Magic Lanthon

               

মোহাম্মদ আলী মানিক

প্রকাশিত ০৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

গুদামঘর থেকে আন্তর্জাতিকতায় লন্ডন চলচ্চিত্র স্কুল

মোহাম্মদ আলী মানিক

 

৫৮ বছর আগে সামান্য একটি গুদাম ঘরে স্বপ্নের যাত্রা শুরু; অল্প দিনেই বিক্রি হয়ে যায় সম্মিলিত সেই স্বপ্ন। তারপর একা পথচলা। নানা চড়াই-উতরাই। তবে আজ ৫৮ বছর পরে এসে স্বপ্নের এতো বড়ো প্রাপ্তি হবে, তা হয়তো ভাবেননি স্বয়ং স্বপ্নদ্রষ্টা গিলমোর রবার্টস। সেই স্বপ্ন আজ এক জাতি ছাড়িয়ে বহু জাতির চোখে রঙ ছড়াচ্ছে। বহু দেশ-জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ আজ ভাবে গিলমোর-এর সেই স্বপ্নকে নিয়ে। সেই স্বপ্নের নাম লন্ডন চলচ্চিত্র স্কুল। আজ সারা পৃথিবীর মধ্যে চলচ্চিত্র শিক্ষার অনন্য এক প্রতিষ্ঠান এটি।

২০০৬ সালে লন্ডন চলচ্চিত্র স্কুল (এল এফ এস) চলচ্চিত্র কলাকৌশল শিক্ষায় বিশ্বের অন্যতম পুরনো আন্তর্জাতিক স্কুল হিসেবে ৫০ বছরে পদার্পণ করে। অর্ধশতাব্দীর অধিক সময় ধরে স্কুলটি সাংস্কৃতিক নৈপুণ্যসহ বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের চলচ্চিত্র বিষয়ে হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়ে আসছে। বর্তমানে স্কুলটির ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বিদেশি; বাকি ২৫ শতাংশ যুক্তরাজ্যের। চলচ্চিত্র-নির্মাণের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলীর সমন্বয়ে স্কুলটি আজ বিশ্বে চলচ্চিত্র নিয়ে আশাবাদীদের তীর্থস্থল। এখন আমরা লন্ডন চলচ্চিত্র স্কুল ও তার কার্যক্রম সম্পর্কে জানবো। সেই সঙ্গে তার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস দেখার চেষ্টাও থাকবে।

লন্ডন চলচ্চিত্র স্কুল, জীবনবৃত্তান্ত

ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষপাদে ১৮৯৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি লন্ডনের জনগণ নতুন এক জাদু দেখার আমন্ত্রণ পায়। ফরাসি জাদুকর ও প্রদর্শক ফেলিসিন ট্রিউয়ে (Felicien Trewey) লন্ডনের রিজেন্ট স্ট্রিট পলিটেকনিকে সর্বকালের ভিন্নধর্মী এই শোর আয়োজন করেন। তিন সপ্তাহের এ আয়োজনে প্রতিজনের প্রবেশমূল্য ছিলো এক শিলিং। নতুন যে জাদু, যে শিল্পের মুখোমুখি লন্ডন সেদিন হয়েছিলো তার নাম চলচ্চিত্র। এটিই ছিলো লন্ডনের তথা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম চলমানচিত্র-দর্শন। ধীরে ধীরে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে থাকে লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের এ যুগান্তকারী আবিষ্কার।

ব্রিটিশরাও অবশ্য চলচ্চিত্রের আবিষ্কার দৌড়ে পিছিয়ে ছিলো না। ১৮৮৮ সালেই লন্ডন চলচ্চিত্র-নির্মাণের একেবারে দোরগোড়ায় পৌঁছেও ব্যর্থ হয়। লুইস অ্যামি অগাস্টিন লে প্রিন্স (Louis Aime Augustin Le Prince) ১৮৮৮ সালে ইংল্যান্ডে বিশ্বের প্রথম সিঙ্গেল লেন্স মোশন পিকচার ক্যামেরা বানিয়েছিলেন। ১৮৯০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর লে প্রিন্স তার ক্যামেরার কারিগরি উন্নয়নের জন্য প্যারিসগামী ট্রেনে সওয়ার হন। তারপর আর তাকে ও তার ক্যামেরা খুঁজে পাওয়া যায়নি। সত্যিই যদি তিনি তার ক্যামেরার সফল প্রয়োগ করতে পারতেন, তবে হয়তো চলচ্চিত্র আবিষ্কারের ইতিহাস অন্যভাবেই লেখা হতো।

ট্রিউয়ের শোর পর ব্রিটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম ফ্রিয়েস-গ্রিন (William Friese-Green) চলচ্চিত্রের উন্নয়নকল্পে উন্নত ও আধুনিক ক্যামেরা নির্মাণ বিষয়ে গবেষণা করতে থাকেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, তার উদ্ভাবিত প্রযুক্তি সত্যিকার অর্থে চলচ্চিত্র-নির্মাণে কোনো কাজে আসেনি। অন্যদিকে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জর্জ আলবার্ট স্মিথ ব্রিটিশ চলচ্চিত্রশিল্প গড়ে তোলার পিছনে ব্যাপক অবদান রাখেন। ১৮৯২ সালে লিজ নেওয়া সেন্ট অ্যান্স ওয়েল গার্ডেনকে তিনি তার চলচ্চিত্র কারখানায় রূপান্তর করেন। যেখানে প্রথম দিকের ব্রিটিশ চলচ্চিত্রগুলোর শুটিং করা হতো। ১৮৯৭ সালে তিনি গার্ডেনের পাম্প হাউজকে চলচ্চিত্র ডেভেলপ ও প্রিন্ট কারখানায় পরিণত করেন। সম্ভবত ১৮৯৯ সালের কোনো একসময়ে এটিকে গ্লাসহাউজ চলচ্চিত্র স্টুডিওতে রূপান্তর করেন স্মিথ। এ সময় তার স্টুডিও থেকে বাণিজ্যিকভাবে চলচ্চিত্র-নির্মাণ শুরু করেন। সেসব চলচ্চিত্রে স্মিথের স্ত্রীসহ স্থানীয়রা অভিনয় করতেন। তার স্টুডিওতে ক্যামেরা, প্রিন্টার, প্রজেক্টর, পার্ফোরেটরসহ চলচ্চিত্র-নির্মাণ ও প্রদর্শনের জন্য সব ধরনের প্রাযুক্তিক যন্ত্রপাতির জোগান দিতেন ইঞ্জিনিয়ার আলফ্রেড ডার্লিং (Alfred Darling)

কিন্তু যুক্তরাজ্যে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো চলছিলো ধুকে ধুকে। ১৯০৯ সালের দিকে ব্যাপকভাবে বিদেশি চলচ্চিত্রে ভরে যায় ব্রিটিশ চলচ্চিত্র বাজার। ফলে দেশীয় চলচ্চিত্রের অবস্থা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। তার ওপর শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এ যুদ্ধ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিতে ফাটল যেমন ধরায়, তেমনি চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিও প্রায় থমকে যায়। একদিকে যুদ্ধের ধকল, অন্যদিকে বিদেশি চলচ্চিত্রের আগ্রাসনে ব্রিটিশ চলচ্চিত্রের প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। এ সময়ে ব্রিটিশ চলচ্চিত্রগুলো থিয়েটার নির্ভর হয়ে পড়ে। একই অভিনেতা-অভিনেত্রী আর সেট ব্যবহার করে চলচ্চিত্র নির্মাণ হতে থাকে। তবে ব্রিটিশ দর্শকরা এসব চলচ্চিত্রগুলোকে পাতেই তুলতো না। তারা দেখতে চাইতো আমেরিকা ও অন্যান্য দেশের চলচ্চিত্র। দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ধস ও দর্শকদের অসহযোগিতায় ১৯১৮ সালের দিকে ব্রিটিশ চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি দেউলিয়া হতে শুরু করে। এবং ১৯২৪ সালে এসে একেবারেই বন্ধ হয়ে যায় ব্রিটিশ চলচ্চিত্র-নির্মাণ।

এ সময় ব্রিটিশ চলচ্চিত্রের দেশীয় বাজার তৈরি ও নিজেদের চলচ্চিত্র বাঁচাতে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট Cinematographers Trade Bill পাশ করে। এতে বাণিজ্যিকভাবে বিদেশি চলচ্চিত্র আসা বন্ধ হলেও কেবল স্টুডিওগুলোর স্বার্থে পরিমিত মাত্রায় বিদেশি চলচ্চিত্র আসতে থাকে। এতে ব্রিটিশ চলচ্চিত্র সংখ্যায় বৃদ্ধি পেলেও তা গুণগত মানে ছিলো খুবই দুর্বল। বিদেশি চলচ্চিত্রগুলোর শৈল্পিক ও প্রাযুক্তিক মানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছিলো না ওই চলচ্চিত্রগুলো। তবে ১৯৩৩ সালের পর থেকে ব্রিটিশ চলচ্চিত্র-নির্মাণ বৃদ্ধি পায়। ১৯৩৬ সালে চলচ্চিত্রের সংখ্যা দাঁড়ায় দুইশো ২০টি। কিন্তু এ চলচ্চিত্রগুলো কারিগরি ও আধেয়ের দিক থেকে খুবই দুর্বল ও অপরিপক্ব হওয়ায় দর্শক পাচ্ছিলো না। ফলে নিরুপায় ব্রিটিশকে আবারো আমেরিকান চলচ্চিত্রের জন্য দরজা খুলে দিতে হয়। এ সময় দেউলিয়া হয়ে যাওয়া চলচ্চিত্র-নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো কিনে নেয় আমেরিকান কোম্পানিগুলো। এর মধ্য দিয়ে ব্রিটেনে আবারো আমেরিকান চলচ্চিত্রের আধিপত্য ফিরে আসে।

এর কিছুকাল পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কফিনে যেনো শেষ পেরেক ঠুকে দেয় এটি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ চলচ্চিত্র অবকাঠামোর মেরুদ-ও ভেঙে দেয় এ যুদ্ধ। ব্যাপক সংখ্যক চলচ্চিত্র ও স্টুডিও কর্মী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। অর্ধেকেরও বেশি চলচ্চিত্র স্টুডিও ভেঙে গড়ে তোলা হয় মিলিটারি ক্যাম্প। একসময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলেও শেষ হয় না ব্রিটিশ চলচ্চিত্রের নিজ পায়ে দাঁড়ানোর যুদ্ধ। যুদ্ধ শেষে নির্মাতারা দর্শক-চাহিদা অনুযায়ী যুদ্ধনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যা ব্রিটিশ চলচ্চিত্রের পালে সুবাতাস দিয়েছিলো। কিন্তু তার পরেও বিংশ শতাব্দীর ৫০, ৬০ ও ৭০-এর দশকগুলোতে ব্রিটিশ চলচ্চিত্র যেনো হামাগুড়ি দিয়েই চলছিলো।

ততোদিনে অবশ্য চলচ্চিত্র স্বতন্ত্র একটি শিল্প হিসেবে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। চলচ্চিত্র নিয়ে হয়েছে বিভিন্ন আন্দোলন, তৈরি হয়েছে নব নব ধারা; কারিগরি ও শৈল্পিক দিক দিয়েও চলচ্চিত্র তখন স্বয়ংসম্পূর্ণ, সঙ্গে পেয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক রূপও। কিন্তু প্রাযুক্তিক অনগ্রসরতা, সঠিক লোকবলের অভাব বিশেষ করে চলচ্চিত্র সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও দক্ষতার অভাবে তখনো ধুকছিলো ব্রিটিশ চলচ্চিত্র। এমন কিছুর প্রয়োজন দেখা দিয়েছিলো যা ব্রিটিশ চলচ্চিত্রপ্রেমীদের নতুন দিশা দিবে, আশা জাগাবে। ঠিক এমনই এক পরিস্থিতিতে, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে লন্ডনের হ্যাদারলে চারুকলা স্কুলের (Heatherley School of Fine Art) অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন গিলমোর রবার্টস। ব্রিটিশ চলচ্চিত্রের উন্নয়নকল্পে তিনি সে স্কুলে চলচ্চিত্র-নির্মাণ বিষয়ক একটি সংক্ষিপ্ত কোর্স চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। এল এফ এস-এর যাত্রা শুরু হয়েছিলো ১৯৫৬ সালে এই হ্যার্দালে চারুকলা স্কুলে গিলমোর রবার্টসের হাত ধরেই।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ কোর্সের শিক্ষার্থীরা তালিকাভুক্ত হওয়ার আগেই হ্যাদোরলে চারুকলা স্কুলটি বিক্রি হয়ে যায়। সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় গিলমোর-এর চলচ্চিত্র কোর্সটিও। কিন্তু সহজে গিলমোর হার মানার মতো মানুষ ছিলেন না। গিলমোর একাই স্বাধীনভাবে এই কোর্সটি চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেন। এবং সংক্ষিপ্ত কোর্সটিকে বদলে দেন স্কুলে। লন্ডনের কাভেন্ট গার্ডেনের গুদাম ঘরকে বদলে নিয়ে সেখানেই শুরু করেন তার স্বপ্নের বাস্তবায়ন। তখন তিনি নিজেও হয়তো কল্পনা করেননি তার এ ছোটো স্কুলটি আজকের আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর হবে।

অনিশ্চিত দিনগুলি যাওয়ার পরে স্কুলটি বিক্সটনে স্থানান্তর করে নামকরণ করা হয় লন্ডন স্কুল অব ফিল্ম টেকনিক,। এটি এ আশায় স্থাপন হয়েছিলো যে, ব্রিটেনে চলচ্চিত্র-নির্মাণে যারা আগ্রহী তাদের যথাযথ, পরিকল্পিত ও পদ্ধতিগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমে চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নয়ন করা। ১৮ শতকের কাভেন্ট গার্ডেনের গুদাম ঘরেই স্কুলটি ১৯৬০ দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে। ৬০ দশকের শুরুতে লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ড-এর চার্লট স্ট্রিটের একটি বাড়িতে স্থানান্তর করা হয় এটিকে।

১৯৭৪ সালে স্কুলটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় লন্ডন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম স্কুল। এল আই এফ এস নামকরণের পর থেকে খুব জোরালোভাবে এর কার্যক্রম চলতে শুরু করে। দাতাগোষ্ঠীর তালিকায় এটি নিবন্ধন হয় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে। সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত এই প্রতিষ্ঠানটির কোর্সসমূহ লন্ডন মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির পাঠ্যক্রম অনুসারে পরিচালিত হয়।

লন্ডন চলচ্চিত্র স্কুল

এল এফ এস-ই বিশ্বের একমাত্র চলচ্চিত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেখানকার মোট শিক্ষার্থীর ৭০ শতাংশেরও বেশি যুক্তরাজ্যের বাইরের। বিশ্বের ৮০টির বেশি দেশের প্রায় একশো ৪০ জন শিক্ষার্থী প্রতিবছর এখান থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। দুই বছর মেয়াদী স্নাতকোত্তর পর্বে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে কমপক্ষে ছয়টি চলচ্চিত্র-নির্মাণের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকতে হয়, যার মধ্যে দুটিতে থাকতে হয় পরিচালক হিসেবে। এল এফ এস থেকে পাওয়া সুযোগ-সুবিধায় এখানকার শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর একশো ৭০টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে। এর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিশ্বের বিভিন্ন চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের ব্যবস্থা করা হয় এল এফ এস থেকে। শিক্ষার্থীরা সহজেই যুক্তরাজ্য ও এর বাইরের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারে।

এল এফ এস-এর পাঠ্যক্রমে শিক্ষার্থীদের পেশাগত উৎকর্ষ অর্জন, সৃজনশীলতা বৃদ্ধি, ব্যবহারিক কাজে সক্ষমতা গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হয়। দক্ষ, অভিজ্ঞ ও সৃজনশীল শিক্ষকরা সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও কারিগরি যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে শিক্ষার্থীদের এসব বৈশিষ্ট্য অর্জনে সহায়তা করেন। শিক্ষক, শিক্ষার্থীর যৌথ প্রচেষ্টার একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নেয় তারা চলচ্চিত্র-নির্মাণের ঠিক কোন্ শাখায় (পরিচালনা, ক্যামেরা-সঞ্চালন, সম্পাদনা, সেট নির্মাণ, শব্দ প্রকৌশল) কাজ করবে।

যুক্তরাজ্য সরকারের অডিও-ভিজ্যুয়াল বিষয়ে প্রশিক্ষণ সম্পর্কিত সংস্থা ক্রিয়েটিভ স্কিলসেট(Creative Skillset) দেশটিতে সবচেয়ে ভালো চলচ্চিত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে যে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে মূল্যায়ন করেছে তার মধ্যে লন্ডন চলচ্চিত্র স্কুল অন্যতম। সরকারের পক্ষে ক্রিয়েটিভ স্কিলসেট কেবল সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকেই নির্বাচন করে, যারা চলচ্চিত্র বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণ দিতে সক্ষম।

এল এফ এস প্রযুক্তি পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে নিয়মিতভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির বিস্তার এবং উন্নয়নে কাজ করে থাকে। এছাড়া নির্দিষ্ট করে প্রতিটি বিভাগ আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে সাজানো। শিক্ষার্থীরা চাইলেই যেকোনো সময় ভার্চুয়াল দুনিয়া থেকে প্রযুক্তিগত ম্যানুয়াল, পাঠ্যসূচি, কোর্স বিবরণ, ফরম, আইনগত চুক্তি, স্কুলের নিয়ম-কানুন এবং অন্যান্য নথি দেখতে, ডাউনলোড করতে এমনকি মুদ্রণও করতে পারে। এছাড়া কোর্স শিক্ষকের সঙ্গে ভার্চুয়ালি যোগাযোগের মাধ্যমে শিক্ষা কর্মকাণ্ডেও অংশ নিতে পারে। এখানে চলচ্চিত্র-নির্মাণ, নাটক ও চিত্রনাট্য অনুশীলনের জন্য রয়েছে নিজস্ব দুটি স্টুডিও। এছাড়া ৩৫ ও ১৬ মিলিমিটার এবং ডিজিটাল প্রক্ষেপণ সুবিধাসহ একশো ১০ ও ৩৫ আসনের দুটি প্রেক্ষাগৃহও রয়েছে।

এল এফ এস-এর ডিজাইন বিভাগ সাজানো হয়েছে সর্বাধুনিক চিত্রাঙ্কন বোর্ড, ভিজ্যুয়াল রেফারেন্স গ্রন্থাগার, ব্যবহারিক গ্রন্থাগারের সমন্বয়ে। ডলবি ডিজিটাল মিক্সের সাউন্ড ট্র্যাক প্রস্তুতির জন্য Protol 24HD work station, ধারাভাষ্য ও ফলি রেকর্ডিং এলাকা, সাউন্ড ইফেক্ট আর্কাইভের সমন্বয়ে এল এফ এস-এর রয়েছে পূর্ণাঙ্গ একটি সাউন্ড বিভাগ। যেখানে শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে সাউন্ড বিষয়ে শিক্ষা লাভ করতে পারে।

ক্যামেরা-সঞ্চালনায়ও রয়েছে হাতে-কলমে শিক্ষার ব্যবস্থা। স্নাতকোত্তর প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ১৬ মি মি ও ডিজিটাল ফরম্যাটের দুটি করে তথ্যচিত্র নির্মাণ ও গবেষণা প্রকল্পের জন্য প্রাইম লেন্সসহ আটটি অ্যাটন (Aaton) ক্যামেরা রয়েছে। দ্বিতীয় বর্ষে শিক্ষার্থীরা অনুশীলনের জন্য পান ৩৫ মি মি ক্যামেরা এবং ডিজিটাল ফরম্যাটের জন্য অ্যালেক্সা ক্যামেরা। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ সম্পাদনা বিভাগ রয়েছে। এ বিভাগে ডিজিটাল ও অ্যানালগ উভয় পদ্ধতিতেই শিক্ষার্থীরা চলচ্চিত্র সম্পাদনা শিখতে পারে।

এল এফ এস-এ রয়েছে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার। স্কুলের প্রয়োজনীয় নথিসহ সেখানে সংরক্ষিত রয়েছে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন বই, জার্নাল, সংবাদপত্র। এছাড়াও শিক্ষার্থীরা ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটের (বি এফ আই ) রেফারেন্স গ্রন্থাগার ও লন্ডন মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি গ্রন্থাগার ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে থাকে।

যা পড়ানো হয়

চলচ্চিত্র এমন একটি শিল্পমাধ্যম যা সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, আলোকচিত্র, নাট্যকলা ইত্যাদি মৌলিক মাধ্যমের যৌগিক সমাহারে গঠিত। আবার একটি চলচ্চিত্র-নির্মাণে পরিচালক প্রধান ও মুখ্য ভূমিকা পালন করলেও এ শিল্পে চিত্রনাট্যকার, আলোকচিত্রী, শিল্পনির্দেশক, সঙ্গীত পরিচালক, সম্পাদক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, এমনকি একজন স্পটবয়ের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অর্থাৎ, এটি সম্মিলিত প্রচেষ্টার একটি যৌথ শিল্প। সেজন্য এল এফ এস চলচ্চিত্র-নির্মাণের আঙ্গিক ও প্রকরণের সব দিক বিবেচনায় রেখে চলচ্চিত্র-নির্মাণ, চিত্রনাট্য রচনা ও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র ব্যবসায় শুধু স্নাতকোত্তর কোর্স চালু করে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা চাইলে চলচ্চিত্রের যেকোনো শাখায় স্বল্পমাত্রায় প্রশিক্ষণসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে পারবে।

চলচ্চিত্র-নির্মাণ বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্সটি দুই বছর মেয়াদি। এই কোর্সে শিক্ষার্থীরা বছরের দুইটি সেশনে ভর্তি হতে পারেস্প্রিং (জানুয়ারি) ও অটাম (সেপ্টেম্বর)। এতে নির্দেশনা, ক্যামেরা-সঞ্চালন, সম্পাদনা, শব্দ প্রকৌশল, সেট নির্মাণ, চিত্রনাট্য রচনা, প্রযোজনা, সঙ্গীত ও প্রদর্শন বিষয়ে পড়ানো হয়। আগ্রহের ভিত্তিতে এর থেকে যেকোনো একটি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের গুরুত্বারোপ করা হয়।

অন্যদিকে চিত্রনাট্য রচনা বিষয়ে এক বছর মেয়াদি একটি স্নাতকোত্তর কোর্স করানো হয়। শিক্ষার্থীরা কেবল অটাম (সেপ্টম্বর) সেশনে ভর্তি হতে পারে এ কোর্সে। পেশাদার অভিনেতা, পরিচালক, সঙ্গীতজ্ঞ, সম্পাদক ও প্রযোজকদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় শিক্ষার্থীদের চিত্রনাট্য রচনা বিষয়ে জ্ঞান দেওয়া হয় এ কোর্সের অধীনে।

চলচ্চিত্র তো তৈরি হলো, এবার সেটাকে পৌঁছাতে হবে দর্শকের কাছে। যতো ভালোভাবে চলচ্চিত্র দর্শকের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে, তার ওপর নির্ভর করবে ব্যবসা। এ বিষয়ে এল এফ এস-এ আছে এক বছর মেয়াদি স্নাতকোত্তর কোর্স। কোর্সটি এক্সটার বিশ্ববিদ্যালয়ের (Exeter University) চলচ্চিত্র বিভাগের ব্যবসা স্কুলের সঙ্গে অংশীদারি ভিত্তিতে পড়ানো হয়। এ কোর্সে চলচ্চিত্র বিতরণ, বিপণন, অর্থায়ন, প্রোগ্রামিং, প্রদর্শন, ডিজিটাল প্রদর্শন কৌশল, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় চলচ্চিত্রের মধ্যে সম্পর্ক, বিদেশে চলচ্চিত্র-নির্মাণ ও বিপণন বিষয়ে পড়ানো হয়।

এছাড়াও শিক্ষার্থীদের প্রায়োগিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য এল এফ এস নিয়মিত নানা কর্মশালার আয়োজন করে। এতে পরিচালনা, প্রযোজনা, চিত্রনাট্য রচনা, টেলিভিশন প্রোডাকশন, সিনেমাটোগ্রাফি, ডিজাইন, সম্পাদনা, সঙ্গীত ও শব্দ, পোস্ট প্রোডাকশন, স্ক্রিপ্ট সুপারভিশন, বিক্রয়, বিপণন ও বিতরণ, তথ্যচিত্র, ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট, কাস্টিং ইত্যাদি বিষয়ে প্রায়োগিক জ্ঞান দেওয়া হয়। এছাড়া কোনো শিক্ষার্থী চাইলে চলচ্চিত্র বিষয়ে উচ্চতর গবেষণা (পিএইচ ডি) করতে পারবে।

আবেদন ও ভর্তি 

আপনি যদি লন্ডন চলচ্চিত্র স্কুলে ভর্তি হতে চান, তাহলে আপনার তিন বছর মেয়াদি বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি অথবা প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে পেশাদারি দক্ষতা থাকতে হবে। এছাড়া ক্লাস লেকচার বুঝতে ও অনুসরণ করতে ইংরেজি ভাষায় সহজে ও অনর্গল কথা বলা ও লেখার দক্ষতাও থাকতে হবে। এক্ষেত্রে TOEFL গ্রেড ন্যূনতম পাঁচশো ৫০ অথবা IELTS এ ন্যূনতম ছয় থাকতে হবে কিংবা ক্যামব্রিজ প্রফিসিয়েন্সি গ্রেড সি সার্টিফিকেট লাগবে।

এল এফ এস-এ ভর্তি হওয়ার জন্য যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী শিক্ষার্থীদের সাক্ষাৎকারের জন্য অবশ্য স্বশরীরে উপস্থিত হতে হবে। বিদেশি শিক্ষার্থীরা যারা আবেদনপত্র তোলার জন্য মনস্থ করেছেন বা জমা দিয়েছেন, সাক্ষাৎকারের জন্য তাদেরকেও যুক্তরাজ্যে যেতে হবে। তবে স্কুল কর্তৃপক্ষ চাইলে টেলিফোন ও স্কাইপ-এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সাক্ষাৎকার নিতে পারেন।

সরাসরি চলচ্চিত্র-নির্মাণ কোর্সে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের থিয়েটার, সাংবাদিকতা, ফটোগ্রাফি, গ্রাফিক ডিজাইন বিষয়ের যে কোনোটিতে শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে। তবে এসব বিষয়ে যাদের অ্যাকাডেমিক শিক্ষা নেই, কিন্তু পেশাদারি যোগ্যতা রয়েছে তারাও আবেদন করতে পারবে। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে চলচ্চিত্র-নির্মাণ কোর্সে ভর্তিচ্ছুরা ৫০ পাউন্ড দিয়ে ইন্টারনেট থেকে আবেদনপত্র সংগ্রহ করতে পারবে। এরপর তা পূরণ করে যথাযথ রেফারেন্সসহ পাঠাতে হবে। এছাড়া ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী এই কোর্সকে কেনো উপযুক্ত মনে করেন এবং তার ভবিষৎ পরিকল্পনা কী, তা সাড়ে সাতশো শব্দের মধ্যে লিখে পাঠাতে হবে আবেদন পত্রের সঙ্গেই। যদি আবেদনকারীর সঙ্গীত, থিয়েটার, ভিডিও, সাউন্ড রেকর্ডিং, পেইন্টিং, ভাস্কর্য, গ্রাফিক, ফটোগ্রাফি ইত্যাদি কোনো বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকে, তার বিস্তারিত বর্ণনা ও প্রমাণপত্র আবেদনপত্রে যোগ করতে হবে।

এছাড়া তিন মিনিটের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট পাঠাতে হবে। এর শট্ সংখ্যা হতে হবে ২০ থেকে ৩০-এর মধ্যে; স্কেচ এঁকে অথবা স্থিরচিত্রের মাধ্যমে প্রতিটি শট্ বিভাজন করে দেখাতে হবে।

যোগাযোগ

আগ্রহীরা নিম্নলিখিত ঠিকানায় এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন এবং জেনে নিতে পারেন আরো তথ্য

The London Film School
24 Shelton Street
London WC2H 9UB
United Kingdom
T: +44(0)207 836 9642
F: +44(0)207 497 3718

এছাড়াও স্কুলটির ওয়েবসাইট www.lfs.org.uk থেকে ভর্তি ও বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে।

 

লেখক : মোহাম্মদ আলী মানিক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।

manikmcjru@gmail.com

 

পাঠ সহায়িকা

দাশগুপ্ত, ধীমান (২০০৬); চলচ্চিত্রের অভিধান; বাণীশিল্প, কলকাতা।

http://www.history.uk.com/history/a-brief-history-british-film-indust/

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন