নাজমুল রানা
প্রকাশিত ২৬ জানুয়ারী ২০২৩ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশে সানডান্স উৎসব
নাজমুল রানা

শীতের বুড়ি যেখানে দুহাত ভরে হিম বয়ে আনে, চারপাশ ঢেকে দেয় সাদা বরফের চাদরে; সে বরফের উপরেই ঠিকরে পড়ে উষ্ণতার অপ্সরী আবেদনময়ী সোনালি রোদ। এ যেনো পৃথিবীর বুকে এক ছোটো স্বর্গরাজ্য। তাই প্রতিবছরই এমন আবহাওয়া উপভোগ করতে এখানে ছুটে আসেন ভ্রমণপিপাসু, প্রকৃতিপ্রেমী অসংখ্য মানুষ; আসেন মনের আনন্দে সাদা বরফে স্কি করে জীবনকে একটু অন্যভাবে উপভোগ করার জন্য। বলছিলাম আমেরিকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি উটাহ’র পাহাড়বেষ্টিত ছোটো শহর পার্ক সিটির কথা। সবসময় কম-বেশি পর্যটকদের আনাগোনা থাকলেও প্রতিবছর একটি বিশেষ সময়ে পার্ক সিটি সারাবিশ্বের ‘স্বাধীন চলচ্চিত্র’-এর মানুষদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে। উদ্দেশ্য শুধুই স্বাধীন চলচ্চিত্রের গুরুত্ব বিশ্বের মানুষের সামনে তুলে ধরা এবং তা বিকাশে সার্বিক সহায়তা করা। অনুমান করতে পেরেছেন নিশ্চয়ই, বলছি বিশ্বের সর্ববৃহৎ স্বাধীন চলচ্চিত্র উৎসব সানডান্স-এর কথা। প্রতিবছর আমেরিকার পার্ক সিটিতে আসর বসে এ চলচ্চিত্র উৎসবের।
সানডান্স-এর স্বাধীনতামুখী অনন্য বৈশিষ্ট্য শুরু থেকেই বিশ্ববাসীর নজর আটকে রেখেছে। অন্যান্য চলচ্চিত্র উৎসবে যখন প্রচলিত ধারার চলচ্চিত্র নিয়ে মাতামাতি চলে, ঠিক তখন সানডান্স বলে ভিন্ন কথা; স্টুডিওর বাইরে নির্মিত স্বাধীন চলচ্চিত্রের কথা। শুধু কথায় নয়, সব বাধা ছাড়িয়ে চলচ্চিত্রের দ্রুত বিকাশের জন্যও কাজ করে চলেছে সানডান্স। নানাভাবে সহায়তা করছে স্বাধীন চলচ্চিত্রনির্মাতাদের, যারা নিজেদের সৃজনশীলতা ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে নিজের মতো করে নির্মাণ করতে চান চলচ্চিত্র।
প্রতিবছর জানুয়ারিতে পার্ক সিটিতে সানডান্স স্বাধীন চলচ্চিত্রের পসরা সাজিয়ে বসে। অতিথি পাখির মতো খানিক অবসর নিতে এখানে ছুটে আসেন বিখ্যাত তারকারা। মনের আনন্দে, স্বাধীন চিত্তে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি সবার চোখ থাকে সানডান্স-এর রুপালি পর্দায়। স্বাধীন চলচ্চিত্রের কবিদের চলচ্চিত্রিক কাব্যময়তার এ প্রদর্শন চলে ১০ দিনেরও বেশি সময় ধরে। কিন্তু দর্শকের হৃদয়ে এর ছোঁয়া থাকে সারাবছর।
সানডান্স-এর পথ চলার শুরু
তিনজন চলচ্চিত্রপ্রেমী, স্বপ্নচারী মানুষ—স্টার্লিং ভ্যান ওয়েগনেন, জন আর্লি ও সিরিনা হ্যাম্পটন কাটানিয়া’র হাত ধরে পথচলা শুরু এই উৎসবের। তখন অবশ্য এর নাম সানডান্স ছিলো না। স্টার্লিং ভ্যান ওয়েগনেন ছিলেন রবার্ট রেডফোর্ডস কোম্পানির কর্মকর্তা এবং অন্য দু’জন ছিলেন উটাহ অঙ্গরাজ্যের ‘উটাহ চলচ্চিত্র কমিশন’-এর কর্মকর্তা। এদের হাত ধরে ১৯৭৮ সালে প্রথমবারের মতো সল্ট লেক সিটিতে আসর বসে উটাহ (Utah) বা ইউএস চলচ্চিত্র উৎসবের।
সেসময় মূলত তিনটি বিষয়কে সামনে রেখে উটাহ/ইউ এস চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন হতো। প্রথমত, জাতীয় পর্যায়ে এমন একটি চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন করা যাতে নির্মাতারা উটাহ’র প্রতি আকৃষ্ট হয়। দ্বিতীয়ত, আমেরিকার ধ্রুপদী চলচ্চিত্র প্রদর্শন এবং নির্মাতা, সমালোচক ও অন্যান্যদের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ে প্যানেল আলোচনার সুযোগ করে দেওয়া। তৃতীয়ত, হলিউডের বাইরের স্বাধীন নির্মাতাদের চলচ্চিত্র নিয়ে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন, যাতে ব্যাপক দর্শকের সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়।
উদ্দেশ্যগুলোকে সফল করতে উৎসব আয়োজনে সার্বিক সহায়তার জন্য এগিয়ে আসেন রবার্ট রেডফোর্ডস কোম্পানির প্রধান রবার্ট রেডফোর্ড ও উটাহ’র তৎকালীন গভর্নর স্কট এম. ম্যাথিসন। পরে চলচ্চিত্রকার রবার্ট রেডফোর্ডই এ উৎসবের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। (১৯৮১ সালে রেডফোর্ড-এর অরডিনারি পিপল অস্কার পায়, চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য ২০১২ সালে তিনি পেয়েছেন অস্কারের আজীবন সম্মাননা।)
শুরুর দিকে উটাহ/ইউ এস চলচ্চিত্র উৎসবের কার্যক্রম আমেরিকার ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের ধারাবাহিক প্রদর্শন, প্যানেল আলোচনা ও ফ্রাঙ্ক কাপরা (Frank Capra) পুরস্কার দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো। সেসময় নতুন স্বাধীন চলচ্চিত্রগুলো প্রদর্শনের জন্য নির্ধারিত ছিলো খুব অল্প সময়। তার পরও প্রথমবারের উৎসবেই প্রদর্শন করা হয় ডেলিভারেন্স (১৯৭২), অ্যা স্ট্রিটকার নেইম ডিজায়ার (১৯৫১), মিডনাইট কাউবয় (১৯৬৯), মিন স্ট্রিটস (১৯৭৩), দ্য সুইট স্মেল অব সাকসেস (১৯৫৭) নামের বেশ কয়েকটি স্বাধীন চলচ্চিত্র।
উৎসবের অনন্য এই বৈশিষ্ট্যের কারণে শুরু থেকেই তা নির্মাতাদের দৃষ্টি কাড়ে। দিন দিন চলচ্চিত্রের মানুষের কাছে, বিশেষ করে স্বাধীন চলচ্চিত্রের মানুষের কাছে এ উৎসব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সঙ্গে আরো কয়েকটি বিষয় বেশ গুরুত্ব পায়; এর মধ্যে অন্যতম হলো উটাহ’র বাসিন্দা রবার্ট রেডফোর্ডের সংযুক্তি। শুধু তার জড়িয়ে থাকার কারণে উৎসবটি আরো বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়। এছাড়া আমেরিকায় নির্মিত স্বাধীন চলচ্চিত্র প্রদর্শনের তেমন কোনো ভেন্যু না থাকায় নির্মাতারা এমন একটি উৎসব চাচ্ছিলেন।
প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আগ্রহী স্বাধীন চলচ্চিত্রগুলোকে বাছাইয়ের জন্য ১৯৭৮ সালে গ্যারি অ্যালিসন’কে প্রধান করে একটি জুরি বোর্ড গঠন হয়। এর সদস্যরা হলেন—ভারনা ফিল্ডস, লিন উড জি. ডান, ক্যাথরিন রোজ, চার্লস ই. সেলার জুনিয়র, মার্ক রিডেল ও অ্যানথিয়া সিলবার্ট প্রমুখ। ১৯৭৯ সালে উৎসবের
এক বছর মেয়াদি পাইলট প্রোগ্রামের প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ান স্টার্লিং ভ্যান ওয়েগনেন। ওয়েগনেন-এর চলে যাওয়ার পর স্বল্প সময়ের জন্য নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পান জেমস ডব্লিউ. (জিম) ইউরি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তার জায়গায় স্থায়ীভাবে আসেন সিরিনা হ্যাম্পটন কাটানিয়া। উৎসবে ১৯৭৯ সালেই প্রথমবারের মতো ফ্রাঙ্ক কাপরা পুরস্কার চালু হয়। সে বছর এ পুরস্কারটি পান জিমি স্টুয়ার্ট। সিরিনা হ্যাম্পটন কাটানিয়া ১৯৮০ সালে উটাহ ছেড়ে ক্যারিয়ার গঠনের জন্য হলিউডে চলে যান।
১৯৮১ সালে ইউ এস উৎসব স্থানান্তর হয় উটাহ’র পার্ক সিটিতে। সঙ্গে পরিবর্তন আসে উৎসবের সময়সূচির। গ্রীষ্মের শেষভাগ থেকে উৎসবটিকে নিয়ে আসা হয় শীতের মাঝামাঝি সময়ে, অর্থাৎ সেপ্টেম্বরের পরিবর্তে জানুয়ারিতে বসতে শুরু করে উৎসবের আসর। সময় পরিবর্তনের কারণ হিসেবে শীতে উটাহ’য় বিপুল সংখ্যক পর্যটকের উপস্থিতিকে ধরা হয়। উঠতি দর্শকের এই বিশাল উপস্থিতি হলিউডের কাছে উৎসবটিকে আরো বেশি গ্রহণযোগ্য করে। মূলত হলিউড পরিচালক সিডনি পোলার্ক-এর পরামর্শেই আনা হয় সময়সূচির এ পরিবর্তন।
দিনে দিনে উটাহ/ইউ এস উৎসবের জনপ্রিয়তা বাড়লেও উদ্যোক্তারা কেনো জানি সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। মূলত অল্পবিস্তর স্বাধীন চলচ্চিত্র দেখানোর বাইরে তখন ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের প্রদর্শন ও প্যানেল আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো উৎসবের কার্যক্রম। তাই উৎসবটিকে নির্দিষ্ট একটি বৈশিষ্ট্য দিতে আয়োজকরা প্রয়োজন অনুভব করলেন একটি সুসংগঠিত প্রতিষ্ঠানের। বিষয়টি সবচেয়ে বেশি ভাবিয়ে তোলে উৎসবের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান রবার্ট রেডফোর্ডকে। ১৯৮১ সালের কোনো একদিন রেডফোর্ড তার বন্ধু ও সহকর্মীদের একটি দলকে আমন্ত্রণ জানান উটাহ পাহাড়ের পাদদেশে। রেডফোর্ডের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে তারা সেখানে মিলিত হন। সেখানেই আলোচনা হয় স্বাধীন চলচ্চিত্রের গুরুত্ব, নির্মাতাদের নানা সমস্যা এবং সে বিষয়ে করণীয় বিভিন্ন দিক নিয়ে। দীর্ঘ আলোচনার পর স্বাধীন, অনুসন্ধানী ও নবাগত নির্মাতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সর্বসম্মতিক্রমে ১৯৮১ সালেই প্রতিষ্ঠা করা হয় সানডান্স ইন্সটিটিউট। সানডান্স নামটি মূলত এসেছিলো রবার্ট রেডফোর্ড অভিনীত বিখ্যাত চলচ্চিত্র বুচ ক্যাসেডি অ্যান্ড দ্য সানডান্স কিড-এর (১৯৬৯) জনপ্রিয় চরিত্র সানডান্স কিড থেকে।
রবার্ট রেডফোর্ড এ উদ্যোগটি নিয়েছিলেন ইউ এস চলচ্চিত্র উৎসবের সঙ্গে থেকেই। কারণ তিনি চাইতেন স্বাধীন চলচ্চিত্র একটি ভালো জায়গায় দাঁড়াক। তাই সেই বসন্তেই (১৯৮১ সালে) ১০ স্বাধীন নির্মাতাকে সানডান্স ইন্সটিটিউটের ‘ডিরেক্টর ল্যাব’-এ আমন্ত্রণ জানানো হয়। যারা স্বাধীন চলচ্চিত্রের প্রজেক্টের আওতায় তাদের মৌলিক গল্পগুলোকে উন্নত করার জন্য কাজ করবে শীর্ষস্থানীয় লেখক ও পরিচালকদের সঙ্গে। এই স্বাধীন চলচ্চিত্র প্রকল্পের ব্যয়ের পুরোটিই বহন করবে সানডান্স ইন্সটিটিউট। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই প্রকল্প থেকে কোনো ধরনের লাভ না করার সিদ্ধান্ত নেয় ইন্সটিটিউট। তাদের উদ্দেশ্য একটিই, স্বাধীন চলচ্চিত্রের উন্নয়ন ও বিশ্বব্যাপী প্রসার। সেই থেকেই সানডান্স ইন্সটিটিউট কাজ করছে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে।
১৯৮১ সালে সানডান্স ইন্সটিটিউট গঠন হওয়ার পর থেকেই উটাহ/ইউ এস চলচ্চিত্র উৎসব পরিচালনার দায়িত্ব আসে সানডান্স ইন্সটিটিউটের কাঁধে। তবে উৎসব আয়োজনে তারা আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পায় ১৯৮৫ সালে। ততোদিনে অবশ্য সানডান্স-এর ভিত্তি মজবুত হয়ে গেছে। তখন অবশ্য উৎসবটির নাম পরিবর্তন করা হয়নি। তবে লোক মুখে তা সানডান্স চলচ্চিত্র উৎসব বলে পরিচিতি পেতে শুরু করে। আনুষ্ঠানিকভাবে সানডান্স চলচ্চিত্র উৎসব নামকরণ করা হয় ১৯৯১ সালে।
সানডান্স ২০০৯ সালে পদার্পণ করে ২৫ বছরে। সে বছর উৎসবে প্রদর্শন করা হয় দুইশো ১৮টি চলচ্চিত্র। যার মধ্যে ৪২টি ছিলো নির্মাতাদের প্রথম পরিচালনা। ২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি বসে সানডান্সের ৩০তম আসর। এ বছর যাত্রা শুরু হয় সানডান্স কিডস নামে একটি শিশুতোষ চলচ্চিত্র বিভাগের, এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দিবে স্বাধীন চলচ্চিত্রের সঙ্গে। ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপনের জন্য সানডান্স-এ প্রদর্শন করা হয় গত তিন দশকের বিখ্যাত সব স্বাধীন চলচ্চিত্র। যার মধ্যে রয়েছে বিস্টস্ অব দ্য সাউদার্ন ওয়াইল্ড, ফ্রুটভ্যালি স্টেশন, লিটল মিস সানশাইন, অ্যান এডুকেশন, সেক্স,লাইস অ্যান্ড ভিডিওটেপ, রেজারভয়ার ডগস, দ্য কোভ, হেডউইং অ্যান্ড দ্য অ্যাংরি ইঞ্চ, অ্যান ইনকনভেনিয়েন্ট ট্রুথ, প্রিসিয়াস ও নেপোলিয়ন ডিনামাইট প্রভৃতি।
স্বাধীন চলচ্চিত্রের শুরুর কথা
১৯০৮ সাল। আমেরিকায় আত্মপ্রকাশ করে মোশন পিকচার প্যাটেন্টস কোম্পানি (এম পি পি সি) বা এডিসন ট্রাস্ট। লক্ষ্য একটিই, চলচ্চিত্র বাজারের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে ওঠা। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তারা চুক্তি করে তৎকালীন প্রধান চলচ্চিত্র প্রযোজনা, পরিবেশনা ও চলচ্চিত্রের কাঁচামাল সরবরাহকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে। পেয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত সাফল্যও। অল্প সময়ে চলচ্চিত্র পরিবেশনা ও প্রযোজনার একক আধিপত্য চলে আসে তাদের হাতে। চলচ্চিত্রের জন্য যা ছিলো সত্যিই দুঃখজনক। কারণ এডিসন ট্রাস্টের হাতে চলচ্চিত্রের একক আধিপত্য চলে যাওয়ার পর কোনো নির্মাতা চাইলেও আর নিজের মতো করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারছিলেন না। অনেক নির্মাতা বাধ্য হয়ে, কেউ বা স্বেচ্ছায় যোগ দিতে থাকেন এডিসন ট্রাস্টে।
কিন্তু সাহসীরা থেমে থাকেননি। স্বাধীনচেতা, উদ্যমী ও সাহসী কয়েকজন নির্মাতা সিদ্ধান্ত নেন এ ট্রাস্টের বাইরে এসে চলচ্চিত্র-নির্মাণের। এভাবেই পথ চলতে শুরু করে স্বাধীন চলচ্চিত্র। উন্মোচিত হয় নতুন এক চলচ্চিত্র দিগন্তের। স্রোতের বিপরীতে সাঁতরাতে শুরু করে স্বপ্নচারী সাহসী কয়েকজন মানুষ। কারণ তখন এডিসন ট্রাস্টের বিরোধিতা করে টিকে থাকা ছিলো দুষ্কর।
বাজারের একক অধিপতি হওয়ার পর এম পি পি সি মরিয়া হয়ে ওঠে তাদের স্বত্বাধিকারী ক্ষমতার শতভাগ প্রয়োগে। এডিসন ট্রাস্টের বিরোধিতাকারী নির্মাতাদের বিরুদ্ধে ঠুকে দেওয়া হয় মামলা। যদিও পরবর্তী সময়ে কোনো মামলার রায় এডিসন ট্রাস্টের জন্য সুখবর বয়ে আনেনি। ১৯১২ ও ১৯১৫ সালে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের দুটি রায়ে দ্রুতই সমাপ্তি ঘটে কর্তৃত্ববাদী এডিসন ট্রাস্টের। কিন্তু সেটি কেবলই কাগজে-কলমে। বাস্তবে শুধু রূপ বদল হয়, অন্যরূপে থেকেই যায় স্টুডিওতন্ত্রের একক আধিপত্য।
এখনো যেসব ছোটো ছোটো স্টুডিও থেকে স্বাধীন চলচ্চিত্রের অর্থের জোগান দেওয়া হয়, অর্থাৎ যাদেরকে আমরা স্বাধীন চলচ্চিত্রের স্বাধীন প্রযোজক হিসেবে চিনি, তারাও কোনো না কোনোভাবে বড়ো স্টুডিওগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। অনেক ক্ষেত্রে তাদেরই অঙ্গসংগঠন। যাই হোক আশার কথা হলো, তার পরও কিছু স্বাধীন নির্মাতা সব বাধা অতিক্রম করে নির্মাণ করে চলছেন গুরুত্বপূর্ণ সব চলচ্চিত্র। আমেরিকা নিয়ে কথা হলেও গোটা বিশ্বের স্বাধীন চলচ্চিত্রের রূপ প্রায় অভিন্ন।
মূলধারার স্টুডিওতন্ত্রের বাইরে নির্মিত এসব চলচ্চিত্র মূলত অবাণিজ্যিক ও শৈল্পিক মানসম্পন্ন। এর আধেয়, স্টাইল ও কাহিনি মূলধারার চলচ্চিত্র থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্বাধীন চলচ্চিত্রের বাজেটের কিছু অংশ আসে বড়ো স্টুডিওর সহযোগী ছোটো কোনো স্টুডিও থেকে কিংবা পুরো খরচ নির্মাতাই বহন করেন। মনে রাখতে হবে, কোনো চলচ্চিত্রের বাজেটের অর্ধেকের বেশি যদি বড়ো কোনো স্টুডিও থেকে আসে, তবে তা কিন্তু মোটেও স্বাধীন চলচ্চিত্রের মর্যাদা পাবে না। ঐতিহাসিকভাবেই আমেরিকায় স্বাধীন চলচ্চিত্রগুলোকে একটু বেশি মর্যাদার চোখেই দেখা হয়; সেটি সঙ্গত কারণেই। কারণ হলিউডের মতো এতো বড়ো ইন্ডাস্ট্রির বাইরে এসে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা খুব একটি সহজসাধ্য ব্যাপার নয়।
তবে বর্তমানে প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারে স্বাধীন চলচ্চিত্র ধারাও ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ হতে শুরু করেছে। বিশেষ করে ১৯৯০ এবং শূন্য দশকে এসে দ্রুত বিকাশ হয় স্বাধীন চলচ্চিত্রের। কম খরচে সহজলভ্য ডিজিটাল ক্যামেরা, সহজে সম্পাদনা সফটওয়্যার ও উৎসবগুলোয় স্বাধীন চলচ্চিত্র প্রদর্শনের সুযোগ এই পথকে আরো সমৃদ্ধ করেছে।
উদ্দেশ্য যখন শুধুই স্বাধীনতা
শুরুর দিকে সানডান্স উৎসব আমেরিকার স্বাধীন চলচ্চিত্রনির্মাতা, কলাকুশলীদের নিয়ে কাজ করলেও পরবর্তী সময়ে তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। বিশেষ করে সানডান্স ইন্সটিটিউট যখন উটাহ/ইউ এস উৎসবের ভার কাঁধে নেয়, আমেরিকা ছাড়িয়ে তখন তারা খুঁজে বের করতে থাকে বিশ্ব চলচ্চিত্রের স্বাধীন মুখগুলোকে। উদ্দেশ্য, প্রচলিত চলচ্চিত্রের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলা, চলচ্চিত্র শুধু কল্পনানির্ভর সুখের ভুবন নয়; শুধু ব্যবসা বা নিছক বিনোদন নয়; চলচ্চিত্র বাস্তবনির্ভর জীবনমুখী মাধ্যম। যা বিনোদনের মধ্য দিয়ে মানুষকে আন্দোলিত করে। যা মানুষকে স্বপ্ন থেকে নিয়ে যাবে কঠিন বাস্তবতার সম্মিলনে।
সানডান্স ইন্সটিটিউটের কাজ শুধু স্বাধীন নির্মাতাদের উন্নয়ন করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; শিল্পী, স্বাধীন থিয়েটারকর্মীসহ সব বিষয় নিয়ে কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। নির্মাতাদের সহায়তা ও উৎসাহিত করার পাশাপাশি সানডান্স তাদের নতুন চলচ্চিত্রকে দর্শকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কাজটিও করে থাকে। রবার্ট রেডফোর্ড বিষয়টিকে গুছিয়ে বলেন এভাবে,‘থিয়েটারসমূহ ও দর্শকরা মিলে সানডান্স চলচ্চিত্র উৎসব উদ্যাপন করছে, যা স্বাধীন নির্মাতাদের সহায়তা ও উৎসাহিত করার অখণ্ড অংশ।’
প্রতিযোগিতামূলক বিভাগসমূহ
সারাবিশ্বের স্বাধীন নির্মাতাদের চলচ্চিত্রসমূহ কিছু নির্দিষ্ট বিভাগে সানডান্স উৎসবে অংশ নেয়। প্রতিযোগিতামূলক বিভাগগুলোর মধ্যে রয়েছে কাহিনিচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র, বিশ্ব চলচ্চিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এর বাইরে আছে প্রিমিয়ার, স্পেকট্রাম, পার্ক সিটি অ্যাট মিডনাইট ও নিউফ্রন্টিয়ারের মতো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। এসব বিভাগের কোনোটিতে শুধু আমেরিকার আবার কোনোটিতে আমেরিকাসহ বিশ্বের সব দেশের স্বাধীন চলচ্চিত্র অংশ নেয়।
কাহিনিচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র বিভাগ দুটি শুধু আমেরিকার স্বাধীন নির্মাতাদের জন্য নির্দিষ্ট। এখানে শর্ত থাকে সানডান্সেই হতে হবে এসব চলচ্চিত্রের ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার। এ বিভাগে প্রতিযোগিতার জন্য নির্বাচিত হয় মোট ১৬টি চলচ্চিত্র। আমেরিকার স্বাধীন নির্মাতাদেরকে উৎসাহিত করতে সানডান্সের এই বিশেষ আয়োজন।
বিশ্ব চলচ্চিত্র বিভাগে শুরু থেকেই সানডান্স প্রদর্শন করে আসছে বিশ্বের নানা দেশের কাহিনিচিত্র ও নন-ফিকশন ধাঁচের বিখ্যাত স্বাধীন চলচ্চিত্র। এই বিভাগটি দীর্ঘদিন ধরে একেবারেই সীমিত পরিসরে কাজ করছিলো। বিশ্বের অন্যান্য উৎসবগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ২০০৮ সাল থেকে বিভাগটির পরিসর বাড়ানো হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাধীন চলচ্চিত্রগুলো এই বিভাগে কাহিনিচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র—দুভাগে ভাগ হয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এজন্য নির্বাচন করা হয় ২০টি চলচ্চিত্রকে।
প্রচলিত ধারার বাইরে এসে কথা বলতে চায়—এমন নবাগত নির্মাতাদের নিজেদের যোগ্য প্রমাণের প্ল্যাটফর্ম হলো সানডান্সের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগটি। বিভাগটিতে স্বল্পদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে।
প্রিমিয়ার বিভাগে আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বনামধন্য স্বাধীন নির্মাতাদের নতুন চলচ্চিত্র প্রিমিয়ারের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই বিভাগ থেকেই চলচ্চিত্রগুলো বেশিরভাগ সময় তাদের বিশ্ব পরিবেশক পেয়ে যায়। সাধারণত নিরীক্ষামূলক, নতুন চিন্তার শক্তিশালী গল্পের চলচ্চিত্রগুলোকে এই বিভাগের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়।
জুরি বোর্ডের বিচারে যে চলচ্চিত্রগুলো প্রতিযোগিতামূলক বিভাগে মনোনয়ন পায় না, সেগুলোকে সানডান্সের রুপালি পর্দায় দেখানোর সুযোগ করে দেয় স্পেকট্রাম বিভাগটি। এ বিভাগটি মূলত স্বাধীন চলচ্চিত্রনির্মাতাদের মানসিক অবস্থা চাঙা রাখতে ভূমিকা পালন করে থাকে।
সানডান্স উৎসবের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও ঐতিহ্যবাহী বিভাগ হলো পার্ক সিটি অ্যাট মিডনাইট। চলচ্চিত্র প্রদর্শনের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিতে সুনাম রয়েছে এ বিভাগটির। সারাবিশ্ব থেকে আসা চলচ্চিত্রগুলো বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে পার্ক সিটি অ্যাট মিডনাইট-এ প্রদর্শন হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। দর্শকনন্দিত এ বিভাগের সূচনা হয়েছিলো ১৯৯৯ সালে ‘Rags To Riches’ গল্প অবলম্বনে নির্মিত স্বাধীন চলচ্চিত্র The Blair Witch Project-এর মধ্যরাতের প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে। নিউফ্রন্টিয়ার বিভাগটি মূলত চলচ্চিত্র ও মিডিয়ার মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপনের জায়গা, যেখানে চলচ্চিত্রের গবেষণা, মিডিয়ার কার্যক্রম ও ডিজিটাল মিডিয়ার মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করা হয়।
এছাড়াও সানডান্সের রয়েছে নিজস্ব চলচ্চিত্র মহাফেজখানা, যেখানে সংরক্ষিত আছে পাঁচ শতাধিক স্বাধীন চলচ্চিত্র। এই মহাফেজখানায় সংরক্ষণের জন্য প্রতিবছর মাত্র দুটি স্বাধীন চলচ্চিত্রকে নির্বাচন করা হয়।
উপসংহার
পরাধীনতার বাঁধ ভেঙে প্রতিনিয়ত আসুক নতুন জোয়ার। স্বাধীন বৃক্ষ শাখায় ফুটুক নব নব ফুল। ভোরের পাখির কলরবে মুখরিত হোক স্বাধীনতা চত্বর। আবারো নবতরঙ্গ দোলা দিক লক্ষ নবীন প্রাণে। কেটে যাক সব পুরনো আঁধার। ‘খেলা ভাঙার খেলায়’ মাতুক বিশ্ব। চেতনার বাতিঘরে প্রজ্বলিত হোক হাজারো মশাল। নব চেতনার উন্মাদনায় মেতে উঠুক চলচ্চিত্র। সানডান্স প্রতিনিয়ত আমাদের মাঝে নিয়ে আসুক স্বাধীনতার নব এই বারতা। চলুন সবাই মিলে স্বাধীন হিয়ায় গাই স্বাধীন চলচ্চিত্রের জয়গান, ঠিক সানডান্সের মতো। জয় হোক সানডান্সের, জয় হোক মুক্ত চিন্তার, জয় হোক স্বাধীনতার।
লেখক : নাজমুল রানা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
ranamcj.ru@gmail.com
তথ্য সহায়িকা
১. http://www.sundance.org/festival/
২. http://en.wikipedia.org/wiki/Sundance_Film_Festival
৩. www.sundanceguide.net/basics/history/-সহ সানডান্স চলচ্চিত্র উৎসব বিষয়ক বিভিন্ন ওয়েবসাইট।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন