সিহাব কায়সার প্রীতম
প্রকাশিত ২৬ জানুয়ারী ২০২৩ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
সাইবার বুলিং : নিউমিডিয়ার ‘নিউ টিজিং’
সিহাব কায়সার প্রীতম

২০১৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর, সকাল। রেবেকা অ্যান সেডউইক-এর শোওয়ার ঘরে যত্রতত্র স্তুপ করে রাখা জিনিসপত্র। স্কুলের উদ্দেশে ঘর ছাড়ার আগে সেডউইক তার বইপত্রগুলো একদলা কাপড়ের নীচে লুকিয়ে রাখে; সঙ্গে মুঠোফোনটিও। তার আগে অবশ্য ফোনটির অ্যাপ্লিকেশন কিক মেসেঞ্জারে গিয়ে তার প্রোফাইল নাম পরিবর্তন করে রাখে ‘দ্যাট ডেড গার্ল’। এটি সেই ফোন যার ভিতরে আছে একটি আত্মনিপীড়িত ভার্চুয়াল দুনিয়া। সবশেষে দুজন বন্ধুর কাছে ‘গুডবাই ফরএভার’ লিখে একটি মেসেজও পাঠিয়ে দেয় সেডউইক। এরপর ঘর থেকে বের হয়ে সে একটি পরিত্যক্ত সিমেন্ট কারখানার চূড়ায় ওঠে। এরপর ওখান থেকেই মাটিতে লাফ দেয় সে।১ তার পর?
তার পরই মূলত সেডউইক-এর আত্মহত্যার কাহিনিটি পুরো মার্কিন মুল্লুকে আলোড়ন তোলে। এটি আসলে সাইবার দুনিয়ায় নিপীড়নের শিকার ১২ বছরের এক মার্কিন কিশোরীকে হারিয়ে ফেলার নির্মম গল্প, এক কিশোরীর আত্মহত্যার করুণ কাহিনি। শুধু একজন সেডউইক-ই নয়, সারা পৃথিবীতে এ রকম হাজারো সেডউইক-এর গল্প তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত, শুধু অনলাইন নিপীড়নের কারণে। যাকে আমরা বলছি সাইবার বুলিং।
বিশ্বায়নের মাধ্যমে প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তারের ফলে ইন্টারনেট এখন সবার হাতে হাতে। এর ইতিবাচক ব্যবহার পৃথিবীকে যেমন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অনেক দূর, বিপরীতে কেউ কেউ ব্যবহারিক সহজলভ্যতাকে কাজে লাগিয়ে এটির অপব্যবহারও করছে; ফলে সমাজে তৈরি হচ্ছে নানা সঙ্কট। সাইবার বুলিং এই অপব্যবহারের ফলে উৎপন্ন এক সঙ্কট। সঙ্কটটি দিন দিন সারাবিশ্বের টিনএজার, বিশেষ করে নারীদের জীবনকে যেভাবে দুর্বিষহ করে তুলছে তা খুবই দুশ্চিন্তার। এখন এটি বৈশ্বিক সঙ্কট। তাই বিষয়টি নিয়ে কিছু লেখার তাড়না অনুভব করছি। তবে মূল আলোচনার আগে সাইবার বুলিং সম্পর্কে একটু ধারণা নেওয়া যাক।
ইট’স নেম সাইবার বুলিং বাট কজেস হিউম্যান কিলিং
সাইবার অর্থ কম্পিউটার, প্রযুক্তি ও ভার্চুয়াল সংক্রান্ত বিষয়। বুলিং মানে কাউকে উৎপীড়ন করা। অর্থাৎ সাইবার বুলিং হলো তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ভার্চুয়াল জগতে কাউকে উৎপীড়ন করা। অন্যভাবে বললে, সাইবার বুলিং হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির নেতিবাচক ব্যবহার, যা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ, আঘাতমূলক আচরণকে উৎসাহিত করে। একে অনেকে সাইবার স্টকিং-ও বলে থাকেন।২ যদিও আগে এই বিষয়টি শুধু শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হতো, কিন্তু নারীরাই এখন বুলিংকারীদের প্রধান লক্ষ্য।
বুলিংকারীরা এই কাজটি নানা উপায়ে করে থাকে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বাইরেও মুঠোফোন বা ই-মেইলের মাধ্যমে অশ্লীল ও হুমকিমূলক বার্তা পাঠানো হয়। এছাড়া ইন্টারনেট চ্যাটরুমে থাকা অন্যান্য ইউজারকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা কিংবা মানহানিকর ছবি আপলোড করা তো স্বাভাবিক কাজে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো কারো ব্যক্তিগত তথ্য কিংবা তার চরিত্র নিয়ে মিথ্যা ও মানহানিকর তথ্য অনলাইনে শেয়ার করা। আর নেতিবাচক এই উপস্থাপনের কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সামাজিকভাবে হেয় হতে হয়। এমনকি মানসিক চাপ, বিষণ্নতায় ভুগে শেষ পর্যন্ত অনেকেই সেডউইক-এর মতো আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।
‘জলের ওপর পানি না পানির ওপর জল’
প্রশ্ন উঠতে পারে, দৈনন্দিন জীবনের এতো সমস্যা থাকতে ভার্চুয়াল জগৎ নিয়ে কেনো এতো আয়োজন। আসলে বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের একটি বড়ো অংশ যতোটা না বাস্তব জগতে বাস করে তার চেয়ে অনেক বেশি বাস করে ভার্চুয়াল জগতে। সহজ করে বললে, আমাদের জীবন এখন কোরিয়ান চলচ্চিত্র কাস্ট অ্যাওয়ে অন দ্য মুন-এর (২০০৯) নারী চরিত্র কিম জুং ইয়োন-এর মতো হয়ে যাচ্ছে। এই চলচ্চিত্রে ইয়োন স্বেচ্ছা গৃহবন্দিত্ব বরণ করে, কিন্তু কখনো ‘একাকিত্বে’ ভোগে না। কারণ তার আছে হাইটেক প্রযুক্তি ব্যবহারের অনবদ্য ক্ষমতা, যেখানে টাকা-পয়সা কামানো-খরচসহ সবকিছু সে করতে পারে ঘরের মধ্যে থেকেই; সাধারণ মানুষের চেয়ে বিশ্ব প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অনেক বেশি ওয়াকিবহালও থাকে। মোদ্দাকথা, তার পঞ্চেন্দ্রিয় পুরোপুরি নির্ভরশীল প্রযুক্তির বিস্ময় টেলিফটো লেন্সের ক্যামেরা ও উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগের ওপর। কী নেই তার! তবে দুঃখ একটাই, ক্যামেরার চোখ দিয়ে সে বাইরের জগতকে দেখে, উপভোগ করে; কিন্তু বাস্তব জীবনের স্পন্দন থেকে সে বঞ্চিত, যেনো সবকিছু থেকেও তার কিছুই নেই।
চলচ্চিত্রের এই গল্প হয়তো এখন অনেকেরই বাস্তব জীবনের গল্প। এই প্রযুক্তি মানুষের মধ্যে তৈরি করছে বিচ্ছিন্নতা; গৃহবন্দি করছে মানুষকে। এই জগতই এখন তাদের আসল জগৎ। অর্থাৎ বাস্তব জগতের মানবীয় মিথস্ক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন যান্ত্রিক ‘এই মানুষ মনমরা মানুষ, হাঁটে, কথা বলে, যন্ত্রের মতো, তার মন নেই, এমনকি মনের জন্য হাহাকারও সহসা চোখে পড়ে না।’৩ যতো অনুভূতি, সামাজিকতা, প্রয়োজনীয়তা আছে—এর সবকিছুই ব্যক্তি এখন ভার্চুয়াল জগতে মিটায়।
এমনকি পাশের বাড়ির লোকটির সঙ্গে যোগাযোগ থেকে শুরু করে মৃত পিতার শেষ দর্শনও অনেকে দেশের বাইরে থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে করছে। তাছাড়া চলচ্চিত্রের ওই মেয়েটির মতোই পড়াশোনা, জামা-কাপড়সহ যেকোনো পণ্যের চাহিদার কথা চালডাল ডট কম, রকমারি ডট কম কিংবা ই-হাটবাজার ডট কম জাতীয় অনলাইন পোর্টালে জানালেই বাড়িতে বসে পেয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ বাস্তব জগৎ আর ভার্চুয়াল জগতের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য এখন আর করা যাচ্ছে না! আধুনিক প্রযুক্তির ‘কল্যাণে’ বাস্তব জগতকে ক্রমশই বশ করে চলেছে এই ভার্চুয়াল জগৎ।
‘আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল’
সাইবার বুলিং : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ
এদেশে গত কয়েক বছরের সবচেয়ে বেশি বার উচ্চারিত শব্দ সম্ভবত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদের নির্বাচনি প্রচারণা থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন সরকারেরও অধিক গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা বাংলাদেশকে পুরোপুরি ডিজিটাল অর্থাৎ ইন্টারনেটভিত্তিক একটি রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা। এরই ধারাবাহিকতায় কিছুদিন আগে একসঙ্গে ২৫ হাজার ওয়েবসাইট খুলে দেশটি বিশ্ব রেকর্ডও গড়তে যাচ্ছে।৪ বি টি আর সি’র হিসাবে, চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা তিন কোটি ৭০ লক্ষ। এর মধ্যে ৩৩ লক্ষেরও বেশি মানুষ ফেইসবুক ব্যবহার করে।৫ আর, বিশাল সংখ্যক এই ব্যবহারকারীর একটি বড়ো অংশ নারী। প্রশ্ন উঠতে পারে, নারী এতো মাত্রায় কেনো ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে?
যে দেশে অনুশাসন, পুরুষালি আইন ও ধর্মীয় ফতোয়া দিয়ে চলে নারীকে বৃত্তবন্দি করার চেষ্টা; যে দেশে নারী বাইরে বের হলে হেনস্তার আশঙ্কা করতে হয়, ভুগতে হয় নিরাপত্তাহীনতায়, সেখানে ভার্চুয়াল জগৎ নারীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হয়ে উঠতেই পারে। কারণ মুঠোফোন, কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার ফলে ইচ্ছা করলেই নারী এখন অন্য সবার মতো এই জগতে অনায়াসে ঘোচাতে পারে নিঃসঙ্গতা, মিটাতে পারে প্রয়োজন। কিন্তু সেখানেও আজ দেখা দিয়েছে বিপত্তি; পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কাছে তাদের হতে হচ্ছে ভার্চুয়াল যৌন হয়রানি (ইভ টিজিং) তথা সাইবার বুলিংয়ের শিকার। বি টি আর সি’র হিসাব মতে, সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৭৫ শতাংশ হয়রানি হয় ফেইসবুকের মাধ্যমে, ১৫ শতাংশ হয় বিভিন্ন ব্লগ ও পর্নো সাইটের মাধ্যমে।৬
সম্প্রতি জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইউ এন উইমেন-এর এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ৭৬ শতাংশ নারী শিক্ষার্থীরা যৌন হয়রানির শিকার হয়। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ মুঠোফোনে কল ও খুদেবার্তার মাধ্যমে এবং ৬ শতাংশ ইন্টারনেটের মাধ্যমে। অর্থাৎ হয়রানি হওয়া ছাত্রীদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ সাইবার বুলিংয়ের মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হয়। আশঙ্কার অন্যতম কারণ হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও এই হয়রানির সঙ্গে যুক্ত।৭ সাইবার বুলিং বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলে সেটি জানার জন্য ১০ জনের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। এরা সবাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থী। নমুনায়িত এই ১০ জন কোনো না কোনোভাবে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন। এক্ষেত্রে প্রথম বর্ষ থেকে কাউকে পাওয়া যায়নি, দ্বিতীয় বর্ষের একজন, তৃতীয় বর্ষের তিনজন, চতুর্থ বর্ষের দুইজন, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে তিনজন এবং স্নাতকোত্তর পরীক্ষা শেষ করেছেন এমন একজনের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে।
কতো রঙ্গ জানো রে পুরুষ
‘Facebook helps you connect and share with the people in your life.’—এটি ভার্চুয়াল প্রচ্ছদে লেখা ফেইসবুক-এর প্রথম বাণী। এই বাণীতে সাড়া দিয়ে কোটি কোটি মানুষ তাদের আবেগ-অনুভূতির প্রকাশও করছে এতে। তবে ‘একাকিত্ব আর অস্থিরতা, মন খারাপ আর যন্ত্রণা, বিবর্ণতা আর বিষণ্নতা যতোটা পাওয়া যায় ফেইসবুকের স্ট্যাটাসে ততোটা পাওয়া যায় না আনন্দের খবর। ...নিও লিবারেল বাস্তবতায় বাজারি লেনদেন আর বেচাকেনার যুগে আমরা কেউ ভালো নেই। ...এই একাকিত্ব ঘোচাতে অনেক তরুণ তরুণী রাতভর (ফেইসবুকে) বসে থাকে।’৮
তবে বাস্তব জগতের মতো ফেইসবুকেও পুঁজি আর পুরুষের দাপট খেয়াল করা যায়। ‘সুন্দর নারী’ মানেই আলোচনার ক্ষেত্র, মনের খোরাক মিটানোর কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। নারীকে প্রতিনিয়ত অশ্লীল, অপরাধ ও হুমকিমূলক বার্তার দ্বারা হয়রানি করা যেনো ভার্চুয়াল দুনিয়ার কাছে পুরুষের প্রতিশ্রুতি। যে ১০ জনের সঙ্গে কথা হয়েছে তাদের সাতজন এই ধরনের হয়রানির শিকার। বার্তাগুলো কে পাঠায় এবং এর কথাগুলো কেমন থাকে—এমন প্রশ্নে সবার উত্তর মোটামুটি এ রকম—‘অপ্রয়োজনে অপরিচিত, আধা-পরিচিতরা ইনবক্সে মেসেজ পাঠায়, অনেক সময় চ্যাটবক্সে পরিচিত বড়ো ভাইয়ের আই ডি থেকে আজেবাজে কথা বলা হয়। আর কয়েক দিনের ফ্রেন্ড, সে আমার খোলামেলা ছবি চায়!’
এছাড়া, নমুনায়িত ১০ জনের চারজনই ছবির দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছেন। যে ছবিগুলো তাদেরকে ট্যাগ বা ওয়ালে পোস্ট করা হয়েছে, তা যে শুধু তাদের ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা বন্ধুরাই করেছে তা নয়, অপরিচিতরাও করেছে। একজনের বক্তব্য এ রকম—‘আমার বন্ধু নয়, এমন একজন ব্যক্তি আমাকে খুবই বাজে একটি ছবি ট্যাগ করেছিলো।’
অন্যদিকে, নমুনায়িত ১০ জনের ছয়জনই ছবি, স্ট্যাটাসে অশ্লীল কিংবা কুরুচিপূর্ণ কমেন্টের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। এ সম্পর্কে তাদের সবারই প্রথম কথা, ‘সব কথা বলার মতো নয়।’ তার পরও তারা এ সম্পর্কে যে কথাগুলো বলেছেন সেগুলো এমন—যদি প্রোফাইল পিক (ছবি) দিই তাহলে সেখানে কমেন্টের বন্যা বয়ে যায়। যেমন, ‘অনেক সেক্সি লাগছে’, ‘তোমার ঠোঁট অনেক সুন্দর তো’, ‘জান পাখি’, ‘ময়না পাখি’ ইত্যাদি।
এর বাইরে আরেকভাবে বুলিংয়ের শিকার হন নারী। নমুনায়িত ১০ জনের তিনজন বলেন, তাদের নামে ভুয়া আই ডি খুলে হয়রানি করা হয়েছে। বুলিংকারীরা এক্ষেত্রে নিজেদের ছবি প্রোফাইলে না রেখে অন্য আরেকজনের ছবি ব্যবহারের মাধ্যমে আপত্তিকর চ্যাট করে, অশালীন মন্তব্য করে। এই আই ডি থেকে যে পোস্টগুলো করা হয়েছে তাও অনেক আপত্তিকর ও কুরুচিপূর্ণ। এর বাইরেও নানাভাবে নমুনায়িত ১০ জনের প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন। যেমন : অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা, বিভিন্ন আই ডি থেকে ‘পোক মারা’, বাজে পেইজে লাইক মারতে বলা, অনুমতি না নিয়েই বিভিন্ন গ্রুপে তাদেরকে সংযুক্ত করা ইত্যাদি। নমুনায়িত ১০ জনের একজন অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছেন। এ সম্পর্কে তার ভাষ্য, ‘আমার অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা হয়েছিলো, সেখানে চ্যাটিং থেকে শুরু করে আমার পোস্ট করা ছবি পুনরায় বিকৃতভাবে সম্পাদনা পর্যন্ত করা হয়েছে।’
‘যার জন্য হয়েছি এই দণ্ডধারী’
প্রভাবের কথা বলতে গিয়ে নমুনায়িত ১০ জনের সবাই বলেন, রাস্তাঘাটে হয়রানি আর ফেইসবুকে বুলিংয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তারা এটাকেও একধরনের যৌন হয়রানি মনে করেন। কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, এক্ষেত্রেও মনের ওপর প্রচণ্ড খারাপ প্রভাব পড়ে। একজন বলেন, ‘রাস্তাঘাটে আমরা যখন হয়রানির শিকার হই, তখন কারো না কারো সামনে বিষয়টি ঘটে। সেটা যেমন খুবই খারাপ লাগার বিষয়, ফেইসবুকেও অনেক বন্ধুর সামনে বিষয়টি ঘটার ফলে সেটাও খারাপ লাগে। যা মানসিক অবস্থাকে বিপর্যস্ত করে দেয়।’ কারণ বাজে ছবি ট্যাগ বা পোস্ট করলে সেই ছবিটি ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা সবাই দেখতে পায়। নমুনায়িত আরেকজনের মতে, ‘এটা একটা মেয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট করে দেয়। কারণ ফেইসবুকের বন্ধু তালিকায় শিক্ষক, বড়ো ভাই, ছোটো ভাইসহ অনেকে থাকে; তারা এই বিষয়টাকে খারাপভাবে নেয়।’ বাজে ছবি ট্যাগ করা প্রসঙ্গে আরেকজন বলেন, ‘আমাকে খুব বাজে একটা ছবি ট্যাগ করা হয়েছিলো। এটা দেখার পরে আমার এক বন্ধু আমাকে বলেছিলো, এটা তুমি রিমুভ করবা নাকি আমি তোমাকে আমার ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে বাদ দিবো?’ একইভাবে আজেবাজে মন্তব্য করার কারণে নমুনায়িত একজন শিক্ষার্থীকে বন্ধুদের কাছে ভয়ঙ্কর এক সমস্যায় পড়তে হয়েছিলো। যদিও সেটা তিনি বলতে রাজি হননি।
এছাড়া অ্যাকাউন্ট হ্যাক করার মাধ্যমেও নমুনায়িত ১০ জনের একজনকে অপরিচিত অনেকের কাছে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। এ নিয়ে তাকে নানাধরনের সমস্যায় পড়তে হয়েছিলো। বিষয়টি তার ভাষায়, ‘আমার জন্য সেটা খুব অস্বস্তিকর একটা ব্যাপার ছিলো এবং এটা আমার সম্মানে লাগার মতো একটি বিষয়। আমার সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিলো। ...আমি আমার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুদের কাছে খারাপ হয়ে যাচ্ছিলাম।’ এর বাইরে অনুমতি না নিয়ে নাম, ছবি, মুঠোফোন নম্বরসহ পুরো ঠিকানা দেওয়ার ফলে মুঠোফোন কিংবা বাড়ির ঠিকানায় চিঠি চলে আসার মতো ঘটনাও ঘটে।
সাইবার বুলিংয়ের নেপথ্যে
ইংরেজ এক দার্শনিক বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাই, সেখানে দেখি একজন কবি আগেই বসে আছেন।’ এ কথাটি গণমাধ্যম বিকশিত হওয়ার অনেক দিন আগের কথা। কিন্তু আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন তাহলে হয়তো বলতেন, পৃথিবীর তাবৎ গণমাধ্যমের যে দিকেই তাকাই, সেখানে দেখি নারী ‘বসে’ আছেন। কেননা পুরুষতান্ত্রিক-পুঁজিমুখী এই সময়ের গণমাধ্যমে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত পণ্যটি হলো নারী। ফেইসবুকও এর বাইরে নয়; ‘যে কবি নিজেকে বন্ধুত্বের আহ্বান পাঠাবার সুযোগ থেকে অন্যদের বঞ্চিত রেখেছে সেই কবিকেই দেখি বিভিন্ন ‘সুন্দরী’ নারীদের ওয়ালে গিয়ে ছবি পোস্ট করে আসছে। কেউ কেউ নোট লিখে এমনভাবে শুধুই মেয়েদের ট্যাগ করে রাখে যেন ফেইসবুকের সমস্ত ছেলেরা অক্ষর-বঞ্চিত। ...(এমনকি) লেখক হয়ে উঠবার প্রচেষ্টারত পুরুষ তাদের ইন্টারেস্ট হিসেবে শুধুই মেয়েদের কথা জানান দিয়ে রেখেছে প্রফাইল ইনফরমেশনে।’৯ এই হলো নারীর প্রতি আমাদের পুরুষকুলের বুদ্ধিজীবীয় চৈতন্য।
কিন্তু এর প্রধান কারণ কী? এক কথায় কারণটা হলো পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব। পুরুষ নারীকে নারী হিসেবে দেখতেই অভ্যস্ত, মানুষ হিসেবে নয়। পুরুষের দৃষ্টিতে নারী অবলা, সর্বংসহা, নির্বিবাদী চরিত্র। তাকে যা ইচ্ছা করা যাবে, সে কোনো প্রতিবাদ করবে না—এই মনোভাব সমাজে বিদ্যমান। একপর্যায়ে নারী নিজেও একই মনোভাব পোষণ করে, ফলে তাকে মুখ বুজে সব সহ্য করতে হয়। এতে পুরুষ তাকে আরো পেয়ে বসে। সেটি করতে গিয়েই নারীর প্রতি চলে যতো অন্যায়-অত্যাচার।
নারী নির্যাতনের এই বিষয়গুলো শিশুরা (পুরুষ, নারী যেই হোক) ছোটোবেলা থেকেই অবলোকন করে। বিশেষত যাদের নিজেদের পরিবারের ভিতরেই নারীদের সম্মান দেওয়া হয় না, নির্যাতন করা হয়; সঙ্গে ঘরে থাকা টেলিভিশন, পত্রিকা, রাস্তার বিশাল বিলবোর্ড, ফ্যাশন হাউজের ম্যানিকিন তো আছেই। স্বভাবতই ধীরে ধীরে ওই শিশু চলতি ডিসকোর্সের অংশ হয়ে যায়। এজন্য প্রথমে হয়তো সে বাসার কাজের মেয়ের ওপর অত্যাচার করে। তারপর ছোটো বোনের ওপর নির্যাতন চালায়; এরপর তা পরিবারের গণ্ডি ছাড়িয়ে সমাজের অন্যান্য নারীদের আক্রমণ করে। একপর্যায়ে তার এই পুরুষতান্ত্রিক আচরণ হয়তো একইভাবে ছড়িয়ে পড়ে সাইবার জগতেও।
‘নীতির মা মারা গেছে’
যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সচেতনতার ধোঁয়া তুলে মুঠোফোন অপারেটর ‘রবি’ এবং জুতা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ‘বাটা’র যৌথ একটি বিজ্ঞাপন বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সম্প্রচার হচ্ছে। সেখানে দেখা যায়, কোনো একটি স্কুলের সামনে বাটা কোম্পানির জুতা পরিহিত নারী শিক্ষার্থীরা যৌন হয়রানিকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে। বুঝলাম ‘বাটা’ জুতা পরা মেয়েরা এক হলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ সম্ভব! কিন্তু যারা এই লোগোর জুতা পরে না, তাদের কী হবে? তারা কি প্রতিনিয়ত এর শিকার হবে? রবি নিবেদিত ‘বাটা’র এই বিজ্ঞাপন আদতে কোনো সমাধান দিতে ব্যর্থ।
একইভাবে সাইবার বুলিং ঠেকাতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের ক্ষেত্রেও ওই একই কথা প্রযোজ্য। কেননা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধিত) আইন, ২০১৩ এর ৫৭ ধারা মতে, ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মিথ্যা, অশ্লীল কিছু প্রকাশ করে ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করলে অপরাধীর সর্বনিম্ন সাত বছর ও সর্বোচ্চ ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে এই আইনে সাইবার বুলিংয়ের শিকার অনেকে মামলা করলেও এখন পর্যন্ত কারো বিচার করা সম্ভব হয়নি।১০
আশার কথাই শেষ কথা
‘অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়া ছাড়া প্রিয় সাধ নেই’১১ যেনো এই বুলিংকারীদের। অথচ এই ‘প্রিয় সাধ’ তাদের কাছে টাইমপাস বা বিনোদন হলেও আক্রান্তের জন্য তা মোটেও তা নয়। নির্দোষ মানুষ আত্মহত্যা করছে, অথচ যারা এর সূচনা করছে তারা হয়তো বুঝতেও পারছে না, কীভাবে তারা ‘নির্দোষ’ উক্তিতে একজনকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
সত্য একটি ঘটনা দিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম, আরেকটি সত্য ঘটনা দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনার বাসিন্দা হেলি শিনেডার সাইবার বুলিং করতো। তাকে উচিত শিক্ষা দিতে তার মা একদিন তার (শিনেডার) ছবি একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে পোস্ট করে দেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই যেনো লাভ হচ্ছিলো না। শেষমেষ অন্য একটি উপায় বের করলেন মা কারা শিনেডার। তিনি শিনেডার’কে বাধ্য করলেন বুলিংয়ের কাজে ব্যবহৃত তার অতি পছন্দের আইপ্যাডটি বিক্রি করতে। ঘটনা শুধু এখানেই থেমে থাকেনি, সেই অর্থ তিনি শিনেডার’কে দিয়েই পাঠালেন অ্যান্টি-সাইবার বুলিং চ্যারিটি ফান্ডে। কারণ, কারা শিনেডার-এর আশা, একদিন ঠিক এইভাবেই তিনি তার সন্তানকে সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে রাস্তায় আনতে পারবেন। আশা পূরণ হলো তার, শিনেডার ঠিকই প্ল্যাকার্ডে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সে ভবিষ্যতে আর সাইবার বুলিং করবে না।১২ ইশ্, এমন গল্প যদি সব বুলিংকারীর ক্ষেত্রে হতো!
লেখক : সিহাব কায়সার প্রীতম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
gentle_pritom@yahoo.com
তথ্যসূত্র
১. http://archives.anandabazar.com/archive/1130915/15bigyan1.html
২. http://en.wikipedia.org/wiki/Cyberbullying#Cyberbullying_vs._Cyberstalking
৩. খান, কলিম (১৪০৬ : ২০১ ); ‘সাংস্কৃতিক মহাবিস্ফোরণের অশনিসংকেত’; দিশা থেকে বিদিশায় নতুন সহস্রাব্দের প্রবেশ বার্তা; হাওয়া ঊনপঞ্চাশ প্রকাশনী, কলকাতা।
৪. ‘বাংলাদেশে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ওয়েব পোর্টাল’; প্রথম আলো, ২২ জুন ২০১৪।
৫. ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হয়রানি বেড়ে চলেছে’; প্রথম আলো, ১৯ জুন ২০১৪।
৬. প্রাগুক্ত; প্রথম আলো, ১৯ জুন ২০১৪।
৭. ‘৭৬ শতাংশ ছাত্রীই যৌন হয়রানির শিকার’; প্রথম আলো, ১৩ মার্চ ২০১৪।
৮. অধিকারী, বাধন (২০১২ : ৮৪); ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক : নিও লিবারাল যুগের সম্পর্কের নেটওয়ার্ক’; ক্ষমতা মিডিয়া আর মানুষ; শ্রাবণ প্রকাশনী, ঢাকা।
৯. প্রাগুক্ত; অধিকারী, বাধন (২০১২ : ৮৪)।
১০. প্রাগুক্ত; প্রথম আলো, ১৯ জুন ২০১৪।
১১. ‘অনলাইন মাধ্যমে হয়রানি’; প্রথম আলো, ২০ জুন ২০১৪।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন