মো. খালিদ হাসান
প্রকাশিত ১৭ জানুয়ারী ২০২৩ ১২:০০ মিনিট
অন্যকে জানাতে পারেন:
বার্লিন উৎসব : সদা জাগ্রত এক ভালুকের গল্প
মো. খালিদ হাসান

চারদিক স্তব্ধ। যেদিকে চোখ যায় শুধু ভাঙা দেয়াল, বিধ্বস্ত গাড়ি, রাস্তায় কাঁচের টুকরা আর ছোপ ছোপ রক্ত। বাতাসে হাজারো মানুষের লাশ আর বুলেটের বিকট কালো গন্ধ। বিশ্বযুদ্ধের তাণ্ডবলীলা যেনো সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে গেছে। কিন্তু এর মাঝেও একটা ভালুক যেনো আপন মনে খেলা করছে। তার যেনো কোনো ভয় নেই। ওরা বলে, এই ভালুকটা নাকি শীতকালেও ঘুমায় না—ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে উঠে আসা জার্মানির প্রাণ—বার্লিন এটি। জার্মানদের প্রাণের প্রতীক এই ভালুক; এর মতোই তারা সদা চঞ্চল, জাগ্রত আর চির প্রত্যয়ী। ধ্বংসকে বলি দিয়ে এরাই তিল তিল করে গড়ে তুলেছে তাদের প্রাণের এই শহরকে, আর এতো কিছুর মধ্যেও ভালোবেসেছে চলচ্চিত্রকে। আর সেই ভালোবাসার প্রতিদান দিতেই হয়তো প্রতিবছর সারাবিশ্বের নামি-দামি তারকাদের পদধূলিতে মুখরিত হয় এই বার্লিন।
সেই ১৯৭৮ সাল থেকে নিয়মিত এখানে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ উৎসব, বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব। আর ওই ভালুকই এই উৎসবের প্রতীক। মূলত ১৯৫১ সালে বার্লিনে এ উৎসবের শুরু। তারপর বার্লিনকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বিশ্বের অন্যান্য চলচ্চিত্র উৎসবের তুলনায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দর্শকের উপস্থিতি পাওয়া যায় এখানে। প্রতিবছর টিকিট বিক্রি হয় তিন লাখেরও বেশি।
আঁধার কাটিয়া আসিয়াছে
ধ্রুব জ্যোতির্ময়
সময়টা জার্মানদের জেগে ওঠার, সাল ১৯৫১। জার্মানের বুকের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধের ঝড়। আর রাজধানী বার্লিন তো রীতিমতো ধ্বংসস্তুপ। তখন জার্মানিতে প্রায় ২০ লাখ মানুষ বেকার এবং হাজার হাজার গৃহহারা। এর মধ্যে চলচ্চিত্র উৎসব! কিন্তু বিশ্বকে তাক লাগিয়ে জার্মানরা যেনো নির্মাণ করলো এক নতুন ইতিহাস। সবকিছু ঘুচে পূর্বের ঐতিহ্যে ফিরে যাওয়ার পথ হিসেবে এমন একটি বিষয়ের কথা সর্বপ্রথম ভাবলেন অস্কার মার্টে। পেশায় তিনি ছিলেন আমেরিকান ফিল্ম অফিসার। ব্রিটিশ সহকর্মী জর্জ টার্নারকে তার এই পরিকল্পনার কথা প্রথম জানান তিনি। এরপর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে পরে জার্মান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির দুইজন প্রতিনিধি ও একজন সাংবাদিককে নিয়ে প্রাথমিক একটি কমিটি করে আলোচনার আয়োজন করেন। সেই আলোচনায় উৎসব নিয়ে সবাই আগ্রহ প্রকাশ করে এবং ১৯৫১ সালের ৬ জুন বার্লিনে চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়। সর্বসম্মতিক্রমে নতুন এই উৎসবের নামকরণ হয় বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল বা বার্লিনাল।
৬ জুন প্রথম উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুটাই ছিলো আলফ্রেড হিচকক-এর বিখ্যাত চলচ্চিত্র রেবেকা প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে। এই রেবেকার কেন্দ্রীয় চরিত্রের অভিনেতা জন ফনটেইন ছিলেন উৎসবের প্রধান অতিথি; আর উৎসব পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ড. আলফ্রেড বোয়ার (চলচ্চিত্র ইতিহাসবিদ)। শুরু থেকেই এই উৎসবে পুরস্কারের ব্যবস্থা ছিলো। বিষয়ভিত্তিতে কাহিনীচিত্র, হাস্যরসাত্মক, সঙ্গীতনির্ভর, ক্রাইম ও অ্যাডভেঞ্চার এবং তথ্যচিত্র—এই পাঁচটি বিভাগে পুরস্কার দেওয়া হয়। টানা ১২ দিন পর ১৭ জুন শেষ হয় প্রথম আন্তর্জাতিক বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব। তবে এ কথা ঠিক, দুটো বিশ্বযুদ্ধের তাণ্ডবকে তুচ্ছ করে এতো সফলভাবে জার্মানদের এই আয়োজন আজও সারাবিশ্বের কাছে এক অজানা রহস্যই হয়ে আছে।
শুরুটা ভালো হলেও তা বেশি দিন ভালো থাকেনি। ১৯৬১ সালে জার্মানিকে বিভক্ত করা হয় দুই ভাগে, সবচেয়ে বেশি বিভক্তির মধ্যে পড়ে বার্লিন। রাজনীতি নামক ভয়াল কুঠার দিয়ে একই জাতি, একই সংস্কৃতি, খাদ্য-রুজি আর একই ভাষা দুই ভাগ হয়ে যায়। সীমানার মাঝে দাঁড় করানো একটি দেয়ালই বদলে দেয় পুরো জার্মানিকে।
সত্যি কথা বলতে কি—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর মানচিত্র থেকে যেনো জার্মানি শব্দটিই প্রায় উঠে গিয়েছিলো। জার্মান জাতি ছিলো শুধুই নামে। এই সুযোগে পরাশক্তি আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এক অর্থে ভাগাভাগি করে নেয় দেশটিকে। কংক্রিটের বিভক্তি-দেয়ালের পশ্চিমপাশ যায় পশ্চিমা দেশগুলোর দখলে। সেখানে বেড়ে ওঠে ধনতন্ত্র আর পূর্ব প্রান্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলে এসে সমাজতন্ত্র গড়ে ওঠে। একপাশে চলে সম্পত্তি বাড়াবার প্রতিযোগিতা, লোভ, হিংসা আর যৌনতার নামে চূড়ান্ত ব্যক্তি স্বাধীনতার যথেচ্ছ ব্যবহার। আর অন্যপাশে মুনাফা ও পুঁজিবাদের বিলোপসাধন করে খাদ্য ও বাসস্থানের সমবায় সৃষ্টি।
জার্মানির দুই প্রান্তে তখন অদৃশ্য এক যুদ্ধ। একপর্যায়ে পরিস্থিতি এমন যে, সবধরনের যোগাযোগ ও চলাচল পর্যন্ত বন্ধ। পূর্ব ইউরোপের প্রায় পুরোটাই সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলে। ফলে পূর্ব ইউরোপের কোনো চলচ্চিত্রই রাখা হতো না পশ্চিমের এই উৎসবে। এ কারণে তারা উৎসবেও অংশগ্রহণ করতে পারতো না। এসব মিলে বার্লিন উৎসবের জৌলুস যেনো দিন দিন হারিয়ে যেতে থাকে, সঙ্গে কমতে থাকে দর্শকসংখ্যাও। এমতাবস্থায় উৎসবকে টিকে রাখতে কর্তৃপক্ষকে বিকল্প অর্থায়নের কথা ভাবতে হয়। তবে নিজেদের এই অর্থনৈতিক সঙ্কটাবস্থা কাটাতে এগিয়ে আসে স্বয়ং পশ্চিম জার্মানি সরকার। ফলাফলও আসে দ্রুত; ১৯৫৬ সালের বার্লিন উৎসব ‘এ’ স্ট্যাটাস (প্রথম শ্রেণির চলচ্চিত্র উৎসবের মর্যাদা) লাভ করে । সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটা, একই বছর উৎসব কর্তৃপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়নকে উৎসবে আমন্ত্রণ জানিয়ে বসে। আশার কথা, সোভিয়েত ইউনিয়নও সেই আমন্ত্রণকে গ্রহণ করে উৎসবে যোগ দেয়। আর এর মধ্য দিয়ে অঘোষিতভাবেই যেনো ঘুচে যেতে থাকে দুই দেশের সীমানার কাঁটাতার।
এরপর অবশ্য ৯০ দশকে দুই জার্মানির স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে, ভেঙে দেওয়া হয় প্রাচীর। সবকিছুর সঙ্গে বার্লিন উৎসবে ফিরতে থাকে পূর্ণতা।
দূরে কার শোনা যায় বাঁশি
কাকে খুঁজি, কাকে ভালোবাসি
প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে বার্লিন শহর যেনো নতুন সাজে সজ্জিত হয়। চারিদিকে আলোর পসরা। বার্লিনালের ভালুকটি দেখার জন্য সারাবিশ্বের মানুষ জমতে থাকে। রাস্তায় থাকে হাজারো মানুষের ঢল। নানা দেশ-জাতি-ধর্ম-বর্ণ সব শ্রেণির মানুষের মিলনস্থল হয়ে ওঠে বার্লিন।
উৎসবের সাতটি বিভাগে প্রতিবছর সারাবিশ্ব থেকে প্রায় চারশোর মতো চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর জন্য নির্বাচন করা হয়। চলচ্চিত্র বাছাই করার ক্ষেত্রে সাধারণত তিনটি পদ্ধতি অবলম্বন করে কর্তৃপক্ষ। প্রথমত, অঞ্চল ভাগ করে প্রত্যেকটির জন্য বার্লিন উৎসব থেকে একজন করে প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা নির্দিষ্ট ওই অঞ্চলের চলচ্চিত্র ও নির্মাতাদের সম্পর্কে নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ করে। এছাড়াও তারা ওই সব অঞ্চলের স্থানীয় সব চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিয়ে বিভিন্ন দিক বিবেচনায় বার্লিন উৎসবের জন্য চলচ্চিত্র নির্বাচন করে। বাছাইয়ের দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটি করা হয় কেন্দ্রীয়ভাবে। এর নেতৃত্বে থাকেন উৎসব পরিচালক নিজেই। তার নেতৃত্বে উৎসবের কেন্দ্রীয় একটি দল টরেন্টো, কান, ভেনিস, সানড্যান্সসহ পৃথিবীর বিখ্যাত সব চলচ্চিত্র উৎসব ভ্রমণ করেন। আর ওই উৎসবগুলোতে প্রদর্শিত চলচ্চিত্র থেকে সেরা কয়েকটি নির্বাচন করেন।
আর চলচ্চিত্র নির্বাচনের তৃতীয় ধারাটি চলে বছরব্যাপী। বার্লিনালের ওয়েবসাইটে ঘোষিত একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সারাবিশ্বের যেকোনো নির্মাতা এখানে তার চলচ্চিত্র জমা দিতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় সারাবিশ্ব থেকে হাজার হাজার চলচ্চিত্র জমা পড়ে। এরপর এগুলো থেকে যাচাই-বাছাই করে কিছু সংখ্যক চলচ্চিত্র উৎসবের জন্য নির্বাচন করেন বিখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতাদের নিয়ে গঠিত একটি দল।
উৎসবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘কম্পিটিশন’ বিভাগ। এ বিভাগটি নিয়েই যতো জল্পনা-কল্পনা। কারণ, এ বিভাগটিতে অংশ নেয় জার্মানির বাইরের বাছাইকৃত বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলো। এখানে মোটামুটি কুড়িটির মতো চলচ্চিত্র নির্বাচন করা হয়। ভেনিসের ‘গোল্ডেন লায়ন’, কানের ‘পাম’-এর মতো বার্লিনালের রয়েছে ‘গোল্ডেন বিয়ার’ পুরস্কার। এটিই উৎসবের সবচেয়ে সম্মানীয় ও সর্বোচ্চ পুরস্কার। ‘গোল্ডেন বিয়ার’ দেওয়া হয় উৎসবের সেরা চলচ্চিত্রটিকে। পুরস্কারটি দেওয়ার প্রচলন সেই ১৯৫১ সাল থেকেই। এছাড়াও ১৯৮২ সাল থেকে প্রতিবছর চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট একজনকে আজীবন সম্মাননা হিসেবে সম্মানসূচক ‘গোল্ডেন বিয়ার’ পুরস্কার দেওয়া হয়।
এরপর ‘সিলভার বিয়ার’ নামে আরেকটি পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়। পরিচালনা, অভিনয় ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে আলাদা অবদানের জন্য এই পুরস্কারটি দেওয়া হয়। মানের ভিত্তিতে এটির অবস্থান ‘গোল্ডেন বিয়ার’-এর ঠিক পরেই। এটির প্রচলন ১৯৫৬-তে। তবে ১৯৬৫ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত এটিকে ‘স্পেশাল জুরি প্রাইজ’ নামে ডাকা হতো; পরে ২০০০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে ‘জুরি গ্র্যান্ড প্রিক্স’ করা হয়।
পরবর্তী সময়ে এসে আরো কিছু পুরস্কার উৎসবে যোগ হয়। যেমন, ১৯৭৮ সালে আউটস্ট্যান্ডিং আর্টিস্টিক অ্যাচিভমেন্ট (Outstanding Artistic Achievement), ২০০২ সালে বেস্ট ফিল্ম অব মিউজিক এবং ২০০৮ সালে সেরা চিত্রনাট্য (Best Screenplay)পুরস্কার।
উৎসবে তরুণ চলচ্চিত্রকারদের জন্য রয়েছে ‘ফোরাম’ নামের একটি বিভাগ। এ বিভাগে সারাবিশ্ব থেকে নির্বাচিত কিছু গবেষণামূলক চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। মজার বিষয় হলো—এ বিভাগের চলচ্চিত্রগুলোর জন্য কোনো বিধি-নিষেধ অর্থাৎ কোনো শর্ত প্রযোজ্য থাকে না। তবে এ বিভাগের চলচ্চিত্রগুলো কোনো পুরস্কারের জন্য প্রতিযোগিতা করে না। উৎসবের আরেকটি আকর্ষণের জায়গা হচ্ছে ‘জেনারেশন’ বিভাগ। এ বিভাগটি গড়ে উঠেছে শুধু শিশু-কিশোরদের জন্য নির্মিত চলচ্চিত্র দিয়ে। এখানে রয়েছে দুটি উপ-বিভাগ। প্রথমটি হচ্ছে ‘জেনারেশন কে-প্লাস’। যেখানে থাকে নির্বাচিত এমন কিছু চলচ্চিত্র যেগুলো নির্মাণ করা হয়েছে শিশুদের জন্য (৪ থেকে অনুর্ধ্ব ১৪ বছর) আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ‘জেনারেশন ফোর্টিন-প্লাস’। এ উপ-বিভাগটিতে থাকছে কিশোরদের (১৪ থেকে অনুর্ধ্ব ১৮ বছর) জন্য নির্মিত চলচ্চিত্র। আর এ বিভাগের যারা জুরি অর্থাৎ নির্বাচক তাদেরও কিন্তু রয়েছে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন বিভাগ—চিলড্রেন জুরি, ইয়্যুথ জুরি ও ইন্টারন্যাশনাল জুরি। এ বিভাগে সেরা চলচ্চিত্রের জন্য পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় ‘ক্রিস্টাল বিয়ার’। বার্লিনালের রয়েছে একটি ব্যতিক্রমধর্মী বিভাগ ‘প্যানোরোমা’। এ বিভাগে যেসব চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয় সেগুলোর বিষয়বস্তু সাধারণত প্রচলিত ধারার বাইরে। যেগুলো বরাবরই কোনো না কোনো আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে, যেমন : পুরুষ সমকামী (Gay), মহিলা সমকামী (Lesbian), লিঙ্গ পরিবর্তন (Transgender) ইত্যাদি।
ভাবছেন, এতো সব আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের মধ্যে জার্মান চলচ্চিত্র বোধ হয় হারিয়েই গেলো! চিন্তার কারণ নেই, নিজস্ব সংস্কৃতির জানান দিতে রয়েছে ‘পার্স্পেকটিভ ডয়েচেজ কিনো’ (Perspektiv Deutsches Kino) নামের একটি বিভাগ। জার্মান চলচ্চিত্রের সমসাময়িক যে ধারা প্রচলিত রয়েছে, সেগুলোই মূলত এ বিভাগে তুলে ধরা হয়।
এ-তো গেলো পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের বিভাগ নিয়ে কথা। মনে হতে পারে বার্লিনে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জন্য হয়তো কোনো জায়গা নেই। কিন্তু না; স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের রয়েছে ‘বার্লিনাল শর্টস’ নামে আলাদা একটি বিভাগ। আগেই বলেছি স্বল্পদৈর্ঘ্য সেরা চলচ্চিত্রের জন্যও রয়েছে ‘সিলভার বিয়ার’। আর ‘রিট্রোস্পেকটিভ’ বিভাগে সবগুলো বিভাগে প্রদর্শিত চলচ্চিত্রের মধ্য থেকে ক্ল্যাসিকাল কয়েকটি প্রদর্শনের জন্য বেছে নেওয়া হয়।
এতো সব বিভাগের বাইরে রয়েছে ‘বার্লিনাল ট্যালেন্ট ক্যাম্পাস’। সারাবিশ্বে চলচ্চিত্রের তরুণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে আয়োজন করা হয় এই কর্মসূচির। ট্যালেন্ট ক্যাম্পাস মূলত বার্লিনের একটি শীতকালীন চলচ্চিত্র স্কুল। ২০০৩ সালে বার্লিনালের সঙ্গে চুক্তি হয় এবং একে উৎসবের আওতায় আনা হয়। এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারে ৩৫০ জন শিক্ষার্থী। সাত দিন ধরে চলা এই কর্মসূচির মধ্যে থাকে চলচ্চিত্রের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মুক্ত আলোচনা ও বিশেষজ্ঞদের নানা গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা; পাশাপাশি রয়েছে প্রশিক্ষণ, কর্মশালা ও মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন বাস্তব অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করার সুযোগ। এছাড়াও অন্যান্য উৎসবের মতো চলচ্চিত্র বাজার তো রয়েছেই।
বার্লিনের মূল উৎসব প্রাঙ্গণের নাম হচ্ছে ‘পোস্ডামার প্লাৎজ’ (Potsdamer Platz)। তবে চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী চলে বার্লিনের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিখ্যাত সব প্রেক্ষাগৃহে। তবে ‘পোস্ডামার প্লাৎজ’ নিয়ে দু-একটি কথা না বললেই নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটি ছিলো ব্যস্ত চৌরাস্তা, কিন্তু এর নিচেই ছিলো হিটলারের গুপ্ত বাঙ্কার। যেখান থেকেই তিনি চালিয়েছিলেন বিশ্বব্যাপী ধ্বংসযজ্ঞ। আর কথিত আছে, এখানেই পরাজয় না মেনে নিয়ে নিজেই নিজের মাথায় গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন হিটলার। যাই হোক, উৎসবের জন্য নির্ধারিত এই প্রাঙ্গণটি মূলত উৎসব চলাকালীন অর্থাৎ ১০ দিনের জন্য ভিন্ন রূপ পায়। এখানে নির্মাণ করা হয় ‘The Haus der Kulturen der Welt and the Haus der Berliner Festspiele’ নামে বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো চলচ্চিত্র উৎসব মঞ্চ।
নাবিক, আজো আলোয় আলোকময়
২০১৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বসেছিলো বার্লিনালের ৬৩তম আসর। বার্লিন উৎসবের একটি অন্যতম দিক হচ্ছে প্রতিবছর উৎসবে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পূর্ব ইউরোপের মানুষদের তুলে আনা হয়েছে এবারের উৎসবে। মূলত বিশেষভাবে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে পূর্ব ইউরোপের নারী জীবনের ওপর। এ নিয়ে উৎসব পরিচালক ডিয়েটার কসলিক-এর বক্তব্যটা এ রকম, ‘এবারের উৎসবের বেশিরভাগ চলচ্চিত্রেই নারীরা প্রধান ও কেন্দ্রীয় ভূমিকায় ছিলো। অধিকাংশ চলচ্চিত্রের নির্মাতারাও ছিলেন নারী।’ এ রকম বিষয় নির্ধারণের অন্য একটি কারণও অবশ্য আছে, ২০১২ সালের কান উৎসবে পাম পুরস্কারের জন্য মনোনীত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে একজনও নারী নির্মাতা ছিলো না। বিষয়টি সেসময় অত্যন্ত সমালোচনার মুখে পড়েছিলো।
বার্লিনে ২০১৩ সালের উৎসবের উদ্বোধনী চলচ্চিত্র ছিলো হংকং-এর বিখ্যাত নির্মাতা ওং কার-ওয়াই-এর দ্য গ্র্যান্ডমাস্টার। তিনি ছিলেন এবারের উৎসবের জুরি বোর্ডেরও প্রধান। আর ১৬ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করা হয় ‘গোল্ডেন বিয়ার’ পুরস্কার। রোমানিয়ান চলচ্চিত্রনির্মাতা ক্লেইন পিটার নেজার-এর চাইল্ড’স পোজ জিতে নেয় এ পুরস্কারটি। এটিও নারী প্রধান চলচ্চিত্র। আর ‘সিলভার বিয়ার’ পুরস্কার জিতে নেয় বসনিয়ান নির্মাতা ডেনিস ট্যানোভিচ-এর অ্যান এপিসোড ইন দ্য লাইফ অব অ্যান আয়রন পিকার। ডেনিস ট্যানোভিচ মূলত তার অস্কার জয়ী চলচ্চিত্র নো ম্যানস্ ল্যান্ড-এর জন্য বিখ্যাত। এছাড়া শিশুদের জন্য নির্মিত ‘গ্লোরিয়া’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে সেরা অভিনেত্রী হিসেবে সিলভার বিয়ার জেতেন চিলির বিখ্যাত অভিনেত্রী পলনিয়া গারসিয়া। আর সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান বসনিয়ার নাজিফ মুজিক। উৎসবে মোট চারশো চারটি চলচ্চিত্র প্রদর্শন হয়।
লেখক : মো. খালিদ হাসান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।
Khalidj78@gmail.com
তথ্য সহায়িকা
১. বার্লিন ও চলচ্চিত্র উৎসব বিষয়ক বিভিন্ন ওয়েবসাইট।
২. গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল (বাংলা ১৪১৬); ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ; আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।
বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৪ সালের জানুয়ারির ম্যাজিক লণ্ঠনের ষষ্ঠ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন