয়।
ম্যাজিক লণ্ঠন : তার পর, বলেন?
যুবরাজ : যেটা বলছিলাম, আমি যে মুহূর্তে আদিম শুরু করি, তখন এর ভবিষ্যৎ চিন্তা করি নাই। এটা কী হবে সেটা জানতাম না। যদি ভবিষ্যৎ চিন্তা করতাম, তাহলে তো আমি স্টার কাস্ট করতাম। আমি অন্য কোনোভাবে গল্প বলার ধরন চিন্তা করতাম। এভাবে শ্যুটের প্ল্যান-ও করতাম না। আমি তো আসলে আর্টের ওই মজাটাই চেয়েছি। আর্টের যে জার্নি, এই যে বস্তিতে থাকা, একটা সিনেমার সঙ্গে দীর্ঘদিন থাকা—এটা আমার ভালো লেগেছে। আমি এই মজাটা নিয়েছি!
ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকারদের সমস্যাটা আসলে কোথায়? আমরা কাজ করার আগেই কি ভাবি জানেন? আমাদের নাম হবে; আমাকে মানুষ চিনবে-জানবে! এটা একটা সমস্যা! এটা কাজের ক্ষেত্রে এক ধরনের বাধা। এই যে ধরেন আমি অতল করছি। নিশ্চিতভাবে অতল-এর ভবিষ্যৎ আমি জানি না। কিন্তু আমি জার্নিটা করেছি, আমি প্রতিদিন উঠে শুটিংয়ে গেছি সেহরীর সময়। ২০২২-এর রোজার মধ্যে আমি এটা করেছি। আমার আব্বা মারা গেছেন ২০২১-এ। আব্বাকে হারানোর বেদনা তখনো ভেতরে ছিলো। সেই বেদনা নিয়ে, অন্তরে আব্বাকে নিয়ে, আমি স্কুটারে—সিনেমাটোগ্রাফার পেছনে বসেছে, আমি সামনে—তুষার ভাইয়ের কথা বলছি। সেহরী খেয়ে বেরিয়ে গেছি; কারণ ভোরের আলোতে শ্যুট করবো। দুই বেলা শ্যুট করেছি, ভোরের আলো আর বিকেলে। এইভাবে আমরা ২০২২-এ কাজ করেছি। তার পর দেখলাম আবহাওয়া চেঞ্জ হয়ে শীত এসে গেছে। ফলে আমরা শ্যুট বন্ধ করলাম, আবার পরের বছরের জন্য অপেক্ষা করলাম। ২০২৩-এ আমরা আবার শ্যুট করলাম।
এই যে জার্নিটা, এর মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেলো; আমি অ্যাওয়ার্ডেড হয়ে গেলাম। টাকাপয়সা আসলো; কিংবা ধরেন, কারো কাছে এ বিষয়ে টাকা চাইলে সে তখন রাজি হতো। কিন্তু আমরা যেভাবে অতল-এর জার্নিটা শুরু করেছিলাম, সেভাবেই শেষ করলাম। আমি আসলে আর্টের এই মজাটা চেয়েছিলাম!
এখন আপনি বা অন্য কেউ সিনেমা বানাবেন কীভাবে? আপনি কেনো এতো চিন্তা করছেন! আপনার কাছে মোবাইল ফোন আছে, সেটা দিয়ে শ্যুট করে ফেলেন না, আপনি যেটা কল্পনা করছেন। মানে সিনেমার মজাটা আসলে কোথায়? শ্যুট করার মজাটা কোথায়? আপনার ভেতরে একটা ইমেজ আছে, আপনি সেটাকে ক্যামেরার সামনে হাজির করতে পারেন কি পারেন না, সেটা আপনার চ্যালেঞ্জ। আপনি আপনার ভেতরে থাকা ইমেজের সঙ্গে বাইরের ইমেজকে কানেক্ট করতে পারছেন কিনা, এটাই আপনি টেস্ট করছেন। খুঁজছেন? দেখেন, সেটা পান কি না? আপনি পারলে মোবাইলে এডিট করেন। আমার কথা হলো, আপনি আর্টের জার্নিটা নেন। কারণ এই সময়ে সিনেমা বানানো অনেক সহজ হয়ে গেছে। কিন্তু তার পরও আমাদের জীবন কঠিন! জীবন কঠিন থেকে কঠিনতর হওয়ার কারণে সিনেমা বানানোও কঠিন লাগে। আপনি আপনার ওয়াইফকে শ্যুট করেন—অনেকে এখন এভাবে সিনেমা বানাচ্ছে তো! থেমে থাকার কিছু নাই! আপনি আপনার ওয়াইফের সঙ্গে প্রতিদিন কথা বলেন, সেটা রেকর্ড করেন—এটা তো একটা সিনেমা।
আমি তো একটা সিনেমা বানানোর চিন্তা করছি এভাবে—একটা ক্যারেক্টার, সে কেবল মানুষের গল্প শোনে। পুরো সিনেমায় সে কেবল মানুষের গল্প শুনবে। আর অতল তো পুরো সাইলেন্ট। আমার ওই সিনেমার পুরোটার মধ্যে কেবল কথা থাকবে। কেউ তার প্রিয়জন হারিয়েছে, সে ওই গল্প বলছে। এই গল্প শেষ, তখন ওই ক্যারেক্টার আরেক জায়গায় যাবে। কেউ একজন তার প্রেমিকার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছে কীভাবে, সেই গল্প বললো। বুঝতে পারছেন নিশ্চয় বিষয়টা? এভাবেই সিনেমা হয়ে যাবে। আপনি এভাবেই বানান না, মানে আপনার ওয়াইফের সঙ্গে একইভাবে গল্প করেন না! গল্প করেন আর সেটা ভিডিও করেন; এটা একটা অদ্ভুত বিষয়। এটা দিয়ে নতুন একটা আর্ট হবে। তার পরে আপনি এডিট করতে বসেন, এডিট করা তো এখন অনেক সহজ! আপনি কেবল মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে নেন এই এই শটগুলো আপনি এভাবে বসাবেন। এগুলো নিয়ে ল্যাপটপে বসেন বা ফোনে বসেন; দেখবেন সিনেমা হয়ে গেছে। এভাবেই তো হবে। আর ধরেন ওয়ার্ক করলো না, সিনেমা হলো না, তাতে কী হয়, কী হারানোর আছে! সব সিনেমাই মানুষকে দেখাতেই হবে?
ম্যাজিক লণ্ঠন : অনেকে বলছে, বাংলাদেশের সিনেমায় নতুন ধরনের ভাষা তৈরি করছেন আপনারা। বিশেষ করে আপনার আদিম, পেয়ারার সুবাস কিংবা ‘শাটিকাপ’; এই কনটেন্টগুলো নতুন ধরনের চলচ্চিত্রভাষার ইঙ্গিত করছে। এ নিয়ে আপনি ঠিক কী বলবেন?
যুবরাজ : এই যে আপনি সিনেমার ভাষার কথা বললেন না—অনেকে এখন বলছে সিনেমায় কোনো গল্প নাই। আবার কেউ বলছে, নতুন কিছু মনে হচ্ছে। কিন্তু দেখেন, এটা নতুন কিছু না তো! গদার-এর সিনেমা দেখলেও দেখবেন কিংবা বার্গম্যান-এর সিনেমা দেখলেও দেখবেন কিংবা তারকোভস্কিকেও আপনি দেখতে পারেন—আসলে আমরা যেটাকে নতুন বলছি, সেটা নতুন না আসলে। ফলে আমরা যখন নতুন সিনেমা, এবং তার নতুন ধরনের ল্যাঙ্গুয়েজের কথা বলছি,এগুলো মোটেও নতুন কিছু না। এগুলো আমাদের এই অঞ্চলে হয়তো নতুন মনে হচ্ছে। বরং আমার কাছে যেটা বেশি ইন্টারেস্টিং মনে হয়, এখন ফিল্মমেকাররা নিজের সিনেমাটা নিজের মতো করে বানানোর সাহস করছে। অনেকে নিজের মতো সিনেমা বানাচ্ছে, বানিয়ে ফেলেছে। কারণ দুনিয়াটা উন্মুক্ত হয়ে গেছে।
আমাদের এই অঞ্চলে ধরেন, সুলতানের [এস এম সুলতান] মতো আর্টিস্ট জন্মেছে কিংবা লালন জন্মেছে—ভাবলে অবাক লাগে—তাদের মতো গ্রেট আর্টিস্ট এই মাটিতে জন্ম নিয়েছে। ধরেন, আমি মস্কো শহরের রাস্তা দিয়ে ঘুরছি, সেখানে ওদের ভাস্কর্য দেখছি। এ সময় আমি কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি, যারা ফিল্মের সঙ্গে জড়িত না, আমি তাদের জিজ্ঞাসা করেছি, তোমার প্রিয় ফিল্মমেকার কে? ওরা আমাকে বলেছে তারকোভস্কি; আকিরা কুরোসাওয়ার নাম বলেছে; ওরা ইরানের জাফর পানাহির নামও বলেছে। তাহলে আপনি দেখেন ওরা ফিল্মের কেউ না, একেবারে সাধারণ লোকজন, তারাও এই ধরনের গ্রেট সিনেমা ও ফিল্মমেকারদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। যেগুলো ধরেন, এখানে আমাদের ফিল্মপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা পড়ছে। তার মানে ওরা কতো এগিয়ে আছে। সেই জায়গা থেকে এখানকার ছেলেমেয়েরা যে সাহস করে নিজেদের মতো সিনেমা বানাতে শুরু করেছে, এটা ভাবতেই আমার দারুণ লাগে!
আমি আপনাকে তখন বলছিলাম না, আর্টিস্ট শব্দটা বোঝার জন্য আমরা হয়তো ব্যবহার করি; অথচ এই সময়ে এসে আমি নিজেও বুঝিনা আর্টিস্ট বলতে আসলেই কী বোঝায়! আমি আসলেই বুঝি না, বোঝার চেষ্টা করছি। আর্টিস্ট বলতে আমরা একটা কাঠামো দাঁড় করিয়েছি এবং সেখান থেকে এটা ব্যবহার করছি। ফলে এই অঞ্চলে যে এই ধরনের কাজ হচ্ছে, সেটা আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মনে হয়। ফলে নতুন ভাষা হচ্ছে কি হচ্ছে না, সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না।
ম্যাজিক লণ্ঠন : তার পরও কিছু একটা নিশ্চয় দাঁড়াচ্ছে?
যুবরাজ : আসলে সিনেমার সব ভাষা তৈরি হয়ে গেছে। এখন প্রত্যেক ফিল্মমেকার—ধরেন আপনি একভাবে কথা বলেন, আমি একভাবে কথা বলি, আমাদের কথা বলার ভাষায় ভিন্নতা আছে না।প্রত্যেকের ভাষা তো আলাদা আলাদা হবেই। ফিল্মের নিজের মতো করে ভাষা তৈরি করার কিছু নাই। এখন ফিল্মমেকার হিসেবে আপনি যেটা করতে পারেন, আপনার ইমোশন—এখন আর ওই দিন নাই যে ইমোশন বোঝানোর জন্য আমার ক্লোজ শট্ দরকার আছে। আমি একই ইমোশন আমার মতো করে লঙ শট্ দিয়েও বোঝাতে পারি।
ম্যাজিক লণ্ঠন : এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। ওটিটি প্লাটফর্ম চালু হয়েছে, এ নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী? কিংবা দেশীয় ওটিটির বাজারকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
যুবরাজ : ওটিটির বাজার তো ভালো, কারণ অনেকে এখানে কাজের সুযোগ পাচ্ছে। তবে এটা আমি বা আমার মতো যারা সিনেমা বানায়, তাদের জন্য কিছু যায় আসে না। ওটিটি থাকা না থাকার সঙ্গে আমাদের মতো ফিল্মমেকারের সিনেমা বানানোয় কিছু যায় আসে না। কিন্তু ব্যাপার হলো, আদিম ওটিটিতে বিক্রি হয়েছে। এজন্য আমার কিছুদিন ভালো কেটেছে। কারণ কিছু টাকা পেয়েছি; অনেককে টাকা ফেরত দিতে পেরেছি। কিন্তু এটা বিক্রি না হলে—এর মানে এই না যে, আমি পরের সিনেমাটা বানাতে পারবো না! আদিম বিক্রির আগেই আমি গন্দম এবং অতল নামে দুইটা সিনেমা বানিয়েছি। তার মানে হলো, আমার সিনেমা বানানোর সঙ্গে ওটিটির সেই অর্থে কোনো সম্পর্ক নাই। কিন্তু ওটিটির কারণে প্রচুর মানুষ কাজের সুযোগ পাচ্ছে। সেটা তাদের জন্য অবশ্যই একটা বড়ো ঘটনা।
ধরেন, এখন অনেক সিনেমা খুব হিট হচ্ছে, এটা তো ইন্ডাস্ট্রির জন্য জরুরিও। জরুরি এ কারণে যে, ধরেন হিট সিনেমাটা হলে চলছে; আবার ওই দর্শক অচেতনভাবেই আদিম-এর পাশে দাঁড়াচ্ছে। কারণ সিনেমাহলগুলো ওই সব সিনেমার কারণে চলছে, আর চলছে কারণেই আমি সেখানে আদিম রিলিজ দিতে পারছি। একইভাবে ওটিটি যদি চাঙ্গা থাকে, সেখানে আমাদের মতো দুই-একটা কাজ তারা নিতেও পারে আবার নাও নিতে পারে। কিন্তু এর সঙ্গে আমাদের মতো—আমি আমার কথা বলছি—ফিল্মমেকারের ফিল্ম বানানো না বানানোর কোনো সম্পর্ক নাই।
ম্যাজিক লণ্ঠন : আরেকটা বিষয় জানতে চাচ্ছিলাম, এফ ডি সি একটা ঘরানা ছিলো, ৮০’র দশকে এসে বিকল্পধারা বলে আরেকটা ঘরানা আসলো। কিন্তু এখন এই দুইটা ঘরানার কোনোটাই নাই। এর বাইরে ব্যক্তিকেন্দ্রিক যে এক ধরনের ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হচ্ছে নতুনভাবে, এ নিয়ে আপনার মতামত কী? যেমন ধরেন, আপনি সিনেমা বানাচ্ছেন এখানে, আমার কাছে মনে হয়, এটা একেবারে ব্যক্তিকেন্দ্রিক একটা ইন্ডাস্ট্রি।
যুবরাজ : দেখেন, ইন্ডাস্ট্রি তো অনেক বড়ো ব্যাপার!
ম্যাজিক লণ্ঠন : আমি আসলে বলতে চাচ্ছি, রায়হান রাফী তার লোকজন নিয়ে সিনেমা বানাচ্ছে, আপনি এখানে আপনার মতো করে সিনেমা বানাচ্ছেন, রাজশাহীতে তাওকীর সাইক সিনেমা বানাচ্ছে ...
যুবরাজ : আসলে এটাকে আমি আদৌ ইন্ডাস্ট্রি বলবো কিনা বুঝতে পারছি না। তবে এটা বলতে পারি, ব্যক্তিকেন্দ্রিক ফিল্ম নির্মাণের জোয়ার বইছে এখন দেশে। যে যার মতো করে এখন সিনেমা বানাচ্ছে।
যুবরাজ শামীম
মইনুল ইসলাম, জাগোনিউজটুয়েন্টিফোরডটকম-এ প্রতিবেদক হিসেবে কর্মরত।
Moynulislam2071@gmail.com
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন