সাজ্জাদ বকুল, আ-আল মামুন, মামুন হুসাইন ও তানভীর শাওন
প্রকাশিত ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
“‘শুনতে কি পাও’ দেখতে দেখতে ব্যক্তিগত পাপের জায়গাটা বুঝতে পেরেছি”
সাজ্জাদ বকুল, আ-আল মামুন, মামুন হুসাইন ও তানভীর শাওন

গত ১৪ অক্টোবর ২০২৩ ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একাডেমিক ভবনের ১৫০ নম্বর কক্ষে ‘নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন-এর সঙ্গে একবেলা’ শিরোনামে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেই অনুষ্ঠানে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, ‘ম্যাজিক লণ্ঠন আড্ডা’, ‘ম্যাজিক লণ্ঠন বাতচিত’ (দর্শকের মুখোমুখি নির্মাতা) এর আয়োজন করা হয়। কামারের শুনতে কি পাও চলচ্চিত্রটি প্রদর্শনের পর এ নিয়ে সম্পূরক ‘ম্যাজিক লণ্ঠন আড্ডা’য় অংশ নেয় প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মামুন হুসাইন, শিক্ষক ও গবেষক আ-আল মামুন, চলচ্চিত্র সংগঠক ও অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ বকুল এবং চলচ্চিত্রবিষয়ক লেখক তানভীর শাওন। পুরো এই আড্ডাটি অনুলিখন করে দুই পর্বে ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’-এর পাঠকের জন্য হাজির করা হলো। — সম্পাদক
দ্বিতীয় পর্ব
সাজ্জাদ বকুল : ধন্যবাদ। চমৎকার কথা! সাহিত্যের নির্মাণশৈলীর সঙ্গে চলচ্চিত্র নির্মাণশৈলীর একটা সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলেন মামুন হুসাইন। আমরা এ ধরনের চলচ্চিত্রকে যে নামেই অভিহিত করি না কেনো, এই চলচ্চিত্রগুলো সমাজের কথা বলে, জীবনের কথা বলে, সময়ের কথা বলে। এবং যে বিষয় নিয়ে এই সিনেমাটি তৈরি হয়েছে সেটা একটা দুর্যোগ কবলিত এলাকার মানুষের জীবনসংগ্রাম। সংবাদপত্রে আমরা এ রকম রিপোর্ট দেখি। এই ধরনের দুর্যোগের পরে তা নিয়ে এবং তাদের জীবনযাপন নিয়ে সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে আলোচনার জন্য আমি এবার তানভীর শাওনের কাছে যাবো। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের যে কাঠামো তার সঙ্গে ডকুমেন্টারি ফিল্মের উপস্থাপনের কাঠামোর—বিশেষ করে শুনতে কি পাও-এর প্রেক্ষাপটে যদি ভাবি—কতোটা পার্থক্য তৈরি করলো? এক্ষেত্রে নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন সেই সব মানুষের বা তাদের জীবনগাঁথা তুলে আনলেন এবং চলচ্চিত্রের ভাষাগত দিক থেকে তিনি তাদেরকে যুক্ত করতে পারলেন কি না-তানভীর শাওন কী মনে করেন?
তানভীর শাওন : ধন্যবাদ। প্রথমত আমি ধন্যবাদ দিতে চাই ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’কে। সাধারণত আমি দেখতাম, ‘ম্যজিক লণ্ঠন’ কথামালার আয়োজন করে। সেখানে প্রধানত নির্মাতাদেরকে আনা হয়, সেটা নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চলে। এই আয়োজনের তারা নাম দিয়েছে আড্ডা। এটা ঘরোয়া আড্ডার মতো। সিনেমা দেখে সেটা নিয়ে একসঙ্গে বসে কথা বলা। এটা আমার ভালো লাগছে। এজন্য ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’কে ধন্যবাদ।
যাইহোক, আমি যখন সিনেমাটা দেখছিলাম, তখন সামহাউ ডকুমেন্টারি বলতে আমার চোখে যা ভাসে, ডকুমেন্টারিতে প্রথাগত যে বাস্তবতা বয়ে যায়, সেটা জাস্ট ধারণ করা অ্যাজ ইট ইজ; একটা রিয়েলিটিকে ক্যামেরার সামনে আনা, পর্দার সামনে আনা; সেটা কিন্তু এটা নয়। ডকুমেন্টারিতে একটা লোককে বসিয়ে দেওয়ার পর উনি যে কথাটা বলছেন, সেটা আমরা ক্যামেরাবন্দি করছি। সেটা শুনলে কিন্তু বোঝা যায়, এর বাইরে কিছু প্রশ্ন-উত্তর আছে। আমি হয়তো শুনেছি এবং কিছু প্রশ্নের ইঙ্গিত দিয়েছি। যদি সেই অনুযায়ী ওই ব্যক্তি কথাগুলো বলেন। কিন্তু আমার কাছে শুনতে কি পাও দেখার পুরোটা সময় মনে হয়েছে, এখানে যে রিয়ালিটি এসেছে, এ তো পুরোপুরি। মানে একেবারে শীতল জলের মতো। এতে একটা নদী দেখছি। একটু পর পর নদীর শট্ আসছে। সে নদীর জলধারার মতোই ওই লোকগুলোর জীবনের আলো-আঁধার, সন্ধ্যা, সকালের বাস্তবতাগুলো বয়ে যাচ্ছে। নির্মাতা যেনো নির্মোহভাবে ওই বাস্তবতাকে ক্যামেরায় তুলে এনেছেন। যেনো যে বাস্তবতাটা বয়ে যাচ্ছে, ওইটাই কোথাও একটা চোখ যেনো অবিরত নির্মোহ থেকে জাস্ট ক্যামেরাবন্দি করেছে। বাস্তবতাগুলোকে আমাদের সামনে একেবারে বাড়া ভাতের মতো যেনো গরম গরম এটা পরিবেশন করলো। তা দেখে মন ভরে গেলো। এখানে তাদের ডায়ালগগুলো গুরুত্বপূর্ণ। ডায়ালগের মধ্যে কোনো ধরনের কৃত্রিমতা নেই—তাদের যে হাস্যরস, তারা ঠাট্টা করছেন একজন আরেকজনের সঙ্গে। তাদের প্রতিদিনের সংগ্রাম এবং তার ফাঁকে কৌতুক চলছে, হাসাহাসি চলছে। এবং এর ফাঁকেও তাদের মধ্যে কিন্তু একটা স্বপ্ন আছে মোবাইল ফোন কেনার।
তার পর আরেকটা জিনিস আমি বলবো, সিনেমার ভেতরে একটা জিনিস লক্ষ করলাম, এখানে কথায় কথায় দুই নারী বলছে, তাদের বাড়িতে ওই জায়গায় একটা পেয়ারা গাছ ছিলো; যে গাছের ডাল ভেঙে পড়তো; সেখানে অনেক পেয়ারা ধরতো। সেই গাছটা কালের বিবর্তনে মরে গেছে বা হয়তো ভেসে গেছে। আসলে এই গাছটা মানে কী! তাদের সঙ্গে গাছটার যেনো আত্মীয়তা ছিলো; যেনো গাছটা তাদের পরিবারের সদস্য। তাদের যেমন বাবা ছিলো, মা ছিলো, তারাও চলে গেছে। কালে কালে ওই গাছটার সঙ্গে যে সম্পর্ক, সেটাও গেছে। গাছটা মরে গেছে। আইলার পরে বর্তমানে তারা যে জায়গায় এসেছে, সে জায়গায় তারাও কিন্তু এক একটা গাছের মতোই। সেখানে কিন্তু আমি দেখছি রাষ্ট্র ভীষণভাবে অনুপস্থিত। রাষ্ট্র কিন্তু বহু দূরের ব্যাপার তাদের থেকে।
যদিও স্কুলে আমরা দেখছি বাচ্চারা বইয়ে পড়ছে, সুনাগরিক হতে গেলে কী কী করতে হয়। এই কথা শুনতে হয়; রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করা লাগে। কিন্তু আমরা অন্য জায়গায় দেখছি, সরকারি সাহায্য নামে যে জিনিসটা আছে, সেই সাহায্যের কিন্তু সুষম বণ্টন নাই। তার মানে রাষ্ট্র ওখানে বিশেষভাবে অনিশ্চিত এবং অনুপস্থিত। আবার কিছু বিদেশি এন জি ও দেখছি, সেগুলো সাহায্যের বিজ্ঞাপন দিয়েই ঝুলে আছে মাত্র। সেগুলোকেও আমি সাহায্য বলতে চাচ্ছি না। ফলে দেখেন রাষ্ট্র কিন্তু ওখানেও নাই। আবার দেখবেন স্কুলে বা টোল ঘরে যে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, সেখানেও কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নাই। ওখানে যে গৃহবধূ পড়াচ্ছেন, নামমাত্র টাকার বিনিময়ে পড়াচ্ছেন। সেই ব্যাপারটাও স্পষ্ট নয়। যে বাস্তবতা উনি ওখানে এনেছেন তার পুরোটাই অস্পষ্ট। আসলে গল্পটাই অস্পষ্ট। গল্পটা অনিশ্চিত, অনিশ্চয়তার গল্প; আলো-আঁধারের গল্প। ওই আলো-আঁধারের গল্পটা সেলুলয়েডের পর্দায় এনে মানুষকে দেখানো চাট্টিখানি কথা নয়।
স্যার [সাজ্জাদ বকুল] যেটা বললেন, সংবাদ মাধ্যমের যে প্রতিবেদন এবং তার সঙ্গে বাস্তবতার যে মিল-অমিল, সেগুলো আছে। তার সঙ্গে এই গল্প দেখতে গিয়ে আমার যা মনে হয়েছে, এখানে ডকুমেন্টারির যে একটা ভিন্ন ধাঁচ, মানে সাধারণ ডকুমেন্টারিকে এটা সংজ্ঞায়িত করেছে নতুন করে। এখানে ফরাসি সিনেমার যে একটা ধারা আমরা পড়েছিলাম, সিনেমা ভেরিতে’র কথা মনে হচ্ছে। এখানে ন্যাচারাল সাউন্ড নেওয়া হয়েছে, পেশাদার কোনো আর্টিস্ট নেই। এখানে দেখবেন পুরোই অ্যাজ ইট ইজ তুলে আনা হয়েছে। এখানে আরেকটা জিনিস আছে, সব সিনেমায় তো কোথাও কোথাও ডায়ালেক্টিক আসে; মন্তাজ আসে; কোথাও কোথাও দ্বন্দ্ব আসে। এখানে সবচেয়ে বড়ো দ্বন্দ্ব রাষ্ট্র ইটসেল্ফ। সাহায্যের সমবণ্টনে এখানে রাষ্ট্র নাই।
আবার দেখবেন বাচ্চাদের পাঠ্যক্রমে, তাদের বেড়ে ওঠায়, প্রথম সিলেবাসে, প্রথম পড়ালেখায় রাষ্ট্র বিষয়টা আছে। তার মানে এই যে রাষ্ট্রের দ্বৈত সত্তার ভূমিকা, এটা কিন্তু এখানে এসেছে। যাইহোক আমার কাছে এই জিনিসটা ভালো লেগেছে। এবং আরেকটা ব্যাপার বলতেই হয়, বাচ্চাগুলো যখন খেলতে যায়—আপনারা ওই সিনটা একটু মনে করেন—একটা বাচ্চা আর একটা বাচ্চাকে বলছে, তোর বাড়ি কই? বা আমার বাড়ি কই? এখানে তারা খেলার ছলে দেখিয়ে দিচ্ছে, কোনো একটা অনিশ্চিত দিকে আঙুল দিয়ে। বলছে আমার বাড়ি তো ওই দিকে। আসলে তার বাড়িটা কোথায় তাহলে? বাড়ির ধারণা এখানে প্রচণ্ডরকমে অনির্দেশক। যেমন আমাদের রাষ্ট্র ধারণাও অনির্দেশক। রাষ্ট্রকে পুরো সংজ্ঞায়িত করা; রাষ্ট্রকে জানা ও বোঝা; কিংবা রাষ্ট্রের যে গোড়ার দিকটা, একেবারে গোড়ার ভূমিকার দিকটা নিয়ে এই সিনেমাটা কিন্তু দারুণভাবে ভাবায়, প্রশ্ন তোলে। এবং দ্বিতীয়ত, আমার কাছে মনে হয়, রাষ্ট্র যেমন এখানে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়, তেমনই ওই বাড়ি-ও। বাড়ি মানে একটা মানুষ, একটা পরিবার, একটা সমাজ ক্রমাগত তার পরিচয় খুঁজে চলে। ক্রমাগত তার আত্মীয় খুঁজে চলে। তার স্বপ্নকে চেঞ্জ করে। ফলে এখানে শুধু টিকে থাকার গল্প নয়, এটা আমার কাছে একইসঙ্গে ড্রিম চেঞ্জের গল্প; ভাগ্য বদলের গল্প।
আমি আরেকটা জিনিস ভাবছিলাম সিনেমা দেখতে দেখতে, কিছু সিনেমায় দেখবেন সিনেমায় কী দেখানো হচ্ছে, তার চেয়ে ইম্পরট্যান্ট সিনেমার গল্পটা কীভাবে ক্যামেরাবন্দি করা হয়েছে সেটা। কিংবা ক্যামেরার পেছনে যারা ছিলো, তারা কীভাবে কী করেছে? কিংবা তাদের উপস্থিতি কি ওই সব মানুষকে প্রভাবিত করেছে? নির্মাতার কাছে এই প্রশ্নটা থাকলো, অনুষ্ঠানের পরের পর্বে তার কাছে এর উত্তর আমি আশা করছি।
সিনেমায় ক্যামেরার সামনে যে মানুষগুলোকে দেখলাম দেড় ঘণ্টা যাবৎ, তাদের সামনে যখন সেলুলয়েডে এটা বন্দি করা হলো, সেখানে আপনাদের উপস্থিতি তাদের ভেতরে কী ধরনের ভূমিকা ফেলেছিলো? কিংবা তারা কতোটা প্রভাবিত হয়েছিলো? এই কথাটা বার বার আমি ভাবছিলাম। যখন ওরা খেতে বসে কথা বলছে, দেখে মনে হচ্ছিলো আমার বাবা-মা—আমি ছোটোবেলায় দেখেছি খেতে বসে তারা জরুরি কথা বলতো—এই মাসে কী হলো, বা কালকে কী হবে? তারাও একইভাবে কথা বলছে অবিচল থেকে। এই ব্যাপারগুলো নিয়ে আমি নির্মাতার কাছে একটু শুনতে আগ্রহী। ধন্যবাদ। কথা চলুক। সময় থাকলে পরে আরো কিছু বলবো।
সাজ্জাদ বকুল : অনুষ্ঠানের মাঝখানে আমাদের কিছু সময় নষ্ট হয়েছে, না হলে আরো কিছু কথা শোনা যেতো। এরপরেও হয়তো আরেকবার করে আমরা উপস্থিত গুণীজনদের কাছে যাবো। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা যদি বলি, এই সিনেমার সিনেমাটোগ্রাফিও অসাধারণ! সাউন্ডও খুবই চমৎকার! মানে ডকুমেন্টারি নির্মাণে সাউন্ড নিয়ে খুবই ভুগতে হয়। এখানে অসাধারণ সাউন্ড, চমৎকার লোকেশন! সিনেমার দৃশ্য একেবারে পেইন্টিংয়ের মতো! আমরা সবমিলিয়ে কামার আহমাদ সাইমনের জন্য একটা করতালি দিতে পারি।
আসলে এ ধরনের সিনেমা সাধারণত আমরা দুভাবে করতে পারি; একটা ডকু-ড্রামা; যেখানে রিয়েলিটির সঙ্গে ফিকশন হাজির থাকে। অন্যটা হলো পুরোটাই নন-ফিকশন। এখানে এক ধরনের ব্লেন্ডিং আছে। এখানে মূলত রিয়েল ঘটনাকে ঘিরে এটা করা হয়েছে, কিন্তু ধরনটা ফিকশনের মতো। একটা পরিবার এবং তাদের গল্পে আমরা দেখি দুর্যোগকে। আসলে এখানে সৌমেন, রাখি এবং তাদের যে লড়াই, সেটাকে বড়ো করে তোলা হয়েছে। এই দুইজনের মধ্যে যদি প্রোটাগনিস্ট হিসেবে ধরি, আমি রাখিকে পাই। রাখি সিনেমাজুড়ে রাজত্ব করেছেন। রাখি অনেক ধরনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। তিনি যেভাবে পরিবারটাকে আগলে রাখছেন, তার গল্পটাই উঠে আসতে দেখি।
এখন আ-আল মামুন ভাইয়ের কাছে আমার প্রশ্ন থাকবে, এই যে বাস্তবের একটা ঘটনার ভেতর থেকে পিন পয়েন্ট করে—দুর্যোগ তো আছেই—সেখানে একজন নারী, পরিবারের প্রতি তার যে দায়িত্ববোধ, সেখানে তার পরিবারকে পরিচালনার জন্য যে সংগ্রাম এবং নতুন আবাসস্থলে যাওয়ার যে লড়াই, সবকিছু নিয়ে এই সিনেমাকে যদি আমরা অ্যানালিসিস করি, তাহলে কী বলতে পারি? যদিও আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই। ছোট্ট করে আপনার কাছে এই প্রসঙ্গটা জেনে তারপরে মামুন হুসাইনের কাছে যাবো।
আ-আল মামুন : ধন্যবাদ। আমার কাছে যেটা মনে হয়, এখানে রাখি প্রধান চরিত্র নিঃসন্দেহে। কারণটা হলো, এখানে নারী, প্রকৃতি ও শিশু, এই তিনটার উপস্থিতি যদি লক্ষ করি, এটা প্রবলভাবে উপস্থিত। এখানে শিশুর উপস্থিতি যতো বেশি, শিশুর ডায়ালগও ততো বেশি। নারীর স্যাটায়ার করা পুলিশকে দিয়ে; তাদের একসঙ্গে বসে আড্ডা দেওয়া; নারীর ভয়েজটাকে রেইজ করা—‘তোমার ফোনের দরকার আছে, আমার নাই? তোমার মন্ত্রীর সাথে কথা বলা লাগে, আমার কি দেশের বাইরের কারোর সাথে কথা বলা লাগে না?’ নিজেদের কথাগুলোকে তারা যে এমনভাবে বলতে পারছে—সত্যিকার অর্থে আমরা যদি সো কল্ড ভদ্রলোক সমাজের বাইরে যাই; যদি বাংলাদেশের চাতালগুলোতে যাই, যেখানে ধান শুকানো হয়; কিংবা একেবারে প্রান্তিক এলাকাগুলোতে যাই; কিংবা বস্তিগুলোতে যাই; তাহলে দেখবেন সেখানে নারী কিন্তু অনেক বেশি স্ট্রং ক্যারেক্টারের। সেখানে আমাদের মতো এ রকম পুতুপুতু নারী নাই; যেটা এই সমাজে ভর্তি।
আমার কাছে মনে হয়, যে রিয়েলিটির মধ্যে আমরা বাস করি, এটা বানানো ভদ্রলোকের রিয়েলিটি। তার বাইরে যদি আমরা দেখতে চাই, সেখানে কিন্তু পাখি, নদী, শিশুর উপস্থিতি। তার যে প্রাণবন্ত, প্রাণের প্রকাশ এবং শক্তির প্রকাশ এবং সেটা ন্যাচারের সঙ্গে মিলিয়ে-এটাই মনে হয় মূল শক্তির জায়গা। আমার কাছে মনে হয়, কামারের চুলের দিকে তাকান, সুলতানের চুলের দিকে তাকান, রবি ঠাকুরের চুলের দিকে তাকান, বুঝবেন দিস ইজ অ্যা ডিফারেন্ট কাইন্ড অব কনস্ট্রাকশন অব দ্য সেল্ফ অ্যান্ড কমিউনিটি—যেটা আসলেই দরকার। যে সো কল্ড পৌরুষ এবং পুরুষত্ব আমরা নির্মাণ করে চলেছি বার বার, তার বাইরে এসে ভাবতে শেখা এবং বুঝতে শেখা আমাদের ভীষণভাবে দরকার। এখানে ক্লাইমেট চেঞ্জের গল্প একটা উপলক্ষ। কিন্তু শুনতে কি পাও-এর গল্পটা আসলে ক্লাইমেট চেঞ্জে থেমে থাকে না। ক্লাইমেট চেঞ্জের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে শক্তির গল্পটা; প্রান্তিক মানুষ, নারী, শিশু, প্রাণের গল্পটা। এবং সিনেমাটা যখন শেষ হচ্ছে, আমরা দেখি একটা ট্রলার আসছে। দুটো মানুষ রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। একটা ফিউচারের কথা উঠছে, যে ভবিষ্যৎ নির্মাণের দায়িত্ব তো তাদেরই। ধন্যবাদ।
সাজ্জাদ বকুল : আল মামুন ভাই কামার আহমাদ সাইমনের চুলের কথা বললেন। ঠিক তার পেছনে বসেই ছবিটা দেখছিলাম। ছবির শেষের দিকে একটা দৃশ্য ছিলো, রাখি তার খোঁপা খুলে চুল এলোমেলো করে দেয়। ঠিক ওই মুহূর্তে দেখলাম কামার আহমাদ সাইমন তার চুলগুলো খুলে এলোমেলো করে দিলেন। টাইমিংটা এতোই অসাধারণ ছিলো! আমি ভাবছিলাম রিয়েল টাইমে ছবি শ্যুট করতে যেমন তিনি সফল, ঠিক তেমনই প্রদর্শনীর সময়ও তার সঙ্গে তাল মেলাতে তিনি সফল হয়েছেন। এটা জাস্ট আমি একটু মজা করলাম! অনেকক্ষণ ভারী ভারী কথা হচ্ছে।
এবার আমরা কথাসাহিত্যিক মামুন হুসাইনের কাছে যাবো, তিনি একইসঙ্গে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। তিনি বার বার আমাদেরকে অধ্যাপক বলছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেও একজন অধ্যাপক, মনোচিকিৎসক। আমরা মামুন হুসাইন স্যারের কথা দিয়েই আজকের এই আড্ডা শেষ করবো। আপনি একজন চলচ্চিত্র বক্তাও। আপনি যতোই বলুন, আপনি চলচ্চিত্র নিয়ে কিছু জানেন না, কিন্তু আমরা জানি চলচ্চিত্র নিয়ে আপনার অসাধারণ সংগ্রহ আছে; আপনি নিয়মিত ছবি দেখেন। এবং আপনি চলচ্চিত্রকে খুব চমৎকারভাবে পাঠ করতে পারেন। ফলে এই সিনেমার যে শক্তিমত্তা, সেই জায়গা থেকে আপনার কী মনে হয়, ছবিটা কোন দিক থেকে আমাদের সঙ্গে কানেক্ট করতে পারলো? এবং সফল হতে পারলো? সেই কথা দিয়েই আজকে আমরা এই আলোচনা শেষ করবো।
মামুন হুসাইন : বলতে গেলে এর জবাব আমি আগেই খানিকটা দিয়ে ফেলেছি। আবার পুনরাবৃত্তির মতো হয়ে যাচ্ছে। আসলে ছবির শক্তিমত্তা কী? মানে যেমন ধরুন, শুনতে কি পাও দেখতে দেখতে ব্যক্তিগত পাপের জায়গাটা বুঝতে পেরেছি। আমরা যেমন ডাঙার মানুষ। অথচ কীভাবে ওই মানুষগুলো বেঁচে আছে? আপনারা নিশ্চয় লক্ষ করলেন, এক কলস পানির জন্য কতো দীর্ঘপথ তাদের যেতে হয়! এই যাওয়াটা কিন্তু খুব সহজ নয়। উত্তরবঙ্গের একজন নারী বা আমাদের পূর্ববঙ্গের একজন নারী যেভাবে বাড়ির পানীয় জল সংগ্রহ করেন, এই বিষয়টা কিন্তু তা নয়। আমি এক জায়গায় পড়েছিলাম, রাজস্থানে যখন বিয়ে দেওয়া হতো, তখন মেয়ের বাবা দেখতেন কতো কম দূরত্বে গিয়ে তার মেয়েকে পানি আনতে হবে। দেখবেন রাজস্থানের মেয়েরা লম্বা সারি বেঁধে একসঙ্গে চলে যায়, তাদের মাথায় পাগড়ির মতো কী যেনো আছে এবং এর সঙ্গে নানারকম ফোক সঙ্গীত আছে। অসম্মান বা যেটাই বলি, নিজের কাছে পাপের জায়গা মনে হয়, ডাঙার মানুষ কতো সহজভাবে বেঁচে আছে। আমরা এই দেশে কতো চমৎকার সুবিধাবাদী জীবনযাপন করছি। তার একদম উল্টো পরিপ্রেক্ষিতে এই মানুষগুলোর বেঁচে থাকা; মানবেতরভাবে বেঁচে থাকা।
একটা রাষ্ট্র সবচেয়ে কল্যাণময় কাজ করছে কিনা বোঝার বড়ো একটি পরিমাপক, যারা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে তাদের প্রতি রাষ্ট্র বা আমরা কী দায়ভার বা কী দায়িত্ব পালন করছি? এই বিষয়টি আমার কাছে বার বার মনে হয়েছে। এবং এই ছবিটি করা, মানে কী অমানুষিক পরিশ্রম তাদের করতে হয়েছে। সেই টাই সিনেমা দেখতে গিয়ে বার বার আমার মনে হচ্ছিলো। যেমন ধরুন, জোয়ার ভাটার কথা এসেছে। ওই যে বলছেন, ভাটার সময় পাঠিয়ে দেবেন। হয়তো নির্মাতা ওই সময় চেয়েছেন যে পানি আসবে, তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। কিংবা ধরেন সূর্য, আলো, চাঁদ যেটাকে নিতে চাইছেন নির্মাতা; সেটাও সবসময় করা এতো সহজ কাজ ছিলো না। আমার মনে হয় সেই অসাধারণ কাজটি উনি করেছেন। আমরা ওই কথাটিই বলতে পারি, জীবন নামক আশীর্বাদ আমাদেরকে শেষ পর্যন্ত কীভাবে বাঁচিয়ে রাখে! একটু একটু করে স্বপ্ন জোগায় এবং আমরা শ্রমশীল হই, রক্তাক্ত হই, বিক্ষুব্ধ হই; আবার ঘুরে দাঁড়াই। হয়তো তারাশঙ্করের উপন্যাসের সেই বিখ্যাত উক্তি বলতে হয়, ‘জীবন এত ছোট কেনে’? সেই মায়া, আমার মনে হয় এই ছবি দেখতে দেখতে আবার জাগ্রত হলো। এজন্য পরিচালক তো বটেই সঙ্গে আয়োজক যারা আছেন, তাদের সবাইকে আমার পক্ষ থেকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
সাজ্জাদ বকুল : আমরা আবারও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি মামুন হুসাইন, আ-আল মামুন ও তানভীর শাওনকে। এবং আমাকেও আমি ধন্যবাদ দিতে চাই; কারণ আমিও একজন আলোচক। আপনারা যারা এখানে উপস্থিত থেকে আমাদের আলোচনাটা শুনলেন, বোরিং আলোচনা, তাদের সবাইকে ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেষ করছি। এবং পরের পর্বে আপনাদের সবার আবারও আমন্ত্রণ রইলো। [দর্শকের হাততালি]
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন