মোহাম্মদ আল তুর্কি; ভূমিকা ও ভাব-ভাষান্তর : রীতা জান্নাত
প্রকাশিত ২৫ জুন ২০২৫ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
“এমন অনেক কিছুতেই ‘হ্যাঁ’ বলেছি যেগুলোতে ‘না’ বলা উচিত ছিলো”
মোহাম্মদ আল তুর্কি; ভূমিকা ও ভাব-ভাষান্তর : রীতা জান্নাত

ভূমিকা
প্রগতিশীলতা আর রক্ষণশীলতার লড়াই পৃথিবীতে সবসময়ই চলমান। কেউ যেমন প্রগতিশীলতার মধ্য থেকে রক্ষণশীল হয়ে উঠতে পারে, আবার কেউ রক্ষণশীলতার মধ্যে থেকে প্রগতিশীল হয়ে উঠতে পারে। এমনই একজন সৌদি আরবে জন্ম নেওয়া মোহাম্মদ আল তুর্কি। যিনি স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে না চলে, বরং নিজেই পথ তৈরি করে অন্যদের জন্য আলো জ্বেলেছেন। মোহাম্মদ সৌদি সমাজব্যবস্থার ভেতর থেকে উঠে এসে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন প্রযোজক, উদ্যোক্তা ও সমাজসেবক হিসেবে। তার কাজ সৃজনশীলতা বিকাশের পাশাপাশি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে এক ধরনের সংলাপও তৈরি করে। তবে মোহাম্মদ এই পথচলায় কেবল বাহবা পেয়েছে এমন নয়, সমালোচনাও কম হয়নি। প্রশ্ন উঠেছে তিনি কি নিজের সংস্কৃতিকে বিলীন করছেন, নাকি সেটা নতুন ভাষায় প্রকাশ করছেন?
১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের ৩ জুলাই সৌদি আরবের আল-খোবার শহরে জন্ম নেওয়া মোহাম্মদ বড়ো হয়েছেন প্রভাবশালী ও সমাজ সচেতন এক পরিবারে। তার বাবা শেখ আব্দুল আজিজ আল তুর্কি ছিলেন ব্যবসায়ী ও দাতব্য সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। পারিবারিকভাবেই সমাজসেবার মূল্যবোধ মোহাম্মদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। মোহাম্মদের জীবনের মোড় ঘুরে যায় যখন তিনি লন্ডনে মিডিয়া স্টাডিজ নিয়ে পড়ালেখা করতে যান। যা তাকে পশ্চিমা সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। একইসঙ্গে এখানেই বোধহয় তার জীবনের চ্যালেঞ্জেরও শুরু। একদিকে সৌদি সংস্কৃতির রক্ষণশীল মানসিকতা, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরিবেশে মুক্ত চিন্তার প্রয়াস, এই দুইয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মোহাম্মদ খুঁজে নেন নিজের পথ।
২০১০ খ্রিস্টাব্দে The Imperialists Are Still Alive! দিয়ে চলচ্চিত্র প্রযোজনার যাত্রা শুরু মোহাম্মদের। তার পর Arbitrage (২০১২), 99 Homes (২০১৪), Crisis (২০২১) এর মতো চলচ্চিত্রে প্রযোজনা করে তিনি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তার প্রযোজিত চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু হয়েছে মূলত সামাজিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক সঙ্কট ও মানবিক টানাপড়েন। এটা মূলত মোহম্মদের অন্তর্দৃষ্টি ও দায়িত্ববোধকেই প্রতিফলিত করে। তবে তিনি কেবল সেলুলয়েডেই থেমে থাকেননি। রেড সী ফিল্ম ফাউন্ডেশন-এর [সৌদি আরবের অলাভজনক একটি সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশন। সৌদির চলচ্চিত্র নির্মাণ, বিতরণ ও সেইসঙ্গে চলচ্চিত্র শিক্ষায় সহায়তার জন্য ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে সংগঠনটি গড়ে ওঠে।] প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সি ই ও) হিসেবে তিন বছর নেতৃত্ব দেন। এবং সৌদি আরবের চলচ্চিত্রজগতে এক নতুন যুগের সূচনা করেন। যেখানে কয়েক বছর আগেও প্রেক্ষাগৃহ নিষিদ্ধ ছিলো; সেখানে মোহাম্মদ চলচ্চিত্রকে জাতীয় পরিচয়ের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন!
মোহাম্মদ এর বাইরে বিভিন্ন সময়ে ইউনিসেফ, Steve Irwin Sea Shepherd, amfAR-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে ভেনিসে অনুষ্ঠিত amfAR গালায় তিনি ‘Philanthropic Leadership Award’ অর্জন করেন।
মোহাম্মদ তার কর্মজীবন, চিন্তাভাবনা, চলচ্চিত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, সংগ্রাম নিয়ে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে কথা বলেছেন। তার মধ্যে থেকে একটি সাক্ষাৎকার ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’-এর পাঠকের জন্য ভাব-ভাষান্তর করা হয়েছে। সাক্ষাৎকারটি ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ২১ মে বিনোদন ও ফ্যাশন ম্যাগাজিন ‘A & E’ (aeworld.com) এ প্রকাশ হয়।
আ অ্যান্ড ই : আপনি কি মনে করেন যে ধরনের কাজ করেছেন, তা দিয়ে দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পেরেছেন; করলে সেটা কীভাবে?
মোহাম্মদ আল তুর্কি : আমি মনে করি, আমার দেশের মানুষকে আমি অনুপ্রাণিত করতে পেরেছি। যখন আমি কাজ শুরু করি তখন সৌদি আরবে চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ ছিলো। সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে মাত্র এক বছর আগে। আমি এমন এক পেশা বেছে নিয়েছিলাম, যেটায় আমার পুরোপুরি বিশ্বাস আছে। চলচ্চিত্রকে আমি ভালোবাসি¾গল্প বলার শিল্পমাধ্যম, সৃষ্টিশীলতা ও গোটা বিশ্বের কাছে গল্প ভাগ করে নেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে। যখন আমি চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই, তখন দেশের মানুষের মনে এটা নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিলো। ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, আমি তাদের সমর্থন পাচ্ছি।
ক্যারিয়ার শুরুর কয়েক বছর পর নিউ ইয়র্ক ফিল্ম অ্যাকাডেমিতে বক্তৃতার সময় আমি খেয়াল করলাম দর্শকের প্রায় ৮০ শতাংশই সৌদি শিক্ষার্থী। সঞ্চালক আমাকে বলেছিলেন, ৬,০০০ শিক্ষার্থী চলচ্চিত্র নিয়ে পড়ালেখার জন্য নিবন্ধন করেছে। এবং তখনো সৌদি আরবে চলচ্চিত্র সেভাবে চালু হয়নি! সেই সময়ই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, এটা একটা বড়ো পরিবর্তনের ইঙ্গিত। কয়েকজন আমাকে জানায়¾এমনকি ইনস্টাগ্রামে মন্তব্য করে¾‘আমরা দেখেছি আপনি চলচ্চিত্রকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তখন আমরা ভেবেছি, যদি আপনি এটা করতে পারেন আমরাও পারবো।’ ফলে এটাকে আমি বড়ো একটা দায়িত্ব বলেই মনে করি। আশা করি, ভবিষ্যতে আমি এ ব্যাপারে তাদের সাহায্য করতে পারবো।
আ অ্যান্ড ই : পেশা হিসেবে চলচ্চিত্রকে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে আপনার অনুপ্রেরণার জায়গাটা কী ছিলো?
মোহাম্মদ : সবসময়ই চলচ্চিত্র আমার কাছে ভালোবাসার জায়গা। ছোটোবেলা থেকেই এটা আমার জীবনের একটা বড়ো অংশ ছিলো। বাবা ও মায়ের সঙ্গে অনেক চলচ্চিত্র দেখেছি। যখনই লন্ডনে যাওয়ার সুযোগ হতো, আমরা সেখানে ম্যাগাজিন কিনতাম এবং যে চলচ্চিত্রগুলো দেখতে চাইতাম, সেগুলো চিহ্নিত করে রাখতাম। তখন এমন একটা ব্যাপার ছিলো যে, গ্রীষ্মকালে যতোটা সম্ভব চলচ্চিত্র দেখতে হবে, বাড়ি ফিরে যাওয়ার আগে। এমনকি সৌদিতে ফিরে আসার আগে দোকান থেকে সিডি প্লেয়ার আর সিডি কিনে নিয়ে আসতাম।
আ অ্যান্ড ই : সৌদি আরবের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে আপনার কাজ কতোটা অবদান রেখেছে বলে মনে করেন?
মোহাম্মদ : আমি সৌদি আরব যাচ্ছি সৌদি চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। সরকারি উদ্যোগেই এটা হচ্ছে। সেখানে আমি ‘জার্নি ইন হলিউড’ শিরোনামে এক আলোচনায় অংশ নেবো। প্রথমে যখন উৎসবের লোকজন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে, তখন ৬০ জন দর্শকের সামনে ছোট্ট পরিসরে আলোচনার কথা হয়েছিলো। কিন্তু পরে তারা আবার আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে বললো, অংশগ্রহণকারীরা এ ব্যাপারে প্রচণ্ড আগ্রহী; ফলে ৩০০ দর্শকের সামনে আলোচনা করতে হবে। এটা আমার জন্য সত্যিই আনন্দের, কারণ এই আয়োজনে সরকারের সমর্থন আছে। সৌদি চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে জি সি সি১ তুলনামূলকভাবে নতুন। তবে আমি মনে করি সৌদিতে এমন কিছু লোক আছে যারা সত্যিই অসাধারণ কাজ করছে।
উদাহরণ হিসেবে ‘জ্যাক রায়ান শো’-এর অভিনয়শিল্পী দিনা শিহাবি’র কথা বলা যেতে পারে। আছেন সৌদি নির্মাতা হাইফা আল-মনসুর, যিনি একাধিক পুরস্কার জিতেছেন এবং কান চলচ্চিত্র উৎসবে জুরি সদস্য ছিলেন। সৌদি নারী হিসেবে এটা অনেক বড়ো অর্জন। আমি মনে করি তিনি সৌদির গর্ব। এছাড়া অভিনয়শিল্পী আহদ কামে-ও আছেন, যিনি ক্যারি মুলিগান-এর সঙ্গে ‘কোল্যাটেরাল শো’তে অভিনয় করেছিলেন। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই এই মানুষগুলো নিজেরাই নিজেদের কাজকে ছাপিয়ে গেছে এবং সৌদি ইন্ডাস্ট্রির জন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছে।
আ অ্যান্ড ই : সৌদি আরবে এখন অনেক পরিবর্তন হচ্ছে, প্রেক্ষাগৃহগুলোও খুলে দেওয়া হয়েছে। আপনি এই শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবছেন?
মোহাম্মদ : বিনোদন ইন্ডাস্ট্রি এবং শিল্পে অনেক বেশি বিনিয়োগ ও উৎসাহের কারণে সৌদি চলচ্চিত্র বদলে যাচ্ছে। গত এক বছরে এমন অনেক কিছু ঘটেছে, যা সৌদি আরবে কখনো ঘটতে পারে বলে আমি কল্পনাও করিনি! এখন অনেক সঙ্গীতানুষ্ঠান হচ্ছে; রিয়াদে একটা অপেরা হাউজ খোলা হয়েছে। সরকার গানের স্কুল খোলার অনুমতিও দিয়েছে; আরবের কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পীদের সম্মানিত করছে এবং স্কুলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
তাছাড়া এখানে কনসার্ট হচ্ছে। সম্প্রতি মারিয়া ক্যারি২ পারফর্ম করেছেন এখানে। একন ও ফ্রেঞ্চ মন্টানা’র৩ কনসার্টও হয়েছে। পরিস্থিতি সত্যিই দ্রুত বদলাচ্ছে। সৌদি আরবে আগে যেটা কখনো দেখিনি¾প্রাইম ডাইনিং [বিশেষায়িত বিলাসবহুল রেস্টুরেন্ট] চালু হয়েছে। এখানে সবসময়ই অনেক ভালো মানের সব রেস্টুরেন্ট ছিলো; কিন্তু এ ধরনের প্রাইম ডাইনিং অভিজ্ঞতা আগে কখনো হয়নি। রিয়াদে এখন সিপ্রিয়ানি৪ ও নোজোমির৫ মতো ভেন্যু খোলা হয়েছে। সৌদি আরবজুড়েই পপ-আপ রেস্টুরেন্টও হচ্ছে। এটা সত্যিই রোমাঞ্চকর!
আ অ্যান্ড ই : আপনার নতুন চলচ্চিত্র সম্পর্কে কিছু বলতে চান?
মোহাম্মদ : এখন ড্রিমল্যান্ড (২০২০) নামে একটি চলচ্চিত্রে কাজ করছি। এটা ওপিওয়েড৬ সঙ্কট (Opioid Crisis) নিয়ে নির্মিত; বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুর কারণ। আমি মনে করি, সামাজিক সচেতনতামূলক বিষয় নিয়ে চলচ্চিত্রে কাজ করাটা খুব দরকার। আমার উদ্দেশ্যই মূলত মানুষের জীবনের চলমান সমস্যাগুলো চলচ্চিত্রে তুলে ধরা। ২০১২ খ্রিস্টাব্দে আমি আরবিট্রেজ (Arbitrage) নামের একটি চলচ্চিত্রে কাজ করেছি। যেখানে আর্থিক সঙ্কট নিয়ে একটি গল্প বলা হয়েছে। এতে অভিনয় করেছেন মার্কিন অভিনয়শিল্পী রিচার্ড গিয়ার।
এরপর আমি নাইন্টিনাইন হোমস-এও কাজ করি। এটা ফ্লোরিডার আবাসন সঙ্কট৭ পরবর্তী ঘটনা নিয়ে নির্মিত। তারপর আমি রিচার্ড গিয়ারের সঙ্গে টাইম আউট অব মাইন্ড (২০১৪) নামের আরেকটি চলচ্চিত্রে কাজ করি; যা ছিলো গৃহহীন মানুষদের নিয়ে। সুতরাং আমার কাছে চলচ্চিত্র কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়¾এমন কিছু, যা মানুষকে বার্তাও দিবে। আমি চাই দর্শক চলচ্চিত্র দেখে বাড়ি ফিরে ভাবুক তারা আসলে কী দেখলো।
আ অ্যান্ড ই : এখন পর্যন্ত আপনার কোন অর্জনটাকে সবচেয়ে বড়ো মনে হয়?
মোহাম্মদ : ব্যক্তিগত জায়গা থেকে বললে, আমার ২০-এর কোঠা পার করা, নিজেকে নিয়ে খুশি থাকা এবং ভেতরের শান্তি খুঁজে পাওয়াটাকেই সবচেয়ে বড়ো অর্জন বলে মনে হয়। যখন আমরা বয়সে ২০-এর কোঠায় থাকি, তখন নিজের পরিচয় খুঁজতে সংগ্রাম করতে হয়। এই সময় নিজেকে জানতে এবং নিজের নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে লড়াই করতে কষ্ট হয়। কিন্তু আমার কাছে ৩০-এর কোঠায় পা দেওয়া মানে একদম নতুন জীবন শুরু করা। আমার কাছে মনে হয়, দুটো বয়সের বা সময়ের মধ্যে পার্থক্য একেবারে রাত-দিনের মতো।
চলচ্চিত্রে আমার সবচেয়ে বড়ো অর্জন হলো, আমি যে চলচ্চিত্র দুটোতে কাজ করেছি সেগুলো ‘গোল্ডেন গ্লোবে’র জন্য মনোনীত হয়েছে। এটা আমার কাছে এখনো স্বপ্নের মতো লাগে। এজন্য আমি কখনো কখনো নিজেই নিজেকে চিমটি কাটি! এখন আমার লক্ষ্য অস্কারে মনোনয়ন পাওয়া; ভবিষ্যতে আমি এই অভিজ্ঞতাটা অর্জন করতে চাই। তবে আরবের চলচ্চিত্র এবং হলিউডে কাজ করা আরবদের নিয়ে আমি ভীষণভাবে আশাবাদী। সবদিক থেকে এই বছরটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এই বছর অস্কারে আমি উপস্থিত ছিলাম। সেখানে মিশরীয়-আমেরিকান অভিনয়শিল্পী রামি মালেক (Rami Malek) অস্কার জেতেন। বক্তৃতায় তিনি নিজের অভিবাসনের পটভূমি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসাটা তার জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো তা নিয়ে কথা বলেন; যা ছিলো সত্যিই অনবদ্য! এছাড়াও লেবানিজ নির্মাতা নাদিন লাবাকি (Nadine Labaki) তার ক্যাপারনাউম (Capernaum) চলচ্চিত্রের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। এতেই বোঝা যায়, মধ্যপ্রাচ্যেও অনেক প্রতিভাবান রয়েছে। একজন আরবীয় হিসেবে সেখানে থাকতে পেরে সত্যিই আমার খুব ভালো লেগেছিলো!
আ অ্যান্ড ই : জীবনে আপনার সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ কী ছিলো?
মোহাম্মদ : জীবনে চ্যালেঞ্জের অভাব ছিলো না! তবে আমার সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ ছিলো একান্তই ব্যক্তিগত¾আমি বরাবরই একটু অধৈর্য প্রকৃতির মানুষ। এই বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনের জন্য বহু বছর কষ্ট করতে হয়েছে। আমি ধৈর্য ধারণ করতে শিখেছি ধাপে ধাপে।
আ অ্যান্ড ই : আপনাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করে কারা?
মোহাম্মদ : অনুপ্রেরণা অনেকের থেকেই পেয়েছি। তবে যারা গভীরভাবে আমাকে প্রভাবিত করেছে, তারা হলো আমার মা-বাবা। তাদের জীবনদর্শন, পরিশ্রম আর ভালোবাসা আমাকে সবসময় পথ দেখিয়েছে।
আ অ্যান্ড ই : আপনার ব্যক্তিগত মোটো কী?
মোহাম্মদ : সত্যি বলতে, সময়ের সঙ্গে মোটো বদলেছে। তবে আমি মনে করি, অসম্ভব বলে কিছু নেই। এবং আমি এই নীতিতে বিশ্বাসী যে¾‘আগামীকাল একটি নতুন দিন’। আপনার জীবনের যদি কোনো খারাপ সময় আসে¾তা চাকরি, সম্পর্ক বা আর্থিক যাইহোক না কেনো, শেষ পর্যন্ত একটা সময় আসে যখন আর কিছুই করার থাকে না। সেক্ষেত্রে আমি বলি, ঘুমিয়ে যাও, আগামীকাল নতুনভাবে শুরু করো।
আ অ্যান্ড ই : আর আপনার পেশাগত মোটো?
মোহাম্মদ : স্থির থাকা, লেগে থাকা¾এমনকি সেটা কখনো কখনো বিরক্তিকর মনে হলেও।
আ অ্যান্ড ই : এখন যদি আপনার ছোটোবেলার নিজেকে উপদেশ দিতে পারতেন, তাহলে সেটা কী হতো?
মোহাম্মদ : সত্যি বলতে কোনো উপদেশ দিতাম না। আমি বিশ্বাস করি, জীবনে যা কিছু ঘটে ভালো কিংবা খারাপ, সেগুলো সবই আমাদের মানসিকতা গঠন ও বেড়ে উঠতে ভূমিকা রাখে। আমি আজকে যে মানুষ, সেটা আমার সব অভিজ্ঞতারই ফল। কিন্তু এটুকু বলতেই হয় আমি আবার ২০ বছর বয়সের সময়টাতে ফিরতে চাই না!
আ অ্যান্ড ই : এখন থেকে ১০ বছর পরের নিজেকে আপনি কী বলতে চাইবেন?
মোহাম্মদ : ১০ বছর আগে আমি কল্পনাও করতে পারতাম না, আজ যেখানে আছি সেখানে থাকবো! তাই নিশ্চিত ১০ বছর পরে যা ঘটবে, তাতে আমি অবাকই হবো। আরো বুঝতে পেরেছি, যখন ছোটো ছিলাম তখন আমি ভবিষ্যতের কথা এমনভাবে বলতাম, যেনো তা অনেক দূরের বিষয়। সময় সত্যিই খুব দ্রুত চলে যায়। এটা সত্যিই অবাক করার মতো বিষয়!
আ অ্যান্ড ই : আপনার ব্যক্তিগত স্টাইল সম্পর্কে যদি বলতেন?
মোহাম্মদ : আমি একটু ক্লাসিক ঘরানার। সাধারণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাকই আমার পছন্দ। ছোটোবেলায় আমি ছেঁড়া জিন্স ও ব্র্যান্ডের পোশাক পছন্দ করতাম। সময়ের সঙ্গে সেই পছন্দ বদলেছে। লোগোওয়ালা জিনিস ব্যবহার করা এখন আমি একদম ছেড়ে দিয়েছি। আরামদায়ক কটন বা লিনেন এখন আমার প্রথম পছন্দ। স্টাইলের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা বলতে হলে বাবা ও আমার প্রয়াত চাচার কথা স্বীকার করতেই হবে। ছোটোবেলায় আমরা ভাইবোনেরা চাচাকে ‘দ্য ডন’ বলতাম। তিনি সবসময় থ্রি পিস স্যুটে থাকতেন, যেনো দ্য গডফাদার-এর সেট থেকে এসেছেন! তাই রেড কার্পেট ইভেন্টের জন্য রেডি হওয়ার সময় আমি সবসময় তার সেই ইমেজকেই সামনে রাখি¾ক্লাসিক ও এলিগ্যান্ট সৌন্দর্য তুলে ধরার জন্য।
আ অ্যান্ড ই : একটু বলবেন, আপনি কোন কোন ক্ষেত্রে না বলেন?
মোহাম্মদ : ‘না’ বলা শেখাটা আমার জন্য বেশ নতুন একটা বিষয়। গত কয়েক বছর ধরে নিজেকে রক্ষার কৌশল হিসেবে আমি এটা শিখেছি। আমি এমন অনেক কিছুতেই ‘হ্যাঁ’ বলেছি, যেগুলোতে ‘না’ বলা উচিত ছিলো। কারণ আমি তখন ‘না’ বলতে জানতাম না! কিন্তু এখন আমি যা-ই অস্বস্তিকর মনে করি, তাতেই ‘না’ বলতে পারি।
আ অ্যান্ড ই : এই মুহূর্তে আপনি কী বই পড়ছেন?
মোহাম্মদ : আমি এখন কোনো বই পড়ছি না; তবে একটি স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ করছি।
আ অ্যান্ড ই : বিশ্ব কীভাবে আপনাকে মনে রাখবে বলে প্রত্যাশা করেন?
মোহাম্মদ : এটা অনেক গভীরের প্রশ্ন। তবে আমি চাই বিশ্ব আমাকে ইতিবাচকভাবে স্মরণ করুক। এই অঞ্চলের একজন অগ্রগামী চলচ্চিত্রনির্মাতা হতে পেরে আমি খুবই খুশি ও গর্বিত। এটা এমন একটি বিষয় যা আমাকে আনন্দিত ও বিনয়ী করে। আমার খুব ভালো লাগে এই জন্য যে, আমাকে উদাহরণ হিসেবে দেখা হয়।
যদিও আমি অভিনয়শিল্পী নই, তবুও বিভিন্ন নিবন্ধে পড়েছি, যেখানে লোকেরা আমাকে ‘নতুন যুগের ওমর শরীফ’ [মিশরীয় অভিনয়শিল্পী] বলেছে। আসলে আমি তা নই। তবে এমন তুলনা ভীষণ আনন্দের ও সম্মানজনক। ওমর শরীফ ছিলেন পর্দার এক জীবন্ত কিংবদন্তি। যখন তিনি মারা যান, আমি তার উদ্দেশে একটা শ্রদ্ধাঞ্জলি লিখেছিলাম, ‘বড়ো হওয়ার পর জানতে পারলাম, তার মতো কেউ একজন আছেন, যিনি আমায় স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।’ ওমর শরীফ গন ইন দ্য উইন্ড (১৯৩৯), ড. ঝিভাগো (১৯৬৫) ও ফানি গার্ল (১৯৬৮) এর মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। এই কাজগুলো তিনি করেছিলেন ৫০ ও ৬০-এর দশকেই। তার সেই অর্জন আমাকে শিখিয়েছে¾যদি তিনি (ওমর) এটা পারেন, তবে আমিও পারবো। তাই এটা যদি কাউকে বুঝতে সাহায্য করে¾সৌদি আরবের ছোট্ট একটা শহর থেকে আমি হলিউডে পৌঁছেছি¾তাহলে তারাও পারবে!
রীতা জান্নাত, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্বের শিক্ষার্থী।
jannatulru.mcj@gmail.com
https://www.facebook.com/profile.php?id=100010314337649
সাক্ষাৎকার লিঙ্ক : https://aeworld.com/lifestyle/art/mohammed-mo-al-turki-interview-saudi-arabian-cinema/; retrieved on: 15.03.2025
টীকা
১. Gulf Co-operation Council (GCC), ছয়টি আরব দেশ নিয়ে গঠিত একটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জোট। এটা সৌদি আরবের রিয়াদে অবস্থিত। বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার ও সৌদি আরবের মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বাড়ানোর উদ্দেশ্য ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে জি সি সি গড়ে ওঠে।
২. মারিয়া ক্যারি, আমেরিকান সঙ্গীতশিল্পী, গীতিকার ও প্রযোজক। যাকে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস থেকে `Songbird Supreme’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।
৩. একন, জনপ্রিয় আমেরিকান-সেনেগালিজ সঙ্গীতশিল্পী। ফ্রেঞ্চ মন্টানা, জনপ্রিয় আমেরিকান-মরোক্কান র্যাপার।
৪. সিপ্রিয়ানি, প্রিমিয়াম ইতালিয়ান রেস্টুরেন্ট। এখানে ঐতিহ্যবাহী ইতালিয়ান খাবার পরিবেশন করা হয়। সাধারণত উচ্চবিত্তদের কাছে এটা জনপ্রিয়।
৫. নোজোমি, বিলাসবহুল জাপানি রেস্টুরেন্ট। এই রেস্টুরেন্টটি উচ্চবিত্তের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
৬. Opioid crisis : Opioid ব্যথানাশক ওষুধ। মরফিন, অক্সিকোডোন, ফেন্টানিল, এমনকি হেরোইন এই জাতীয় ওষুধগুলো অনেকেই চিকিৎসার জন্য শুরু করলেও পরে আসক্ত হয়ে পড়ে। Opioid সঙ্কট বলতে এই ব্যথানাশক ড্রাগের অতিরিক্ত ব্যবহার, অপব্যবহার ও এর ফলে ব্যাপকহারে আসক্তি, ওভারডোজ ও মৃত্যু হওয়া সামাজিক ও জনস্বাস্থ্য সঙ্কটকে বোঝায়। এই আসক্তি ও মৃত্যুর হার এতোটাই বেড়ে গেছে যে, এটা এখন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের অন্যতম মৃত্যুর কারণ। এটা যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হলেও অন্যান্য দেশেও লাখ লাখ মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
৭. ফ্লোরিডার আবাসন সঙ্কট : ফ্লোরিডায় বাসস্থান ভাড়া ও বাড়ির মূল্য দ্রুতগতিতে বাড়ছে। যা মানুষের আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর পক্ষে ভাড়া মেটানো কঠিন হয়ে পড়েছে। পর্যটননির্ভর এই অঙ্গরাজ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি আবাসন সুবিধার স্বল্পতা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। বাধ্য হয়ে অনেকে গাড়িতে বা অস্থায়ী জায়গায় বসবাস করছে। সরকার কিছু কর্মসূচি চালু করলেও তা চাহিদার তুলনায় কম। ফলে ফ্লোরিডায় আবাসন সঙ্কট একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন