ম্যাজিক লণ্ঠন ডেস্ক
প্রকাশিত ২৪ জানুয়ারী ২০২৩ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
সত্যজিতের চলচ্চিত্রে নায়িকারা
ম্যাজিক লণ্ঠন ডেস্ক
1674556944.jpg)
গত সংখ্যায় (সংখ্যা ৬) ‘ম্যাজিক আড্ডা’ বিভাগে আমরা প্রয়াত নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ স্মরণে পশ্চিমবঙ্গের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচারিত আড্ডার ট্রান্সক্রিপ্ট প্রকাশ করেছিলাম। আমরা মূলত সেই আড্ডার অডিও-ভিজ্যুয়াল আলোচনার একটি লিখিত রূপ দিয়ে পাঠককে ভিন্ন স্বাদ দিতে চেয়েছি। আমাদের সেই চেষ্টা সফল হয়। এ নিয়ে পাঠকদের কাছ থেকে আমরা বেশ সাড়া পেয়েছি। তাই এবারে আমরা ‘সত্যজিতের নায়িকারা’ শিরোনামে ২০১৩ সালে ‘কলকাতা লিটারেরি মিট’ (২০১২ সালের ২৬ জানুয়ারি কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনটি দেশি-বিদেশি লেখকদের সঙ্গে পাঠকের সেতুবন্ধন তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া নিয়মিতভাবে এরা ইতিহাস, খেলাধুলা, ভূ-রাজনীতি ও চলচ্চিত্র নিয়ে বিভিন্ন আড্ডার আয়োজন করে।) আয়োজিত একটি আড্ডার ভিডিও ইউটিউব থেকে সংগ্রহ করে তার ট্রান্সক্রিপ্ট প্রকাশ করছি। আলোচনাটি দীর্ঘ হওয়ায় তা পর্বাকারে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এবার থাকছে প্রথম পর্ব। আগ্রহী পাঠকের যে কেউ চাইলে ইউটিউবে ঢু মেরে আসতে পারেন : পার্ট-১, https://www.youtube.com/watch?v=0MEhqakZX-I এবং পার্ট-২, https://www.youtube.com/watch?v=gR5UZV-tRvQ । [সম্পাদক]
প্রথম কিস্তি
ঋতুপর্ণ ঘোষ : নমস্কার, শুভ সন্ধ্যা। আজকে আমরা যেটা নিয়ে কথা বলতে এসছি মানে যেটা ঠিক করা হয়েছে, সেটা হলো ‘সত্যজিৎ রায়ের নায়িকারা’।আজকে মঞ্চে আমার সঙ্গে তিনজন আছেন—অপর্ণা সেন, মাধবী মুখোপাধ্যায় ও শর্মিলা ঠাকুর। সত্যজিৎ রায় ও তপন সিংহ ছাড়া কেবল আমি এই তিনজনকে ডিরেক্ট করেছি। আমি জানি না, লিটফেস্ট এই হিস্টোরিসিটিটা মাথায় রেখে আমাদের ডেকেছেন কি না। কিন্তু এটা আমার একটা অপরিসীম সৌভাগ্য যে, আমি তিনজনকে একসঙ্গে এক মঞ্চে পেলাম এবং আজ তাদের সঙ্গে কথা বলবো। বিষয়টা ‘সত্যজিৎ রায়ের নায়িকারা’, কিন্তু সেটা যেহেতু একটু ডেকোরেটিভ লাগে, আমি যদি ছড়িয়েনি—সত্যজিৎ রায়ের চোখে মেয়েদের জগৎ। আমি আপনাদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে বিষয়টাকে একটু ছড়িয়ে নিচ্ছি। তাহলে কেবল নায়ক-নায়িকা বলে যে ডিসটিঙ্কশনটা তৈরি করা হয় চরিত্রাভিনেতা থেকে সেটা চলে যায় এবং অনেকেই নায়িকা বলে তার সঙ্গে একটা মানে রোমান্টিক ইন্টারেস্টের যে অনুষঙ্গ কাজ করে সেটাও নষ্ট হয়ে যায়, সেজন্য এটাকে আমি চরিত্র হিসেবে ট্রিট করতে চাই।
এদের তিনজনের সঙ্গে একটা জায়গাতে আমার বিরাট তফাত—এরা সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছেন, আর আমার প্রথম ছবি সেন্সর হবার সাত দিন আগে সত্যজিৎ রায় এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আমার কোনোদিন সৌভাগ্য হয়নি আমার ছবি সত্যজিৎ রায়কে দেখাবার। তাই জন্য, আমার তার তৈরি করা ছবিগুলো জাপটে থেকেই সত্যজিৎ রায়কে চেনা। হয়তো ওনার ছবিতে যারা অভিনয় করেছেন বা যারা আছেন এখানে, তাদের অনেক ঘটনা মনে না থাকলেও সত্যজিৎ রায়কে মনে রাখার দায়িত্বটা আমাকে খুব কনসাসলি নিতে হয়েছে। কারণ ওর কাজ দেখেই আমি একদিন ঠিক করেছিলাম, আমি ছবি বানাবো। প্রথমে আমি প্রত্যেককেই জিজ্ঞেস করি, সত্যজিৎ রায় তাদের কাছে কী? আমি শর্মিলা ঠাকুরকে দিয়ে শুরু করছি।
শর্মিলা ঠাকুর : সত্যজিৎ রায়, হোয়াট ক্যান আই সে? হি উড ইন্ট্রোডিউসড মি টু সিনেমা অ্যান্ড ইফ আই হ্যাডল বিন ফর হিম..., বিকজ আই ডিডেন্ট ওয়ান্ট টু বিকাম অ্যা ফিল্ম অ্যাক্টর, আই ওয়াজ অ্যা স্কুল গার্ল, সো হি ফাউন্ড মি ইনফ্রন্ট অব অ্যা স্কুল অ্যান্ড হি চেঞ্জড মাই লাইফ। হি ইন্ট্রোডিউসড মি টু দিস ওয়ান্ডারফুল ওয়ার্ল্ড অ্যান্ড আই অ্যাম সিটিং হেয়ার অ্যান্ড ইউ আর টকিং টু মি দ্যাটস বিকজ অব হিম। সো হি ওয়াজ মাই মেন্টর সারটেইনলি অ্যান্ড হোয়াট অ্যা প্রিভিলেজ ইট হ্যাজ বিন টু নো হিম প্রোফেশনালি অ্যান্ড পার্সোনালি। সো আই মিন, ইফ ইট হ্যাডল বিন ফর হিম, মাই লাইফ উড হ্যাভ বিন সামথিং এল্স, ইজন্ট ইট? সো অ্যান্ড দেন আই ওয়াজ সো ইয়াং অ্যাট দ্যাট টাইম, আই ওয়াজ থার্টিন। তার মানে যেটা আবিষ্কার করা, সেটা অনেক পরে। যখন আই রিচড অ্যা ম্যাচিউরড এইজ দেন আই লুক ব্যাক অ্যান্ড থিঙ্ক অব মানিক দা, অ্যান্ড হোয়াট আই সি দ্য ফিল্ম অ্যান্ড আই আন্ডারস্ট্যান্ড দ্য ফিল্ম সো মাচ বেটার। ১৩ বছরে আমি কী করে অপুর সংসার বুঝেছি কিংবা আমি কী করেছি, আমি কী করে বুঝবো। কিন্তু ক্যান আই টেল, ডু হ্যাভ দ্য টাইম টু জাস্ট সে সামথিং বিকজ দিস (দর্শক সারি থেকে কে যেনো বললো, বাংলা বলুন)।
সরি, বাংলায়। আমি যখন ক্যাথরিন বলে একজন ভদ্রমহিলা, ফরাসি ভদ্রমহিলা...।
ঋতুপর্ণ : গাছ,গাছ বলে একটা ছবি করেন সৌমিত্রের ওপর।
শর্মিলা : সৌমিত্রের ওপরে একটা ডকুমেন্টারি করছিলেন, তো তখন উনি আমাকে ওই টালার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। তো তখন যখন আমি ওখানে গেলাম মানে বাড়িটা একেবারেই...।
ঋতুপর্ণ : টালার বাড়ি মানে যেখানে অপুর সংসার-এর ছাদ। অপুর সংসার মানে অপুর সংসার অ্যাকচুয়ালি, যে সংসারে অপু রইলো।
শর্মিলা : আর বাড়িটা একদম বদলায়নি জানো মাধবী দি! আর ওখানে আমরা এলাম, তারপর বাড়িটা যেখানে, প্রথমে একটা মানে যেটা কলতলা যেখানে কাপড়-টাপড় কাচাটাচা হয়, তার পরে থ্রু দ্য ভেরি ক্রাউডেড স্টেয়ার কেস..., দেয়ার ওয়াজ নো প্রিভিসি, এভরিবডি ইজ লুকিং অ্যাট ইউ, ইউ নো? ভেরি ভেরি ক্রাউডেড প্লেস, অ্যান্ড ইউ আর ওয়াকিং আপ অ্যান্ড আপ ,আপ অ্যান্ড দেয়ার ইজ নাথিং; দেয়ার ওয়াজ নো প্রিভিসি অ্যাট অল। অ্যান্ড দেন হোয়েন ইউ গো আপ , চিলেকোঠার ঘরে দরজাটা খুললে অ্যাট দ্য মোমেন্ট ইউ এন্টার, এটা একটা ডিফারেন্ট জগৎ অ্যাবসলিউটলি। খোলা ছাদ, একটা ছোট্টো ঘর। সো লুক অ্যাট দ্য পোয়েট্রি, লুক অ্যাট দ্যাট, এভরিডে হোয়েন অপু কামস ব্যাক হোম, হি গোজ আপ থ্রু দ্য ক্রাউড অ্যান্ড হি গোজ আপ দেয়ার অ্যান্ড ইটস আন্ডার দ্য ব্লু স্কাই। দ্যাটস দ্য পোয়েট ইন হিম, ইজ অ্যা লাইফ দেয়ার। ওখানে ও লেখে, ওখানে ও ব্যায়াম করে, ওখানে ও গান গায়।
ঋতুপর্ণ : বৃষ্টিতে ভেজে।
মাধবী মুখোপাধ্যায় : বাঁশি বাজায়।
শর্মিলা : সো, ওখানে ওই ১৩ বছরে আমি ওটা কীভাবে বুঝবো! সো লুকিং ব্যাক, আই হ্যাভ ডিসকাভারড হিম, আই কনটিনিউ টু ডিসকাভার হিম। লাইক অদুর গোপালকৃষ্ণণ সেইজ, দ্য মোর ইউ সি, দ্য মোর ইউ ডিসকাভার হিম, দ্য মোর হি রিভিলস। সো, আই অ্যাম গ্রেট ফ্যান অ্যাবসলিউটলি। এবং থাকবোও। হি মিনস অ্যা লট টু মি।
ঋতুপর্ণ : এটা আমি বুঝতেই পারছি, যারা তিনজন রয়েছেন সত্যজিতের সঙ্গে তাদের সম্পর্কটা এতো গভীর যে, মানে আমার মতো সত্যজিতের সঙ্গে এদের কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক নেই—বিষয়টা এমন নয়। ফলে আজকের এই আলোচনায় এতো বছর পর, আমরা যখন সত্যজিতের কাজ নিয়ে কথা বলবো, তার মধ্যে কিন্তু অনেক বিশ্লেষণও থাকবে এবং কিছুটা ফিরে দেখাও থাকবে। কারণ যার মধ্যে কোনো অ্যানালিসিস নেই, সেই শ্রদ্ধার কোনো মানে হয় না—আমি অন্তত তাই মনে করি। আমরা ওকে দেখে, বুঝে তারপর আমরা আজকে যদি ওকে নিয়ে...।
শর্মিলা : সেটা তো তোমরা ক্রিটিক বাবা, তোমরা দেখো, বোঝো; আমাদের সবার বোঝার কী দরকার, আমাদের তো ভালোবাসাই যথেষ্ট।
ঋতুপর্ণ : আমি চারুলতার কাছে পরে আসছি। কারণ, মানে সত্যজিতের নায়িকা বলতে যিনি আলটিমেট তিনি আমাদের মাঝখানে রয়েছেন। তার আগে আমি অপর্ণা সেন মানে রিনা দি’কে বলবো, কারণ রিনা দি’কে আমি শুধু সত্যজিৎ রায়ের অভিনেত্রী হিসেবে নয়, একজন ফিল্মমেকার হিসেবে সত্যিই সত্যজিৎ রায়কে আজকে তোমার কী মনে হয়? মানে তোকে যদি ছোট্টো করে সামারাইজ করতে বলা হয়।
অপর্ণা সেন : আমার পক্ষেও কিন্তু সত্যজিৎ রায় সম্বন্ধে অবজেক্টিভ হওয়া একটু কঠিন। কারণ এতো ছোটোবেলা থেকে ওকে দেখছি, আমার বাবা-মার বন্ধু ছিলেন, পারিবারিক বন্ধু ছিলেন, তারপর উনি আমাকে আনলেন এই জগতে এবং সত্যি ওকে ছাড়া তো আজকে আমি, আমি হতাম না। সেটা শুধু কিন্তু উনি একটা ছবিতে আমাকে ইন্ট্রোডিউস করলেন সেজন্য নয়, ধীরে ধীরে ওর সঙ্গে কাজ করার অনেকটা পরে নাইনটিন সেভেনটি সিক্স-এ উনি চেয়ারম্যান অব দ্য জুরি ছিলেন ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভালে, যেটা ইন্ডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল, সেখানে উনি আমার নাম প্রস্তাব করেছিলেন জুরি মেম্বার হিসেবে। আমি সেখানে যখন গিয়েছিলাম, তখন ওর সঙ্গে আমার গভীর একটা বন্ধুত্ব হয়। সেই বন্ধুত্বটা শেষ অবধি ছিলো।
ঋতুপর্ণ : কুরোসাওয়া, আন্তোনিওনি সবাই এসছিলেন, সেটা?
অপর্ণা : না না, সেটা নয়। সেবারে অনেকে এসছিলেন, ফ্রাঙ্ক কাপরা এসছিলেন, অসিমা এসছিলেন, অনেকেই এসছিলেন। তো সেখানটায় একটা গভীর বন্ধুত্ব হয়, কারণ আমি বলেছিলাম ওকে, তুমি আমায় ডাকলে কেনো, আমি কী বুঝি? তখন আমি অনেক ছোটো মেয়ে, ইন মাই টুয়েনটিজ। তো উনি আমায় বললেন, তুই চিতু’র সঙ্গে, চিতু মানে আমার বাবা চিদানন্দ দাশগুপ্ত, ছোট্টোবেলা থেকে ছবি দেখছিস না?
আমি বললাম, হ্যাঁ তা দেখেছি। তিনি বললেন, তাহলে আবার কী চাই? একদম রিলাক্স কর।মানে আমাকে এমন সহজ করে দিলেন এবং তার পর আমরা ছবিগুলো নিয়ে আলোচনা করতাম এবং অনেক ব্যক্তিগত কথা আমাদের হয়েছে। অনেক ছবির কথা হয়েছে, উনি ফিরে এসে ফোনে আমার সঙ্গে কথা বলতেন—কেনো উনি একটা চরিত্র আনলেন, কীভাবে আনলেন, তার অনেকগুলো চিত্রনাট্যতে সমস্যা, কীভাবে সমস্যাগুলো সমাধান করলেন। অনেক আলোচনা করতেন আমার সঙ্গে, ইন ফ্যাক্ট তার পরেই করলেন জন-অরণ্য। তো জন-অরণ্যতে আমাকে নেওয়ার কথা ছিলো না। ইন ফ্যাক্ট ঋতু যেটা এক্ষুনি বললো যে, আমাকে পরিচালক হিসেবে বলতে হবে, তার একটা বড়ো কারণ আমি প্রায় মানিক কাকার ছবিতে অভিনয়ই করিনি। আমি তো একটা মৃন্ময়ী করেছি সমাপ্তিতে, তারপর পিকুতে অভিনয় করেছিলাম। কিন্তু, তাছাড়া যে দুটো, সে দুটো তো শুধু কেমিও।
দর্শক : অরণ্যের দিনরাত্রি?
ঋতুপর্ণ : হ্যাঁ, বলছেন উনি...।
অপর্ণা : হ্যাঁ, কেমিও তো। আমি মানিক কাকাকে ঠাট্টা করে বলতাম, তুমি আমাকে স্টেপনি হিসেবে ইউজ করো; কারণ অন্য একজনের করার কথা ছিলো জন-অরণ্য, তাকে পাওয়া গেলো না, তখন আমাকে নিলেন। সমাপ্তিতেও অন্য একজনের করার কথা ছিলো, সুপ্রীতি ঠাকুর; তাকেও পাওয়া গেলো না, তখন আমাকে নিলেন।
শর্মিলা : আমারও তো অপুর সংসার-এ অন্য কাউকে মানে অলকনন্দা, না?
ঋতুপর্ণ : অলকনন্দা কাঞ্চনজঙ্গায়।
শর্মিলা : তাহলে কে ছিলো? আরেকজনকে নিয়েছিলেন, শুটিং হয়েও গেছিলো। তার পরে বসন্ত চৌধুরী...।
ঋতুপর্ণ : অলকা চৌধুরী।
শর্মিলা : সরি সরি সরি, অলকা দি।
অপর্ণা : কিন্তু অলকা দি তো লীলা করছিলেন।
মাধবী : সেটা অন্য চরিত্র।
শর্মিলা : না গো, সেটা অপুর সংসার-এই, আমি তো জানতাম। মাধবী দি’র সঙ্গে তর্ক করবো না, মাধবী দি যদি বলেন সেটা নিশ্চয়ই...।
ঋতুপর্ণ : এটা আমরা গসিপ করছি না, এটা ইতিহাস, অপুর নায়িকা অপরাজিততেই আসার কথা ছিলো। তার নাম লীলা মানে...।
অপর্ণা : লীলার জন্য অলকা দি’কে বাছা হয়েছিলো, বসন্ত চৌধুরীর স্ত্রী।
ঋতুপর্ণ : তখন বসন্ত দা অলকা চৌধুরীকে বিয়ে করবেন; তাই তিনি গাড়ি হাঁকিয়ে এসে শুটিংয়ের মাঝখান থেকে অলকা দি’কে তুলে নিয়ে গেলেন, মানে হবু স্ত্রীকে অভিনয় করতে দেবেন না বলে। ফলে লীলা বাদ পড়ে গেলো অপরাজিত থেকে এবং অপুর প্রথম নায়িকা হলেন অপর্ণা।
অপর্ণা : কিন্তু মানিক কাকা আমায় পরে কথায় কথায় বলেছিলেন, মানে যখন আমরা আড্ডা মারতাম; কথায় কথায় বলেছিলেন, একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। কারণ অপুর সঙ্গে লীলার ঠিক যে কী সম্পর্কটা হতো—সেটা খুব আনসিওর গ্রাউন্ডে আর কি; কারণ বৈবাহিক সম্পর্ক নয়, মানিক কাকার বোধ হয় সেখানে আনকমফোর্টেবল লাগছিলো, মানে মানিক কাকার কথায় আমার মনে হয়েছিলো যেটা। মানিক কাকা সবচেয়ে কমফোর্টেবল ছিলেন যেখানে বৈবাহিক সম্পর্ক, চারুলতার কথা বাদ দিলে। (দর্শকদের হাসি)
ঋতুপর্ণ : না, অনেকগুলো ছবি—চারুলতা, কাপুরুষ, ঘরে-বাইরে।
অপর্ণা : কিন্তু সেখানেও... যাক যেটা বলছিলাম, আমার প্রথম ছবির চিত্রনাট্য, আমি ভেবেছিলাম ইংরেজিতে লিখেছি, তাই কেউ কোনোদিন এটা নিয়ে ছবি করবে না, তাই এটা আমি ড্রয়ারে রেখে দিই। তারপর আমার মনে হলো, একবার মানিক কাকাকে দেখিয়ে তারপর না হয় দেরাজে তুলে রাখবো। তারপর ওকে যখন দেখালাম, উনি কিন্তু আমাকে শুধু অভিনেত্রী হিসেবে ইন্ট্রোডিউস করেছেন তা নয়, উনি ওটা না দেখলে এবং আমাকে উৎসাহ না দিলে আমার কিন্তু পরিচালক হওয়াই হতো না। উনি যখন বললেন ভালো, তখন আমার একটু বুকে বল এলো এবং উনি আমায় বলে দিলেন শশী কাপুরকে এটা পাঠাতে। সুতরাং একটা বিরাট মানে মেন্টর, এক্ষুনি শর্মিলা যেটা বললেন; আমার কাছেও উনি ভীষণভাবে মেন্টর এবং একটা অসম বয়সী বন্ধু ছিলেন; তাই জন্য আমার পক্ষে অবজেক্টিভ হওয়াটা খুব কঠিন, তবু আমি এটা মনে করি...। আমি একটু সময় নিচ্ছি (ঋতুপর্ণের দিকে তাকিয়ে)।
ঋতুপর্ণ : নিশ্চয়ই।
অপর্ণা : তবুও আমি এটা মনে করি, আমাদের সময় এসেছে যখন আমাদের ফিরে দেখা দরকার; অন্তত আমার আর ঋতুর তো বটেই। কারণ আমরা পরিচালনা করি। যেমন আপামর বাঙালি রবীন্দ্রনাথের ছায়া থেকে বের হতে পারে না, একসময় সুনীল দা প্রমুখ কবিদের প্রয়োজন হয়েছিলো রবীন্দ্রনাথকে ভেঙে বেরিয়ে আসার; আমাদের অবস্থা তেমনই হয়েছে। সত্যজিৎ রায় যেনো আমাদের রক্তে বইছেন, আমরা যেনো উত্তরাধিকার সূত্রে তাকে পেয়েছি এবং এখন আমাদের দরকার ছিলো ওকে অনুকরণ না করে ওর যা প্রভাব আছে সেটা ভিতরে যেনো সাবটেরিনিয়ান, অন্তঃসলিলাভাবে কাজ করে সেটার জন্য একটু ভেঙে বেরোনো দরকার, আর ভেঙে বেরোনোর জন্য নিরপেক্ষ হওয়া দরকার; একটু দূর থেকে দেখা, ভালো-খারাপ। আমি যদি তাকে কখনো খারাপ বলতে না পারি, তাহলে আমার শ্রদ্ধাটা অন্ধ ভক্তি এবং সেটা আমি চাই না।
ঋতুপর্ণ : নিশ্চয়ই। এবার চারুলতার (মাধবীকে ইঙ্গিত করে) কাছে আসবো। না, আমি তোমার কাছে সত্যজিৎ কী তা জানতে চাই না, তুমি আমাকে এটা বলো যে...; আমি একটা ছোট্টো ঘটনা বলি, সত্যি মাধবী মুখোপাধ্যায় কীভাবে আইকোনাইজড হয়ে গেছেন। আমি তখন বার্লিনে, দহন ছবিটা দেখানো হয়েছে। ওটা একটা নেটপ্যাক পুরস্কার মানে ওটা এশিয়ান এরিয়া থেকে পুরস্কার দেওয়া হয়, আমাকে দেওয়া হয়েছে ছবিটার জন্য। ছবিটার জন্য পুরস্কার নিতে আমি স্টেজে উঠেছি, আমার হাতে সার্টিফিকেটটা ধরানো, বাঁধানো সার্টিফিকেট, তার যে মাউন্টটা একটা গ্রে রঙের মাউন্ট মানে ছবির যে মাউন্টটা থাকে, তার ওপর নানা চরিত্রের মুখ, তার মধ্যে একটা হচ্ছে অপেরা গ্লাস হাতে মাধু দি।
তখন আমি সার্টিফিকেটটা নেবো কি, আমি দাঁড়িয়ে চারুলতাকে দেখছি, আমার পাশে ফ্রেমড হয়ে, মানে সেটাতে যে আমার সত্যি কী আনন্দ হয়েছিলো! আপনারা প্রত্যেকেই নিশ্চয় বুঝতে পারছেন বিদেশে—সেই বার্লিনে প্রথমবার ফিল্ম ফেস্টিভালে গেছি, কেউ ইংরেজি ভালো করে বলতে পারে না, সেখানে একটা বাংলার মুখ টলটল করছে হাতে অপেরা গ্লাস নিয়ে। এই মানে আমাদের বাড়ির মাধু দি, যার ওপরে আমরা সব রকমের আবদার করি এবং তিনি সহাস্য মুখে সেগুলো রাখেন। সেই মাধু দি’কে ওখানে গিয়ে নতুন করে আবিষ্কার করা এবং আমার মনে আছে এখনো, একটা অপরাজিত, তখন ভি এইচ এস দেখি আমরা, বিদেশি প্রিন্টের একটা অপরাজিত দেখেছিলাম এবং আমি নিউইয়র্ক থেকে নিয়ে এসেছিলাম। আমার সব থেকে অহঙ্কার হয়েছিলো একটা বাংলা ছবি, সত্যজিতের ছবি, আমি নিউইয়র্ক-এর একটা দোকান থেকে কিনতে পারছি।
আজকাল অবশ্য সব জায়গায় সব পাওয়া যায়, কিন্তু তখন সত্যি সেটা অন্যরকম ছিলো। মাধু দি তোমাকে আমি এটা জিজ্ঞাসা করবো যে, তুমি ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে কাজ করেছো, মৃণাল সেনের সঙ্গে কাজ করেছো, সত্যজিতের নায়িকা বলতে তোমাকেই বলা হয়, মিউজ যদি বলা হয় সেটা তুমিই; আর পূর্ণেন্দু পত্রী, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার—এমন কোনো বড়ো পরিচালক নেই, যার সঙ্গে তুমি কাজ করোনি। তোমার কাছে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনা কিংবা সত্যজিৎ রায়কে তুমি পরিচালক হিসেবে কোথায় আলাদা করবে অন্যদের থেকে? এরা প্রত্যেকেই গুণী।
মাধবী : যেমন আমাদের দেশে প্রথম দুঃখ-কষ্টের কথা বলেছেন যিনি, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি মেয়েদের যে কী দুঃখ-কষ্ট, সেই কথাটা বলেছেন। তার পর ছবিতে মেয়েদের কোথায় অবস্থান, কী করতে হবে, কী কাজ করতে হবে সেই জায়গাটা উনি (সত্যজিৎ) দেখিয়ে দিয়েছেন। কোথা থেকে শুরু করেছেন, একদম পথের পাঁচালী থেকে; সর্বজয়া, তার যে স্ট্রাগলিং, এই স্ট্রাগলিং করতে করতে অপুকে সে দাঁড় করিয়েছে এবং তারপরে শর্মিলা ঠাকুরের মতো মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে। (দর্শকদের হাসি)
অবশ্য তাতেও তো মেয়েদের স্ট্রাগলিং কমেনি কিছু। আবার আরেক রকমভাবে স্ট্রাগলিং শুরু হলো, সেটা হচ্ছে মেয়েরা কাজ করবে—এটা কিন্তু কোনো স্বামীই পছন্দ করে না, এটা সব স্বামীদের ব্যাপারেই। দেখা যায়, যদি স্বামী আর স্ত্রী দুজনে কাজ করতে গেছে, যখন ফিরে আসে, তখন কিন্তু স্বামী একটা চেয়ারের উপর সিগারেট নিয়ে স্মোক করতে থাকে আর বউ হাতটা কোনো রকমে একটু ধুয়ে চায়ের কেটলিটা বসায়। তার মানে মেয়েদের হচ্ছে রান্নাঘর, তার থেকে মেয়েরা বেরোবে না। সেই জায়গায় মেয়েদের বের করে এনেছেন সত্যজিৎ রায়। তো সেখানে আমার মনে হয়, সব মেয়েদের হয়ে বলতে হয়, তার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ; আর একটা কৃতজ্ঞতা হচ্ছে গিয়ে আমার দর্শক বন্ধুদের কাছে। তারা তখনকার ছবিও যতোটা সুন্দরভাবে দেখতেন, এখন যে ছবিগুলো হচ্ছে, মানে ফাঁন্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে, সেটাও ভালো করে দেখেন, খুব সুন্দর করে দেখেন। সে কারণে কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে পারলাম না।
ঋতুপর্ণ : (হাসতে হাসতে) মাধু দি তোমাকে আমি ফাঁন্দে পড়িয়া নিয়ে বলতে বলিনি; এখন সত্যজিৎ কোথায় আলাদা সেটা তুমি বলো?
মাধবী : আলাদা কিছু বলার নেই। আমি বলছি যে, দর্শক বন্ধুদের আমি আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এবং কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, কারণ তারা তখন মানে স্বর্ণযুগের ছবি যেমন দেখেছেন, এখন ফাঁন্দে পড়িয়া বগাও সেরকমভাবেই দেখছেন। এই যে অবস্থা, কোনো তফাত নেই; সেই তফাতের জায়গাটায় আজকে যখন একটা-দুইটা ছবি আসে, সেই ছবিটা বেশিদিন থাকে না। সেই জায়গাটায় দর্শক বন্ধুদের বলি, তারা যদি একটু সাহায্য করেন, সেই ছবিগুলো যদি দেখেন, তাহলে আমার মনে হয়, আবার আমরা সেই স্বর্ণযুগটা ফিরে পেতে পারি। আমরা সেই স্বর্ণযুগে সবাই যেতে চাই।
সত্যজিৎ রায় সম্বন্ধে বলি, প্রথম উনি দেখালেন যে, ছবিটা একসময় শুধু সাইলেন্ট পিকচার্স ছিলো, তখন কথা ছিলো না। তারপর কথা আসলো, যখন কথা আসলো তখন কথার বাড়াবাড়ি চললো, কিন্তু আবার উনি ওটাই ফিরিয়ে দিলেন—ছবিটা কথা বলার নয়, ছবিটা দেখার। আমরা যেটা বলতাম আগে—ছবি দেখতে যাবো মানে বই দেখতে যাবো, তারপর বই দেখতে যাবো মানে একটা বই পড়া হলো; আসলে না পড়ে দেখা। এই যে দেখার জায়গাটা উনি প্রথম থেকে মানে পথের পাঁচালী থেকে শুরু করলেন। এবং সেই থেকে আমাদের দেখার বাসনাটা বেড়ে গেলো। তো আজকেও আমরা দেখছি, কিন্তু আমাদের বাঙালি কালচার কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে, যে রুটটা সেই রুটটা কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে।
সত্যজিৎ রায় অনেক ইংরেজি ছবি দেখেছেন, অনেক রকমের ছবি দেখেছেন। কিন্তু কখনো ওই জায়গাটা ভোলেননি যে, তার রুটটা কোথায়। আমরা কিন্তু আজকে ভুলে গেছি আমাদের রুটটা কোথায়। সেই জন্য আপনাদের কাছে অনুরোধ করি, যারা রুটওয়ালা ছবিগুলো করেন যেমন অপর্ণা সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ আরো অনেকে আছেন যারা ভালো ছবি করেন; আপনারা যদি তাদের উৎসাহ দেন তাহলে আমার মনে হয় সবচেয়ে ভালো হয়।
ঋতুপর্ণ : কিন্তু মাধু দি, এখন কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের ছবির ডিভিডিও অনেক বেশি বিক্রি হয় আগের থেকে। তখন সত্যজিৎ রায়কে বলা হতো যে, তিনি প্যারালাল ছবি বানান, সেই ছবিগুলো যে খুব দর্শক আনুকূল্য পেয়েছিলো তা নয়।
অপর্ণা : কিন্তু মানিক কাকার সমস্ত ছবি, মানিক কাকা নিজেই বলেছেন, ‘আমার একটা ছয় সপ্তাহের অডিয়েন্স এনসিউরড’—এটা কিন্তু ছিলো।
শর্মিলা : এখনো মানিক দা’র ছবি যেমন চারুলতা, যেমন অপু ট্রিলজি আর অরণ্যের দিনরাত্রি—এগুলো তো ভীষণভাবে চলে। যেখানেই আমি গেছি, আমি কলকাতার ব্যাপার জানি না, কিন্তু বাইরে ওয়াশিংটন, প্যারিস, লসএঞ্জেলস—হয়্যারএভার ইট ইজ স্ক্রিন্ড মানে একেবারে এতো ভিড় হয়; আর ওই সেই জায়গাতে অরণ্যের দিনরাত্রিতে রবি দা যে কী ভীষণভাবে অ্যাপ্রিশিয়েট হচ্ছে! মানে ইমাজিন, হাউ ম্যানি ইয়ারস মানে ছবিটা করবার এতো বছর পরে, অ্যাগ্জ্যাক্টলি যেখানে দুর্গা ট্রেনের আওয়াজ শুনছে বা বৃষ্টিতে ভিজছে বা চারুলতার প্রথম সিনটা যেটা, তুমি (মাধবী মুখোপাধ্যায়কে লক্ষ্য করে) দোলনায় দুলছো।
মাধবী : দুরবিন দিয়ে দেখছি।
শর্মিলা : দুরবিন দিয়ে যেটা দেখছো, তারপর তোমার ওই ভীষণ...।
মাধবী : এখন প্রশ্ন, এই দুরবিন দেখা কেনো? তখনকার দিনে স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর সম্পর্ক ছিলো গুরু-শিষ্যের যেমন সম্পর্ক তেমন। স্বামীর সঙ্গে তার এতো দূরত্ব ছিলো, সেই দূরত্বের জন্য তাকে অপেরা গ্লাস দিয়ে দেখতে হয়েছে।
শর্মিলা : সেটা তো তুমি বিষয় নিয়ে কথা বলছো। কিন্তু আমি বলছি, ওনার সিনেমার ক্রাফ্ট যেটা, সেটা কী ভীষণভাবে অ্যাপ্রিশিয়েট করছে, এখনো পুরনো হয়নি, এখনো ভীষণ কনটেম্পোরারি রয়েছে।
ঋতুপর্ণ : আমরা বোধ হয় মেইন জায়গা থেকে সরে যাচ্ছি, নারীর জগতে সত্যজিৎ রায়। আমরা যদি প্রথম ছবিটা ধরি, পথের পাঁচালী, সেটা একটা পরিবারকে নিয়ে। সেই পরিবারের তিনজন খুব ইম্পর্টেন্ট মহিলা হচ্ছেন ইন্দির ঠাকরুণ, সর্বজয়া আর দুর্গা। সর্বজয়া ও ইন্দির ঠাকরুণের মধ্যে সম্পর্কটা মানে একজন গলগ্রহে থাকা ননদ, যার কোথাও যাবার জায়গা নেই, তিনি একজন দরিদ্রের সংসার জুড়ে বসে আছেন। এবং সর্বজয়ার ভিতরে যে নিষ্ঠুরতা, স্বাভাবিক নিষ্ঠুরতা, সেটা কোথাও আড়াল করা হয় না। আমার যেটা মনে হয়, পরের দিকে সত্যজিতের ছবিতে যে সতর্কতাগুলো এসেছে তাতে মনে হয়েছে, ওই ছবিটা অসতর্ক। যে দুর্গা একটা পুঁতির মালা চুরি করলো, প্রধান চরিত্র কিন্তু সেটা অ্যালাউ করলো এবং অপু আবার পরে সেটাকে ফেলে দিলে সেটা পানা-পুকুরে ঢেকে যায়। এই যে অলঙ্কারের প্রতি আসক্তি, এটা যখন ‘মণিহারা’য় গিয়ে দেখি আমরা, তখন সেটা একটা অন্যরকম চেহারা পায়, কিন্তু এখানে একটা গ্রাম্য বালিকার যে পুঁতির মালার প্রতি লোভ এবং সেই লোভটা যে অত্যন্ত বৈধ...।
অপর্ণা : স্বাভাবিক।
ঋতুপর্ণ : ছবিটা যেনো এই বৈধতাটা দেয় ওকে। অপু যখন পুঁতির মালাটা খুঁজে পায় তখন তো আমার সাইকোর গাড়ি ডুবে যাওয়ার কথা মনে পড়ে। কোনটা থেকে কোনটা ইনফ্লুয়েন্সড, বুঝতে পারি না। সাইকোতে আমরা যেমন অলমোস্ট চাই গাড়িটা ডুবে যাক, এটা যেনো কেউ দেখতে না পারে, ঠিক সেইভাবে এটাও পানা-পুকুরে যেনো ডুবে যায়। তারপরে সর্বজয়া আর ইন্দির ঠাকরুণের সম্পর্কের মধ্যে একটা অপূর্ব মর্মস্পর্শী জায়গা আছে যেখানে ইন্দির ঠাকরুণ বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছেন, মানে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রায়, সেই সময় সর্বজয়ার একটা কাশির দমক ওঠে, তিনি বলতে বলতে কাশছেন; তারই মধ্যে ইন্দির ঠাকরুণ আবার সর্বজয়ার পিঠে হাত বোলাচ্ছেন, মানে যাকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এটার একটা রেজিমেন্স আমি অনেক পরে পেয়েছিলাম রীনা দি’র (অপর্ণার ডাক নাম) পরমায়। যেখানে পরমা মানে রাখি গুলজার যে চরিত্রটা, সেখানে শিলা যে চরিত্রটা রীনা দি করেন, তার কাছে গিয়ে টাকা চায় এবং হাতের বালাটা রেখে আসে এবং শিলা সেটা নেয়, এতখানি সম্মান বন্ধুত্বটাকে দেয়—এই দুজনের সম্পর্কে। মহিলাদের নিজেদের মধ্যে সম্মান বিনিময়ের যে একটা নম্রতা আছে এবং একটা অন্য ডিগনিটি আছে, সেই ডিগনিটিটাকে পোর্ট্রে করা ওইখান থেকেই বোধ হয়। আমি জানি না, রীনা দি ওই দৃশ্য থেকে ইন্সপায়ার্ড হয়ে করেছেন কি না?
অপর্ণা : এগুলো এতো ভেতরে থাকে না যে, এগুলো পরে অ্যানালাইজ করা যায় না। আর আমি না অ্যানালাইজ করতেও চাই না যে, কোথা থেকে কী প্রভাব এসছে; কারণ সেটার যে একটা ম্যাজিক থাকে সেটা চলে যায়। মানে ক্রিয়েটিভিটির একটা ম্যাজিক থাকে না, প্রত্যেকটা জিনিস যদি বিশ্লেষণ করা যায়, কোথা থেকে কী পেয়েছি—এটা আমার ইচ্ছে করে না করতে। (চলবে)
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন