Magic Lanthon

               

আসিফ রহমান সৈকত

প্রকাশিত ২৮ অক্টোবর ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

‘দ্য প্রেসিডেন্ট’

এক স্বৈরশাসকের গল্প গণতন্ত্রের চর্চার কথা স্মরণ করায়

আসিফ রহমান সৈকত

এক.

দীর্ঘদিনের শোষিত মানুষ হঠাৎ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে স্বৈরশাসককে ধরার জন্য। উন্মাদের মতো তারা প্রেসিডেন্টকে ধরতে হামলে পড়ে। তাদের সব ক্রোধ, আক্রোশ, হতাশা আর অবহেলার কারণ যেনো কেবলই স্বৈরশাসক, আর কেউ নয়। যেনো জনগণের কোনো দোষ নেই; তাদের কোনো কমতি নাই; তাদের কিছুই করার ছিলো না। কোনো দায় নাই তাদের। জনগণ মানে যেনো নিরপরাধ এক গোষ্ঠী।

যে সৈনিকরা এখন স্বৈরশাসককে খুঁজছে তারাই কিছুদিন আগে, তার কথায় মানুষ মেরেছে। নিরপরাধ মানুষ!  স্বৈরশাসক এই সৈন্যদের সাহায্য ছাড়া কি এসব অপকর্ম করতে পারতো? স্বৈরশাসকের কথায় জনগণেরই বিশাল অংশ তাকে রক্ষা করেছে, তার অপকর্মে অবৈধ উপার্জনে নিজেও ভাগ বসিয়েছে; তাহলে একা স্বৈরশাসকের ওপর এতো রাগ যারা দেখাচ্ছে তাদের আগে নিজেদের দিকে তাকানো দরকার।

ওই স্বৈরশাসককে শাস্তি দিয়ে আরেক স্বৈরশাসকই হয়তো ক্ষমতায় আসবে; যেহেতু দিনশেষে অনেকে এই শাসনকেই জানে বা চিনে বা পুরো সিস্টেম এভাবেই যুগের পর যুগ সবাই মিলে দাঁড় করিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ জনগণের মধ্য থেকে একজন বলেন, তাহলে আমরা কী করবো?

বিপরীতে সচেতন এবং চিন্তাশীল জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে একজন মানুষ তখন বলেন, শাসককে সত্যিকারের গণতন্ত্রের জন্য নাচতে বাধ্য করো; নাচাও তাকে। তাকে গণতন্ত্রের মাধ্যমে দেশ চালানোর জন্য চাপ দাও। যাতে তার পক্ষে বা বিপক্ষে যেই হোক, ক্ষমতায় এসে আবার স্বৈরতন্ত্র চালু না করে। যাতে পক্ষে বা বিপক্ষে যেই হোক, ক্ষমতায় গিয়ে গণতন্ত্র ভুলে না যায়। যাতে সেও প্রতিটি কাজে মানুষের মতামতের অপেক্ষা করে, তাদের মতামতের ওপর সিদ্ধান্ত নেয়, একক সিদ্ধান্ত খেয়াল খুশি মতো চাপিয়ে না দেয়। নিজেকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে না ভাবে। মানুষের কথা ভাবে। জনগণের কথা ভাবে। শুধু দেশের জন্যই যেনো কাজ করে। শুধু নিজের লোকের জন্য না, পরিবারের জন্য না।

হযরত আলী (রা.) এর একটা বক্তব্যের মর্মার্থ অনেকটা এই রকম যে - জনগণ যেমন, তার নেতারাও আসলে তেমনই হয়। তাই জনগণের চিন্তাভাবনা, অন্যের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার অভ্যাস তৈরি না হলে, কেবল নেতা পরিবর্তন হতে থাকবে; অন্যায় শাসন ‘স্বৈরশাসন’ হয়েই ফিরে আসবে এই জনগণের ওপরে। হয় এটা এক নায়কের হবে, বা ১০-২০ জনের সম্মিলিত স্বৈরশাসন হবে। এই রকম একটা নাম না জানা, অজ্ঞাত দেশের বা অঞ্চলের এক প্রেসিডেন্টের কাহিনি দ্য প্রেসিডেন্ট, যেখানে একজন স্বৈরশাসক তার নাতির মনোরঞ্জনের জন্য সারাদেশের বাতি, পাখা, বিদ্যুৎ ইচ্ছেমতো বন্ধ করেন , আবার খুলে দেন। মহসিন মাখমালবাফ-এর নির্মিতদ্য প্রেসিডেন্ট ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে মুক্তি পেলেও তা সবসময়ের, সব কালের স্বৈরশাসককে উদ্দেশ্য করে কথা বলে। তবে সেটা তিনি বলেন জনগণকে উদ্দেশ্য করে, কারণ দেশের আসল মালিক তারাই। চলচ্চিত্রে দেশের নামটা ‘নাম না জানা এক দেশ’ (In an unknown country) রাখার ব্যাপারে নির্মাতা নিজেই বলেন এভাবে - এটা তিনি করেছেন কারণ এটা হতে পারে যেকোনো দেশ, যেখানে স্বৈরাচার আছেন বা আসবেন বা ছিলেন। সবসময়ের, যেকোনো জায়গার ঘটনার জন্যই এটা হতে পারে।

দুই.

দ্য প্রেসিডেন্ট-এ অনেক রূপকের ব্যবহারে নির্মাতা একটা সার্বজনীন গল্প বলতে চেয়েছেন। তাই কোনো দেশের নাম তিনি উল্লেখ করেননি। চলচ্চিত্রে একবারও বলেননি প্রেসিডেন্ট মহোদয় আসলে কোন দেশের!

একটি দৃশ্যে নাতির সঙ্গে গল্প করতে করতে প্রেসিডেন্ট দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের মৃত্যুদণ্ডের আদেশে স্বাক্ষর করছিলেন; ক্ষমতার জোরে এই রকম একটা সিদ্ধান্ত একাই নিচ্ছেন, তাও আবার নাতির সঙ্গে গল্পের ফাঁকে ফাঁকে। এর মধ্যে ১৬ বছরের একজনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন, যেটা আন্তর্জাতিক আইনে এবং সম্মেলনে তাকে ঝামেলায় ফেলতে পারে, সেটা তার আমলা মনে করিয়ে দিতেই, স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট হুংকার দিয়ে বলেন, আজকে এই ছেলেকে ছেড়ে দিলে, কালকে আরো শত শত দাঁড়িয়ে যাবে বিপ্লবের নামে, এটা আমি হতে দিবো কেনো?

শহরের বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার খেলার মধ্যেই একবার আর বিদ্যুৎ আসে না, লাইট জ্বলে না, হঠাৎ গোলাগুলির আওয়াজ, অন্ধকারে কোথাও কোথাও গোলাগুলির কারণে আলো দেখা যাচ্ছে। প্রেডিসেন্ট বুঝে যান কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, বিদ্রোহ হয়েছে অনেক জায়গায়। পরের দিনই পরিবারকে বিমানে করে দূরে নিরাপদ জায়গাতে পাঠিয়ে দেন তিনি। পরিবারে তার এক মেয়ে আরেক বোনকে বলছে এভাবে – তার এবং তার জামাইয়ের দুর্নীতি আর অপকর্মের কারণেই আজকে এ ফল ভোগ করতে হচ্ছে। এর আগে প্রেসিডেন্টের ছেলে এবং তার বউ মারা গিয়েছিলো এই রকম ঘটনায়। শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট তার নাতিকে নিয়ে থেকে যান, পরেরদিন বা পরিস্থিতি দেখে পরে রওনা দিবেন বলে। কিন্তু অবস্থা এতো বেগতিক হয়ে যায় যে, স্বৈরশাসকের নিজের সৈন্যরাও বিদ্রোহ করে বসে। এয়ারপোর্টে গতকালও যে সৈন্যরা তাকে গার্ড অব অনার দিয়েছিলো, তারাই তার দিকে অস্ত্র ধরে নতুন নেতৃত্বের প্রতি অনুগত থেকে তাকে মারতে চায়। নিজেদের চাকরি বাঁচাতে দ্রুত তারা নতুন প্রেসিডেন্টের কাছে নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করতে চায়।

আসলে পুরো চলচ্চিত্রে একটা ব্যাপার দেখানোর চেষ্টা হয়েছে, এভাবে শুধু প্রেসিডেন্টই পরিবর্তন হয়, কিন্তু তাদের স্বৈরশাসন, জনগণের মধ্যকার গণতন্ত্রের চর্চা আর এগোয় না। তারা শুধু প্রেসিডেন্ট পরিবর্তন চায়, কিন্তু নিজেরা না করে গণতন্ত্রের চর্চা, তাদের না আছে পরমতে সহিষ্ণুতা। ফলে পুরনো সিস্টেমে যে যায় গদিতে সেই পরিণত হয় আরেক স্বৈরশাসকে।

স্বৈরশাসক একা একা তৈরি হয় না। তাকে অনেকেই সাহায্য করে, তার অন্যায় কাজে অনেকে ফায়দা নিতে চায়। একই লোককে দেখা যায় সব সরকারের সময় সেই স্বৈরশাসকের কথাতেই চলতে, উঠতে বসতে, স্লোগান দিতে। তাই স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট ক্ষমতাচ্যুত হলেও জনগণের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। যেহেতু জনগণ তাদেরকে গণতন্ত্রের জন্য বাধ্য করতে পারে না, এবং তারা নিজেরাও সেটার মূল্য বোঝে না। এই জন্য নাম না জানা সেই দেশের অবস্থাও পরিবর্তিত হয় না।

জনগণের মধ্যে একজন চিন্তাশীল নাগরিককে চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যে সেই কথাটাই বার বার উচ্চারণ করতে, বার বার মারমুখী জনগণকে বুঝানোর চেষ্টা করতে দেখি। সহনশীলতা, পরমতে সহিষ্ণুতা যদি জনগণের, নাগরিকের নিজেদের মধ্যেই প্রাত্যহিক জীবনে না আসে, তাহলে এই ক্ষমতা বদল আসলে বৃথা! কারণ এই অসচেতন জনগণই একভাবে আবার এদেরকে স্বৈরশাসকে পরিণত করবে। আর তারাও সেটা করতে করতে এক সময় জনগণকেই পিষে ফেলবে। তার পর জনগণই আবার প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা থেকে নামাবে, নতুন আরেকজন আবার সেইভাবেই তৈরি হবে, আবার নামাবে - এই চলতে থাকবে। নির্মাতা সেই জায়গাটাকেই দেখাতে চেয়েছেন। বুঝাতে চেয়েছেন, জনগণের নিজেদের আত্মোপলব্ধি, ছোটো ছোটো ক্ষেত্রে অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা, গণতন্ত্রের চর্চাই পারে তাদেরকে এই নষ্ট চক্র থেকে বের হতে সাহায্য করতে।

তিন.

দ্য প্রেসিডেন্ট-এর একটা দৃশ্যে দেখা যায়, প্রেসিডেন্ট দেশের বিদ্যুৎ বিভাগকে বলছে, তার নাতি যা বলে সেটা করতে, কারণ নাতির আদেশই তার আদেশ, যদিও তার নাতির বয়স ১০ বছরও নয়। বংশ পরম্পরায় যখন ক্ষমতার লোভ ঢুকে যায়, তখন এই প্রেসিডেন্টরা এটাই করে। ক্ষমতায় নিজের আত্মীয়স্বজনকে বসায়। যেনো তার ক্ষমতা মানে তার প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা, তার পরিবারের ক্ষমতা, তার বন্ধুদেরও ক্ষমতা। এই বাইরে বাকিরা হলো ‘অন্য’।

পুরো প্রশাসন প্রেসিডেন্টের ভয় আর হুকুমে চলে, এখানে দ্বিতীয় কোনো কথা নেই। তবে এটাও ঠিক যে, এতো সব আয়োজন কাউকেই শেষ রক্ষা করতে পারে না। সেটা চলচ্চিত্রজুড়ে দেখা যায়। কিন্তু তার সমাধান হিসেবে স্বৈরাচারকে হটিয়ে নতুন শাসকরা যেটা করছিলো, সেটাও স্বৈরশাসনের মতোই ছিলো। দিনশেষে সবকিছু একজনের বা এক দলের বা একটা গ্রুপের সিদ্ধান্ত হয়ে থেকেছে। জনগণের আর ভালো থাকা হয়নি। জনগণ থেকেছে জনগণ হিসেবেই। তাদের মতামত, আন্দোলন, চিন্তার অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি। তারা কেবলই প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, পরে সব আবার আগের মতোই থেকে গেছে।

আগের স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্টের যারা সৈন্য, কর্মচারী ছিলো তারাই থেকে গেছে; শুধু পুরাতনের জায়গায় নতুন স্বৈরশাসকের আদেশ মতো কাজ করছে। সেটা তো আদতে কোনো সত্যিকার পরিবর্তন নয়। এভাবে তো আসলে কিছুই পরিবর্তন হয় না। যতোদিন জনগণ নিজে সচেতন না হবে; নিজে অন্যায় করার আগে ভাববে; নিজে প্রশ্ন করবে; নিজে অন্যদের বুঝানোর জন্য কাজ করবে; নিজেদের অধিকার নিয়ে আলাপ করবে, গণতন্ত্রের জন্য কথা বলবে; শাসকদের সত্যিকারের গণতন্ত্রের মেনিফেস্টো তৈরি করতে বাধ্য করবে; প্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্রের চর্চা করবে - তখনই সত্যিকারের পরিবর্তন আসবে। শুধু শাসকের পরিবর্তনে গণতন্ত্র আসে না। নির্মাতা মহসিন মাখমালবাফ পুরো চলচ্চিত্রে সেটেই দেখাতে চেয়েছেন। স্বৈরশাসকের তৈরি করা সিস্টেমেই যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে প্রেসিডেন্ট বদল হয়েও কোনো সুফল আসবে না। সেটা শুধুই একটা চক্রাকারে ঘোরা অনন্তকালের সিস্টেম হয়েই থেকে যাবে।

চার.

মহসিন মাখমালবাফ নিজেও বলেছেন, চলচ্চিত্রে এক আরব স্বৈরশাসককে উৎখাত করে যে আরেকটা শাসন ব্যবস্থা বা দল আনছি তারাও স্বৈরশাসকের মতোই আচরণ করছে। আরব বিশ্বের অনেক দেশেই সেটা দেখা যাচ্ছে, এমন কি আরব বসন্তের পরেও। চলচ্চিত্রে প্রেসিডেন্ট নিজে যখন পালানোর জন্য সাধারণ বেশভূষা পরে তার নাতিকে নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গা দিয়ে যাচ্ছিলেন, নিজের চোখে দেখছিলেন নিজের দেশের কী খারাপ অবস্থাই না তিনি করে ফেলেছেন। হয়তো তিনি এতো বিস্তারিত কখনো নিজের চোখে দেখেন নাই। যা শুনেছেন তোষামোদকারী রাজনীতিবিদ আর আমলাদের থেকেই শুনেছেন, যারা তাকে খুশি রাখতে আর নিজেদের পদোন্নতি নিয়েই ব্যস্ত।

চলচ্চিত্রে দেখা যায়, তিনি যখন জনগণের দুরবস্থা সত্যি সত্যি নিজ চোখে দেখতে থাকেন, তখন তার একটু একটু করে খারাপ লাগা শুরু হয়। কিন্তু ততোক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। জনবিচ্ছিন্ন শাসকরা হয়তো নিজেরাই জানে না নিজের দেশকে তারা কোন পর্যায়ে নিয়ে গেছে বা কোন পর্যন্ত দেশটাকে পিছিয়ে বা নষ্ট করে দিয়েছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে চাটুকারদের সভায় স্বৈরাচার বুঝতে পারে না, তার নিজের তৈরি করা সিস্টেম কীভাবে তার দেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে; আর তিনি নিজেও অতল গহ্বরে পতিত হয়েছেন। অহংকার আর সাফল্যের গল্প তাকে অন্ধ করে দিয়েছে।  তাদের চারপাশের ভীত, চাটুকারদের বলয়টাও হয়তো সেটা জানতে দেয় না বা ভয়ে তারা সেটা বলেও না।

কিন্তু এই চারপাশের মানুষজনই আবার নতুন শাসকের পদলেহন করে, দল বদল করে আবার একই কাজই শুরু করে, একইভাবে সাধারণ মানুষকে শোষণের বুদ্ধি দিতে থাকে। যেহেতু এটা করেই তারা অভ্যস্ত, তাই সিস্টেম বা কাঠামো, সরকারের চলার পদ্ধতি সেটার আমূল পরিবর্তন না করলে এই ধারা থেকে দেশের বা সাধারণ মানুষের মুক্তি নেই। সেই সিস্টেম শুধু স্বৈরাচারই তৈরি করতে পারে।  এই কথাই ঘুরেফিরে দ্য প্রেসিডেন্ট বুঝাতে চায়। মহসিন বলেন, চলচ্চিত্রটির শুটিং জর্জিয়াতে হলেও এটা আসলে জর্জিয়ার গল্প না, এটা অতীতের, বর্তমানের বা ভবিষ্যতের যেকোনো স্বৈরশাসকেরই গল্প হতে পারে। যেকোন সময়ের যেকোনো স্বৈরশাসকের জন্যই এই চলচ্চিত্র সত্য এবং আয়নাস্বরূপ।


পাঁচ.

দ্য প্রেসিডেন্ট-এ ক্যামেরা ভাষা ব্যবহারের দারুণ প্রয়োগ দেখা যায়। প্রেসিডেন্ট আর তার নাতির জায়গা থেকে (তাদের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে) পুরো রাজধানীকে দেখানো হয়। দেখা যায়, বিদ্যুতের আলোতে আলোকিত পুরো শহর শুধু প্রেসিডেন্টের নির্দেশে মিনিটে মিনিটে অন্ধকার আর আলোর খেলায় পরিণত হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট তার নাতিকে দেখাচ্ছেন তার ক্ষমতা। তাদের কাছে এটা একটা খেলা। ক্ষমতা প্রদর্শনের খেলা। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে সেটা শুধুই বিরক্তির কারণ।

প্রেসিডেন্ট আর তার নাতিকে ফোরগ্রাউন্ডে রেখে পেছনে অনেক দূর পর্যন্ত আশপাশের এলাকা, দালানের কাঠামো ইত্যাদি দেখিয়ে পরিবেশটা বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে। আর শহর থেকে বাইরে বের হবার পরেই দেখা যায়, ঝলমলে প্রাসাদ থেকে একেবারে ধূসর, রুগ্ন পরিবেশ যা গ্রে স্কেলের কাছাকাছি, হঠাৎ বোঝা যায় রাজপ্রাসাদের বাইরে, রাজধানীর বাইরে পুরো দেশটা আসলে ধূসর, দরিদ্র, শ্রীহীন। যা চলচ্চিত্রের গল্পের রঙের ব্যবহারকে আশ্রয় করে দর্শককেও সেই মুডে নিয়ে যায়। দাঙ্গার দৃশ্যে হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরার ব্যবহার দর্শকের অস্থিরতাকে বাড়িয়ে দিয়েছিলো।

দ্য প্রেসিডেন্ট ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী চলচ্চিত্র ছিলো। আরব বসন্তের সময়ে মহসিন মাখমালবাফ আফগানিস্তানে একটা কাজে ছিলেন, তখন তার এই চলচ্চিত্রের ভাবনা আসে। তিনি যেটা বুঝাতে চান সেটা হলো, গণতন্ত্র মানে শুধু ক্ষমতা বদল নয়, এটা একটা সংস্কৃতি, একটা অভ্যাস, যেটা অনেক দেশে শুধুই ক্ষমতার বদলের হাতিয়ার হিসেবেই দেখা হয়। কিন্তু মানুষের এটায় অভ্যাস নাই। ছোটো থেকে ছোটো বিষয়েও, সাধারণ মানুষের মধ্যে গণতন্ত্রের কোনো চর্চা নাই। জনগণের মধ্যে গণতন্ত্র মানার অভ্যাস না থাকলে, নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতনতা তৈরি না হলে, গণতন্ত্র শুধুই ভোট দিয়ে শাসক বদলের প্রক্রিয়াই হয়ে থাকবে। চলচ্চিত্রের শুরুতে দেখানো হয়, একটা শহরে রাতের আলো একটা ফোন কল করে বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতার আনন্দ নেওয়াটাই শাসকের মূল লক্ষ্য হয়ে থাকে; যে কাজগুলোতে কোনো কারণের প্রয়োজন থাকবে না; থাকবে শুধু ক্ষমতা দেখানোর পৈশাচিক আনন্দ।

যে দেশের লোকজন গণতন্ত্রের সত্যিকারের মানে বুঝে না, সেখানকার প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই গণতন্ত্রের নামে স্বৈরাচার হয়ে ওঠে। আর তাদের হাতিয়ার হয়ে ওঠে সব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত ক্ষমতা, সেটা হোক সরকার বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বা কোনো ক্রীড়া ফেডারেশন বা কোনো পেশাদার সংগঠন বা শিক্ষকদের সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন - যাইহোক না কেনো।

লেখক : আসিফ রহমান সৈকত, চলচ্চিত্রকর্মী, নির্মাতা ও লেখক।

saikatfpdu@gmail.com

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন