এ বি এম সাইফুল ইসলাম
প্রকাশিত ০৩ মে ২০২৫ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
নায়িকা সংবাদ : একটি সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
এ বি এম সাইফুল ইসলাম

চলচ্চিত্র নির্মাণ, দেখার কারণ ও তার ফল সবার কাছে একই রকম নয়; অনেকের কাছে হয়তো এর কোনোটারই কোনো মূল্য নেই। নির্মাতার মনের মধ্যে সমাজ, জীবন, পরিবেশ, ব্যক্তি, কল্পনাসহ বিভিন্ন বোধ খেলা করে¾নানাভাবে সেসব তাকে উপাদান জোগায়, অবশেষে চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে। দর্শকও সেখান থেকে শিল্পের আনন্দ, জীবনের জিজ্ঞাসা, কল্পনার রঙ, মোহ, ঐতিহাসিক সত্যতা, সমাজের স্পন্দন পায় এবং পেতেও চায়। তবে দর্শক ও নির্মাতা¾এ দু-পক্ষ সৃষ্টি ও প্রাপ্তির ব্যাপারে সর্বদা সচেতন নাও থাকতে পারে। কোনো নির্মাতার স্পষ্ট ভাবনায় হয়তো শিল্পের তাড়নাই বেশি কাজ করে; তবে সে আন্তরিক ও নিখুঁত হলে সেই তাড়নার সঙ্গে জড়িয়ে যায়¾অন্তত ইতিহাস, সমাজ ও জীবন। দর্শক অবশ্য যদি পরিণত বুদ্ধির তথা একগুঁয়ে হয়, তাহলে সে চলচ্চিত্র দেখে নিজের মন মতো বিষয় বেছে নেয়; অন্য কোনো বিষয় আছে কি না ভাবে না, ভাবতেও চায় না। কিন্তু এর বিপরীত শ্রেণির দর্শকও আছে, যাদের কাছে সামাজিক সত্যের নির্মাণ হিসেবেই চলচ্চিত্রের দাম¾তারা রূপের আনন্দ চায় না; উৎসে সক্রিয় সামাজিকতার সন্ধান করে সেলুলয়েডে প্রতিফলিত বাস্তবতার ছবিতে।
উপরের দু-শ্রেণির দর্শকের বাইরে বহুভোজে তৃপ্তি প্রত্যাশী এক শ্রেণির দর্শকও আছে, যাদের রুচির অজস্র রঙ অথবা যারা সমগ্রতায় চলচ্চিত্রকে ধরতে চায়। তারা শিল্পের ভোগে চিত্ত সরস করে এবং একই পাত্রে জীবনরসও পান করে। দর্শক চলচ্চিত্রের সমাজ-সংশ্লেষ বিষয়ে নির্বাচনপ্রবণ হতেই পারে, কিন্তু নির্মাতার ক্ষেত্রে সচেতনভাবে তা এড়িয়ে যেতে চাইলেও, তার ক্ষেত্রে বাছাইয়ের সুযোগ কম; কেউ সোজাসুজি সামাজিক বিষয়কে চলচ্চিত্রে টেনে আনে-তারা এবং যারা আনে না, তারাও সমাজকে নিজের ব্যক্তিত্বে বহন করে, করতে বাধ্য হয়।
তবে যে কথাটি ভুলে গেলে চলবে না, দর্শক ও নির্মাতার বাইরে চলচ্চিত্রশিল্পে আরেকটা শ্রেণি আছে, যারা চলচ্চিত্র তৈরিতে অর্থলগ্নি করে¾এসব সম্পর্ক-বিষয়কে সংশ্লিষ্ট করে বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি, সংলাপ, চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় নায়িকা সংবাদ (২০১৩) নিয়ে একটি সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে চলমান লেখায়।
২.
নায়িকা সংবাদ মূলত একটি সাসপেন্স-থ্রিলার ধারার চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রটির চরিত্রের ক্রম-উন্মোচন একে শেষ পর্যন্ত উপভোগ্য করেছে। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র দিয়া চ্যাটার্জি। প্রদীপের আলো যেমন স্নিগ্ধ কিন্তু আসলে আগুন, দিয়ার ব্যক্তিত্বও একই রকম আগুনচাপা। নায়িকা বলতে আমাদের সমাজ নির্মিত যে বিষয়গুলো চোখের সামনে ভাসে, তার পুরো লাস্যতা নিয়েই দিয়ার আবির্ভাব পর্দায়। বাস্তব প্রেক্ষাপটের মতোই তার জীবনেও আসে উত্থান-পতন, যার সঙ্গে চলতে থাকে নায়িকা জীবনের আলো ও অন্ধকারের দ্বন্দ্ব। চলচ্চিত্রের শুরুতেই যে নায়িকা নিখোঁজ হয় এবং পুরো চলচ্চিত্রেই দৃশ্যত যিনি অনুপস্থিত¾তা চলচ্চিত্রটির সাসপেন্স বাড়িয়েছে। পুলিশের কাছে খবর পেয়ে নিখোঁজ এ নায়িকার রহস্য উদঘাটনে অনুসন্ধান শুরু করেন সাংবাদিক নিখিল। একপর্যায়ে সাংবাদিকের সঙ্গে দিয়ার সম্পর্ক নতুন মোড় নেয়। এভাবেই স্কুপ সংবাদের মতো চলচ্চিত্রের স্কুপ বিষয়গুলোকেও সুনিপুণভাবে পর্দায় হাজির করতে থাকেন বাপ্পাদিত্য।
তবে উত্তম কুমার ও অঞ্জনা ভৌমিক অভিনীত নায়িকা সংবাদ (১৯৬৭) যেমন একেবারেই বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ; বাপ্পাদিত্যের নির্মাণে অরুণিমা ঘোষ ও ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তের নায়িকা সংবাদ একেবারেই ভিন্ন পথে চলে। যদিও ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের নায়িকা সংবাদ-এর নায়িকা উর্মিতা যেভাবে উধাও হয়, ২০১৩’র দিয়া চ্যাটার্জিও একইভাবে নিখোঁজ হন; কিন্তু ১৯৬৭ থেকে ২০১৩¾এই ৪৬ বছরের ব্যবধানে চলচ্চিত্রশিল্পে যে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে তা হয়ে ওঠে অনেক জটিল। কারণ বিনোদনের বাইরে চলচ্চিত্রের সঙ্গে রাজনীতির যোগসূত্র তখন এতোটা ছিলো না। এমনকি সংবাদপত্রের সম্পাদকরাও কোনো নায়িকার ছবি পত্রিকায় কবে ছাপানো হবে কিংবা হবে না, তা নিয়ে এতো আহ্লাদ করতেন না। আজকে যাকে আমরা সংবাদ বলছি, তখনো সেটা আজকের মতো কেবলই ব্যবসা হয়ে ওঠেনি; প্রযোজকরাও পুঁজির নগ্ন টানে এতোটা ভেসে যাননি। নায়িকা সংবাদ-এ হালের চলচ্চিত্রশিল্পের হালহকিকতের সঙ্গে কে, কেনো এবং কোন সমীকরণে কখন, কোথায়, কী করে, তার স্কুপটা সাধারণের সামনে স্কুপ করেছেন বাপ্পাদিত্য।
নায়িকা সংবাদ-এ বিভিন্ন দৃশ্যে প্রযোজক মি. মল্লিক, সাংবাদিক নিখিল ও নায়িকা দিয়ার সঙ্গে কথোপকথনের সার-সংক্ষেপ হলো¾তাদের অর্থাৎ করপোরেটের ব্যানারে কাজ না করলে কেউ ‘স্টার’ বা ‘সুপারস্টার’ হতে পারে না। আর ব্যবসার সঙ্গে গ্ল্যামারের একটা যোগ আছে, ব্যবসায়ীরা ইনভেস্ট করে বলে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি চলে; এই যুক্তিতে চলচ্চিত্রের শিল্প ও ব্যবসা তারা কোনোটাই বুঝতে চান না। তাদের কাছে চলচ্চিত্রের বাইরে নায়িকাদের একটা অন্য বাজার আছে, সে বাজার থেকেই লগ্নি টাকার অনেক বেশি উঠে আসে¾এই স্কুপের পুরোটায় বাপ্পাদিত্য উদাহরণ হিসেবে হাজির করেন দিয়া চ্যাটার্জিকে; একই সঙ্গে কীভাবে অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তি ঘটে, রাজনীতির সঙ্গে ব্যবসা এবং এর সঙ্গে প্রযোজকদের আন্তঃসম্পর্কগুলো সুন্দরভাবে তুলে এনেছেন।
‘বাণিজ্যিক’ চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়ক বিজিত। তার একটি চলচ্চিত্রের জন্য সাক্ষাৎকার দিতে আসেন দিয়া। তাদের কথোপকথনের একপর্যায়ে নবাগত দিয়াকে লক্ষ্য করে বিজিতকে বলতে শোনা যায়, ‘অন স্ক্রিন কেমিস্ট্রিটা নির্ভর করে, অফ স্ক্রিন বায়োলজির ওপর।’ দিয়াকে শেষ পর্যন্ত বিজিতের কাছে অফ স্ক্রিন বায়োলজিতে উতরে যেতে হয়। ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিষ্ঠিত বিজিত যেভাবে উঠতি নায়িকাদের যৌন ফাঁদে ফেলে, পরে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর একই ফাঁদে উঠতি নায়কদেরকে ফেলেন দিয়া। অন্যদিকে, উঠতি নায়িকাদের সংবাদ প্রকাশেও অর্থ ও অন্যান্য বিষয়ে ছাড় দিতে হয়; যার মাধ্যমে সংবাদপত্রশিল্পের অন্য একটা অধ্যায়ের দিকে ইঙ্গিত করেন বাপ্পাদিত্য।
৩.
‘দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নায়িকা সংবাদ নিয়ে বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য এমন¾
দেখুন কোন ব্যক্তিগত আক্রমণ আমার ছবিতে নেই। সিস্টেম নিয়ে কথা বলেছি। সেটার নানা দিক তুলে ধরেছি। আর আমার ছবিতে বরাবরই সমাজের নানা দিককে তুলে ধরা হয় ... যেটা সত্যি সেটা বলেছি ... দেখুন আমি বিশ্বাস করি সামাজিক বিষয় নিয়ে তৈরি ছবি সমসাময়িক লোকজন কখনও নিতে পারেন না। ... এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ ঋত্বিক ঘটক। উনি যখন ছবি বানাতেন কেউ বুঝতেই পারতো না তিনি কি বুঝাতে চাইছেন ... উনার ছবি বুঝতে ৪০ বছর লেগেছে ...।১
অর্থাৎ নির্মাতার কথা অনুসারে নায়িকা সংবাদ সামাজিক বাস্তবতার রূপায়ণ। ৬০-এর দশকে মুক্তি পাওয়া নায়িকা সংবাদ-এ চলচ্চিত্রজগতের এ বাস্তবতা অনেকটা অসম্ভব মনে হলেও, বর্তমানে বাপ্পাদিত্য চলচ্চিত্র দিয়ে যে স্কুপগুলো চিত্রায়ণ করেছেন তা বিক্ষিপ্ত বা রহস্য কিংবা কানাকানির মধ্যে সীমিত থাকলেও, সাধারণের কাছে সেটা দেখানোর সাহস ও বুদ্ধিমত্তা দেখিয়েছেন তিনিই।
সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে সাধারণত যে ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, তার মধ্যে অন্যতম কেস স্টাডি। নায়িকা সংবাদকে কেস ধরে এখানে এর সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে। আর নমুনা পদ্ধতি হিসেবে যৌথভাবে ব্যবহার করা হয়েছে বিবর্তনবাদী ও কাঠামোগত-ক্রিয়াবাদী মডেল। বিবর্তনবাদী মডেল অনুসারে সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে, এ বিশেষ মডেলকে একটি আদর্শ হিসেবে ধরে, সমগ্র সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। আর কাঠামোগত-ক্রিয়াবাদী মডেল অনুসারে সমাজব্যবস্থার কোনো একটি অংশের পরিবর্তন হলে অন্যান্য অংশে শুধু এর প্রভাব দেখা যায় তা নয়, সামগ্রিক সমাজে এর পরিবর্তন হয় বলে ধারণা করা হয়।
৪.
সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার তুলনায় সমাজতত্ত্ব একটি কনিষ্ঠ বিজ্ঞান। সমাজ নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তা-ভাবনার সময়কাল নির্দিষ্ট করে জানা না গেলেও, প্রাচীন গ্রিক সমাজ থেকেই ধারাবাহিকভাবে সমাজ সম্পর্কিত আলোচনার সূত্রপাত লক্ষ করা যায়। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো ও অ্যারিস্টটল সমাজ সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করেছেন; এদের চিন্তা-ভাবনাই সমাজতত্ত্বের পরবর্তী ক্রমবিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ‘সমাজতত্ত্বই একমাত্র বিজ্ঞান যা সামাজিক সম্পর্কসমূহ এবং সমাজ সম্পর্কে অধ্যয়ন করে।’২ অর্থাৎ সমাজতত্ত্বের বিষয়বস্তু হচ্ছে সমাজ ও সামাজিক সম্পর্ক। সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্র সমাজের খণ্ডিত অংশ নিয়ে আলোচনা করে। অন্যদিকে সমাজতত্ত্ব সমাজের সামগ্রিক দিক সম্পর্কে আলোকপাত করে। সমাজতত্ত্ব মানুষের সমগ্র সমাজব্যবস্থা¾যেমন : অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি, পরিবার, অবসর, বিনোদন ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করে। এছাড়া সমাজের বিবর্তন, পরিবর্তন ও এর কারণ; বিভিন্ন সমাজিক প্রতিষ্ঠান, এগুলোর কাঠামো ও কার্যাবলি, এদের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং এদের আন্তঃসম্পর্ক সমাজতত্ত্বের আওতাভুক্ত।
বাপ্পাদিত্য নায়িকা সংবাদ-এ দেখানোর চেষ্টা করেন চলচ্চিত্র কীভাবে করপোরেট পুঁজির নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। যে করপোরেটের আওতায় চলচ্চিত্র নির্মাণ ও জনপ্রিয় করার অন্যতম দুটি ইস্যু¾প্রযোজনা ও মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ। প্রযোজক ও গণমাধ্যম কীভাবে চলচ্চিত্রশিল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তার বাস্তব উদাহরণ নায়িকা সংবাদ। এখানে সব অনিয়মই নিয়ম। পুঁজি ও ক্ষমতার একটা সম্পর্ক আছে; তাই কোন চলচ্চিত্রে কোন নায়িকা নির্বাচন করা হবে, এটা যেমন প্রযোজক নির্ধারণ করে, একইভাবে সুপারস্টার বিজিত এবং একপর্যায়ে দিয়াও তাতে ভূমিকা রাখে। এখানে প্রযোজকের ক্ষমতার উৎস টাকা, আর বিজিত ও দিয়ার ক্ষমতার উৎস জনপ্রিয়তা; কারণ জনপ্রিয়তার আরেক নামও টাকা-ই।
মানুষের ওপর ক্ষমতার শ্রেণিকরণ করা যায়, ব্যক্তি সমষ্টিকে প্রভাবিত করার উপায় বিবেচনা করে; কিংবা কী ধরনের সংগঠন কাজ করছে তার স্বরূপ বিচার করে। বার্ট্রান্ড রাসেল তার ‘ক্ষমতা’ গ্রন্থে বিষয়টা বলেন এভাবে¾কোনো ব্যক্তিকে প্রভাবিত করা যেতে পারে¾ক. তার দেহের ওপর সরাসরি ক্ষমতা প্রয়োগ করে, যেমন : তাকে কারারুদ্ধ বা খুন করে (নায়িকা সংবাদ-এর শারীরিক যৌনক্রিয়া); খ. উৎসাহিত করার জন্য পুরস্কার কিংবা শাস্তি প্রদান করে, যেমন : কোনো কাজে নিয়োগ বা বরখাস্ত করে (অ্যাওয়ার্ড বা অভিনয়ের সুযোগ করে দিয়ে); গ. একজনের মতামতকে প্রভাবিত করে, প্রসারিত অর্থে একে প্রচারণা বলা যেতে পারে (নায়িকা সংবাদ-এ গণমাধ্যমে ব্যক্তির প্রচার বা চলচ্চিত্রের প্রচার)।৩ নায়িকা সংবাদ-এ দিয়ার ওপর সুপারস্টার বিজিত বা প্রযোজক মল্লিক এবং রাজনৈতিক নেতা, যথাক্রমে ‘ক’ ও ‘খ’ পয়েন্ট অনুসারে ক্ষমতা প্রয়োগ করে; এবং পত্রিকার সম্পাদক ক্ষমতা প্রয়োগ করে ‘গ’ পয়েন্ট অনুসারে। অন্যদিকে ‘ক’ ও ‘গ’ পয়েন্ট অনুসারে সুরজিত ও অনুরাধার ওপর নায়িকা দিয়া ও সম্পাদক ক্ষমতা প্রয়োগ করে। সাধারণত উল্লিখিত ক্ষমতার এ রূপ জীবজন্তুর ক্ষেত্রে ব্যবহƒত হয়৪, কিন্তু নায়িকা সংবাদ-এ তথা চলচ্চিত্রশিল্পে অত্যন্ত নগ্নভাবে অতি সহজে এর ব্যবহার লক্ষণীয়।
বিবর্তনবাদী মডেল অনুযায়ী, মানুষ ও সমাজ একটি নির্দিষ্ট ধাপের ভিতর দিয়ে আরেকটি নির্দিষ্ট জটিল ধাপে বিবর্তিত হয়, পরিশেষে একটি নতুন সুনির্দিষ্ট ও চূড়ান্ত ধাপের দিকে অগ্রসর হয়।৫ নায়িকা সংবাদ-এ দেখানো হয় কীভাবে চলচ্চিত্রশিল্পে আসা নতুন শিল্পীরা একটি নির্দিষ্ট ধাপের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয়। উদাহরণ হিসেবে নায়িকা দিয়া ও নায়ক সুরজিতের কথা বলা যায়। দিয়া যখন অখ্যাত, তখন দিয়াকে এই ধাপ অতিক্রম করতে হয়; অন্যদিকে দিয়া যখন বিখ্যাত, তখন সুরজিতকে অতিক্রম করতে হয় একই ধাপ।
বিবর্তনবাদী মডেলের আরেকটি ধরন হলো ‘আবর্ততত্ত্ব’। আবর্ততত্ত্বের প্রবক্তারা বলেন, সমাজ চক্রাকারে কয়েকটি ধাপের মধ্য দিয়ে এক বা একাধিক বার বিবর্তিত হয়ে থাকে। ইতালিয় সমাজতত্ত্ববিদ প্যারেটো’র মতে, সমাজ সবসময়ই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত¾এলিট ও নন-এলিট। একটি অভিজাত শ্রেণির পতনের সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি বিশেষ অভিজাত শ্রেণি সমাজ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে থাকে।৬ এই স্তরবিন্যাস সামাজিক ব্যাপার, প্রাকৃতিক নয়; সমাজভেদে আলাদা হলেও সব সমাজেই এর অস্তিত্ব বিদ্যমান এবং সংস্কৃতি এই স্তরবিন্যাসকে প্রতিফলিত করে। দিয়ার উত্থানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য; দিয়াকে প্রথমে সুপারস্টার বানায় বিজিত এবং পরবর্তী সময়ে মল্লিক গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনা করে।
কাঠামোগত-ক্রিয়াবাদী মডেল জীবদেহের সঙ্গে সমাজদেহের তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করলেও, এ মডেল ব্যক্তি অথবা দলের পরিবর্তে সমাজ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে।৭ প্রতিটি নতুন প্রজন্মের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের সদস্যদের মধ্যে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগলেও, সমাজ-জীবন শত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পরিচালিত হয়; কারণ সমাজ কিছু নির্দিষ্ট পন্থার মাধ্যমে চাহিদা পূরণ করে, যা সংগঠিত জীবনের পূর্বশর্ত বা ফলাফল। এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী দিয়ার যাত্রায় অভিনয় তারই প্রমাণ বহন করে। অন্যভাবে বলা যায়, নতুন প্রজন্মের আবির্ভাবের সঙ্গে সমাজের সদস্যদের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসলেও সমাজ টিকে থাকে এবং সময় মতো সামনে অগ্রসর হয়। দিয়াকে বাদ দিয়ে অনুরাধাকে নিয়ে বিজিতের পথচলা; বিজিতের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সুরজিতের সঙ্গে দিয়ার পথচলা বা দিয়াকে বাদ দিয়ে সুরজিতের তিথি মুখার্জির সঙ্গে সামনে এগিয়ে যাওয়ার খেলা পরিবর্তিত সমাজে টিকে থাকার লড়াই¾যা কাঠামোগত-ক্রিয়াবাদী মডেলেরই দৃশ্যায়ন।
অন্য কথায়, পরিবর্তনের মাত্রা দিয়ে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে বিশ্লেষণ না করে, একটি নির্দিষ্ট সময়ে এ ইন্ডাস্ট্রি ব্যবস্থা কীভাবে ক্রিয়াশীল আছে এবং কীভাবেই-বা ব্যবস্থাগুলোকে টিকিয়ে রাখছে, সে সম্পর্কিত আধেয় নায়িকা সংবাদ-এ মুখ্য বিষয় হিসেবে দেখানো হয়। অর্থাৎ একটি বিশেষ সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ধরন, সমাজের নির্ধারিত বিবর্তনবাদী ধাপ নির্ধারিত বা নিয়ন্ত্রিত, তা দেখানো হয়। অন্যদিকে একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠান একটি ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য কীভাবে ক্রিয়াশীল তা পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করেও দেখানো হয়। চলচ্চিত্র বিনোদন থেকে ব্যবসায় পরিণত হয়েছে; একই সঙ্গে সেই ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখতে বিভিন্ন অনুঘটক এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ে। চলচ্চিত্র-নির্মাণে অর্থের উৎস ও সিস্টেম পরিবর্তন হয়েছে; দর্শকপ্রিয় করতে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রচার ও জনসংযোগ; তার মাত্রাও দিন দিন পরিবর্তন হচ্ছে। সামনের দিনে এর সঙ্গে নতুন কিছু হয়তো যুক্ত হবে, কিন্তু চলচ্চিত্র হচ্ছে এবং হবেই।
তবে উভয় ক্ষেত্রে সামাজিক বিবর্তনে রাজনৈতিক দর্শনের প্রভাব সব সমাজের মতো চলচ্চিত্রেও বিদ্যমান। কার্ল ম্যানহাইমের মতে, ‘সভ্যদেশ মাত্রে সমাজতত্ত্ব একটি লাভজনক ব্যবসা।’৮ এ কথা শুধু উন্নত বিশ্ব যেমন অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশকে নিয়ন্ত্রণ করে, এক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়; অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে যারা অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে¾তাদের ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য। অর্থাৎ সামাজিক সম্পর্ক ও সমাজের সিস্টেমকে যে পরিচালনা করে, সেই সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রেও আলাদা কিছু নয়। বাপ্পাদিত্য তার নায়িকা সংবাদ-এ চলচ্চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রে সামাজিক ও অর্থনৈতিক আয়তনে তা অনেকটা দৃশ্যমান করতে সক্ষম হয়েছেন।
সমাজ বিবর্তনের কথা বলতে গিয়ে হারবার্ট স্পেনসার বলেছেন, সমাজের বিবর্তন হলো, সরল ব্যবস্থা থেকে জটিল ব্যবস্থায় রূপান্তর। আর এই বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতিও যৌগিক বা মিশ্র রূপ ধারণ করে।৯ আর চলচ্চিত্র হচ্ছে সংস্কৃতির একটি অন্যতম উপাদান। মার্কসের চিন্তায় সংস্কৃতি থাকে উপরিকাঠামোয়, যার চরিত্র উৎপাদন পদ্ধতি ও উৎপাদন সম্পর্কের দ্বারা নির্ধারিত হয়। বাপ্পাদিত্য সেটাই দেখানোর চেষ্টা করেছেন এভাবে¾চলচ্চিত্রে কে অভিনয় করবে তা নির্ধারণের মতো, কে জনপ্রিয় হবে, কে ফ্লপ করবে এবং তার মাধ্যমে লগ্নিকৃত পুঁজি ফেরত আসবে কি না¾তা উৎপাদন পদ্ধতি ও উৎপাদনের সম্পর্কই নির্ধারণ করছে। চলচ্চিত্রের উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদনকারীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সম্পর্ক একযোগে চলচ্চিত্রের আর্থিক বুনিয়াদকে নির্ধারণ করে। আর প্রত্যেক আর্থিক বুনিয়াদেরই পরিপূরক উপরিকাঠামো বা সংস্কৃতি।
৫.
নির্মাতা চলচ্চিত্রে তার অনুভূতি ও চেতনাকে প্রকাশ করেন; কিন্তু এর বৃহত্তম উপাদান হলো জীবন। জীবনকে তিনি যে কেন্দ্র থেকে উপলব্ধি করেন, তাকেই তিনি প্রকাশ করেন সেলুলয়েডের মাধ্যমে। শিল্পের সবচেয়ে বড়ো গুণ হলো প্রতিফলন¾যার অনুধাবনে শিল্প বিচার করা হয়। এ প্রেক্ষাপটে বাপ্পাদিত্য ও নায়িকা সংবাদ-এর শিল্পের স্বরূপ সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলা যায়, সমাজের কাঠামো ও ক্রিয়ার মধ্যকার পরিবর্তনকে নিখুঁতভাবে দেখাতে সক্ষম হয়েছেন নির্মাতা।
সমাজ পরিবর্তিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ কীভাবে পরিবর্তিত হয়¾এই পরিবর্তন সমাজের ভিতরের স্বরূপ ও তার বাইরের আঙ্গিককে দৃশ্যমান করেছে। একই সঙ্গে সমাজের সদস্যদের জৈবিক অবস্থার পরিবর্তন, নতুন নতুন অনুঘটকের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার প্রবণতা, চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধের উদ্দেশ্য ও আদর্শের ভিন্নতা দেখা যায়।
লেখক : এ বি এম সাইফুল ইসলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ান।
mon_mcru@yahoo.com
তথ্যসূত্র
১. http://goo.gl/pPQHKf; retrieved on 13.11.2015
২. আলি, এ. এফ. ইমাম (১৯৯২ : ১১-১২); সমাজতত্ত্ব; সেন্টার ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ, ঢাকা-রাজশাহী, কথাকলি, চট্টগ্রাম।
৩. রাসেল, বার্ট্রান্ড (২০১১ : ২৭); ক্ষমতা; অনুবাদ : আরশাদ খান আজিক; অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা।
৪. প্রাগুক্ত; রাসেল, বার্ট্রান্ড (২০১১ : ২৮)।
৫. প্রাগুক্ত; আলি, এ. এফ. ইমাম (১৯৯২ : ৬৩)।
৬. প্রাগুক্ত; আলি, এ. এফ. ইমাম (১৯৯২ : ৬৩)।
৭. প্রাগুক্ত; আলি, এ. এফ. ইমাম (১৯৯২ : ৬৭)।
৮. ম্যানহাইম, কার্ল (২০১৫ : ২৩); সংস্কৃতির সমাজতত্ত্ব; ভাষান্তর : বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর; অনন্যা, ঢাকা।
৯. করিম, নাজমুল (১৯৯৩ : ৬৬); সমাজবিজ্ঞান সমীক্ষণ; নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন