Magic Lanthon

               

হিরু মোহাম্মদ

প্রকাশিত ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

ধ্বংস-রক্ত-বারুদ আর লাশের মধ্যে ফোটা এক গোলাপ ‘ফজ্‌র’

হিরু মোহাম্মদ

১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি; শোষণ, অরাজকতা আর পুঁজিবাদী-স্বৈরাচারী শাহ শাসকের দাসত্ব অস্বীকার করে ইরানি জনগণ জেগে ওঠে। তারা গ্রহণ করে নতুন এক শাসন কাঠামো, যেখানে তাদের প্রাণের উচ্ছ্বাস ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে দেয় সব গ্লানি। কিন্তু মাথা তুলে দাঁড়ানোর আগেই ইরাকের যুদ্ধবিমান রক্তাক্ত করে মুক্তিকামী ইরানিদের বুক—শুরু হয় এক অসম যুদ্ধ। ধ্বংস-রক্ত-বারুদ আর লাশের গন্ধ ম্লান করে দেয় মুক্তির স্বাদ। কিন্তু সবকিছু উপেক্ষা করে ইরানের রক্তমাখা লাল-ধূসর ভূমিতে প্রস্ফুটিত হয় একটি লাল গোলাপ, যার নাম ‘ফজ্‌র আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’। ইরানি নবজাগরণের সমুজ্জ্বল স্মৃতি ধারণ ও বিপ্লবের সতেজ দীপ্তি অনির্বাণ রাখতে ১৯৮৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু হয় এ উৎসবের। এসব বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও চলচ্চিত্র যে মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের হাতিয়ার হতে পারে, বিশ্ববাসীকে তা আবারও স্মরণ করিয়ে দেয় এই ঘটনা। যদি ২০ শতকের ৫০ দশককে ইতালির নিওরিয়ালিজম, ৬০ দশককে ফ্রান্সের নুভেলভাগ, ৭০ দশককে নতুন জার্মান চলচ্চিত্রের দশক এবং ৮০’র দশককে চিনা চলচ্চিত্রের বিশ্বজয়ের দশক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তবে ৯০ দশককে চিহ্নিত করতে হয় ইরানের মুক্তি ও তার চলচ্চিত্রের বিশ্বজয়ের দশক হিসেবে।



সাহস, ভালোবাসা, শক্তি, শান্তি আর চিরযৌবনা ইরানের প্রাণের প্রতীক একটি ‘সিমর্গ’। পারস্য রূপকথায়, ময়ূরের মতো পেখম, কুকুরের মতো মুখ আর সিংহের থাবা বিশিষ্ট উড়ন্ত এক পাখি সিমর্গ, যে কিনা পারস্যের প্রথম সম্রাট প্রিন্স খুরশিদকে (যাকে ঈশ্বরের পুত্র বলা হয়) ফিরিয়ে দিয়েছিলো তার রাজ্যে। সিমর্গ কখনো ঘুমায় না; হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি রোধ করে ইরানকে রাখে সুরক্ষিত—সেই বিশ্বাসে ইরানের প্রাণের মেলা ফজ্র আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতীক এই সিমর্গ। উৎসবের সর্বোচ্চ সম্মাননীয় পুরস্কারটির নামও ‘ক্রিস্টাল সিমর্গ’ (Cristol Symorgh)। প্রতি বছর ইরানের মুক্তি দিবস উদ্‌যাপনে ১-১১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত উৎসবে হাজারো তারকার মিলন মেলায় পরিণত হয় তেহরান। প্রাচ্যের অন্যতম বৃহৎ এ উৎসব যেমন ইরানি জনগণের চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ, তেমনই জাতীয় জীবনে চলচ্চিত্রের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার প্রমাণ দেয়।

ইরান চলচ্চিত্র

ইরানি জনগণ যে সময়টিতে তাদের নিজস্ব চলচ্চিত্র পেলো, ততোদিনে প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক পণ্যের তকমা পেরিয়ে বিশ্ববাসীর মনে শিল্প হিসেবেও জায়গা করে নিয়েছে চলচ্চিত্র। সেসময় ইরানের মসনদে আসীন স্বৈরশাসক রেজা শাহ পাহলভি। পশ্চিমা ধারার আধুনিকায়ন, গণতন্ত্রের নামে শোষণ-পীড়ন-দমন আর সাধারণের কণ্ঠ রুদ্ধ করাই ছিলো রেজা শাহের শাসনের মূল কথা। এমনই একসময়ে ১৯৩০ সালে আভানেস ওহানিয়ান নির্মাণ করেন ইরানের প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র আবি রাবি। এর তিন বছরের মাথায় ইরান পায় প্রথম সবাক চলচ্চিত্র লরের মেয়ে (১৯৩৩)। রেজা শাহের অতিরিক্ত পশ্চিমা প্রীতি আর আধুনিকায়নের নির্লজ্জ জোয়ার নবজাতক চলচ্চিত্রের জন্য বর না, বরং শাপই হয়েছিলো। কেননা ততোদিনে ইরানের বাজার দখল করে নিয়েছে হলিউড ও অন্যান্য দেশের চলচ্চিত্র।

বিদেশি চলচ্চিত্রের অবাধ আমদানি রোধ করে নিজেদের চলচ্চিত্রকে দাঁড়ানোর সুযোগ দেওয়ার কথা মাথাতেই আনেনি রেজা শাহের দরবার। তাই রাষ্ট্রীয় অমনোযোগিতায় ইরানের চলচ্চিত্র চলতে থাকে হামাগুড়ি দিয়ে। তবে কিছু সাহসী মানুষের জন্য একেবারে হারিয়ে যায়নি তা; দারিয়ুস মেহেরজুই, আব্বাস কিয়োরোস্তামি, মহসিন মাখমালবাফ, বাহরাম রেইজি, আমির নাদরি, রোকসান বানি এটমাড-এর মতো বিখ্যাত নির্মাতারা নিজেদের সৃষ্টিশীলতা আর মেধা দিয়ে এগিয়ে নেন ইরানের চলচ্চিত্র।

১৯৫৯-এ এসে ইরানি চলচ্চিত্র অঙ্গনে নতুন আশার প্রদীপ প্রজ্বালন করেন ফারুক জেফারি। তিনি ইউরোপিয় শিল্প ও ইতালির নিওরিয়ালিজমে প্রভাবিত হয়ে নির্মাণ করেন সাউথ অব দ্য সিটি (১৯৫৮)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির অমানবিক কার্যক্রমের মধ্যে স্বপ্নপ্রেমী চলচ্চিত্রনির্মাতারা রচনা করেছিলেন নিওরিয়ালিজম নামের এক ব্যতিক্রমী শিল্পতত্ত্ব। ইরানের তৎকালীন অবস্থা ইতালির মতো না হলেও রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ না পাওয়ায়, এখানকার চলচ্চিত্রনির্মাতারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। এমন পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য ৬০-এর দশকে এসে তারা নিওরিয়ালিজম ধারায় আকৃষ্ট হন; নির্মাণ করেন দ্য নাইট অব হান্সব্যাক (১৯৬৩) ও ঘেউসার-এর (১৯৬৬) মতো চলচ্চিত্র।

তবে ইরানি চলচ্চিত্রের জন্মবার্তা বিশ্ববাসীর কাছে প্রথম পৌঁছে দিয়েছিলো দারিয়ুস মেহেরজুই-এর দ্য কাউ (১৯৬৯)। এবং এটিই ছিলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র। মেহেরজুই-এর দ্য কাউ-এর ভিত্তি ছিলো সাহিত্যিক গোলাম হোসেন সাইদির গল্প। সাহিত্য আর চলচ্চিত্র যেনো একই নদীর দুইটি কূল। তাই সাহিত্য ইরানের নির্মাতাদের গভীরভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিলো। এর পর ৭০-এর দশকে এসে ইরানের চলচ্চিত্রে আরো খানিকটা উন্নতির ছোঁয়া লাগে। এ সময় বেশকিছু চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় যা দেশটির চলচ্চিত্রের মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্রেড অ্যান্ড অ্যালি (১৯৭০), বিটা (১৯৭২), স্টিল লাইফ (১৯৭৪), কালারস (১৯৭৫), গোজারিস (১৯৭৬), হাউ টু মেক (১৯৭৭), ফার্স্ট কেস (১৯৭৮), বালাদ অব তারা (১৯৭৯) ইত্যাদি। এর মধ্যে সোহারাব শহীদ সেলস-এর স্টিল লাইফ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এবং বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে জিতে নেয় ‘সিলভার বিয়ার অ্যাওয়ার্ড’।

ফজ্‌র উৎসবের যাত্রা

৭০-এর দশকে ইরানি চলচ্চিত্র যখন কেবল মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখছে, তখনই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে ওঠে। দীর্ঘদিনের শাহ শাসনের অত্যাচার, নির্যাতন আর নিষ্পেষণ থেকে মুক্তি পেতে শুরু হয় বিপ্লব। অত্যাচারী শাহ শাসনের পতন ঘটিয়ে দীর্ঘদিনের ঘনীভূত ক্ষোভ আর অত্যাচারের পরিসমাপ্তি ঘটে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে। আর এই বিপ্লবের অন্যতম বাহন ছিলো ইরানের চলচ্চিত্র। কিন্তু স্বাধীনতার স্বাদ পেতে না পেতেই এক বছরের মাথায় আবার ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে দেশটি।

এ সময় ইরানে চলচ্চিত্র-নির্মাণ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে যায়। কিন্তু তার পরও দমে যাননি ইরানের নির্মাতা আর দর্শকরা। যুদ্ধের মধ্যে জনগণের মনে সাহস আর শক্তি জোগাতে ইসলামি বিপ্লবের চার বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৯৮৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু হয় ‘তেহরান চলচ্চিত্র উৎসব’-এর। বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে ইরানের দিকে, যেখানে প্রতিদিন রক্তের হোলি খেলা চলছে সেখানে কিনা চলচ্চিত্র উৎসবে লাল গোলাপ হাতে বরণ করা হচ্ছে ইরানের নির্মাতা, চলচ্চিত্রপ্রেমীদের! ১৯৮৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে ১১ ফেব্রুয়ারি ইরানের বিজয় দিবস পর্যন্ত চলে এ উৎসব।

এ উৎসব এমন এক সময়ে যাত্রা শুরু করেছিলো, যখন ইরানি চলচ্চিত্র প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিলো। ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধকালীন গড়ে প্রতিবছর মাত্র চার থেকে পাঁচটি চলচ্চিত্র নির্মাণ হতো। একদিকে শাহ শাসনের অবসান অন্যদিকে ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধ, রাজনীতির মতো চলচ্চিত্র জগতেও চলতে থাকে উত্থান-পতন। অনেক পরিচালক নিজেদের গুটিয়ে নেন চলচ্চিত্র-নির্মাণ থেকে; আর অনেকের ওপর চলচ্চিত্র-নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে নতুন সরকার। এর মধ্যেও কয়েকজন নতুন উদ্যমী নির্মাতা প্রবেশ করেন চলচ্চিত্র জগতে।

এতকিছুর পরও নতুন-পুরাতন নির্মাতাদের উৎসাহ দিতে, দর্শকদের দেশি চলচ্চিত্রের প্রতি আকৃষ্ট করতে  তৎকালীন সংস্কৃতি ও ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে যাত্রা শুরু করে ‘তেহরান চলচ্চিত্র উৎসব’। প্রথম কয়েক বছর অর্থাৎ ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এ উৎসবে শুধু ইরানি চলচ্চিত্রই অংশ নিতে পারতো। কারণ বিপ্লব পরবর্তী সরকার সব ধরনের বিদেশি চলচ্চিত্র প্রদর্শন নিষিদ্ধ করে। বিপ্লবের অন্যতম নেতা আয়াতুল্লাহ্‌ আল খোমেনি’র দৃঢ় উচ্চারণ ছিলো, ‘আমি চলচ্চিত্রের বিরোধিতা করি না, বরং নগ্নতার বিরোধিতা করি।’ তাই উৎসবে ইরানের সব ধরনের চলচ্চিত্র প্রদর্শনের পাশাপাশি এর মধ্য থেকে বাছাই করে বিভিন্ন শাখায় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রগুলোকে পুরস্কার দেওয়া হতো, যা নতুন নির্মাতাদের বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলো। উৎসবে চলচ্চিত্র বাছাই ও পুরস্কার দেওয়ার জন্য বিশিষ্ট নির্মাতা ও কলাকুশলীদের সমন্বয়ে জুরি বোর্ড গঠন করা হতো। এই জুরি বোর্ডের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিখ্যাত নির্মাতা হাজির দারিয়ুস।  

তবে যে উদ্যমের সঙ্গে ‘তেহরান চলচ্চিত্র উৎসব’-এর যাত্রা শুরু হয়েছিলো, সেই উদ্যমকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেননি জুরি বোর্ডের সদস্যরা। তাদের অদক্ষতা, ভুল নীতিমালা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে মতানৈক্য, নির্মাতাদের উৎসব বর্জন ও শর্তারোপের পাশাপাশি নবগঠিত রক্ষণশীল সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ ‘তেহরান চলচ্চিত্র উৎসব’-এর গতি রোধ করে। আর রাষ্ট্র উৎসবটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করায় জুরি বোর্ডও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছিলো না। এই চরম প্রতিকূলতার মধ্যে উৎসবকে সঠিকভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে যে কয়েকজন নির্মাতা বিশেষভাবে কাজ করেছিলেন, তাদের মধ্যে মুহাম্মদ বেহেস্তি ও সাইফুল্লাহ অন্যতম। প্রথম চার বছর উৎসব তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন জাবেদ শামগাদরি। তবে অভ্যন্তরীণ জটিলতা ও যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেও তেহরান উৎসব প্রতিবছরই নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। 

১৯৮৮ সালে যুদ্ধাবসানের পর ইরান নতুন করে বিশ্বে তাদের অবস্থান জানান দেয়, সেই সঙ্গে দেশটির চলচ্চিত্রও উৎকর্ষ সাধন করে। চলচ্চিত্র-নির্মাণের হার বেড়ে যায়, সরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠে প্রায় দুইশো নতুন প্রেক্ষাগৃহ। এই সময় দেশটির রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জনগণের রুচি ও অভ্যাসের যেমন পরিবর্তন হয়েছিলো, সেই সঙ্গে তাল রেখে পরিবর্তন হয়েছিলো চলচ্চিত্র উৎসবের রঙও। ইরানি জনগণও নতুন করে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলো নিজেদের চলচ্চিত্রের প্রতি। ১৯৯০ সালে উৎসবটি কেবল অভ্যন্তরীণ চলচ্চিত্রের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক রূপ নেয়। আর সঙ্গে সঙ্গে ‘তেহরান চলচ্চিত্র উৎসব’-এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ফজ্‌র আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’।

ইসলামি বিপ্লবের ঐতিহ্য ও ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে যে উৎসব যাত্রা শুরু করেছিলো, তা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে রূপান্তরিত হওয়ার পরেও প্রথম দিকে ইসলামের বিরুদ্ধাচরণকারী ‘অনৈতিক ও নিয়ম ভঙ্গকারী’ পশ্চিমা, পূর্ব ইউরোপিয় ও পূর্ব এশিয়ার চলচ্চিত্রগুলোর প্রদর্শন নিষিদ্ধ ছিলো। এ সময় পারাজানভ (parajanov), তারকোভস্কি, ওজু ও অ্যাঞ্জেলোপোলাস-এর মতো বিখ্যাত নির্মাতাদের চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হতো না।

তবে ৯০ দশকের মাঝামাঝি এসে সব সমস্যা কাটিয়ে ‘ফজ্‌র আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’ পূর্ণতা লাভ করে। ১৯৯৭ সালে মোহাম্মাদ খাতামি সরকারের প্রচেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষকতায় উৎসবের বিশেষ পরিবর্তন ও উৎকর্ষ সাধন করা হয়। উৎসবের পরিসর বৃদ্ধি পায় এবং অনেকগুলো বিভাগ যোগ হয়। ‘সিনেমা অব দ্য স্পিরিট’ নামের একটি বিভাগে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রখ্যাত নির্মাতাদের মাস্টারপিসগুলো প্রদর্শন ও মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়। ২০০৫ সালে উৎসবে ‘এশিয়ান চলচ্চিত্র’ নামে নতুন একটি বিভাগ চালু করা হয়; যাতে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।

ফজ্‌র-এর যতো পুরস্কার

ফজ্‌র উৎসবে প্রধান দুটি বিভাগে চলচ্চিত্রগুলো শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে অংশ নেয়। প্রথমটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র বিভাগ, অন্যটি জাতীয় চলচ্চিত্র বিভাগ। এই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র বিভাগকে আবার দুটি ভাগে ভাগ করা হয়—একটি প্রতিযোগিতা বিভাগ, যেখানে চলচ্চিত্রগুলো শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই করে; অন্যটি অপ্রতিযোগিতা বিভাগ, এখানে কিছু নির্বাচিত চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বিভাগ আবার দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথমত, ইসলামি বিশ্বের চলচ্চিত্র বিভাগ; দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র বিভাগ।

পরিচালনা কমিটি বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে উৎসবের জন্য চলচ্চিত্র আহ্বান করে থাকে। উৎসবের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বিশ্বের যেকোনো নির্মাতা তার চলচ্চিত্র জমা দিতে পারেন। জমা পড়া চলচ্চিত্র থেকে যাচাই-বাছাই করে কিছু সংখ্যক চলচ্চিত্র উৎসবের জন্য নির্বাচন করেন বিখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বোর্ড। সাধারণত চলচ্চিত্র নির্বাচনের প্রক্রিয়া চলে বছরব্যাপী।  

উৎসবে নির্বাচিত বিভিন্ন বিভাগের চলচ্চিত্রগুলো প্রতিযোগিতা করে ‘ক্রিস্টাল সিমর্গ’ নামে অ্যাওয়ার্ডটির জন্য। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতা বিভাগে সেরা চলচ্চিত্র, পরিচালক, চিত্রনাট্য, অভিনেতা, অভিনেত্রী ও টেকনিকাল অ্যাচিভমেন্ট ক্যাটাগরিতে প্রত্যেকেই ‘ক্রিস্টাল সিমর্গ’ নামের অ্যাওয়ার্ডটি দেওয়া হয়। যদিও ইসলামি বিশ্বের চলচ্চিত্রের জন্য আলাদা একটি বিভাগ রয়েছে, তার পরও আন্তর্জাতিক বিভাগে ইসলামি বিশ্বের যেকোনো দেশের চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতা করতে পারে; এবং তা জুরিদের মন কাড়তে সক্ষম হলে সেই নির্মাতাকে বিশেষ জুরি পুরস্কার হিসেবে ‘ক্রিস্টাল সিমর্গ’ দেওয়া হয়ে থাকে।

ক্রিস্টাল সিমর্গ এর ছবি যাবে

ইসলামি বিশ্বের চলচ্চিত্র বিভাগে ওই সব দেশের চলচ্চিত্র বাছাই করে প্রদর্শন করা হয়। এ বিভাগে সেরা অভিনেতা-অভিনেত্রীর জন্য থাকে ‘ক্রিস্টাল সিমর্গ’। এছাড়া শ্রেষ্ঠ পরিচালক, শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য ও শ্রেষ্ঠ আর্টিস্ট অ্যাচিভমেন্ট-এর জন্যও ‘ক্রিস্টাল সিমর্গ’ অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। এর বাইরে এ বিভাগে সেরা চলচ্চিত্রের জন্য ‘মোস্তফা আক্কাদ প্রাইজ’ বা ‘গোল্ডেন ফ্ল্যাগ’ নামে একটি বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হয়। ২০০৭ সাল থেকে ইরানের শ্রেষ্ঠ বীর মোস্তফা স্মরণে বিশেষ এই পুরস্কারটি চালু করা হয়।

উৎসবে অপ্রতিযোগিতা বিভাগে চলচ্চিত্র বাছাই ও পুরস্কার নির্ধারণ করে থাকে কেন্দ্রীয় জুরি বোর্ড। এই জুরি বোর্ডের সদস্যরা বিশ্বের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিয়ে নানা দিক বিবেচনায় ফজ্‌র উৎসবের জন্য চলচ্চিত্র নির্বাচন করে থাকে। এই নির্মাতাদের উৎসবে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য কোনো আবেদন করতে হয় না; বরং কেন্দ্রীয় বোর্ড নির্বাচিত নির্মাতাদের উৎসবে আমন্ত্রণ জানায়। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র বিভাগের আর একটি শাখা হলো এশিয়ান চলচ্চিত্র বিভাগ। এ বিভাগে কেবল এশিয়ার চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতা করে থাকে।

জাতীয় চলচ্চিত্র বিভাগে তিনটি শাখায় প্রদর্শন ও প্রতিযোগিতা চলে। সবচেয়ে বেশি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার দেওয়া হয় এ বিভাগে। কাহিনিচিত্র শাখায়—সেরা চলচ্চিত্র, অভিনেতা-অভিনেত্রী ছাড়াও সহঅভিনেতা-অভিনেত্রী, চিত্রনাট্যকার, সম্পাদক, সিনেমাটোগ্রাফার, কম্পোজার, মেকআপ আর্টিস্ট, সাউন্ড ইফেক্ট, সাউন্ড রেকর্ডার, কস্টিউম অ্যান্ড স্টেজ ডিজাইনার এবং স্পেশাল ইফেক্ট-এর জন্য প্রত্যেকে পান ‘ক্রিস্টাল সিমর্গ’ অ্যাওয়ার্ড। প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নামে বাকি দুটি শাখায় সেরা চলচ্চিত্রসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ‘ক্রিস্টাল সিমর্গ’ অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়।

ফজ্‌র উৎসবে পুরস্কারের জন্য চলচ্চিত্রের মানদণ্ড বিচারে বেশ কড়াকড়ি করা হয়। কোনো বিভাগে যথাযথ চলচ্চিত্র না থাকলেও পুরস্কার দিতেই হবে—বিষয়টি মোটেও এমন নয়। ১৯৮৪ সালে জুরি বোর্ড সেরা চলচ্চিত্রের জন্য ‘ক্রিস্টাল সিমর্গ’ দেওয়ার মতো কোনো চলচ্চিত্রই পায়নি। ১৯৮৮ সালেও জুরি বোর্ড একই সমস্যার সম্মুখীন হয়। তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে, ১৯৮৬ সালের উৎসবে জুরি বোর্ড একই সঙ্গে চারটি চলচ্চিত্রকে সেরা বলে ঘোষণা করে।

এক নজরে ৩২তম ফজ্‌র উৎসব

১ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪; ইরানের রাজধানী তেহরান সেজেছিলো নতুন সাজে। সিমর্গ তার সোনালি ডানায় ঢেকে দিয়েছিলো তেহরানের আকাশ, যার ছায়ায় ফুটন্ত রক্ত গোলাপ হাতে মিলনমেলায় আনন্দে মেতেছিলো বিশ্বের হাজারো চলচ্চিত্রপ্রেমী। এবারের উৎসব সেজেছিলো একটু ভিন্ন আঙ্গিকে, এবারই প্রথম প্রতিটি চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর পরে এর নির্মাতা, অভিনেতা, কলাকুশলীরা সরাসরি দর্শকের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। উৎসব এলাকায় ছিলো সার্বক্ষণিক পাঁচটি রেডিও স্টেশন। তারা উৎসবে আগত প্রায় প্রত্যেক নির্মাতা ও অতিথির সাক্ষাৎকার সম্প্রচার করেছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। এছাড়া আয়োজন করা হয়েছিলো চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যবহৃত অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি প্রদর্শনীর। ছিলো বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত সিনেমাটোগ্রাফার, পরিচালক ও কস্টিউম ডিজাইনারদের অংশগ্রহণে বিশেষ সেমিনার।

এবারের উৎসবে ১৭টি দেশের একশো ১৫টি চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতার জন্য আন্তর্জাতিক বিভাগে মনোনয়ন পায়। যার মধ্যে আটটি চলচ্চিত্র বিভিন্ন শাখায় অর্জন করে ‘ক্রিস্টাল সিমর্গ’। শ্রেষ্ঠ নির্মাতা হিসেবে দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড­-এর জন্য অ্যাওয়ার্ড পান ডাচ্‌ নির্মাতা ইয়াপ ভান হিউসডেন (Jaap Van Heusden)। জাতীয় চলচ্চিত্র বিভাগে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার পায় আহমেদ রেজা দরবেশ-এর হুসেইন, হু সেইড নো। একই সঙ্গে শ্রেষ্ঠ পরিচালক, সেরা সঙ্গীত, সেরা কস্টিউম, সেরা সহঅভিনেতা ও সেরা সিনেমাটোগ্রাফার ক্যাটাগরিতে ‘ক্রিস্টাল সিমর্গ’ জিতে নেয় চলচ্চিত্রটি। ইরান যুদ্ধের বীর মোস্তফা চামরান-এর জীবনীভিত্তিক চলচ্চিত্র ইব্রাহীম হাটামিকিয়া’র চে শ্রেষ্ঠ সম্পাদনা ও ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট শাখায় ‘ক্রিস্টাল সিমর্গ’ অর্জন করে। এছাড়া তারেক ওয়ান ফোরটি থ্রিহার্ড মেকআপ চলচ্চিত্র দুটিতে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হয় নারগিস অবের’কে।

৩২তম উৎসবে এবার দর্শকদের জন্য ছিলো সেরা চলচ্চিত্র নির্বাচনের সুযোগ। এ প্রক্রিয়ায় যেকোনো দর্শক তার পছন্দের চলচ্চিত্রকে ভোট দিতে কাগজে নাম লিখে নির্ধারিত বক্সে ফেলতো। এতে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে ‘ক্রিস্টাল সিমর্গ’ জিতে তারেক ওয়ান ফোরটি থ্রি। এছাড়া এবারের উৎসবে ‘নিউ ভিউ’ নামের বিভাগে ফিউ কিউবিক মিটারস অব লাভ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ নির্মাতার পুরস্কার পান জামসেদ মোহাম্মাদি।

 

লেখক : হিরু মোহাম্মদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।

hirumohammad.ru@gmail.com

 

পাঠ সহায়িকা

হাসীন, মানজারে; ‘সাম্প্রতিক সময়ের ইরানের জাতীয় চলচ্চিত্র’; যোগাযোগ; সম্পাদনা : ফাহমিদুল হক; সংখ্যা ৭, ফেব্রুয়ারি ২০০৫, রাজশাহী।

দোয়েল, আশফাক; ‘রাজনৈতিক-মঞ্চে বন্দি চলচ্চিত্র, আলো হাতে মেহেরজুই সঙ্গে দ্য কাউ’; ম্যাজিক লণ্ঠন; সম্পাদনা : কাজী মামুন হায়দার; বর্ষ ২, সংখ্যা ২, জানুয়ারি ২০১৩, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

ইসলাম, উদিসা (২০১২); ইরানী চলচ্চিত্র ১০ নারী নির্মাতা; ভাষাচিত্র, ঢাকা।

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন দফতরের ইতিহাস বিভাগ রচিত ইরানের সমকালীন ইতিহাস (ডিসেম্বর ১৯৯৬); অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী; প্রকাশক : ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, বাড়ি নম্বর : ৫৪, সড়ক : ৮/এ, ধানমণ্ডি, ঢাকা।

চলচ্চিত্র অভিধান; সম্পাদনা : ধীমান দাসগুপ্ত; জানুয়ারি ২০০৬, বাণীশিল্প, কলকাতা।

http://en.wikipedia.org/wiki/Fajr International Film Festival

www.fajrfilmfestival.com

 

বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জানুয়ারির ম্যাজিক লণ্ঠনের অষ্টম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন