আবুবকর সিদ্দিক
প্রকাশিত ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
উত্তমকুমার বললেন, ‘কুঞ্জ দা, ইনি ওই বাংলার কবি, তুমি এর জন্যে পাঞ্জাবি কেটে দেবে তো?’
আবুবকর সিদ্দিক

সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আমার মুখোমুখি পরিচয়টা হয় ১৯৬৩ সালের জানুয়ারি মাসে; কলকাতায় টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে মহানগর সিনেমার সেটে—সে কথায় একটু পরে আসবক্ষণ। তার আগে আমার ব্যক্তিগত জীবনে সিনেমা-সংসর্গ নিয়ে কিছু প্রাথমিক কথা জানানো উচিত।
আমার জন্মস্থান এই বাংলায় মানে বাগেরহাটে; কিন্তু বাবার চাকরিসূত্রে আমার যখন এক বছর বয়স, ১৯৩৫ সাল থেকেই আমাদের পশ্চিমবঙ্গে বসত; এটা ছিলো একেবারে ৪৮ পর্যন্ত। বাবার চাকরি উপলক্ষে স্বভূমি বাগেরহাট ছেড়ে প্রথমে আমরা হুগলি শহরে বাস করতে থাকি। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ সালের ২২ডিসেম্বর যখন কলকাতায় বোমা পড়লো, তখন বাবা ট্রান্সফার নিয়ে বর্ধমানে চলে গেলেন। বাবা যথেষ্ট সংস্কৃতিমনা ছিলেন, ফলে যা হয় আর কি, ওই পরিবেশে থাকার ফলে সিনেমাটার সঙ্গে খুব সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিলো একেবারে শৈশব থেকে।
আমার এটা বলতে দ্বিধা নেই যে, এখন দেশে খুব কম লোকই আছে, সিনেমা সম্পর্কে যাদের এতো আগের অভিজ্ঞতা আছে। কারণ আমার মনে আছে, বর্ধমানে আমরা গেলাম ১৯৪৩-এর গোড়ায়। তখন বাংলা আর হিন্দি দুটো সিনেমাই পাল্লা দিয়ে জনপ্রিয় ছিলো; কলকাতায় ‘রক্সি’ সিনেমাহলে হিন্দি কিসমত আর ‘পূরবী’ ও ‘উত্তরা’ সিনেমাহলে বাংলা উদয়ের পথে চলছিলো। সেসময় এই দুটো সিনেমা ছিলো মানুষের মুখে মুখে।
কিসমত বর্ধমানে এলো, হলের নাম ‘বর্ধমান সিনেমা’। বিখ্যাত-জনপ্রিয় সিনেমা এলে বাবাই মা’সহ আমাদের নিয়ে যেতেন। সিনেমা দেখার ট্রেনিংটা আমার ওই ভাবেই হচ্ছিলো। তো আমরা কিসমত দেখতে গেলাম। আগে থেকেই জানতাম কে কে আছেন। অশোককুমার নায়ক আর নায়িকা মমতাজ শান্তি। কিসমত-এর কিছু গান এখনো মনে আছে আমার। আমাদের ছেলেবেলা এমনিভাবে সিনেমা, গান-বাজনা ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত হয়ে গিয়েছিলো।
এর কিছু পরেই বর্ধমানের আরেকটি সিনেমাহল ‘বিচিত্রা’য় সেই বিখ্যাত বাংলা সিনেমা উদয়ের পথে এলো; ওটাও দেখলাম বাবার সঙ্গে। গত বছর না তার আগের বছর একটা পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় বাংলাদেশের বিখ্যাত ও পুরনো পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম তার সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘আমি অনেক আগে থেকে সিনেমা খুব দেখতাম, তো আমার এখনো মনে আছে ছেলেবেলায় কিসমত দেখার কথা। তার নায়ক ছিলেন অশোককুমার, নায়িকা মধুবালা।’ এটা একেবারে মাথাখারাপ ব্যাপার, তিনি একজন নামকরা পরিচালক অথচ ভুলেই গেছেন, আন্দাজে লিখে ফেলেছেন। কিসমত-এ মধুবালার অভিনয়ের প্রশ্নই উঠে না, তখন মধুবালার জন্ম হয়েছে কি না, জানি না। যাক এসব গল্প, এখন আর করবো না। তবে আমি প্রচুর সিনেমা দেখতাম নানাভাবে।
১৯৬৩ সালে, তখন আমি বাগেরহাট পি সি কলেজে বাংলার প্রফেসর। এই বছর আমি কলকাতায় গিয়েছিলাম সাহিত্য সংক্রান্ত কাজে। সাহিত্য নিয়ে বিভিন্ন জনের সঙ্গে তখন আমার কথাবার্তা, মেলামেশা চলছে; এটা তখন কিছুটা রাজনীতিরও ব্যাপার। বাম রাজনীতির তখন একটা গোপন কর্মকাণ্ড ছিলো। সেই সময় ‘নতুন সাহিত্য’ নামে একটা অসাধারণ সুন্দর পত্রিকা বের হতো, এটা প্রকাশ হতো নতুন সাহিত্য ভবন নামে প্রকাশনালয় থেকে। এদের অফিসটা ছিলো কলকাতার এলগিন রোডের মোড়ে। তো আমি একদিন দুপুরবেলা সেই অফিসে গেলাম। সম্পাদক অনিল কুমার সিংহ; তাঁর সঙ্গে গল্পগুজব, কথাবার্তা বলে, ওখান থেকে বেরিয়ে ট্রামে উঠলাম। সেখানে একটা হালকা দুর্ঘটনার শিকার হই। ট্রামে ওঠার অভ্যাস নেই কলকাতার মানুষের মতো, তাই উঠতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম।
যাই হোক, কোনোমতে ট্রামে উঠে বসলাম, আমি যাবো ‘পরিচয়’ পত্রিকায়, ৮৯ মহাত্মা গান্ধী রোড কলেজ স্ট্রিটে। ‘পরিচয়’ পত্রিকা তখন খুব জনপ্রিয়, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে নিষিদ্ধ। এটা নিষিদ্ধ রাজনৈতিকভাবেই। তখন তো আইয়ুব খানের আমল। ‘পরিচয়’ নিষিদ্ধ পত্রিকা কিন্তু খুব সুনাম, কমিউনিস্ট পার্টি বা প্রগতিশীল যারা, তাদের পত্রিকা। তো আমি সেই অফিসে যাবো। ঘটনাচক্রে ট্রামে আমার পাশে যিনি বসেছিলেন, উনি আমাকে দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘আপনার নাম কী, কোথায় যাবেন?’ আমি বললাম। তখন উনি বললেন, ‘আমিও ‘পরিচয়’-এ যাবো, চলুন আপনাকে নিয়ে যাই।’
তখন আমি ঢাকার ‘সমকাল’ পত্রিকায় খুব লিখতাম। ‘সমকাল’-এ লেখা মানে মোটামুটি জাতে ওঠা। সেই সূত্রে আমার নামের সঙ্গেও তারা আগে থেকে কিছুটা পরিচিত ছিলেন। আমার পকেটে তখন কবিতার পাণ্ডুলিপি। আমি সেখান থেকে পড়া শুরু করলাম। একপর্যায়ে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় আমার হাত থেকে পাণ্ডুলিপিগুলো নিয়ে নিজেই পড়তে শুরু করে দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে চমৎকার একটা আড্ডা জমে উঠলো। এখনো মনে পড়লে আমার লজ্জা লাগে, তখন আমি তাদের চেয়ে বয়সে অনেক ছোটো ছিলাম। অধ্যাপনা কেবল পাঁচ বছর হয়েছে। আমি খুবই ইয়াঙ, আর ওরা সব দিকপাল, বড়ো বড়ো নামকরা লোক।
সেখান থেকেই কিছু লেখক ও সাংস্কৃতিক কর্মীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়ে গেলো; মূলত ওরাই করে দিলেন। অসীম রায় আমাকে তার দুদিন পরে নিয়ে গিয়েছিলেন কবি বিষ্ণু দে’র বাসায়। বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়—সবার সঙ্গে আমার তখন দেখাসাক্ষাৎ হচ্ছে।
এই সূত্র ধরেই এর দিন দুই পরে সত্যজিৎ রায়, ৫০ দশকের শেষের দিকে পথের পাঁচালী করে যিনি খুবই খ্যাতি অর্জন করেছেন, তার সঙ্গে ফোনে আলাপ হলো। তিনি আমাকে বললেন, ‘আপনি সরাসরি চলে আসুন।’ আমি বললাম, ‘কোথায়?’ তিনি বললেন, ‘টেকনিশিয়ান স্টুডিও, নিউথিয়েটার্স স্টুডিওর পাশেই।’ আমি গেলাম পরদিন। গিয়ে দেখলাম, সেখানে সত্যজিৎ বাবুর মহানগর সিনেমার শুটিং হচ্ছে। সেটা ছিলো নরেন্দ্রনাথ মিত্রের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে।
আবুবকর সিদ্দিক
সেখানে গিয়ে অনেকক্ষণ কথাবার্তা হলো। আমি আসলে প্রথম দেখায় অনেকটা চমকে গিয়েছিলাম সত্যজিৎ বাবুকে দেখে। যার এতো নামডাক শুনি-জানি, কিন্তু একেবারে সাধারণ মানুষ—লম্বা দীর্ঘ শরীর, টানা চোখ, ভারি সুন্দর দেখতে, গলার স্বর গমগম করে। আমাকে নিয়ে বসলেন, নানা কথাবার্তা চলছিলো, শুটিং হচ্ছিলো। তার ফাঁকে ফাঁকে আলাপ। তখন অবশ্য লাঞ্চ আওয়ার শুরু হয়ে গেছে। মহানগর-এর নায়ক অনিল চ্যাটার্জি, নায়িকা মাধবী মুখার্জি। আরো ছিলেন শৈলেন মুখোপাধ্যায়, আরো কে কে মনে নেই।
যতোদূর মনে পড়ে, পর পর দুদিন দুটো বা তিনটে সেটের শুটিং দেখেছিলাম। একটা দৃশ্যে নায়ক, নায়িকা ও নায়কের বাবা; বাবার চরিত্রে যিনি অভিনয় করছিলেন, তিনি একজন সুদর্শন প্রৌঢ় ভদ্রলোক। তার চোখে নতুন পাওয়ারের চশমা নিতে হয়। নায়কের এক বন্ধু চোখের ডাক্তার। তাকে দেখানোর কথা চলছে। আমি মানিক বাবুকে ফিসফিস স্বরে বললাম, ‘এতো সুন্দর বাবা, একে আপনি কোথায় পেলেন?’ মানিক বাবু বললেন, রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে একদিন এক বাড়ির রকে বসে খবরের কাগজ পড়তে দেখেন ভদ্রলোককে। সেখান থেকে তুলে এনেছেন পরে।
বেশ অনুগত টাইপের এক যুবককে দেখলাম সত্যজিৎ বাবুর কাছে অনুনয়-বিনয় করছে— ‘একটা চান্স দিয়ে দিন মানিক দা।’ সত্যজিৎ বাবু শেষটায় বললেন, ‘যা গাড়িটা নিয়ে আয়।’ মহা উল্লাসে বেরিয়ে গেলো ছেলেটি। তার একটু পরেই দেখি, একটা আস্ত ট্যাক্সি বাইরে থেকে চালিয়ে একেবারে সেটের মধ্যে চলে এসেছে; সুব্রত বাবুর ক্যামেরার সামনে। সেদিন সত্যজিৎ বাবু কথায় কথায় এই বাংলার ক্যামেরাম্যান বেবি ইসলাম ও গায়ক আবদুল জব্বারের খুব প্রশংসা করেন। কথাপ্রসঙ্গে শাহেদ আলীর ‘জিব্রাইলের ডানা’ গল্পটি নিয়ে সিনেমা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি। এক ফাঁকে সত্যজিৎ বাবু একটা বড়ো খাতায় পেন্সিলে আঁকা স্কেচ দেখালেন। বললেন, বিভিন্ন দৃশ্যের পরিকল্পনা যখন মাথার মধ্যে কাজ করে, তখন এই ধরনের স্কেচ এঁকে রাখেন।
লাঞ্চ আওয়ারে সত্যজিৎ বাবু আমাকে নিয়ে মুখোমুখি বসলেন। আমার লেখা নিয়ে কথা উঠলো, কবিতার কথাই বেশি হলো। আমি তখন ব্যাগ থেকে ‘সমকাল’ পত্রিকার চলতি মাসের সংখ্যাটা বের করে দিলাম। ‘সমকাল’-এর তখন মূল সম্পাদক সিকানদার আবু জাফর আর সহযোগী সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান। আমি সত্যজিৎ বাবুর হাতে চলতি মাসের সংখ্যাটা বের করে দিলাম, ওর মধ্যে আমার একটা কবিতা ছিলো ‘জ্ঞানী বিধাতার ইচ্ছা ও দয়া’ নামে। উনি ওখানে বসেই গোটা কবিতাটা পড়ে ফেললেন, এরপর বেশ মিষ্টি করে হাসলেন; তারপর বললেন, ‘দেখুন মশাই, আপনাদের ওখানে একটা সুবিধা আছে।’ আমি বললাম, ‘কী রকম?’ উনি বললেন, ‘ওই উর্দুওয়ালাদের ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট এতো সূক্ষ্ম না, আপনারা যেভাবে রূপক-প্রতীক দিয়ে লিখবেন, ওরা এগুলোর ভিতর যেতে পারবে না।’ আমি আসলে ‘জ্ঞানী বিধাতার ইচ্ছা ও দয়া’ শিরোনামের কবিতাটা সেসময়ের সামরিক সরকারকে খোঁচা দিয়ে লিখেছিলাম।
তারপর লাঞ্চ নিয়ে এলো, মনে হয় টোস্ট আরো কী কী জানি, এখন আর ঠিক মনে নেই। সত্যজিৎ বাবু আবার ওর অংশ থেকেও আমাকে খেতে দিলেন; আর বললেন, ‘আসুন দুই বাংলায় ভাগাভাগি করে মিলেমিশে খাই।’ এর বেশ কিছুক্ষণ পরে দেখলাম একজন বিদেশি মহিলা ক্যামেরা নিয়ে ঘুর ঘুর করছেন। দেখে মনে হলো একটু অধৈর্য। একসময় তিনি বললেন, ‘মানিক বাবু আমাকে একটু সময় দিন, আমি অনেকক্ষণ ধরে আছি।’ সত্যজিৎ বাবু তখন একটু উত্তেজিত হয়েই বললেন, ‘নো, নট নাউ। আমি এখন পূর্ব বাংলার কবির সাথে কথা বলছি।’
আমি সত্যজিৎ বাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ব্যাপার কী?’ তখন সত্যজিৎ বাবু বললেন, ‘উনি আমার ওপরে একটা বই লিখছেন। সেই নিয়ে একটু সাক্ষাৎকার, কথাবার্তা আর কি।’ যাহোক শুটিং দেখছিলাম, ভালোই লাগছিলো, আমি তো আর আগে কখনো শুটিং দেখিনি। তার ওপর আবার মানিক বাবুর বই। অবশ্য এর আগে আমি তার পথের পাঁচালী দেখেছি ‘গুলিস্তান’ সিনেমাহলে। সেখানে অনিল চ্যাটার্জি, শৈলেন মুখোপাধ্যায় সবার সঙ্গে একে একে পরিচয় হলো, মানে ভালোই আলাপ হলো। পরে তো অনিল চ্যাটার্জির সঙ্গে আমার একটা সম্পর্কই হয়ে গেলো। এখনো তার কিছু চিঠি মনে হয় আছে আমার কাছে। গল্প করতে করতে সত্যজিৎ বাবু বললেন, ‘আপনি এতো দূর থেকে আসছেন, এখানে পাশেই নিউথিয়েটার্স স্টুডিও, আপনি ওখানে ঘুরে আসুন।’ আমি বললাম, ‘কেনো?’ উনি বললেন, ‘ওখানে সৌমিত্র আছে। সৌমিত্রের সঙ্গে আপনার পরিচয় হওয়া একান্ত দরকার বলে আমি মনে করি, সৌমিত্র ভালো লেখে।’
এরপর সত্যজিৎ বাবু একজনকে ডেকে বললেন, ‘এই, তুই যা তো ওকে নিয়ে, সৌমিত্রের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে আয়।’ যাওয়ার সময় উনি আবার আমাকে বিশেষ করে বললেন, আমি যেনো তার অভিযান সিনেমাটা অবশ্যই দেখি। তারপর ওই ছেলেটার সঙ্গে আমি গেলাম পাশের স্টুডিওতে। সত্যজিৎ বাবুর রেফারেন্সে গেছি তো, তাই সহজেই ঢুকে গেলাম। ওখানে তখন বিনিময় সিনেমার শুটিং হচ্ছিলো। পরিচালকের নামটা অবশ্য ভুলে গেছি, ইয়াঙ লোক আর কি। সত্যজিৎ বাবু পাঠিয়েছেন শুনে ওখানকার সবাই আমাকে অত্যন্ত ভালোভাবেই নিলো। তারপর জানাজানি হলো, পূর্ব বাংলা থেকে এসেছি, লেখালেখি করি।
প্রথমে ওরা আমাকে মূলত শুটিং দেখাতে ভিতরে নিয়ে গেলো। স্টুডিওর ভিতরে গিয়ে দেখি একটা বেডরুম তৈরি হয়েছে। সেখানে একজন মহিলা বসে আছেন। আমি অবশ্য তাকে দেখেই চিনতে পেরেছি; খুব ইয়াঙ মহিলা, শর্মিলা ঠাকুর। শর্মিলা ঠাকুর তখন সত্যজিৎ বাবুর অপুর সংসার করেই বেশ পরিচিত। নায়িকা শর্মিলা ময়ূরকণ্ঠী রঙের শাড়ি পরে বসে আছেন। পরে বুঝলাম ওটা ছিলো একটা বাসরঘরের দৃশ্য। জীবনে প্রথম সিনেমার শুটিং দেখা, বুঝতেই পারছো, আমি তো একেবারে ফ্যালফ্যাল করে শর্মিলা ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে আছি। সবকিছু দেখছি গোগ্রাসে। আর আমার অবস্থা দেখে শর্মিলা ঠাকুর মোচড় দিয়ে উঠেছেন, ‘না, আমি এখন শুটিং করবো না।’ আর শর্মিলারই বা দোষ কী, অল্প বয়স।
আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম, ওই যে বলে, যার মনে যে দুর্বলতা। কারণ ওখানে একমাত্র আউটসাইডার আমি, তার ওপর আবার অন্য দেশ থেকে আসছি। তাই আমি লজ্জা পেয়ে বাইরে চলে এলাম। সৌমিত্রের কতো অল্প বয়স তখন, এখন যখন টেলিভিশনে দেখি, মাঝে মাঝে ভাবি, আমার বয়সী তো উনি বা আমার থেকে হয়তো একটু বড়ো হবেন। এখন বার্ধক্যে, মোটা হয়ে গেছেন, গলার স্বর ভারি হয়ে গেছে। আর তখন ছিপছিপে পাতলা যুবক, অত্যন্ত সুন্দর চেহারা, কথাবার্তা মিষ্টি, হলুদ রঙের পাঞ্জাবি গায়ে দেওয়া। আমি তাকে বলেছিলাম, ‘হলুদ রঙের পাঞ্জাবি কেনো?’ উনি বললেন, ‘এটা ওই ক্যামেরার সামনে লাইটের অ্যাডজাস্টমেন্টের জন্য লাগে।’ এরপর আলাপ পরিচয় হলো, বেশ কিছুক্ষণ উনি আমার সঙ্গে কাটালেন। এর মধ্যে অসিতবরণ আসলেন, তার সঙ্গেও আলাপ পরিচয় হলো। এর পরেই এলেন উত্তমকুমার। আমি তো তাকে দেখেই চিনে ফেললাম। সৌমিত্র তার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। উত্তমকুমারকে দেখে আমি কী বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি প্রথমেই একেবারে আকাট মূর্খের মতো বলে বসলাম, ‘আচ্ছা আপনি পাঞ্জাবি কাটান কোথা থেকে? বলুন তো আপনার দর্জি কে?’
এর অবশ্য কারণও আছে, সেই অধ্যাপনার শুরু থেকেই আমি পাঞ্জাবি পরি, অন্য কোনো পোশাক পরি না। এবং এই পোশাকটির ব্যাপারে, মানে এর ডিজাইন, কাট—এসব নিয়ে আমি খুবই সচেতন, যদিও সাদা পাঞ্জাবি পরি, তখন সাদা খদ্দরই পরতাম বেশি। তাই পাঞ্জাবি নিয়ে আমার একটা আগ্রহ ছিলো।
আমার প্রশ্ন শুনে সহাস্যে উত্তমকুমারও বললেন, ‘কেনো বলুন তো আপনি আমার পাঞ্জাবির কথা জিজ্ঞেস করছেন?’ আমি বললাম, ‘না, মানে আমার জানার আগ্রহ—আপনি সিনেমায় যে ডিজাইনের পাঞ্জাবি পরে অভিনয় করেন, সেগুলো কোথায় কাটান?’ আমি একেবারে ছেলেমানুষের মতো এসব কথা তাকে বলছি। উনি বললেন, ‘দেখুন আমার তো একেক সিনেমায় একেক ধরনের পাঞ্জাবির ডিজাইন, সেটাও হয় আমার পরিচালক মশাই যা বলেন সেভাবেই; তার পরও আপনি ঠিক কোন্ সিনেমাটার কথা বলছেন?’
আমি বললাম, শিল্পী সিনেমায় আপনি যে পাঞ্জাবিটা পরেছিলেন। শিল্পী অবশ্য তখন মুক্তি পাওয়া বেশিদিন হয়নি। উত্তম বাবু এটা শুনে হো হো করে হেসে দিলেন। আর বললেন, ও শিল্পী সিনেমার পাঞ্জাবি! এরপর কাকে যেনো ডেকে বললেন, ‘দেখুন তো পূর্ব বাংলার কবি কী বলেন!’ আমি কিন্তু তার হাসি দেখে কাত হয়ে গেছি। আমার অবস্থা তখন সত্যি ভয়ঙ্কর শোচনীয়। কারণ সে হাসির কোনো তুলনা আমি দিতে পারবো না, যদিও এতো কবিতা লিখি-টিখি। তার চোখে, কপালে, দুই গালে, সে যে কী একটা আলোর খেলা, এক কথায় অপূর্ব আর কি। তার মানে আমি প্রায় চেতন হারাই। পরে ভেবেছি, কোনো মহিলা তার এই রূপ সহ্য করবে কীভাবে! এতো সুন্দর, এতো জ্যোতির্ময়! উত্তম বাবু বললেন, ‘আমার একজন দর্জি আছে খুব প্রিয়, আপনি পাঞ্জাবি করবেন?’ আমি বললাম, অবশ্যই করবো। তারপর উনি আমাকে সময় দিলেন, ঠিক মনে নেই, একদিন না দুদিন পর। বললেন, সকাল ১০টার দিকে আপনি চলে আসুন। আমি নির্ধারিত দিনে খুব উত্তেজনা নিয়ে সেখানে গেলাম। উনি ঠিক যে দোকানের কথা বলে দিয়েছিলেন। আমি গিয়ে ওর ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর উত্তমকুমার আসলেন। এটা আমার কাছে এখনো স্বপ্নের মতো মনে হয়, কারণ এতো বড়ো নায়ক, তিনি শুধু পাঞ্জাবি বানিয়ে দেওয়ার জন্য চলে এসেছেন!
তারপর উনি আমাকে নিয়ে সেই দোকানে ঢুকলেন। সেখানে একজন প্রায় বৃদ্ধ লোক চোখে রোলগোল্ডের ফ্রেমের চশমা পরে কুঁজো হয়ে কাপড় কাটছেন। উনি তাকে লক্ষ্য করে বললেন, নামটা ঠিক মনে নেই, কুঞ্জ বাবু যতোদূর সম্ভব। ‘কুঞ্জ দা দেখো কাকে নিয়ে এসেছি, ইনি ওই বাংলার কবি, তুমি এর জন্য পাঞ্জাবি কেটে দেবে তো?’
কুঞ্জ বাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, দেবো না কেনো, তুমি বললে তো দেবোই।’ এরপর উত্তমকুমার বললেন, ‘আচ্ছা আচ্ছা, আমি তাহলে আসছি।’ উনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন এবং দোকান থেকে দুটো পাঞ্জাবির কাপড় কিনলেন। আমার তো তখন পাঞ্জাবিতে লাগতো তিন গজ বারো গিরের মতো, কারণ ঢোলা লম্বা পাঞ্জাবি। তখন কলকাতায় সবচেয়ে ভালো নামকরা আদ্দি হচ্ছে শাহাজাদা আদ্দি, সাদা রঙের সেটাই উনি দুটো কিনলেন। কিন্তু মুশকিল হলো, আমার একটু নীতিবাগীশতা আছে, টাকা দেওয়ার জন্য বেশ জোরাজুরি করলাম, কিন্তু উনি কিছুতেই রাজি হলেন না। উল্টো তিনি বললেন, ‘এটা আমি আপনাকে উপহার দিচ্ছি।’ তারপর তিনি সেই কাপড় এনে দর্জিকে দিলেন এবং বললেন, ‘তুমি আর্জেন্ট এটা করে দাও।’ তারপর সেখানে সেলাইয়ের টাকাও দিয়ে দিলেন।
এটা ছিলো একেবারেই সত্যিকারের উপহার, ভালোবাসা থেকে। এই গল্পটা আমি এখানেই শেষ করবো, আমার ট্র্যাজেডিটা উল্লেখ করে। এই পাঞ্জাবি আমি তখন মাঝে মাঝেই পরতাম, আবার যত্ন করে রেখে দিতাম আমার বাসার স্যুটকেসে। কিন্তু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যে চাপটা এলো, তখন বাগেরহাটে আমার বাসা ছেড়ে বড়ো নৌকোয় নদী পেরিয়ে গ্রামের বাড়িতে পালিয়ে যাই। যাবার সময় বই সব বাসায় পড়ে থাকলো, কিছুই নেওয়া সম্ভব হলো না, অদৃষ্টের ওপর নির্ভর করে চলে গেলাম।
ঘটনা হচ্ছে যে, আমার সঙ্গে তখন হাসান আজিজুল হক এবং তার বড়ো বোন জাহানারা নওশীন মানে জানু, ও ছিলো আমার ছেলেবেলার বর্ধমানের বান্ধবী, ওরা খুলনা থেকে রিকশায় করে পালিয়ে এসেছে বাগেরহাটে আমার বাসায়। খুলনায় তখন মোটামুটি হিন্দু কিলিং শুরু হয়ে গেছে। ওরা ভয়ে চলে এসেছে। ওই দুই পরিবার ও আমরা (আমার পরিবার বলতে তখন কেবল বড়ো মেয়েটি হয়েছে, মানে বিদিশা) মানে মোট তিন পরিবার মিলে, আমরা নদী পেরিয়ে ওপারে গ্রামে গেলাম। পরে ওরা, মানে হাসানরা পরিবেশ-পরিস্থিতির খোঁজখবর নিয়ে এপ্রিল মাসে চলে গেলো দৌলতপুরে ওদের নিজেদের বাসায়, আমি থাকলাম গ্রামে। কিন্তু কিছুদিন পর দেখলাম সেখানে থাকা নিরাপদ নয়। তারপর আমি আমার শ্বশুরবাড়ি ও মামাবাড়ি, একই গ্রামে মানে গোটাপাড়ায় চলে গেলাম। ও আর একটা কথা, এই গ্রামে মামাবাড়িতেই অবশ্য আমার জন্ম।
আমার বাবা গ্রামের বাড়িই থেকে গেলেন। আমি, আমার বউ আর বিদিশা—আমরা চলে গেলাম গোটাপাড়ায়, গ্রামের পিছনের চোরাই পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে, সেটা খুব কষ্টের ছিলো সেসময়। এরপর একদিন শুনলাম বাগেরহাট শহরে মিলিটারি ঢুকেছে, একেবারে দিনের বেলায়। ওরা এসেই স্থানীয় বিহারিদের সহযোগিতায় গুলি, আগুন দেওয়া শুরু করে দিলো। তখন যতোখানি মনে পড়ে শান্তি কমিটি কেবল গঠন হয়েছে।
তো মিলিটারি চলে যাওয়ার পরের দিন আমি আমার ছোটো মামাকে সঙ্গে নিয়ে বাগেরহাট ছুটলাম পাগলের মতো। যে বাগেরহাট শহর থেকে আমি পালিয়ে এসেছি, সেখানে। অবশ্য কারণ ছিলো পালিয়ে আসার। আমরা তখন স্বাধীনতার জন্য লড়াকু কর্মী। ঠিক মনে নেই, ২৩ মার্চ আমরা বাগেরহাট টাউন স্কুলের মাঠে স্বাধীনতার জন্য অনুষ্ঠান করেছিলাম বিরাট করে। সেখানে আমি তাৎক্ষণিকভাবে একটা একাঙ্কিকা লিখেছিলাম ‘বিপ্লবের দুর্গমাটি বাংলা’ নাম দিয়ে। তাৎক্ষণিক অভিনয়ও করিয়েছিলাম আমরা।
সেই সময় বাগেরহাট সদর থানার ওসি ছিলেন আলতাফ হোসেন। তার দেশের বাড়ি ছিলো গোপালগঞ্জের মকসুদপুরে। তিনি কঠোর শেখ মুজিবপন্থি আওয়ামী লীগার ছিলেন। মোটরসাইকেলে চলাফেরা করতেন। অনুষ্ঠানের পরদিন রাতের বেলা আমাকে এসে তিনি খবর দিয়ে গেলেন, ‘স্যার, আপনি কাল-পরশুর মধ্যে বাসা ছেড়ে চলে যান।’ আমি বললাম, ‘কেনো?’ উনি বললেন, ‘আপনার ওই নাটকের বিষয় নিয়ে অফিসারদের মধ্যে খুব কথা হচ্ছে। যেকোনো সময় ওরা কিন্তু আপনাকে গ্রেফতার করতে পারে। তাই আপনি বাসা ছেড়ে চলে যান।’ আমি মূলত ওই শুনেই (হাসান ও ওর বোনসহ) গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছিলাম।
ও, যে কথা বলছিলাম, মামাকে নিয়ে আমি তখন হেঁটে নৌকোয় বাগেরহাটে যাচ্ছি। তবে বাগেরহাট শহরে না গেলেও চলবে। কারণ আমি তখন বাগেরহাটের পশ্চিমে দশানি গ্রামে। ওখানে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্বশুরবাড়ি, মানে মীনাক্ষীর বাবার বাড়ি। দশানি এলাম মূলত আমাদের বাগেরহাট কলেজের অ্যাকাউন্ট্যান্ট আজাদ সাহেবের বাড়িতে। উনি সেখানে নতুন বাড়ি করেছেন। ওই বাড়ির পাটাতনের উপরে একটা ট্রাঙ্কের ভিতরে আমার যাবতীয় মার্কসবাদী গোপন ডকুমেন্ট, লিটারেচার, বইপুস্তক সব রেখে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আজাদ সাহেবের ওখানে আমার বইয়ের কোনো বিপদ হবে না। কিন্তু পরিস্থিতি খারাপ দেখে আমি বইয়ের টানে ছুটে আসি। আমার এতো কষ্টের এতো দুর্লভ সব সংগ্রহের কী অবস্থা তা দেখার জন্য। এসে দেখি, আজাদ সাহেব নেই। তিনিও দেশের বাড়ি চলে গেছেন। বাড়ির চাবি সন্তোষ নামে এক প্রতিবেশীর কাছে রেখে গেছেন। তো ওরা আমাকে দরজা খুলে দিলো। তারপর পাটাতনে উঠে দেখি, না, বই সব ঠিকঠাক আছে।
সেদিন ফেরার পথে আমরা শহরের প্রধান রাস্তা হয়ে আসছিলাম। যদিও ছোটো মামা রাজি হচ্ছিলো না। উনি বার বার বলছিলেন, আমি খুব ঝুঁকি নিচ্ছি, যেকোনো সময় বিপদ হতে পারে। কিন্তু আমার বাসা হচ্ছে কলেজ রোডে, আমি বললাম, ‘না, বাসায় যেতে হবে।’ বাসার সামনে গিয়ে ওনাকে মাঠে দাঁড় করিয়ে রেখে, আমি উঠলাম সিঁড়ি দিয়ে, দেখি বাসার দরজা খোলা। সিঁড়ির উপরে আমার বেশ কয়েকটা বই ছেঁড়া, খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। আমার কলিজায় ঘা লাগলো, কারণ বই ছিলো আমার জীবনের আসল আকর্ষণ। তারপর গেলাম ঘরের মধ্যে, সেখানে সব কিছু ছড়ানো-ছিটানো। পরে একটু খোঁজ নিয়ে জানলাম যে, আশেপাশের অনেকে যারা লুটপাট করেছে হিন্দুদের, সেগুলো এনে এনে আমার এখানে রেখেছিলো।
এই মুহূর্তে আমার খেয়াল হলো, সঙ্গে সঙ্গে আমি খাটের তলা থেকে ট্রাঙ্ক, স্যুটকেস এগুলো টেনে বের করি। ট্রাঙ্ক হাতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি, ঠিক কী অবস্থা। আমি পুরোপুরি আঁতকে উঠলাম কষ্টে, কারণ উত্তমকুমার যে পাঞ্জাবি দুটো দিয়েছিলেন তা নেই। কাপড়চোপড়ের সঙ্গে ওই পাঞ্জাবি দুটোও নিয়ে গেছে। কী যে শোক আমার, এটা বোঝাতে পারবো না। ওই পাঞ্জাবি পাওয়ার পর থেকে আমি তো ঘরে দর্জি ডেকে নতুন পাঞ্জাবি বানাতাম ওই ডিজাইনে।
তবে আরো দুটো পাঞ্জাবি ছিলো সে দুটো নেয়নি। ওই পাঞ্জাবি দুটোও খুব স্মৃতিময়। আমি সেসময় কলকাতায় এক সাহিত্য অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। তখন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। অনুষ্ঠানটা ছিলো কথাসাহিত্যিক রমেশচন্দ্র সেনের জন্মশতবার্ষিকী। সে অনুষ্ঠানে অন্নদাশংকর রায় ছিলেন সভাপতি। আর প্রধান ছিলেন মার্কসবাদী তাত্ত্বিক হীরেন মুখোপাধ্যায় ও আমি। সেই সময় জ্যোতি বসুর সঙ্গে আমার একটা সংযোগ হয়। তিনি আমাকে চা খাওয়ান। চা খেতে খেতে জ্যোতি বাবুর গায়ের পাঞ্জাবি দেখে আমি বেশ আগ্রহী হই। কেননা আমার তো ওই দিকেই ঝোঁক।
জ্যোতি বসু বললেন, ‘কী, আমার চেয়ে দেখি আমার পাঞ্জাবির প্রতি আপনার বেশি ঝোঁক!’ আমি বললাম, আপনার এই কাপড়টা কী? উনি বললেন, ‘এটাও খদ্দর, আজকাল তো এসব উঠে গেছে, এখন তো সব রঙিন। আপনার ভালো লাগছে?’ আমি একটু সঙ্কোচ নিয়েই বললাম, হ্যাঁ। তখন উনি তার একজন সহচরকে বললেন, তুমি ওকে নিয়ে কালকে যাও কলেজ স্কোয়ারে অমুক দর্জির দোকানে। তাকে গিয়ে আমার কথা বলে পাঞ্জাবি বানিয়ে দিতে বলো। আমি পরদিন সেখানে গিয়ে ঠিক ওই ধরনের খদ্দর পেয়ে দুটো পাঞ্জাবি বানালাম।
এরপর থেকে আমি কলকাতায় গেলেই খদ্দরের পাঞ্জাবি ওখান থেকে বানিয়ে নিয়ে আসতাম। কারণ এখানে আমাদের দর্জিরা আমার মন মতো ডিজাইনের পাঞ্জাবি কাটতে পারতো না। তো ট্র্রাঙ্কের মধ্যে জ্যোতি বসুর দেয়া পাঞ্জাবি দুটো দেখলাম আছে। এখনো আমার আলমারিতে ওই দুটো পাঞ্জাবি আছে।
আবার কলকাতার কথায় আসি, আমার সঙ্গে পরে অনিল চ্যাটার্জির সম্পর্কটা বেশ স্থায়ী হয়েছিলো। দুজনে চিঠিপত্র দেয়া-নেয়া করতাম। অনিল চ্যাটার্জি তো পরে বিখ্যাত অভিনেতা হন। পরে যখন আমি কলকাতায় গিয়েছি কোনো অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে, তখন অনিল চ্যাটার্জি তার বাড়িতে আমাকে নিয়ে যান।
আমি কিন্তু মহানগর-এর শুটিং তার পরের দিনও গিয়ে দেখেছিলাম। সত্যজিৎ বাবু আমায় বলেছিলেন, ‘কালকে আসুন, লেখক নরেন্দ্র মিত্র আসবেন। আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো।’ পরের দিন সেটে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা হয়। পরে কেনো জানি আমার মনে হয়েছিলো, নরেন্দ্রনাথ মিত্রকে না দেখাই ভালো ছিলো। তার সেই বিখ্যাত ‘রস’ গল্পের পাঠক আমি। সাদা ধুতি, সাদা পাঞ্জাবি; গায়ের রঙ ঘোর কালো না হলেও শ্যামলা। শরীরের গঠন একটু থলথলে মোটা টাইপের। কেমন জানি মনে ধরলো না, তবে আলাপ পরিচয় হলো আর কি। ভুঁড়ির সঙ্গে ঠেসে রাখা একটা পেটমোটা কালো অ্যাটাচি ব্যাগ!
এসব গল্প আর এতো বাড়িয়ে লাভ নেই। আমি সিনেমার এতো পাগল আর পোকা যে জীবনে বহু বই দেখেছি। মানে সেই হিন্দি সিনেমার আদি যুগে নায়ক ছিলেন মতিলাল, নায়িকা খুরশীদ—এখন অনেকে এদের নাম স্মরণই করতে পারবে না। আমি সেই যুগ থেকেই সিনেমা দেখে আসছি।
বাংলাদেশের জহির রায়হানকে নিয়ে আমার স্মৃতি আছে। আমরা একসঙ্গে পড়তাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি ক্লাসে খুব অনিয়মিত ছিলেন। আমাদের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন হাই সাহেব, বিখ্যাত ধ্বনিতত্ত্ববিদ। হাই সাহেবের বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ার দিকে; খুব ভদ্র, শালীন; নরমভাবে কথা বলতেন। একদিন ক্লাসে জহির রায়হান আমার সামনেই বসেছিলেন। জহিরের দিকে চোখ পড়তেই হাই সাহেব বললেন, ‘তুমি আমার ক্লাসের? তোমাকে তো দেখিই না ক্লাস করতে।’
তিনি আরো বললেন, ‘হতে পারে যে, তুমি এই সাবজেক্টটা ভালোই জানো। তুমি যদি ভালো বোঝো জানো, তাহলে তো তোমার আসারই দরকার নেই ক্লাসে। আবার এমনও হতে পারে, হয়তো এ সাবজেক্টটা তোমার ভালো লাগে না, মাথায় ঢোকে না; সেজন্য আসো না। তাহলেও তো তোমার আসার দরকার নেই ক্লাসে।’ বেশ তিরস্কার করলেন, কিন্তু জহির রায়হানকে দেখলাম চুপচাপ একেবারে। উনি অবশ্য কখনোই ক্লাসে এসে খুব একটা কথা বলতেন না। কেবল সিলেক্টেড দু-একজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন।
আর মনে আছে, সেসময় জহরত আরা ইউনিভার্সিটিতে পড়তেন, মেয়েদের হলেই থাকতেন। ছেলেরা তাকে নিয়ে বেশ হইহুল্লোড় করতো। জহরত আরা সদা হাস্যমুখ, গল্পগুজব করতেন, চঞ্চল ছিলেন খুব। জহরত আরার নাম করছি এই কারণে যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সিনেমা মুখ ও মুখোশ-এর নায়িকা ছিলেন তিনি।
একটা যুগ আসলেই শেষ হয়ে গেছে। সেই ৫০—৬০-এর দশক, সেই হেমন্ত মুখার্জি; একসঙ্গে এলেন সব-ধনঞ্জয়, মান্না দে, মানবেন্দ্র, শ্যামল মিত্র, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়—ওই ধারা ওই যুগ শেষ হয়ে গেছে। আমি সৌভাগ্যবান এদের মধ্যে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিলো ১৯৮৪ সালে কলকাতায়। সেদিন ‘আকাশবাণী’তে আমার একটা সাক্ষাৎকার ছিলো, খুব বিখ্যাত কবি কবিতা সিংহ তখন রেডিওতে চাকরি করতেন, সাক্ষাৎকারটা উনি নিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারের বিষয়টা ছিলো, কবি বিষ্ণু দে’র সঙ্গে আমার যে গভীর সম্পর্ক তাই নিয়ে। যাই হোক সেখানেই স্টুডিওতে এক ভদ্রলোক ও এক ভদ্রমহিলা এসেছেন, কবিতা সিংহ আমায় তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি তো একেবারে নাম শুনেই চমকে উঠেছি। আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে উনি তার নিজের মাথায় হাত দিয়েছেন। তারপর একটু আক্ষেপ করে বললেন, ‘আর নেই, সব চলে গেছে!’ আমি প্রথমে বুঝিনি, পরে বুঝলাম, উনি মনে করেছেন, তার এতো সুন্দর চুলগুলো ছিলো, সব উঠে গেছে, তাই হয়তো আমি আরো আশ্চর্য হয়েছি। তিনি হচ্ছেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, বিখ্যাত সেই গান ‘জীবনে যদি দীপ জ্বালাতে নাহি পারো’-এ রকম আরো অনেক গানের শিল্পী। আর তার সঙ্গে ছিলেন উৎপলা সেন।
যাক সেসব কথা। বাংলাদেশ বলো আর কলকাতা বলো, বাংলা সিনেমার যে গৌরবময় সময় তা বুঝি শেষ হয়ে গেলো নতুন যুগ এসে। তখন কী সব নায়ক-নায়িকা, কাহিনি ছিলো! আর এখন! বিশেষ করে কলকাতার সিনেমাই তো আমাদের এখানে খুব বেশি ফলো করা হতো, এখন সেই কলকাতার সিনেমা তো একেবারে পঁচে গেছে, দেখার মতো নয়। এখন এই দেব-টেব ইত্যাদি, লাফালাফি, চেঁচামেচি ইত্যাদি, গল্প-প্লট কিছুই তো নেই; গানও তা-ই। এখন তা আমার আর ভালো লাগে না। অনেকে বলতে পারেন আউটডেটেড, সেটা হতে পারে। তবে আমার কথা হলো, এটা আদৌ কোনো শিল্প নয়, কোনো গভীরতা নেই, বক্তব্য নেই।
(২০১৪ সালে আবুবকর সিদ্দিক খুলনার মুন্সিপাড়ায় তার বাসায় ম্যাজিক লন্ঠনের সঙ্গে সিনেমা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একাধিক দিন স্মৃতিচারণ করেন। সেই স্মৃতিচারণ থেকে এ লেখাটি অনুলিখন করা হয়েছে। )
লেখক : আবুবকর সিদ্দিক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, গীতিকবি। জন্ম ১৯৩৪ সালের ১৯ আগস্ট বাগেরহাটের গোটাপাড়া মাতুলালয়ে। ‘ধবল দুধের স্বরগ্রাম, ‘বিনিদ্র কালের ভেলা’, ‘হে লোকসভ্যতা’, ‘হেমন্তের সোনালতা’, ‘কালো কালো মেহনতি পাখি’, ‘কঙ্কালের অলঙ্কার দিয়ো’, ‘শ্যামল যাযাবর’ তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। লিখেছেন ‘জলরাক্ষস’, ‘খরাদাহ’, ‘একাত্তরের হৃদয়ভস্ম’, ‘বারুদপোড়া প্রহর’ নামে চারটি উপন্যাস। গল্পের মধ্যে ‘ভূমিহীন দেশ’, ‘চরবিনাশকাল’, ‘মরে বাঁচার স্বাধীনতা, ‘কুয়ো থেকে বেরিয়ে’, ‘ছায়াপ্রধান অঘ্রান’, ‘কান্নাদাসী’, ‘হংসভাসীর তীরে’, ‘কালোকুম্ভীর’, ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ ও ‘গল্পসমগ্র’ উল্লেখযোগ্য। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, বাংলাদেশ কথাশিল্পী সংসদ পুরস্কার, ঋষিজ পদকসহ নানা সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জানুয়ারির ম্যাজিক লণ্ঠনের অষ্টম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন