Magic Lanthon

               

লুক্রেশিয়া মার্তেল

প্রকাশিত ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

‘আমি ক্যামেরাকে শারীরিকভাবে উপস্থিত একটি জীবন্ত সত্তা মনে করি’

লুক্রেশিয়া মার্তেল

লুক্রেশিয়া মার্তেল আর্জেন্টিনার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা। লাতিন আমেরিকার আধুনিক চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ এক কণ্ঠস্বর তিনি। মার্তেলের জন্ম ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে আর্জেন্টিনার সাল্টা শহরে। মার্তেল চলচ্চিত্রে জটিল ন্যারেটিভ, উদ্ভাবনী গল্প বলার পদ্ধতি এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার গভীর অনুসন্ধানের জন্য পরিচিত। তিনি ‘নিউ আর্জেন্টিনিয়ান সিনেমা’ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত; যার শুরু ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে। এই আন্দোলন মূলত গতানুগতিক চলচ্চিত্রিক রীতির থেকে ভিন্নতা খোঁজার চেষ্টা করে।
মার্তেলের চলচ্চিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তার পরিবেশগত টেনশন; শব্দ, আবহসঙ্গীত ও দৃশ্যের সূক্ষ্ম বিষয়ে গভীর মনোযোগ; এবং দৈনন্দিন জীবনের উপস্থাপনে প্রায় প্রামাণ্যচিত্রের মতো সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি। তার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে দ্য সোয়াম্প (২০০১), দ্য হলি গার্ল (২০০৪) ও দ্য হেডলেস উইমেন (২০০৮)। এই চলচ্চিত্রগুলো আর্জেন্টিনার সমাজে শ্রেণি, লিঙ্গ এবং ক্ষমতার গতিশীলতা অনুসন্ধান করে, একইসঙ্গে আলোকপাত করে ব্যক্তিগত ইচ্ছা ও সামাজিক প্রত্যাশার জটিল সম্পর্কের ওপরও।
এই সাক্ষাৎকারটি ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে নেওয়া; যখন মার্তেল নিউ ইয়র্ক চলচ্চিত্র উৎসবে দ্য হেডলেস উইমেন-এর প্রদর্শনীর জন্য গিয়েছিলেন। সেখানে ‘FilmComment’ পত্রিকার জুলাই-আগস্ট ২০০৯ সংখ্যার জন্য লুক্রেশিয়া মার্তেলের সাক্ষাৎকার নেন অ্যামি তওবিন (Amy Taubin)। অ্যামি তওবিন ইংরেজি ভাষায় প্রশ্ন করেছিলেন, মার্তেল উত্তর করেছিলেন স্প্যানিশে। এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশের জন্য স্প্যানিশ থেকে ইংরেজিতে ভাষান্তর করা হয়েছিলো।
ভূমিকা ও ভাব-ভাষান্তর : অধরা মাধুরী

অ্যামি তওবিন : দ্য হেডলেস উইমেন অত্যন্ত শক্তিশালী এবং জটিল/শ্রমসাধ্য চলচ্চিত্র। কাঠামোগত দিক থেকে এটা আপনার আগের দুইটি চলচ্চিত্রের (দ্য সোয়াম্প এবং দ্য হলি গার্ল) তুলনায় অনেকখানি আলাদা বলে মনে হয়।

লুক্রেশিয়া মার্তেল : আমার তো মনে হয় আমার আগের দুটি চলচ্চিত্রও একে অন্যের থেকে অনেক আলাদা। যেহেতু আগের দুটো চলচ্চিত্র একই কাঠামোর নয়, ফলে আমি ঠিক নিশ্চিত নই এটাকে কীভাবে আগের দুটো থেকে আলাদা করবো। লেয়ারে কাজ করার ক্ষেত্রে আমার কৌশলগুলো আরো মসৃণভাবে ব্যবহার করতে পারাকে, আমি এই চলচ্চিত্র থেকে একটি ব্যক্তিগত অর্জন হিসেবে দেখি। এছাড়াও আমি যা করতে চেয়েছিলাম, তার জন্য এই কাঠামোটিই সবচেয়ে কার্যকর ছিলো। আমি আরো আগে কেনো এই কৌশল ব্যবহার করিনি তা ভেবে এখন আফসোস হয়!

তওবিন : আমার মতে, অন্যান্য চলচ্চিত্রের সঙ্গে দ্য হেডলেস উইমেন-এর সুস্পষ্ট পার্থক্য হলো, তা মাত্র একটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মার্তেল : একদম ঠিক, এটাই সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ ছিলো আমার জন্য। তখন আমার মনে হতো, আমি একটা ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছি। কারণ এভাবে মাত্র একটি চরিত্র নিয়ে আমি আগে কখনো কাজ করিনি।

তওবিন : আপনার এই লেয়ার বিষয়টি কিন্তু আমার কাছে পরিষ্কার না। লেয়ারের কথা ভাবলে আমার পটভূমি আর চরিত্রের স্তরের কথাই মাথায় আসে।

মার্তেল : লেয়ার বলতে আমি সামগ্রিকতার একটি ধরনকে (form of accumulation) বোঝাচ্ছি, যেখানে পুথিগত অর্থে পটভূমি ধারণাটি আর গুরুত্বপূর্ণ থাকে না। আমি পরস্পর সংযুক্ত অনেকগুলো উপাদানের সঙ্গে কাজ করি; এবং উপাদানগুলো প্রতিটি দৃশ্যে বিভিন্ন অবস্থানে, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে, অগ্রভাগে বা পশ্চাতে উপস্থিত থাকে। উদাহরণস্বরূপ, দুর্ঘটনার কোনো দৃশ্য বিভিন্নভাবে উপস্থিত হতে পারে, হয়তো কেউ একজন মাটি খনন করছে, অথবা কেউ কিছু একটা মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে। অর্থাৎ আমি সরাসরি দুর্ঘটনাটি না দেখালেও এমন কিছু উপাদান পর্দায় রাখছি, যা ওই দিকেই নির্দেশ করে। এই পদ্ধতিতে কাজ করা সহজ হয়, যখন চরিত্রের সংখ্যা বেশি হয়। কিন্তু মাত্র একটি চরিত্র নিয়ে এই পদ্ধতিতে কাজ করা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিলো।

তওবিন : দ্য হেডলেস উইমেন অনবরত দর্শককে একটি সন্দেহের মধ্যে রাখে যে, আদৌ দুর্ঘটনায় ছেলেটি গাড়িচাপা পড়েছিলো কি না? আমি যখন দ্বিতীয়বার চলচ্চিত্রটি দেখছিলাম, প্রথম থেকেই রহস্যের এই সূত্রগুলো খুঁজতে শুরু করি। উদাহরণস্বরূপ, আমি দেখতে চেয়েছিলাম, গাড়ির পাশের জানালায় হাতের যে ছাপগুলো আমরা দুর্ঘটনার ঠিক পরে দেখি, তা প্রথম দৃশ্যে কেন্দ্রীয় চরিত্র ভেরোনিকার গাড়ির কাছাকাছি খেলতে থাকা শিশুদের কিনা।

মার্তেল : প্রকৃতপক্ষে, হাতের ছাপগুলো খেলা করতে থাকা শিশুদেরই ছিলো, ওটা মৃত শিশুটির হাতের ছাপ নয়। কিন্তু আসলে কাউকে হত্যা করা হয়েছে কিনা, তার চেয়ে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো, যা ঘটেছে তার প্রতিক্রিয়া। আমি ভেরোনিকার মানবিক আচরণের ওপর ফোকাস করতে চেয়েছিলাম। কেননা তার জানামতে, তিনি একটি হত্যা করেছেন; এবং এই বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া কী ছিলো। এই বিষয়টি আমার কাছে অত্যন্ত আগ্রহোদ্দীপক মনে হয়েছে, মানব আচরণ তার কৃতকর্মের সত্যতার চেয়ে তার কর্মের ওপর বেশি নির্ভরশীল।

তওবিন : কিন্তু দুর্ঘটনাটির দৃশ্যায়নের জন্য কি আপনাকে আগে সিদ্ধান্ত নিতে হয়নি, শিশুটি মারা গিয়েছিলো কি না? উদাহরণস্বরূপ, আমি দ্বিতীয়বার চলচ্চিত্রটি দেখার সময় সাউন্ডট্র্যাকটিতে মনোযোগ দিয়েছিলাম, দুর্ঘটনার শব্দটি রাস্তায় পড়ে থাকা কোনো পাথরের শব্দও হতে পারতো; আবার শিশুটির সঙ্গে সংঘর্ষের শব্দও হতে পারতো। আপনাকে তো সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিলো, কোনটি সঠিক?

মার্তেল : আমি দুটো সম্ভাবনা মাথায় রেখেই দৃশ্যায়ন করেছিলাম। একটি হলো—তিনি শিশুটিকে আঘাত করেছেন এবং তার পর তিনি খালে পড়ে গেছেন, এবং ঝড়ের পানি তার দেহটিকে টেনে নিয়ে গেছে। আবার অন্যদিকে, এমনভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়—তিনি একটি কুকুরকে আঘাত করেছেন এবং মৃত শিশুটির দেহ সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে সেখানে ছিলো। তাই যখন আমি শ্যুট করেছি, তখন এটা মাথায় রেখেছি যে, দুটো ঘটনার পেছনেই যেনো সমানভাবে শক্তিশালী যুক্তি থাকে।

তওবিন : এটা একটি সম্ভাব্য হিট অ্যান্ড রান।

মার্তেল : এটাই আসলে ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু। অর্থাৎ কোনো মানুষের যদি সামান্য সন্দেহ থাকে যে, তিনি অন্য একজন মানুষের জীবন বিপন্ন করে ফেলেছেন—তারপরও যদি সেই ব্যক্তি থেমে বা পিছিয়ে এসে ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা না করে—তাহলে সে আর মানুষের কাতারে থাকে না। আমার কাছে এটাই মূল বিষয়। আসলে আমি বিশ্বাস করি, এই প্রক্রিয়াটি ক্রমাগত কাজ করছে। এটা এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে—এমনকি সবচেয়ে মৌলিক সামাজিক মিথস্ক্রিয়াতেও লোকজন তাদের দায়িত্ব অস্বীকার করে। পরিবর্তে, তারা পুরো সামাজিক শ্রেণি বা প্রকৃতিতে যা ঘটবে তার জন্য অন্য কিছুকে দায়ী করে, যাতে তারা অন্যদের দুঃখকষ্ট উপেক্ষা করতে পারে। তারা বলে—এমনই হয়, দুনিয়ার ইতিহাসে এভাবেই চলে আসছে, এটাই প্রকৃতির নিয়ম। সামাজিক দায়বদ্ধতা এড়ানোর এই উপায় মানুষ হিসেবে আমাদেরকে কম আগ্রহী করে তোলে। এই সময়েও আমরা কেনো এই বিশ্বাস নিয়ে আছি যে, পরিবর্তন আনার জন্য ব্যক্তিগত স্তরে আমরা কিছুই করতে পারি না? বৃহত্তর সমস্যাগুলোর জন্য ব্যক্তি পর্যায়ে দায়িত্ব নিতে এতো ভয় কেনো, আমি সেটা বুঝতে পারি না! আমি বিশ্বাস করি, এটা সত্যিই আমাদের সময়ের বালাই।

তওবিন : আপনি বলতে চাচ্ছেন, ব্যক্তি পর্যায়ে মানুষ বৃহৎ সামাজিক সমস্যার সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চায় না, কারণ তারা বিহ্বল বোধ করে?

মার্তেল : এই চলচ্চিত্রে আমি একটি সামাজিক প্রক্রিয়া দেখিয়েছি, যা সত্যিই সুন্দর ও আকর্ষণীয় হতে পারে। কিন্তু একইসঙ্গে সেটা ভয়ঙ্করও। এটা এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একটি সামাজিক গোষ্ঠী সামগ্রিকভাবে তার কোনো সদস্যের কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করে। একটি হত্যা সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও, নিজেদের একজনকে রক্ষার জন্য কোনো অপরাধ ধামাচাপা দিতে কোনো গোষ্ঠী একত্রিত হয়। একদিকে, এটা কোনো মানুষকে সমর্থন করার দিক থেকে ইতিবাচক; অন্যদিকে এটাতে কোনো সামাজিক শ্রেণির সমস্ত নেতিবাচকতার শিকড়ও রয়েছে—যেমন তথ্য লুকিয়ে রাখা, এমনকি অপরাধও। এবং এটাই বর্ণবাদের মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি।

তওবিন : আমার ধারণা, আপনি যে প্রক্রিয়াটির কথা বলছেন তাকে ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব অনুযায়ী disavowal বা অস্বীকৃতি বলা হয়। ভেরোনিকা জানে তিনি ভয়ানক কিছু করেছেন; তবু তিনি নিজে সেটা মানতে চান না। এই পরিস্থিতিতে ধীরে ধীরে তার কষ্ট কমতে থাকে। অতঃপর চলচ্চিত্রের একেবারে শেষের দিকে তিনি তার চুলের রঙ পরিবর্তন করে ভিন্ন মানুষে পরিণত হন; যিনি তার অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানে না।

মার্তেল : হ্যাঁ, বিষয়টা আমার কাছেও অনেকটা এমনই।

তওবিন : এই যে অস্বীকৃতি বা অস্বীকার করার বিষয়টা কিন্তু দমন করা নয়। কারণ বিষয়টা এমন যে, ব্যক্তি নিজের কাছেই স্বীকার করে না সে বিষয়টি জানে।

মার্তেল : আমার মনে হয়, কোনো ব্যক্তি এমন পরিস্থিতি থেকে সহজে বের হয়ে আসতে পারে না। চলচ্চিত্রের এই নারীটি তার সারাজীবন এই বোঝা তার ঘাড়ে একটি মৃতদেহ কিংবা হাড় ভর্তি থলে যেমন বহন করে মানুষ, সেভাবেই বয়ে নিয়ে চলেছে। আমার দেশ আর্জেন্টিনায়, আমি এমন অনেক মানুষকে দেখি, যারা স্বৈরাচারের অধীনে ঘটে যাওয়া অনেক খারাপ স্মৃতি এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে। যেখান থেকে তারা কখনোই পুরোপুরি বের হয়ে আসতে পারেনি। একটা বড়ো সংখ্যার মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে; তারা জানতে চায় না কী ঘটছে। এবং দারিদ্র্যের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে। দেশের একটি বিশাল অংশ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে; চরম দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে; অথচ প্রচুর মানুষ এমন ভান করে যে তারা এগুলো দেখতেই পায় না। আমরা এটাও দেখার চেষ্টা করি না যে, পুরো আইনব্যবস্থা, স্বাস্থ্য, শিক্ষাব্যবস্থা সামাজিক শ্রেণির মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে, কিংবা বর্ণপ্রথার মধ্যে। উদাহরণস্বরূপ, এমন কিছু রোগ আছে, যেগুলোতে আক্রান্ত হলে আমাদের মতো সামাজিক শ্রেণির কোনো ব্যক্তি তিন দিন বিছানায় থাকবেন, তার পর সুস্থ হয়ে উঠবেন। বিপরীতে অন্য কোনো সামাজিক শ্রেণিতে ওই ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওই রোগী মারা-ই যাবে। অন্যের কষ্টকে উপেক্ষা করার জন্য আমরা অতীতে যে ধরনের কৌশল ব্যবহার করতাম তা আজও বর্তমান। এই কারণেই আমি চলচ্চিত্রে এমন সব দৃশ্যে ৭০ দশকের সঙ্গীত ব্যবহার করেছি, যেখানে মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, আবার আধুনিক গাড়িও চালায়। আমি এই উপাদানগুলোর মাধ্যমে জোর দিয়ে বোঝাতে চেয়েছি, অতীতে শুরু হওয়া কৌশল এখনো অব্যাহত রয়েছে।

তওবিন : আমেরিকান দর্শকের কাছে এই বার্তাটি ঠিক এভাবে পৌঁছাবে কিনা, আমি নিশ্চিত নই। যেমন, প্রধান চরিত্রটির চুল—আমেরিকায় অনেকে এখন লম্বা চুল রাখে, অনেকে রাখে না। বর্তমান নিউ ইয়র্ক শহরের কোনো আধুনিক দোকানে ঢুকলে আপনার আধুনিক সময়ের কোনো সঙ্গীত এবং ৭০ দশকের সঙ্গীত শুনতে পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় সমান।

মার্তেল : আপনি যা বলতে চাচ্ছেন আমি তা খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছি। চলচ্চিত্রটির সাবটাইটেল করার সময় এমন অনেক উপাদান আমরা কেটে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই; যেনো ইংরেজিভাষী দর্শক বা অন্য কোনো ভাষার দর্শকের চলচ্চিত্রটি বুঝতে কোনো ধরনের সমস্যা না হয়। তবে আমি এটাও মনে করি যে, এতে এমন অনেক উপাদান রয়েছে যা যেকোনো দেশ বা সমাজের জন্যও প্রযোজ্য।

তওবিন : অবশ্যই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমরা নিজেদের তৈরি ভয়ানক যুদ্ধের মধ্যে বসবাস করছি; কিন্তু আমরা এর থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন। যেহেতু এখানকার শতকরা ৯৫ জন মানুষের যুদ্ধের বিষয়ে সরাসরি কিছু করার নেই, তাই তারা একে তাদের চেতনার বাইরে রাখে। কিন্তু এই পরিস্থিতি আমাদের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে ফেলেছে; ফলে এখন আর কেউ ইরাক নিয়ে নির্মিত কোনো চলচ্চিত্র দেখতে যেতে চায় না।

মার্তেল : আমি ভেনিসে ক্যাথরিন বিগেলোর দ্য হার্ট লকার দেখেছি, সেখানে আমি জুরি হিসেবে ছিলাম। ওই নির্মাতাকে আমার অত্যন্ত প্রতিভাবান মনে হয়েছে। তার চলচ্চিত্রে যুদ্ধের এতো কম প্রতিফলন দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম। ক্যাথরিন বিগেলো অত্যন্ত বুদ্ধিমান উত্তর আমেরিকান নারী; তিনি সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধের ওপর চলচ্চিত্রের শুটিং করতে যান, অথচ সেখানে তার প্রধান বার্তা হলো, 'যুদ্ধ হলো মাদক’। আমার মনে হয়েছে, চলচ্চিত্রটি মূলত নির্মাতার যুদ্ধের বাস্তবতা দেখতে না চাওয়ার প্রবল প্রচেষ্টাকে প্রতিনিধিত্ব করে। দেখতে না চাওয়া, কী ঘটছে তা উপলব্ধি করতে না চাওয়া—এগুলোই বুর্জোয়া শিক্ষার ভিত্তি বলে মনে হয়।

তওবিন : আপনার সব চলচ্চিত্রেই শ্রেণি পার্থক্য খুব গুরুত্ব পায়। আপনার দ্য হেডলেস উইমেন-এ ভেরোনিকার মতো একটি চরিত্র ছিলো। দ্য সোয়াম্প-এ একজন মধ্যবয়সি নারী আছেন, যিনি পরিবারের সবকিছুর প্রতি অমনোযোগী। অন্যরা তার দেখাশোনা করে; তিনি কোনো দায়িত্ব নেন না। কিন্তু তিনি সেখানকার এক ডজন চরিত্রের মধ্যে একজন। দ্য হেডলেস উইমেন-এ ভেরোনিকাই কেন্দ্রীয় চরিত্র। কোনো দর্শক যদি তার প্রতি সহানুভূতিশীল হতে না চায়, বা তাকে পছন্দ না করে, তাহলে চলচ্চিত্রটি থেকে সে দূরত্ব অনুভব করবে। আপনি কি এটাই চেয়েছেন?

মার্তেল : দর্শক ভেরোনিকার সঙ্গে আরো বেশি সংযুক্ত বোধ করা চলচ্চিত্রটির জন্য ভালো না খারাপ, সে বিষয়ে আমি ঠিক নিশ্চিত নই।

তওবিন : আমি যখন প্রথমবার দ্য হেডলেস উইমেন দেখেছিলাম, তখন আমার প্রতিক্রিয়া ছিলো এমন যে, ওই চরিত্রটির সঙ্গে আমি আসলে সময় কাটাতে চাই না। আমি জানতাম, তিনি আসলে কী; তিনি নিন্দনীয়। আমি তার সমস্যা জানতাম; আমি জানি কেনো তিনি নিজেই একটি সমস্যা। এরপর আমি কোনো কিছু এড়িয়ে গেলাম কিনা, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য যখন দ্বিতীয়বার চলচ্চিত্রটি দেখতে গেলাম, তখন আমার প্রতিক্রিয়া একেবারে আলাদা ছিলো। কারণ আমি তাকে পছন্দ না করলেও এটা বলতে পারি না যে, তার সঙ্গে আমার কোনোই মিল নেই! কারণ বিষয়টা তীব্রতার। এটা সত্য যে, তিনি খুবই খারাপ একটি কাজ করেন; কিন্তু আমিও প্রতিদিন এমন কিছু না কিছু করি, যা তার কৃতকর্মের সঙ্গে নির্দিষ্ট মাত্রায় সমান্তরাল। এবং আমি মনে করি, এই বিষয়টিই চলচ্চিত্রটিকে জটিল করে তুলেছে। কারণ এটা কেউ স্বীকার করতে চায় না।

মার্তেল : আমার   মতে, কোনো দর্শক যখন চলচ্চিত্রের কোনো চরিত্রের সঙ্গে একাত্মতাবোধ করে বা সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে; একভাবে দেখলে তা জটিল ও ক্ষতিকর হতে পারে। চলচ্চিত্রে এমন অনেক চরিত্র থাকে যারা সত্যিই জঘন্য কিছু করে। তবু সেগুলো দেখানো হয় যেনো দর্শক তাদের সঙ্গে একাত্মতাবোধ করে; এবং সমস্যাটার মোকাবিলা না করে সেটা নিয়ে স্বস্তিবোধ করে। আমি মনে করি, দর্শকের জন্য এটা ক্ষতিকারক হয়ে ওঠার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। কোনো দর্শকের ওপর কোনো একটি চরিত্রের প্রভাব মূল্যায়ন করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অন্যদিকে কোনো একটি চরিত্রের উপস্থাপন ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক ছিলো, তা নির্ধারণ করাও কঠিন বিষয়। এর জন্য একইসঙ্গে দীর্ঘ সময় এবং নিরপেক্ষতা প্রয়োজন।

তওবিন : ভেরোনিকার চরিত্রের অভিনয়শিল্পী মারিয়া ওনেত্তো (Maria Onetto) একজন অসাধারণ শিল্পী। তিনি কি সাধারণত এ ধরনের চরিত্রেই অভিনয় করেন, যেখানে একইসঙ্গে উপস্থিত থেকেও অনুপস্থিত বা অন্যমনস্ক থাকা যায়?

মার্তেল : তিনি মূলত টেলিভিশনে বা সোপ অপেরার চরিত্রে অভিনয়ের কারণে বিখ্যাত। সেখানে তিনি অনেক সমস্যায় জর্জরিত এক মানসিক ভারসাম্যহীন নারীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তবে আমি তাকে ভেরোনিকার চরিত্রের জন্য নির্বাচন করার মূল কারণ তার রহস্যময়তা। এছাড়াও, তাকে এই চলচ্চিত্রের জন্য পছন্দ করার পেছনে তার শারীরিক বৈশিষ্ট্যেরও ভূমিকা ছিলো। মারিয়া বেশ দীর্ঘদেহী, সাদা চামড়ার অধিকারী ও স্বর্ণকেশী। আমার মনে হয়েছিলো, তার এই শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলো তাকে অনেকের মধ্যে আলাদা করে চোখে পড়তে সাহায্য করে।

তওবিন : আপনার চলচ্চিত্র থেকে আমি যা শিখেছি তার মধ্যে একটি হলো, অর্থনৈতিক বা সামাজিক শ্রেণি প্রকাশে ব্যবহৃত ইঙ্গিত বা প্রতীকগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আর্জেন্টিনায় অনেকখানি আলাদা। নিউ ইয়র্কের একজন নারীকে যদি এমন কোনো দৃশ্যে দেখানো হয়, যেখানে সে নিজের শোবার ঘরে ম্যাসাজ নিচ্ছে, কিন্তু ফাঁকা জায়গার অভাবে তাকে মেঝেতে একটা সঙ্কীর্ণ জায়গায় শুতে হচ্ছে। তাহলে দর্শকের কাছে এমন ইঙ্গিত যাবে, সেই নারী আর্থিকভাবে নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অনেক ব্যবধান রয়েছে। তবে তাদের জীবনধারা আর্জেন্টিনার চেয়ে আলাদা। যুক্তরাষ্ট্রে মানুষের যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা নেই, তবে বড়ো বাড়ি রয়েছে। অনেকেই জানে না তাদের পরবর্তী ডলার কোথা থেকে আসবে, অথচ তাদের একটি বড়ো বাড়ি, একটি বা দুটি বড়ো গাড়ি, এমনকি বিনোদন কেন্দ্রও রয়েছে।

মার্তেল : আমার চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলো কিন্তু তেমন ধনী নয়। তারা মধ্যবিত্তের চেয়ে অল্প বেশি ধনী। তবে আর্জেন্টিনায় মানুষের ভোগবাদী আচরণ যুক্তরাষ্ট্রের মতো না।

তওবিন : কিন্তু দ্য হেডলেস উইমেন-এ বাড়িতে গৃহকর্মী দেখা যায়; যারা সবসময় বাড়ির মালিকদের দেখাশোনা করে। যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ির কাজের জন্য একজন সার্বক্ষণিক মানুষ রাখতে কিন্তু আপনাকে অনেক ধনী হতে হবে।

মার্তেল : হয়তো এ কারণেই আপনার মনে হয়েছে, এখানে অনেক উচ্চবিত্ত কাউকে দেখানো হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে আমি নিজের কথাই বলতে পারি; আর্জেন্টিনায় আমার বাসায় একজন নারী পরিচ্ছন্নতাকর্মী আছেন, যিনি সপ্তাহে একবার আমার অ্যাপার্টমেন্টটি পরিষ্কার করতে আসেন। আর্জেন্টিনার যেকোনো মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীর সাহায্যকারী হিসেবে একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী নারী আছে। সমস্যা হলো, উত্তরাঞ্চলে মানে যেখানে আমার চলচ্চিত্রগুলোর শুটিং করা হয়, সেখানে পরিচ্ছন্নতার এই কাজকে যথাযথভাবে পেশা হিসেবে মনে করা হয় না। এসব পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের মনে করা হয় চাকর। তাদের কাছে আশা করা হয়, তারা কেবল তাদের কাজেই দক্ষ হবে না, বরং পরিবারটির প্রতিও স্নেহশীল হবে। এবং তাদের সঙ্গে একটি পারিবারিক আবেগীয় সম্পর্ক থাকবে।

আমার কাছে এই ব্যাপারটা অনেকটা অদ্ভুত লাগে; এই সামাজিক শ্রেণিগুলো নিজেদের মধ্যে এতোটাই আবদ্ধ থাকে যে, অজাচার (incest) এসব ক্ষেত্রে মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে। তারা যেনো নিজেরা নিজেদেরই প্রেমে পড়েছে। এ কারণেই আমার চলচ্চিত্রে এতো আন্তঃপারিবারিক সম্পর্ক দেখানো হয়। আমার চলচ্চিত্রগুলোর উদ্দেশ্য বাস্তবতার দলিল হিসেবে উপস্থাপিত হওয়া নয়; এগুলো আমার নির্মাণ করা। আমার কাছে এটা খুব অদ্ভুত লাগে, কীভাবে তারা নিজের ও নিজেদের পরিবারের মধ্যে এতোটা আবদ্ধ হয়ে যায়।

তওবিন : তার মানে বলতে চাচ্ছেন, আপনি সামাজিক স্যাটায়ার নির্মাণ করেন?

মার্তেল : আমার চলচ্চিত্রে এমন অনেক উপাদান আছে যেগুলো ঠিক ব্যঙ্গাত্মক নয়, তবে অবশ্যই অতিরঞ্জিত। এই চলচ্চিত্রটিও সেদিকেই যাচ্ছে। এখানে আপনি দেখবেন, একজন শয্যাশায়ী বৃদ্ধা অনেক বছর আগের একটি বিয়ের ভিডিও দেখছেন; তিনি তার মৃত আত্মীয়দের দেখছেন, আর মনে করছেন তারা বেঁচে আছে। এর মধ্যে বাস্তববাদকে ছাপিয়ে জীবনকে দেখার উপাদান আছে। আমার চলচ্চিত্রগুলোকে আমি ন্যাচারালিজম বলে দাবি করতে পারবো না। আর্জেন্টিনায় এমন একটি ধারা রয়েছে; যেখানে বাস্তবের মতো পোশাক, অভ্যাস, ইত্যাদিসহ জীবনের অংশগুলো দেখানো হয়। মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকে তা দেখানোর চেষ্টা করা হয়। এই ধারাটি নৃতাত্ত্বিক, তবে সেগুলোও কল্পকাহিনি।

তওবিন : আপনি সেটা করেন না?

মার্তেল : না। আমি মনে করি, চলচ্চিত্রে যা করি তা আসলেই ‘মিথ্যা’। আমার কাছে চলচ্চিত্র শুধু গল্প বলা নয়, আমার কাছে চলচ্চিত্র দর্শকের সঙ্গে নির্মাতার দৃষ্টিভঙ্গি ও উপলব্ধি ভাগাভাগি করে নেওয়ার একটা চেষ্টা। চলচ্চিত্র আমার কাছে চিন্তাকে দেখানোর একটা প্রক্রিয়া। তবে আমি চিন্তাকে ব্যাখ্যা করি উপলব্ধি আর আবেগের একটি মিশ্রণ হিসেবে। চলচ্চিত্রের জগতে—বিশেষ করে শিক্ষানবিশ ও লেখকদের মধ্যে—এই ধারণাটি প্রচলিত যে চলচ্চিত্র হলো গল্প বলা। আমি এর সঙ্গে একমত নই। আমি মনে করি, চলচ্চিত্র এর চেয়ে অনেক বেশি কিছু। আমি মনে করি, গল্প বলা কেবল একটা শুরু, এটা একটা যন্ত্রের মতো, যার মাধ্যমে গল্পটা বলার পাশাপাশি আরো অনেক কিছু করার আছে।

তওবিন : আপনি সাংবাদিকদের জন্য যে নোটটি লিখেছেন, সেখানে বলেছেন, আপনি স্বপ্নে দেখেন কাউকে হত্যা করেছেন। স্বপ্নের বর্ণনায় আপনি বলেছেন, একজনকে খুন করে তার মাথা আপনি একটি শেলফে রেখেছেন। এবং আপনার বাবা জানেন আপনি কী করেছেন! তিনি আপনাকে একটি নোট লিখে গেছেন এভাবে যে, তিনি আপনার শেলফের তাক গুছিয়েছেন। এটাকে অপরাধবোধ এবং জটিলতা প্রকাশের স্বপ্ন হিসেবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, স্বপ্নের এই বর্ণনা দিয়ে কি আপনি ভেরোনিকা এবং এই চলচ্চিত্রের সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত সম্পর্ককে বোঝাতে চেয়েছেন? 

মার্তেল : অনেক দিক থেকেই এটা ঠিক। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না আমার এই স্বপ্ন অপরাধ বোধের সঙ্গে সম্পর্কিত। আর এই চলচ্চিত্রের মূল বিষয় কিন্তু অপরাধ বোধ নয়। কারণ আমি মনে করি, অপরাধ বোধ আসলে কিছুই ব্যাখ্যা করে না। আমার স্বপ্নটা একটা সম্ভাবনার বিষয়ে—কেউ একটি বড়ো ভুল করলেও, সেই ব্যক্তির বাকি জীবন মোটেও ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে না। এবং কোনো না কোনোভাবে, অন্যদের সাহায্যে, সেই ব্যক্তি তার ভুল কাজটির পরিণতি কাটিয়ে উঠতে পারে।

তওবিন : তাহলে এটা কীভাবে ‘হাড়ের থলে’র সঙ্গে সম্পর্কিত যা আপনি একটু আগেই বললেন!

মার্তেল : যখন আমি কাঁধে ‘হাড়ের থলে’বয়ে বেড়ানোর কথা বলেছিলাম—এটা বলতে আমি মোটেও অপরাধ বোধ বোঝাইনি। আমি মনে করি, এটা এমন একটি বিষয় যা কোনো ব্যক্তির জীবনকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে। আমি অপরাধবোধ সম্পর্কে কথা বলতে পছন্দ করি না। কারণ আমি মনে করি, অপরাধবোধের ধারণা আমাদেরকে কিছুই বুঝতে দেয় না। সুতরাং, ‘হাড়ের থলে’র অর্থ এই নয় যে, আপনার কাঁধে অপরাধবোধ রয়েছে। এর অর্থ, হঠাৎ করেই আপনার জীবন সীমাবদ্ধ হয়ে যায়, আপনার কর্মক্ষমতা, বা আপনি যা হতে চান তা হয়ে ওঠার শক্তি হঠাৎ করে কমে যায়, সীমিত হয়ে যায়। আমি মনে করি, আপনি যখন ক্যাথলিসিজম বা মনোবিশ্লেষণের মতো অপরাধবোধের দিকে মনোনিবেশ করেন, তখন এটা আপনাকে আর কিছুই ভাবতে দেয় না। তাই আমি অপরাধবোধ শব্দটির ব্যবহার এড়াতে চাই; যেনো আমরা খুব সহজে মূল সমস্যাটি গুটিয়ে না ফেলি। আমি মনে করি, দায়িত্ববোধ আর অপরাধবোধ খুব আলাদা দুটি ধারণা।

তওবিন : আমি এবার চলচ্চিত্রের প্রোডাকশন সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করতে চাই। কয়েক বছর আগে আমি যখন দ্য হলি গার্ল নিয়ে আপনার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, তখন সিনেমাটোগ্রাফারের সঙ্গে আপনার কাজের পদ্ধতি নিয়ে কথা বলেছিলাম। এই চলচ্চিত্রে কি একই সিনেমাটোগ্রাফার কাজ করেছেন?

মার্তেল : না। আমি আমার প্রতিটি চলচ্চিত্রে আলাদা আলাদা সিনেমাটোগ্রাফার নিয়ে কাজ করেছি। আমি এটাকেই বেশি সুবিধাজনক বলে মনে করি। তবে আমি আমার সবগুলো চলচ্চিত্রের জন্য একই সাউন্ড রেকর্ডিস্ট এবং সাউন্ড মিক্সারের সঙ্গে কাজ করতে পছন্দ করি।

তওবিন : আমি একটু দ্য হেডলেস উইমেন-এর মিজ-অঁ-সেন সম্পর্কে, সেখানকার শ্যালো ফোকাস রাখার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে—যেখানে ভেরোনিকা ফোকাসে থাকে আর তার চারপাশের সবকিছু ঝাপসা-প্রশ্ন করতে চাই।

মার্তেল : আসলে আমি যখন স্ক্রিপ্টটি লিখছিলাম তখন অনেক চিন্তা করেছি, ভেরোনিকার ওপর ফোকাস এবং পটভূমি বিবর্ণ হওয়া দরকার, নাকি তার বিপরীত। শেষ পর্যন্ত আমি এমন কিছু দৃশ্যের সংমিশ্রণ করেছি, যেখানে শুধু তিনি স্পষ্টভাবে ফোকাসে রয়েছেন, অন্য কিছু স্পষ্ট নয়; আবার এর উল্টোটাও। আমি এমন কিছু দৃশ্য সত্যিই পছন্দ করেছি, যেখানে ব্যাকগ্রাউন্ডটি অতিপ্রাকৃত লাগছে। সাধারণভাবে চলচ্চিত্র দেখার সময় পর্দায় যখন ফোকাস এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর করা হয়, আমি সেটা খুবই অপছন্দ করি। তাই এই স্থানান্তর এড়াতে আমি আগে থেকেই ফোকাস নির্দিষ্ট করে রাখি।

তওবিন : আপনি কি সিঙ্গেল শটের কথা বলছেন?

মার্তেল : সিঙ্গেল শটের সময় আমি শুধু আমার ক্যামেরা সেট করি এবং পুরো শটের জন্য একই ফোকাস রাখি। কখনো কখনো আমরা ফোকাস পরিবর্তনও করি; কিন্তু আমরা শুধু একটি চরিত্রের ওপর ফোকাস রাখি। ক্যামেরা ওই চরিত্রের কাছে আসতে পারে বা দূরে সরে যেতে পারে, তবে ফোকাস কখনো এক চরিত্র থেকে অন্য চরিত্রে স্থানান্তরিত করি না। যতোদূর সম্ভব এটা আমার চলচ্চিত্রের লেয়ার স্ট্রাকচারের সঙ্গে জড়িত।

তওবিন : এই বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিতভাবে কথা বলতে হলে আমাকে চলচ্চিত্রটি আবার দেখতে হবে। কিন্তু আমার মনে হয় না সেখানে কোনো সাবজেক্টিভ শট্ আছে!

মার্তেল : না, নেই।

তওবিন : আপনার অন্য চলচ্চিত্রগুলোতেও এমনটি নেই?

মার্তেল : ক্যামেরা আমার কাছে চলচ্চিত্রেরই একটা চরিত্রের মতো। ফলে আমি ক্যামেরাকে কখনোই অন্য আরেকটি চরিত্রের স্থান দিতে পারি না। এ কারণে আমি চরিত্রগুলোকে পর্দায় বাস্তবসম্মত অবস্থানে রাখি। যখন আমি একটি গাড়ি শ্যুট করি, আমি কখনোই ক্যামেরাটি গাড়ির সামনের অংশে রাখবো না। কারণ সেখানে কোনো চরিত্র থাকতে পারে না। এই চলচ্চিত্রটির ক্ষেত্রে ক্যামেরাকে আমি গাড়ির ভেতরে রেখেছি। কখনো কখনো জায়গার অভাবে আমাকে এটা গাড়ির বাইরে রাখতে হয়েছে। কিন্তু আপনার মনে হবে ক্যামেরার চরিত্রটি গাড়ির ভেতরে।

আমি মনে করি, ক্যামেরা রাখার ক্ষেত্রে আমার যে পদ্ধতি তা চলচ্চিত্রটিকে একটি নির্দিষ্ট আকার দেয়। আপনি চান বা না চান, দর্শক হিসেবে আপনি অনুভব করেন, আপনিও ওই দৃশ্যের একটা অংশ। এবং এই কারণেই আমি স্ট্যাবলিশিং শট্ বা ট্রানজিশন শট্ ব্যবহার করি না। আমি ক্যামেরাকে শারীরিকভাবে উপস্থিত একটি জীবন্ত সত্তা মনে করি, যা আদতে খুব কৌতূহলী ও যার কোনো নৈতিক জাজমেন্ট নেই। ক্যামেরা এমন এক সত্তা, যে চোখের সামনে যাই দেখুক না কেনো—ইতিবাচক বা নেতিবাচক যাইহোক—তা নিয়ে কোনোভাবেই বিচলিত হয় না।

তওবিন : তাহলে আপনি কি এটাকে প্রামাণ্যচিত্রনির্মাতাদের ভাষায় ‘ফ্লাই অন দ্য ওয়াল’ এর মতো হওয়াকে বোঝাচ্ছেন?

মার্তেল : না, ব্যাপারটা মোটেও সেরকম নয়। কারণ একটি ফ্লাই বা মাছির কোনো সচেতন ইচ্ছা, দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যক্তিত্ব থাকে না। কিন্তু আমার চলচ্চিত্রে ক্যামেরা একটি চরিত্রের মতো। নির্দিষ্ট করে বললে, ঠিক একজন মানুষের মতো। যেমন, কোনো দৃশ্যে যদি একটি শব্দ হয়, ক্যামেরা সেদিকে ঘুরবে। ব্যাপারটা এমন যে, কোনো ব্যক্তি হঠাৎ করে একটি শব্দ শুনতে পেলে যেমন সেই শব্দের উৎসের দিকে মনোযোগী হয়, সেরকম। একটা মাছি কখনো এটা করবে না।

তওবিন : তাহলে কি একটা মাত্রা পর্যন্ত আপনি নিজেকেই ক্যামেরা মনে করেন? যেনো আপনি নিজেই দৃশ্যে উপস্থিত?

মার্তেল : হ্যাঁ, এটা আমি। তবে সেটা আমার বর্তমান সত্তা নয়, আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোটো একটি চরিত্র।

তওবিন : কেনো?

মার্তেল : প্রথমত, যখন আমি ক্যামেরার কাছাকাছি যাই, তখন আমি এক ধরনের কৌতূহল বোধ করি, যেনো স্ক্রিপ্টটি আমি লিখিনি। এর মূল উদ্দেশ্য হলো চিত্রগ্রহণের সময় আমি এমন কারো মনোভাব রাখতে চাই, যে জানে না ঘটনাপ্রবাহে এরপর কী হবে। আমি মনে করি, আমি বা অন্য যেকোনো নির্মাতার জন্য কৌতূহলী হয়ে পরিচালিত হওয়া খুব জরুরি। শুধু দৃশ্যের বিষয়ে নয়, বরং অভিনয়শিল্পীদের বিষয়েও কৌতূহলী থাকা দরকার। তাছাড়া এটা কল্পনা করা মুশকিল হয় যে, চরিত্রগুলোকে কীভাবে ক্যামেরায় ধারণ করা হবে। আমার মনে হয়েছে, ১০ বছর বয়সি শিশু হিসেবে এই ইচ্ছা, কৌতূহল ও নৈতিকতা বিচার না করার উপাদানগুলো ধারণ করা সহজ। কিন্তু আপনি যদি আমাকে প্রশ্ন করেন, আমি ১০ বছর বয়সে চিত্রগ্রহণের কথা ভেবেছিলাম কিনা¾না, আমি ভাবিনি।

তওবিন : দ্য হেডলেস উইমেন কি এখনো আর্জেন্টিনায় প্রদর্শিত হয়?

মার্তেল : আসলে, এই ধরনের চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা নিয়েও আর্জেন্টিনাতে আমরা কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছি। এটা অবিশ্বাস্য, কারণ আর্জেন্টিনায় প্রতিবছর ১২০টির বেশি চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়। কিন্তু আমাদের যথাযথ বিতরণ ব্যবস্থা নেই। এই চলচ্চিত্রগুলো একইসঙ্গে সেই সব থিয়েটারেই দেখানো হয়, যেখানে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রও চলে। ফলে ভিন্ন চিন্তার কাজগুলো শ্রেক বা ব্যাটম্যান-এর মতো চলচ্চিত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে না। এই চলচ্চিত্রগুলোর দর্শক সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য আমাদের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে আমাদের দুর্দান্ত সব প্রোডাকশন থাকা সত্ত্বেও তা দর্শকের কাছে পৌঁছায় না। বিষয়টি আমার কাছে অদ্ভুত লাগে; কারণ ফুটবলের ক্ষেত্রে আমাদের ব্যবস্থাপনা খুবই বুদ্ধিদীপ্ত। আন্তর্জাতিক ফুটবলের জন্য আমাদের বড়ো স্টেডিয়াম আছে, ছোটো স্টেডিয়ামও আছে আবার প্রশিক্ষণকেন্দ্রও আছে। চলচ্চিত্রের বেলায় এমন না।

সাক্ষাৎকারের লিঙ্ক : https://www.filmcomment.com/article/shadow-of-a-doubt-lucrecia-martel-interviewed/; retrieved on : 27.11.2024

 

অধরা মাধুরী, গণযোগাযোগ সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর শেষে কিছুদিন সাংবাদিকতা, এর পর কিছুদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা, আবার সাংবাদিকতা করছেন।

madhuriadhara771@gmail.com

https://www.facebook.com/adhara.paroma

 

টীকা

১. ফ্লাই অন দ্য ওয়াল : এটা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের একটা ধরন। চলচ্চিত্র নির্মাণের পর্যবেক্ষণ শৈলী থেকে এর উদ্ভব। ১৯৬০-এর দশকে এই ধারণাটি জনপ্রিয়তা পায়। এই প্রক্রিয়ায় বাস্তব জীবনের পরিস্থিতিকে নির্মাতা কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ ছাড়াই ক্যামেরাতে ধারণ করে। ক্যামেরা এখানে অদৃশ্য পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকে।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন