Magic Lanthon

               

তৈয়ব তরুণ

প্রকাশিত ২১ আগস্ট ২০২৩ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

আবেগ, অনুভূতি নিয়ে ‘বাতাস’-এর খেলা

তৈয়ব তরুণ

১.

এক সময়ের আদিম সমাজ, দ্বন্দ্ব ও সময়ের ধারাবাহিকতায় আজ   রূপ নিয়েছে বাজারি সমাজে। আদিম সমাজে পশু-শিকার যেমন একটি উপাদানরূপে সক্রিয় ছিলো, তেমনি বর্তমান বাজারি সমাজে পণ্য-উৎপাদন এবং সেই পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের নানা প্রক্রিয়া সক্রিয় রয়েছে। বাজারি সমাজের এই প্রক্রিয়া আবার সক্রিয় রয়েছে বিভিন্ন অনুঘটকের সাহায্যে। এই অনুঘটকের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ভূমিকা পালন করছে গণমাধ্যম। আদিম সমাজ একটি ব্যবস্থা, বাজারি সমাজ একটি ব্যবস্থা; তেমনি গণমাধ্যমও একটি ব্যবস্থা। তার মানে গণমাধ্যমকেও টিকে থাকতে সহায়তা করে কোনো না কোনো উপাদান। সেই উপাদান খুঁজতে গেলে বিজ্ঞাপনের নাম আসতে বাধ্য। আর  বাজারি সমাজের সঙ্গে বিজ্ঞাপনের সুসম্পর্ক চিরদিনের। যে-সম্পর্কে বাজারি সমাজ বিজ্ঞাপনকে ব্যবহার করে তার উৎপাদিত পণ্য বা সেবা-সামগ্রী বিক্রির পরিকল্পনা-বাস্তবায়নকারী হিসেবে। এই পরিকল্পনার প্রধান শর্ত থাকে, মানুষের মাঝে উৎপাদিত পণ্য-ভোগের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করা। তাই বিজ্ঞাপনের সবটুকু প্রচেষ্টা সেই আকাঙ্ক্ষা তৈরির পিছনে ব্যয় হয়। প্রচেষ্টা ফলপ্রসূও হয়। কারণ, ‘বিজ্ঞাপন মানুষের চাহিদাকে প্রভাবিত করে তার অভ্যস্ত অভাববোধেরও পরিবর্তন ঘটাতে পারে।’

এখন, এই চাহিদা বা আকাঙ্ক্ষার পরিবর্তন ঘটাতে গিয়ে বিজ্ঞাপন সচেতন বা অবচেতনভাবে সমাজের অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটাতে চায় কিংবা ঘটিয়ে ফেলে। কিন্তু সেই পরিবর্তন সমাজের জন্য ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক, তা দেখার আগ্রহ বিজ্ঞাপনের নেই। আগ্রহ যেটুকু ওই পণ্যের চাহিদা তৈরির প্রচেষ্টাকে কেন্দ্র করে। চাহিদা তৈরির প্রক্রিয়াটি অসীম। অসীম বলছি এ-কারণে, বিজ্ঞাপন তার জন্মের পর থেকেই এই কাজটি করে আসছে। বিজ্ঞাপন স্রষ্টাদের মাথায় রাখতে হয় তাদের সৃষ্ট বিজ্ঞাপন যেনো দর্শক বা পাঠকের কাছে একঘেঁয়ে না হয়ে যায়। এ-কারণেই অভাববোধ বা চাহিদা সৃষ্টিতে তারা প্রতিনিয়ত নানান কৌশল ব্যবহার করে। তারা চায় কৌশলের নতুনত্ব, অভিনবত্ব।

ম্যাজিক লণ্ঠন ধারাবাহিকভাবে এই  নতুনত্ব বা অভিনবত্বের ভিতর-বাহির খোঁজার চেষ্টা করছে। গত দুই সংখ্যায় যথাক্রমে বিজ্ঞাপনে নারী এবং শিশুদের উপস্থাপনার বিষয়টি স্থান পেয়েছে। এই সংখ্যায় আমরা মোবাইল অপারেটরের কয়েকটি বিজ্ঞাপন নিয়ে কথা বলবো।     

২.

বেসরকারি মোবাইল অপারেটর ‘রবি’র ইন্টারনেট মিনিপ্যাকের একটি বিজ্ঞাপন দিয়ে আলোচনা শুরু করছি। বিজ্ঞাপনটির প্রথম দৃশ্যেই দেখা যায়, গ্রামের বাড়ির আঙ্গিনায় একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেয়ারা খাচ্ছে। এ-সময় মধ্যবয়সী এক  নারী এসে মেয়েটির উদ্দেশে বলেন, ‘হাবিজাবি খাইতাছো, দুপুরে তুমগো লাইগা রানতাছি মসুরি আর  ফ্রন, চিকেন ফ্রাইডরাইস।’ মেয়েটি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘এসব কোথায় পাবেন?’ সেই নারী উত্তরে বলেন, ‘আমাগো রাঁধুনী ইন্টারনেট আছে না!’

এরপরের দৃশ্যে দেখা যায়, মাটির দেয়ালের উপর টিনের ছাউনি দেওয়া ঘর। ঘরের পাশে একটি ছোট কুঁড়ে রান্নাঘর। রান্নাঘরে আগের দৃশ্যের সেই মধ্যবয়সী নারী রান্না করছেন। তার পাশে পেয়ারা খাওয়া মেয়েটি বাদে আরও  একটি মেয়ে বসা; তিনি বড়ো মনিটরের একটি মাল্টিমিডিয়া ফোনসেটে ইন্টারনেট ব্রাউজ করছেন এবং বলছেন, ‘কাঁচা মরিচ তিনটা’; তখন রান্না করতে থাকা নারী বলেন, ‘এরপর?’ মেয়েটি আবার বলেন, ‘ছয়াসস চার চামচ, দ্যাও দ্যাও।’

পরের দৃশ্যেই মাটির ঘরের মধ্যে দেখা যায়, ওই পরিবারের সবাই মিলে কম্পিউটারে ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে ব্যস্ত। এ-সময় ব্যাকগ্রাউন্ডে বলা হয়, ‘রবি ইন্টারনেট এখন আরও  উন্নত নেটওয়ার্ক নিয়ে, যখন দরকার, যেখানে দরকার। এবার রবি ইন্টারনেট মিনিপ্যাক অফার দশ মেগাবাইট মাত্র দশ টাকায়। অ্যাক্টিভেট করতে ইন্টারনেট সেটিং নিশ্চিত করে ডায়াল করুন *৮৪৪৪*৮০# । চালু হয়ে যাবে সাথে সাথে। জ্বলে উঠুন আপন  শক্তিতে। রবি...।’

বিজ্ঞাপনটি দেখার পর বুঝতে বাকি থাকে না, এর টার্গেট অডিয়েন্স বা উদ্দিষ্ট ভোক্তা গ্রামের সাধারণ নারী; যারা ফোন ব্যবহার করেন কিন্তু ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। এখন প্রথম প্রশ্ন হলো; এই  নারীদের কেনো ইন্টারনেটের ভোক্তা করার দরকার পড়লো? উত্তরটা খোঁজার চেষ্টা করি-আমাদের দেশে শুরু থেকে যারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন তাদের মধ্যে ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। গ্রামের মধ্যবিত্ত নারী যাদের ‘পেশাগত’ পরিচয় গৃহিণী, তারা অনেক পরে মোবাইল ফোন ব্যবহার শুরু করেছেন। বর্তমানে শুধু মধ্যবিত্তরাই নয়, গ্রামের নিম্নবিত্ত নারীরাও মোবাইল ফোনের গ্রাহক হয়ে উঠেছেন। গ্রামের ওই ‘সাধারণ নারীরা’ কিন্তু ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। মূলত, তাদের দৈনন্দিন যে-জীবন, সেখানে ইন্টারনেটের খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না বললেই চলে। অনেকের আবার ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতাও নেই।

কিন্তু কথা হলো, এতো কিছু বুঝি না, ইন্টারনেটের ভোক্তা বাড়াতে হবে। তখন চোখে পড়লো ওই নারীদের। তাহলে প্রথম কথা হলো, এই নারীদের ভোক্তা বানাতে হবে। অর্থাৎ, তাদের ‘বশ’ মানাতে হবে। আঘাত করতে হবে দুর্বল জায়গায়। তাদের জন্য ফেইসবুক, টুইটার, ই-মেইল কিংবা অনলাইনে আড্ডা নয়। বাকি থাকে সেই নারী সংক্রান্ত ডিসকোর্স-রূপচর্চা, শাড়ি-গহনা, না-হয় রান্নাবান্না। প্রথম দুটি আপাতত বাদ দিয়ে তৃতীয়টি নিয়েই শুরু হলো তাদের খেলা।

তাই বিজ্ঞাপনের নতুনত্ব দৃষ্টি দিলো নারীর রান্নাঘরে। ‘দায়িত্ব’ নিলো নারীকে রান্না শেখানোর। ভেবেই নেওয়া হলো এসব নারী, যারা স্ত্রী বা গৃহিণী-তাদের প্রধান লক্ষ্য রান্না-বান্না করে স্বামী বা কর্তাকে সন্তুষ্ট রাখা। তাই বিজ্ঞাপনটি হাজির হলো বাংলার নারীকে রান্না শেখানোর দায়িত্ব নিয়ে। ভাবটা এমন-নারী রান্না ছাড়া আর  কিছুই করে না! তো, ওই নারীরা ভাত, মাছ, মাংস এসব রান্নাতো পারেই। তাই এমন কোনো রান্না শেখাতে হবে যা তাকে ‘স্মার্ট’ করবে; প্রয়োজন পড়লো মসুরি আর ফ্রন, চিকেন ফ্রাইডরাইস-এর। কিন্তু একবারও ভাবা হলো না মসুরি, ফ্রন, চিকেন ফ্রাইডরাইস ওই মানুষগুলোর জীবনের জন্য কতোখানি প্রয়োজন। ইন্টারনেট তাদের জীবনধারণ বা বেঁচে থাকার জন্য কতোখানি দরকারি? বিনয় ঘোষের কথাটি এ-ক্ষেত্রে খুবই যুক্তিযুক্ত, ‘এই যে দেদার ভোগ্যদ্রব্য যার শতকরা পঁচানব্বই ভাগ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন নেই, এমনকি বাঁচার মতো বাঁচার জন্যও নেই, শুধু সামাজিক অপচয়, তা বাজারে চালাতে গেলে তার জন্য চাহিদা সৃষ্টি করতে হয় অর্থাৎ, নতুন নতুন অভাববোধ জাগাতে হয় মানুষের মধ্যে এবং যা করতে হলে সকলের আগে এবং সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় বিজ্ঞাপনের।’

শুরুতে বলেছিলাম, এই অভাববোধ জাগাতে গিয়ে আনতে হয় নতুনত্ব। আর  এই নতুনত্ব অনেক কিছু সম্পর্কে নতুন করে ভাবাতে মানুষকে বাধ্য করে। বিজ্ঞাপনের শুরুতেই পেয়ারা সম্পর্কে বলা হলো, এটি ‘হাবিজাবি’ খাবার। এখন প্রশ্ন, পেয়ারা যদি হাবিজাবি খাবার হয় তাহলে চিকেনফ্রাই কী? বার্গার, চিকেনফ্রাই, হটডগ জাতীয় এসব খাবার ফাস্টফুড নামে পরিচিত হলেও চিকিৎসাবিজ্ঞানে এ-গুলোকে বলা হয় জাঙ্কফুড। এই জাঙ্কফুড তৈরিতে মাখন, মেয়োনেজ, পনির, ইউগার্ড, ঘি, ছয়াসস, তেলের মতো প্রচুর পরিমাণ ফ্যাট জাতীয় উপাদান ব্যবহার করা হয়। ফ্যাট ব্যবহারে খাবার my¯^v`y হলেও তা আর  স্বাস্থ্যসম্মত থাকে না। ফলে এসব খাবার খেয়ে স্থুলতা, হৃদরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে অনেকখানি। যা-হোক, নতুনত্বের কথা বলছিলাম। নতুনত্বটা হলো রুচিবোধের পরিবর্তন। যে-পরিবর্তনে পেয়ারা হয়ে ওঠে হাবিজাবি খাবার, আর চিকেন ফ্রাইডরাইস হয় স্বাস্থ্যকর, আধুনিক ও আভিজাত্যের প্রতীক; সঙ্গে বোনাস হিসেবে থাকে অভিজাত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। আর এই আকাঙ্ক্ষা একবার তৈরি করতে পারলেই বাকিটুকু ইন্টারনেট করে ফেলবে। কারণ ইন্টারনেট আর কিছুই নয়, বাজার। কলগার্ল থেকে শুরু করে আমেরিকার শপিংমলে কেনাকাটা, এভরিথিংস্‌ আছে ওই ‘তথ্যের মহাসড়কে’।    

বর্তমান ভোগবাদী সমাজের অঢেল ভোগ্যপণ্য ও সেবা-সামগ্রীর ক্রেতা সৃষ্টি করতে গিয়ে বিজ্ঞাপন তার সামাজিক দায়বদ্ধতার দিকটি প্রায় ভুলতে বসেছে। ভোগ্যদ্রব্যের বাজার কাটতি বাড়ানোর জন্য তারা সামাজিক দায়বদ্ধতার পরোয়া না করে সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধকে ব্যবহার করছে নিজেদের স্বার্থে এবং নিজেদের মতো করে। ‘রাঁধুনী’ শব্দটির ব্যবহার লক্ষ্য করলে এ-বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া যাবে। শব্দটির যে-ডিসকোর্স আমাদের সমাজে দাঁড়িয়েছে তা কেবল নারীকেই বোঝায়। বিজ্ঞাপনে রাঁধুনী বলতে যে নারীকেই নির্দেশ করা হয়েছে এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর  এই নির্দেশের মাধ্যমে সমাজের অস্থিমজ্জায় গেঁথে থাকা সংস্কারকে জিইয়ে রাখতে চেয়েছে বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনে কিন্তু রাঁধুনী হিসেবে নারীর পরিবর্তে পুরুষকেও বোঝানো যেতো। কারণ, আধুনিক বিশ্বে রাঁধুনী মানে আজ  আর কেবল নারী নয়, বিশ্বের সেরা রাঁধুনী টমি মিয়া কিন্তু পুরুষ! আরও  একটি কথা না বললেই নয়, সামাজিক কারণে নারীরা রান্নায় যতো অভিজ্ঞ, পুরুষরা কিন্তু নয়। চাইলে তাদের টার্গেট করেও বিজ্ঞাপনটি করা যেতো। কিন্তু সেটা করলে কী আর ‘নতুনত্ব’, ‘অভিনবত্ব’ থাকে! 

৩.

দ্বিতীয় আলোচনা গ্রামীণফোনের লং টক অফারের একটি বিজ্ঞাপন নিয়ে। বিজ্ঞাপনটি দৃশ্যত এই রকম-রাতের বেলা; মেয়ের বাড়ির গেটের সামনে একটি ছেলে দেখা করতে আসে। স্পষ্টই বোঝা যায়, দুজনের মাঝে প্রেমের সম্পর্ক। প্রথমেই উৎকণ্ঠা-ভরা কণ্ঠে ছেলেটি জিজ্ঞাসা করে, ‘কী ব্যাপার!’ মেয়েটি চিন্তিতভাবে উত্তর দেয়, ‘পাত্রপক্ষ পছন্দ করে গেছে; ছেলে আমেরিকায় থাকে, নাসায় জব করে।’ শোনার পর মেয়েটির সিন্ধান্ত জানতে ছেলেটি প্রশ্ন করে, ‘তুমি কী বলছো?’ এ-সময় বাড়ির ভিতর থেকে ডাক আসে, ‘রুপা, এই রুপা।’ ‘বাবা ডাকছে’ বলে মেয়েটি তখন চলে যেতে চায়। ছেলেটি বলে, ‘কথাটা শেষ করে যাও! শোন!’ মেয়েটি ‘লম্বা ঘটনা, ফোন দিও’ বলে বাড়ির ভিতরে চলে যায়। তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে বলা হয়, ‘গল্প যখন অল্প নয়, তখনই গ্রামীণফোনের লং টক। যেকোনো গ্রামীণফোন নাম্বারে টানা ত্রিশ মিনিট কথা বলুন মাত্র সাড়ে সাত টাকায়। অফারটি পেতে স্টার, স্পেস, এলটি লিখে পাঠিয়ে দিন ৯৯৯৯ নাম্বারে । কাছে থাকুন। গ্রামীণফোন...।’

বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে এখানে কোনো আলোচনা করতে চাই না; কারণ উপরের কথাগুলো হয়তো এ-বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই এ-ক্ষেত্রে কেবল বিজ্ঞাপনটির আধেয় নিয়েই কথা বলবো। বিজ্ঞাপনটিতে যে ঘটনা উপস্থাপন করা হয়েছে তা স্বাভাবিক-ই মনে হয়েছে। স্বাভাবিক বলছি এই অর্থে যে, সমাজে এই ঘটনা ঘটছে। কিন্তু স্বাভাবিকত্বের মধ্যে কোনো  অস্বাভাবিকতা পাওয়া যায় কিনা তা খুঁজে দেখা যাক।

পাত্রপক্ষ পছন্দ করে গেছে; ছেলে আমেরিকায় থাকে, নাসায় জব করে-এই বিষয়টি নিয়ে শুরু করি। ছেলে-মেয়ে দুজনেরই উৎকণ্ঠার বিষয়, ছেলে (পাত্রপক্ষ) পছন্দ করে গেছে। তার মানে, বিয়ে হওয়ার ক্ষেত্রে ছেলের পছন্দই সব। সে-ক্ষেত্রে মেয়ে ছেলেকে পছন্দ করলো কি করলো না, সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের সমাজে ছেলেরা যেকোনো মেয়েকে অপছন্দ কিংবা বিয়ে না করার ক্ষেত্রে সরাসরি আপত্তি জানাতে পারে। যেমন­-ছেলেরা অনায়াসেই পরিবারকে জানাতে পারে, অমুক মেয়েকে তার পছন্দ হয়নি, অথবা অমুক মেয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে। এ-রকম অনেক কিছুই সে বলতে পারে।

কিন্তু মেয়েরা সাধারণত তা পারে না। আমরা দেখি পছন্দ নিয়ে আপত্তি থাকার পরও মেয়েরা স্পষ্ট করে কিছুই বলতে পারে না। পাশ কাটিয়ে বলে, আমি আরও  পড়াশুনা করবো কিংবা এখনই বিয়ে করবো না ইত্যাদি। অধিকাংশ মেয়ের সরাসরি তার পরিবারকে হ্যাঁ-না বলার ‘সাহস’ পর্যন্ত নেই। অন্যভাবে বললে সমাজ নারীদের সেই সাহস দেয়নি। সভ্য আধুনিক সমাজেও বিয়ের জন্য মেয়ে ঠিক করার পর্বের অনেকগুলোই এখনও  চলছে সেই পুরনো রীতি-নীতি অনুসারেই। একসময় পাত্রপক্ষ পাত্রীর বাড়িতে গিয়ে গায়ের রঙ, দেহের গড়ন, উচ্চতা, হাত-পায়ের আঙুল, গোড়ালী, দাঁত, মাথার চুল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতো; ঠিকমতো হাঁটতে পারে কি না তা পাত্রীকে হেঁটে দেখাতে হতো; দেখা হতো উচ্চতা কেমন? আবার, ভালোভাবে কথা বলতে পারে কি না তা জানতে কথা বলিয়ে নিতো; ধর্মভীরু কি না তা জানতে পাঠ করিয়ে নিতো সূরা বা গীতা। তারপর সবকিছু পাত্রপক্ষের মনমতো হলে তবেই পাত্রীকে বিবাহের জন্য পছন্দ করতো; অনেকটা হাট থেকে কোরবানির পশু কেনার মতো।

বলা হয় পরিস্থিতি অনেকখানি পাল্টেছে। বর্তমানে কথিত ‘শিক্ষিত আধুনিক সমাজ’ এ-গুলো করে না। গণমাধ্যমও উঁচু গলায় এর বিরোধিতা করে। কিন্তু হাস্যকর ব্যাপার হলো সেই গণমাধ্যমই আবার তাদের বিজ্ঞাপনে বিয়ের ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিকতাকে স্পষ্টভাবে সমর্থন করলো। লক্ষ করুন, বিজ্ঞাপনটিতে কিন্তু একবারও মেয়েটির কোনো গুণের কথা বলা হয়নি। তার মানে, পাত্রপক্ষ রূপের কারণেই মেয়েটিকে পছন্দ করেছে। অন্যদিকে ছেলের গুণ কিন্তু ঠিকই বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘ছেলে আমেরিকায় থাকে, নাসায় জব করে।’ ব্যস্; এমন গুণী পাত্র, তাই আর  পাত্রীর পক্ষে কিছুই করার নেই। সমাজে হরহামেশাই এটি হচ্ছে, পাত্র যতো ‘যোগ্য’ হবে পাত্রীর সে-বিয়ে ঠেকানো ততো মুশকিল হয়ে পড়বে, পাত্র যদি পাত্রীর অপছন্দেরও হয় তারপরেও। বিজ্ঞাপনে কিন্তু এর উল্টোটাও হতে পারতো। অর্থাৎ, পাত্রী-ই আমেরিকায় থাকে, নাসায় জব করে। সে পাত্রকে দেখে পছন্দ করে গেছে তাই পাত্রের আর কিছু করার নেই। তখন অবশ্য আমাদের কাছে বিষয়টি হাস্যকরভাবে উপস্থাপিত হতো।

বিজ্ঞাপনটিতে এরপর ছেলেটি জিজ্ঞাসা করে ‘তুমি কী বলছো? মেয়েটি তখন বলে, ‘লম্বা ঘটনা, ফোন দিও।’ এখন প্রথম বিষয় হলো লম্বা কথা বলার জন্য ফোন দিতে হবে কেনো? কথাগুলো তো পরবর্তী সময়ে সাক্ষাতেও হওয়া সম্ভব ছিলো। কিন্তু তা হয়নি। প্রচলিত নিয়মে আমরা সাধারণত বলি, ‘অনেক কথা আছে ফোনে বলবো না, সামনা-সামনি দেখা হলে বলবো’; আর  বিজ্ঞাপন বলছে, ‘লম্বা ঘটনা, ফোন দিও।’ তার মানে কী? এই যদি হয় আধুনিক প্রযুক্তির সুফল, তাহলে বলার কিছু নেই। সুফল যাই হোক তরুণ-সমাজকে সম্পর্কের এই যোগাযোগের জালে আটকাতেই হবে; তাই চলতে থাকে বিজ্ঞাপনের অভিনবত্বের দৌড়ঝাঁপ।

এক্ষেত্রে মোবাইল অপারেটরগুলো দুটি বিষয় খুব সচেতনভাবে করে। প্রথমত, তারা উঠতি বয়সীদের ফাঁদে ফেলতে সাশ্রয়ী প্যাকেজের নতুন টোপ দেয়; দ্বিতীয়ত, প্যাকেজগুলোর বিজ্ঞাপনে মডেল হিসেবে বেশিরভাগ সময় তরুণ-তরুণীদের বেছে নেয়। ধরে নিলাম নগর-জীবনের যান্ত্রিকতায় বেশি সময় কথা বলার জন্য মোবাইল ফোন লাগে, কিন্তু প্রশ্ন এই কথা কি কেবল কমবয়সী প্রেমিক-প্রেমিকারাই বলে? তরুণ-তরুণী ছাড়া কি এই বিজ্ঞাপনটি করা সম্ভব হতো না? লম্বা কথা কি কেবল প্রেমিক-প্রেমিকারাই বলে? ব্যবসায়ী বা চাকরিজীবীদেরও কি লম্বা কথা থাকতে পারে না? পারে, কিন্তু তাতে তো ব্যবসা আর  হয় না।

তাই তো তরুণ-তরুণীরা, ভাত খেয়েছো কী দিয়ে; তোমাদের বাসার রং কী; তোমার বিড়ালটা আজ   রাতে কী খেয়েছে-ইত্যাদি ‘মূল্যহীন’ কথা চালায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এটি এখন এদের অভ্যাস হয়ে গেছে। ঘুরিয়ে বললে বলা যায়, এদের অভ্যস্ত করানো হয়েছে। এই যে, ‘যেকোনো গ্রামীণফোন নাম্বারে টানা ত্রিশ মিনিট কথা বলুন মাত্র সাড়ে সাত টাকায়’-এভাবে! পাঠক, এই প্যাকেজটি খেয়াল করুন। এই অফারে কথা বললে কিন্তু আপনাকে টানা ত্রিশ মিনিট কথা বলতে হবে। কথা থাক, বা না থাক তা বড়ো ব্যাপার নয়। আজকের এই কথা শুরুর অবশ্য একটা ‘ঐতিহাসিক’ প্রেক্ষাপট আছে। কথা বলায় অভ্যস্ত করানোর এই প্রক্রিয়া দীর্ঘদিনের।

গ্রামীণফোন ২০০৫ সালে ডিজুস প্যাকেজে রাত ১২টার পর প্রথম মিনিটের পর থেকে ফ্রি কথা বলার অফার নিয়ে আসে। এই সময়ে সিমের দামও কমিয়ে ফেলা হয়। আর  প্রতি মিনিট সাত টাকার বিপরীতে হঠাৎ করেই বিনা টাকায় কথা বলার অফারে তরুণ-তরুণীরা যেনো কথা বলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। কথা চলে রাতভর, শুরু হয় অভ্যস্ত হওয়া। কিন্তু ফ্রি ফ্রি কতোদিন? একসময় এই অফার বন্ধ হয়। অফার বন্ধ হলেও থেকে যায় অভ্যস্ততা-সেটিই মূলত ফোন অপারেটরগুলো চেয়েছিলো। এই অভ্যস্ততাকে পুঁজি করে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর চলতে থাকে বিভিন্ন অফার। যার অঘোষিত লক্ষ্য হয় দেশের ভবিষ্যৎ তরুণ সমাজ।

একটু আগেই এ-ধরনের প্যাকেজগুলোর দুটি বৈশিষ্ট্যর কথা বলেছি। এর বাইরে আরেকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্যণীয়; রাত ১২টার পর থেকে প্রতিটি মোবাইল ফোন কোম্পানির কলরেট কিন্তু কমে যায়। প্রশ্ন, তারপরও কেনো এতোসব অফার? উত্তর সহজ-অভ্যস্ততা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে এখন আর  শুধু রাতে কথা বলেই হয় না!  

ফিরে যাই রাতে কথা বলার অফারে। এমনও  শোনা যায়, অনেকেই রাতভর কথা বলতে বলতে সকাল করে ফেলে। কথা-পাগল এসব তরুণ-তরুণীদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। দেখা যায়, রাত জেগে কথা বলার কারণে তাদের অনেকেই পরদিন সকালে সময়মতো ক্লাসে যেতে পারেন না; অনেকে অন্যমনস্ক থাকেন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, মোবাইল ফোন অনেকক্ষেত্রে লেখাপড়ার বিপরীতে তার অবস্থান করে নিয়েছে। তরুণ-তরুণীদের ওপর বহুজাতিক এসব কোম্পানির নতুন উপনিবেশবাদ এখন যেনো মোবাইল ফোন। এর প্রভাবে আমাদের সামাজিক সম্পর্কগুলো যেনো এখন বেদখল হয়ে যাচ্ছে। এখন তো সাক্ষাতের কথা আসেই না। সামাজিক সম্পর্ক এখন যেনো নিয়ন্ত্রণ করে ভার্চুয়াল পৃথিবী; সামাজিকতা এখন গৌণ। ফলে, এই সম্পর্কে তৈরি হয় পারস্পারিক অনাস্থা, অবিশ্বাস। তাই কিশোর বন্ধুটি খুন করছে সহপাঠিকে, সামান্য ফোনসেটের জন্য বন্ধুকে অপহরণ করে বন্ধু। সম্পর্কের প্রতিনিয়ত এই ভাঙ্গা-গড়া কিন্তু ইতিবাচক কিছু বয়ে আনছে না। যতো ইতিবাচকতা সব যেনো চলে যাচ্ছে ফোন কোম্পানিগুলোর কাছে!

৪.

ছোট নদী, ধারে একটি নৌকা বাঁধানো; নদীর কূল ঘন কাশবনে ঢাকা। মেঘলা আকাশ, মৃদু বাতাস বইছে। এরপর দেখা যায়, ছনের ছাউনি আর  মাটির দেয়ালের বাড়ি, রোদে দেওয়া জুতা আর  শাড়ি বাতাসে দুলছে। বৃষ্টির পূর্বমুহূর্তের এ-রকম পরিবেশে মাথার লম্বা চুল ও শাড়ির আঁচল ছেড়ে ঘন কাশবনে শূন্যে দৃষ্টি মেলে বিষণ্ণ মনে দাঁড়িয়ে থাকে এক  নিঃসঙ্গ নারী। ব্যাকগ্রাউন্ডে তখন গান ভেসে ওঠে-আমারে ছাড়িয়া রে বন্ধু কই রইলা রে, কই রইলা রে, বন্ধু কই রইলা রে...। বৃষ্টি আসে; নারীটি বৃষ্টির মধ্যে স্বচ্ছ নদীর জলে ডুব দেয়। এরপর সে মাঠ থেকে মহিষ এবং উঠোন থেকে ভেজা জুতা ঘরে তোলে। ঘরে এসে আনমনে দাঁড়িয়ে থাকে, চোখে পানি। বৃষ্টি শেষে রোদ ওঠে; কিন্তু সে তখনও বসে থাকে বিষণ্ণ মনে, ঘরের ভিতরে, তারপর বাইরে। ঘরের মধ্যে ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। সে উচ্ছ্বসিত মনে দৌড়ে গিয়ে ফোন রিসিভ করে, কথা বলে। তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে বলা হয়-বাতাস, বৃষ্টি, আলোর সব আয়োজনই ব্যর্থ হয়ে যায় যদি প্রিয়জন পাশে না থাকে। আর  তাই দেশজুড়ে দশ হাজার পিটিএস-এ তৈরি আমাদের নিরবিচ্ছিন্ন নেটওয়ার্ক। কাছে থাকুন। গ্রামীণফোন...।

বিজ্ঞাপনটির সারাংশ হলো, কিছু কিছু সময় আসে যখন মানুষ প্রিয়জনকে পাশে চায়। আর  না পেলে তার ভিতরে জেগে ওঠে একাকীত্ব, বিচ্ছিন্নতা ও বিষণ্ণতাবোধ। বিজ্ঞাপনের ওই নারীর অবস্থাও অনুরূপ। প্রথমে প্রিয়জন তার পাশে ছিলো না। তবে শেষ পর্যন্ত আসে; ফোনের রিংটোন হয়ে। বিজ্ঞাপনটির এই দৃশ্যায়ন নিয়ে দর্শক হিসেবে খুব একটা খট্‌কা লাগেনি। খট্‌কা যতোটুকু লেগেছে তার প্রায় পুরোটুকুই বলা যায় বিজ্ঞাপনের ব্যাকগ্রাউন্ডের কথা নিয়ে। সেখানে বলা হয়, ‘বাতাস, বৃষ্টি, আলোর সব আয়োজনই ব্যর্থ হয়ে যায় যদি প্রিয়জন পাশে না থাকে।’ তার মানে দাঁড়ায়, সব আয়োজনই সফল হতো যদি প্রিয়জন পাশে থাকতো। এবং বিজ্ঞাপনে সেটি সফল করে দেখানোও হয় যখন ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। তাহলে প্রথম কথা হলো, প্রিয়জন দূরে থাকলে কোনো সমস্যা নেই; সমস্যা হলো মোবাইল ফোন না থাকাটা। মোবাইল ফোন থাকলে সব একাকীত্ব, বিষণ্ণতাই দূর করা সম্ভব, বিজ্ঞাপনের দাবি তাই-ই। কিন্তু বিজ্ঞাপনের ওই বাক্যের মতোই আরেকটি বাক্য তৈরি করা যায়। বাক্যটি এমন-‘মোবাইল ফোন, নেটওয়ার্ক সবকিছুই ব্যর্থ হয়ে যায়, যদি প্রিয়জন পাশে থাকে।’

এই বাক্যের পিছনে যুক্তিটি এমন-শুরু থেকে আজ   পর্যন্ত সমাজ ক্রমবিকাশের প্রতিটি পর্যায়েই মানুষ সংঘবদ্ধভাবে থেকেছে অথবা থাকার চেষ্টা করেছে। কারণ, মানুষ একা থাকতে পারে না। তাকে কিছু-না-কিছুর ওপর নির্ভর করতেই হয়। আর  মানুষ যখন কোনো কারণে বিচ্ছিন্ন হয়েছে তখনও চেষ্টা করেছে বিভিন্নভাবে কাছে থাকার, সংঘবদ্ধ থাকার। কিন্তু ক্রমবিকাশের সেই ধারায়  আমরা এমন পরিস্থিতিতে এসে পৌঁছেছি যেখানে মানুষের সংঘবদ্ধতা ভেঙ্গে গেছে। রাষ্ট্র, সমাজ, গোত্র, পরিবারে বিভক্ত হতে হতে মানুষ এখন একক  সত্তায় পরিণত হয়ে গেছে। কিন্তু সংঘবদ্ধভাবে থাকার প্রাকৃতিক ইচ্ছা এখনও মানুষের মধ্যে বিদ্যমান। সেই ইচ্ছা থেকে সে চেষ্টা করে তার কাছের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করার। কিন্তু বিচ্ছিন্নতার রূপ এখন এমন পর্যায়ে যে, শারীরিকভাবে মানুষ এক  হতে পারছে না। তাই বিকল্প পথ অবলম্বন করতে হচ্ছে। প্রত্যক্ষর অভাব পূরণ করছে আজ  পরোক্ষ। সেই বিকল্প বা পরোক্ষর পুরোটাই এখন দখলে নিয়েছে প্রযুক্তি। আর  যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তির একটা বৃহৎ অংশ জুড়ে আছে মোবাইল ফোন।

তার মানে দাঁড়ালো, মানুষের বিচ্ছিন্নতা যতো বাড়বে, বিকল্প বা পরোক্ষর প্রয়োজন ততো বাড়বে। আর  বিচ্ছিন্নতা যতো কমবে বিকল্প বা পরোক্ষর প্রয়োজন ততো কমবে। যেমন, এই বিজ্ঞাপনটিতে মোবাইল ফোনটির কোনো প্রয়োজন ছিলো না, যদি ফোন করা সেই মানুষটি বিষণ্ণ নারীর পাশে থাকতো। অর্থাৎ, দুইজন মানুষের মধ্যে মোবাইল ফোন ব্যবহারের একটি শর্ত হলো বিচ্ছিন্নতা। পাঠক, এই হিসাব কেবল আমি আর  আপনি-ই বুঝি, তা তো নয়। এই হিসাব বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান, অর্থনীতি ও সমাজ যারা নিয়ন্ত্রণ করে তারা সবাই বোঝে। 

৫.

প্রথম বিজ্ঞাপনটিতে আমাদের অগোচরে বিজ্ঞাপনদাতারা নিজেদের স্বার্থ অটুট রাখতে মানুষের রুচিবোধ পরিবর্তনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে বলা যায়, বিজ্ঞাপনদাতারা তরুণ সমাজকে ব্যবহার করতে গিয়ে তরুণ সমাজের স্বাভাবিকতা ব্যাহত করছে। আর  শেষেরটি সম্পর্কে বলবো যে, সেটি মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে ভেঙ্গে দিয়ে প্রতিটি সত্তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। কিন্তু বাজারে তো বিজ্ঞাপন এই  তিনটিই নয়; অগণিত। এই অগণিত বিজ্ঞাপন অগণিতভাবে আমাদের ভাঙছে-গড়ছে নিজেদের মতো করে। এতে আমরা পরিবর্তিত হয়ে কী রূপ নিলাম তা তাদের চিন্তার বিষয় নয়। তারা শুধু দেখে, আমাদের পরিবর্তন হলো কি না এবং সেই পরিবর্তন তাদের অনুকূলে কি না। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে যদি এভাবে পরিবর্তন ঘটতে থাকে, পেয়ারার মতো ফল ‘হাবিজাবি’ হয়ে যায়, তরুণ সমাজ পড়াশুনা বাদ দিয়ে রাতে ফোনের পিছনে দৌড়ায় এবং মোবাইল ফোনই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নেয়-তাহলে একদিন কী হবে! যেটি হবে, একটা পেয়ারা গাছও আর  থাকবে না, তরুণরা জাতিকে দিতে পারবে না কিছুই এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের মানবিক সম্পর্ক হয়ে যাবে যান্ত্রিক।

লেখক : তৈয়ব তরুণ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

toyebur.rahman@gmail.com

তথ্যসূত্র

১. ঘোষ, বিনয়; (১৯৯৯ : ১৮১); ‘বিজ্ঞাপন ও মন’; মেট্রোপলিটন মন-মধ্যবিত্ত-বিদ্রোহ; ওরিয়েন্ট লংম্যান লিমিটেড, কলকাতা।

২. প্রাগুক্ত; ঘোষ, বিনয়; (১৯৯৯ : ১৮০)।

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন