নাজমুল ইসলাম
প্রকাশিত ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
কাফা, মতাদর্শিক দ্বন্দ্বে বিভক্ত মানুষের স্বপ্ন-কারখানা
নাজমুল ইসলাম

কোরিয়ার নিজস্ব চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিলো চলচ্চিত্রের জন্মের তিন দশকের মাথায়; যখন এটি শিল্প (art) হিসেবে স্বীকৃতির পথে। ১৯১৯ সালে চলচ্চিত্রনির্মাতা কিম দু সান নির্মাণ করেছিলেন অ্যা ডিটেক্টিভস গ্রেট পেইন। নির্বাক এ চলচ্চিত্র দিয়ে যাত্রা শুরুর পর কোরিয়ার চলচ্চিত্র নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আগেই তাকে আঘাত করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ; জাপানের উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা পেলেও বিভক্ত হয়ে যায় কোরিয়া। ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্টের পর তাই সঙ্গত কারণেই পৃথক হয় কোরিয়ার চলচ্চিত্র অঙ্গনও। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, বিদেশি চলচ্চিত্রের আগ্রাসন আর বিনিয়োগের অভাবে কোরিয়ান চলচ্চিত্র তখন প্রায় কোণঠাসা।
মতাদর্শিক ভিন্নতা আর বৈরিতার ঘেরাটোপে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্র বেড়ে উঠতে থাকে অসমভাবে। এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্র উন্নয়নকল্পে ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘কোরিয়ান মোশন পিকচার প্রোমোশন করপোরেশন’ (কে এম পি পি সি)। কিন্তু রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আর কঠোর সেন্সরশিপের কারণে ঠিক দাঁড়াতে পারছিলো না দেশটির চলচ্চিত্রশিল্প। আধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত চলচ্চিত্র-নির্মাণ সামগ্রীর যেমন অভাব ছিলো, তার চেয়ে বেশি ছিলো দক্ষ ও অভিজ্ঞ মানুষের অভাব। ততোদিনে বিশ্বচলচ্চিত্রের জন্য আনুষ্ঠানিক পড়াশোনার ক্ষেত্র তৈরি হলেও কোরিয়ায় তার প্রভাব তেমনভাবে ছিলো না। তাই চলচ্চিত্র ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ, দক্ষ ও পেশাদার মানুষ তৈরির উদ্দেশ্যে ১৯৮৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় কে এম পি পি সি’র অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে ‘কোরিয়ান অ্যাকাডেমি অব ফিল্ম আর্টস’, সংক্ষেপে কাফা (KAFA)।
বর্তমান বিশ্বের অন্যতম এই চলচ্চিত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি শুধু কোরিয়ান চলচ্চিত্রেই সুফল বয়ে আনেনি, সঙ্গে তা বিশ্ব-চলচ্চিত্রের উৎকর্ষ সাধনেও নিবেদিত। চলচ্চিত্র বিষয়ে আগ্রহী স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে চলচ্চিত্র শিক্ষায় এটি পরিণত হয়েছে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানে। আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সুবিধা সম্বলিত এ প্রতিষ্ঠানে দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের পরিচর্যায় শিক্ষার্থীরা চলচ্চিত্রের জ্ঞান অর্জন করে। সাধারণ শিক্ষাসূচির পাশাপাশি কাফা চলচ্চিত্র বিষয়ক বিভিন্ন কর্মশালা, সম্মেলন ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে নানা কর্মসূচি পালন করে। দক্ষিণ কোরিয়ার বর্তমান চলচ্চিত্রশিল্পের অনেক কাণ্ডারি কাফার স্নাতক। এবারের আলোচনা এই কাফাকে নিয়েই।
ইতিহাসের পুনর্পাঠ
১৮৯৭ সালে এক চাইনিজের কাছ থেকে ধার করে কোরিয়ার ভূখণ্ডে প্রথম চলমান চিত্র প্রদর্শন করেছিলো ‘মোশন পিকচার’। আর দেশটিতে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন আমেরিকান পরিব্রাজক বার্টন হোমস (Burton Holmes) এবং তা তিনি ১৮৯৯ সালে রাজপরিবারকে দেখিয়েছিলেন। জন্মের অল্প সময়ের মধ্যে চলচ্চিত্র কোরিয়ার ভূমিকে স্পর্শ করলেও নিজস্ব চলচ্চিত্র হতে সময় নিয়েছে দীর্ঘদিন। তবে ১৯০৩ সালেই স্থাপন করা হয়েছিলো কোরিয়ার প্রথম মুভি থিয়েটার ‘দংদায়েমান মোশন পিকচার স্টুডিও’। শুরুটা হয়তো আরো ভালোভাবে এগিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু ১৯১০ সালে দেশটি জাপানের উপনিবেশে চলে গেলে নিজস্ব চলচ্চিত্রের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসে। ঔপনিবেশিক জাপান অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো চলচ্চিত্র দিয়েও শোষণ করতে থাকে কোরিয়াকে। পরিস্থিতি এমন হয়, যে চলচ্চিত্রগুলো কোরিয়াতে দেখানো হতো—জাপান সরকার তা বিশেষভাবে সেন্সর করতো। মূলত এসব চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ঔপনিবেশিকতাকে বৈধ করার প্রচারণা চালাতো জাপান। এমনকি ১৯১৯ সালে কোরিয়ার নিজের চলচ্চিত্র অ্যা ডিটেক্টিভস গ্রেট পেইন নির্মাণের পর জাপান সরকার তা নিজেদের সেন্সরের আওতায় নিয়ে আসে। সেন্সরের প্রকোপ এতটাই ছিলো যে, জাপানের উপনিবেশ থেকে মুক্ত (১৯৪৫ সাল) হওয়ার আগ পর্যন্ত বছরে মাত্র দুই-তিনটি চলচ্চিত্র নির্মাণ হতো কোরিয়ায়।
এছাড়া নির্বাক চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে জাপানি বেনশি’দের (নির্বাক চলচ্চিত্রে এরা ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করতো) প্রাধান্যও ছিলো অনেক বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র-নির্মাণের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রধান শিল্পীদের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ বেনশিদের দিতে হতো। ১৯৩৫ সালে লে মিয়ং-উ (Le Myeong-woo) চুংইয়ং-জিয়ন (Chunhyang-jeon) নামে প্রথম সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। চলচ্চিত্রটির শব্দের মান খারাপ হলেও নিজের ভাষার চলচ্চিত্রকে স্বাগত জানিয়েছিলো কোরিয়ার সাধারণ দর্শক। কিন্তু ঔপনিবেশিক জাপান সরকার চলচ্চিত্রের জন্য কোরিয়ার ভাষাকে নিষিদ্ধ করে। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কোরিয়ার প্রায় সব চলচ্চিত্রেই জাপানের সেনাবাহিনী ও ঔপনিবেশিক সরকারের গুণকীর্তন করতে হতো; তাছাড়া সেন্সরে অনুমোদন দেওয়া হতো না।
দীর্ঘ উপনিবেশের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে জাপান পরাজিত হলে কোরিয়া দুই বিশ্বশক্তির মতাদর্শে ভাগ হয়ে যায়। দক্ষিণ কোরিয়া চলে যায় যুক্তরাষ্ট্রের হাতে আর উত্তর কোরিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে। কিন্তু দুই কোরিয়াই একে অন্যের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য দাবি করে। ফলে ১৯৫০ সালে শুরু হয় দুই কোরিয়ার যুদ্ধ। দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তর কোরিয়ার পক্ষে চিন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন অবস্থান নেয়। যুদ্ধের সময় কোরিয়ায় চলচ্চিত্র-নির্মাণ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। যে গুটিকয়েক চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছিলো তার মধ্যে চই ইন-গিয়ো’র (Choi In-gyu) ভিভা ফ্রিডম (Viva Freedom) উল্লেখযোগ্য। দক্ষিণ কোরিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ হয়। অবশেষে ১৯৫৩ সালে দুই কোরিয়ার যুদ্ধাবসানে চুক্তি হয়; দীর্ঘ বিরতির পর ২০০৭ সালে এসে সেই চুক্তি স্থায়ী শান্তিচুক্তিতে রূপ নেয়। তবে এর আগে ২০০৫ সালে প্রথমবারের মতো উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া যৌথভাবে ইমপ্রেস চাং নামে একটি অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র নির্মাণ করে। চলচ্চিত্রটি প্রথমবারের মতো দুই কোরিয়ায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তি পায়।
যুদ্ধবিরতির পর ১৯৫৩ সালে চলচ্চিত্রের উন্নয়নকল্পে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি সিংম্যান রি (Syngman Rhee) চলচ্চিত্রের ওপর আরোপিত উচ্চমাত্রার কর রহিত করেন। যা মৃতপ্রায় চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে অক্সিজেন হিসেবে কাজ করে; পূর্ণ উদ্যমে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়। ১৯৫০ সালে যেখানে দেশটিতে চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় মাত্র পাঁচটি, ১৯৫৯ সালে এসে এর সংখ্যা দাঁড়ায় একশো ১১টিতে। কিন্তু সুসময় বেশিদিন দীর্ঘ হয়নি, রি’র পরে ১৯৬২ সালে পার্ক চুং হি (Park Chung Hee) ক্ষমতায় এসেই পুরো চলচ্চিত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন। তিনি পরের বছরই ‘মোশন পিকচার ল’ জারির মাধ্যমে কঠোর সেন্সর আরোপ করেন। সরকার বিরোধী বা কমিউনিস্ট ভাবধারার চলচ্চিত্রগুলো সেন্সরে নিষিদ্ধ হতে থাকে একে একে। এবং ঔপনিবেশিক সরকারের মতোই তারা সরকারের প্রচারণায় ব্যবহার করতে থাকে চলচ্চিত্রকে। ফলে এক বছরের মধ্যেই চলচ্চিত্রের সংখ্যা ৭১ থেকে নেমে আসে ১৬টিতে।
৭০ দশকের মাঝামাঝি সরকারি নিয়ন্ত্রণ এতটাই বেড়ে গিয়েছিলো যে, কোরিয়ার চলচ্চিত্রশিল্প প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। মূলত মার্কিন সমর্থিত চুং হি সরকার ভয় পেতো—কমিউনিস্ট ধারার চলচ্চিত্রগুলো তাদের ক্ষতি করবে এবং সরকার পতনের দিকে ঠেলে দিবে। এ সময় তারা কেবল সেসব চলচ্চিত্রকে সেন্সরে ছাড় দিতো যেগুলো হি সরকারের প্রশংসা করতো। ১৯৮১ সালে ‘আন্তর্জাতিক ফিল্ম গাইড’ দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্র সম্পর্কে বলে, ‘পৃথিবীর কোনো দেশেই দক্ষিণ কোরিয়ার মতো কঠোর চলচ্চিত্র সেন্সর নেই।’১
১৯৭৩ সালের এপ্রিলে ‘কোরিয়ান মোশন পিকচার প্রোমোশন করপোরেশন’ স্থাপন করে হি সরকার। কোরিয়ার জাতীয় চলচ্চিত্র উন্নয়নের নামে প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করা হলেও মূলত এর কাজ ছিলো চলচ্চিত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে ‘রাজনৈতিকভাবে সঠিক’ চলচ্চিত্র-নির্মাণ নিশ্চিত করা। চলচ্চিত্রশিল্পের এই কঠোর নিয়ন্ত্রণের ইতি ঘটে ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট পার্ক চুং হি আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে। এ সময় দক্ষিণ কোরিয়ায় চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করে। তবে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে খুব বেশি সময় লাগেনি। ৮০ দশকের শুরুতেই চলচ্চিত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হতে থাকে। ১৯৮১ সালেই ইম কুয়ং টাক-এর (Im Kwon-taek) মানদালা চলচ্চিত্রটি হাওয়াই চলচ্চিত্র উৎসবে গ্রান্ড পিক্স জিতে। মূলত এটাই ছিলো দক্ষিণ কোরিয়ার কোনো চলচ্চিত্রের প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।
হি’র স্থলাভিষিক্ত প্রেসিডেন্ট রোহ তিই-উ (Roh Tae-woo) ধীরে ধীরে চলচ্চিত্রের ওপর থেকে সব ধরনের বিধিনিষেধ তুলে নিতে থাকেন। কে এম পি পি সি এবার সত্যি সত্যিই দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্র উন্নয়নে কাজ করতে থাকে। এর অন্যতম পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় দেশটির প্রথম চলচ্চিত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘কোরিয়ান অ্যাকাডেমি অব ফিল্ম আর্টস’ (কাফা)। ফলে ১৯৮৮ সালের মধ্যেই সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়নির্ভর চলচ্চিত্র-নির্মাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে তখনো সরাসরি সরকারবিরোধী চলচ্চিত্র-নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ করা হতো। তার পরও দক্ষিণ কোরিয়ার মৃতপ্রায় চলচ্চিত্রকে জাগিয়ে তোলা এবং চলচ্চিত্র শিক্ষার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার লক্ষ্য নিয়ে যে কাফা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, তা আজ পূর্ণতা পেয়েছে।
কাফা, এক আলোকবর্তিকার নাম
এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, কোরিয়ার বর্তমান চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নয়নে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের অধিকাংশই কাফা থেকে স্নাতক। নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে তারা কোরিয়ান চলচ্চিত্রকে প্রতিদিন বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। ২০১৩ সালে কাফা ধুমধাম করে ৩০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান করলেও শুরুটা কিন্তু এতো জাঁকজমক ছিলো না। প্রতিষ্ঠার বছরে পরিচালনা আর সিনেমাটোগ্রাফি নামে মাত্র দুটি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করে কাফা। তখন এখানে দেড় বছরের কোর্স করানো হতো। দীর্ঘদিন পর্যন্ত কেবল এই দুটি বিষয় পড়ানো হতো কাফায়। এর পর ১৯৯৯ সালের মার্চে কাফা অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র-নির্মাণে ‘কোরিয়ান অ্যানিমেশন অ্যান্ড আর্ট অ্যাকাডেমি’ নামে একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান চালু করে। প্রথম ব্যাচে মাত্র ১২ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে অ্যানিমেশনের স্নাতক কোর্স। কিন্তু ২০০১ সালে এসেই ফিল্ম ও অ্যানিমেশন বিভাগ যৌথভাবে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। চলচ্চিত্রের প্রযোজনা বিষয়ে ২০০৫ সালে নতুন আরেকটি বিভাগ চালু করা হয়।
চলচ্চিত্রের যথাযথ শিক্ষা নিশ্চিত করতে ২০০৬ সালে কাফার পাঠ্যক্রমকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়—রেগুলার ও রিসার্চ প্রোগ্রাম। রেগুলার প্রোগ্রামে এক বছর পড়াশোনার পর চাইলে যে কেউ আরেক বছর রিসার্চ প্রোগ্রামে অংশ নিতে পারে। একই বছর কাফা তাদের শিক্ষার মান উন্নয়নের স্বীকৃতি হিসেবে ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ফিল্ম অ্যান্ড টিভি স্কুলস’-এর (সি আই এল ই সি টি) সদস্যপদ লাভ করে।
রিসার্চ প্রোগ্রামের আওতায় ২০০৭ সাল থেকে মূলত কাহিনিচিত্র ও অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রের জন্য দুটি কোর্স শুরু হয়। এর মধ্যে কাহিনিচিত্র নির্মাণ কোর্সটির জন্য এক বছর এবং অ্যানিমেশনের জন্য এক বছর দুই মাস সময় নির্ধারণ করা হয়। এই বছরে কাফা জাপানের সঙ্গে যৌথভাবে চলচ্চিত্র প্রযোজনা বিষয়ে একটি কর্মশালাও শুরু করে। ২০০৮ সালে রিসার্চ প্রোগ্রামের আওতায় প্রথমবারের মতো তিনটি কাহিনিচিত্র ও একটি অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র নির্মাণ করে কাফা’র শিক্ষার্থীরা। ২০১১ সালে রেগুলার ও রিসার্চ প্রোগ্রামে পরিচালনা, অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র-নির্মাণ ও সিনেমাটোগ্রাফির সঙ্গে চিত্রনাট্য নামে নতুন একটি বিভাগ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
যা পড়ানো হয়
আগেই বলেছি কাফায় শিক্ষার্থীদের জন্য এক বছর মেয়াদি রেগুলার প্রোগ্রাম ও দুটি রিসার্চ প্রোগ্রাম চালু রয়েছে। রেগুলার প্রোগ্রামটি চার কোয়ার্টারে বিভক্ত। একজন শিক্ষার্থী প্রতি কোয়ার্টারে ১০ সপ্তাহ ক্লাস করে থাকেন। এই এক বছরের কোর্সে চলচ্চিত্র পরিচালনা, সিনেমাটোগ্রাফি, অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র-নির্মাণ, চিত্রনাট্য ও চলচ্চিত্র প্রযোজনা বিষয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষকরা হাতে কলমে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। প্রথম ও দ্বিতীয় কোয়ার্টারে শিক্ষার্থীরা চলচ্চিত্রের আধুনিক প্রযুক্তি ও নির্মাণের প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করেন। তৃতীয় কোয়ার্টারে শিক্ষার্থীরা মাঝারি দৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র ও অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র-নির্মাণ প্রক্রিয়া শিখে থাকেন। এ পর্বে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে দুটি মাঝারি দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র ও একটি অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হয়। সর্বশেষ কোয়ার্টারে শিক্ষার্থীদের চিত্রনাট্য লেখা ও প্রযোজনার ওপর জোর দেওয়া হয়, যাতে তারা সফলভাবে কোনো পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র ও অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারে।
রিসার্চ প্রোগ্রামে কাহিনিচিত্র প্রযোজনা ও অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য চিত্রনাট্য প্রস্তুত, প্রযোজনা পূর্ববর্তী-পরবর্তী কাজ, বিপণন ব্যবস্থাপনা বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা দেওয়া হয়। কোর্স দুটির মূল উদ্দেশ্য থাকে চলচ্চিত্র বিষয়ে শিক্ষার্থীদের কার্যকর, বাস্তব জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করা। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে পেশাদার অভিজ্ঞ পরিচালক, সিনেমাটোগ্রাফারদের দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এজন্য প্রতিবছর নিয়মিত শিক্ষকদের পাশাপাশি ১২ জন করে কাহিনিচিত্র ও অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রনির্মাতা এবং ছয় জন সিনেমাটোগ্রাফারকে নিযুক্ত করা হয়। কোর্সের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীরা দলীয়ভাবে পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র ও অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র নির্মাণ করে থাকেন। সিনেমাটোগ্রাফি, শব্দগ্রহণ ও সম্পাদনায় ডিজিটাল প্রযুক্তির পাশাপাশি ১৬ ও ৩৫ মিলিমিটার ক্যামেরায়ও কাজ শেখানো হয়।
কাফায় প্রতিটি কোর্সে সমৃদ্ধ পাঠ্যতালিকার পাশাপাশি কঠোর নিয়ম ও পর্যবেক্ষণ করা হয়। চলচ্চিত্র বিষয়ক বিভিন্ন বই, গবেষণাপত্র, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে অভিজ্ঞ ও পেশাদার শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে কাফা’র শিক্ষার্থীরা গড়ে ওঠেন পরিপূর্ণ চলচ্চিত্রনির্মাতা ও কলাকুশলী হিসেবে।
আবেদন ও ভর্তি তথ্য
বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে কাফা ভর্তির জন্য আবেদনপত্র আহ্বান করে। কাফা থেকে সরবরাহ করা নির্দিষ্ট ফরমে ভর্তির জন্য আবেদন করতে হয়। ভর্তি ফরম কাফার কার্যালয় থেকে সরাসরি অথবা ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করা যায়। কোরিয়ার শিক্ষার্থীদের আবেদনপত্রের সঙ্গে নাগরিকত্ব ও স্বাস্থ্যের সনদপত্র এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণপত্র যুক্ত করে রেজিস্ট্রি করে পাঠাতে হয়। কুরিয়ার বা কুইক সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠানো হলে তা গ্রহণযোগ্য হয় না। এছাড়া রেজিস্ট্রার মেইলের রশিদটি সংরক্ষণ করতে হয়। আগ্রহী প্রার্থী কোন্ বিভাগে ভর্তি হতে চান আবেদনপত্রে তা উল্লেখ করতে হবে। কাহিনিচিত্র ও অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র পরিচালনা বিভাগে ভর্তির জন্য প্রার্থীকে অবশ্যই স্নাতক পাস হতে হবে।
অ্যানিমেশন কোর্সে আবেদনের জন্য অডিও-ভিজ্যুয়াল, পেইন্টিং, ফটোগ্রাফি, ডিজাইন ও চিত্রণশৈলী সম্পর্কিত অভিজ্ঞতার প্রমাণপত্র আবেদনপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। আবেদনপত্র গ্রহণের পর তিন স্তরে প্রার্থীদেরকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়। বাছাই করা প্রার্থীদের তিন ধাপে স্ক্রিনিং ও সরাসরি সাক্ষাৎকার দিতে হয়। এর পর ভর্তিযোগ্যদের তালিকা প্রকাশ করে কাফা কর্তৃপক্ষ।
কাফায় ভর্তিচ্ছু আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ভর্তি প্রক্রিয়া কিছুটা জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ। ৭০ হাজার কোরিয়ান ওন এককালীন পরিশোধের মাধ্যমে একজন বিদেশি শিক্ষার্থী কাফায় আবেদনের সুযোগ পান। আবেদনপত্রের সঙ্গে প্রার্থীর নাগরিকত্বের সনদপত্র, পাসপোর্টের কপি, ছয় মাসের মধ্যে তোলা রঙিন ছবি ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রমাণপত্র দিতে হয়। এছাড়া প্রতিমাসে প্রার্থীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে তিন হাজার ডলার পরিমাণ অর্থ সঞ্চয় থাকার প্রমাণপত্রও এর সঙ্গে যোগ করতে হয়। কেবল চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই ‘কোরিয়ান ফিল্ম অ্যাকাডেমি ফর ফরেইন ভিসা’ কর্তৃপক্ষ তাদের ভিসা মঞ্জুর করে থাকে। যাচাই-বাছাইয়ের পর ভর্তির জন্য নির্বাচিত হলে প্রতিবছর টিউশন ফি দিতে হয় ২০ লক্ষ ওন।
তবে কাফায় স্কলারশিপের ব্যবস্থাও রয়েছে। প্রার্থীদের লৈঙ্গিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে এ বৃত্তি দেওয়া হয়। তিন ক্যাটাগরিতে এ বৃত্তি প্রদান করে কাফা—সম্পূর্ণ টিউশন ফি ও অর্ধেক টিউশন ফি ছাড় এবং প্রতিবছর দুই ইন্সটলমেন্টে টিউশন পরিশোধের সুযোগ থাকে। তবে এ বৃত্তি পাওয়ার জন্য অবশ্যই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীকে আবেদনপত্র জমা দিতে হবে।
যোগাযোগ
আগ্রহীরা ভর্তির জন্য যোগাযোগ করতে পারেন
Korean Academy of Film Arts
337 Seogyo-done
Mapo-gu
Seoul, 121-836
Korea.
Email : kafa21@kofic.or.kr
Phone : +82-2-332-6087
এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট www.kafa.ac থেকে ভর্তি ও বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা যাবে।
লেখক : নাজমুল ইসলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।
mcjnazmul@gmail.com
তথ্যসূত্র
১. Kai Hong, ‘Korea (South)’, International Film Guide 1981, p.214
পাঠ সহায়িকা
http://film.culture360.asef.org/directory/korean-academy-of-film-arts/#sthash.LFbNGbfi.dpuf
http://en.wikipedia.org/wiki/Cinema_of_Korea
বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জানুয়ারির ম্যাজিক লণ্ঠনের অষ্টম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন