Magic Lanthon

               

আ-আল মামুন

প্রকাশিত ৩০ জানুয়ারী ২০২৫ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

‘শাহবাগ মুভমেন্ট দেখে যে থিসিস ফর্ম করেছিলাম, এবার প্রায় সেই ঘটনাটাই ঘটেছে’

আ-আল মামুন


সাত বছর আগে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষক, গবেষক ও অ্যাক্টিভিস্ট আ-আল মামুনের সঙ্গে একটা আলাপ করেছিলাম। সেটা ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ পত্রিকায় দুই পর্বে প্রকাশিত হয়েছিলো। পরে ‘ম্যাজিক লণ্ঠন প্রকাশন’ থেকে ‘রাষ্ট্র গণমাধ্যম ও জঙ্গিবাদ’ নামে পুস্তিকাও প্রকাশিত হয়। ওই আলাপে নেশনের ধারণা, সেক্যুলার ও রিলিজিয়াস পরিসরের বাইনারি রাজনীতি, জঙ্গিবাদী তৎপরতা, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের অর্থনীতি, ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে কথা হয়। এছাড়া শাহবাগ আন্দোলনের খুঁটিনাটি ও হলি আর্টিজান হামলার পূর্বাপর ও পশ্চিমা গণমাধ্যমে এর উপস্থাপনা নিয়েও আলোচনা হয়।

যে ধরনের অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে ওই আলাপ আমরা করেছিলাম, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুতই পরিবর্তিত হচ্ছিলো। এই পরিস্থিতিতে আমরা আরেকটি আলাপের কথা ভেবেছিলাম ‘রাষ্ট্র গণমাধ্যম ও জঙ্গিবাদ’ পুস্তিকার একটি পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশের জন্য। সময় ও সুযোগের অভাবে সেটা আর হয়ে উঠছিলো না। এর মধ্যেই ঘটে যায় অভূতপূর্ব এক গণঅভ্যুত্থান। ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাই গণঅভ্যুত্থান একরকম আমাদেরকে বাধ্য করে নতুন করে এই আলাপে বসতে।

সেক্যুলার ও রিলিজিয়াসের বাইনারি রাজনীতি, বাংলাদেশে যার প্রকাশ শাহবাগ ও শাপলায়—এই বাইনারি ভেঙে কীভাবে এতো বড়ো একটা আন্দোলন সফল হলো; আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলো তা এই সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে। যেকোনো অভ্যুত্থানের ফলাফল সমাজে থেকে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জুলাই অভ্যুত্থান সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সর্বোপরি গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে কতোটা ভূমিকা রাখবে? বাংলাদেশে ইসলামপন্থি রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী? এসব বিষয়ও আলাপে গুরুত্বসহকারে উঠে এসেছে। সঙ্গে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ‘গণবিরোধী’ ভূমিকা এবং ভারতীয় গণমাধ্যমে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের উপস্থাপন ও প্রোপাগান্ডা নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।

আ-আল মামুনের সঙ্গে ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ এর পক্ষ থেকে গত ২২ ও ২৩ নভেম্বর ২০২৪-এ আলোচনায় অংশ নেন জাহাঙ্গীর আলম। চলতি সংখ্যায় এই আলোচনার প্রথম কিস্তি প্রকাশ করা হলো।


ম্যাজিক লণ্ঠন : আগের আলাপে আপনি বলেছিলেন, শাহবাগ আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে কারণ রাষ্ট্র ও সমাজ ইসলামের প্রশ্ন ডিল করতে পারে নাই। তাহলে জুলাই অভ্যুত্থানে রাষ্ট্র ও সমাজে ইসলামের প্রশ্ন কীভাবে ডিল হলো? নাকি আদৌ ডিল হয়নি। আপনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ যদি সামনে এগিয়ে যেতে চায় তবে একটা নেগোসিয়েশন হতেই হবে।

আ-আল মামুন : ধন্যবাদ। একটা মুভমেন্ট নিয়ে কথা বলেছিলাম, যেটা ২০১৩ সালের শাহবাগ মুভমেন্ট। কিন্তু, এখন এমন একটা মুহূর্তে বসেছি, যখন তুমুল একটা গণঅভ্যুত্থান ঘটে গেছে, যেখানে একটা ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হয়েছে। অনেকেই দাবি করেন, ২০১৩ সালের ঘটনাপ্রবাহ মূলত এই ফ্যাসিজম ডেভেলপড করার ক্ষেত্রে বড়ো ভূমিকা রেখেছে। ফলে, এ সময়ের এই আন্দোলন দারুণ ইন্টারেস্টিং অধ্যয়নের একটা বিষয় হয়ে উঠেছে। 

আমি খুব ফ্যাসিনেটেড, ২০১৩ সালে শাহবাগ মুভমেন্ট দেখে যে থিসিস ফর্ম করেছিলাম, এবার প্রায় সেই ঘটনাটাই ঘটেছে। বলেছিলাম বিয়ন্ড বাইনারি এক থিসিসের কথা; শাহবাগ ও শাপলার বাইনারি থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের আত্মসত্তার রাজনীতি ভাবতে হবে। তোমার মনে থাকার কথা শাহবাগে প্রথম যে স্লোগান বেশি পপুলার ছিলো—‘আমি কে, তুমি কে? বাঙালি, বাঙালি’। এই ‘বাঙালি’ খুব আনক্রিটিকাল একটা ধারণা হিসেবে চর্চিত হয়েছে। বাঙালি ধারণাটা এমন একটা কালচারাল ফর্মেশন, যার বাইরে থেকে গেছে এই অঞ্চলের বাংলাভাষী মুসলিম মানুষজন। এরা সবসময় বাঙালি বর্গের বাইরে থেকে গেছে। ফলে ‘আমি কে, তুমি কে? বাঙালি, বাঙালি’, এই স্লোগান একাত্তর সালে রিলেভেন্ট থাকলেও কিন্তু ২০১৩ সালে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। তখন ‘একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে ওঠো আরেকবার’ এ রকম স্লোগান দেওয়া হয়েছিলো।

এই যে এসেন্সিয়াল একটা বাঙালি ক্যাটাগরি—এর বিরুদ্ধে শাপলাতে আরেকটা স্লোগান বারে বারে উচ্চারিত হয়েছিলো—‘আমি কে, তুমি কে? মুসলমান, মুসলমান’। তারাও বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়েই গিয়েছিলো। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, বাঙালি মুসলমান একটা ক্রাইসিস হিসেবে থেকে গেছে—যেটার সল্যুশন ঘটেনি তাত্ত্বিক পর্যায়ে।

২০১৩ সালে আমরা দেখলাম, এটা পুরনো একটা ক্রাইসিস, আর্টিফিসিয়াল একটা ক্রাইসিস; যা তৈরি করা হয়েছিলো ১৯ শতকের রাজনীতিতে। ১৯ শতকে যেভাবে বাঙালি বর্গকে কনস্ট্রাক্ট করা হলো, নির্মাণ করা হলো, সেটা ২০ শতকে কন্টিনিউ করা হয়েছে। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ এবং ’৭১ ওই বাঙালি ধারণাকে অ্যাডাপ্ট করেছে। ’৭১-এ এটার প্রাসঙ্গিকতা হয়তো ছিলো, যখন পাঞ্জাবি, উর্দুভাষী ‘অপর’ আমাদের শাসন করছে। ’৭১-এর পর থেকে বাঙালি বর্গ এমন একটা ডেফিনেশন তৈরি করতে থাকে যেখানে প্রগতিশীলতা মানে বাঙালিয়ানা—যেটা রিপ্রেজেন্ট করে শাহবাগ। আর শাপলা রিপ্রেজেন্ট করে ইসলাম এবং এ রিলেটেড যতো ধারণা। ২০১৩ সালের আন্দোলন এই বাইনারি আরো গভীর করে তোলে। জাতীয় সংহতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এটা একটা ফেইলর। এখানে মেজোরিটি বাঙালি মুসলমান। এই যে দুটি বর্গে ভাগ করে ফেলছি—বাঙালি বনাম মুসলমান—এটা কিন্তু ১৯ শতকের নির্মাণ। বাঙালি কনস্ট্রাকশনের কারণেই এটা ঘটেছে। এটার একটা রেজ্যুলেশন হওয়ার দরকার ছিলো। এর পরে যে আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে, মুসলিম আইডেন্টিটি ও ইসলামের প্রশ্ন আমরা ’১৩ সালে ডিল করতে পারিনি, সেটার একটা রিপারকেশন সোসাইটির মধ্যে ছিলো। ফিলোসফিকালি বা যদি অন্যভাবেও বলি, মানুষ আসলে সেক্যুলার ও রিলিজিয়াস, দুই বর্গেই বাস করে। ২০১৩ সালের থিসিসে বলেছিলাম, বিয়ন্ড বাইনারির কথা অর্থাৎ শাহবাগ ও শাপলার মধ্যে সমাধান নেই। সমাধান আছে এর মাঝখানে কোনো একটা পজিশনে। ২০২৪ সালে আমরা দেখবো, ইনফ্যাক্ট এই পজিশন তৈরি হয়েছে। এ সময়ে বাঙালি বর্গ আর গুরুত্বপূর্ণ থাকছে না। মুসলমান বর্গটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আর এই দুটো বর্গ ভেঙেচুরে মানুষ একাকার হয়ে গেছে। এই একাকার হওয়ার ফলে বিভিন্ন ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষের পার্টিসিপেশন হয়েছে। যদি তারা বাঙালি বর্গে বসে থাকতো, যদি ইসলামকে একমাত্র বর্গ ভাবতো, তাহলে ২০২৪ সালের ঘটনা ঘটা সম্ভব ছিলো না। বরং গণতন্ত্র ও বৈষম্যহীন সমাজের বাসনা থেকে বাঙালি ও মুসলমান বর্গটাকে তারা ভেঙেছে; এক জায়গায় নিয়ে এসেছে—এটাই ২০২৪ সালের বিশিষ্টতা।

আমরা যদি ভাবি, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট একটা মোমেন্ট। বহুকাল আগে থেকে এর ফর্মেশনটা ঘটছে এবং আগস্টের ৫ তারিখে ঘটনাটা ঘটলো। এটা বাঙালি ও মুসলমান বাইনারির বাইরে এসে ঘটেছে। এটাও ধরে নিতে হবে মানুষ তার পলিটিক্স ও স্বার্থ বিবেচনায় রাখে। ফলে ওই মুহূর্তে যে বিয়ন্ড বাইনারি ইডিওলজি; বিয়ন্ড বাঙালি ও মুসলমান প্রশ্ন নেগোশিয়েট করেছে, সেক্যুলারের প্রশ্ন নেগোশিয়েট করেছে। কিন্তু ওই মুহূর্তটাও যে ভবিষ্যতে একই রকম থাকবে এমনটা আশা করা যায় না। বরং একটা গণআন্দোলনের মুহূর্ত আমরা কীভাবে ডিফাইন করছি, কীভাবে স্ট্রাগল করছি, তার ওপর নির্ভর করবে ওই মুহূর্তটা আগামীতে কী রূপ নেবে—আমরা বাইনারির বাইরে থাকতে পারবো কি না? এখনো আশা করি পরিস্থিতি ভালো আছে।

আ-আল মামুনের সঙ্গে আলাপচারিতায় জাহাঙ্গীর আলম     আলোকচিত্রী : সোহাগ আব্দুল্লাহ

ম্যাজিক লণ্ঠন : আহমদ ছফা’র ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ তো অনেক আলোচিত প্রবন্ধ। এতে কি ওই ডিলের বিষয়ে কোনো কিছু আছে?

আল মামুন : এটা খুবই ভালো একটা প্রবন্ধ। সর্বাধিক পঠিত প্রবন্ধ বলা যেতে পারে। যখনই আমরা বাঙালি ও মুসলমান প্রশ্নের কাছে আসি, তখনই এই প্রবন্ধের কথা চলে আসে। বাঙালি মুসলমান ক্যাটাগরি আগেও ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু ছফা এটাকে স্ট্রংলি কয়েনস করেছে। বাঙালি মুসলমানের আলাদা একটা সত্তার কথা ভেবেছে। তবে সেটা তিনি ভেবেছেন একটা সঙ্কীর্ণ অশ্বক্ষুরাকৃতির হৃদের মতো—এই জায়গায় আমার আপত্তি আছে। আরো কয়েকটি জায়গায় আমার আপত্তি আছে। তবে এটা খুবই প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ। এটা নিয়ে আমাদের য়েনগেজ হওয়া দরকার, কথা বলা দরকার।

আসলে সমস্যাগুলো কোথায়? বাঙালি মুসলমান সমাজের মধ্যে যে পশ্চাৎপদতা, এটা তো হিস্ট্রিকালি কনস্ট্রাক্টটেড। ইতিহাসের কিছু ভুল ধারণা এই কমিউনিটির মধ্যে কার্যকর থেকেছে। তার অনেকখানি-ই ছফা বিশ্লেষণ করেছেন। যেটা মুশকিল—এই প্রবন্ধে বাঙালি মুসলমান বর্গে এক ধরনের হীনম্মন্যতা দেখা যাচ্ছে। বস্তুত, এটা ছফার নিজের মধ্যেও সক্রিয় ছিলো। ছফা বলছেন, এ রকম একটা মুহূর্তে প্রবন্ধটা লিখছি, যখন জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেছেন। তিনি একজন নাস্তিক বুদ্ধিজীবী আবুল ফজলকে টুপি পরে হাঁটতে দেখেন। ছফার মনে প্রশ্ন জাগে, যে লোক দুদিন আগেও নাস্তিকতা প্রচার করেছেন, ক্ষমতার পালাবদলে লোভ তাকে পেয়ে বসেছে, সে কেনো ইসলামি প্রোগ্রামে যোগ দিতে টুপি পরে যাচ্ছে? তার মনের যে সঙ্কীর্ণতা, কোনো কিছুতে থিতু হওয়া কিংবা নিজের অবস্থান তৈরি করা—এটা বাঙালি মুসলমান পারে না। এটাই ছফার কথা। আমার মনে হয়, এই যুক্তি খুবই সঙ্কীর্ণ প্রিমাইস-এর ওপর দাঁড়ানো। আমার ধারণা, মুসলমানের মধ্যে অনেক চরিত্র আছে যাদের পজিশন খুবই স্ট্রং ছিলো। আমরা বুঝতে পারি একটা নির্দিষ্ট মুহূর্তে মানে ১৯৭৬ সালে প্রবন্ধটি লেখা। ওই সময়ের মুহূর্তগুলো তাকে বেশ প্রভাবিত করেছে, বিচলিতও হয়তো করেছে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : ফরহাদ মজহার বাঙালি মুসলমান বর্গ ব্যবহার করতে চান না। তিনি যুক্তি দেন, পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু ধর্মাবলম্বী লোকজন নিজেদের বাঙালি পরিচয়ই দেন; বাঙালি হিন্দু বলেন না। তাহলে আমরা কেনো নিজেদের বাঙালি মুসলমান বলবো?

আল মামুন : বাঙালি মুসলমান ক্যাটাগরি পছন্দ না করলেও এটা হাজির থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে এটা কেনো হাজির থাকে? এই প্রশ্ন যদি করি, তাহলে তার উত্তর পেতে হলে—বাঙালি অ্যাজ আ নেশন, অ্যাজ আ ক্যাটাগরি, একটা সার্টেইন কমিউনিটি—এই ধারণাটা কীভাবে তৈরি হলো জানতে হবে। আগে এই ধারণাটিই ছিলো না। কেবল বাংলাভাষী মানুষ ছিলো। কিন্তু বাঙালি বলে সার্টেইন বর্গ, ন্যাশনাল কমিউনিটি—এ রকম ধারণা কবে থেকে তৈরি হলো? এই ধারণার মধ্যে কারা উপস্থিত? বাঙালি ধারণা কালচারাল কনস্ট্রাকশন। যারা কালচারড, তারা নিজেদের বাঙালি বলতেছে। আমরা দেখতে পাবো, হিন্দু উচ্চবর্গীয় লোকজন কলকাতায় বসে বাঙালি বর্গ তৈরি করতেছে। ১৯ শতকে বাঙালি বর্গ তৈরি হচ্ছে। ওই বর্গের মধ্যে নিম্নবর্গের মানুষ প্রায় অনুপস্থিত এবং মুসলমানরা অনিবার্যভাবেই অনুপস্থিত।

বাংলাদেশের বাংলাভাষী বেশিরভাগ মানুষ বাঙালি মুসলমান। কিন্তু তারা বাঙালি বর্গের মধ্যে নেই। হিস্ট্রিকালি এটাই তৈরি হয়েছে—বাঙালি হয়ে ওঠার বিষয়। তুমি দেখতে পাবে, ছায়ানটের স্লোগান ‘সবার আগে বাঙালি হও’। যেনো বাঙালির বিশিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে বৈশিষ্ট্যগুলো মুসলমানদের নেই। মুসলমানকে বাঙালি হয়ে উঠতে হয়। তার মুসলমানিত্ব, ইসলামের অধিকাংশ বৈশিষ্ট্য ছেড়ে বাঙালি হতে হচ্ছে। বাঙালির এই কনস্ট্রাকশন ঘটেছে হিন্দুত্বের একটা ফ্রেমওয়ার্কে। এসেনসিয়ালি হিন্দু ভদ্রলোক—এরা হচ্ছে বাঙালি, এই কনস্ট্রাকশন ঘটেছে কলকাতায়।

ফলে, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যখন বাঙালি শব্দ বাংলাদেশে ব্যবহার করা হয়েছে, তখন তা খুব সঙ্কীর্ণ একটা ক্যাটাগরি হিসেবে হাজির হচ্ছে। বাঙালি মুসলমান আসলে ঠিকঠাক বাঙালি না। তাহলে বাঙালি হতে হলে কী করতে হবে? ইসলামের যা যা এখানে চর্চিত হয়, বাঙালি মুসলমানেরা চর্চা করে সবকিছু অ্যাভয়েড করে বাঙালি হতে হবে। ফলে এখন তুমি যখন ‘বাঙালি এজ আ ন্যাশনাল কমিউনিটি’ নিয়ে আলোচনা করছো—এর বাইরে রাখা হয়েছে বিশাল জনগোষ্ঠী—তখন বাঙালি মুসলমান বর্গ হাজির করা ছাড়া আলাপ করতে পারছো না। তবে এ কথা বলা যায়, একটা হিস্ট্রিকাল ট্রাজেক্টরি পার হওয়ার পর বাঙালি ধারণাটা হয়তো নরমালাইজড হতে পারে।

আমরা দেখতে পাবো, ’৭১-এ বাঙালি মুসলমানরা নিজেদের বাঙালি দাবি করছে। এর আগে ’৪৭-এ তারা মুসলমান দাবি করেছিলো। ’৭১-এর পরে যে ধরনের রেজ্যুলেশন ঘটানোর দরকার ছিলো, তা হয়নি। ধারণাগত (কনসেপচুয়াল) জায়গা থেকে মুসলমান ও বাঙালি বর্গ যে বাইনারি হয়ে আছে, এটাকে ভেঙে ফেলা দরকার ছিলো। কিন্তু তা হয়নি। ’৭১-এর পরে এই বাইনারি আরো গভীর করে তোলা হয়েছে। সংবিধানে বাংলাদেশের সব মানুষকে ‘জাতি’ হিসেবে বাঙালি বলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের যে ন্যারেটিভ গড়ে উঠেছে তা বাঙালি ‘হয়ে ওঠার’ ন্যারেটিভ এবং তা অ্যান্টি ইসলাম। আর তা আমাদের সিনেমা, উপন্যাস, গল্প, সাহিত্যে নানাভাবে হাজির আছে। এই যে হিস্ট্রিকাল ফেইলর—বাংলাদেশের ফেইলর—এটাকে অ্যাড্রেস করতে হবে। আমার মনে হয়, বাঙালি মুসলমান বর্গ, আপাতত প্রয়োজনীয় বর্গ।

ম্যাজিক লণ্ঠন : ইউরোপে ধর্মের আলোচনা অর্থাৎ থিওলজি’কে দর্শনের আঙিনায় নেওয়া হয়েছে। আমাদের এখানে তা ঘটেনি। এর সঙ্গে কি বাঙালি ও মুসলমান বাইনারির কোনো সম্পর্ক আছে? যে ডিলের কথা বলছিলেন, তার কি কোনো সম্পর্ক আছে?

আল মামুন : আগের প্রশ্নের সূত্র ধরে আরেকটু বলে নিই। এই সঙ্কটটা খুব মুশকিলের সঙ্কট। জাতীয়তার যে নতুন ধারণা তৈরি হলো—ভাবা হলো ভাষা ও সংস্কৃতি আমাদের পরিচয়ের মূল। কিন্তু কথা হলো, ভাষা ও সংস্কৃতি কি ধর্মকে বাদ দিয়ে হয়, আদৌ কোথাও হয়েছে? সংস্কৃতির মধ্যে যদি সবকিছু থাকে, তাহলে ভাষার মধ্যেও তার প্রকাশ ঘটবে। কারণ সংস্কৃতি একা একা কথা বলতে পারে না। তার জন্য ভাষা লাগে। তুমি দেখবে, আমাদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির একটা সার্টেইন ডেফিনেশন এবং স্ট্রাকচার তৈরি হচ্ছে ১৯ শতক থেকে। ১৮ শতকের শেষ নাগাদ যে ভাষা ছিলো, ১৯ শতক থেকে সেটা আর কার্যকরী থাকছে না। বরং একটা পরিশীলিত ভাষা—ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ভাষা সর্বজনীন হয়ে উঠছে। সেই ভাষা ক্রমাগতভাবে ফারসি শব্দ বাতিল করছে। সংস্কৃতকে ভাবা হচ্ছে বাংলা ভাষার মা, যা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। সংস্কৃতিতে মুসলমানের ওনারশিপ নেই। ফলে ধর্মীয় একটা রূপ হিসেবে ভাষা ও সংস্কৃতি হাজির হচ্ছে। এটা সবখানে হয়। কিন্তু যখন ইসলাম প্রসঙ্গ আসে আমরা তা হাইড করে ফেলি। এটাকে আমরা প্রশমিত করে ফেলি। ইসলামের সবকিছুকে বিদেশি বলছি; সংস্কৃতি বলতে পারছি না। হিন্দু ধর্মের সবকিছুকে আমরা সংস্কৃতি গণ্য করছি। একটা ভয়ানক গণ্ডগোল ঘটে যাচ্ছে। আমার যে ভাষা, আমার যে জীবনযাপন, আমার যে চর্চা, তা সিনেমায় হাজির হতে পারছে না। নামাজের দৃশ্য তুমি দেখতে পাচ্ছো না। মসজিদের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছো না। আমার মা যে তসবি গোনে, জায়নামাজে বসে থাকে—এসব দৃশ্য অপ্রগতিশীল মনে হয়। ইসলামও যে ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে হাজির থাকার কথা, সেটা ’৭১-এর পর থেকে ইনটেনশনালি ক্রমাগত ইরেজ করা হয়েছে।

১৯ শতকে কলকাতায় যে বাঙালির কল্পনা ঘটেছিলো, এটাই যদি একমাত্র বাস্তবতা হতো, তাহলে তো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এভাবে হতো না। খুবই পাওয়ারফুল একটা ইমেজ দেখতে পাবে—একজন মুক্তিযোদ্ধা বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্যে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ও পোটলা পাশে রেখে নামাজ পড়ছেন। কিংবা শুক্রবার বিভিন্ন মসজিদে খুতবা পড়া হচ্ছে—মুক্তিযোদ্ধারা যেনো জিতে যায়; আমাদের ছেলেরা যেনো ভালো থাকে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের যে কনস্ট্রাকশন দেখতে পাবে, সেখানে নামাজ দেখতে পাবে না। প্রথম নামাজি মুক্তিযোদ্ধা অ্যাপিয়ার করছে তৌকীর আহমেদ জয়যাত্রায় ও হুমায়ূন আহমেদ শ্যামল ছায়ায়। উপন্যাসের বেলায়ও তুমি অনেকটা একই রকম চর্চা দেখতে পাবে। মুসলমানের জীবনযাপন অ্যাজ আ প্র্যাকটিস—সেটা কালচারাল জগৎ থেকে বহুলাংশেই ইরেজড। মুক্তিযুদ্ধের গল্প থেকে ইরেজড। এগুলো ক্রাইসিস তৈরি করেছে। আমার কল্পনায় আমার পূর্বপুরুষ কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছে? মুসলিম পরিচয়টাকে কীভাবে ডিল করবো তাহলে? ফলে এই ডিবেটগুলো থেকেই গিয়েছিলো। এইগুলোকে নিয়ে আমাদের রেজ্যুলেশনের দিকে যেতে হবে।

এখন পরের যে প্রশ্নটা তুমি করেছো, ইউরোপ অবশ্যই ধর্মের প্রশ্নটা ডিল করেছে। কিন্তু সেটা কীভাবে? ধর্মের প্রশ্নটা কীভাবে তুলবো? মানে ইউরোপে যে ধর্মের প্রশ্ন, ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মের প্রশ্ন ঠিক সেরকম নয়। ইউরোপে যেভাবে চার্চ ও স্টেটের প্রশ্ন হাজির হয়, এখানে কিন্তু মসজিদ-মন্দির ও স্টেটের প্রশ্ন একইভাবে হাজির হয় না। ওখানে চার্চ ও রাজার মধ্যে যে নেগোসিয়েশন তা বহুবিধ যুদ্ধের কারণ হয়ে ওঠে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের প্রশ্ন এখানে একইভাবে হাজির হয়নি।

দ্বিতীয়ত, ধর্মের প্রশ্ন তারা যেভাবে ডিল করেছে—ধর্মের প্রশ্নটা তারা ডিল করেছে বটে, কিন্তু ধর্ম বলতে কী বুঝবো? নতুনভাবে ধর্ম হাজির হচ্ছে, যেটাকে প্রোগ্রেসিভিজম বা সেক্যুলারিজম বলি, সেটা ধর্মকে রিডিফাইন করছে। পুঁজি ইটসেল্ফ একটা ধর্ম হিসেবে হাজির হয়েছে। এখন ইউরোপে পুঁজির বিকাশ এবং আমাদের এখানে পুঁজির বিকাশ একরকম নয়। মালিকানার ধরনও ভিন্ন। ইউরোপের যে ফিউডালিজম—যে ফিউডাল স্ট্রাকচারকে ভেবে আমরা এখানকার প্রবণতা বিশ্লেষণ করেছি, ভেবেছি ওইভাবেই রূপান্তরের স্টেজগুলো হবে। কার্ল মার্কস-ও ভেবেছেন রূপান্তরের স্টেজ হবে—দাস সমাজ থেকে ফিউডাল সমাজ, তার পর ক্যাপিটালিস্ট সমাজ, তার পর সমাজতান্ত্রিক সমাজ—এ রকম কল্পনা করা হয়েছে। আমরা ভেবেছি ওইভাবেই আমাদের এগোতে হবে। কিন্তু পরে তাত্ত্বিকরা দেখতে পাচ্ছেন, ভারতীয় উপমহাদেশে প্রশ্নগুলো একই রকম নয়। রিলিজিয়নের যে ডেফিনেশন দাঁড়িয়েছে, আর ধর্ম বলতে ভারতীয় উপমহাদেশে যা বোঝাতো—এক জিনিস নয়। ধর্ম বলতে অনেক কিছু বোঝায়—একটা কমিউনিটির সদস্য বোঝায়, তার সঙ্গে অনেক কিছু বোঝায়। ইউরোপে রিলিজিয়ন শব্দটা শুধু সুপারন্যাচারাল পরমের প্রতি বিশ্বাসের ধারণা হিসেবে হাজির হয়। ফলে ওখানে ধর্মের প্রশ্ন যেভাবে ডিল করা সম্ভব, এখানে সেভাবে সম্ভব নয়। এখানে নাস্তিকেরও ধর্ম থাকে। চার্বাক—যাকে নিয়ে আমরা এতো কথা বলি—সেই চার্বাকও ধার্মিক। ধর্ম করা ও অধর্ম করা দুই রকমের মিনিং তৈরি করে। ফলে ধর্মের প্রশ্ন ইউরোপে যেভাবে নেগোশিয়েট হয়, এখানে সেভাবে নেগোশিয়েট হওয়ার কথা না। এমনকি ধর্মনিরপেক্ষ বলে যে শব্দ আমরা ব্যবহার করি, সেটাও অনেকখানি প্রবলেমেটিক হয়ে উঠেছে।

এই সময়ে আমার মনে হয়, ইউরোপ যেভাবে ধর্মের প্রশ্ন ডিল করেছে, আমরা আদৌ সেভাবে ডিল করবো কিনা—সেটাও আরেকটা প্রশ্ন। ইউরোপে ওই ডিল করার পরিণতি কী? যে ক্যাপিটালিজমের রাইজ ঘটলো, যে ক্যাপিটালিজম একটা নতুন ধর্ম হিসেবে হাজির হলো এবং ইন্ডিভিজ্যুয়ালও হাজির হলো—যার ধর্ম থাকলো প্রাইভেট স্ফিয়ারে এবং পাবলিক স্ফিয়ারে ধর্ম আসবে না—তারা বললো। কিন্তু আদৌ কোনো দিন কোথাও প্রাইভেট ও পাবলিক স্পিয়ারের এই বিচ্ছেদ ঘটেনি। এমনকি ইউরোপেও ঘটেনি। ইউরোপে প্রাইভেট ও পাবলিক দুই স্পেসে ধর্মের হাজিরা দেখা গেছে। তুমি যদি আমেরিকার সিটিজেন হতে চাও, তাহলে তোমাকে বাইবেল ছুঁয়েই নাগরিকত্বের শপথ নিতে হবে। ইংল্যান্ডের হাউজ অব লর্ডসে এখনো ২৬টি আসন চার্চের জন্য বরাদ্দ।

ম্যাজিক লণ্ঠন : ফ্রান্সের কী অবস্থা?

আল মামুন : ফ্রান্সের সেক্যুলারিজমের চরিত্র আলাদা। কথা হলো, একেক দেশে সেক্যুলারিজম একেক রকম হয়েছে। তাহলে আমরা কোনটাকে অ্যাডাপ্ট করবো? কিংবা আদৌ অ্যাডাপ্ট করবো কিনা। আমার ধর্মের প্রশ্ন আমরা কীভাবে নেগোশিয়েট করবো? আমেরিকায় ধর্মের চর্চাকে অনেক বেশি উৎসাহিত করা হয়। সেখানে ভাবা হয়, ধর্ম সোশাল ইন্সটিটিউশন হিসেবে বিকশিত হবে; ধর্ম একটা এথিকাল রোল প্লে করতে পারবে। কিন্তু ফ্রান্সে একদমই এর উল্টো ভাবা হয়—ধর্ম কোনোভাবেই পাবলিক স্পিয়ারে থাকবে না। এই প্রশ্নগুলো আমাদের এখানে কীভাবে নেগোশিয়েট করবো। আমরা দেখতে পাচ্ছি, মানুষ ধর্ম পালন করে, ধর্মচর্চা করে। তাহলে ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রশ্ন কীভাবে ডিল করবো? এগুলো বড়ো বড়ো প্রশ্ন। আমার ধারণা, আমরা এখন সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি। ধর্মের হিস্ট্রিকাল ট্রাজেক্টরি যেমন ভাবা দরকার, সেইসঙ্গে যে রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে উঠেছে, সেই কাঠামোর সঙ্গে হিস্ট্রিকালি ট্রান্সফর্মড, রিলিজিয়াস প্র্যাকটিস কীভাবে নেগোশিয়েট করবে, সেগুলো নিয়েও ভাবা দরকার। ইউরোপের মতো করে ভাবলে চলবে না। বরং আমাদের মতো করে ভাবা শিখতে হবে। নিশ্চয় ইউরোপ থেকে আমরা অনেক কিছু গ্রহণ করবো। তবে আমাদের ট্র্যাডিশনের সবকিছুই খারাপ, সবকিছুই পশ্চাৎপদ, এমন ভাবার কারণ নেই। এখানকার রাষ্ট্রচিন্তা, সমাজ চর্চার মধ্যে ভালো অংশ কী কী, সেগুলো নিয়ে গবেষণা ও স্টাডি হওয়া দরকার। তখন একটা রেজ্যুলেশনের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে।

এখানে ধর্মের প্রশ্নটাকে নিয়ে প্রবলেম তৈরি করা হয়েছে। ইউরোপ ধর্মের প্রশ্ন সমাধান করেছে, আমরা পারি নাই—এটা একটা স্ইুপিং স্টেটমেন্ট মনে হয়। ইনফ্যাক্ট এখানে আমরা দেখতে পাবো, ধর্মের প্রশ্নটাকে পলিটিকাল করে তোলা হলো। ঔপনিবেশিক চর্চায় এখানে চারটা বর্গ স্পষ্ট করে দেওয়া হলো যাতে আমরা পরিচিত হতে পারবো—হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও মুসলমান। এর বাইরে আর কোনো বর্গ থাকবে না। ১৮৭০ সালের দিকে সেন্সাস হলো। কলোনিয়াল স্ট্যাটিসটিক্সের মাধ্যমে ধর্মকে পলিটিকাল করে তোলা হলো।

জুলাই গণঅভ্যুত্থান ২০২৪ নিয়ে আঁকা গ্রাফিতি     ছবি : ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

ম্যাজিক লণ্ঠন : ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, ইংল্যান্ডে আদমশুমারিতে কে কোন ধর্মের তা উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক ছিলো না।

আল মামুন : তাহলে বুঝতে হবে, এখানে ধর্ম একটা ক্যাটাগরি হিসেবে তৈরি হয়েছে, কলোনিয়াল প্র্যাকটিসের মধ্য দিয়ে। এবং সেটাই কিছুকাল পর থেকে, আমরা যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি দেখতে পাই, হিন্দু একটা বর্গ হিসেবে তৈরি হবে, মুসলমান একটা খুবই স্পষ্ট বর্গ হিসেবে তৈরি হবে—এই দুইটা বর্গ তো আগে এভাবে স্পষ্ট ছিলো না। নেগোসিয়েশন ছিলো, কথাবার্তা ছিলো, লেনদেনও ছিলো। কিন্তু এই যে দুইটা বর্গে ভাগ করলাম এবং এই বর্গ দুইটা তখন পলিটিকালি খুব সক্রিয় হয়ে উঠলো। ফাইনালি এখানে রেজ্যুলেশন যা ঘটলো—ইন আ ওয়ে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত এবং পাকিস্তান দুইটা নতুন রাষ্ট্র তৈরি হলো—ধর্মকে প্রধান মার্কার হিসেবে ধরে। ইভেন বাংলা যে ভাগ হলো সেটাও ধর্মীয় রেখা বরাবর—কোন অংশে হিন্দু বেশি আর কোন অংশে মুসলমান বেশি তার ভিত্তিতে। না হলে তো এভাবে আমাদের মানচিত্র হবার কথা নয়। কলোনিয়াল টাইমের আগে ধর্ম অবশ্যই ছিলো, কিন্তু ধর্মই একমাত্র পরিচয় ছিলো না। এবং ধর্মীয় আইডেন্টিটি পলিটিক্সটা শুরু হয়েছে কলোনিয়াল টাইমের ভেতর দিয়ে। এটা খুব প্রবলেমেটিক ছিলো। যেটা এখনো সচল আছে। এটাকেই ভেঙে নতুনভাবে ভাবতে পারা আমাদের জন্য জরুরি।

ম্যাজিক লণ্ঠন : সাম্প্রতিক জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে যদি বলি। ২০১৮-তে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে কোটা বাতিল হয়েছিলো। তার পর আদালতের মাধ্যমে কোটা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হলে শিক্ষার্থীরা জুন থেকেই এর বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে আন্দোলন শুরু করে। হাসিনা সরকার যেভাবে পরিস্থিতিটা তৈরি করছিলো, যেনো বাঘের পিঠে উঠেছে, ওখান থেকে সে নামতেও পারছে না, আর নামলে নিজেই মরবে। শেখ হাসিনা সরকারের এতো অল্প সময়ে পতন হবে অনেকেই তা ভাবেনি। কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করলো। একপর্যায়ে সরকার পতনের এক দফা হলো। এই আন্দোলনে আপনিও একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন। আপনি ঠিক কখন থেকে তাদের মুভমেন্টে নজর রাখছিলেন?

আল মামুন : ২০১৮’র যে কোটা মুভমেন্ট, ওই মুভমেন্টে যখন নিপীড়ন নির্যাতন চলছে, তাদের রাজাকার এটা-সেটা বলা হচ্ছে, ওই সময়ও আমরা কিন্তু সক্রিয় ছিলাম। ওই সময় আমরা প্রোটেস্ট করেছি।  এবং এখানে যে ছাত্ররা আহত হয়েছে তাদেরকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া, তাদের পক্ষে স্টেটমেন্ট দেওয়া এগুলো করেছি। এই ভায়োলেন্স তো তারা ডিজার্ভ করে না! ফলে এর প্রতিবাদ করা দরকার ছিলো, আমরা করেছি। আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, ওই সময় কিন্তু আরেকটা শক্তিশালী আন্দোলন হয়েছিলো। সে আন্দোলন ছিলো অনেক বেশি পার্টিসিপেটরি—রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নগুলোকে অনেক বেশি সামনে নিয়ে আসে—নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। ওই আন্দোলনে একটা পরিপূর্ণ জনসমর্থনও কিন্তু ছিলো। তারপরও আন্দোলনটা এক অর্থে ফেইল করলো। ফেইল করলো মানে তাদের ম্যাচুরিটির অভাব। তখন আমার মনে হয়েছিলো, এরা এবার ফেইল করছে কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন আন্দোলনে নামবে ফেইল করবে না। কারণ এবার যে ভুলগুলো তারা করেছে, দ্বিতীয়বার সেসব ভুল তারা করবে না। ওই সময় ফেইসবুকে আমি লিখেও ছিলাম, তারা দ্বিতীয়বার আর ভুল করবে না। এবার ২০২৪ সালের ঘটনাবলী যদি খেয়াল করো, কী হয়েছে? ২০১৮’র পর যে ছয় বছর চলে গেছে, মানে যে ছেলেমেয়েগুলো স্কুল-কলেজে ছিলো, তারা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কেউ বিশ্ববিদ্যালয় পার করে যাচ্ছে, কেউ এখনো ছাত্র। মানে একটা জেনারেশন, যারা ২০১৮’র মুভমেন্টের সঙ্গে ছিলো, সমর্থন করেছে, সেই জেনারেশনটা ম্যাচিউর হয়েছে, তরুণ হয়েছে এবং কেউ কেউ হয়তো বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়েও গেছে। এরাই মূলত আন্দোলনের সঙ্গে আছে।

সম্ভবত জুলাইয়ের ১৫ তারিখ হবে; তার আগে আমি খেয়াল করছিলাম বিভিন্ন ক্যাম্পাসে কোটা বাতিল আন্দোলন চলছে। রাজশাহীতে আমাদের ছেলেমেয়েরা ৮-১০ তারিখে বোধহয় সড়ক অবরোধ করেছিলো। দেখলাম, অনেকগুলো ছেলেমেয়ে ফিরছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কোথা থেকে ফিরছো? তারা জানালো, ‘স্যার, কোটা আবার বহাল হয়েছে। আমরা তার প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ করতে গিয়েছিলাম।’ আমি খোঁজখবর রাখছিলাম, আন্দোলনটা কোথায়, কীভাবে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু ১৫ তারিখে প্রেস কনফারেন্সে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ওরকম কথা বললেন—কোটা কি মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিদের দেবো নাকি রাজাকারদের নাতিপুতিদের দেবো!১ এটা তো খুবই ইনসাল্টিং কথা। আমরা জানি, ইনফ্যাক্ট এতো পারসেন্ট কোটা থাকাই তো একটা অগণতান্ত্রিক ব্যাপার। বোধহয় ৫৬ পারসেন্ট কোটার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটাই ছিলো ৩০ পারসেন্ট। কোটার দুইটা হিসাবই গোলমেলে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে এটা তো হতে পারে না!

যাহোক, ১৫ তারিখ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীমউদ্দীন হলে ছাত্ররা প্রথম সেøাগান দেয় ‘আমি কে তুমি কে, রাজাকার রাজাকার’। এবং তার পরে সেøাগানটা আরেকটু স্পষ্ট হলো—‘আমি কে তুমি কে, রাজাকার রাজাকার’, ‘কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার।’ আমার মনে আছে ওই সময় আমি ফেইসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম—‘প্রশ্ন উঠেছে রাজা কার? মানে হু ইজ দ্য গভর্নমেন্ট? হু ইজ ইন দ্য পাওয়ার?’ প্রধানমন্ত্রী এমনভাবে অপমানজনক কথা বললেন, তার ফলে একটা প্রশ্ন উঠেছে, ‘আমি কে তুমি কে, রাজাকার রাজাকার’। তখনো যে এটা একটা সরকার পতনের আন্দোলনের দিকে যাবে কিংবা এটা একটা অনিবার্য পরিণতি পাবে, এ রকম আমার মনে হয় নাই। কিন্তু দুইটা জিনিস এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলতে থাকলেন, ‘রাজাকারের নাতিপুতিদের’ উচিত শিক্ষা দিতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট। এবং পরের দিন ছাত্রলীগ গিয়ে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ব্যাপক পিটুনি দিলো। খুব ইন্টারেস্টিংলি ওই রাতে জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাস, বরিশাল ক্যাম্পাস এবং তার পরদিন ঢাকার ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারীরা ছাত্রলীগকে পিটিয়ে উৎখাত করলো। আমার কাছে মনে হলো, বাংলাদেশে এই প্রথমবার পাল্টা মাইর দেওয়ার ঘটনা ঘটলো।

খেয়াল করলে দেখা যায়, ২০০৯-২০১০ থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের নেতারা মানে ছাত্রলীগ এবং যুবলীগ কেবল মাইর দিয়েই গেছে। পাল্টা মাইর কিন্তু তারা খায় নাই। এই প্রথম পাল্টা মাইর খেয়ে তারা হল থেকে, ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হলো। এটা কিন্তু সিগনিফিকেন্ট ঘটনা। এবং এই পাল্টা মাইরের সময়ই আমার মনে হয়েছে, এবার কিছু একটা ঘটবে—‘বন্দুকের নল উল্টা দিকে ঘুরে যাচ্ছে!’ পাল্টা মাইরের ঘটনার পর সরকার কিন্তু খুব তৎপর হয়ে ওঠে। খেয়াল করবে, সরকার ভয়ানকভাবে দমন করার চেষ্টা করেছে; ছাত্রদেরকে মেরে হল থেকে বের করে দিয়েছে। তারা সব  বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়। এবং ছাত্র খুনের কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেলো। ফলে ১৬-১৭ তারিখ থেকে আমার কাছে মনে হয়েছে, এটা একটা ভয়ানক টাসেলের দিকে যাচ্ছে। যখন তারা ইন্টারনেট বন্ধ করে দিলো, তখন এটা পরিষ্কার যে, এটা একটা রক্তারক্তির দিকে যাচ্ছে। এবার সরকারের সঙ্গে ক্ষমতার একটা লড়াই হবে। এমনকি এটা পজিটিভ ফলের দিকেও যেতে পারে।

সত্যিকার অর্থেই দেখা গেলো, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা খুব ওয়াইজলি মুভমেন্টটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে। তারা একের পর এক অভিনব একেকটা কর্মসূচি দিয়েছে এবং সারাদেশে তা সমানভাবে পালিত হয়েছে। ইন্টারেস্টিংলি, ছাত্রদের যখন ক্যাম্পাস-হল থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে, তারা কিন্তু শহর ছেড়ে যায়নি। তারা জাস্ট ক্যাম্পাসের আশপাশে ছিলো। এবং আশপাশের মানুষ তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে। মানুষ তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে—রিকশাওয়ালা থেকে বিভিন্ন শ্রেণিবর্গের মানুষ। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো তখনো মাঠে নামে নাই। তারা বরং কৌশলী হয়ে ডিনাই করে চলেছে—বিএনপি, জামায়াতে ইসলাম বলছে, এই আন্দোলনের সঙ্গে আমরা নাই। তারা বলেছে, কোটা আন্দোলনের সঙ্গে আমরা নাই। আমরা কোটা আন্দোলনের পেছনে ইন্ধন দিচ্ছি না। এই কথা তারা জুলাইয়ের ২২-২৩ তারিখেও বলেছে।

কিন্তু আন্দোলনের যে গতিপ্রকৃতি দেখা যাচ্ছিলো, তাতে ওই সময় এর ফল সম্পর্কে অনেকটা নিশ্চিত হওয়াও যাচ্ছিলো। আর যখনই ১৮ তারিখে এএফপি’তে রিপোর্টটা হলো—বোধহয় শফিক ভাই [শফিকুল আলম] রিপোর্টটা করলেন—১৭৩ জন ডেড। একমাত্র সে-ই কাউন্ট করেছে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে বসে। এটা তো একটা বিশাল ঘটনা, পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। তখন একদম নিশ্চিত যে, এটা আর পেছনে ফিরবে না। ৫ আগস্ট সরকারের পতন ঘটবে এ রকম নিশ্চিত কিছু না। কিন্তু এটা যে এক দফার দিকে যাবে এবং সরকার পতনটা অনিবার্য, তা ১৬-১৭ তারিখের দিকেই ক্লিয়ার হয়ে গেছে। আমার কাছে অন্তত ক্লিয়ার—এটা হয়তো ৫ তারিখ না হয়ে ১৫ হতে পারে—কিন্তু পতনটা অনিবার্য। এটা আর কারো পক্ষে থামানো সম্ভব না। খেয়াল করে দেখবে, ফরহাদ মজহার ১৫-১৬ তারিখেও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি ঠিকঠাক বুঝতে পারেননি।

ম্যাজিক লণ্ঠন : ফেইসবুক স্ট্যাটাসে?

আল মামুন : হ্যাঁ। সেগুলো হয়তো এখন আর খুঁজে পাবে না। হয়তো ডিলিট করে দিয়েছে। কিন্তু আমি যখন লিখেছি, ‘প্রশ্ন উঠেছে রাজা কার?’ সেই সময় ফরহাদ মজহার লিখছে, এটা খুবই পেটি বুর্জোয়া একটা আন্দোলন। এই পেটি বুর্জোয়া শব্দটা ব্যবহার করে সেই সময় তিনি বলছেন, শিক্ষার্থীদের কাছে আমি কিছুই আশা করতে পারছি না। এরা শুধু চাকরির জন্য, চুরি-ডাকাতি, ঘুষ খাওয়ার জন্য একটা পেটি বুর্জোয়া আন্দোলন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। এখন আন্দোলন দরকার তো অন্য কিছুর। কিন্তু ওইটা একটা স্ফুলিঙ্গ; যে স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে যেতে পারে। সত্যিকার অর্থে এটা ফরহাদ মজহার অ্যাসেস করতে পারেননি।

ম্যাজিক লণ্ঠন : স্যার, রাজনীতি সাহিত্যের ক্ষেত্রে যে পরিভাষা ব্যবহার করা হয়, গণঅভ্যুত্থান, বিপ্লব কিংবা কেউ বলছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা। এক্ষেত্রে আপনার কোন পরিভাষা পছন্দ বা অন্য কোনো পরিভাষা ব্যবহার করতে চান? একাত্তরকে বাদ দিয়ে অনেকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে হাইলাইট করতে চাইছে। পরবর্তী সময়ে অবশ্যই এটা নিয়ে আলোচনা করবো—জামায়াতে ইসলাম তাদের কৃতকর্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করতে চায় না। ফলে আপনি এই পরিভাষাগুলোকে কীভাবে ব্যবহার করবেন—গণঅভ্যুত্থান না বিপ্লব, না অন্য কিছু?

আল মামুন : যারা বিপ্লব বলছেন তাদের সাথে আমি একমত নই। বিপ্লব বলা যায় না। বিপ্লব মানে কী? পরিপ্লাবন, যা সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। জুলাই আন্দোলন একটা পরিপূর্ণ বিপ্লবের দিকে যেতে পারতো। কিন্তু যারা আন্দোলনে লিড করছে, যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তাদের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য যদি বোঝা যায় তাহলে বলতে হবে, তারা মিডল ক্লাস বুর্জোয়া। এবং যাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে তারাও কিন্তু মিডল ক্লাস বুর্জোয়া। ফলে চরিত্রগত কারণে তারা বিপ্লবের ভাষায় চলবে না। বিপ্লব হওয়া মানে কী? এখানে সংবিধান বাতিল হয়ে যাবে। নতুন ধরনের রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি হবে। এখানকার যে আইন, বিচারব্যবস্থা এবং পুলিশ প্রশাসন কিংবা অন্যান্য প্রশাসন, সবকিছু আমূল বদলে যাবে। নতুন এক ধরনের রাষ্ট্র কল্পনা তৈরি হবে। সেটা কিন্তু ঘটেনি।

আমি বলতে পারি, একটা রাষ্ট্রের আমূল পরিবর্তনের প্রশ্ন এখানে উঠছে না। তার মানে হলো, এটা বিপ্লব না। আমি এটাকে বলি গণঅভ্যুত্থান। এবং অনেকে বলছে এটা দ্বিতীয় স্বাধীনতা। হয়তো এই কথার মধ্যে এক ধরনের এসেন্স আছে। প্রথম স্বাধীনতা আর দ্বিতীয় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রথম স্বাধীনতা যদি আমরা ’৭১-কে ধরি, তাহলে এটা দ্বিতীয় স্বাধীনতা। এটার পক্ষে হয়তো একটু যুক্তি দেওয়া যায় যে, প্রথমবার আমরা ভৌগোলিক ভূখণ্ডের স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু আমাদের মনোজগতে এক ধরনের বদ্ধতা ছিলো। সেই বদ্ধতা কাটেনি। আমরা সব মানুষকে এক করতে পারিনি কিংবা নাগরিক অধিকার ভিত্তিক যে রাষ্ট্র হওয়ার কথা, সেটা করতে পারিনি। ফলে আমাদের আরেকটা সংগ্রাম করতে হলো; আরেকটা লড়াই করতে হলো। প্রথম স্বাধীনতা ছিলো, পাকিস্তানের যে ইসলামকে একমাত্র ক্যাটাগরি হিসেবে ভাবছে, সেই ভাবনা থেকে আমরা বের হয়ে আসলাম। এবং একটা স্বাধীন ভূখণ্ড তৈরি হলো। আরেকটা হলো ‘বাঙালি’, একটা বর্গ ও ক্যাটাগরি হিসেবে ভাবা। এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে এমন এক চেতনাকল্প তৈরি করা, যেটা ওই ‘বাঙালি’ ছাড়া আর সম্ভব না। ফলে তাও ভাঙতে হলো। এই অর্থে এটাকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলা যেতে পারে।

এই যে একটা বদ্ধতা কিংবা ভারতের কাছে আমাদের এক ধরনের আনুগত্যের প্রশ্ন বার বার নানাভাবে ওঠে, সেই দিক থেকেও। আমরা পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়েছিলাম বটে, কিন্তু ভারত আমাদের ওপরে এক ধরনের বড়ো রকমের প্রভাব ফেলে রেখেছিলো। দ্বিতীয় স্বাধীনতা এই অর্থে—ভারতের যে অন্ধ আধিপত্য, অন্যায়-অত্যাচার আছে, বাংলাদেশে ইন্টারভেনশন আছে, সেটা থেকেও আমরা স্বাধীনতা চেয়েছিলাম। যেটাকে অনেকেই তথাকথিত ভারত বিদ্বেষ বলবে। কিন্তু আমরা এটাকে বলবো ভারত বিরোধিতা। এই ভারত বিরোধিতার প্রশ্ন কেনো উঠেছে? কারণ ভারত একটা সার্টেইন ডেফিনেশন তৈরি করতে চেয়েছে থ্রু আওয়ামী লীগ। এটা থেকে মানুষ মুক্তি চেয়েছে। দ্বিতীয় স্বাধীনতা এই অর্থেও বলা যেতে পারে।

কিন্তু আমি আসলে সেটাও বলতে চাই না। কেননা ইরেজার-এর প্রশ্ন ওঠে। ফলে আমি মনে করি, এটা একটা গণঅভ্যুত্থান। এইটা হচ্ছে, বাংলাদেশে যে নানা রকমের বাঙালি সমাজের কিংবা জনগোষ্ঠী বসবাস করে, তাদের যে ঐতিহাসিক লড়াই, সংগ্রাম আছে তারই কন্টিনিউয়েশন। এবং এই গণঅভ্যুত্থান আগের গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত। খুবই মৌলিকভাবে যদি আমরা দেখি ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে এটার চেহারা অনেকটা মেলে না। ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের চেহারার সঙ্গে এটা মেলে না। যারা আন্দোলনে পার্টিসিপেট করেছে তাদের ভাষা লক্ষ করলে দেখতে পাবে, তারা ‘৭১-এর ভাষা, ’৫২-এর ভাষা ও ’৪৭-এর ভাষাকে অ্যাডাপ্ট করার চেষ্টা করেছে।

বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর মুক্তির একটা আকাঙক্ষা—রাষ্ট্র বলতে কলোনিয়াল রাষ্ট্র না এবং রাষ্ট্র মানে তার নির্ভরতা ভারত কিংবা পাকিস্তান না বরং আমরা একটা সক্রিয় সত্তা—এই আন্দোলনের মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। আগেও বার বার এই আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটেছে। ভোটের অধিকারের প্রশ্ন উঠেছে। যেমন, ’৭১-এ কীসের প্রশ্ন উঠেছিলো? প্রথমত, ন্যায্যতার প্রশ্ন ছিলো, গণতন্ত্রের প্রশ্ন ছিলো। এবারও তো সেই প্রশ্নগুলোই উঠেছে—এটাকে একটা ইন্সটিটিউশনাল রূপ দিতে হবে। এই অভ্যুত্থান সেই মেসেজগুলো ক্যারি করে বলে আমার মনে হয়। ফলে এটাকে আমি দ্বিতীয় স্বাধীনতা ওই অর্থে বলি না।

ম্যাজিক লণ্ঠন : ’৭১-এর পরেও আমরা ন্যায্যতা, ন্যায়বিচার, সাম্য, মানবিক মূল্যবোধ এগুলো প্রতিষ্ঠা করতে পারি নাই। ইতোমধ্যে ৫৩ বছর চলে গেছে। এই গণঅভ্যুত্থানের পরে কোন বিষয়গুলো নিয়ে আপনি বেশি আশান্বিত? এই অর্থে যে, এগুলোর কিছুটা হলেও হয়তো প্রতিষ্ঠা হবে। নাকি আবারও অনিশ্চয়তাই বেশি? নাকি আপনি সম্ভাবনা বলতে আশা নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়, এ রকম আশাই করছেন? কোন যুক্তিতে, কীভাবে সেসব বিষয়ের ওপর আশা করছেন? আরো একটু নিদিষ্ট করে যদি বলি, আরব বসন্ত হয়েছে, মিশরে নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতায় এসেছে; তাদের সরেও যেতে হয়েছে। আবার সামরিক শাসন এসেছে। সেখানে আশাপ্রদ কিছু আমরা দেখলাম না। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে আপনি কতোটা আশাবাদী?

আল মামুন : আশার চেয়ে যেটা আশঙ্কার ব্যাপার সেটা আগে বলা দরকার। আমি দুই দিন আগেও ফেইসবুকে লিখছিলাম, আমরা যে সময়টাতে বাস করছি, এই সময়টা হলো নিওলিবারেল গ্রেট এগজিলারেশন-এর টাইম। যেটাকে আমরা ইকোনমিক টাইম হিসেবে দেখি। এটা খুবই অ্যাগ্রেসিভ ইকোনমিক টাইম। এখানে ধর্মের প্রশ্ন, সেক্যুলারের প্রশ্ন এগুলো ইমম্যাটেরিয়াল। বরং গ্রোথ এবং প্রোফিট প্রধান প্রশ্ন। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ইকোনমিক অর্ডার যেভাবে চলছে—ইউরোপে ইন্সটিটিউশনাল প্রোটেকশন আছে, অনেক দেশেই ইন্সটিটিউশনাল প্রোটেকশন আছে—আমাদের এখানে নাই। ফলে এখানে এক ধরনের—যেটাকে আমরা এক অর্থে বলি প্রিমেটিভ অ্যাকিউম্যুলেশন-এর একটা ফেইজের মধ্যে আছি। এই প্রবণতা যে থামবে এমনটা আমার মনে হয় না। ইকোনমির এই চরিত্র বদলাবে মনে হয় না—হঠাৎ করেই বাংলাদেশ বদলে গেলো! এটা একটা ঝুঁকির জায়গা যে, ফ্যাসিস্টিক স্ট্রাকচার অনেক কিছু বানচাল করে দিয়ে দ্রুত ডিসিশন নিতে পারে। ফ্যাসিস্ট সরকার কিন্তু মূলত করপোরেট সরকারের একটা রূপ। এই ইকোনমিক অর্ডার যদি না বদলায় তাহলে কিন্তু ফ্যাসিজম চলতেই থাকবে।

আমাদের এখনকার আরেকটা জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো, যে টেকনোলজিকাল প্রতিবেশে আমরা বসবাস করি, যে ধরনের কানেকশন এবং ইনফরমেশন, মিসইনফরমেশন ও ডিজইনফরমেশনের মধ্যে বসবাস করি, সেটা স্বাধীন ডিসিশন নেওয়া, ইন্ডিভিজ্যুয়াল রাইটস রক্ষা করা—এগুলোর জন্য খুব ঝুঁকিপূর্ণ। আমার প্রাইভেসি রক্ষার জন্য তা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটা স্পেস। এগুলোকে ফ্যাসিজম গ্রো করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে বার বার। ফলে যে মব তৈরি হচ্ছে, সেটা কিন্তু সোশাল মিডিয়ার মধ্য দিয়েই হচ্ছে। কিংবা যে ধরনের প্রোপাগান্ডা চলছে, সেগুলো সোশাল মিডিয়ার মধ্য দিয়ে অনেক বেশি সার্কুলেটেড হচ্ছে; এবং আমাদের পারসেপশন তৈরি করছে। ফলে এগুলো হচ্ছে ঝুঁকির জায়গা। একটা গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ হতে পারে তার পরবর্তী প্রোপাগান্ডা ও ইকোনমিক অর্ডারের কারণে।

আরেকটা জিনিস স্পেসিফিকালি আমাদের দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ কেবল অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী দেশ হওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু এশিয়া প্যাসিফিক রিম-এর যে পলিটিক্স, এশিয়ার পলিটিক্স—চিন, রাশিয়া, ইন্ডিয়া ও আমেরিকার; এবং আমেরিকার এশিয়া প্যাসিফিক রিম নিয়ে যে পরিকল্পনা, এই সবকিছু মিলিয়ে এখানে স্টাবল, স্বাধীন একটা দেশ হয়ে থাকা, মানে অন্যদের থেকে অনেক বেশি স্বাধীন হয়ে থাকা এবং সেটা নিয়ে সারভাইভ করা, একটা ঝুঁকির ব্যাপার। এগুলো হচ্ছে আশঙ্কার জায়গা। যে কারণে একটা গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ হতে পারে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থান ইটসেল্ফ—যেকোনো গণঅভ্যুত্থানের ফলাফল থাকে। গণঅভ্যুত্থানে যেই রকম প্রাণহানি ঘটেছে এর একটা ফলাফল আসবে। যেমন ধরো, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পরে কিন্তু আমরা একটা স্বাধীন দেশ পাচ্ছি। দুই বছর দেরি হয়েছে, কিন্তু আমরা একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পরে মিলিটারি রেজিম থেকে বেরিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারের দিকে যেতে পেরেছি। গণঅভ্যুত্থানের কিছু ফল অবশ্যই ফলে।

তবে প্রকৃতিগত দিক থেকে এবারের গণঅভ্যুত্থানকে আমার ’৬৯-এর মতো বড়ো মনে হয়। এই সরকার যদি ফেইল-ও করে; ধরো এই সরকার ফেইল করলো; সংস্কারের প্রশ্নগুলোকে রিসলভ করতে পারলো না। বাংলাদেশের জনগণ এটা মানবে না, স্পেশালি তরুণরা মানবে না—এটা পরিষ্কার। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব মূলত এই তরুণ সমাজকে লিড করার ক্যাপাসিটি হারিয়ে ফেলেছে। তারা যে ভাষায় কথা বলে এবং যেভাবে কমিউনিকেট করতে চায় তরুণদের সঙ্গে—শিক্ষার্থী ও তরুণ—সেটা অ্যাপ্রোপিয়েট হয় না। এই তরুণরা, যাদেরকে আমরা জেন জি বলছি, এরা কিন্তু আমাদের মতো না। কিংবা তোমাদের মতোও না। এরা কিন্তু গ্লোবাল সিটিজেন এক অর্থে। আমরা একদম স্থানীয় ছিলাম। ফলে ওরা গ্লোবালি কোথায় কী ঘটছে সেটা আমাদের চেয়ে বেশি জানে। ভিডিওতে দেখে, কথা বলে, সিনেমা দেখে, যেগুলোতে আমাদের অ্যাকসেস ছিলো না। ফলে আমার যে নাগরিকতার ধারণা, আমার যে অধিকারের ধারণা, জাতীয় সত্তার ধারণা এগুলো কিন্তু ওদের মধ্যে সেভাবে কাজ করে না। ওদের ভেতরে অন্যভাবে কাজ করে। ওদের ওই জায়গাটা আমরা ধরতে পারছি না। ওরা কিন্তু একটা নাগরিক অধিকারের ভিত্তিতে—মূলত যে আকাক্সক্ষাটা প্রকাশিত এই আন্দোলনে—একটা কল্যাণমূলক গণতান্ত্রিক সমাজ চায়। এইটা হচ্ছে চাওয়া।

যারা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে—রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী, হিন্দু থেকে খ্রিস্টান কিংবা চাকমা, গারো, মারমা থেকে বাঙালি—সবার মধ্যে এই আকাঙ্ক্ষাটা দেখা গেছে। এই আন্দোলনে পুলিশের ছেলে জয়েন করেছে, শিক্ষকের ছেলেও জয়েন করেছে। তাদের আকাঙ্ক্ষাটা কী? এক হচ্ছে, এই ব্লাডশিড আমরা চাই না। এই ভায়োলেন্স আমরা চাই না, ন্যায্য বিচার চাই, আইনের শাসন চাই; এবং একটা গণতান্ত্রিক অধিকারভিত্তিক সমাজ চাই। এইটাই তো সবার আকাঙ্ক্ষা। এই আকাঙ্ক্ষার সবটুকু পূরণ হবে এমনটা আশা করা যায় না। কিন্তু এই আকাঙ্ক্ষাটা জারি থাকবে। আমি বলছি এই কারণে যে, এখানে জেনারেশনগত একটা বড়ো গ্যাপ আছে। নতুন জেনারেশনকে ’৭১-কে এমপাওয়ার করে যে গল্পটা বলা হয় সবসময়; যারা বলতে চায় এবং বড়ো যে রাজনৈতিক দলগুলো লিড করছে, তাদেরকে এই বিষয়গুলো হিসাবে নিতে হবে। তারা যদি এগুলোকে হিসাবে না নিতে পারে—যেই কিংবা যারাই ক্ষমতায় আসুক না কেনো অদূর ভবিষ্যতে, তাদের বিরুদ্ধেও আমরা বড়ো আরেকটা আন্দোলন দেখতে পাবো। সে আন্দোলনে তারা তাদের অধিকারের প্রশ্ন নিয়ে আবার হাজির হবে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : ৯০-এর আন্দোলনকে যদি গণঅভ্যুত্থান ধরি, তাহলে দেখবো সেখান থেকে ৩৫ বছর পরে আরেকটা অভ্যুত্থান হলো।

আল মামুন : প্রত্যেক জেনারেশনে এ রকম একটা অভ্যুত্থান ঘটে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : ফেইসবুক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পত্রিকার কলামে আওয়ামী বলয় কিংবা কালচারাল এলিটিস্ট—তাদের প্রধান আশঙ্কা—দেশটা দক্ষিণ পন্থার দিকে যাচ্ছে, ধর্মীয় ন্যারেটিভ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আপনি যেই আশঙ্কার কথাগুলো বললেন, তাদের আলাপে এই প্রসঙ্গগুলো সেভাবে আসেনি কিংবা আমি দেখতে পাইনি। তারা ওই বাইনারির মধ্যেই আবার ঢুকতে চাচ্ছে যে, সামনে বাংলাদেশ একটি ইসলামি রাষ্ট্র হয়ে যাবে। এটাও তো সত্যি যে, ছোটো ছোটো কিছু দল কিংবা ক্ষুদ্র অংশ, জোরেশোরে ইসলামি রাষ্ট্র কায়েমের কথা বলছে। এই বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন?

আল মামুন : প্রথমত, আমার কাছে মনে হয়েছে, এটা বোঝাপড়ার বড়ো রকমের সমস্যা। ধরো, জামায়াতে ইসলাম জানে তাদের ভোট হচ্ছে তিন থেকে পাঁচ পারসেন্ট কিংবা সর্বোচ্চ ১০ পারসেন্ট। তার বেশি ভোট সে পাবে না। কোথাও সে জিততে পারবে না। যদি এককভাবে ক্যান্ডিটেড দেয় তাহলে দেখবে তারা অল্প কয়েকটা সিটে জিততে পেরেছে। যদি অন্য কোনো বড়ো দলের সঙ্গে তারা ইলেকশনে যায়, তাহলে বেশ কয়েকটা সিট পাবে। আর যদি একা একা যায়, তাহলে পাঁচটা থেকে সাতটা সিট পাবে। এটা জামায়াত-ও জানে। প্রশ্ন হলো, অন্যরাও কি এখানে ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করতেছে? আর ইসলামি রাষ্ট্র বলতে আদৌ কি কিছু বোঝায়? ইনফ্যাক্ট ইসলামি রাষ্ট্র বলতে কোনো রাষ্ট্র হয় না। আধুনিক রাষ্ট্রে ইসলামি রাষ্ট্র হয় না। আধুনিক রাষ্ট্রে দুই-একটা জিনিস করা যেতে পারে—একটা আইন করলাম মহানবীকে কটূক্তি করে কিছু বলা যাবে না। তাহলে এ রকম কঠোর শাস্তি হবে। কোরআনের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না। বললে কঠোর শাস্তি হবে। কিংবা সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম থাকবে। কিন্তু এগুলো দিয়ে তো আর রাষ্ট্র চলছে না। রাষ্ট্র চলছে মডার্ন একটা ফ্রেমের মধ্যে, মডার্ন ইকোনমির মধ্যে। ফলে রাষ্ট্র ইসলামি হয় না। ইসলামি রাষ্ট্র বলে কোনো ধারণা আসলে ইসলামেও নাই। মানে খোদ ইসলামের মধ্যেই ইসলামি রাষ্ট্র সম্পর্কে কিছু নাই। উম্মাহর কথা আছে। ফলে রাষ্ট্র ও ইসলামকে যারা একাকার করে তারা একটা পলিটিক্সই করে—ক্ষমতার রাজনীতি!

আরো একটি জিনিস বোঝা দরকার। বাংলাদেশে কি কোনো তালেবান রাষ্ট্র কায়েম হবে? ইনফ্যাক্ট তাও হবে না। ২০০৪ সালেও কিন্তু এ ধরনের কথা উঠেছিলো। আমি দেখেছি, তখন আলী রীয়াজ লিখেছিলো, ‘ইজ বাংলাদেশ বিকাম আ তালেবান স্টেট?’ অনেক প্রবণতা দেখে তার মনে হয়েছে, এ রকম একটা দিকে বাংলাদেশ যাচ্ছে। তিনি কিন্তু এখানে আশঙ্কিত, বাংলাদেশ বোধহয় তালেবানি রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে। এই রকম একটা শঙ্কা তার লেখার মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু সেই ২০০৪ সালের পর আজকে ২০২৪ সাল। তালেবানি রাষ্ট্র আর হয় নাই। এটা বুঝতে হবে, আমাদের ইসলাম আর আফগানিস্তানের ইসলাম এক ইসলাম না।

(চলবে)

-আল মামুন

abdullahmamun@ru.ac.bd

https://www.facebook.com/A.al.Mamun.ru

জাহাঙ্গীর আলম, পড়ালেখা করেছেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায়। বর্তমানে ‘প্রথম আলো’য় কর্মরত।

alamrumcj@gmail.com

টীকা

১. সেদিনের সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে এতো ক্ষোভ কেনো? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না, তাহলে রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে? সেটা আমার প্রশ্ন, দেশবাসীর কাছেও প্রশ্ন।’ সংবাদ সম্মেলনের লাইভ ভিডিওটি দেখতে পারেন এই লিঙ্কে : https://www.youtube.com/watch?v=kWjKsWKt6HI; retrieved on: 15.12.2024


এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন