Magic Lanthon

               

এম জিয়াউল হক সরকার

প্রকাশিত ২১ আগস্ট ২০২৩ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

রেডিও পদ্মা : ঢাকাই এফএম থেকে পৃথক করা দায়

এম জিয়াউল হক সরকার

সময়ের অবগুণ্ঠনে বিশ্বব্যাপী তথ্য-প্রবাহের জোয়ার বইছে।প্রযুক্তির বদৌলতে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়ানো এখন ক্ষুদ্র সময়ের ব্যাপারমাত্র।তথ্য নিরিখের এই মানচিত্রে সবচেয়ে বেশি জায়গা দখল করে আছে গণমাধ্যম।প্রয়োজনের ভিন্নতায় এই গণমাধ্যম আছে নানান রূপে।গণমাধ্যম-বাজারে কেউ আছে রাজনীতির খবর জানাতে,কেউ আছে অর্থনীতির খবর জানাতে;আবার কেউ বা আছে দুনিয়ার সব খবর জানানোর কথা বলে।পুরো দুনিয়া বাদ দিয়ে সমাজের একটি নির্দিষ্ট অংশের খবর জানাতে কিংবা সেই অংশের স্বার্থে কাজ করার ঘোষণা দিয়েও আছে অনেকে।এই শেষ কিসিমের গণমাধ্যম নিজেদের অস্তিত্বের বৈধতার স্বপক্ষে যে-যে যুক্তি দেখায় তার মধ্যে অন্যতম হলো-মূলধারার গণমাধ্যমে দেশের প্রান্তিক ও তৃণমূল মানুষের স্বার্থ থাকে উপেক্ষিত;যে-কারণে সমাজের ওই শ্রেণীর জন্য তাদের অস্তিত্ব জরুরি।নানান যুক্তির মধ্যে এই যুক্তিকে মূল আদর্শ ধরে রেডিও নামের যে-গণমাধ্যমের আবির্ভাব তার নাম কমিউনিটি রেডিও।

এই কমিউনিটি রেডিওর আরও দু-এক লাইন ভাষ্য বলে নেওয়া দরকার।এই রেডিওর দাবি,প্রচলিত মূলধারার গণমাধ্যম ব্যবস্থায় সমাজের বিপুল সংখ্যক প্রান্তিক ও তৃণমূল মানুষ কখনই প্রাধান্য পায়নি।এসব গণমাধ্যমে তাদের সংবাদ,সংস্কৃতি বা অন্যান্য বিষয়াদি যতোটুকু আসার কথা তা কখনই আসেনি।আর যতোটুকু এসেছে তা গণমাধ্যমের রাজনৈতিক-অর্থনীতির ব্যাকরণ মেনেই।এসব যুক্তি দেখিয়ে কমিউনিটি রেডিও বলে,পিছিয়ে থাকা এসব প্রান্তিক ও তৃণমূল জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষায় তাদের অংশগ্রহণ, ব্যবস্থাপনায় স্থাপিত ও পরিচালিত, তাদের লোকজ জ্ঞান,সম্পদ,সংস্কৃতি,আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ও জনঅংশগ্রহণ সৃষ্টির মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নের জন্যই আবির্ভাব হয়েছে তাদের।এ-রকম উদ্দেশ্য থেকেই ২০১১ সালের ৭ অক্টোবর রাজশাহীতে রেডিও পদ্মা নামের একটি কমিউনিটি রেডিও যাত্রা শুরু করে।

পড়াশুনার কারণে রাজশাহীতে থাকার সুবাদে সম্প্রচারে আসা দেশের প্রথম কমিউনিটি রেডিও-রেডিও পদ্মার অনুষ্ঠান শুরু থেকেই আমার শোনার সুযোগ হয়।গণমাধ্যমের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি তা মোটামুটি আগ্রহ নিয়ে শুনেছিও। ‘কমিউনিটি রেডিও’ কনসেপ্ট ও রেডিও পদ্মায় সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানের আধেয় শুনে আমার কিছুটা খট্‌কা লাগে।তাই অনেকটা নিজের আগ্রহে আমি কমিউনিটি রেডিও স্থাপন,সম্প্রচার ও পরিচালনা নীতিমালা ২০০৮ জোগাড় করি।এতে এ-নিয়ে খট্‌কা আমার পাকাপোক্ত হতে থাকে।এই লেখায় আমি সেই খট্‌কাগুলোই তুলে ধরার চেষ্টা করবো।যদিও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কমিউনিটি রেডিওর নতুন ধারণায়ন প্রতিষ্ঠা করতে হয়তো সময় লাগবে;তারপরও এই লেখা নতুন এ-মাধ্যমের সম্প্রসারণকে ইতিবাচক ফল দেবে বলে আশা করছি।এই আলোচনার আগে বাংলাদেশ গেজেট অনুযায়ী কমিউনিটি রেডিওর সংজ্ঞা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু কথা বলার প্রয়োজন মনে করছি।

বিকল্প রেডিও : কমিউনিটি রেডিও

কমিউনিটি রেডিওর উদ্ভব মূলত লাতিন আমেরিকার বলিভিয়ায়;১৯৪৮ সালে।খনি-শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ এবং শ্রম নিযুক্তির জন্য কমিউনিটির লোকজনকে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে মাইনার্স রেডিও নামের একটি কমিউনিটি রেডিও সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়।বাংলাদেশে মূলধারার রেডিওর যাত্রা ১৯৩৯ সালে হলেও কমিউনিটি রেডিও আসে মাত্র দুই বছর আগে;২০১০ সালের ২২ এপ্রিল।‘কণ্ঠহীন মানুষের কণ্ঠ দেবার’ অভিপ্রায়ে ১৪টি কমিউিনিটি রেডিও অনুমোদন পায়।এর একটি বাদে বাকি ১৩টি কমিউনিটি রেডিওর উদ্যোক্তা বেসরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা।এর মাঝখানে ২০০৬ সালে অবশ্য ব্যক্তি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক এফএম রেডিও চালু হয়। কিন্তু এগুলোর সবকটি ঢাকাকেন্দ্রিক।

মাইনার্স রেডিও মূলত খনি শ্রমিকদের উপযুক্ত কাজের পরিবেশ এবং শ্রম নিযুক্তির জন্য কমিউনিটির লোকজনকে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। এটা শ্রমিক ইউনিয়ন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং তারাই এর অর্থের যোগান দিতো। তারপর প্রায় একই নিয়মে কমিউনিটি রেডিও বিকাশ লাভ করে ইউরোপ ও দক্ষিণ আফ্রিকায়।মূলত গণতন্ত্রায়ন,স্থানীয়করণ,বিকেন্দ্রীকরণ,কণ্ঠহীন জনগণের ক্ষমতায়ন ইত্যাদি উদ্দেশ্যে এসব অঞ্চলে কমিউনিটি রেডিওর যাত্রা শুরু হয়েছিলো। অবশ্য দক্ষিণ এশিয়ায় কমিউনিটি রেডিও প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট খানিকটা ভিন্ন;সেটি বিশেষ করে উদ্যোক্তার দিক দিয়ে। এখানে ইউনেস্কো কিংবা বিভিন্ন দাতাসংস্থার উদ্যোগেই প্রথম দিকে কমিউনিটি রেডিও প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। তবে উদ্দেশ্য থাকে আগের মতোই। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম কমিউনিটি রেডিও প্রতিষ্ঠা পায় নেপালে;১৯৯৭ সালে। নাম রেডিও সাগরমাথা। নেপালের কাঠমান্ডুতে অবস্থিত এ-কমিউনিটি রেডিওটির উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান নেপাল ফোরাম অফ এনভাইরনমেন্ট জার্নালিস্ট (নেফিজ)। এ-ছাড়া নেপাল প্রেস ইন্সটিটিউট, হিমাল অ্যাসোসিয়েশন ও ওয়ার্ল্ড ভিউ নেপাল এদের সহযোগিতা দিয়ে থাকে। রেডিও সাগরমাথা নেপালি ভাষা ছাড়াও নেয়ারি (Newari), মৈথালি (Maithali), তামাঙ (Tamang) এবং স্থানীয় কয়েকটি নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার করে। দিনে নয়বার নিউজ বুলেটিনসহ দৈনিক ১৮ ঘণ্টা অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়। রেডিও স্টেশনটি সপ্তাহে ৯০টির বেশি অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে। সামাজিক ইস্যুভিত্তিক অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-জনস্বাস্থ্য, আইন-আদালত, সবার জন্য শিক্ষা, পরিবেশ, টেকসই উন্নয়ন, লিঙ্গ বৈষম্য, নারীর ক্ষমতায়ন, সুশাসন, মানবাধিকার, সংস্কৃতি ও পর্যটন, সাহিত্য, তৃণমূলের কণ্ঠ, তরুণ, শ্রমিক, লোক-সংগীত ইত্যাদি। ‘সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তন এবং দরিদ্র কণ্ঠহীনদের কণ্ঠ জাগিয়ে তোলা’ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে রেডিওটিতে ৭০ জনেরও বেশি সাংবাদিক কাজ করে যাচ্ছে। এদের অর্ধেকই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ  করে থাকে। রেডিওটির শ্রোতা সাধারণত শহুরে, আধা-শহুরে ও গ্রামীণ। এদের মধ্যে আমলা, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে শ্রমিক, কৃষক সবাই রয়েছেন। রেডিও সাগরমাথার শ্রোতারা রেডিওটির অনুষ্ঠান তৈরি এবং অন্যান্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে নানাভাবে সম্পৃক্ত থাকেন।  রেডিও সাগরমাথার সমসাময়িক ভারতেও কমিউনিটি রেডিও ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। এরপর একপর্যায়ে আসে আমাদের দেশে। ‘কণ্ঠহীন মানুষের কণ্ঠ দেবার’ আদর্শিক জায়গা থেকে আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় কমিউনিটি রেডিও। এই রেডিও প্রতিষ্ঠায় আমাদের উদ্দেশ্যও অন্যান্য দেশের মতোই। পাঠক, আসুন এই উদ্দেশ্যগুলো সংক্ষেপে জেনে নিই।

প্রথমে দেখা দরকার এ-সংক্রান্ত নীতিমালায় কমিউনিটি এবং কমিউনিটি রেডিও সম্পর্কে কী বলা হয়েছে? বাংলাদেশ গেজেটের কমিউনিটি রেডিও স্থাপন, সম্প্রচার ও পরিচালনা নীতিমালা-২০০৮ এ কমিউনিটি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘কমিউনিটি হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী যার অন্তর্ভূক্ত ব্যক্তিবর্গ সমধর্মী কিছু লোকজ, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তারা সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক অবস্থান যেমন, কোনো বিশেষ শহর, গ্রাম কিংবা মহল্লার মধ্যে থেকে পারস্পারিক আদান-প্রদানে অংশগ্রহণ করে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিপন্ন সেবা ও মালামাল লেনদেনের মাধ্যমে একই অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের অভিন্ন অংশীদার হয়ে থাকে।’

আর কমিউনিটি রেডিও সম্পর্কে সেখানে বলা হয়েছে, ‘কমিউনিটি রেডিওর সম্প্রচার কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রণে থাকবে একটি অলাভজনক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এর মালিকানা থাকবে নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠী বা দলের হাতে এবং এটি পরিচালিত হবে ট্রাস্ট, ফাউন্ডেশন অথবা কোনো এসোসিয়েশনের মাধ্যমে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে কমিউনিটিকে সেবা প্রদান করা এবং স্থানীয় লোকজ, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন-বিকাশের সুযোগ করে দেওয়া।এটি এক প্রকার জনসেবামূলক সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান যা সমগ্র জাতির উন্নতির পরিবর্তে কোনো একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করবে। কমিউনিটি রেডিও একটি কমিউনিটির নিজস্ব সম্পদ যা একটি জনপদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা, বিচার-বিবেচনা ও চিন্তা-চেতনার যথাযথ প্রতিফলন ঘটাবে। এছাড়া, কমিউনিটি রেডিও এমন একটি মাধ্যম যা তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের আত্মপ্রকাশ ও বিকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে, প্রান্তিক মানুষের প্রকাশ বাহন এবং তাদের যোগাযোগের মূল মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। সর্বোপরি এটি সমাজের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে জোরদার করে। কমিউনিটি রেডিও হচ্ছে একটি সম্প্রচার পদ্ধতি যা কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠীর প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত এবং যা জনগোষ্ঠীর কল্যাণে পরিচালিত হয়।’

এখন আবার ফিরে আসি দেশের প্রথম কমিউনিটি রেডিও রেডিও পদ্মায়।সম্প্রচারের শুরুর পর থেকে অল্প সময়ের মধ্যে রেডিও পদ্মা নগরীর মানুষের কাছে অনেকখানি ‘জনপ্রিয়’ (যদিও জনপ্রিয় ডিসকোর্সের সঙ্গে কমিউনিটি রেডিওর ধারণা একেবারেই বেমানান) হয়ে ওঠে।একই সঙ্গে প্রচারিত সংবাদ, তুমুল বিজ্ঞাপন ও প্রথাগত অনুষ্ঠান নাগরিক সমাজে একটু-আধটু প্রশ্নও তোলে।যদিও এখনও তাদের ‘পাইলট সম্প্রচারে’র দুই বছর শেষ হয়নি।তবুও কমিউনিটি’র রেডিও হিসেবে রেডিও পদ্মা কোন্‌ কমিউনিটির রেডিও, বিকল্প গণমাধ্যম হিসেবে এটা কী ধরনের সংবাদ প্রচার করছে, এর বিজ্ঞাপনের ধরন, আর্থিক-ব্যবস্থাপনা বা তাদের অনুষ্ঠানের আধেয় নিয়ে সম্যক আলোচনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।

রেডিও পদ্মা : আদৌ কি কোনো কমিউনিটির?

রাজশাহীতে সেন্টার ফর কমিউনিকেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিসিডি বাংলাদেশ) নামের একটি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ক জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র রেডিও পদ্মার উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান।তাদের ভাষ্যমতে, ‘এ অঞ্চলের প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কণ্ঠ জাগিয়ে তোলা, সাধারণ মানুষের তথ্যগত ক্ষমতায়ন ঘটানো, তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করা এবং সেই সঙ্গে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগরণে এবং দেশজ সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনে সক্রিয় ভূমিকা রাখার উদ্দেশ্য নিয়ে রেডিও পদ্মা যাত্রা শুরু করেছে।’

এই আলোচনায় দেখার চেষ্টা থাকবে-উপরের এই ভাষ্যকে রেডিও পদ্মার আধেয় কতোখানি সমর্থন করে। একইসঙ্গে সরকারি নীতিমালার সঙ্গেও তা মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবো।এখন নজর দেওয়া যেতে পারে রেডিও পদ্মার নিয়মিত অনুষ্ঠানমালার দিকে।এক্ষেত্রে আমরা ধরেই নিতে পারি রেডিও পদ্মার উদ্যোক্তারা অবশ্যই ‘উদ্দিষ্ট কমিউনিটি’ মাথায় রেখেই তাদের নিয়মিত ও সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানগুলো প্রচার করছে।

সপ্তাহজুড়ে রেডিও পদ্মা শুনে যেসব অনুষ্ঠান পাওয়া গেছে তার তালিকাটা অনেকটা এরকম-আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, বাঁচতে হলে শিখতে হবে, প্রান্তজনের কথা, উন্নয়নধারা, পদ্মাপাড়ের জীবন, নারীকণ্ঠ, জনতার মঞ্চ, তারুণ্য, শেকড়ের সন্ধানে, গুণীজন, কবির কবিতা, ভালোবাসার এপিঠ-ওপিঠ, তারায় তারায়, আইন-কানুন, জবের ব্যাপার, ফেরারি বিকেল, কানার হাটবাজার, মনে রেখো আমায়, হে নানা, সুস্থ থাকুন, জব মার্কেট, আগামীর তারকা, ভালোবাসো মোর গান, বাউল মন, রাজশাহী ডট কম, আমার ক্যাম্পাস, সিনে বাংলা, গানে গানে আড্ডা, হ্যালো রাজশাহী, শুভকামনা, ভিন্ন স্বাদের মাটির গান, বাংলায় গান গায়, টু-লেট, তোমায় গান শোনাবো, ক্রীড়াকণ্ঠ, জ্ঞানভাণ্ডারআজকের রাজশাহী ইত্যাদি।একই সঙ্গে আমরা কমিউনিটি রেডিও নির্দেশিকায় তাদের অনুষ্ঠানের যে তালিকা আছে তাও মিলিয়ে নিয়েছি।

প্রাথমিকভাবে তালিকার বেশিরভাগ অনুষ্ঠান শুনে আমার বুঝতে কষ্ট হয়েছে-এগুলো ঠিক কোন্‌ কমিউনিটির; অর্থাৎ এসব অনুষ্ঠানের উদ্দিষ্ট শ্রোতা কারা? তালিকায় থাকা ৩৭টি অনুষ্ঠানের মধ্যে ১৬-১৭টি অনুষ্ঠানই মূলত গানভিত্তিক। বাকি অনুষ্ঠানগুলোর কয়েকটি উন্নয়নমূলক (প্রান্তজনের কথা, উন্নয়নধারা, পদ্মাপাড়ের জীবন, নারীকণ্ঠ, জনতার মঞ্চ, তারুণ্য, শেকড়ের সন্ধানে), কয়েকটি সচেতনতামূলক (বাঁচতে হলে শিখতে হবে,সুস্থ থাকুন,আইন-কানুন)।এছাড়া শিক্ষা, সাহিত্য, খেলা, তথ্যপ্রযুক্তি নিয়েও বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়।এর বাইরে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি প্রচার করা হয় কিছু সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপনও।আর  আছে আজকের রাজশাহী শিরোনামে নিয়মিত সংবাদ অনুষ্ঠান। 

আলোচনার সুবিধার্থে এখন আমরা দেখি রেডিও পদ্মার পুরো একদিন কী ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার করে।১৬ মে ২০১২ অনুষ্ঠানসূচি ছিলো এমন-সকাল ৭.০০ থেকে ৭.৩০ টা পর্যন্ত সুপ্রভাত নামক অনুষ্ঠান দিয়ে অধিবেশন শুরু হয়।এরপর সকাল ৭.৩০ থেকে বিকেল ৩.০০টা পর্যন্ত আগের দিনের অনুষ্ঠানমালা পুনঃপ্রচার করা হয়ে থাকে।এ-দিন সকাল ৭.৩০ থেকে ৮.০০টা পর্যন্ত ছিলো পদ্মা চরের বসবাসরত মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে প্রামাণ্য অনুষ্ঠান পদ্মাপাড়ের জীবন, ৮.০০ থেকে ৯.৩০টা রাজশাহীর স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে সরাসরি গানের অনুষ্ঠান গানে গানে আড্ডা, ৯.৩০ থেকে ১০.০০টা ক্রীড়াঙ্গনের বিভিন্ন তথ্য নিয়ে ক্রীড়াকণ্ঠ, ১০.০০ থেকে ১.০০টা পর্যন্ত গান, গল্প আর বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান হ্যালো রাজশাহী, দুপুর ১.০০ থেকে ২.৩০টা হারানো দিনের গানের অনুষ্ঠান মনে রেখো আমায় এবং ২.৩০ থেকে ৩.০০টা পর্যন্ত আবার পদ্মাপাড়ের জীবন অনুষ্ঠানটি পুনঃপ্রচার করা হয়।এরপর বিকেল ৩.০০টা থেকে ব্যান্ড ও আধুনিক গানভিত্তিক অনুষ্ঠান ফেরারি বিকেল দিয়ে চলমান দিনের অনুষ্ঠান শুরু হয়।এ-অনুষ্ঠান চলে সন্ধ্যা ৬.০০টা পর্যন্ত।সন্ধ্যা ৬.০০টা থেকে সন্ধ্যা ৭.৩০টা পর্যন্ত রবীন্দ্র সংগীতের অনুষ্ঠান তোমায় গান শোনাবো, সন্ধ্যা ৭.৩০ থেকে রাত ৮.০০টা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের নিয়ে প্রামাণ্য অনুষ্ঠান প্রান্তজনের কথা, রাত ৮.০০ থেকে ৯.৩০টায় রাজশাহীর গুণীজনদের নিয়ে সরাসরি অনুষ্ঠান গুণীজন, রাত ৯.৩০ থেকে ১০.০০টা কবিতা পাঠের আসর কবির কবিতা, ১০.০০ থেকে ১১.৩০টা শিক্ষার্থীদের নিয়ে তথ্য ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান আমার ক্যাম্পাস, ১১.৩০ থেকে ১২.০০টা পর্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান জ্ঞানভাণ্ডার, ১২.০০ থেকে ১.০০টায় প্রিয় মানুষদের জন্মদিন, বিবাহ-বার্ষিকী বা যেকোনো শুভবার্তা জানানোর অনুষ্ঠান শুভকামনা।অবশ্য সংবাদভিত্তিক অনুষ্ঠান আজকের রাজশাহী সকাল ৭.১৫টা থেকে শুরু করে দুই ঘণ্টা পরপর রাত ১১.০০টা পর্যন্ত এবং সর্বশেষ রাত ১.০০টায় প্রচারিত হয়।

এখন আবারও আগের প্রশ্নে ফিরে আসি, উপরের এই অনুষ্ঠানগুলো মূলত তৃণমূল, পিছিয়ে পড়া ও প্রান্তিক কোনো কমিউনিটির জন্য কি না-এটা দেখা জরুরি।নাকি গতানুগতিক বাণিজ্যিকধারার ঢাকাই এফএম রেডিওগুলোর মতো? বিশেষ করে সঙ্গীত-নির্ভর অনুষ্ঠানগুলোতে যেসব গান ও কথামালা উপস্থাপন করা হয়, তা কোন্‌ পিছিয়ে পড়া ও প্রান্তিক কমিউনিটির? অনুষ্ঠানগুলোর ধরন দেখে সার্বিকভাবে মনে হয়েছে তা সমাজের মোটামুটি সব ধরনের শ্রেণীকে মাথায় রেখে নির্মাণ করা হয়েছে।সাধারণভাবে মনে হতে পারে,ঠিকইতো আছে,সমস্যা কী?

সমস্যা আছে,মনে রাখতে হবে এটা বিকল্প মাধ্যম। মূলধারার গণমাধ্যমের মতো সব শ্রেণীকে এখানে আমলে নিলে চলবে না।কর্তৃপক্ষ যদি মনে করেন তারা সমাজের সবার কথা ভাববেন তাহলে উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের ক্ষেত্র কীভাবে প্রস্তুত হবে।কারণ মূলধারার রেডিও কিন্তু বাণিজ্যিক কারণে সবার কথা ভেবেই অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে।

প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে মনে হয়েছে,রেডিও পদ্মা মূলধারার রেডিওর কাজটিই করছে।এর ফলে যেটা হয়েছে, এফএম কিংবা মূলধারার অন্যান্য রেডিওতে যেমন প্রান্তিক মানুষের জন্য হাতেগোনা কয়েকটি অনুষ্ঠান থাকে,রেডিও পদ্মা’তেও থাকছে তাই।অথচ মোটেও এ-রকম হওয়ার কথা ছিলো না।এক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, এ-অবস্থায় একটি নির্দিষ্ট কমিউনিটির মানুষ কীভাবে ভাবতে শিখবে এটা তাদের একান্ত আপন রেডিও কিংবা এটি কীভাবে তাদের কমিউনিটির উন্নয়ন ঘটাবে?

তবে এই মতের সঙ্গে একমত পোষণ করেননি রেডিও পদ্মার উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠান সিসিডি বাংলাদেশ-এর কর্ণধার গোলাম মুরতুজা।তার ভাষ্যমতে,‘একটি কমিউনিটি রেডিও স্থাপন করতে প্রায় দশ লক্ষ টাকা লাগে বলে সরকার দাবি করলেও আমাদের এই স্থায়ী ও পূর্ণাঙ্গ কমিউনিটি রেডিও স্থাপন করতে প্রায় কোটি টাকার মতো ব্যয় হয়েছে।এমতবস্থায় আমাদের লক্ষ্য হলো রেডিওটি সর্বোচ্চ সময় অন-এয়ারে রাখা।আর পরিকল্পনা রয়েছে বিভিন্ন পেশাজীবীদের উদিষ্ট শ্রোতা হিসেবে নিয়ে বিভিন্ন সময়মাফিক ভাগ করে রেডিওটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর করে তোলা।কেউ যদি আমাদের রেডিওটি রাত দশটা থেকে একটা পর্যন্তু শোনেন তাহলে তার মনে হবে এটা তরুণদের রেডিও।ঠিক এভাবে এ রেডিওটি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পেশাজীবীদের আপন কমিউনিটি রেডিওতে পরিণত হবে।’ এখন একটি রেডিও অনেকগুলো কমিউনিটির আপন হয়ে ওঠার বাস্তবতা কতোখানি যুক্তিযুক্ত তা খুব জোরালোভাবে ভেবে দেখবার অবকাশ আছে। এছাড়া প্রায় এক বছর বয়সী রেডিও পদ্মা এই লক্ষ্যে কী করেছে তাও বিবেচনার বিষয়।   

আর্থিক ব্যবস্থাপনা নীতিমালা কোন্‌ ধাঁচের?

অন-এয়ারের প্রায় এক বছর হওয়া এ কমিউনিটি রেডিওটির মাসিক খরচ (অনুষ্ঠান তৈরি, স্টেশন পরিচালনা, বেতন-ভাতা ইত্যাদি) প্রায় দুই লক্ষ টাকা।এই অর্থ কর্তৃপক্ষ সিসিডি বাংলাদেশ নামের প্রতিষ্ঠান এবং বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সংগ্রহ করছে। কিন্তু কমিউনিটি রেডিও হ্যান্ডবুক অনুযায়ী এই রেডিও জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা পরিচালিত এবং এর কাঠামো গড়ে ওঠে জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এছাড়া কমিউনিটিভিত্তিক গণমাধ্যমগুলো টিকে থাকে এবং ‘সফল’ হিসেবে বিবেচিত হয় তখন,যখন তারা কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেদের পরিচালনায় অর্থ যোগান দিতে পারে।কিন্তু এটি তখনই সম্ভব হবে যখন ওই গণমাধ্যমে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মানুষের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ থাকবে।আর এজন্য করতে হবে কঠোর পরিশ্রম।

আফ্রিকা ও এশিয়ায় অবস্থিত প্রায় হাজারখানেক কমিউনিটি রেডিও স্টেশন দাবি করে যে,তাদের বছরের পর বছর এ-রকম অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে।এদের বেশকিছু বিভিন্ন এনজিও, সমবায় সংস্থা, সমমনা দল এবং সরকারের কাছে থেকে সহযোগিতা পায়।তবে ব্যতিক্রমও আছে।বলিভিয়ার খনি শ্রমিকদের কমিউনিটি রেডিও ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শ্রমিকদের টাকায় চলে আসছে।আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এটাকে যদি আদর্শ হিসেবে নাও ধরি তবুও এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো,নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মানুষেরা যদি রেডিওর পলিসি,সিদ্ধান্ত গ্রহণ,অনুষ্ঠান পরিচালনা,গণতন্ত্রায়ন ইত্যাদিতে সামাজিকভাবে অংশগ্রহণ বা সর্মথন করে তবেই যেকোনো রেডিও এগিয়ে যাবে।এছাড়া সরাসরি অনুদান, রেডিওর মাধ্যমে ব্যক্তিগত ঘোষণাদি প্রচার (যেমন: জনগণের টেলিফোনধর্মী বার্তা প্রচার),শ্রোতা-সাধারণকর্তৃক প্রদত্ত সদস্য চাঁদা এবং কমিউনিটির মধ্যকার সংগঠনগুলোর রেডিও পরিচালনায় সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।আর এটি করতে পারলেই কমিউনিটির মানুষকে রেডিওর মূল চালিকাশক্তি করে তোলা সম্ভব।

কিন্তু এতোদিনেও রেডিও পদ্মা মাঠপর্যায়ে শ্রোতাদের নিয়ে কোনো সংঘ,সাধারণ সদস্য বা আর্থিক সমস্যা সমাধানের জন্য কমিউনিটির মানুষদের নিয়ে কোনো ধরনের পরিকল্পনা করেছে বলে জানা যায়নি।তাহলে কি রেডিও পদ্মা শুধুমাত্র সহযোগী প্রতিষ্ঠান আর ‘প্রচলিত বিজ্ঞাপন’ থেকে অর্থসংস্থান করবে? যদি উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে নানা ধরনের শ্রোতা ক্লাব, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন,রেডিও পদ্মা সদস্য ইত্যাদি না গড়ে তোলে তবে কীভাবে রেডিও এবং কমিউনিটির মানুষের ভিতরে আত্মিক মেলবন্ধন গড়ে উঠবে? কীভাবে তারা ভাবতে শিখবে এটা তাদের রেডিও বা এটার সম্পূর্ণ দায়ভার তাদের।আর এটা যদি গড়ে না ওঠে তবে কী করে কমিউনিটির জনগোষ্ঠী এ মাধ্যমটিকে নিজেদের মাধ্যম,সম্পদ এবং তাদের কণ্ঠস্বর মনে করবে? আর যদি মনে না করে সে-ক্ষেত্রে এটি কীভাবে কমিউনিটি রেডিও হবে উঠবে?

আজকের রাজশাহী : কোন্‌ ধারার সংবাদ?

রেডিও পদ্মার নিয়মিত সংবাদভিত্তিক আয়োজন ‘আজকের রাজশাহী’।সকাল সোয়া ৭টা থেকে প্রতি দু-ঘণ্টা পরপর রাত ১.০০টা পর্যন্ত প্রচারিত হয়।আমি আলোচনার সুবিধার্থে উদ্দেশ্যমূলক নমুনায়ন পদ্ধতিতে ৫ মে থেকে ৯ মে ২০১২ পর্যন্ত পাঁচ দিনের সংবাদ এখানে নিয়েছি।পাঁচ দিনের সংবাদ থেকে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে১০ সময় নির্বাচন করে প্রাপ্ত সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখেছি,মূলত রাজশাহী মহানগরীর পরিস্থিতি বা নগরীতে সংঘটিত অপরাধ বা দুর্ঘটনা,সরকারের নানান কর্মকাণ্ড বা কর্মসূচি,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রুয়েটের খবর,সিটি মেয়রের প্রতিদিনের কার্যক্রম,সভা-সেমিনার,শিক্ষা-সংস্কৃতিমূলক অনুষ্ঠান,রাজশাহীর বিভিন্ন সংগঠন বা ফোরামের মিছিল-মানববন্ধন,নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি,রাজনৈতিক পরিস্থিতির মতো বিষয়গুলো বেশি প্রাধান্য পায়।আর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদের মধ্যে থাকে কোনো কিছুর উদ্বোধন বা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন,আহত-নিহত,দিবস-প্রতিপাদ্য,বিদেশি কোনো মন্ত্রীর সফরের খবর,তাদের বয়ান ইত্যাদি খবরাখবর।আর খেলাধুলা বিষয়ক সংবাদে বেশি পেয়েছি আইপিএল,রাজশাহী প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগ,রাজশাহী দ্বিতীয় বিভাগ হকি লিগ বা টেনিস লিগ,স্থানীয় বিভিন্ন ক্রিকেট একাডেমি বা টুর্নামেন্টের খবর ইত্যাদি।তবে আবহাওয়া-সংক্রান্ত কোনো খবর নমুনা হিসেবে নেওয়া সংবাদগুলোর মধ্যে পাওয়া যায়নি।

পাঠক,একটি কমিউনিটি রেডিওর সংবাদ কেমন হবে তা কমিউনিটি রেডিও স্থাপন,সম্প্রচার ও পরিচালনা নীতিমালা-২০০৮ ও কমিউনিটি রেডিও হ্যান্ডবুক ইত্যাদিতে স্পষ্ট দেওয়া আছে।নীতিমালাতে বলা হয়েছে, ‘কমিউনিটি রেডিও যেহেতু স্থানীয় মাধ্যম হিসেবে কাজ করে তাই স্থানীয় উন্নয়ন-সংবাদ সম্প্রচারের অনুমতি দেওয়া হবে।তবে কোনো ধরনের রাজনৈতিক বিষয় সম্প্রচার,সকল প্রকার নির্বাচনী প্রচার ও বিজ্ঞাপন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হবে।কমিউনিটি রেডিও স্টেশন শুধু দেশি-বিদেশি রেকর্ডকৃত বিনোদনমূলক ও প্রামাণ্য অনুষ্ঠান বেতার সেন্সর নীতিমালা অনুসরণ সাপেক্ষে সীমিতভাবে প্রচার করতে পারবে।বিদেশি সম্প্রচার সংস্থা/চ্যানেলের সংবাদ ও চলতি ঘটনাভিত্তিক অনুষ্ঠান, আলোচনা ও টকশো সরাসরি বা রেকর্ড করে সম্প্রচার করতে পারবে না।’১১

অর্থাৎ,বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় বা বাণিজ্যিক বেতারের পাশাপাশি কেবলমাত্র কমিউনিটির খবরাখবর নিয়ে ক্ষুদ্র পরিসরের কমিউনিটি রেডিও টিকে থাকার কথা।তার মানে এই নয় যে,কমিউনিটি রেডিও শুধু কমিউনিটির সংবাদ নিয়ে পড়ে থাকবে। আবার মূলধারার রেডিওর খবর কাঠামো বা রীতি পুরোপুরি অনুকরণ করবে? বরং কমিউনিটির উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সহায়ক সবরকম সংবাদকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় এনে তারা বুলেটিনে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।১২ পাঠক,রেডিও পদ্মার সংবাদভিত্তিক অনুষ্ঠান ‘আজকের রাজশাহী’ খবরাখবর শুনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে এসব সংবাদ কোন্‌ কমিউনিটির জন্য বা মূলধারার গণমাধ্যমের সঙ্গে এর পার্থক্য কী? যেহেতু কমিউনিটি রেডিও ‘কণ্ঠহীন মানুষের কণ্ঠ দেবার’ অভিপ্রায়ে অনুমোদন পেয়েছে, সেহেতু উচিত হবে সংবাদকে অতোটা নগরকেন্দ্রিক কিংবা জাতীয়ভাবে নির্বাচন না করে প্রান্তিক ও তৃণমূল মানুষের জন্য তৈরি করা।আবার,যেহেতু এই কমিউনিটি রেডিও নগরকেন্দ্রিক (আরবান সেটিংস্‌),এখানে সাধারণত বিভিন্ন কমিউনিটির মানুষের বসবাস,তাদের মধ্যকার প্রান্তিক ও তৃণমূল মানুষগুলোরও বিভিন্নতা আছে; তাই এ-ধরনের নগরকেন্দ্রিক কমিউনিটি রেডিওকে উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর কাছে তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য প্রতিফলন করার জন্য খুবই চিন্তা-ভাবনা করতে হয়।তবে একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো,প্রত্যেক নগরীর নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে।আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে প্রান্তিক ও তৃণমূল মানুষগুলোর নগরীর সঙ্গে এক ধরনের আত্মিক বন্ধন গড়ে ওঠে।এ-জন্য আধেয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় আনতে হয়।তাই মাথায় রাখতে হয় প্রচারিত সংবাদটি কতোটা ‘উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠী’র জীবনঘনিষ্ঠ বা উন্নয়নকেন্দ্রিক? অর্থাৎ এ-সংবাদগুলো কীভাবে উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।তাই তাদের প্রচারিত রাজনৈতিক সংবাদ থেকে প্রান্তিক ও তৃণমূল মানুষগুলো কীভাবে লাভবান হচ্ছে তা বোধ্যগম্য নয়।যদি এই সংবাদ অতোটা জীবনঘনিষ্ঠ বা উন্নয়নকেন্দ্রিক না হয়,তবে পদ্মা চরের বা কোনো গ্রামের দরিদ্র কৃষকের গরু অথবা কোনো রিকশা চালকের রিকশা হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাই কমিউনিটি রেডিওর মূল শিরোনাম হওয়া উচিত ছিলো।কিন্তু রেডিও পদ্মা তা করেনি।

উদাহরণ হিসেবে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে নির্বাচিত ৫ মে সকাল ৭.১৫ মিনিটে প্রচারিত সংবাদ অনুষ্ঠানের আধেয়ের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই সংবাদের প্রধান শিরোনাম ছিলো-ডাক কর্মচারি স্বার্থরক্ষা ফোরাম রাজশাহীর মৌনমিছিল সংক্রান্ত।দ্বিতীয় শিরোনাম,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী হল বির্তক পাঠশালা আয়োজিত আন্তঃহল বির্তক প্রতিযোগিতা নিয়ে।এভাবে তৃতীয়,চতুর্থ,পঞ্চম শিরোনাম ছিলো যথাক্রমে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় কমে গেছে বাজারের সব সবজির দাম;নগরীর পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের মসজিদ পরিদর্শন করলেন সিটি মেয়র;এবং ২০১৫ সালের মধ্যে রাজশাহীসহ দেশের সবকটি সিটি কর্পোরেশন চলবে সৌরচালিত বিদ্যুৎ বাতিতে।এরপর দেশ টিভির ‘আমার দেশ দর্শক ফোরাম’-এর আয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত আরেকটি অনুষ্ঠান,রাজশাহী জেলা তথ্য অফিসের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ইত্যাদি খবর এভাবে চলতে থাকে।

আবার ওই দিন রাত ১.০০ টার সংবাদ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়,প্রধান শিরোনাম ছিলো,এ মাসেই নগরীতে গ্যাস সরবরাহ চালু করা হবে বললেন সিটি মেয়র।দ্বিতীয়,তৃতীয় ও চতুর্থ শিরোনাম যথাক্রমে-সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় বাজারে কমেছে সবজির দাম;থানা তথ্য অফিসের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান;নগরীতে ছিনতাইয়ের দায়ে দুই আসামীর কারাদণ্ড।এছাড়া ছিলো জাতীয় ও খেলাধুলার সংবাদ।জাতীয় সংবাদের মধ্যে প্রধান,দ্বিতীয় সংবাদগুলোর শিরোনাম যথাক্রমে-বিরোধীদলীয় নেতারা দাবী করেন সরকার গণবিরোধী আচরণ করছে...;প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন;আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন,জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে সরকার বিরোধীদলের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে...।আর তৃতীয় সংবাদটি হলো আফগানিস্তানে ব্র্যাকের কর্মী খুন হওয়ার ঘটনা নিয়ে।আবার খেলার সংবাদে প্রধান শিরোনাম-রাজশাহী প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগের খবর,এরপর ইয়াং টাইগার অনূর্ধ্ব-১৬ জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে রাজশাহী জেলা দলের ওঠার খবর।তারপর আইপিএলের খবরের মাধ্যমে সংবাদ শেষ হয়।

এছাড়া ৬ মে দুপুর ১.০০টার সংবাদের প্রধান শিরোনাম ছিলো-বৌদ্ধ পূর্ণিমা উদ্‌যাপনের খবর;৭ মে বিকেল ৩.১৫ মিনিটের খবরের প্রধান শিরোনাম ছিলো-‘প্রকাশিত হলো এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল’;৯ মে রাত ১.০০টার খবরের প্রধান শিরোনাম ছিলো ‘পালিত হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের ১৫১তম জন্মবার্ষিকী।’ পাঠক এমন সংবাদ যে প্রচারিত হবে না তা নয়,তবে কিছু প্রশ্ন থাকে।যেমন : তারা আন্তঃহল বির্তক প্রতিযোগিতা,সিটি মেয়রের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম,বৌদ্ধ পূর্ণিমা উদ্‌যাপন বা এ-ধরনের খবর প্রচার করছে-এতে কীভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা ওঠে আসছে বা উন্নয়নে কী ধরনের ভূমিকা রাখছে তা বোধগম্য নয়।সিটি করপোরেশন বা অন্যান্য অনেক সংবাদই প্রচারিত হতে পারে বা প্রচার হওয়া জরুরি;কারণ কমিউনিটি রেডিওতেও স্থানীয় সরকারের কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে।কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে এ-ধরনের সংবাদের উপস্থাপনা নিয়ে।মেয়র কোথায় কী করলেন কিংবা সিটি করপোরেশনের হালচাল বর্ণনার চেয়ে করপোরেশনের নাগরিক সুবিধা-অসুবিধা,সেবা,কিংবা উন্নয়ন ভাবনাকেন্দ্রিক নাগরিকদের জীবনঘনিষ্ঠ সংবাদ প্রচার জরুরি।আবার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করছে,খুবই ভালো কথা।কিন্তু এ সংবাদটিতে তারা শুধু বাজারদর কোন্‌টির কমলো বা বাড়লো এটি বলেই খালাস!কেনো বাড়লো,সাধারণ মানুষের ভোগান্তি নিয়ে কোনো কথা সংবাদে নেই।  

কথা বলা যেতে পারে খেলাধুলার সংবাদ নিয়েও।খেলার সংবাদে দেখা যায়-নগরকেন্দ্রিক ক্রিকেট,টেনিস,হকি ইত্যাদি বেশি। হ্যাঁ,এসব খেলার মধ্যে যে দুই-একটি খেলা তৃণমূলের ছেলেমেয়েরা খেলে না,তা নয়।তবে তাদের প্রচারিত খেলাধুলা মূলত টুর্নামেন্টকেন্দ্রিক;এতে তৃণমূলের লেশমাত্র নেই।এরচেয়ে কি প্রান্তিক ও তৃণমূল জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের খেলার মাঠ সংকুচিত হয়ে যাওয়া,উপযুক্ত পরিবেশ না থাকার বিষয়গুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়? এছাড়া আমাদের নিজস্ব যেসব খেলা যেমন : হা-ডু-ডু,কাবাডি,গোল্লাছুট,বউচি,দাঁড়িয়াবান্ধা-এসব নিয়েও কোনো তথ্য,আলোচনা এখানে উঠে আসেনি। আবহাওয়ার কথা জোর দিয়েই বলতে হয়,অবশ্যই এ-অঞ্চলের মাটি,জলবায়ু,পরিবেশ ইত্যাদি বিষয় আমলে এনে স্থানীয় কৃষি-অর্থনীতি বিকাশ বা তাদের উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জীবনঘনিষ্ঠ আবহাওয়া সংবাদ নিয়মিত প্রচার হওয়ার কথা।কারণ কমিউনিটির মানুষের জন্য আবহাওয়া সংবাদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।উদাহরণ হিসেবে আমরা ধরতে পারি,পদ্মার চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের কথা।প্রতিনিয়ত প্রতিকূল আবহাওয়ায় মধ্যে যাদের বাস।তাদের জীবিকানির্বাহ,বাজার-সওদা,চিকিৎসা ও নানা কাজে প্রতিদিন শহরে আসতে হয়। আবহাওয়া কেমন হবে,তারা প্রতিদিনের কাজে যেতে পারবে কি না,নদীপথে পারাপার নিরাপদ কি না-এসব কমিউনিটি রেডিওর সংবাদ হওয়ার কথা ছিলো।ঠিক একইভাবে নগরবাসী,কমিউনিটির জন্য টানা বৃষ্টি অথবা প্রচণ্ড তাপদাহের সংবাদ আগে থেকে জানা জরুরি।কারণ এই সংবাদের ওপর নগরের দিনমজুর,রিকশাওয়ালার জীবন অনেকখানি নির্ভরশীল।কিন্তু দৈবচয়ন পদ্ধতিতে সময় নির্বাচন করে প্রাপ্ত সংবাদে এ-ধরনের কোনো নজির পাওয়া যায়নি।

বিজ্ঞাপনে কেনাকাটা নাকি ‘উন্নয়ন’!

‘নানকিং বাজার!নানকিং বাজার!নানকিং বাজার!সবকিছুই এখানে।সবকিছু মানে!আরে সবকিছুই।তোমাদের জন্য তেল,চাল,ডাল,মসলাসহ দৈনন্দিন সবজি বাজার।তোমাদের জন্য টি-শার্ট,শর্ট-শার্ট,জিন্স,ফতুয়াসহ সবকিছু।তাই বুঝি!তুমি কি জানো,তোমার জন্য ফ্যাশানাবল সব থ্রি-পিস,শাড়ি,আকর্ষণীয় সবকিছুই নানকিং বাজারে!’

এরপর আছে আরাবী ফুড গার্ডেনের বিজ্ঞাপন।এখানেই শেষ নয়;আপনি চাইলে রেডিও পদ্মায় পেতে পারেন পছন্দের ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোন,ল্যাপটপ,রঙ ফর্সা করার ক্রিম,আবাসিক হোটেলের খোঁজ। রেডিও পদ্মায় সম্প্রচারিত সবচেয়ে বেশি সময় (তিন ঘণ্টা ধরে) ধরে চলা গানের অনুষ্ঠান ‘ফেরারি বিকেল’ ৩০ এপ্রিল ২০১২ অনুষ্ঠানের মাঝে বিজ্ঞাপনের তালিকাটা ছিলো এমন-লুকমি এলএক্স কসমেটিকস্‌,কলিকাতা হারবাল মেডিকেল সেন্টার,হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনাল,মোবাইল হাট,ল্যাপটপ সিটি,নানকিং বাজার,রয়েল মেডিকেল ভর্তি কোচিং,কনটেস্ট কোচিং,আরাবী ফুড গার্ডেন,রেটিনা মেডিকেল ভর্তি কোচিং,মোহনা মেগাসিটি ইত্যাদি।

এর বাইরে জনসচেতনতা ও সরাসরি উন্নয়নমূলক বিজ্ঞাপনের সংখ্যা ছিলো দু-একটি।শুধু ফেরারি বিকেল নয়,রেডিও পদ্মার অন্যান্য অনুষ্ঠানগুলোতে এ-ধরনের বিজ্ঞাপন অহরহ প্রচারিত হয়।কিন্তু নীতিমালায় বিজ্ঞাপন নিয়ে স্পষ্ট করে বলা আছে, ‘বিজ্ঞাপন উন্নয়নমূলক সেবা সংশ্লিষ্ট হতে হবে এবং নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে,কমিউনিটি রেডিও স্টেশন নিশ্চিত করবে যে অনুষ্ঠান অর্থায়নকারীরা সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠান বা অনুষ্ঠানমালার বিষয়াবলী কিংবা স্টাইল এবং স্টেশনের নীতিমালার ব্যাপারে কোন প্রভাব বিস্তার করছে না।এছাড়া বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে সরকারের বিদ্যমান নির্দেশনা অনুসরণ করবে।’১৩

এখন প্রশ্ন প্রথমত,লুকমি এলএক্স কসমেটিকস্‌,কলিকাতা হারবাল মেডিকেল সেন্টার-এর বিজ্ঞাপন জনগোষ্ঠীর কোন্‌ উন্নয়ন ঘটায়? নানকিং বাজার বা আরাবী ফুড গার্ডেনের মতো এসব বিজ্ঞাপন কাদের কথা বলে? তারা সমাজের প্রান্তিক না তৃণমূল? প্রচলিত বিজ্ঞাপনগুলোর মতো এসব বিজ্ঞাপন কি শ্রোতাদের মাঝে ভোগবাদীতার বাড়তি চাহিদা তৈরি করে না? কমিউনিটি রেডিওর এসব বিজ্ঞাপন শুনে মনে হয়,প্রচলিত গণমাধ্যমগুলোর মতো এই গণমাধ্যমটিও বলছে,জীবনের জন্য পণ্য উপকরণ নয়,বরং পণ্যভোগের জন্যই জীবন।

দ্বিতীয়ত,ধরে নিলাম প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার জন্য অর্থের প্রয়োজন।কিন্তু এটি একটি কমিউনিটি রেডিও;তাই এটি প্রতিষ্ঠার আগেই উদ্যোক্তাদের মাথায় রাখতে হতো,তাদের প্রতিষ্ঠানের অর্থ-সংস্থাপন কীভাবে হবে।অর্থের দোহাই দিয়ে তারা কোনোভাবেই লুকমি এলএক্স কসমেটিকস্‌ কিংবা কলিকাতা হারবাল মেডিকেল সেন্টার-এর বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারে না।বরং এর উল্টোটাই হওয়ার কথা ছিলো-এসব ক্রিম যে আসলে মানুষের ত্বক ফর্সা করে না,তাই বিশেষজ্ঞ এনে কমিউনিটির মানুষকে বোঝানোর দায়িত্ব ছিলো রেডিও পদ্মার।

ফেরারী বিকেল : ফেরাবে কি কমিউনিটিকে?

‘ঘুরতে-ফিরতে আপনার সাথে আছে ফেরারি বিকেল।শ্রোতা যারা এই মুহূর্তে হরতালের এই দিনে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত,অতিষ্ঠ হয়ে গেছেন বসে থাকতে থাকতে বাসায়।একেতো রোদের তীব্র তাপমাত্রা,দ্বিতীয়ত বিদ্যুৎ নেই।আবার বাইরে যাবারও উপায় নেই।সব মিলিয়ে বন্দিদশা পালন করছেন।কোনো সমস্যা নেই!আর বন্দি জীবদ্দশা থেকে পুরোপুরি মুক্ত করে দেবার জন্য আমি আরিফ চৌধুরী আছি আপনার সাথে সন্ধ্যা পর্যন্ত।হ্যাঁ এভাবেই ঘুরতে-ফিরতে আমাদের নিত্য সঙ্গী হয়ে গেছে ফেরারি বিকেল।’১৪ রেডিও পদ্মার দীর্ঘসময় ধরে চলা অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে ফেরারি বিকেল অন্যতম।এটি বিকেল তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত প্রচারিত হয়।পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে থাকে ব্যান্ড ও আধুনিক গান,সেই সঙ্গে উপস্থাপকের এসএমএস পড়া।এসএমএস পড়ে উপস্থাপক আবার মাঝেমাঝে শ্রোতাদের কিছু তথ্য ও টিপস্‌ও দেন।

এখানে উপস্থাপকের কথার ধরন দেখে এফএম রেডিও-জকিদের কথা মনে পড়ে যায়।এখানেও এফএম রেডিওর মতো এসএমএস করে শ্রোতারা তাদের মন খারাপের কথা জানায়,আর আরেফিন রুমী,ন্যান্সি,হাবীব,হৃদয় খানদের গান শুনতে চায়।উপস্থাপক আবার ওই এফএম’র আদলেই মন খারাপ থাকা দর্শকের উদ্দেশে বলে ‘তোমার চোখের পানি এতো সস্তা কেনো? বড়োদের মতো হতে হবে।’১৫ আর এখানেও প্রিয়জনকে গান ডেডিকেট করা হয়।

পাঠক একটু ভাবুন,এই ফেরারি বিকেল-এর উদ্দিষ্ট শ্রোতা কারা? তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা কী? ভাষার ক্ষেত্রে উচ্চারণ ভঙ্গি,সুর,লয় ইত্যাদিও লক্ষ্য করার মতো।এসব বিষয়ে ধারণা পেতে ‘অডিয়েন্স রেসপন্স’ বিশ্নেষণ করে দেখা যায়,শ্রোতাদের বেশিরভাগই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং এদের বেশিরভাগের আর্থ-সামাজিক অবস্থা উচ্চ-মধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তের কাতারে।আর উপস্থাপকদের কথা বলার ধরন,উচ্চারণ ভঙ্গি,সুর,লয় ইত্যাদিও গতানুগতিক বেসরকারি এফএম রেডিও স্টেশনগুলোর মতোই-একথা বললে ভুল হবে না।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে,যদি তাদের উদ্দিষ্ট শ্রোতা বা ভাষার ক্ষেত্রে উচ্চারণ ভঙ্গি,সুর,লয় ইত্যাদি সমাজের পিছিয়ে থাকা প্রান্তিক কোনো জনগোষ্ঠীর সামঞ্জস্য না হয়,তবে কীভাবে এটি কমিউনিটি রেডিও হিসেবে ওই নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সহায়ক হবে-তা বোধগম্য নয়।আমার এই দুর্বোধ্যতা আরও ঘনীভূত হয় উপস্থাপকের টিপ্‌স বা তথ্য দেওয়া দেখে।তথ্য বা টিপস্‌গুলো এরকম-বিশ্বের সর্বোচ্চ ঘড়ির দাম কতো? বাইরে বেরোনোর সময় ছাতা নিয়ে বের হবেন,গরমে বেশি করে ফলের রস পান করুন,হিট-স্টোক থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায় ইত্যাদি।পাঠক ভাবুনতো,এ টিপস্‌গুলো কোন্‌ শ্রেণীর শ্রোতাদের জন্য? যাদের দুমুঠো ভাতের জন্য সারাদিন রোদে পুড়ে দেহ তামাটে করতে হয়,তাদের জন্য নিশ্চয় ছাতা ব্যবহার বা ফলের রস পান করার টিপস্‌ নয়!

শেষে কয়েকটি প্রশ্ন

রেডিও পদ্মার কর্তাব্যক্তিদের মতে,দুই বছর যাবৎ এটির পাইলট সম্প্রচার চলবে।এই সময়ের মধ্যে এ রেডিওটির পরিচালনা,অনুষ্ঠানমালা তৈরি ও সম্প্রচার এবং উদ্দিষ্ট কমিউনিটি নির্ধারণ ইত্যাদি হবে।আর এভাবেই একসময় ঠিকঠাক ‘বিকল্প মাধ্যম’ হিসেবে এটি একটি আদর্শ কমিউনিটি রেডিও-তে পরিণত হবে।কিন্তু এতোদিন পেরিয়ে গেলেও আমরা এই রেডিওটির আধেয়,সংবাদ,বিজ্ঞাপন,আর্থিক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদিতে সেই আদর্শের আগমনীর তেমন ছাপ দেখতে পাইনি।তাই প্রায় এক বছরের মাথায় প্রশ্ন তোলা স্বাভাবিক,এই রেডিও জাতীয় উন্নয়নে সামাজিকভাবে প্রান্তিক কোনো জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নীতি-নির্ধারণ,সিদ্ধান্তগ্রহণ,অনুষ্ঠান পরিচালনা,গণতন্ত্রায়নে কতোখানি ভূমিকা রাখতে পারবে? কিংবা প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলোতে প্রান্তিক মানুষের জন্য কতোটুকু সময় বেড়েছে? সবমিলিয়ে সর্বশেষ যে প্রশ্নটি না করলেই নয়,‘কমিউনিটি রেডিও’ নাম ধরে রেডিও পদ্মা কতোটুকু কমিউনিটির হতে পেরেছে?


লেখক :এম জিয়াউল হক সরকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ফ্রিল্যান্স লেখালেখি করেন।

ziamcj@gmail.com

 

তথ্যসূত্র

১.ফ্রিকোয়েন্সি মডুলেশন যা সংক্ষেপে এফএম; ১৯৩০ সালে এডউইন এইচ আর্মস্ট্রং এর আবিষ্কারক;সম্প্রচার-দূরত্ব সাধারণত ৫০ থেকে ৮০ কিলোমিটারের মধ্যে,কৃত্রিম উপগ্রহ ব্যবহারের মাধ্যমে এই দূরত্ব বাড়ানো সম্ভব।

২.http://en.wikipedia.org/wiki/Radio_Sagarmatha

৩.কমিউনিটি রেডিও স্থাপন,সম্প্রচার ও পরিচালনা নীতিমালা-২০০৮,বাংলাদেশ গেজেট।

৪.কমিউনিটি রেডিও স্থাপন,সম্প্রচার ও পরিচালনা নীতিমালা-২০০৮।

৫.কমিউনিটি রেডিও নির্দেশিকা,২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২;বাংলাদেশ এনজিও’স নেটওয়ার্ক ফর রেডিও এ্যান্ড কমিউনিকেশন কর্তৃক প্রকাশিত।

৬.কমিউনিটি রেডিও নির্দেশিকা,২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২।

৭.উদোক্তা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর কমিউনিকেশন এ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (সিসিডি বাংলাদেশ)কর্ণধার গোলাম মুরতুজার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকার।

৮.গোলাম মুরতুজার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকার।

৯.কমিউনিটি রেডিও হ্যান্ডবুক,জুলাই ২০১০,বাংলাদেশ এনজিও’স নেটওয়ার্ক ফর রেডিও এ্যান্ড কমিউনিকেশন কর্তৃক প্রকাশিত।

১০.গত ০৫-০৫-২০১২ থেকে ০৯-০৫-২০১২ তারিখ পর্যন্ত প্রচারিত মোট পাঁচ দিনের সংবাদগুলোর মধ্যে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিছু সংবাদ হাজির করা হয়েছে।আর পাঁচ দিনের সংবাদগুলোর মধ্যে থেকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিছু সংবাদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে সমগ্র সংবাদ থেকে সময়ের ভিত্তিতে দৈবচয়ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে।

১১.কমিউনিটি রেডিও স্থাপন,সম্প্রচার ও পরিচালনা নীতিমালা-২০০৮।

১২.কমিউনিটি রেডিও হ্যান্ডবুক।

১৩.কমিউনিটি রেডিও স্থাপন,সম্প্রচার ও পরিচালনা নীতিমালা-২০০৮,বাংলাদেশ গেজেট অনুচ্ছেদ-৭.৯।

১৪.রেডিও পদ্মা :ফেরারি বিকেল,৩০ এপ্রিল ২০১১ তারিখে প্রচারিত অনুষ্ঠান।

১৫.রেডিও পদ্মা :ফেরারি বিকেল,প্রাগুক্ত।



বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৩ সালের জুলাইয়ের ম্যাজিক লণ্ঠনের তৃতীয় সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।



এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন